মেঘের রাজ্য সাজেকে (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব 8781 বার পঠিত

সাজেক ভ্যালীটা মূলতঃ একটি পাহাড়ের চূড়া, যেটা প্রস্থে অল্প তবে দৈর্ঘ্যে প্রায় ২ কিলোমিটার। আশপাশের থরে থরে সাজানো পাহাড়গুলি এর চেয়ে বেশ নীচু। ফলে উভয় পাশের সৃষ্টিসৌন্দর্য খুব ভালোভাবেই অবগাহন করা যায়। বাইরে দু’কদম ফেলতেই দেখি ঘন ঘাসের চাদরে মোড়া ছোট ছোট একাধিক টিলা। সবুজের তীব্রতায় চোখ ধাঁধিয়ে যায়। উপরে কাষ্ঠ নির্মিত চেয়ার সাজানো। সেখানে কিছুক্ষণ বসে চারপাশের দৃশ্য দেখতে লাগলাম। পূর্বের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী পাহাড়ের অকৃত্রিম সৌন্দর্যে চোখ জুড়াতে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের বিকল্প নেই। তাই ভাবতেই পারিনি হাইকিং, ট্রেকিং-এর কোন কষ্ট ছাড়াই আরাম কেদারায় বসে কেতাদুরস্তভাবে নয়নাভিরাম এ সৌন্দর্য দর্শনের সুযোগ পাব। যাইহোক কিছুক্ষণ অবস্থানের পর হাঁটতে হাঁটতে বিজিবির নির্মিত হেলিপ্যাডে উঠলাম। আরেকটু এগিয়ে পেলাম বিডিআর ক্যাম্প। যেখানে একটি মসজিদও আছে। মনটা প্রসন্ন হয়ে উঠলো। ইতিমধ্যে মাগরিবের আযান ধ্বনি ভেসে আসলো। ওযূ সেরে মসজিদে প্রবেশ করে বেশ ক’জন বয়স্ক পর্যটকের সাক্ষাৎ পেলাম। তবে যুবাদের উপস্থিতি শুন্য। কারণটা বোধহয় সর্বজন বিদিত। বিগত সফরে আন্তর্জাতিক ইসলামিক ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রামের কিছু ভাইয়ের সাথে কদিন ছিলাম একত্রে। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন নিয়মিত ছালাত আদায় করেন বলে জানান। তবে সফরে তা করেন না। কারণ অধিক পরিশ্রম! সব ছালাতই বাকীর খাতায়। কঠোরভাবে হিসাব রাখছেন বাসায় গিয়ে কাযা আদায় করবেন তাই। বিস্ময়কর পরিকল্পনা। তবে বাস্তবতা এরূপই। ছালাতের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে দেখি সবই জানেন। সবই বোঝেন। কিন্তু আমলী যিন্দেগীতে এসে ধরা খেয়ে যাচ্ছেন। আল্লাহ হেফাযত করুন।

এই মসজিদে ইমামতি করেন বিডিআরে চাকুরীরত জনৈক ড্রাইভার। ছালাতের পূর্বে তিনি সবার উদ্দেশ্যে কয়েক মিনিট ছালাতের গুরুত্ব ও মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। তারপর ছালাত আদায় করলেন। ছালাত শেষে সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর তার সাথে পরিচিত হলাম। ড্রাইভার হলেও ভাব-ভঙ্গিতে বেশ জ্ঞানের পরিচয় দিতে চাইলেন। কিছুটা পরিচিত হওয়ার পর একটু নরম হলেন।

কথার একপর্যায়ে বললেন, কুরআনের সাথে হাদীছের বিরোধ নিয়ে উনি খুব বিরক্ত। কে যে এসব হাদীছ সংকলন করেছেন। পরে বুখারীর একখানা অনুবাদ বের করে এনে বের করলেন ঘোড়ার গোশত খাওয়া সংক্রান্ত হাদীছ। বললেন, কুরআনে এসবের গোশত খাওয়া নিষেধ। অথচ এ হাদীছ বলে কিনা তা খাওয়া যাবে!... এসব নতুনভাবে সংকলন করতে হবে। কুরআন বিরোধী হাদীছ বাদ দিতে হবে। হাদীছই মুসলমানদেরকে দলে দলে বিভক্ত করেছে....। ইত্যাদি ইত্যাদি বক্তব্য। কিছুটা বুঝানোর পর নরম হন। তবে তালগাছটা আমার। হাদীছে যত এলার্জি। বাদ দিলে ভালো হয়। যাইহোক আলোচনা খুব দীর্ঘ না করে চলে এলাম।

