দুনিয়া ও আখেরাতের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেমন হওয়া উচিৎ
মুহাম্মাদ আবুল কালাম
দুনিয়া জুড়ে রামাযানে তাকবওয়ার অনুশীলনে, মাসব্যাপী কর্মশালা চলে। মুসলমানদের জীবনে এই রামাযান তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। চান্দ্রমাস তথা ইসলামিক ক্যালেন্ডারের নবম মাস রামাযান। এ মাসে মুসলমানদের জীবনকে পূর্ণভাবে মূল্যায়ন করতে বলা হয়েছে। ছিয়াম ফরয হয় হিজরতের ১৮ মাস পরে, কিবলা পরিবর্তনের ১০ দিন পরে ২য় হিজরীতে, নবুঅতের ১৫তম বছর। রামাযান আরবী শব্দ যা রময ধাতু হ’তে উৎপন্ন। এর অর্থ হচ্ছে ঝলসানোকারী বা প্রজ্জ্বলনকারী। অন্যদিকে ছাওম অর্থ বিরত থাকা বা আত্মসংযম করা। যাবূরে ছিয়ামকে ‘ক্বোরবাত’ বলা হয়েছে যার অর্থ নৈকট্য লাভ করা বা নিকটবর্তী হওয়া। ইঞ্জীলে একে ‘ত্বাব’ বলা হয়েছে যার অর্থ পবিত্র হওয়া বা নির্মল হওয়া। তাওরাতে ছিয়ামকে ‘হাত্ব’ শব্দ দ্বারা বোঝানো হয়েছে যার অর্থ পাপ মোচন করা। তাই তো কবি বলেছেন,
ছাওম রেখে কর অনুভব
ক্ষুধার কেমন তাপ,
দেহ-মনের সাধনায়
পুড়িয়ে নে তোর পাপ।
ছিয়ামের মাধ্যমে বান্দার সমস্ত কালিমা, পশুত্ব ভস্মীভূত হয়ে যায়। ফলে সার্বিকভাবে ছিয়ামের ফলাফল তাকবওয়ার দিকেই যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ-
‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের উপর ছিয়াম ফরয করা হ’ল, যেমন তা ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা মুত্তাক্বী বা আলস্নাহ ভীরম্ন হ’তে পার’ (বাক্বারাহ ২/১৮৩)।
রামাযানের শিক্ষা :
১. ছবর : ছিয়াম ধৈর্য ও সংযম শেখায়। আত্মনিয়ন্ত্রণ শক্তির উন্নয়ন ঘটায়। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,صُمْ شَهْرَ الصَّبْر ‘তোমরা ছবরের মাসে ছিয়াম রাখ’।[1] আর ছবরের পুরস্কার হ’ল জান্নাত। ছিয়াম আমাদের পরিবেশ দিয়ে সাহায্য করে যাতে করে আমরা অসৎ ইচ্ছা, খারাপ অভ্যাস প্রতিরোধ করতে পারি এবং শয়তানের মোকাবিলায় প্রতিরোধ শক্তি অর্জন করি। এতে নৈতিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, الصِّيَامُ جُنَّة ٌ ‘ছিয়াম ঢাল স্বরূপ’।[2] শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন, أنه حجاب وحصن للصائم من المعاصى ‘ছিয়াম পাপাচার থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে ছায়েমের জন্য আড়াল ও রক্ষাকবচ’।
২. তাক্বওয়া : তাক্বওয়াহীন জীবন মৃত লাশের মত। তাক্বওয়া মুমিন জীবনের সবচেয়ে বড় সঞ্চালক ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের একমাত্র নিয়ামক। আল্লাহ বলেন,
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتقَاكُمْ-
‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম সম্মানিত ব্যক্তি সেই যে আল্লাহকে অধিক ভয় করে’ (হুজুরাত ৪৯/১৩)। তিনি আরো বলেন,
