দক্ষিন এশিয়ার আহলেহাদীছ আন্দোলন
প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব 575 বার পঠিত
আধুনিক যুগ : ৩য় পর্যায় (ক)
دور الجديد : المرحلة الثالثة (الف)
মিয়াঁ নাযীর হুসাইন দেহলভী (السيد نذير حسين الدهلوى)
সাহসোয়ান : মাওলানা আমীর হাসান। ইনি মিয়াঁ ছাহেবের নিকটতম সেরা ছাত্রদের অন্যতম ছিলেন। তাঁদের মধ্যে পিতা-পুত্রের ন্যায় মধুর সর্ম্পক ছিল। শেষ বয়সেও তিনি মিয়াঁ ছাহেবের কথা দুঃখ ও আফসোসের সঙ্গে স্মরণ করতেন। ‘মি‘য়ারুল হক’-এর সমর্থনে একদিনেই তিনি براهين اثنا عشر নামক ১২টি দলীলসমৃদ্ধ বিখ্যাত পুস্তিকা রচনা ও প্রকাশ করেন। ২। শামসুল ওলামা মাওলানা আমীর আহমাদ। ইনি মাওলানা আমীর হাসানের পুত্র ছিলেন। মিয়াঁ ছাহেবকে ‘দাদাজী’ বলে ডাকতেন। মিয়াঁ ছাহেবের তিনি খুবই আদরের ছিলেন। আগ্রাতে একটি মাদরাসার মুদাররিস ছিলেন। কিন্তু মিয়াঁ ছাহেবকে দেখতে প্রায়ই দিল্লী আসতেন। তিনি তীক্ষ্ণধী ও মেধাবী ছিলেন, যার তুলনা বিরল ছিল। ছিহাহ সিত্তাহ্ বিশেষ করে ছহীহায়েন-এর অধিকাংশ তিনি সনদসহ মুখস্ত বলতেন। একই সাথে মান্তেক ও ফাল্সাফার প্রতিও আকর্ষণ ছিল। লেবাস-পোষাক খাছ দিল্লীওয়ালাদের মতই ছিল ৩। মাওলানা মুহাম্মাদ বাশীর (১২৫০-১৩২৬/১৮৩৪-১৯০৮)। এই খ্যাতনামা আহলেহাদীছ আলেম ইল্মে হাদীছে পারদর্শী হওয়ার সাথে সাথে আরবী সাহিত্যে খুবই দক্ষ ছিলেন। মিয়াঁ ছাহেবের ছাত্রদের অন্যতম ছিলেন। মিয়াঁ ছাহেবের মৃত্যুর পরে তিনিই তাঁর স্থালাভিষিক্ত হয়ে দরস জারি রাখেন। ইতিপূর্বে তিনি ভূপালে ছিলেন। মাওলানা আব্দুল হাই লাক্ষ্মৌবী (১২৬৪-১৩০৪/১৮৪৮-১৮৮৬)-এর সঙ্গে তাঁর লেখনীযুদ্ধ চলতো। মিয়াঁ ছাহেবের পরামর্শক্রমে তিনি আরবদেশ হ'তে আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আহমাদ হাম্বলী (মৃঃ ৭৪৪ হিঃ) রচিত প্রসিদ্ধ গ্রন্থالصارم المنكي في الرد علي السبكي বইটি আনিয়ে নেন এবং তার সাহায্যে মাওলানা আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌবীকে পরাভূত করেন। শিরকের বিরুদ্ধেصيانة الأناس নামে তিনি আরবী ভাষায় বৃহৎ কলেবরের একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর ছাত্র সংখ্যাও ছিল অনেক। ৪। মৌলবী হাকীম বাদরুল হাসান ও তাঁর পুত্র আখতার হাসান সহ মোট ৭ জনের নাম উল্লেখিত হয়েছে।
গাযীপুর : হাফেয আব্দুল্লাহ গাযীপুরী (১২৬০-১৩৩৭/১৮৪৪-১৯১৮)। ইনি ‘উস্তাযুল আসাতিযাহ’ বা শিক্ষককুলের শিক্ষক উপাধিতে ভূষিত ছিলেন। তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ উস্তাযগণের একটি বিরাট অংশ তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলেন। ডাক্তারী তাঁর পেশা ছিল। ফলে বহু ডাক্তার তাঁর ছাত্র ছিলেন। তিনি নিজে তো খ্যাতনামা আলেম ছিলেন, তাঁর মেয়েরাও যোগ্য আলেমা ছিলেন। তাঁর দুই ভাগ্নে হাফেয আব্দুর রহমান বাক্বা ও হাফেয আব্দুল মান্নান অফা প্রসিদ্ধ আলেম ছিলেন। এতদ্ব্যতীত মৌলবী আব্দুল আযীয হুজরীআবাদী গাযীপুরের অন্যতম প্রসিদ্ধ আলেম ছিলেন।
শাহজাহানপুর : মৌলবী আবু ইয়াহ্ইয়া মুহাম্মাদ শাহজাহানপুরী (মৃঃ ১৩৩৮/১৯২০)। তাক্বলীদ ও ইজতিহাদ বিষয়ে তাঁর লিখিত ‘আল-ইরশাদ’ নামক উর্দূ বইটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম জীবনে কঠোর মুকাল্লিদ ছিলেন। পরে আহলেহাদীছ আন্দোলনে বিশেষ অবদান রাখেন। এতদসহ মোট ৫ জনের নাম উল্লেখিত হয়েছে।