নিকষ আধারে ঢেকে নিয়েছে চারিদিক। তবে বিজিবি ক্যাম্প জেনারেটরের আলোয় কিছুটা আলোকিত। আরেকটি হেলিপ্যাডে উঠে গেলাম তিনজনে। বসলাম ঘাসের চাদরে। সামনে দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়ের সারি। চাঁদের আলোয় সামান্যই দেখা যায়। দূরে সীমান্তবর্তী ক্যাম্পের কয়েকটি আলো মিটিমিটি জ্বলছে। সাজেক থেকে তারা প্রয়োজনীয় রসদ নিয়ে হেলিকপ্টরে চলে যায় সেখানে। তারপর দেড় মাস পর ডিউটি পরিবর্তন হয়। এভাবেই চলে নির্জন সীমান্তে বিজিবির প্রহরা।

নীরব-নিস্তব্ধ পাহাড়ে বেশ কিছু সময় কাটিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। সেনাবাহিনীর ভাইয়েরাই সেখানে রান্না থেকে শুরু করে সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। আগে থেকেই অর্ডার দেওয়া রাতের খাবার খেতে বসলাম পাহাড়ী ঢালের উপর নির্মিত হোটেলটির খোলা বেলকনিতে। দুপুরটা এটা ওটা খেয়েই চালিয়ে দিয়েছিলাম। তাই রাতে ডিম আর ডাল দিয়ে খেয়ে নিলাম পেটপুরে। তারপর ঘরে ফিরে শুরু হ’ল প্রশান্তির ঘুম।

ফজরের সময় কাফী ভাইয়ের ডাকে উঠে পড়লাম। চললাম মসজিদ পানে। অন্ধকারে নিস্তব্ধ পাহাড়ী ঢাল বেয়ে মসজিদে গেলাম। বেশ কয়জন বিজিবি ভাইও উপস্থিত হয়েছেন দেখে খুব ভাল লাগল আলহামদুলিল্লাহ। তারপর কিছুক্ষণ কুরআন তেলাওয়াত করে বেরিয়ে পড়লাম সূর্যোদয় নান্দনিক দৃশ্য অবলোকনে। বাদ ফজর যেকোন প্রকৃতিই ভিন্ন মাত্রায় ফুটে ওঠে। আর পাহাড়ী এলাকা! সেতো বর্ণনাতীত। কিছুসময় বসে থেকে সূর্যোদয় দেখে এবার হাটতে শুরু করলাম কংলাক পাড়ার দিকে। মিনিট চল্লিশেক হেটে পৌঁছে গেলাম কাংখিত লক্ষ্যে। এলাকাটি বেশ উচুতে অবস্থিত পাহাড়ী চূড়ায় অবস্থিত। নীচ থেকে পাড়ায় পৌছানোর একটিই পথ। কিছুটা দূর্গম। রাতে ওঠা-নামা কঠিন।

ছবির মত সুন্দর গ্রাম কংলাক পাড়া। প্রতিটি বাড়ীর সামনে রয়েছে ফুলের বাগান। ১৮০০ ফুট উচ্চতায় এই পাড়ায় পাংখোয়া আর ত্রিপুরা জনগোষ্ঠির প্রায় ৩০টি পরিবারের বসতি। পাহাড়ের ঢালে চা বাগান, পাহাড়ের বিভিন্ন অংশে কফি গাছ, আনারস গাছ। আর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে একটু নীচে নামলে রয়েছে কমলা বাগান। দূর্লভ সুগন্ধি ‘আগরৎ গাছেরও দেখা মেলে এখানে। এককথায় চমৎকার একটি গ্রাম। ওখানে পৌঁছে পাশেই দোকান পেলাম। ডাব, পেপে আর কলা খেলাম। দোকানী জানালো সে পাশ্ববর্তী মিজোরামে পড়াশুনা করে। ছুটিতে এখন বাড়িতে। ওখানে পৌঁছে পাশেই দোকান পেলাম। ডাব, পেপে আর কলা খেলাম। দোকানী জানালো সে পাশ্ববর্তী মিজোরামে পড়াশুনা করে। ছুটিতে এখন বাড়িতে এসেছে। এরপর চলে গেলাম পাহাড়ের প্রান্তসীমায়। প্রকৃতি যেন এখানে আরো মায়াবী। এখান থেকে অনেক নীচে দেখা যায় সাজেক পয়েন্ট।

