ধর্মহীন শিক্ষার কুফল : পরিত্রাণের উপায়
আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক
চতুর্থ : আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা।
স্বরণ রাখুন আপনি খুতবা দিচ্ছেন ও কথা বলছেন একমাত্র আল্লাহর ক্ষমতা ও শক্তি বলে। সুতরাং যদি আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করেন তাহ’লে আপনার মুখকে খুলে দিবেন নতুবা তালাবদ্ধ করবেন। যদিও আল্লাহর পক্ষ হ’তে আপনাকে কথা বলার ব্যাপারে সামর্থবান ও অপরাগতার উভয়ই দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। নিশ্চয় আপনার গলা যা ধ্বনি বের হওয়ার স্থান, জিহবা, ঠোঁট, দাঁতসমূহ এবং কথা গঠন করতে ও সুমধুর কন্ঠস্বর তৈরি করা মহান আল্লাহর অপার সৃষ্টি। যেমন আল্লাহ বলেন,
الَّذِي أَنْطَقَ كُلَّ شَيْ ‘যিনি (আল্লাহ) সবকিছুকে বাকশক্তি দিয়েছেন’ (হা-মীম-সাজদাহ ৪১/২১)।
আর হে খতীব! অবশ্যই আল্লাহ আপনার সাথে আছেন সাহায্যকারী ও অন্তরে (জ্ঞানের) জাগ্রতকারী হিসেবে। পূববর্তী দাঈদের প্রতি লক্ষ্য রাখুন। আল্লাহকে অাঁকড়ে ধরুন অর্থাৎ (পবিত্র কুরআন ছহীহ সুন্নাকে) যাতে আপনার জন্য আল্লাহর নবী মূসা (আঃ)-এর জীবন আদর্শকে উত্তম আদর্শ হয়। যেখানে মূসা (আঃ) বলেছিলেন। আল্লাহ বলেন,
قَالَ رَبِّ اشْرَحْ لِي صَدْرِي- وَيَسِّرْ لِي أَمْرِي- وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِنْ لِسَانِي . يَفْقَهُوا قَوْلِي-
অর্থ : (মূসা বলল) ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার বক্ষ প্রসারিত করে দাও। এবং আমার কর্ম সহজ করে দাও আর আমার জিহবার আড়ষ্টতা দূর করে দাও। যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে’ (ত্বোয়াহা ২০/২৫-২৮ )।
আর কঠোরভাবে হুশিয়ার থাকবে প্রতারক দাঈর কবল থেকে এবং তাদের আত্মতুষ্টি থেকে, কেননা তাদের প্রচার-প্রচারণা ছল-চাতুরতায় পরিপূর্ণ যা হৃদয়ে হতাশা সৃষ্টি করে।
পঞ্চম : আল্লাহর জন্য দৃষ্টান্ত স্বরূপ হওয়া।
কেননা আম জনতা খত্বীবের (পথচলার) দিকে নযর রাখবে এবং সূক্ষ্মভাবে তার দিকে দৃষ্টি দেবে। এ কারণে খত্বীবকে তার কথার সাথে (বক্তব্যের) কাজের মিল রাখতে হবে। অতএব খত্বীবের প্রতি আবশ্যক যে ইসলামের বিধান সমূহকে নিজের জীবনে সম্পূর্ণরুপে বাস্তবায়ন করা। তাহ’লে তার বক্তব্য শ্রোতাদের মাঝে গ্রহণযোগ্য হবে। পক্ষান্তরে খত্বীবের কথা কাজে অমিল হ’লে অবশ্যই সে শ্রোতাদের নিকট তার কথার (বক্তব্যের) মাধ্যমে আস্থাভাজন হ’তে পারবে না। আল্লাহ বলেন,
أَتَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَتَنْسَوْنَ أَنْفُسَكُمْ وَأَنْتُمْ تَتْلُونَ الْكِتَابَ أَفَلَا تَعْقِلُونَ-
অর্থ : ‘তোমরা সৎকাজের আদেশ দাও, আর নিজেদের বেলায় তা ভুলে যাও? অথচ তোমরা কিতাব পাঠ করে থাকো? তোমরা কি বুঝো না? (বাক্বারাহ ২/৪৪)। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ-
অর্থ : ‘হে মুমিনগণ! তোমরা যা কর না তা কেন বল? তোমরা যা কর না, তা বলা আল্লাহর কাছে খুবই অসন্তোষজনক’ (ছফ ৬১/২-৩)।
আদর্শ খত্বীব তিনিই যিনি সমাজের আশরাফ-আতরাফ সকল শ্রেণীর মানুষকে তার কথা ও কাজের সম্মোহনের মাধ্যমে আহবান করবে। ফলে সে প্রভাব বিস্তারকারী দাঈ হিসাবে সমাজে প্রসিদ্ধি লাভ করবে ও মানুষের অন্তরের মণিকোটায় জায়গা করে নেবে যা তার দাওয়াতী যিন্দেগীকে ভিন্ন মাত্রা দেবে। আর দাঈর (খত্বীব) কথা-কাজে মিল পাওয়া যাবে না তার ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) মমার্ন্তিক পরিণতির কথা উল্লেখ করে বলেন,