লাক্ষ্মৌ ও অযোধ্যা : মৌলবী আব্দুল হালীম শারার (১২৭৮-১৩৪৫/১৮৬০-১৯২৬) (খ্যাতনামা সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক) ২। মৌলবী বদীউয্যামান বিন মসীহুয্যামান (মৃঃ ১৩০৪ হিঃ)। ইনি মুওয়াত্ত্বা ও তিরমিযী শরীফের অনুবাদক এবং কুরআন শরীফের বিষয়বসুও সমূহের তালিকাা প্রস্ত্তুতকারক ছিলেন। ৩। মৌলবী অহীদুয্যামান বিন মসীহুয্যামান (ইনি ছিহাহ সিত্তাহর স্বনামধ্য উর্দূ অনুবাদক। এর পূর্বে তিনি হানাফী ফিক্হ ‘শরহে বেকায়াহ্’র তরজমা করেন) ৪। মৌলবী হাকীম মুহাম্মাদ ইয়াহ্ইয়া (সিপাহী বিদ্রোহের পূর্বেকার শাগরিদ)। ৫। মৌলবী সাইয়িদ আমীর আলী মালীহাবাদী (বহু মূল্যবান গ্রন্থের রচয়িতা)। এতদসহ মোট ৭ জনের নাম আছে।
মুরাদাবাদ : মাওলানা জান আলী (উঁচুদরের মুহাদ্দিছ ও মুদাররিস ছিলেন) ২। কাযী ইহতিশামুদ্দীন (‘ইন্তিছারুল হক’ -এর প্রতিবাদে ‘ইখ্তিছারুল হক’ -এর লেখক)। এতদসহ মোট ৪ জনের নাম উল্লেখিত হয়েছে।
মীরাট : মৌলবী আব্দুল জাববার ওমরপুরী ২। মৌলবী যিয়াউর রহমান ওমরপুরী।
এতদ্ব্যতীত পীলীভেত-এ ১ জন, জলেশ্বরে ৩ জন, খুরজাহতে ২ জন, সাহারানপুরে ১ জন, ফতেহ্পুরে ১ জন, ফারখাবাদে ৩ জন, কানপুরে ১ জন, গোরক্ষপুরে ১ জন, মছলীশহরে ১ জন, মোযাফ্ফর নগরে ১ জন, রামপুরে ৩ জন ও হায়দরাবাদের মৌলবী আব্দুল হাইয়ের নাম উল্লেখিত হয়েছে।
তিববত : মৌলবী আবু ইমরান আতাউল হক-এর লেখা হ'তে বুঝা যায় যে, তাঁর ছাত্রজীবেন তিববতের একজন ছাত্র মিয়াঁ ছাহেবের নিকট পড়তে আসেন। কিন্তু তার নাম জানা যায়নি। এমনিভাবে মৌলবী শামসুল হক বলেন যে, মিয়াঁ ছাহেবের দু’জন তিববতী ছাত্রের সঙ্গে আমাদের মোলাকাত হয়েছে। তাদের কয়েকটি চিঠি ও আমাদের কাছে এসেছে।
কাবুল : মৌলবী আব্দুল হামীদ ২। মৌলবী ইখওয়ান ৩। মৌলবী শিহাবুদ্দীন ৪। মৌলবী আব্দুর রহীম
গযনী : মোল্লা শিহাবুদ্দীন গযনবী।
কান্দাহার : মোল্লা আব্দুর রহমান।
কাশগড় : মোল্লা নূরুদ্দীন কাহাস্তানী (সিপাহী বিদ্রোহের পূর্বেকার শাগরিদ) ২। মোল্লা আবদুন নূর (ঐ) ৩। মোল্লা মীর আলম।
হিরাট : মোল্লা আযীযুদ্দীন ২। মোল্লা সাইয়িদ মুহাম্মাদ।
এতদ্ব্যতীত আফগানিস্তানের বাজোড়-য়ে ১ জন, ইয়াগিস্তানে ১ জন, সামরূদে ২ জন, কোকান্দা-য়ে ১ জন, হাবশাঁ দ্বীপ ১ জনের নাম উল্লেখিত হয়েছে।
হেজায : আব্দুর রহমান মুহাম্মাদ বিন আওন নু‘মানী।
সনৌস : আব্দুল্লাহ বিন ইদরীস আল-হুসাইন আল-মাগরেবী (মরক্কোর খ্যাতিমান আলেম ছিলেন। মক্কা মু‘আয্যামাতে বহুদিন যাবত হাদীছের দরস দিয়েছেন)।
নাজদ : ইসহাক বিন আব্দুর রহমান (বড় আলেম ও নেক্কার ব্যক্তি ছিলেন)। ২। আলী বিন মাযী ৩। সাইয়িদ আব্দুল্লাহ বিন সা‘আদ আব্দুল আযীয ৪। কাযী মুহাম্মাদ বিন নাছির বিন মুবারক ৫। কাযী সা‘আদ বিন হামাদ বিন আতীক।[1]
এইভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকার প্রসিদ্ধ ৫০০শত ছাত্রের নাম উল্লেখ করে জীবনীকার ফযল হুসাইন বিহারী বলেন, ‘মূলতঃ এগুলি বিরাট সমুদ্রের এক চুল্লু পানির মত।’ তিনি বলেন ‘শুধু হিন্দুস্থান ও কাবুল নয় এবং আরব, ইয়ামন, নাজ্দ, হিজায, সনৌস (তিউনিসিয়া), হাবশান, আফ্রিকা, চীন, কোচিন, তিববত প্রভৃতি দেশও তাঁর ছাত্র হ’তে খালি নয়।[2]