وَتزَوَّدُوا فَإِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التقْوَى وَاتقُونِ يَا أُولِي الْأَلْبَابِ-
‘তোমরা (আখিরাতের জন্য) সম্বল অর্জন করে নাও, নিশ্চয়ই সর্বাধিক উত্তম সম্বল হ’ল তাকবওয়া’ (বাক্বারাহ ২/১৯৭)।
وَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَات وَالْأَرْضُ أُعِدَّت لِلْمُتقِين-
‘আর তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে দ্রুত ধাবিত হও। যার প্রশস্ততা আসমান ও যমীন পরিব্যপ্ত। যা প্রস্ত্তত করা হয়েছে আল্লাহভীরুদের জন্য’ (আলে-ইমরান ৩/১৩৩)।
রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَكْرَمُ النَّاسِ قَالَ أَتقَاهُمْ ‘(ছাহাবীগণ বললেন) মানুষের মাঝে সবচেয়ে সম্মানী কে? নবী করীম (ছাঃ) বললেন, আল্লাহকে যে সবচেয়ে বেশী ভয় করে’।[3] ছিয়ামের প্রতিটি মুহুুর্ত ছিয়ামপালনকারীর জন্য হয় তাক্বওয়াময় ও জান্নাতী আলোয় উদ্ভাসিত।
৩. ইনছাফ : ইনছাফ হচ্ছে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা, সুবিচার করা, হক্বদারকে তার প্রাপ্য হক্ব বুঝিয়ে দেয়া ইত্যাদি। ছিয়াম অন্যের সম্পদ বা অধিকার হরণ থেকে বিরত রাখে। বৈধভাবে জিনিষ ক্রয়-বিক্রয় করা চলে কিন্তু অবৈধ, ধোঁকাবাজির প্রশ্নই আসেনা। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّى ‘যে ব্যক্তি ধোঁকা দেয় সে আমার দলভুক্ত নয়’।[4]
ارْحَمُوا أَهْلَ الأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِى السَّمَاءِ ‘তোমরা যমীনবাসীর উপর দয়া কর (আল্লাহ) আকাশবাসী তোমাদের উপর দয়া করবেন’।[5]
اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى ‘তোমরা ন্যায়বিচার কর, যা আল্লাহভীতির অধিকতর নিকটবর্তী’ (মায়েদা ৫/৮)।
৪. দান-খয়রাত : আমরা দিতে শিখব, নিতে নয়। এ মাসে বেশী বেশী দান- খয়রাতকে উৎসাহিত করা হয়েছে। রাসূল(ছাঃ) বলেন, اتَّقُوا النَّارَ وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ ‘তোমরা একটি খেজুর দান করে হ’লেও জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচ’।[6]
রাসূল (ছাঃ) রামাযান মাসে সকলের চেয়ে অধিক ধন-সম্পদ ব্যয় করতেন।
فَلَرَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَجْوَدُ بِالْخَيْرِ مِنَ الرِّيحِ الْمُرْسَلَة-
‘রাসূল (ছাঃ) সকলের চেয়ে অবশ্যই কল্যাণবহ মুক্ত বায়ু অপেক্ষা অধিক দানশীল ছিলেন।[7]
৫. পাপ মোচন : রামাযান পাপ মোচনের মাস। আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
الصَّلَوَات الْخَمْسُ وَالْجُمُعَةُ إِلَى الْجُمُعَةِ وَرَمَضَانُ إِلَى رَمَضَانَ مُكَفِّرَات لِمَا بَيْنَهُنَّ مَا اجْتنِبَت الْكَبَائِرُ
‘পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত, এক জুমু‘আ থেকে আরেক জুমু‘আ এবং এক রামাযান থেকে আরেক রামাযানের মধ্যবর্তী পাপ হয় তা মুছে দেয় যদি কবীরা গুনাহ থেকে বেচেঁ থাকে’।[8] তিনি আরো বলেন,