عَنْ أُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ قَالَ قِيلَ لَهُ أَلاَ تَدْخُلُ عَلَى عُثْمَانَ فَتُكَلِّمَهُ فَقَالَ أَتُرَوْنَ أَنِّى لاَ أُكَلِّمُهُ إِلاَّ أُسْمِعُكُمْ وَاللَّهِ لَقَدْ كَلَّمْتُهُ فِيمَا بَيْنِى وَبَيْنَهُ مَا دُونَ أَنْ أَفْتَتِحَ أَمْرًا لاَ أُحِبُّ أَنْ أَكُونَ أَوَّلَ مَنْ فَتَحَهُ وَلاَ أَقُولُ لأَحَدٍ يَكُونُ عَلَىَّ أَمِيرًا إِنَّهُ خَيْرُ النَّاسِ. بَعْدَ مَا سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- يَقُولُ يُؤْتَى بِالرَّجُلِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَيُلْقَى فِى النَّارِ فَتَنْدَلِقُ أَقْتَابُ بَطْنِهِ فَيَدُورُ بِهَا كَمَا يَدُورُ الْحِمَارُ بِالرَّحَى فَيَجْتَمِعُ إِلَيْهِ أَهْلُ النَّارِ فَيَقُولُونَ يَا فُلاَنُ مَا لَكَ أَلَمْ تَكُنْ تَأْمُرُ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَى عَنِ الْمُنْكَرِ فَيَقُولُ بَلَى قَدْ كُنْتُ آمُرُ بِالْمَعْرُوفِ وَلاَ آتِيهِ وَأَنْهَى عَنِ الْمُنْكَرِ وَآتِيهِ.
অর্থ : আবু ওয়াইল (রহঃ) হ’তে বর্ণিত। তিনি বলেন, উসামাহ (রাঃ)-কে বলা হল, কত ভাল হত! যদি আপনি ঐ ব্যক্তির (ওছমান (রাঃ)-এর নিকট যেতেন এবং তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতেন। উত্তরে তিনি বললেন, আপনারা মনে করছেন যে আমি তাঁর সঙ্গে আপনাদেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলব। অথচ আমি তাঁর সঙ্গে (দাঙ্গা দমনের ব্যাপারে) গোপনে আলোচনা করছি, যেন আমি একটি দ্বার খুলে না বসি। আমি দ্বার উন্মুক্তকারীর প্রথম ব্যক্তি হ’তে চাই না। আমি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট হ’তে কিছু শুনেছি, যার পরে আমি কোন ব্যক্তিকে যিনি আমাদের আমীর নির্বাচিত হয়েছেন এ কারণে তিনি আমাদের সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তি এ কথা বলতে পারি না। লোকেরা তাঁকে বলল, আপনি তাঁকে কী বলতে শুনেছেন? উসামাহ (রাঃ) বললেন, আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, ক্বিয়ামাতের দিন এক ব্যক্তিকে আনা হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তখন আগুনে পুড়ে তার নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যাবে। এ সময় সে ঘুরতে থাকবে যেমন গাধা তার চাকা নিয়ে তার চারপাশে ঘুরতে থাকে। তখন জাহান্নামবাসীরা তার নিকট একত্রিত হয়ে তাকে বলবে, হে অমুক ব্যক্তি! তোমার এ অবস্থা কেন? তুমি না আমাদেরকে সৎ কাজের আদেশ করতে আর অন্যায় কাজ হ’তে নিষেধ করতে? সে বলবে, আমি তোমাদেরকে সৎ কাজে আদেশ করতাম বটে, কিন্তু আমি তা করতাম না আর আমি তোমাদেরকে অন্যায় কাজ হতে নিষেধ করতাম, অথচ আমিই তা করতাম’ (মুসলিম হা/২৯৮৯)।
সুতরাং আরশের মালিক মহান আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করছি তিনি আমাদেরকে হাক্কানী খত্বীব (প্রকৃত দাঈ) হওয়ার তাওফীক দান করুন।
ষষ্ঠতম : সাহসী হওয়া
খত্বীবকে সাহসী ও সত্যসেবী হ’তে হবে। খত্বীবের হিকমাতপূর্ণ কথা, প্রজ্ঞা, দায়িত্বশীলতা, হিম্মতের চাদর মুড়ানো হ’তে হবে। যা খত্বীবকে হক্ব কথা বলার আসল গুণে গুনান্বিত করবে।