প্রাসংগিকভাবে আমরা বলতে পারি যে, আল্লামা ইসমাঈল শহীদ (রহঃ) সশস্ত্র জিহাদ আন্দোলনের মাধ্যমে ভারত উপমহাদেশে তথা দক্ষিণ এশিয়ার সর্বত্র আহলেহাদীছ আন্দোলনের যে জোয়ার সৃষ্টি করেন, পরবর্তীতে আল্লামা সাইয়িদ নাযীর হুসাইন দেহলভী (রহঃ) পরিচালিত তাদরিসী জিহাদ সেই জোয়ারকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়। মুসলমান সমাজ থেকে শিরক ও বিদ‘আতের শিকড় উৎপাটনের কার্যকর ভূমিকা তিনি পালন করেন। বিভিন্ন এলাকা হ'তে আগত মিয়াঁ ছাহেবের অসংখ্য ছাত্র ও অনুসারীবৃন্দের আন্তরিক প্রচেষ্টার মধ্যেমে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, তথা দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সর্বত্র আহলেহাদীছ আন্দোলন ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে।
লেখনী
সারক্ষণ দারস-তাদরীস, ফৎওয়া প্রদান ও ওয়ায-নছীহতে ব্যস্ত থাকার কারণে মিয়াঁ ছাহেব গ্রন্থ রচনার দিকে বিশেষ মনোনিবেশ করতে পারেননি। তবুও শতাব্দীর এই ইল্মী মহীরুহ সারাজীবনে যত লিখিত ফৎওয়া দিয়েছেন, তা একত্রিত করা হ'লে বড় বড় বেশ কয়েকটি গ্রন্থ হবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। মৃত্যুর ২৭ বৎসর পূর্বে একবার তিনি বলেছিলেন ‘যদি আমার সমস্ত ফৎওয়ার নকল রাখা হ’তে, তাহ’লে ‘ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী’র চারগুণ হ’ত।[3] জীবনীকার ফযল হুসাইন বিহারী বিভিন্ন সময়ে মুদ্রিত ছোট বড় ৫৬টি ফৎওয়া পুস্তিকার তালিকা দিয়েছেন। মিয়াঁ ছাহেবের মৃত্যুর পরে তদীয় খ্যাতিমান ছাত্র মাওলানা শামসুল হক আযীমাবাদী (১২৭৩-১৩২৯/১৮৫৭-১৯১১) ও মাওলানা আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (১২৮৩-১৩৫৩/১৮৬৫-১৯৩৫)-এর সংশোধনী ও মাওলানা শারুফুদ্দীন দেহলভী (মৃঃ ১৩৮১/১৯৬১) কর্তৃক সংক্ষিপ্ত সংযোজনীসহ ১৩৩৩/১৯১৫ সালে ‘ফাতাওয়া নাযীরিয়াহ’ নামে বৃহদাকার দু’খন্ডে মিয়াঁ ছাহেবের ফৎওয়া সংকলন সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়।[4]
মিয়াঁ ছাহেবের রচিত ‘মি‘য়ারুল হক’ (معيار الحق) বা ‘সত্যের মানদন্ড’ বইটি ছিল সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ। বইটি মোট দু’টি অধ্যায়ে বিভক্ত। ১ম অধ্যায়ে ইমাম আবু হানাফী (৮০-১৫০ হিঃ)-এর ফাযায়েল ও গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে এবং এব্যাপারে হানাফী ফিক্হের গ্রন্থসমূহে যেসব বাড়াবাড়ি করা হয়েছে, যুক্তিপূর্ণভাবে সে সবের প্রতিবাদ করা হয়েছে।[5]
২য় অধ্যায় তাক্বলীদ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা করা হয়েছে।[6] কুরআন, হাদীছ, ইজমা, কিয়াস-এর দলীল দ্বারা এবং চার ইমামসহ উম্মতের অন্যান্য জ্ঞানী মনীষীবৃন্দের উক্তিসমূহের মাধ্যমে তিনি ‘তাকলীদে শাখছী’-কে বাতিল প্রমাণ করেছেন। তাকলীদপন্থীদের তরফ থেকে যেসব জওয়াব দেওয়া হয়ে থাকে, সেগুলিকে উদ্ধৃত করে তার দলীলভিত্তিক জওয়াব দিয়েছেন। মুসলমানকে প্রচলিত চার মাযহাবের যেকোন একটির অনুসারী হওয়া ওয়াজিব-এর দাবীর অসারতায় তিনি চার মাযহাবের শ্রেষ্ঠ ওলামায়ে কেরামের ৩৫টি বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন।[7]