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ-
‘আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছওয়াবের আশায় রামাযানে ছিয়াম পালন করবে, তার অতীতের সমস্ত গোনাহ মাফ করা হবে’।[9]
৬. নিয়মানুবর্তিতা : ছিয়াম কঠিনভাবে নিয়ম ও সময় মেনে চলতে শেখায়। নির্ধারিত সময়ের এক মিনিট আগে ইফতার করা যাবে না, এক মিনিট পরেও করা যাবে না। সাহারী খাওয়ার ক্ষেত্রেও ছায়েম পূর্ণ নিয়ম মেনে চলবেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,
إِنَّا مَعْشَرَ الأَنْبِيَاءِ أُمِرْنَا بِتعْجِيلِ فِطْرِنا، وَتأْخِيرِ سُحُورِنا
‘আমরা নবীদের দল আদিষ্ট হয়েছি ইফতার দ্রুত করতে এবং সাহারী দেরীতে করতে’।[10] তিনি আরো বলেন,لاَ يَزَالُ الدِّينُ ظَاهِرًا مَا عَجَّلَ النَّاسُ الْفِطْرَ لأَنَّ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى يُؤَخِّرُونَ ‘দ্বীন ততদিন পর্যন্ত বিজয়ী থাকবে যতদিন মানুষ তাড়াতাড়ি ইফতার করবে। কেননা ইহুদী ও নাছারাগণ দেরীতে ইফতার করে’।[11]
৭. রিয়ামুক্ত আমল : ছিয়াম রিয়ামুক্ত ইবাদত করার প্রশিক্ষণ দেয়। ছায়েম আল্লাহর জন্যই খাদ্য-পানীয় ও কুপ্রবৃত্তি বর্জন করে। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আললাহ বলেন,الصِّيَامُ لِى، وَأَنَا أَجْزِى بِهِ ‘ছিয়াম আমারই জন্য। আমিই এর প্রতিদান দেব’।[12]
রামাযানের গুরুত্ব :
ছিয়াম ফরয ও ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের একটি। প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিম নর-নারীর শারঈ ওযর ব্যতীত ছিয়াম ভঙ্গ করা যাবে না। তাদের উপর রামযানের ছিয়াম পালন করা ফরয। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
مَنْ أَفْطَرَ يَوْمًا مِنْ رَمَضَانَ، مِنْ غَيْرِ عُذْرٍ وَلاَ مَرَضٍ لَمْ يَقْضِهِ صِيَامُ الدَّهْرِ، وَإِنْ صَامَهُ-
‘কেউ যদি ওযর ছাড়া রামযানের একটি ছিয়াম না রাখে তবে সারাজীবন ছিয়াম রাখলেও এর ক্ষতিপূরণ হবে না’।[13] তিনি আরো বলেন,
إِذَا كَانَت أَوَّلُ لَيْلَةٍ مِنْ رَمَضَانَ صُفِّدَت الشَّيَاطِينُ وَمَرَدَةُ الْجِنِّ وَغُلِّقَت أَبْوَابُ النَّارِ فَلَمْ يُفْتحْ مِنْهَا بَابٌ وَفُتحَت أَبْوَابُ الْجَنَّةِ فَلَمْ يُغْلَقْ مِنْهَا بَابٌ-
‘যখন রামযান মাস শুরু হয় তখন শয়তানগুলোকে শিকলে আবদ্ধ করে দেয়া হয়। জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। আর তা খোলা হয় না। জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় আর তা বন্ধ করা হয় না’।[14] তিনি অন্যত্র বলেন,
قُلْت يَا رَسُولَ اللَّهِ مُرْنِى بِعَمَلٍ. قَالَ عَلَيْك بِالصَّوْمِ فَإِنَّهُ لاَ عِدْلَ لَهُ قُلْت يَا رَسُولَ اللهِ مُرْنِى بِعَمَلٍ. قَالَ عَلَيْكَ بِالصَّوْمِ فَإِنَّهُ لاَ عِدْلَ لَهُ.