দু’একটি হোটেল তৈরী হয়েছে এখানেও। চাল ও বেড়া টিনের তৈরী হলেও বেশ ছিমছাম আর পরিচ্ছন্ন হোটেলগুলি। একটির বারান্দায় প্লাস্টিকের ইজি চেয়ার পেয়ে বসে পড়লাম তিনজনে। সবুজ পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে কুয়াশা আটকে থাকার মোহনীয় দৃশ্য দেখতে দেখতে প্রায় ঘন্টা পার হয়ে গেল। সেখান থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে এক বয়স্ক মুরুববীকে পেয়ে আলাপ জমানোর চেষ্টা করলাম। ভাষাগত সমস্যা খুব একটা হ’ল না। ২০০ বছর যাবৎ এই পাহাড় চূড়ায় তাদের বসবাস। আমাদের বেশ অবাক করে দিয়ে জানালেন, সেনাবাহিনী সাজেক পর্যন্ত রাস্তা তৈরীর আগে তারা সভ্য দুনিয়ার কোন খোঁজ-খবরই রাখতেন না। ভাবতেন গোটা দুনিয়ায় মনে হয় এরূপ বন্যতায় ভরা পাহাড়ী অঞ্চল। এই রাস্তা তাদের জীবনের গতি পাল্টে দিয়েছে। হাতে থাকা হুকায় টান লাগানোর দাওয়াত দিলেন। আমরা হাসতে হাসতে সহজ-সরল মানুষটির নিকট থেকে বিদায় নিলাম।

তারপর আরো কিছুক্ষণ ঘোরাফিরার পর নেমে এলাম পাড়াটি থেকে। ব্যাগপত্তর গুছিয়ে ফোন দিলাম হোন্ডাওয়ালাদের। ঘন্টা পার হতে না হতেই তারা হাযির। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো একটি হোন্ডার চাকা পাংচার হওয়ায়। কি আর করা। ফলে তাদের পরিচিত একটি ট্রাক যেতে থামালে ড্রাইভার আমাদের নিতে রাজী হল। পাহাড়ী পথে ট্রাক যাত্রার অভিজ্ঞতাটা মন্দ হবে না ভেবে কোন আপত্তি ছাড়াই উঠে বসলাম তাড়াতাড়ি। মালবাহী ট্রাকটির উপজাতীয় ড্রাইভার উঁচু-নীচু দূর্গম পথের চড়াই-উৎরাইয়ের কোন তোয়াক্কা না করে চালিয়ে নিল উল্কার বেগে।

অজ্ঞতার কারণে সাজেকের রুইলুই পাড়া থেকে অনতিদূরে অবস্থিত কমলক ঝর্ণাটি আমাদের দেখার বাইরে থেকে যায়। পাড়া থেকে মাত্র আড়াই ঘন্টার পথ ট্রেকিং করলে দেখে আসা যায় সুন্দর এই ঝর্ণাটি। স্থানীয় অনেকের কাছে এটি পিদাম বা সিকাম তৈসা ঝর্ণা নামেও পরিচিত।

১০ নং ক্যাম্পের সামনে মাসঊদ ভাই আমাদের রিসিভ করলেন। তারপর নাস্তা সেরে গোসলের প্রস্ত্ততি নিয়ে চললাম ক্যাম্প থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হাজাছড়া ঝর্ণায়। মেইন রোড থেকে ১৫ মিনিট হাটার দুরত্ব। প্রায় দেড়শ’ ফুট উঁচু থেকে নেমে আসা প্রাকৃতিক ঝর্ণাটি সারা বছর প্রবাহমান থাকে। জাদিপাই, নাফাখুম, আমিয়াখুম ইত্যাদির তুলনায় খুব অল্প পরিশ্রমেই সুন্দর একটি ঝর্ণার দেখা পেয়ে আমরা বেজায় খুশী। প্রাণভরে গোসল সারব। কিন্তু সেখানে গিয়ে বিপত্তি ঘটালো ঝর্ণার নীচে একদল পর্যটকের হৈ হল্লা। ফলে বিশাল ঝর্ণায় গা ভিজানোর লোভ সামলে ফিরতি পথ ধরলাম।

