ইসলাম শাশ্বত জীবন ব্যবস্থা

মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ 10341 বার পঠিত

ভূমিকা :

ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম একমাত্র পরিপূর্ণ এবং মানবতার মুক্তির ধর্ম। ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে তৎকালীন আরব মরুবাসীসহ পৃথিবীর সর্বস্তরের মানুষেরা জাহেলিয়াত অমানিশা হ’তে মুক্তি পেয়ে, তারা সোনার মানুষে পরিণত হয়েছিল। ইসলাম ধর্মে আল্লাহ ভীরুতা ব্যতীত ধনী-গরীব, সাদা-কালোর ভেদাভেদ কোন নেই ।

পক্ষান্তরে ইসলামের সাথে অন্যায় ও অসত্যের দূরতম সম্পর্ক নেই। আল্লাহ তার রাসূল (ছাঃ)-এর মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে সতর্ক করেছেন। অন্যায় ও অসত্য পরিহার করার জন্য আদেশ করেছেন। যারা আল্লাহ, রাসূল (ছাঃ)-এর কথা, কর্ম তথা শরী‘আত বিরোধী কাজে লিপ্ত হবে তাদেন জন্য অপমানজনক শাস্তি প্রস্ত্তত করে রাখা হয়েছে।

ইসলাম শব্দের পরিচয় : إسلام আরবী শব্দ। ইংরেজীতে Islam এর আভিধানিক অর্থ বশ্যতা, আত্মসমর্পণ, সমর্পণ।[1] ইংরোজীতে Islamic Peace Commute[2] পারিভাষিক অর্থ  الاسلام اظهار الخضوع و الغبور لما اتى به محمد (ص)- অর্থ: ইসলাম হ’ল বিনয়ী, নম্রতা প্রকাশ, এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) যা নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ করা।[3]

মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর পক্ষ হ’তে মনোনীত যে ধর্ম নিয়ে এসেছেন তাকে ইসলাম বলা হয়।

ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান : ইসলাম যে একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান সে ব্যাপারে সকল মনীষী ঐক্যমত। ইসলাম ধর্মে রয়েছে ধর্মীয়, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকসহ জীবনের সকল সমস্যার বাস্তব সমাধান। তাই তো আল্লাহ আজ থেকে প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ বছর পূর্বে ঘোষণা করেছেন যে,

إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْإِسْلَام-

‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত দ্বীন বা ধর্ম হচ্ছে ইসলাম (সূরা আলে-ইমরান ৩/১৯) আর আল্লাহর নিকট ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন বা ধর্ম গ্রহণযোগ্য নয়, বরং পরকালে নাজাত পেতে হ’লে একমাত্র ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,

 وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ-

‘আর যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন জীবন বিধান তালাশ করে, তা অগ্রহণযোগ্য এবং সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আলে ইমরান ৩/৮৫) । আর ইসলাম মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মৃত্যুবরণের পূর্বেই পূর্ণাঙ্গতা লাভ করেছে যা তার বিদায় হজ্জের ভাষণের মাধ্যমে বুঝা যায়। আল্লাহ  বলেন,

الْيَوْمَ يَئِسَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ دِينِكُمْ فَلَا تَخْشَوْهُمْ وَاخْشَوْنِ الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا-

‘আজ কাফিররা তোমাদের দ্বীনের বিরোধিতা করার ব্যাপারে পুরোপুরি নিরাশ হয়ে গেছে, কাজেই তাদেরকে ভয় করো না, কেবল আমাকেই ভয় কর। আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন (ইসলামকে) পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে কবূল করে নিলাম (মায়েদা ৩/৫)

উপস্থাপিত আয়াতগুলো দ্বারা সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন-বিধান ও পরকালে মুক্তি পেতে হ’লে একমাত্র ইসলামের বিধান সার্বিক জীবনে যথাযথভাবে বাস্ত বায়ন করতে হবে। অন্যথায় পরকালে অপমানিত হ’তে হবে। পৃথিবীর সমস্ত মানুষ প্রথমত ফিৎরাত বা ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করে এবং পারিপার্শ্বিকতার কারণে সে ধর্মান্তরিত হয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন,

كُلُّ مَوْلُودٍ يُولَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ وَيُنَصِّرَانِهِ كَمَا تَنَاتَجُ الإِبِلُ مِنْ بَهِيمَةٍ جَمْعَاءَ هَلْ تُحِسُّ مِنْ جَدْعَاءَ-