‘এযুগে হাদীছের উপর আমল করা কঠিন সেজন্য যেকোন একটি মাযহাবী ফিক্হের অনুসরণ করা ওয়াজিব’ -এর দাবীরও তিনি যথাযথ জওয়াব দিয়েছেন[8] এবং প্রমাণ করেছেন যে, হাদীছে বর্ণিত নাজী ফের্কা বা মুক্তিপ্রাপ্ত দল কেবলমাত্র চার মাযহাবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।[9]
তিনি একথাও প্রমাণ করেছেন যে, ইজতিহাদ চার ইমামের পরেও চালু আছে। যুগ-জিজ্ঞাসার জওয়াবে শরী‘আত-গবেষণা তথা ইজতিহাদের মাধ্যমে তার সমাধান পেশ করা ইসলামের চিরন্তন মৌলিক দাবী। ইজতিহাদের এই খাছ রহমত আল্লাহপাক কোন একটি বিশেষ যুগ পর্যন্ত সীমায়িত করেননি। কিয়ামত পর্যন্ত ইজতিহাদের দুয়ার প্রত্যেক যোগ্য আলেমের জন্য উন্মুক্ত থাকেন।[10] অতঃপর মিয়াঁ ছাহেব তাঁর দাবীর সপক্ষে চার ইমামের পরবর্তী শ্রেষ্ঠ মুজতাহিদগণের পরিচয় বর্ণনা করেছেন।[11] তিনি ‘ইজমা’ সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন[12] এবং প্রমাণ করেছেন যে, ‘ইজময়ে সুকূতী’ দলীল নয়।[13] সবশেষে কতকগুলি বিতর্কিত মাসায়েল উদ্ধৃত করে ছহীহ হাদীছের মাধ্যমে সেগুলির সমাধান পেশ করেছেন।
মিয়াঁ ছাহেবের লিখিত উক্ত বইয়ের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হ’ল এই যে, সকল প্রকারের কুটতর্ক পরিহার করে দলীল দ্বারা প্রতিপক্ষের উদ্ধৃত দলীলের খন্ডন করা হয়েছে। কুরআন ও হাদীছের দলীল ছাড়াও নিজের সপক্ষে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ হানাফী বিদ্বানদের বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে। বইটি মূলতঃ বিতর্কমূলক। আল্লামা ইসমাঈল শহীদ (রহঃ) ছালাতে রাফ্উল ইয়াদায়েন-এর সপক্ষে ‘তানভীরুল আইনাইন’ নামে যে বই লেখেন, মিয়াঁ ছাহেবের দীর্ঘ চার বছরের শাগরিদ মৌলবী মুহাম্মাদ শাহ পাঞ্জাবী তার জওয়াবে ‘তানভীরুল হক’ নামে একটি বই লিখে নওয়াব কুতুবুদ্দীন খানের নামে প্রচার করেন। তারই জওয়াবে ময়াঁ ছাহেব অত্র ‘মি‘য়ারুল হক’ রচনা করেন।[14] বক্তব্যের ঋজুতা, সাবলীলতা, রুচিশীলতা এবং অকাট্য দলীলসমূহের সুন্দর উপস্থাপনায় বইটি মিয়াঁ ছাহেবের জীবনের শ্রেষ্ঠ রচনা হিসাবে সুধী মহলের প্রশংসা কুড়িয়েছে। বইটির শেষদিকে এর প্রশংসায় উপমহাদেশের তৎকালীন শ্রেষ্ঠ ১৮ জন আলিমের বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে।
‘মি‘য়ারুল হক’ -এর প্রতিবাদে সর্বপ্রথম মৌলবী এরশাদ হুসাইন রামপুরী ‘ইন্তিছারুল হক’ নামে একটি পুস্তিকা লিখেন। তাঁর বিরুদ্ধে মিয়াঁ ছাহেবের শিষ্যগণ মোট ৪টি প্রতিবাদ পুস্তক লিখেন।[15] প্রথমটি লিখেন মৌলবী সাইয়িদ আমীর হাসান সাহসোয়ানী, যা ‘ইন্তিছার’ প্রকাশের মাত্র একদিন পরিই ‘বারাহীনে ইছনা আশারা’ নামে প্রকাশিত হয়। পুস্তিকাটিতে ১২টি মযবুত দলীলের অবতারণা করে বলা হয়েছে, যে কেউ উক্ত বারোটি দলীলের জওয়াব দিতে পারবেন ধরে নেওয়া হবে যে, তিনি পুরা বইটির প্রতিবাদ করেছেন। বইটি পড়ে ভারতের খ্যাতনামা হানাফী আলেম আল্লামা আব্দুল হাই লাক্ষ্মৌবী (১২৬৪-১৩০৪/ ১৮৪৮-১৮৬৬) লেখকের নিকট প্রেরিত একটি চিঠিতে বলেন- ‘ইন্তিছার’ বইয়ে উদ্ধৃত কিতাবসমূহ ও সে সবরে প্রণেতাদের নামের ভুলের সংখ্যা অগণিত। সংক্ষেপে কয়েকটির প্রতি দৃকপাত করাই যথেষ্ট মনে করি।[16] মিয়াঁ ছাহেবের শিষ্যদের লিখিত বাকী তিনটি বই হ’ল- (১) ‘তালখীছুল ইনযার ফী মা বুনিয়া আলাইহিল ইন্তিছার’। লেখক মৌলবী সাইয়িদ আহমাদ হাসান দেহলভী ‘ইন্তিছার’ বই প্রকাশের মাত্র দশদিনের মধ্যেই তার প্রতিবাদে উক্ত বই প্রকাশ করে লেখকের নিকট কপি পাঠিয়ে দেন। অথচ ‘ইন্তিছার’ বইটি ‘মি‘য়ারুল হক’ প্রকাশের দীর্ঘ ৮ বৎসর পরে ১২৯০ হিজরীতে প্রকাশিত হয়েছিল (২) ‘ইখ্তিয়ারুল হক’। লেখকঃ কাযী ইহতিশামুল হক মুরাদাবাদী (৩) ‘বাহ্রে যাখার’। লেখকঃ মৌলবী গুহূদুল হক পাটনাবী।
সংক্ষেপে ‘মি‘য়ারুল হক’ বইটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হ’ল মুসলিম উম্মাহ্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের যুগের ন্যায় কুরআন ও হাদীছভিত্তিক জীবন যাপনের দিকে ফিরে যেতে উদ্বুদ্ধ করা এবং জীবনের সকল দিক ও বিভাগে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সর্বোচ্চ অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। দ্বিতীয় শতাব্দী হিজরীর শেষপাদে এসে তাক্বলীদে শাখ্ছীর বিদ‘আত মাথা চাড়া দেওয়ার পর হ'তে যা ক্ষুণ্ণ হয় ও যার ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন বিদ্বানের ভক্তগণ পরবর্তীতে তাদের স্ব স্ব ইমামের নামে এক একটি মাযহাব রচনা করে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হ'য়ে যায়। অথচ কুরআনও ছহীহ হাদীছেকে বিচারের মানদন্ড হিসাবে গ্রহণ করে নিলে শারঈ বিষয়ে উম্মতের মধ্যে কোন দলাদলী সৃষ্টি হ'তে পারেনা। বইটিতে মিয়াঁ ছাহেব মুসলিম উম্মাহ্কে তাক্বলীদে শাখ্ছীর শৃংখল ছিন্ন করে কুরআন ও ছহীহ হদীছকে ‘মি‘য়ারুল হক’ বা ‘সত্যের মানদন্ড’ হিসাবে নিঃশর্তভাবে গ্রহণ করার ভিত্তিতে মুসলিম ঐক্যের আহবান জানিয়েছেন। বলা যেতে পারে যে, ‘মি‘য়ারুল হক’ বইটির মিয়াঁ ছাহেবের লৈখিক জিহাদের জীবন্ত স্মৃতি। ২৪৭ পৃষ্ঠার এই বইটি ‘তাক্বলীদ’ সম্পর্কে প্রচলিত বদ্ধমূল ধারণা নিরসন ক’রে উপমহাদেশে আহলেহাদীছ আন্দোলনকে জোরদার করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
উন্নত ব্যক্তিগত আমল, শিক্ষাকতা, ওয়ায-নছীহত এবং লেখনী যুদ্ধের ময়দানে অতুলনীয় মুজাহিদ মিয়াঁ নাযীর হুসাইন দেহলভী জীবনে কখনো সশস্ত্র জিহাদে লিপ্ত হননি বা তেমন কোন সুযোগ তাঁর জীবন সৃষ্টি হয়নি। তবে সশস্ত্র আততায়ীর সম্মুখীন হয়ে শাহাদাতের দ্বারদেশ হ’তে ফিরে এসেছেন।[17]
বিরোধী পক্ষের নোংরা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে গীবত-তোহমত,[18] জেল-যুল্ম ভোগ করেছেন।[19] এমনকি হজ্জের মওসুমে মক্কার পবিত্র ভূমিতে তাঁকে গ্রেফতার হ’তে হয়েছে কুচক্রী আলেমদের ষড়যন্ত্রের ফলে।[20] সেই সময়কার চরম বিরোধী পরিবেশে আহলেহাদীছ আন্দোলনের এই অকুতোভয় সিপাহ্সালার যে আপোষহীণ জিহাদী মনোভাব নিয়ে দা‘ওয়াত ও তাদরীসের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এবং বিরোধীদের সকল চক্রান্তজাল উপেক্ষা করে এগিয়ে গিয়েছিলেন, তা যেকোন মুজাহিদের জন্য ঈর্ষার বিষয় বৈ-কি!
