ঊনপঞ্চাশ কোটি ফযীলত : বিভ্রান্তি নিরসন
আহমাদুল্লাহ
খায়রুল ইসলাম 1486 বার পঠিত
وَيُعَذِّبَ
الْمُنَافِقِينَ وَالْمُنَافِقَاتِ وَالْمُشْرِكِينَ وَالْمُشْرِكَاتِ
الظَّانِّينَ بِاللَّهِ ظَنَّ السَّوْءِ عَلَيْهِمْ دَائِرَةُ السَّوْءِ
وَغَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَلَعَنَهُمْ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَهَنَّمَ
وَسَاءَتْ مَصِيرًا-
‘আর মুনাফিক পুরুষ ও নারী এবং মুশরিক পুরুষ ও নারী যারা আল্লাহ সম্বন্ধে মন্দ ধারণা পোষণ করে তাদেরকে তিনি শাস্তি দিবেন। তাদের চারিদিকে অমঙ্গল চক্র, আল্লাহ তাদের প্রতি রাগ করেছেন, তাদের প্রতি অভিসম্পাত করেছেন এবং তাদের জন্য জাহান্নাম প্রস্ত্তত রেখেছেন। উহা কত নিকৃষ্ট আবাস্থল’ (ফাতাহ ৪৮/৬)। يَظُنُّوْنَ بِاللهِ غَيْرَ الْحَقِّ ظَنَّ الْجَاهِلِيَّةِ- ‘তারা আল্লাহ সম্পর্কে মূর্খদের মতো অন্যায় ধারণা করছিল’ (আলে ইমরান ৩/১৫৪)। অধিকাংশ মানুষ আল্লাহর প্রতি মিথ্যা ধারণা পোষণ করে থাকে। যে ব্যক্তি সত্যিকারার্থে আল্লাহকে চিনে, তার নামসমূহ ও গুণাবলীসমূহ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখে। তারা মিথ্যা ধারণা মুক্ত থাকে। কিছু মিথ্যা ধারণার উদাহরণ হ’ল।
১. ভাল-মন্দের প্রতিফল বলতে কিছুই নেই।
২. আমল যে যাই করুক আল্লাহ করান, বিধায় তিনি দায়ী। বান্দার ভাল-মন্দ করার এখতিয়ার, শক্তি বা ক্ষমতা নেই।
৩. আল্লাহর চোখ, কান বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বর্ণনাগুলো কুদরতী অঙ্গ-প্রতঙ্গ, কোন কিছুর সাথে সাদৃশ্য স্থাপন করা।
৪. তিনি যেমন ঈমান, পুণ্য, আনুগত্য সংস্কার পসন্দ করেন তেমন কুফর, ফাসিক্বী, সীমালঙ্ঘন করাও পসন্দ করেন।
৫. তিনি সর্বত্র বিরাজমান, যেমন উপরে আছেন তেমনি নীচেও আছেন। যেমন আসমানে আছেন তেমনি পাতালেও আছেন।
৬. নবী-রাসূল, কিতাব বলতে কিছুই নেই। চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায় আমাদেরকে এমনিই সৃষ্টি তৈরী করা হয়েছে। উল্লেখিত মিথ্যা, অমূলক ধারণা ব্যতীত আরো অসংখ্য ধারণা প্রচলিত রয়েছে। সকল প্রকার কুধারণা মুক্ত ঈমান গ্রহণ করাই لا إله إلا الله গ্রহণ করার একটি শর্ত। মিথ্যা ধারণা ত্যাগ করতে হবে। হাদীছে কুদসীতে এসেছে,
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رضى الله عنه قَالَ قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ اللهُ تَعَالَى أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِىْ بِىْ، وَأَنَا مَعَهُ إِذَا ذَكَرَنِىْ، فَإِنْ ذَكَرَنِىْ فِىْ نَفْسِهِ ذَكَرْتُهُ فِىْ نَفْسِى، وَإِنْ ذَكَرَنِىْ فِىْ مَلأٍ ذَكَرْتُهُ فِى مَلأٍ خَيْرٍ مِنْهُمْ، وَإِنْ تَقَرَّبَ إِلَىَّ بِشِبْرٍ تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ ذِرَاعًا، وَإِنْ تَقَرَّبَ إِلَىَّ ذِرَاعًا تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ بَاعًا، وَإِنْ أَتَانِى يَمْشِى أَتَيْتُهُ هَرْوَلَةً-
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘আমি সে রকমই, যে রকম বান্দা আমার প্রতি ধারণা রাখে। আমি বান্দার সঙ্গে থাকি যখন সে আমাকে স্মরণ করে। যদি সে মনে মনে আমাকে স্মরণ করে; আমিও তাকে নিজে স্মরণ করি। আর যদি সে জন-সমাবেশে আমাকে স্মরণ করে, তবে আমিও তাদের চেয়ে উত্তম সমাবেশে তাকে স্মরণ করি। যদি সে আমার দিকে এক বিঘত এগিয়ে আসে, তবে আমি তার দিকে এক হাত এগিয়ে যাই, যদি সে আমার দিকে এক হাত অগ্রসর হয়; আমি তার দিকে দু’হাত এগিয়ে যাই। আর সে যদি আমার দিকে হেঁটে আসে, আমি তার দিকে দৌড়ে যাই’।[1]
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ الأَنْصَارِىِّ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَبْلَ مَوْتِهِ بِثَلاَثَةِ أَيَّامٍ يَقُوْلُ لاَ يَمُوْتَنَّ أَحَدُكُمْ إِلاَّ وَهُوَ يُحْسِنُ الظَّنَّ بِاللهِ عَزَّ وَجَلَّ-
