তিন বন্ধুর গল্প
মুহাম্মাদ লাবীবুর রহমান
মুহাম্মাদ লাবীবুর রহমান 10284 বার পঠিত
মোরগ ভাই, কোথায় যাচ্ছো? আরে
এদিকে এসো। কথাগুলো বলল গাধা। গাধার কথা শুনে মোরগ তার নিকট এসে বলল, কি
ব্যাপার গাধা ভাই, ডাকছো কেন? গাধা বলল, আজ আমাদের বাড়ির মালিক তো নেই।
সন্ধ্যার আগে তারা হয়তো ফিরবে না। তাই বলি আজকের দিনটা একটু সুখ-দুঃখের
গল্প করে কাটিয়ে দেই। এমন দিন হয়তো আর পাব না। আর তুমিও তো ঈদের দিন আমাদের
ছেড়ে চলে যাবে। মোরগ অবাক চাহনিতে জিজ্ঞেস করল, কে বলল আমি চলে যাব? গাধা
বলল, জানো মোরগ ভাই! গতকাল যখন মালিকের সাথে বোঝা নিয়ে যাচ্ছিলাম তখন
পথিমধ্যে এক গোশত বিক্রেতার সাথে মালিকের দেখা হয়। মালিক তার সাথে অনেক
গল্পালাপ করার পর শেষে বলল, বাড়িতে একটা মোরগ যবেহ করব। এবার আর গোশত কিনব
না। একথা শুনে আমার খুব খারাপ লেগেছিল। কিন্তু করার কিছু নেই। কথাগুলো শুনে
মোরগের মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলল, গাধা ভাই! দুঃখ
করে কি হবে বলো। মালিক যখন যাকে ইচ্ছা তাকেই যবেহ করে খায়। এ বয়সে চোখের
সামনে তো কতজনকেই চলে যেতে দেখলাম। অতএব আমাকেও যেতে হবে। ইতিমধ্যে কুকুর
এসে হাজির হয়ে বলল, তোমরা দু’জনে কি গল্প করছো? ও কুকুর ভাই, তুমি এসেছো!
ভাবছিলাম তোমাকেও ডাকতে পাঠাব। বলল গাধা। কুকুর বলল, কেন বলতো? গাধা বলল।
আজতো বাড়ির মালিক নেই। তাই ভাবছি তিনজনে বসে একটু সুখ-দুঃখের গল্প করি।
‘তাই নাকি! তাহ’লে তো বেশ মজাই হয়। তবে আর দেরি কেন? শুরু কর। বলল কুকুর।
গাধাঃ মোরগ ভাই, তোমার কাছে একটা বিষয় জানতে ইচ্ছে করছে। প্রতিদিন ভোরে তুমি ডানা ঝাপটে নিয়ে ডাকতে শুরু কর কেন?
মোরগঃ আল্লাহ আমাকে ফেরেস্তাদের দেখার ক্ষমতা দিয়েছেন। তাই ফেরেস্তাকে দেখলেই আমি ডাকতে শুরু করি। আল্লাহর ম’ুমিন বান্দাদের ছালাতের জন্য জাগিয়ে তুলি। জানো, আমার ডাক শুনলে তাদেরকে একটি দো‘আ পড়তে হয়।
গাধাঃ তুমি জানলে কি করে?