 ‘আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, প্রত্যেক শিশু ফিৎরাত বা ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তার পিতা-মাতার কারণে সে ইহুদী, খ্রীষ্টান ও অগ্নিপূজক হয়। যেমন চতুষ্পদ জন্তু একটি পূর্ণাঙ্গ বাচ্চা জন্ম দেয়, তোমরা কি তাকে (জন্মগত) কানকাটা অবস্থায় দেখেছ’।[4]

রূহের জগতে যখন আল্লাহ আমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলেন তখন আমাদেরকে আল্লাহ জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই? তখন আমরা সবাই স্বীকার করেছিলাম। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,

وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِنْ بَنِي آدَمَ مِنْ ظُهُورِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَأَشْهَدَهُمْ عَلَى أَنْفُسِهِمْ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ قَالُوا بَلَى شَهِدْنَا أَنْ تَقُولُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّا كُنَّا عَنْ هَذَا غَافِلِين-

‘আর (স্মরণ কর) যখন তোমার প্রতিপালক বনু আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের সন্তানদের বের করলাম এবং তাদেরকে তাদের উপর সাক্ষী বানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই? তারা বলল, হ্যাঁ। আমরা সাক্ষী থাকলাম। (এটা এজন্য) যাতে তোমরা ক্বিয়ামতের দিন বলতে না পার যে, আমরা এ বিষয়ে জানতাম না’ (রাফ  ৭/১৭২)

আর ইসলাম হচ্ছে সরল সহজ। এখানে কোন বাড়াবাড়ি বা জবরদস্তি  নেই। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ  বলেন, لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ-  ‘দ্বীনের মধ্যে কোন জবরদস্তি নেই’ (বাক্বারাহ ২/২৫৬)

অন্যত্র বলেন, وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ- ‘তিনি দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন কঠোরতা আরোপ করেননি’ (হজ্জ ২২/৭৮)

অন্যত্র আল্লাহ  বলেন, وَلَا تُحَمِّلْنَا مَا لَا طَاقَةَ لَنَا بِهِ- ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের উপর ঐরূপ বোঝা চাপাবেন না, যা বহনের সাধ্য আমাদের নেই (বাক্বারাহ ২/২৮৬)

রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ الدِّينَ يُسْرٌ، وَلَنْ يُشَادَّ الدِّينَ أَحَدٌ إِلاَّ غَلَبَهُ ، فَسَدِّدُوا وَقَارِبُوا وَأَبْشِرُوا ، وَاسْتَعِينُوا بِالْغَدْوَةِ وَالرَّوْحَةِ وَشَىْءٍ مِنَ الدُّلْجَة-ِ ‘আবু হুরায়রা হ’তে বর্ণিত, নবী (ছাঃ) বলেছেন, নিশ্চয়ই দ্বীন সহজ। দ্বীন নিয়ে যে বাড়াবাড়ি করে দ্বীন তার উপর জয়ী হয়ে যায়। কাজেই তোমরা মধ্যম পন্থা অবলম্বন কর এবং (মধ্যপন্থার) নিকটে থাক, আশান্বিত হও এবং সকাল-সন্ধ্যায় ও রাতের কিছু অংশ (ইবাদত সহযোগে) সাহায্য চাও’।[5] আল্লাহ  বলেন, 

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً وَلاَ تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ-

‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পূর্ণরূপে ইসলামে প্রবেশ কর এবং শয়তানের রাস্তাসমূহের অনুসরণ কর না। নিশ্চয়ই সে (শয়তান) তোমার প্রকাশ্য শত্রু (বাক্বারাহ ২/২০৮)। যারা তাগুত বা আল্লাহদ্রোহী হ’তে ইসলামে প্রবেশ করবে তাদের জন্য সুসংবাদ। আল্লাহ  বলেন,

وَالَّذِينَ اجْتَنَبُوا الطَّاغُوتَ أَنْ يَعْبُدُوهَا وَأَنَابُوا إِلَى اللَّهِ لَهُمُ الْبُشْرَى فَبَشِّرْ عِبَاد-ِ