জাবির ইবনু আবদুল্লাহ আনছারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর তিন দিন পূর্বে আমি তাকে এ কথা বলতে শুনেছি যে, তোমাদের প্রত্যেকেই যেন আল্লাহর প্রতি নেক ধারণা পোষণ করা অবস্থায় মারা যায়’।[2]
হাদীছে এ ব্যাপারে সতর্কতা রয়েছে,
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِيَّاكُمْ وَالظَّنَّ فَإِنَّ الظَّنَّ أَكْذَبُ الْحَدِيْثِ وَلاَ تَحَسَّسُوْا وَلاَ تَجَسَّسُوْا وَلاَ تَنَافَسُوْا وَلاَ تَحَاسَدُوْا وَلاَ تَبَاغَضُوْا وَلاَ تَدَابَرُوْا وَكُونُوْا عِبَادَ اللهِ إِخْوَانًا-
আবু হুরায়রা হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা অনুমান থেকে বেঁচে থাক। কারণ অনুমান সবচেয়ে বড় মিথ্যা। আর কারো দোষ খুঁজে বেড়িও না, গোয়েন্দাগিরি করো না, পরস্পরকে ধোঁকা দিও না, আর পরস্পরকে হিংসা করো না, একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ করো না এবং পরস্পরের বিরুদ্ধাচরণ করো না। বরং সবাই আল্লাহর বান্দা ভাই ভাই হয়ে যাও’।[3] উক্ত আলোচনায় বুঝা গেল, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর প্রতি এমন ইয়াক্বীন থাকতে হবে যা সন্দেহ-সংশয়কে প্রতিহত করতে সক্ষম।
৩য় শর্ত : الْقَبُول ُ(আল-কবূল) গ্রহণ করা :
যখন তাওহীদের ইলম অর্জন ও দৃঢ় বিশ্বাস পয়দা হবে তখন এই তাওহীদী কালিমার প্রাপ্য হক্ব হ’ল তা গ্রহণ করে নেয়া। কোন ক্ষেত্রে হিংসা ও অহংকার বশতঃ তার কোন অংশ অস্বীকার করলে তবে সে মুশরিক, কাফির এবং অমুসলিমের অন্তর্ভুক্ত। মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّهُمْ كَانُوْا إِذَا قِيْلَ لَهُمْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ يَسْتَكْبِرُوْنَ وَيَقُولُوْنَ أَئِنَّا لَتَارِكُو آلِهَتِنَا لِشَاعِرٍ مَجْنُوْنٍ- ‘যখন তাদেরকে বলা হ’ত, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই, তখন তারা ঔদ্ধত্য দেখাতো এবং বলত, আমরা একজন উন্মাদ কবির কথায় আমাদের উপাস্যদের পরিত্যাগ করব? (ছাফফাত ৩৭/৩৫-৩৬)।
যখন তাওহীদের ইলম অর্জন ও এর দৃঢ় বিশ্বাস পয়দা হবে তখন এই ইলম ও ইয়াক্বীনের প্রভাবে তাওহীদের প্রয়োজনীয় বিষয়াদি অন্তর ও মুখের দ্বারা প্রকাশিত হয়ে যাবে।
৪র্থ শর্ত : الِانْقِيَادُ (আল-ইনক্বিয়াদ) অনুগত হওয়া :
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ মুখে উচ্চারণের সাথে সাথে এর প্রতি দৃঢ়বিশ্বাস স্থাপন এবং নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করে দিতে হবে। এই আত্মসমর্পণ হ’ল দু’টি বিষয়ের উপরে। (১) এক আল্লাহর ইবাদত বা একত্বের ঘোষণা (২) সকল প্রকার ত্বাগূত্বী শক্তি বর্জন করা। মহান আল্লাহ বলেন,
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِيْ كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوْا اللهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوْتَ-
‘প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিকট আমরা রাসূল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং ত্বাগূত থেকে দূরে থাক’ (নাহল ১৬/৩৬)।
অতএব যারা গুমরাহকারী ত্বাগূতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহ তে বিশ্বাস স্থাপন করে সে সুদৃঢ় হাতল ধারণ করেছে যা ভাঙ্গার নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوْتِ وَيُؤْمِنْ بِاللهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا وَاللهُ سَمِيعٌ عَلِيْمٌ-
‘যে ব্যক্তি তাগূতে অবিশ্বাস করবে এবং আল্লাহর উপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করবে, সে ব্যক্তি এমন এক মযবুত হাতল অাঁকড়ে ধরল, যা কখনোই ভাঙ্গবার নয়। বস্ত্ততঃ আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (বাক্বারাহ ২/২৫৬)। আল্লাহ অন্যত্র বলেন,
وَالَّذِيْنَ اجْتَنَبُوْا الطَّاغُوْتَ أَنْ يَعْبُدُوْهَا وَأَنَابُوْا إِلَى اللهِ لَهُمُ الْبُشْرَى فَبَشِّرْ عِبَادِ-