কাঙ্ক্ষিত লক্ষে পোঁছতে অবশ্যই খত্বীবকে ঝুঁকিপূর্ণ বড় বড় কাজের দিকে এগিয়ে যেতে হবে নির্ভয়ে বীরদর্পে। যেখানে দাঈর সবচেয়ে বড় সাথী হ’ল ‘সৎ সাহসেই নির্ভরতা’। তা না হ’লে খত্বীবের চূড়ান্ত লক্ষ বস্ত্ত হবে ভূলুন্ঠিত, পর্যুদস্ত।
সপ্তম : জনসাধারণের সাথে সম্পর্ক স্থাপন
খত্বীবকে সাধারণ জনগণের সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন বজায় রাখতে হবে। এখানে এর দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল শ্রোতামন্ডলী। খত্বীব তাদের পরস্পরের সাথে কোন বিষয়ে আলোচনা করবে তাদের রোগের সময় খোঁজ খবর নিবে, তাদের অনুপস্থিতিতে তাদের সন্ধান করবে, (শ্রোতাদের) তাদের কোন সমস্যায় সমবেত চেষ্টা শরীক হবে। তাদের আহবানে সাড়া দিবে এবং তাদের সংকটময় (কঠিন) সময়ে পাশে দাঁড়াবে এমনিভাবে খত্বীবগণ জনসাধারণের নিকটবর্তী হবে ও তাদের সাথে মেলবন্ধন সৃষ্টি করবে।
অতএব লক্ষনীয় যে, মানুষের হাতে যা আছে তা হ’তে নিজেকে বিরত রাখ। যেমন হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেন,
عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ السَّاعِدِىِّ قَالَ أَتَى النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم رَجُلٌ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ دُلَّنِى عَلَى عَمَلٍ إِذَا أَنَا عَمِلْتُهُ أَحَبَّنِىَ اللَّهُ وَأَحَبَّنِىَ النَّاسُ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ - صلى الله عليه وسلم ازْهَدْ فِى الدُّنْيَا يُحِبَّكَ اللَّهُ وَازْهَدْ فِيمَا فِى أَيْدِى النَّاسِ يُحِبُّوكَ -
অর্থ : সাহল ইবনু সা‘দ আস-সা‘ইদী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: ‘এক ব্যক্তি নবী করীম (রাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন কাজ বলুন যা করলে আল্লাহ আমাকে ভালবাসেন, লোকেরাও আমাকে ভালবাসে। তখন তিনি বললেন, দুনিয়ার প্রতি অনুরাগী হবে না, তাহ’লে আল্লাহ তোমাকে ভালবাসবেন; আর মানুষের কাছে যা আছে, তার ব্যাপারে আগ্রহী হবে না, তাহ’লে মানুষও তোমাকে ভালবাসবে’ (ইবনু মাজাহ হা/৪১০২; মিশকাত হা/৫১৮৭)।
অষ্টম : পরিতুষ্টির সাথে দাওয়াত দেয়া
খত্বীবকে অবশ্যই পূর্ণ পরিতুষ্টির সাথে আহবান করতে হবে। যাতে করে খত্বীব সক্ষম হয় পরিতুষ্টিকারী ও প্রভাব বিস্তারকারী হিসেবে। কারণ ঈমান তখন পূর্ণ হয় যা তার সাথীর সাথে পূর্ণ তৃপ্তির সংমিশ্রন ঘটে। যখর খত্বীব পরিতৃপ্তির সাথে দাওয়াত দিতে পারবেনা, তখন সে পরবর্তীতে পরিতৃপ্তি লাভ করতে পরবেনা।
সুতরাং যখন খত্বীব তার বক্তব্যে মানুষকে সম্পদের যাকাত ও ছদাক্বা প্রদান করার কথা বলবে আর নিজেই তা সম্পাদন করবেনা, এর প্রতি আগাধ বিশ্বাস রাখবে না, অথবা যখন মানুষকে আহবান করবে গীবত পরিত্যাগ করতে আর তিনি নিজেই গীবতে ডুবে থাকে অথবা যখন মানুষকে নছীহত করবে তাদের সন্তান-সন্তাদির ও স্ত্রীদের শারঈ পোশাক সম্পর্কে আর তার সন্তান-সন্তাদি ও স্ত্রীগণের উপর এ বিধান আবশ্যক করবে না। তখন অধিকাংশ মানুষ তার কথা ও খুৎবার (দাওয়াত) দিকে ভ্রুক্ষেপ করবে না। অবশেষে তাকে পরিত্যাগ করবে। (চলবে)
(আমীর ইবনে মুহাম্মাদ আল-মাদরীর বই অবলম্বনে লিখিত)
[লেখক : ২য় বর্ষ আরবী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া]