‘যারা তাগুতের পূজা থেকে দূরে থাকে এবং আল্লাহর দিকে ধাবিত হয়, তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ। অতএব আপনি আমার বান্দাদেরকে সুসংবাদ প্রদান করুন’ (যুমার ৩৯/০৭) তাদের জন্য সুসংবাদ অর্থাৎ তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। ইসলামের সুমহান আদর্শ দেখে অমুসলিমরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করছে। যদিও পাশ্চাত্যের মানুষেরা ইসলামের বিরুদ্ধে মিথ্যারোপ করছে, এমনকি ১৮০০-১৯৫০ সাল পর্যন্ত দেড়শ বছরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ৬০০০০ টি বই লিখেছে যা গড়ে প্রত্যেক দিন ১টিরও বেশী।[6] অমুসলিমরা যত মুসলিমদের বিরুদ্ধে মিথ্যারোপ ও চক্রান্ত করছে তত দ্রুত ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটছে। যেমন আমরা দেখতে পায় ঈমানদার যুবক ও আছহাবুল উখদূদের কাহিনী থেকে যে যুবককে পর্যায়ক্রমে প্রথমে পাহাড় ও নদীতে নিয়ে হত্যা করতে ব্যর্থ হ’ল। তখন যুবকের পরামর্শক্রমে এলাকার সকল লোকের সামনে باسم الله رب الغلام অর্থ : ‘গোলামের রবের নামে শুরু করছি’ বলে যুবকটিকে হত্যা করল এবং উপস্থিত সকলেই বলে উঠল আমরা ঈমান আনলাম বালকটির রবের প্রতি। অবশেষে তারা সকলেই রাজার শাস্তির সম্মুখীন হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন কিন্তু ইসলাম হ’তে সামান্য পরিমাণ সরে গেলেন না।[7]

অনুরূপভাবে ইসলামের ঘোরবিরোধী ওমর শানিত তরবারি নিয়ে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে হত্যার জন্য উদ্যত হ’লেন পথিমধ্যে রাসূলের ছাহাবীর সাথে সাক্ষাৎ হয় এবং তিনি ওমরকে বলেন, তুমি মুহাম্মাদকে হত্যা করবে। আর বানু আব্দুল মুত্তালিব তোমাকে ছেড়ে দিবে। ওমর মুহাম্মাদকে হত্যা করার পূর্বে তোমার পরিবার হতে শুরু কর। তোমার বোন ফাতিমা ও তার স্বামী ইসলাম গ্রহণ করেছেন। ওমর তার বোন এবং ভগ্নিপতি সাঈদকে প্রহার করলেন এবং কুরআন পাঠ করে মুসলিম হয়ে গেলেন।[8] পরবর্তীতে এই ওমর ফারূক বা সত্য মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা এবং জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত হন। তিনি ন্যায়, ইনছাফ, বীরত্ব, মহত্ত্ব, দুনিয়াবিমুখতা, অনাড়ম্বরতার জন্য ইসলামের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। হাবশী গোলাম বেলাল ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে ইসলামের প্রথম মুয়াযযিনের উপাধিতে ইসলামের সোনালী ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন। খালিদ বিন ওয়ালীদ, হিন্দা, ওয়াহশী ইসলামের পতাকাতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। পক্ষান্তরে রাসূলের চাচা যিনি তাকে ইসলাম প্রচারের কাজে সার্বিকভাবে সাহায্য করেছেন আবু তালিব। কিন্তু ইসলাম গ্রহণ না করার কারণে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।[9]

জাতির পিতা ইবরাহীমের আববা তার ধর্ম গ্রহণ না করার কারণে জাহান্নামে যাবে। অন্যদিকে আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই রাসূলের পিছনে ছালাত আদায় করে কালেমা পড়ে ও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। পক্ষান্তরে ছাহাবী এক ওয়াক্তও ছালাত আদায় না করে, ছিয়াম বা ইসলামের অন্যান্য বিধান পালন না করে কালেমা শাহাদাত পাঠ করে, যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করার কারণে শহীদের মর্যাদা পাবে।[10] ছাহাবী বিভিন্ন যুদ্ধে শত্রুদের কঠোর মোকাবেলা করেও জান্নাতের প্রবেশ করতে পারবে না। ইসলামের সঠিক মর্মকথা না বুঝার কারণে।[11] তাই আমাদেরকে খালেছ অন্তরে ইসলামের সুমহান বাণী অনুধাবণ করতে হবে। তাই তো আল্লাহ  বলেন, وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا- ‘রাসূল তোমাদেরকে যা দিয়োছেন তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাক’ (হাশর ৫৯/৭)