‘পক্ষান্তরে যারা ত্বাগূতের পূজা হ’তে বিরত থাকে এবং আল্লাহ মুখী হয়, তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ। অতএব সুসংবাদ দাও আমার বান্দাদেরকে’ (জুম‘আর ৩৯/১৭) উল্লেখিত আয়াতগুলিতে ত্বাগূত বর্জন এবং তাওহীদ অর্জনের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। নিম্নে ত্বাগূতের সংক্ষিপ্ত পরিচয় পেশ করা হ’ল।
ত্বাগূত-এর পরিচয় : (الطَّاغُوْتَ) ‘ত্বাগূত’ শব্দটি আরবী الطغيان (তুগইয়ান) শব্দ থেকে নির্গত। ত্বাগূত (الطَّاغُوتَ)-এর শাব্দিক অর্থ বিপদগামী, সীমালঙ্ঘনকারী, আল্লাহদ্রোহী, অবাধ্য, পথভ্রষ্ট, মূর্তি, শয়তান, দেবতা। প্রসিদ্ধ আরবী অভিধান লিসানুল আরব-এ বলা হয়েছে, كلُّ مُجَاوِزٍ حدَّه فِي العِصْيانِ طَاغٍ- ‘যে বা যারা আনুগত্যের ক্ষেত্রে সীমালংঘন করে তারাই ত্বাগূত’।[4]
ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন, الطَّاغُوتَ كلُّ مَا عُبِدَ مِنْ دُوْنِ اللهِ- আল্লাহ ব্যতীত অন্য যারই ইবাদত করা হয় তাকেই ‘ত্বাগূত’ বলা হয়’।[5]
আবু ইসহাক বলেন, كلُّ معبودٍ مِنْ دُونِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ جِبْتٌ وطاغُوْتٌ- আল্লাহ ব্যতীত অন্য যারই ইবাদত করা হয় সেটিই ‘জিবত’ ও ‘ত্বাগূত’।[6]
আবার যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধানকে বাদ দিয়ে নিজের মন মত বিধান রচনা করে সেও ত্বাগূত হিসাবে পরিগণিত হবে। আর যারা মানব রচিত আইন মেনে চলে তারা ত্বাগূতের অনুসারী।
ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮ হিঃ) বলেন,
فالمعبود من دون الله اذا لم يكن كارها لذالك طاغوب ولهذا سمي النبي صلي الله عليه وسلم الاصنام طواغيت-
‘আল্লাহ ছাড়া যাদের ইবাদত করা হয় তারা যদি এতে অসন্তুষ্ট না হয় তবে তারাই ত্বাগূত। এজন্যই রাসূল (ছাঃ) মূর্তিগুলিকে ত্বাগূত নামকরণ করেছিলেন’। [7]
মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব বলেন,
الطاغوت عام في كل ما عبد من دون الله رضي بالعبادة من معبود او متبوع او مطاع في غير طاعت الله و رسوله فهو طاغوت -
‘ত্বাগূত হ’ল ঐ সকল মা‘বূদ অনুকরণীয়, অনুসরণীয় ব্যক্তি বা বস্ত্ত আল্লাহ ব্যতীত যাদের ইবাদত করা হয় আললাহ ও তার রাসূলের আনুগত্যের বিপরীতে এবং তারা এতে সন্তুষ্টি থাকে’।[8]
সাইয়্যেদ কুতুব বলেন,
كل ما يطغي علي الوعي و يجوز علي الحق ويتجاوز الحدود التي رسمها الله للعبادة، ولا يكون له ضابط من العقيدة في الله من الشريعة التي يسنها الله -
‘যারা সত্যকে অমান্য করে আল্লাহর দেওয়া সীমারেখা ইবাদতের ক্ষেত্রে অতিক্রম করে, আল্লাহর দেওয়া শরী‘আতের কোন পরোয়া করে না। ইসলামী আক্বীদার কোন গুরুত্ব রাখে না। এরা সবাই ত্বাগূত’।[9]
ইবনে আবি হাতিমের বর্ণনায় রয়েছে ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন, الطاغوتُ الشيطانُ ‘ত্বাগূত হ’ল শয়তান’।[10]
জাবির (রাঃ) বলেন,
الطَّاغُوتَ : كهان كانت عليهم الشياطين-
‘ত্বাগূত হ’ল জ্যোতিষী যার উপর শয়তান অবতরণ করে’।[11]
এই ত্বাগূতকে বর্জন করার শিক্ষা দিতেই যুগে যুগে মহান আল্লাহ তা‘আলা রাসূল প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ বলেন,
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ-
‘প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিকট আমরা রাসূল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং ত্বাগূত থেকে দূরে থাক’ (নাহল ১৬/৩৬)।
ত্বাগূতে বিশ্বাসীদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِيْنَ أُوتُوْا نَصِيبًا مِنَ الْكِتَابِ يُؤْمِنُونَ بِالْجِبْتِ وَالطَّاغُوتِ وَيَقُولُونَ لِلَّذِينَ كَفَرُوا هَؤُلَاءِ أَهْدَى مِنَ الَّذِينَ آمَنُوا سَبِيلًا-
‘তুমি কি তাদের (ইহুদীদের) দেখনি, যাদেরকে ইলাহী কিতাবের কিছু অংশ দেওয়া হয়েছে। যারা প্রতিমা ও শয়তানের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং (মক্কার) কাফিরদের বলে যে, তারাই মুমিনদের চাইতে অধিক সুপথপ্রাপ্ত’ (নিসা ৪/৫১)। তিনি আরো বলেন,