‘আমি (আবু উমামা) বললাম আমাকে একটি আমলের কথা বলুন। তিনি বললেন, তুমি ছিয়াম পালন কর। তিনি পুনরায় একই প্রশ্ন করলে, তিনি বললেন, তুমি ছিয়াম পালন কর। কেননা ছিয়ামের সাথে তুলনীয় কোন আমল নেই এবং এর কোন বিকল্প নেই।[15]
১. কুরআনের নাযিলের মাস : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَات مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ
‘রামাযান হ’ল সেই মাস, যাতে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। যা মানুষের জন্য সুপথ প্রদর্শক ও সুপথের স্পষ্ট ব্যাখ্যা এবং সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী’ (বাক্বারাহ ২/১৮৫)।
আল্লামা ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহ অন্যান্য মাসের মধ্যে ছিয়াম মাসের বিশেষ মর্যাদা তুলে ধরেছেন। কারণ এ মাসকেই তিনি কুরআন নাযিল করার জন্য পসন্দ করেছেন’। রাসূল (ছাঃ) বলেন,
الصِّيَامُ وَالْقُرْآنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَقُولُ الصِّيَامُ أَىْ رَبِّ مَنَعْتهُ الطَّعَامَ وَالشَّهَوَات بِالنَّهَارِ فَشَفِّعْنِى فِيهِ. وَيَقُولُ الْقُرْآنُ مَنَعْتهُ النَّوْمَ بِاللَّيْلِ فَشَفِّعْنِى فِيهِ. قَالَ فَيُشَفَّعَانِ-
‘ছিয়াম এবং কুরআন ছায়েমের জন্য শাফা‘আত করবে। ছিয়াম বলবে, হে আল্লাহ! আমি অমুক ব্যক্তিকে দিনের বেলা পানাহার ও কামনা-বাসনা থেকে ফিরিয়ে রেখেছি, তার পক্ষে আপনি আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। কুরআন সুপারিশ করবে এই বলে যে, ‘হে আল্লাহ! আমি এ ব্যক্তিকে রাত্রের নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। তিনি বলেন, উভয়ের সুপারিশ কবুল করা হবে’।[16] অতএব ছিয়ামের মাসে বেশী বেশী কুরআন তেলাওয়াত করতে হবে তিনি তাঁর বান্দাকে অফুরন্ত ছওয়াব দিবেন।
২. জাহান্নাম থেকে মুক্তি : রামাযান জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির মাস। রাসূল (ছাঃ) বলেন,
رَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ ذُكِرْت عِنْدَهُ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَىَّ وَرَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ دَخَلَ عَلَيْهِ رَمَضَانُ ثُمَّ انْسَلَخَ قَبْلَ أَنْ يُغْفَرَ لَهُ وَرَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ أَدْرَكَ عِنْدَهُ أَبَوَاهُ الْكِبَرَ فَلَمْ يُدْخِلاَهُ الْجَنَّةَ-
‘আবু হুরায়রা (রাঃ) রাসূল (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, জিবরীল (আঃ) বললেন সেই ব্যক্তি ধ্বংস হোক, যে ব্যক্তির সামনে আপনার নাম উচ্চারিত হ’ল, কিন্তু আপনার উপর দরূদ পড়ল না। যে ব্যক্তি রামাযান মাস পেল তারপরও নিজের কৃত গোনাহখাতা মাফ করিয়ে নিতে পারল না। যে ব্যক্তি তার মাতা-পিতা কাউকে জীবিত পেল। অতপর তাদের সেবা করে জান্নাতে যেতে পারল না ’।[17] রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেন,
وَلِلَّهِ عُتقَاءُ مِنَ النَّارِ وَذَلِكَ فِى كُلِّ لَيْلَةٍ-
‘রামাযানের প্রতিটি দিন-রাতে আল্লাহ অসংখ্য মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন’।[18] তাদের প্রত্যেকের দো‘য়া আল্লাহ কবুল করেন।