শিক্ষকতার মাধ্যমেই তাঁর আন্দোলন পরিব্যপ্ত হয়। তাঁর বিরাট ছাত্রবাহিনী মূলতঃ আন্দোলনের কর্মীবাহিনী হিসাবে কাজ করেন এবং বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে আহলেহাদীছ আন্দোলন পরিচালনা করেন।
শাহ অলিউল্লাহ ও শাহ ইসমাঈল (রহঃ)-এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করে তিনি বলতেন- ‘আমি ঐ দু’জন দাদা ও পৌত্রের সঙ্গে একমত, যাঁরা কেবলমাত্র কুরআন ও হাদীছ থেকে মাসআলা চয়ন করতেন ও নিজেদের সিদ্ধান্তের উপরে দৃঢ় থাকতেন। যায়েদ, আমর বা কোন লেখকের ও আলেমের পায়রবী করতেন না। তাঁদের লেখা পড়লে মনে হয় যেন আল্লাহর অনুগ্রহের দরিয়ায় ঢেউ খেলছে।[21]
হাদীছ থেকে প্রমাণিত কোন মাসআলার ব্যাপারে কেউ হঠকারিতা দেখালে মিয়াঁ ছাহেব সাথে সাথে মুবাহালার আহবান জানাতেন। তাঁর চরিত্রের এই দৃঢ়তা ও সরলতা শিষ্যদের মধ্যে গভীর প্রভাব ফেল্ত, যা আহলেহদীছ আন্দোলনে গতি সঞ্চার করে।
মিয়াঁ ছাহেবের আন্দোলন সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলনের ফলাফল’ (تحريك أهل حديث كا فائده) শিরোনামে আল্লামা সুলায়মান নাদ্ভী (১৩০২-১৩৭২ / ১৮৮৪-১৯৫৩) বলেন, সাইয়িদ নাযীর হুসাইন দেহলভী ও তাঁর ছাত্র মন্ডলীর মাধ্যমে হিন্দুস্থানে আহলেহাদীছ-এর নামে যে আন্দোলন চলে, তার একটি ফল এই হয়েছে যে, তবীয়তের জড়তা ও গোঁড়ামি দূর হয়েছে। যখন একটি বন্ধন ছুটেছে, তখন ইজতিহাদের অন্যান্য বাধার বদ্ধ দুয়ার ও খুলে যায়।’[22] (ক্রমশঃ)।
প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
[বিস্তারিত দ্রষ্টব্য : মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব প্রণীত ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতসহ (পিএইচ.ডি থিসিস) শীর্ষক গ্রন্থ পৃঃ ৩২৫-৩৩০]
[1]. প্রাগুক্ত, পৃ.৬৬২-৭০৪।
[2]. প্রাগুক্ত, পৃ.৬২২।
[3]. প্রাগুক্ত, পৃ.৫৫৭।
[4]. ফাতাওয়া নাযীরিয়াহ ৩য় সংস্করণ (দিল্লী : নূরুল ঈমাম প্রকাশনী, ১৪০৯/১৯৮৮)-এর ভূমিকা, পৃ.৫; তিনখন্ডে সমাপ্ত উক্ত সংকলনের মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৭২৪+৬০০+৪৮০=১৮০৪। ১৩৯০/১৯৭১ সালে লাহোর হ'তে ‘আহলেহাদীছ একাডেমী’ কর্তৃক ২য় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। মিযাঁ ছাহেবের নামে প্রকাশিত উক্ত সংকলনে তাঁর শিষ্যদের প্রদত্ত ফৎওয়া সমূহ তাদের নামসহ সংকলিত হয়েছে। জীবনের শেষ অংশে এসে মিযাঁ ছাহেবের সিদ্ধান্তে অনেক দুর্বলতা এসে গিয়েছিল। যেটা শতায়ু মানুষের জন্য অনেকটা স্বাভাবিক ব্যাপার। অনেকসময় মসজিদে রক্ষিত তাঁর সীলমোহর তাঁর বিনা অনুমতিতেই ব্যবহৃত হ’ত। সেকারণে জীবনীকার ছাত্র মাওলানা ফযল হুসাইন বিহারী বলেন- ‘মিয়াঁ ছাহেবের জীবনের শেষ সিকি অংশের যেসব ফৎওয়া ইতিপূর্বেকার খেলাফ প্রমাণিত হয়, সেগুলি তাঁর নিজস্ব ফৎওয়া গণ্য করা ঠিক নয়। বরং পূর্বের ফৎওয়াগুলিকেই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।’ আল-হায়াত, পৃ.৬১৩-৬১৪।
[5]. ‘মি‘য়ারুল হক’ পৃ.৫-১৯।
[6]. প্রাগুক্ত, পৃ.১৯-২৪৭।
[7]. প্রাগুক্ত, পৃ.৫৪-৮৫।
[8]. প্রাগুক্ত, পৃ.৩৯।
[9]. প্রাগুক্ত, পৃ.২৩।
[10]. প্রাগুক্ত, পৃ.২৫।