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا-
‘আপনি কি তাদের দেখেননি, যারা ধারণা করে যে, তারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে যা আপনার উপর নাযিল হয়েছে তার উপর এবং যা আপনার পূর্বে নাযিল হয়েছে তার উপর। তারা ত্বাগূতের নিকট ফায়ছালা পেশ করতে চায়। অথচ তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তাকে অস্বীকার করার জন্য। বস্ত্ততঃ শয়তান তাদেরকে দূরতম ভ্রষ্টতায় নিক্ষেপ করতে চায়’ (নিসা ৪/৬০)। অন্যত্র তিনি বলেন,
الَّذِينَ آمَنُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ الطَّاغُوتِ فَقَاتِلُوا أَوْلِيَاءَ الشَّيْطَانِ إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطَانِ كَانَ ضَعِيفًا-
‘যারা ঈমানদার তারা লড়াই করে আল্লাহর পথে। আর যারা কাফের তারা লড়াই করে ত্বাগূতের পথে। অতএব তোমরা লড়াই কর শয়তানের বন্ধুদের বিরুদ্ধে। নিশ্চয়ই শয়তানের কৌশল অতীব দুর্বল’(নিসা ৪/৭৬)।
উল্লেখিত বর্ণনার প্রেক্ষিতে বুঝা যায়, ত্বাগূতের অনুসারীরা ভয়াবহ পরিস্থির শিকার হবে। যারা মনগড়া আইনে বিচার করে, তাক্বলীদের অনুসারী, মাযার-দরগার অনুসারী, গণক, জ্যোতিষী, যাদুতে বিশ্বাসী তারাই ত্বাগূতে বিশ্বাসী, এসব বিশ্বাস ত্যাগ করে তাওবা করা আবশ্যক। অন্যথায় জাহান্নামী হওয়ার নিশ্চয়তা রয়েছে।
৫ম শর্ত : الصِّدْقُ (আছ-ছিদক্ব) সত্যবাদিতা :
মিথ্যা এবং নিফাক্বী বর্জিত সত্যতা। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ গ্রহণ করার পর এর এমন সত্যতা প্রকাশ করতে হবে যার মাঝে নিফাক্বী তথা শঠতা থাকবে না, থাকবে না মিথ্যা সন্দেহ-সংশয়, ও অবিশ্বাস। রাসূল (ছাঃ) বলেন,
إِنِّي لأَعْلَمُ كَلِمَةً لَا يَقُولُهَا عَبْدٌ حَقًّا من قلبه فَيَمُوت وَهُوَ عَلَى ذَلِكَ إِلا حَرَّمَهُ الِلَّهِ عَلَى النَّارِ لَا إِلَه إِلَّا اللهِ-
‘নিশ্চয়ই আমি একটি কালিমা জানি যদি বান্দা সত্যিকারে অন্তর থেকে তা বলে এবং তার উপরে অটল থেকে মৃত্যু বরণ করে তবে তার জন্য জাহান্নাম হারাম হয়ে যায়, তা হ’ল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’।[12]
পক্ষান্তরে মুনাফিক্বরা তাওহীদের কালেমা মুখে বললেও অন্তরে তার স্থান নেই। মহান আল্লাহ বলেন,يَقُولُونَ بِأَلْسِنَتِهِمْ مَا لَيْسَ فِي قُلُوبِهِمْ- ‘তারা মুখে তা বলে যা তাদের অন্তরে নেই’। (ফাৎহ ৪৮/১১)। অন্যত্র তিনি বলেন,
إِذَا جَاءَكَ الْمُنَافِقُونَ قَالُوا نَشْهَدُ إِنَّكَ لَرَسُولُ اللهِ وَاللهُ يَعْلَمُ إِنَّكَ لَرَسُولُهُ وَاللهُ يَشْهَدُ إِنَّ الْمُنَافِقِينَ لَكَاذِبُونَ-
‘যখন তোমার কাছে মুনাফিকরা আসে, তখন বলে, আমরা স্বাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রাসূল এবং আল্লাহ জানেন যে, অবশ্যই তুমি তাঁর রাসূল। আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, অবশ্যই মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী’ (মুনাফিকুন ৬৩/১)। এ সকল বিষয় থেকে স্পষ্টই বুঝা যায় যে, কালিমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর সত্যতা ভিতরে-বাহিরে সমানভাবে থাকতে হবে। শুধু বাহ্যিক সাক্ষ্য প্রদানের সত্যতার মাধ্যমে মুসলিম বা মুমিন হওয়া যায় না। বরং এটা মুনাফিকের লক্ষণ। আল্লাহ বলেন,
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَقُولُ آمَنَّا بِاللَّهِ وَبِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَمَا هُمْ بِمُؤْمِنِين-َ
‘আর লোকদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে, যারা বলে আমরা আল্লাহ ও বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি। অথচ তারা বিশ্বাসী নয়’ (বাক্বারাহ ২/৮)। অত্র আয়াত দ্বারা বুঝা যায় অন্তরের সত্যায়ন ব্যতীত ঈমানদার হওয়া যায় না।