৩. লাইলাতুল ক্বদর : রামাযান মাসের গুরুত্ব সম্পর্কে নিম্নোক্ত হাদীছটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।-
قَدْ جَاءَكُمْ رَمَضَانُ شَهْرٌ مُبَارَكٌ افْترَضَ اللهُ عَلَيْكُمْ صِيَامَهُ تفْتحُ فِيهِ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ وَتغْلَقُ فِيهِ أَبْوَابُ الْجَحِيمِ وَتغَلُّ فِيهِ الشَّيَاطِينُ فِيهِ لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ مَنْ حُرِمَ خَيْرَهَا فَقَدْ حُرِمَ-
রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘তোমাদের নিকট এক বরকতময় মাস সমাগত। আল্লাহ তা‘আলা এ মাসে তোমাদের উপর ছিয়ামকে ফরয করে দিয়েছেন। তখন জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। আর শয়তানগুলোকে শিকলে আবদ্ধ করে দেয়া হয় । সে মাসে একটি রাত আছে, যা এক হাযার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, যে ব্যক্তি তার কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হ’ল সে অনেক কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হ’ল’।[19] তিনি আরো বলেন,
مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল ক্বদরে ঈমানের সাথে ছওয়াবের আশায় রাত জেগে ইবাদত করে, তার পিছনের সমসত্ম গোনাহ ক্ষমা করা হবে’।[20]
রামাযানের প্রস্ত্ততি :
১. ছিয়ামের বিধি-বিধান সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করা :
আল্লাহ বলেন,فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتمْ لَا تعْلَمُون ‘তোমরা যদি না জান, তা’হলে যারা জানে তাদেরকে জিজ্ঞেস কর’ (নাহল ১৬/৪৩)।
মূলতঃ যারা ধর্মীয় জ্ঞানে গভীরতা অর্জন করে, তারাই প্রকৃত ভাগ্যবান, তারাই শ্রেষ্ঠ। রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ يُرِدِ اللهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِى الدِّينِ ‘আল্লাহ যার কল্যাণ সাধন করতে চান, তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন।[21]
২. বিশেষ বিশেষ কাজের অভ্যাস গড়ে তোলা :
ক. শা‘বানের ছিয়াম : শা‘বানের ছিয়ামের অত্যান্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ কারণেই রাসূল (ছাঃ) শা‘বানের ছিয়াম রাখতেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,
وَمَا رَأَيْتهُ أَكْثَرَ صِيَامًا مِنْهُ فِى شَعْبَانَ-
‘আমি [মা আয়েশা (রাঃ)] রাসূল (ছাঃ)-কে রামাযান ব্যতীত শা‘বানের ন্যায় এত অধিক ছিয়াম পালন করতে দেখিনি’।[22] ফলে রামাযানের ছিয়াম আসার আগেই দেহ-মন ছিয়ামে অভ্যস্ত হয়ে যেত।
খ. রাত্রি জেগে ছালাত পড়া : রামাযানে ক্বিয়ামুল লায়ল আদায় করতে হয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه- ‘যে ব্যক্তি রামাযানে ঈমানের সাথে নেকীর আশায় রাত জাগরণ করে ইবাদত করে তার পূর্বের সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করা হয়’।[23] রামাযানের এ মহাসুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য রামাযানের পূর্ব থেকেই রাতজেগে ছালাত পড়ার কিছু কিছু অভ্যাস গড়তে পারলে রহমাতের মৌসুমে তা সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করবে।
ঘ. বদ অভ্যাসসমূহ পরিত্যাগ করা এবং সদাভ্যাস ধারণ করা :
রাসূল (ছাঃ) বলেন,