[11]. প্রাগুক্ত, পৃ.২৬-৩০।
[12]. প্রাগুক্ত, পৃ.৩০-৩১, ১২৬।
[13]. প্রাগুক্ত, পৃ.১৪৭।
[14]. ‘আল-হায়াত’ পৃ.৫৮৬-৮৭।
[15]. প্রাগুক্ত, পৃ.৫৯১।
[16]. ..... প্রাগুক্ত, পৃ.৫৯২।
[17]. দিল্লীর ফাটক হাবাশ খাঁ মসজিদ থেকে এশার ছালাত শেষে বাসায় ফেরার পথে সশস্ত্র আততায়ী তাঁকে হামলা করতে গেলে তিনি তাকে ধমক দিয়ে বলেন, ‘আমি যদি ফাতিমার বংশধর হই, তাহ’লে তুমি কখনই কামিয়াব হবেনা।’ (ميں اگر بنى فاطمه ہوں تو تو اپنے ارادے ميں كبہى كامياب نہوگا) একথা শোনার সাথে সাথে নিষ্ঠুর ঘাতকের বুক কেঁপে ওঠে ও তরবারি হাত থেকে পড়ে যায়। পরে প্রচন্ড পেট ব্যথায় সে সেই রাতেই বাড়িতে মারা যায়। মৃত্যুর সময় সে বলে যায় ‘আমি আল্লাহর গযবে পতিত হয়েছি’।- ‘আল-হায়াত’ পৃ.২৩৩।
[18]. একবার এক দুশমন ছাত্র তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসাভরা কবিতা ছাপিয়ে বিলি করে। সেখানে তাঁকে ইঁদুর খেকো বিড়াল’ বলে টিটকারী করা হয়- جب كى خراب اس نے سارى دلى+ چوہے خاكر چلى حج كو بلى) তিনি হাসতে হাসতে সেটা পড়ে ক্ষুদ্ধ শিষ্যদেরকে বললেন-‘সে আমাকে কিছু দিয়েছে, নেয়নিতো কিছু’ آرے مياں.. اس نے ہميں كچه ديا هے، ليا تو نہيں ‘আল-হায়াত’ পৃ.৩০৫।
[19]. বিরোধীদের প্ররোচনায় বৃটিশ সরকার তাঁকে এক বছর রাওয়ালপিন্ডি জেলে বন্দী করে রাখেন। -‘তারাজিমে ওলামায়ে হাদীছ হিন্দ’ পৃ.১৪৮।
[20]. ১৩০০ হিজরী মোতাবেক ১৮৮৩ সালে হজ্জ করার জন্য মক্কায় গেলে তাঁকে চক্রান্তের মাধ্যমে গ্রেফতার করা হয়। -নযীর আহমাদ রহমানী, ‘আহলেহাদীছ আওর সিয়াসাত’ (বেনারসঃ জামেয়া সালাফিইয়া, ২য় সংস্করণ ১৯৮৬) পৃ.৩৬৯। পরে মক্কার শাসক সৈয়দ ওছমান নূরী পাশা সসম্মানে তাঁকে মুক্তি দেন। তার আগে ‘মিনা’ প্রান্তরে পরপর তিনদিন তাঁর বক্তৃতা শুনে বিরোধী আলেম গণ তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন। সাথী মৌলবী তালাত্তুফ হুসাইন আযীমাবাদী ও অন্যান্য শিষ্যগণ উক্ত ষড়যন্ত্র অবহিত হয়ে মিয়াঁ ছাহেবকে ওয়ায বন্ধ করতে পরামর্শ দিলে তিনি জওয়াবে বলেন, এই পুণ্যভূমিতে ইমাম নাসাঈ (২১৫-৩০৩ হিঃ) শহীদ হয়েছিলেন। আমিও শহীদ হওয়ার জন্য প্রস্ত্তত। কিন্তু আমি দা‘ওয়াত ও তাবলীগ থেকে কখনোই বিরত হব না’- (سنو صاحب بہت جى چكا اب زندگى كى تمنا نہيں، امام نسائى بہى اسى حرم ميں شہيد ہوئے جہاں ميرے قتل كے منصربے ہو رہے ہيں- ميں ہر وقت اپنے قتل كيلئے آماده ہوں مگر اس تبليغ سے باز نہ آونگا) (তারাজিম পৃ. ১৪৮)।
[21]. ميں ان دادا پوتوں كا قائل هوں جو صرف قران و حديث سے استنباط مسائل كرتے اور اپنى رائے پر اعتماد ركہتے ہيں- زيد و عمرو كسى مصنف يا عالم كى پيروى نہيں كرتے- ان كى تحرير سے معلوم ہوتا ہے كہ دريائے فيضان إلہى جوش مار رہا ہے- ‘আল-হায়াত’ পৃ.৩০৪।
মৃত্যু : ১৩২০ হিজরীর ১০ই রজব মোতাবেক ১৯০২ খৃষ্টাব্দের ১৩ই অক্টোবর সোমবার বাদ মাগরিব দিল্লীতে একমাত্র মেয়ের বাসায় তাঁর মৃত্যু হয় এবং পরদিন শীদীপুরা গোরাস্থানে স্বীয় একমাত্র পুত্র মৌলবী শরীফ হুসাইন (৫৬)-এর কবরের পার্শ্বে সমাহিত হন। খ্যাতনামা পৌত্র হাফেয মৌলবী আবদুস সালাম (৫৫) তাঁর জানাযায় ইমামতি করেন। ৪ ছেলে ও ৩ মেয়ের পিতা মৌলবী আবদুস সালামের পরে এই বংশের আর কেউ মিয়াঁ ছাহেবের স্থলাভিষিক্ত হ'তে পারেননি। -তারাজিম পৃ.১৫২, ১৬১।