৬ষ্ট শর্ত : الْمُحَبَّةُ (আল-মুহাববাত) ভালোবাসা :
মুমিনগণ তাওহীদের এই কালিমাকে মনেপ্রাণে ভালোবাসবে, এর চাহিদা অনুযায়ী আমল করবে, এর প্রতি যাদের গভীর জ্ঞান রয়েছে তাদেরকেও ভালোবাসবে। নিজেকে কালিমার নিকট সমর্পণ করবে, মুখে ও অন্তরে কালিমার মুহাববাত প্রকাশ করবে। এই ভালোবাসার কিছু নিদর্শন বা আলামত হ’ল- ১. আল্লাহর ভালোবাসাকে অগ্রাধিকার দেওয়া ২. আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বন্ধুকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করা ৩. আল্লাহর শত্রুদের সাথে শত্রুতা পোষণ করতে হবে। ৪. রাসূল (ছাঃ)-এর পূর্ণ অনুগত্যশীল হ’তে হবে। ৫. তার আনিত হেদায়াতই হেদায়াতের একমাত্র পথ হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللهِ أَنْدَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللهِ وَالَّذِيْنَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ-
‘আর মানুষের মধ্যে এমন কিছু মানুষ রয়েছে, যারা অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করে। তারা তাদেরকে ভালোবাসে আল্লাহকে ভালোবাসার ন্যায়। কিন্তু যারা ঈমানদার তারা আল্লাহর জন্য সর্বাধিক ভালোবাসা পোষণ করে থাকে’ (বাক্বারাহ ২/১৬৫)। তিনি আরো বলেন,
مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ -
‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এবং তার সহচরগণ কাফিরদের প্রতি কঠোর, নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভুতিশীল’ (ফাতাহ ৪৮/২৯)।
৭ম শর্ত : الْإِخْلَاصُ (আল-ইখলাছ) একনিষ্ঠতা :
ইখলাছ বা একনিষ্টতা হ’ল বান্দার ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্যই নিবেদিত হওয়া, ইবাদতে গায়রুল্লাহর জন্য বিন্দু পরিমাণ অংশও নিবেদিত না হওয়া। এই কালিমাই যে ইসলামের একমাত্র মূলমন্ত্র তাতে দৃঢ় বিশ্বাস, অন্তর দিয়ে গ্রহণ এবং এতে নিজেকে সমর্পণ করাই এর মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। মহান আল্লাহ বলেন, وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ-
‘অথচ তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি যে, তারা খালেছ অন্তরে একনিষ্ঠভাবে কেবলমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে এবং ছালাত কায়েম করবে ও যাকাত আদায় করবে। আর এটাই হ’ল সরল দ্বীন’ (বাইয়েনাহ ৯৮/৫)।
ইতবান (রাঃ)-এর বর্ণনায় পাওয়া যায় রাসূল (ছাঃ) বলেন,
فَإِنَّ اللهَ قَدْ حَرَّمَ عَلَى النَّارِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ يَبْتَغِى بِذَلِكَ وَجْهَ اللهِ-
‘আল্লাহ তা‘আলা এমন ব্যক্তির উপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দিয়েছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলেন’।[13]
এখানে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্থই হ’ল ইখলাছ। যার মধ্যে ইখলাছ নেই সে মুশরিক। আর যার মধ্যে এর সত্যতার স্বীকৃতি নেই সে মুনাফিক। ইখলাছের সাথে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার সুফল সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন,
يَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، وَفِى قَلْبِهِ وَزْنُ شَعِيرَةٍ مِنْ خَيْرٍ، وَيَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، وَفِى قَلْبِهِ وَزْنُ بُرَّةٍ مِنْ خَيْرٍ، وَيَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، وَفِى قَلْبِهِ وَزْنُ ذَرَّةٍ مِنْ خَيْرٍ. قَالَ أَبُو عَبْدِ اللهِ قَالَ أَبَانُ حَدَّثَنَا قَتَادَةُ حَدَّثَنَا أَنَسٌ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم مِنْ إِيْمَانٍ. مَكَانَ مِنْ خَيْرٍ-