ইসলাম ধর্মগ্রহণ করলে আল্লাহ তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বর্ণনা করেন যে রাসূল (ছাঃ) কে বলতে শুনেছেন, বান্দা যখন ইসলাম গ্রহণ করে এবং তার ইসলাম উত্তম হয়। আল্লাহ  তা‘আলা তার পূর্বের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেন। অতঃপর শুরু হয় প্রতিফল; একটি পূর্ণ্যের বিনিময়ে দশ হ’তে সাতশ’ গুণ পর্যন্ত; অতপর একটি পাপ কাজের বিনিময়ে ঠিক ততটুকু মন্দ প্রতিফল। অবশ্য আল্লাহ  যদি ক্ষমা করে দেন তবে তা অন্য ব্যাপার।[12]

ইসলাম ও মুহাম্মাদ (সাঃ) সম্পর্কে অমুসলিমদের বাণী :

(ক) বিখ্যাত আইরিশ ঔপন্যাসিক ও দার্শনিক জর্জ বার্নাড (১৮৫৬-১৯৫০) লিখেছেন ‘‘If any religion had the chance of ruling over Engliand the nay Europe within the next hundred years, it could be Islam " যদি কোন ধর্ম আগামী ১০০ বছরের মধ্যে ইংল্যান্ড তথা সমগ্র ইউরোপ শাসন করার সুযোগ পায়, তবে সেটা হ’ল ইসলাম।

(খ) ইন্ডিয়ার প্রখ্যাত কবি লেখক, সমাজকর্মী ও রাজনীতিবিদ সরোজিনী নাইডু (১৮৭৯-১৯৪৯) বলেন, ‘ইসলামই ছিল প্রথম ধর্ম যা গণতন্ত্রের প্রচার ও অনুশীলন করেছেন। যেমন মসজিদে ছালাতের জন্য আযান দেয়ার পরে মুছল্লীরা একসাথে মসজিদে একত্রিত হয়। দৈনিক এই পাঁচ ওয়াক্তের ছালাতের মধ্যেই ইসলামের গণতন্ত্র নিহিত রয়েছে। যেমন কৃষক এবং রাজা পাশাপাশি নতজানু হয়ে একই ঘোষণা উচ্চারণ করে বলে, ‘আল্লাহু আকবার’ (এক আল্লাহ  মহান)। ইসলামের এই বিমূর্ত একতা দেখে আমি বার বার হতবাক হয়ে যাই যা একজন মানুষের সহজাতভাবেই একজন ভাইয়ে পরিনত করে।[13]

মেজর আর্থার গ্লীলিন লিউনার্ড বলেছেন, ‘মুহাম্মাদ (ছাঃ) তিনটি বিষয়ের শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী ছিলেন, যা তখনকার দিনে ছিল না বললেই চলে। ধর্ম প্রবর্তক হিসাবে তার অসামান্য মেধা, রাষ্ট্র নায়ক হিসাবে তার অনন্য সাধারণ বুদ্ধিমত্তা এবং প্রশাসক হিসাবে তার অতুলনীয় দক্ষতা’। তিনি আরো বলেন, ‘পৃথিবীর মধ্যে যদি কোন মানুষ আল্লাহকে দেখে থাকেন, বুঝে থাকেন ও প্রকৃত পক্ষে পৃথিবীর কোন উপকার করে থাকেন, তবে এটা নিশ্চিত যে, তিনি হচ্ছে আরবের ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মুহাম্মাদ (ছাঃ)’।[14] ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুর বলেন, মুহাম্মাদ (ছাঃ) যে যুগে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাকে শুধু সেই যুগেরই একজন মনীষী বলা হবে না, বরং তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষী।[15]

ফরাসী রাষ্ট্রনায়ক নেপোলিয়ন বোনাপোর্ট (১৭৬৯-১৮২১) বলেন, ‘আমি আশা করি এমন একটি সময় বেশী দূরে নয় যখন আমি সকল  দেশের বুদ্ধিজীবী এবং বিদ্বান ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে ঐক্যমত গড়ে তুলতে পারব এমন একটি একক শাসক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য। যা কেবল পবিত্র কুরআনের মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। কারণ হ’ল, কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ যা সত্য এবং মানুষকে সুখ এবং শান্তির পথে পরিচালিত করে।[16] হিন্দুদের পুরাণ শাস্ত্রে রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) কে নরোশংস বা প্রশংসিত বলা হয়েছে।[17] এবং ঝগ্বেদের ভাষায় বলা হয়েছে, যো রোক্ষনো মাঘ নস্য কীরে।[18] সংস্কৃত ভাষায় ‘কীরে’ শব্দের বাংলা অর্থ ইশ্বরের প্রশংসাকারী। যার আরবী প্রতিশব্দ আহমাদ।

সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের শ্যালিকা ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং বলেন ‘আল্লাহ আমাকে মদ পান থেকে মুক্তি দিয়েছেন, এবং আমার দিন শুরু হয় ফযরের ছালাত দিয়ে’।

সুনতা নেপোলিয়ান ০৯-০৭-১১ সালে চাঁদে গিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন ‘আমি যখন চাঁদে দিয়েছিলাম পৃথিবীর সাথে আমার যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ ছিল, কিন্তু আমি চাঁদ থেকে আযান শুনতে পাচ্ছিলাম এবং সমস্ত পৃথিবী যখন অন্ধকার ছিল, তখন আরবমরু মক্কা ও মদীনা আলোকিত ছিল’।

বিভিন্ন মনীষীর বাণী এবং হিন্দুদের ধর্ম শাস্ত্রের আলোকে বুঝা গেল ইসলাম এবং ইসলামের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) সর্বশ্রেষ্ঠ যা তারা অকপটে স্বীকার করেছেন। অথচ বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আধুনিকতার ধ্বজাধারী বাক স্বাধীনতাবাদীদের ইসলাম ও মুহাম্মাদ (ছাঃ) কে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করছে। তাদেরকে আমরা আহবান জানাই আপনারা ইসলাম, মুহাম্মাদ (ছাঃ) এমনকি আল্লাহকে নিয়ে কটাক্ষ করেছেন। তারা ইসলামের ধর্মগ্রন্থ গুলো নিরপেক্ষভাবে অধ্যয়ন করলে, তারাও সোনার মানুষে পরিণত হবেন। ডক্টর গ্যারি মিলার কানাডার একজন খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচারক কুরআনের ভুল খুঁজতে গিয়ে সূরা নিসার ৮২ নং আয়াত পড়তে আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণীতে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এভাবে যুগে যুগে মানুষেরা ইসলামের সাম্যের বাণী অনুধাবন করে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিচ্ছেন। ইসলাম কারো প্রতি যুলুম অত্যাচার করে না। বরং শান্তিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকার প্রতি মানুষকে আহবান করে।

বানী ইসরাঈলের এক ব্যক্তি ৯৯ টি খুন করার পরে দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ আলেমের সন্ধান করল। অতঃপর সে একটি পাদ্রীর নিকটে গেল, কিন্তু পাদ্রীর নিরাশাপূর্ণ কথা শুনে ঐ ব্যক্তি পাদ্রীকেও হত্যা করে ১০০ জনকে হত্যা করল। অতঃপর সে একজন আলেমের সাথে কথা বলল, আলেম তাকে তাওবা করতে বললেন, এবং তাকে তার এলাকা ছেড়ে অন্য জায়গায় যেতে বললেন। পথিমধ্যে লোকটি মারা গেল। অতঃপর জান্নাতের ও জাহান্নামের ফেরেশতা তার রূহ নেয়ার জন্য ঝগড়া শুরু করল। অবশেষে আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণীতে দেখা গেল সে ভালো গ্রামের দিকে বেশী অগ্রসর হয়েছে। অবশেষে রহমতের ফেরেশতা তার জান কবয করল। (অর্থাৎ তিনি জান্নাতে প্রবেশ করলেন)। [19]

অন্যদিকে ছুমামাকে ধরে মসজিদে নববীর খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা হ’ল ও রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন ওহে ছুমামাহ! তুমি কি মনে করছ? সে বলল, আমার ধারণা ভালই। হে মুহাম্মাদ! যদি আপনি আমাকে হত্যা করেন তাহ’লে অবশ্যই আপনি একজন খুনীকে হত্যা করবেন। আর যদি আপনি অনুগ্রহ করেন, তাহ’লে একজন কৃতজ্ঞ ব্যক্তির উপরই অনুগ্রহ করবেন। আর যদি আপনি মাল চান, তাহলে যা ইচ্ছা চাইতে পারেন, তা আদায় করা হবে। তার কথা শুনে রাসূল (ছাঃ) তাকে (সেদিনের মত তার নিজের অবস্থার উপর) ছেড়ে দিলেন। রাসূল (ছাঃ) এভাবে তাকে তিনদিন ইসলামের কথা বললেন আর ছুমামাহ বারংবার একই উত্তর দিচ্ছিলেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাকে ছেড়ে দিলেন এবং সে মসজিদের নিকটে খেঁজুর বাগানে একটি পুকুরে গোসল করে এসে ইসলম গ্রহণ করলেন।[20]