মোরগঃ একদিন আমি মসজিদের উঠানে ডেকেছিলাম। সেদিন মসজিদের বারান্দায় এক ওস্তাদ ও তার ছাত্ররা বসা ছিলো। তখন ওস্তাদ তার ছাত্রদের একথা বলেছিলেন।
গাধাঃ মোরগ ভাই, আমাদের মালিক তো ছালাতই পড়ে না। বরং ভোরে যেন নাক ডেকে ডেকে ঘুমায়। আর তোমার ডাক শুনে দো‘আ পড়বে কখন। হি...হি...হি...। জানো মোরগ ভাই, আমি শয়তানকে দেখতে পাই। আল্লাহ আমায় এ ক্ষমতা দিয়েছেন। আর আমার ডাক শুনলে ও তাদের দো‘আ পড়তে হয়।
কুকুরঃ আমিও তো তোমার মত শয়তানকে দেখতে পাই। তখন আমিও চিৎকার করে উঠি। তবে আমার চিৎকার শুনলেও তো তাদের দো‘আ পড়তে হবে।
গাধাঃ ঠিক বলেছো। তবে আল্লাহর বান্দারা বড়ই অবাধ্য। আল্লাহর হুকুম পালন করে না। আমার মালিকের কথাই বলি- একদিন পিঠে বোঝা নিয়ে মালিকের সাথে পথ চলছিলাম। পথে শয়তানের আক্রমণে হঠাৎ হোঁচট খেলাম। সঙ্গে সঙ্গে ডেকে উঠলাম। মালিক তখন দো‘আ পড়ে শয়তানকে না তাড়িয়ে আমার গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল।
কুকুর : গাধা ভাই, আমাদের মালিক আসলে ভালো লোক নয়। ওরা পোলাও গোশত খায়, আর আমি হাড়-হাড্ডি খেয়ে ওদের আনুগত্য করি। তবুও আমায় লাথি মারে, আমার দিকে ইট-পাটকেল ছোঁড়ে।
গাধাঃ জানো কুকুর ভাই, আমার এক স্বজাতি ভাইয়ের মালিক খুব ভাল। তাকে পথের মধ্যে বিশ্রাম দেয়। পথিমধ্যে আযান হ’লে তার মালিক ছালাতে যায়। এভাবে সে কিছুক্ষণ বিশ্রাম পায়। ঐ যা ! আমাদের মালিক যে এসে পড়েছে। শিগ্গির তোমরা কেটে পড়ো। নইলে সন্দেহ করবে।
‘তুমি ঠিক বলেছো। এখানে আর থাকা যাবেনা’ বলে কুকুর দৌড়ে পালালো। মোরগও তার গন্তব্যে ফিরে এলো।
শিক্ষা :
১। মোরগের ডাক শুনলে ‘আল্লা-হুম্মা ইন্নী আস্আলুকা মিন্ ফায্লিকা’ পড়তে হয়।
২। গাধা ও কুকুরের ডাক শুনলে ‘আউযু বিল্লা-হি মিনাশ শায়ত্বা-নির রজীম’ পড়তে হয়।
সম অধিকারের পরিণাম
চর্তুপার্শ্বে কাঁটাবেড়া দ্বারা আবেষ্টিত বিশাল পুকুরের উপর তৈরি করা হয়েছে হাঁস-মুরগির খামার। যাতে ছানাসহ প্রায় শ‘দুয়েক মুরগি পালন প্রক্রিয়া চলছে। হাঁস গুলো পুকুরের সর্বত্র বিচরণ করে খাদ্যের সন্ধান চালায়। আর মুরগিগুলো শুধুমাত্র পুকুর পাড়ে খাদ্য অনুসন্ধান করে। কেননা পুকুরের পানি তাদের জন্য উপযোগী ও নিরাপদ স্থল নয়। তাই হাঁসগুলো যখন পুকুরের পানিতে ডুব দিয়ে ঠোঁটে মাছ সহকারে পানির উপর ভেসে ওঠে এবং তা মজা করে খায়, তখন মুরগিগুলো পাড়ে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য অবলোকন করে ও খুব আফসোস করে। অনেকের যেন জিভে জল এসে যায়। হাঁসের ছানাগুলো যখন পানিতে ডুব দেয়, সাঁতার কাটে, একে অপরকে ধাওয়া করে এভাবে খেলা করে এবং মাঝে মাঝে মাছ ধরে খায় তখন মুরগির ছানাগুলোর ও ঠিক অনুরূপ করার সাধ জাগে। তাই মুরগির ছানাগুলো একদিন তাদের মায়েদের কাছে পানিতে নামার আবদার করে বসল। মায়েরা বাচ্চাদের মুখে এ আবদার শুনে বাধা না দিয়ে বরং উৎসাহিত হ’ল। ফলে সকল মুরগি একত্রিত হয়ে একদিন মতবিনিময় সভার আয়োজন করল। এ সভায় প্রত্যেকে তাদের নিজ নিজ মতামত তুলে ধরল। একটি মুরগি বলল, একই গন্ডীর মাঝে আমাদের সবার বসবাস। অথচ হাঁসগুলো যখন যেখানে খুশি তখন সেখানে ইচ্ছেমত বিচরণ করছে। আর আমারা শুধুমাত্র পুকুর পাড়ে বিচরণ করছি। অপর একটি মুরগি বলল, তারা সকল প্রকার খাদ্যে ভাগ বসাচ্ছে। অথচ আমরা প্রতিনিয়ত অনেক খাদ্য হ’তে বঞ্চিত হচ্ছি। কিন্তু তাদের চেয়ে আমরা কোনো অংশে কম নই। তারা ডিম দেয়, মাংস দেয়। আমরাও এসব দিয়ে থাকি। তাদের বিষ্ঠা যেমন মাছের খাদ্য, আমাদের ও বিষ্ঠাও তেমনি মাছের খাদ্য। আর একটি মুরগি বলল, তুমি ঠিক বলেছো। আমরা তাদের চেয়ে কোনো অংশে কম নই। তবে অধিকারের ক্ষেত্রে কেন এ অনিয়ম থাকবে ? কেন আমরা বঞ্চিত হব? তাদের মত কেন সর্বত্র বিচরণ করতে ও কর্তৃত্ব খাটাতে পারব না ? এটা হ’তে পারে না। তালে তাল মিলিয়ে অপর এক মুরগি বলল, আমাদেরও পাখা রয়েছে। আমরাও উড়তে পারি। তবে কিসের ভয়ে আমরা পানিতে নামছি না ? কোনো সমস্যা হ’লে উড়াল দিয়ে ওপারে চলে যাব। অন্যসব মুরগি সুর মিলিয়ে একত্রে বলে উঠল, ঠিক বলেছো, ঠিক বলেছো। তবে আর দেরি কেন? চলো, আজকেই নামা যাক। যেই কথা সেই কাজ। সকল মুরগি দল বেঁধে পানির কিনারে গিয়ে দাঁড়ালো। এবার নামার পালা। হাঁসগুলো এ দৃশ্য দেখে বেশ অবাক হ‘ল। একটি হাঁস বলল, তোমরা কি করতে চাচ্ছো ? জবাবে এক মুরগি বলল, আমরাও আজ থেকে পানিতে নামবো , মাছ ধরে ধরে খাবো । হাঁসটি আবার বলল, তোমরা কেন এ ভুল করতে যাচ্ছো ? এ পরিবেশ তোমাদের জন্য উপযোগী নয়। তাকে থামিয়ে দিয়ে অপর এক মুরগি ধমকের স্বরে বলল, চুপ কর! আমাদের নামতে না দেয়ার ফন্দি আঁটছো? আমরা তোমাদের কোনো প্রকার কান ভাঙানিতে ভুলতে রাজি নই। অতঃপর বলল, ‘চলো সবাই, এবার নেমে পড়ি, বলে সকল মুরগি একত্রে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়লো। মুরগির ছানাগুলো পুকুরের পানিতে নাকানি-চুবানি খেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রাণত্যাগ করল। মুরগিগুলো পানিতে প্রাণপনে সাঁতরানোর চেষ্টা করল। কিন্তু ব্যর্থ হ‘ল। অতঃপর উড়াল দিয়ে পুকুর পাড়ে উঠতে চাইলো। অতিকষ্টে কিছু মুরগি পাড়ে উঠলো। বাকিগুলো ব্যর্থ হ‘ল। অবশেষে পুকুরের পানিতে তাদের জীবন সাঙ্গ হ‘ল। পাড়ে উঠা মুরগিগুলো ভীষণভাবে লজ্জিত হ‘ল।
শিক্ষা :
১। হাঁস গুলোকে পুরুষজাতি ও মুরগি গুলোকে নারীজাতি কল্পনা করে গল্প থেকে এ শিক্ষা পাই যে, পুরুষদের বিচরণ ও কর্তৃত্বের স্থল এবং নারীদের বিচরণ ও কর্তৃত্বের স্থল এক নয়। তাই সম অধিকারের নামে কোনো নারী যদি পুরুষদের সাথে তালে তাল মিলিয়ে সর্বত্র নিজেকে জাহির করতে চায় তবে ইহকাল ও পরকাল উভয় জীবনেই দুর্ভোগ নেমে আসবে। কাজেই নারী জাতিরা সাবধান হৌন!