মাসঊদ ভাইয়ের সাথে স্থানীয় একটি হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। তিনি আমাদের জন্য বড় এক কাঁদি পাহাড়ী কলা কিনে দিলেন। এসময় হঠাৎ শুরু হ’ল প্রবল বর্ষণ। একটি চাঁদের গাড়ি পেয়ে তাতেই চড়ে বসলাম। অল্প সময়ের মধ্যে দীঘিনালা পেঁীছে সিএনজি নিলাম। বিকাল হ’তে হ’তেই খাগড়াছড়ি শহরে পৌঁছালাম। সেখানে চট্টগ্রামগামী শান্তি পরিবহনে সন্ধ্যা ৭-টার টিকিট নিয়ে এবার চললাম খাগড়াছড়ির বাকি স্পটগুলি দেখার জন্য। সিএনজি নিয়ে চলে গেলাম খাগড়াছড়ি শহর ঘিরে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে থাকা আলুটিলা পাহাড়ে। এখানে রয়েছে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত আবিস্কৃত গুহাদু’টির একটি। তবে বান্দরবানের আলীকদম গুহাটির তুলনায় এটি বড়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় আমরা সেখানে একেবারেই একা। জীবনে প্রথম প্রাকৃতিক গুহায় প্রবেশের সুযোগ। আগেই জেনেছি গুহাটি এ মাথা থেকে ওমাথা যেতে ১৫ মিনিট সময় লাগবে। তাই নির্ভয়ে সঙ্গে নেওয়া টর্চ লাইট জ্বালিয়ে ঢুকে গেলাম ভিতরে। চারপাশটা নিরেট পাথুর। পায়ের নীচ দিয়ে অবিরল ধারায় ঝর্ণার পানি বয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে আবার বাদুড়ের আনাগোণা। একটু যেতেই নিকষ আধারে নেমে এলো চারপাশে। চলার পথ আরো সংকীর্ণ হয়ে আসছে। পরিবেশটা সত্যিই ভয়ংকর। অবশ্য একটু পরেই অপরপার্শ্বে আলোর রেখে ফুটে উঠলো। গুহামুখের বড় বড় পাথর ডিঙ্গিয়ে উঠে এলাম আবার আলোর দুনিয়ায়। ফেরার পথে কাফী ভাই পাহাড়ী কাঠাল আর আনারস কেনার গোঁ ধরলেন। বাজারে গিয়ে সেগুলি কেনা হ’ল। তারপর সোজা বাসস্ট্যান্ডে। সেখানে আরেক বিপত্তি। আগামী কাল হরতাল। তাই বাস বন্ধ। ঘন্টা দুই অপেক্ষার পর নিশ্চিত হ’লাম যে আজ আর ফেরার কোন উপায় নেই। বাধ্য হয়ে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। পাশের হোটেল মালিকের সাথে ইতিমধ্যে বেশ ভাব জমে গেছে। তার পরামর্শে পাশের রাজু বোর্ডিং রাত কাটালাম।

পরদিন সকালে নাস্তা সেরে শহর থেকে ১০-১২ কি.মি. দূরে অবস্থিত রিসাং ঝর্ণাটা দেখে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। মেইন রোড থেকে দেড় কি.মি. পাহাড়ী কাঁচা রাস্তায় চলল সিএনজি। তারপর এক জায়গায় নামিয়ে দিল। বাকী পথটা হেঁটেই যেতে হবে। আবারো দু’পাশে সারি সারি সবুজ পাহাড়। ঢালু পথে নামতে নামতে একসময় পৌঁছে গেলাম কাংখিত ঝর্ণায়। পাহাড়ের বুক চিরে প্রায় ৪০ ফুট উপর থেকে স্বচ্ছ পানিরাশি অবিরাম আছড়ে পড়ছে নীচে। নীচে পড়ার পর তা আবার আরও ৭০ ফুট পাথরের ওপর গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে আরো অনেক নীচে। অব্যাহতভাবে পানি পড়ায় চারপাশটা পাথরে রুপান্তরিত হয়েছে। ঝর্ণা ধারায় পিচ্ছিল হয়ে যাওয়া পাথুরে পথে সলাইডিং করার জন্য খুব আদর্শ একটি ঝর্ণা এটি। কিছুটা বিপজ্জনক হলেও রোমাঞ্চকর। এই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ঝর্ণাটিতে এনে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা।