‘যে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে এবং তার অন্তরে একটি যব পরিমাণ ও নেকী থাকবে তাকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে। যে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে এবং তার অন্তরে একটি গম পরিমাণও নেকী থাকবে তাকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে। যে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে এবং তার অন্তরে একটি অনু পরিমাণও নেকী থাকবে তাকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّهُ قَالَ قِيلَ يَا رَسُولَ اللهِ، مَنْ أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِكَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لَقَدْ ظَنَنْتُ يَا أَبَا هُرَيْرَةَ أَنْ لاَ يَسْأَلَنِى عَنْ هَذَا الْحَدِيثِ أَحَدٌ أَوَّلُ مِنْكَ،لِمَا رَأَيْتُ مِنْ حِرْصِكَ عَلَى الْحَدِيثِ، أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِى يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، خَالِصًا مِنْ قَلْبِهِ أَوْ نَفْسِهِ-
‘রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল ক্বিয়ামতের দিন মানুষের মাঝে আপনার শাফা‘আত পেয়ে কে সবচেয়ে বেশী ধন্য হবে? উত্তরে রাসূল (ছাঃ) বললেন, ক্বিয়ামতের দিন মানুষের মাঝে ঐ ব্যক্তি আমার শাফা‘আত পেয়ে বেশী ধন্য হবে যে একনিষ্ঠচিত্তে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে’।[14]
উল্লেখিত হাদীছগুলোর মূল উদ্দেশ্য হ’ল ইখলাছের সাথে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর সাক্ষ্য প্রদান করা। তাহ’লে ইখলাছের অর্জন করতে হ’লে সকল প্রকার হারাম কাজ-কর্ম ত্যাগ করতে হবে।
‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ তথা মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর রাসূল এ কথার সাক্ষ্য প্রদানের শর্তসমূহ
ইলামের প্রথম স্তম্ভের ২য় অংশ হ’ল একথার সাক্ষ্য প্রদান করা যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। যিনি আব্দুল্লাহর ঔরশে আমেনার গর্ভে সকল মানবের সাধারণ নিয়মে পৃথিবীতে আগমণ করেন। মাটির তৈরী রক্ত-গোশতে গড়া এক মহান মানব। যার বংশ তালিকা ইসমাঈল (আঃ) পর্যন্ত মিশেছে। মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে রাসূল হিসাবে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করতে হ’লে ৪টি শর্ত অবশ্যই মেনে চলতে হবে।
১ম শর্ত : (طاعة النبي صلي الله عليه وسلم فيما امر) নবী করীম (ছাঃ) যা আদেশ করেছেন তার আনুগত্য করা :
মহান আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُولِ-
‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর ও তোমাদের নেতৃবৃন্দের আনুগত্য কর। অতঃপর যদি কোন বিষয়ে তোমরা বাক-বিতন্ডা কর, তাহ’লে বিষয়টি আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। এটাই কল্যাণকর ও পরিণতির দিক দিয়ে সর্বোত্তম’(নিসা ৪/৫৯)। অন্যত্র তিনি আরো বলেন,
مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ وَمَنْ تَوَلَّى فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًا-
‘যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করে, সে আল্লাহর আনুগত্য করে। আর যে ব্যক্তি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাদের উপর আমরা আপনাকে রক্ষকরূপে প্রেরণ করিনি’ (নিসা ৪/৮০)।
রাসূলের অনুসরণের গুরুত্ব যেমন রয়েছে তেমন তার সফলতাও রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ-
‘এগুলি হ’ল আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশ দিয়ে নদী সমূহ প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আর এটাই হ’ল মহা সফলতা’ (নিসা ৪/১৩)। তিনি অন্যত্র বলেন,
قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا الَّذِي لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ يُحْيِي وَيُمِيتُ فَآمِنُوا بِاللهِ وَرَسُولِهِ النَّبِيِّ الْأُمِّيِّ الَّذِي يُؤْمِنُ بِاللهِ وَكَلِمَاتِهِ وَاتَّبِعُوهُ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ-