* মিয়াঁ ছাহেবের জীবনের কিছু ছিটেফোঁটাঃ (১) জীবনের ৮০টি বছর তিনি দিল্লীতে অতিবাহিত করেন। কিন্তু নিজের ও নিজের পরিবারের জন্য কোন নিজস্ব বাসস্থান তাঁর ছিল না। একটি সাধারণ ভাড়া বাসায় তিনি জীবন কাটিয়েছেন। শীত ও গ্রীষ্মের মওসুমে সেখানে থাকাই দুষ্কর ছিল। সেখানে বসেই তিনি ফৎওয়া লিখতেন ও পড়াশুনা করতেন। মাঝে মধ্যে ছাত্রদের ঠাট্টা করে বলতেন- وہاں جاكر سو رہو تو دو روپے ديتا ہوں- ميں جس سائبان ميں رہتا ہوں تم ايك گہنٹہ اگر ‘আমি যেখানে থাকি, সেখানে তোমরা গিয়ে যদি এক ঘন্টা শুয়ে থাকতে পার, তবে দু’টাকা দেব।’ (২) একদা মুহাম্মাদ দীন পাঞ্জাবী কয়েকদিন তাঁর মেহমান ছিলেন। ফলে সে কয়দিন মিয়াঁ ছাহেবকে প্রায় না খেয়েই থাকতে হয়। বসার ক্ষমতা হারিয়ে ফেল্লে অবশেষে শুয়ে শুয়ে ছাত্রদের পড়াতেন। কিন্তু কোনদিন মুখ ফুটে কাউকে কিছু জানাননি। (৩) সওদাগর আতাউল্লাহ পাঞ্জাবী নামক জনৈক শিষ্য একবার তাঁকে তুলার গদি বানিয়ে দিতে চাইলে তিনি তাঁর চিরাচরিত চাটাই ছাড়তে রাযী না হয়ে বললেন, پرانى قبر پر كيا گچ كروگے ‘পুরানো কবরের উপরে কি প্লাষ্টার করবে? অথচ তাঁর ছাত্ররা সতরঞ্চিতে বস্ত। (৪) একবার ভূপালের রাণী সিকান্দার বেগম দিল্লী এসে তাঁকে ভূপালের প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহণের অনুরোধ করলে তিনি বলেন, ‘তাহ'লে এই গরীব চাটাইয়ের ছাত্রদের উপায় কি হবে? (৫) ৫০ বছরের মধ্যে তাঁর কখনো তাহাজ্জুদের ছালাত ক্বাযা হয়নি। (৬) বদরুল হাসান সাহসোয়ানী বলেন যে, একবার আমি মিযাঁ ছাহেবকে দাওয়াত করি। কিন্তু খাওয়া শুরু করার আগেই তাঁর বমি শুরু হয়। ফলে তিনি না খেয়ে চলে যান। পরে আমার পাচকের পেটে ভীষণ বেদনা শুরু হয়। পাচক আব্দুল গণী ছিল রামপুরের বাশিন্দা ও মিয়াঁ ছাহেবের প্রতি দারুণ বিদ্বেষী। অবস্থা সংগীন হ'য়ে উঠ্লে সে এক পর্যায়ে মিনতিভর কন্ঠে স্বীকার করে যে, সে মিয়াঁ চাহেবের জন্য খাসির বদলে শূকরের গোস্ত পাকিয়েছিল। এই পেটের বেদনা তার উপরে আল্লাহর গযব ছাড়া কিছুই নয়।’ অতঃপর তাকে মিয়াঁ ছাহেবের কাছে নিয়ে যাওয়া হ’লে সব কথা খুলে বলে ক্ষমা ভিক্ষা করে। মিয়াঁ সাহেব তার জন্য দো‘আ করার সাথে সাথে পেটের তীব্র বেদনা প্রশমিত হয়। তখন সে মিয়াঁ ছাহেবের হাতে হাত রেখে তওবা ও বায়‘আত করল। তার নতুন নাম রাখা হ’ল ‘আব্দুল্লাহ’। এর পর সে মক্কায় হিজরত করল ও সেখানেই বাকী জীবন অতিবাহিত করল। আল্লাহ পাক এভাবেই মিয়াঁ ছাহেবকে হারাম খাদ্য থেকে হেফাযত করলেন। ফালিল্লাহিল হাম্দ। (৬) তিনি শিষ্যদের নিকট থেকে আনুত্যের ‘বায়‘আত’ গ্রহণ করতেন। একবার বাংলাদেশ সফরে মুর্শিদাবাদের দেবকুন্ডে এলে হাযার হাযার লোকের সমাগম হয়। তারা সকলে উক্ত মাহফিলে তাঁর হাতে ‘বায়‘আত’ -এর সৌভাগ্য গ্রহণ করে।-‘আল-হায়াত’ পৃ.যথাক্রমে ২৪০, ২৩৩, ২৩৮ ও ২৪১, ২৩৮, ২৬৮, ২৬৬ ও ২৬৭।
[22]. আশরাফ সিন্ধূ, নাতায়েজুত্ তাক্বলীদ পৃ.৫৮; গৃহীতঃ হায়াতে শিবলী ১ম খন্ড পৃ.৩০৮-টীকা