২। অহি-র জ্ঞানাভাবে নবীন, প্রবীণ সকলেই এরূপে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। যার দরুণ অনেক সময় জীবনের চরম মূল্য দিতে হয়। তাই অহি-র জ্ঞান অর্জন অপরিহার্য।
দুনিয়াবী শিক্ষার কুফল
অতীতে এক প্রতাপশালী মুসলিম রাজা ছিল। যার দাপটে প্রজাগণ ভয়ে ভয়ে কালাতিপাত করত। রাজার ছিল তিন পুত্র। তিন পুত্রকেই উচ্চ ডিগ্রী অর্জনের জন্য ক্রমান্বয়ে লন্ডনে পাঠিয়েছিল। তাই পুত্রত্রয়ের প্রত্যেকেই ছিল উচ্চ শিক্ষিত। কিন্তু ধর্ম বলতে তাদের মাঝে ধর্মীয় উৎসব অনুষ্ঠানকেই যেন বুঝত। রাজা যখন মৃত্যু শয্যায় শায়িত হ‘ল তখন তিন পুত্র মিলে শ‘খানেক হাফেজকে ডেকে এনে জাঁকজমকভাবে কুরআন তিলাওয়াতের আসর বসালো। প্রায় ঘণ্টা পাঁচেক কুরআন তিলাওয়াতের পর গরু খাসি দ্বারা উত্তমরূপে খাইয়ে কিছু উপঢৌকন হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাদের বিদায় জানালো। পরদিন ফজর হ’তে না হ’তে রাজার মৃত্যুবার্তা গোটা রাজত্ব ব্যাপী ছড়িয়ে পড়লো। রাজার পুত্রত্রয় দু‘চারজন মৌলবী ডেকে এনে পিতার দাফন কার্য সেরে নিল। অতঃপর দো‘আ খায়ের সেরে রাজত্বের সকল প্রজাসাধারণকে পেটপুরে খাইয়ে বিদায় করল। পরদিন থেকেই রাজার বড় ছেলে রাজত্বের দায়ভার গ্রহণ করল। অতঃপর পিতার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের কথা সুন্দর চাকচিক্যময় নকশাখচিত ছোট্ট প্রাসাদ তৈরি করল। মেজ ছেলে পিতার প্রতি বড় ভাইয়ের এ দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ স্বরণপূর্বক পিতার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শনের প্রত্যাশায় স্বর্ণ ও রৌপ্য খচিত একটি বিশালাকার পিতার ভাষ্কর্য তৈরি করে রাজ প্রাসাদের মূল ফটকে স্থাপন করল। উদ্দেশ্য হ’ল- গোটা রাজত্বব্যাপী প্রজাগণের নিকট পিতাকে স্বরণীয় ও বরণীয় করে রাখা। পিতার প্রতি বড় ভাই ও মেজ ভাই-এর শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসার এরূপ নিদর্শন দেখে ছোট ছেলেও কিছু করার মনস্থ করল। অতঃপর সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে রাজপ্রাসাদের প্রতিটি কক্ষের জন্য একটি করে স্বর্ণ খচিত প্রাচীর-ভাষ্কর্য বানিয়ে নিয়ে প্রতিটি কক্ষে লটকিয়ে দিল। উদ্দেশ্য হ’ল- প্রাসাদের প্রতিটি কক্ষ তথা গোটা প্রাসাদব্যাপী বসবাসকারী সকলের নিকট পিতাকে স্বরণীয় করে রাখা। এভাবে রাজ প্রাসাদ রাজ মূর্তিশালায় পরিণত হ’ল।
শিক্ষা :
১। দুনিয়াবী শিক্ষা যত পাহাড় তুল্যই হোক না কেন ধর্মীয় শিক্ষা তথা কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষা ব্যতিরেকে কোনো মানুষ প্রকৃতপক্ষে শিক্ষিত হ’তে পারে না।
২। ভক্তি যখন সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন মূর্খরা এরূপ হীনকর্মই করে থাকে। যার মাধ্যমে কল্যাণের পরিবর্তে মৃত ব্যক্তিকে অকল্যাণের দিকেই ঠেলে দেয়।
-মুহাম্মাদ লাবীবুর রহমান
হয়বৎপুর, পার্বতীপুর, দিনাজপুর।