‘তুমি বল, হে মানবজাতি! আমি তোমাদের সকলের প্রতি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। যার জন্যই আসমান ও যমীনের রাজত্ব। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। যিনি জীবিত করেন ও মৃত্যু দান করেন। অতএব তোমরা বিশ্বাস স্থাপন কর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর, যিনি নিরক্ষর নবী। যিনি বিশ্বাস স্থাপন করেছেন আল্লাহ ও তার বিধান সমূহের উপর। তোমরা তার অনুসরণ কর যাতে তোমরা সুপথপ্রাপ্ত হতে পার’ (আ‘রাফ ৭/১৫৮)।
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
كُلُّ أُمَّتِى يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ إِلاَّ مَنْ أَبَى قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ وَمَنْ يَأْبَى قَالَ مَنْ أَطَاعَنِى دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ عَصَانِى فَقَدْ أَبَى-
‘আমার সকল উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করবে তবে যারা অস্বীকার করে তারা ব্যতীত। বলা হ’ল কারা অস্বীকার করে হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি বললেন, যে আমার অনুসরণ করে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে আর যে আমার অবাধ্যতা করবে সে জান্নাতে যেতে অস্বীকার করে’।[15]
মহান আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَلَا تُبْطِلُوا أَعْمَالَكُمْ-
‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্য কর এবং নিজেদের কর্ম বিনষ্ট করো না’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৩৩)। আয়াত ও হাদীছসমূহে রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্যের তাকীদ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এর অবহেলাকারীদের অপমানজনক অবস্থার সম্মুখীন হ’তে হবে।
২য় শর্ত : (تصديق فيما اخبر) রাসূল (ছাঃ) যে সকল বিষয়ে সংবাদ প্রদান করেছেন তার সত্যতা স্বীকার করা :
কারণ তিনি নিজে থেকে কিছুই বলেন না অহী ব্যতীত। মহান আল্লাহ বলেন,
وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى-
‘তিনি নিজের মনগড়া কিছুই বলেননি যতক্ষণ পর্যন্ত আমার পক্ষ থেকে অহি করা না হয়েছে’ (নজম ৫৩/৩-৪)। তিনি আরো বলেন,
وَلَوْ تَقَوَّلَ عَلَيْنَا بَعْضَ الْأَقَاوِيلِ لَأَخَذْنَا مِنْهُ بِالْيَمِينِ ثُمَّ لَقَطَعْنَا مِنْهُ الْوَتِينَ فَمَا مِنْكُمْ مِنْ أَحَدٍ عَنْهُ حَاجِزِينَ-
‘সে যদি আমার নামে কোন কথা রচনা করত; তবে আমি তার ডান হাত ধরে ফেলতাম, অতঃপর তার গ্রীবা কেটে ফেলতাম। আর তোমাদের কেউ তাকে রক্ষা করতে পারত না’ (হাক্কাহ ৬৯/৪৪-৪৭)। অতএব রামূল (ছাঃ) যেহেতু আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয় কথা বলেন, ‘সেহেতু রাসূলের কথা মুমিনের জন্য শিরোধার্য। এর ব্যতিক্রম করা যাবে না। আল্লাহ বলেন,
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا-
‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফায়ছালা দিলে কোন মুমিন পুরুষ বা নারীর সে বিষয়ে নিজস্ব কোন ফায়ছালা দেওয়ার এখতিয়ার নেই। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করবে, সে ব্যক্তি স্পষ্ট ভ্রান্তিতে পতিত হবে’(আহযাব ৩৩/৩৬)।
৩য় শর্ত : (اجتناب ما نهي عنه صلي الله عليه وسلم وزجر) রাসূল (ছাঃ) যে সকল বিষয় নিষেধ করেছেন এবং ধমক দিয়েছেন তা বর্জন করা :
মহান আল্লাহ বলেন,
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا-
‘রাসূল তোমাদের যা দিয়েছেন তা গ্রহণ কর, আর যা নিষেধ করেন তা বর্জন কর’ (হাশর ৫৯/৭)। তিনি আরো বলেন,
وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَتَعَدَّ حُدُودَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيهَا وَلَهُ عَذَابٌ مُهِينٌ-
‘যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করে এবং তার সীমা অতিক্রম করে তিনি তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। সে সেখানে চিরকাল থাকবে। তার জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি (নিসা ৪/১৪)।