অনুরূপভাবে আবূ যর, আবূ নাজীহ (রাঃ) সহ অনেক ছাহাবী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সোনার মানুষে পরিণত হয়েছিল এবং ইসলাম ইতিহাসে আজও তাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। বর্তমান যুগেও মানুষেরা ইসলামের সুমহান আদর্শে বিমোহিত হয়ে ইসলামের পতাকাতলে আশ্রয় নিচ্ছে নিমেণ কয়েকটি ঘটনা উপস্থাপনা করা হ’ল। নববই দশকে বলিউড কাঁপানো জনপ্রিয় অভিনেত্রী মমতা কুলকার্নি ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তিনি গত ১৪ বছর গরুদেব গগন গিরিনাথের শিষ্যত্ব হয়ে, কঠোর হিন্দু ধর্মের তপস্যা করেন।

এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি পরিপূর্ণভাবে ব্যবসা ও ধর্ম নিয়ে ব্যস্ত আছি। তিনি বলেন, কেউ পৃথিবীতে এসেছে পার্থিব কারণে। কেউ এসেছে স্রষ্টার আরাধনা করতে। আমি এসেছি দ্বিতীয়টি তথা স্রষ্টার আরাধনা করতে’। তাকে চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘ঘি ফিরে দুধ হ’তে পারে, আমার নায়ক শাহরুখ, আমীর, সালমান বদলেও যেত, কিন্তু মমতাকে আর মিডিয়ার পর্দার সামনে পাওয়া যাবে না। এটি একেবারেই অসম্ভব। আমার জগত এখন ভিন্ন। এ জগতে এখন শুধু স্রষ্টার স্থান।[21] অনুরূপ ‘কালি’ নামের বলিউডের এক নায়িকা, তার বাড়ি আমেরিকাতে। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পূর্বে শর্ট জামা-কাপড় পড়তেন। অতঃপর কোন এক স্থানে ভ্রমণে গিয়ে ছালেহ নামের এক মুসলিম যুবকের সাথে পরিচয় এবং প্রেমে জড়িত হয়ে পড়েন। ও তার আচরণ দেখে তিনি মুগ্ধ হন ও অবশেষে ইসলাম গ্রহণ করেন। দেশে ফিরে এসে ২০১০ সালের আগস্ট মাসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন ও ছালেহ এ সাথে তার বিয়ে হয়। তিনি এখন হিজাব পরিধান সহ ইসলামের অন্যান্য বিধান মেনে চলেন। তিনি ইসলাম গ্রহণের পূর্বে বয়ফ্রেন্ডদের সাথে হই-হুল্লোড় করে রাত কাটাতেন। ছালেহের সাথে বিয়ে, হিজাব পরিধান ও ইসলাম গ্রহণ নিয়ে অনেকেই হাসি-তামাশা করে। তিনি এক সাক্ষাতকারে বলেন, ‘শুধু ছোট জামা-কাপড় পড়লেই মানুষ আধুনিক হ’তে পারে না’।[22]

আরো একটি ঘটনা কানাডার তার জন্ম সান্ত্রা নাডায়ি নামের একজন ইহুদী নারী। তিনি বলেন, ২০০৫ সালে আমি ভারত যাই। এটি ছিল আমার মায়ের মৃত্যুর দুই সপ্তাহ পর। আমি যখন সেখানে (ভারত) আমার ধুম ভেঙ্গে যায়। আযানের শব্দের সেই সম্মোহনী শক্তি আমাকে মুগ্ধ করে। আমি আসলে কিছুটা আতঙ্ক গ্রস্থ হয়ে পড়ি। আমি জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। দূর থেকে ভেসে আসা এই আযান আমার মনে পরিপূর্ণ সুখ, শান্তি ও একতার অনুভূতি সৃষ্টি করে। আমি আনন্দে কেঁদে ফেলি। আমার এই কান্না ছিল বিশ্বাসের কান্না।