كُلُّ مَعْرُوفٍ صَدَقَةٌ وَإِنَّ مِنَ الْمَعْرُوفِ أَنْ تلْقَى أَخَاكَ بِوَجْهٍ طَلْقٍ-
‘প্রত্যেক ভাল কথা বা কাজই ছাদাক্বা। এমনকি তোমার ভাইয়ের সঙ্গে হাস্যবদনে সাক্ষাৎও একটি ছাদাক্বা।[24]
মানুষ অভ্যাসের দাস নয়; বরং অভ্যাসই মানুষের দাস। এ কথা ছিয়াম সাধনার দ্বারা প্রমাণিত হয়। তবে সে জন্য নিজেকে প্রস্ত্তত করতে হয় আগেভাগেই। বিশেষকরে রামাযানকে একটি প্রথাগত অনুষ্ঠান মনে করা, সারা দিন রান্না করে কাটানো, সারা দিন ঘুমিয়ে কাটানো, ইচ্ছাকৃতভাবে সাহারী বাদ দেওয়া, ইফতার বেশী খেতে গিয়ে মাগরিবের ছালাতের জামা‘আত ধরতে না পারা, ছিয়াম রাখা অথচ ছালাত ছেড়ে দেয়া, পরীক্ষা কিংবা কর্মব্যস্ততার জন্য ছিয়াম না রাখা, স্বাস্থ্য কমানোর উদ্দ্যেশ্যে ছিয়াম রাখা, ঈদের প্রস্ত্ততি নিতে গিয়ে রামাযানের শেষাংশ অবহেলায় পালন করা ও লোক দেখানো ইফতার পার্টির আয়োজন করা ইত্যাদি। এসব জাহিলিয়াতকে পরিহার করে ছিয়াম সড়কে আমাদের যাত্রা শুরু হোক সকল বদাভ্যাস মুক্ত হয়ে সদাভ্যাসের শুভ্র পোশাকে অলংকৃত হয়ে।
৩. মুহাসাবাতুন নাফস বা আত্ম-সমালোচনা :
জবাবদিহিতাশূন্য, বলগাহীন, যথেচ্ছাজীবনযাপন করা মুমিনের পরিচয় নয়। আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে জবাবদিহিতা করার পূর্বেই মুমিন নিজের কাঠগড়ায় দাঁড়ায়। নিজের কাছে নিজেই জবাবদিহি করে। আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتقُوا اللَّهَ وَلْتنْظُرْ نَفْسٌ مَا قَدَّمت لِغَدٍ وَاتقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تعْمَلُونَ-
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; আর প্রত্যেকের উচিত চিন্তা করে দেখা সে আগামীকালের জন্য কি প্রেরণ করেছে। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর নিশ্চয়ই আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবহিত’ (হাশর ৫৯/১৮)। এ জন্য রামাযান আসার আগেই প্রত্যেক মুমিনের উচিত আত্মসমালোচনা করা।
৪. ছওয়াব অর্জনের অফুরন্ত সুযোগ :
রামাযান মাসে মুমিনের ইবাদতের ছওয়াব বৃদ্ধি করা হয় বহুগুণে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,
كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ يُضَاعَفُ الْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا إِلَى سَبْعِمِائَةِ ضِعْفٍ إِلَى مَا شَاءَ اللَّهُ يَقُولُ اللَّهُ إِلاَّ الصَّوْمَ
‘আদম সন্তানের প্রত্যেক নেক আমলের ছওয়াব দশগুণ হ’তে সাতশত গুণ প্রদান করা হয়। আল্লাহ বলেন কিন্তু ছাওম ব্যতীত।[25] তাই এ মাসে বেশী বেশী করে নেক আমলই হৌক আমাদের কাম্য।
৫. খাদ্যাভাস স্বাভাবিক : স্বাভাবিকভাবেই রামাযানে খাবার অভ্যাস পরিবর্তন করতে হয়। মাগরিবের পর ভারসাম্যপূর্ণ খাবার খান। কোন ভাবেই অতিরিক্ত খাওয়া ঠিক হবে না। সন্ধ্যায় চা, কফি ইত্যাদি খাবার পরিহার করুন। তরল ও পানি বেশী খান। ফল খাওয়া যেতে পারে। ভাজা পোড়া ও মসলা জাতীয় খাবার কম গ্রহণ করুন। বেশী বেশী মিসওয়াক করুন।
আসুন রামাযানের ক্বদর করি :