আরো খুশী হলাম আর আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম মাত্র ২জন কিশোরকে সেখানে গোসল করতে দেখে। কারণ নির্জনতাই আমাদের জন্য যে যেকোন প্রাকৃতিক স্পটের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। দ্রুত নেমে গেলাম গোসলে। ঝর্ণার পতনেস্থলে ঢুকে গেলাম তিনজনে। নির্জন পাহাড়ের কোলে ঝর্ণার স্বচ্ছ পানির নীচে বসে থাকার যে অনির্বচনীয় আনন্দ, তা কি বলে বুঝানো সম্ভব!

কিছুক্ষণ গোসল করে আমরা সলাইডিংয়ে নামার জন্য প্রস্ত্তত হলাম। আগেই জেনেছিলাম নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এখানে কারু পা ভেঙ্গেছে, কারু মাথা ফেটেছে। তাই একটু সতর্ক। প্রথমে তিনজন একসাথে করলাম। তারপর একা একা। অর্ধেক পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ থাকলের বাকী অর্ধেক নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব হয় না। আছড়ে পড়তে হয় নীচে জমে থাকা পানির মধ্যে। কাফী আর সাইফুল ভাই তো মেতে গেছেন ভীষণভাবে। বার কয়েক সলাইডিং করতেই গামছা ছিড়ে ছারখার। এদিকে ঘটলো আরেক বিপত্তি। সাইফুল ভাই ঝরণার পাশে হাটাহাটি গিয়ে হঠাৎ পিছলে পড়ে গেল। উপর দিকে পা আর নীচের দিকে মাথা অবস্থায় পিছলে সোজা চলে যাচ্ছেন নীচের দিকে। ঘটনার আকস্মিকতায় বিহবল আমরা অসহায় নেত্রে চেয়ে চেয়ে দেখছি আর দো‘আ পড়ছি। নিয়ন্ত্রণহীনভাবেই আছড়ে পড়লেন নীচের পানিতে। ছুটে গেলাম। না আল্লাহর রহমতে কোনই ক্ষতি হয়নি। মন শক্ত হওয়ায় তেমন ভয়ও পাননি। ফালিল্লাহিল হামদ।

ঘন্টা দেড়েক অবস্থানের পর ফিরতি পথ ধরলাম। পরবর্তী গন্তব্য আলুটিলা তারেং। আলুটিলা পাহাড়ের একটি চূঁড়া। ত্রিপুরা ভাষায় ‘তারেং’ শব্দের অর্থ ‘উঁচু পাহাড়’। তারেং থেকে পুরো শহরটা একনযরে দেখা যায়। দেখা যায় শহরের মাঝখান দিয়ে সাপের মত এঁকে-বেঁকে বয়ে যাওয়া অপরূপ সুন্দর চেংগী নদীর দৃশ্য। আশপাশে চোখে পড়ে অসংখ্য জুমখেত। আনারস, কমলা ও সবজির বাগান।

সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। বেলা ১-টার গাড়িতে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলাম। পথে কাফী ভাই কলা, আনারস, কাঠাল, ডাব সহ নানা ফলমুল কিনলেন গাড়ি ভর্তি করলেন। এসব বহনের ঝুট-ঝামেলায় আমি বিরক্ত। কাফী ভাইয়ের যুক্তি এগুলো নাকি একেবারেই সারবিহীন প্রাকৃতিক ফল। আমার যুক্তি একদিন খেয়ে লাভটা কোথায়! যাহোক চট্টগ্রাম পৌঁছে সেখানে আত্মীয়ের বাসায় একদিন অবস্থান করে পরদিন সন্ধ্যায় রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলাম। ফালিল্লাহিল হামদ  



বিষয়সমূহ: ভ্রমণস্মৃতি
আরও