অতঃপর তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন ও তার নাম রাখা হয় সালমা। তিনি বলেন, ‘আমি আমার সহকর্মীদের কাছ থেকে যে অভ্যর্থনা পেয়েছি তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিল মধুর। তবে কেউ কেউ মুখে ভেংচি কাটত, কেউ আবার কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত, এবং আমার অনেক সহকর্মী আমার ডেস্কের পাশ দিয়ে যেতে সঙ্কোচবোধ করত’।[23]

সুধী পাঠক-পাঠিকাগণ! উপরে উল্লেখিত ঘটনাগুলো দ্বারা দিবালোকের ন্যায় প্রমাণ হ’ল যে, ইসলাম সাম্য, মৈত্রী, ভালবাসা ও শান্তির ধর্ম। যা কারোও প্রতি যুলুম-অত্যাচার করে না। বরং ইসলামের পতাকাতলে আশ্রয় নিয়েছে, নিচ্ছে ও নিবে। কিন্তু তথা কথিত বাকস্বাধীনতাবাদী, জাতীয়তাবাদী, নারীবাদী ও গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী কিছু শিক্ষিত লোক রয়েছে তারা বাক স্বাধীনতার নামে ইসলাম নিয়ে, আল্লাহ, মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও মুসলিমদের নিয়ে কুমন্তব্য করছে। তাদেরকে উক্ত ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষার্জন করতে হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন!

লেখক : সহ-পরিচালক, সোনামণি, মারকায শাখা

[1]. ড. মুহাম্মাদ ফজলুর রহমান, আল-মু‘জামুল ওয়াফী (আরবী-বাংলা), রিয়াদ প্রকাশনী, ৮ম সংস্করণ মে ২০১১, পৃ. ৯৯।

[2]. S.M Zakir Hussain, Second Edition : February 2009, ROHEL Elaborate DICTIONARY English to Bengali.

[3]. المعجم الوسيط, كتب خانه حينيه ديوبندد ৬৮৫ ص

[4]. বুখারী হা/১৩৮৫, আবুদাউদ হা/৪৭১৪।

[5]. বুখারী হা/৩৯; মিশকাত হা/১২৪৬।

[6]. ডা. যাকির নায়েক, ইসলাম এন্ড মিডিয়া লেকচার।

[7]. মুসলিম হা/৩০০৫; আহমাদ হা/২৩৯৭৬।

[8]. সীরাতে ইবনে হিশাম-টীকা ১/৩৪৫; আর-রাহীক্ব পৃ.১০৪।

[9]. বুখারী হা/৩৮৮৪।

[10].আহমাদ হা/২৩৬৮৪ সনদ হাসান।

[11]. বুখারী হা/৩০৬২

[12]. বুখারী হা/৪১, ঈমান পর্ব, সুন্দরভাবে ইসলাম গ্রহণ অধ্যায়।

[13]. Sarojini Naidu, Ideals of Islam, Nide Speeches & writing (1918), p-169.

[14]. Mejor Arthur Glyn Leonard, Islam her moral and spirituae values.

[15]. মাইকেল এইচ হার্ট, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মনীষীর জীবনী, চৌধুরী এন্ড সন্স প্রকাশনী, জানুয়ারী ২০০১, পৃ.২০।

[16]. Nepolean Benaparte-Quoted in christion Cherfils BONAPARTEEL ISLAM CPARIS-1914.

[17]. ভাগবত পুরান, বণব্রেত সেন সম্পাদিত (কলিকাতা : হরফ প্রকাশনী, ১৯৭৭) ঋগ্বেদ, সংহিতা, স্বন্ধ-৫, অধ্যায়-৫, শ্লোক-২।

[18]. ঋগ্বেদ ; সংহিতা, স্বন্ধ-২, অধ্যায়-১২, শ্লোক-৬।

[19]. বুখারী হা/৩৪৭০, মুসলিম হা/২৭৬৬, মিশকাত হা/২৩২৭। 

[20]. বুখারী হা/৪৬২; মুসলিম হা/১৭৬৪; মিশকাত হা/৩৯৬৪।

[21]. মাসিক আত-তাহরীক, ১৬ তম বর্ষ, ১২তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর-২০১৩, পৃ.৩৩।

[22]. দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, বৃহস্পতিবার, ২২-০৮-১৩ ইং; পৃ.১, প্রেমের কারণে অভিনেত্রী কালির পরিবর্তন শিরোনামে।

[23]. তাওহীদের ডাক, ২২ তম সংখ্যা, মার্চ-এপ্রিল-২০১৫, পৃ. ৪১-৪২।




আরও