মাহে রামাযানের এত বেশী গুরুত্ব মূলতঃ পবিত্র কুরআনের কারণে। এ মাস কুরআন নাযিলের মাস। তাই এ মাসে কুরআন অধ্যয়ন করতে হবে, কুরআন নাযিলের প্রকৃত উদ্দেশ্য অনুধাবন করে সে অনুযায়ী আত্মগঠন করতে হবে। মনকে ইবাদতের মাঝে নিবিষ্ট করার জন্য অর্থ বুঝে ছালাতে কুরআন পড়তে হবে। রামাযানে কুরআন তিলাওয়াতের গুরুত্ব সমধিক। বস্ত্ততঃ মানব ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কুরআন নাযিলের ঘটনা। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহের আলোকেই মানব জীবনকে সাজাতে হবে, ব্যক্তি পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সূর্যবিহীন সৌরজগৎ যেমন নিষ্প্রভ ও তিমিরাচ্ছন্ন, তেমনি কুরআন-সুন্নাহবিহীন মানব সমাজ নিরর্থক ও অকল্পনীয়। মাহে রামাযান থেকে এ শিক্ষা নেয়া যরূরী। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ فِى أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ
‘ছিয়াম রেখে যে মিথ্যা পরিত্যাগ করতে পারল না তার পানাহার ত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই’।[26] কিছু সংখ্যক লোক ক্ষুৎ-পিপাসায় কষ্টভোগ ছাড়া আর কিছুই লাভ করে না। আবার কিছুসংখ্যক রাতজাগা লোকের রাত্রি জাগরণ ছাড়া আর কিছুই লাভ করে না। তাকবওয়া এমন একটি মহৎ গুণ যার মাধ্যমে রিযিক্বের ফায়ছালা হয় এবং বরকতের দরজা উন্মুক্ত হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন,
وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آمَنُوا وَاتقَوْا لَفَتحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَات مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ وَلَكِنْ كَذَّبُوا فَأَخَذْنَاهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ ‘যদি লোকালয়ের লোকেরা ঈমান আনে ও তাকবওয়া অবলম্বন করে, তবে আমি তাদের জন্য আকাশ ও যমীনের বরকতসমূহের দরজা খুলে দেব’ (আরাফ ৭/ ৯৬)।
The Cultural History of Islam গ্রন্থে বলা হয়েছে,
The fasting of Islam in Ramadan has a wonderful teaching for establishing social unity, brotherhood and equity. It has also an excellant teaching for building a good moral character.
‘ইসলামে সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠায় রামাযান মাসের ছিয়ামে রয়েছে এক অভাবনীয় শিক্ষা। রয়েছে উত্তম নৈতিক চরিত্র গঠনের এক চমৎকার শিক্ষা’।
তাই আমাদের সামর্থ্যের মধ্যে সকল প্রচেষ্টা দিয়ে রামাযানের ইবাদতে ব্রতী হওয়া যরূরী। ঈমানী চেতনাকে শাণিত করতে রামাযান মহাসুযোগও বটে। আসুন! আমাদের ঈমানকে উজ্জীবিত ও তাজা করি আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দিন- আমীন!
[লেখক : কেন্দ্রীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ]
[1]. সিলসিলাতু আহাদীছিছ ছহীহাহ হা/২৬২৩ ।
[2]. বুখারী হা/১৮৯৪।
[3]. বুখারী হা/৩৩৫৩।
[4]. মুসলিম হা/২৯৫।
[5]. আবুদাউদ হা/৪৯৪১।
[6]. বুখারী হা/১৪১৩ ও ১৪১৭।
[7]. বুখারী হা/১৯০২।
[8]. মুসলিম হা/২৩৩।
[9]. বুখারী হা/১৯০১।
[10]. ত্বাবারানী হা/১১৪৮৫।
[11]. আবুদাউদ হা/২৩৫৫।
[12]. বুখারী হা/১৮৯৪।
[13]. বুখারী হা/২৯।
[14]. ইবনু মাজাহ হা/১৭১১।
[15]. নাসাঈ হা/২২২৩ ।
[16]. তিরমিযী হা/৩৮৯০।
[17]. ইবনে মাজাহ হা/১৭১১।
[18]. আহমাদ হা/৭৩৪৭।
[19]. বুখারী হা/১৯০১ ।
[20]. বুখারী হা/১০।
[21]. বুখারী হা/১৯৬৯।
[22]. বুখারী হা/৩৭।
[23]. তিরমিযী হা/২০৯৮।
[24]. বুখারী হা/১৯০৩।
[25]. বুখারী হা/১৯০৪।
[26]. বুখারী হা/১৮০৪।