৪র্থ শর্ত : شرع) (ان لا يعبد الله الا بما রাসূল (ছাঃ) যা বিধিবদ্ধ করেছেন তা ব্যতীত আল্লাহর ইবাদত না করা :
নির্ধারিত কোন ইবাদতের ব্যাপারে রাসূল কর্তৃক শিখানো শরী‘আতের কোন পদ্ধতি গ্রহণ না করে ইজতিহাদের দ্বারস্থ হওয়া সঠিক হবে না। বরং বিদ‘আতের রূপান্তর হবে। যা জাহান্নামী হওয়ার পথ আর জান্নাতী হওয়ার অন্তরায়। মহান আল্লাহ বলেন,
كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِينَ مَا تَدْعُوْهُمْ إِلَيْهِ اللهُ يَجْتَبِيْ إِلَيْهِ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِيْ إِلَيْهِ مَنْ يُنِيبُ-
‘আপনি মুশরিকদের সে বিষয়ে আমন্ত্রণ জানান তা তাদের মনোনীত করেন এবং তার অভিমুখী হয়, তাকে পথ প্রদর্শন করেন (শুরা ৪২/১৩)। রাসূলের শরী‘আত ব্যতীত অন্য শরী‘আত প্রনয়ণকারীদের ও অনুসরীদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আল্লাহ বলেন,
أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوْا لَهُمْ مِنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللهُ وَلَوْلَا كَلِمَةُ الْفَصْلِ لَقُضِيَ بَيْنَهُمْ وَإِنَّ الظَّالِمِيْنَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ-
‘তাদের কি এমন শরীক আছে (মা‘বূদ আছে) যারা তাদের জন্য সে ধর্মের শরী‘আত প্রনয়ণ করেছে অথচ যার অনুমতি আল্লাহ দেননি? যদি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না থাকত তবে তাদের ব্যাপার ফায়ছালা হয়ে যেত। নিশ্চয়ই যালেমদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ (শূরা ৪২/২১)।
অত্র আয়াতে শরী‘আত তৈরী এবং অন্য শরী‘আত মেনে নেয়া উভয়ই চরম শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَّمِنْهَاجًا وَلَوْ شَاءَ اللهُ لَجَعَلَكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَلَكِنْ لِّيَبْلُوَكُمْ فِيْ مَا آتَاكُمْ فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ-
‘প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য আমরা পৃথক বিধান ও পন্থা নির্ধারণ করেছি। আল্লাহ চাইলে তোমাদের সবাইকে এক দলভুক্ত করে দিতেন। কিন্তু তিনি চান তোমাদেরকে যে বিধানসমূহ দিয়েছেন, তাতে তোমাদের পরীক্ষা নিতে। অতএব তোমরা আল্লাহর আনুগত্যপূর্ণ কর্মসমূহে প্রতিযোগিতা কর। (মনে রেখ) আল্লাহর নিকটে তোমাদের সকলের প্রত্যাবর্তন স্থল। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে অবহিত করবেন যেসব বিষয়ে তোমরা মতভেদ করতে’(মায়েদাহ ৫/৪৮)। এ আয়াতের তাফসীরে এসেছে,
وهي طاعة الله واتباعه شرعه الذي جعله ناسخا لما قبله والتصديق بكتابه القران الذي هو اخركتاب انزله-
এখানে فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ অর্থ হ’ল তোমরা আল্লাহর আনুগত্য গ্রহণ কর সেই শরী‘আতের অনুসরণ কর যা দ্বারা পূর্বের ধর্মের মানসুখ করা হয়েছে আর তার ঐ কিতাব ‘আল কুরআন’-এর সত্যায়ন কর যা সর্বশেষ নাযিলকৃত কিতাব’।[16]
অত্র তাফসীরে স্পষ্টই বুঝা যায়, সকলকে রাসূল (ছাঃ)-এর শরী‘আতের প্রতি দ্রুত অগ্রসর হ’তে হবে। শরী‘আত কারো ব্যক্তিগত মতের ভিত্তিতে হ’তে পারে না।
আলী (রাঃ) বলেন,لَوْ كَانَ الدِّينُ بِالرَّأْىِ لَكَانَ أَسْفَلُ الْخُفِّ أَوْلَى بِالْمَسْحِ مِنْ أَعْلاَهُ - ‘যদি দ্বীন মানুষের রায় অনুযায়ী হ’ত, তা’হলে মোযার উপরে মাসাহ করার চেয়ে তার নীচে মাসাহ করা অধিক উত্তম হ’ত।[17]
মহান আল্লাহ বলেন,
ثُمَّ جَعَلْنَاكَ عَلَى شَرِيْعَةٍ مِنَ الْأَمْرِ فَاتَّبِعْهَا وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ إِنَّهُمْ لَنْ يُغْنُوا عَنْكَ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا وَإِنَّ الظَّالِمِينَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَاللَّهُ وَلِيُّ الْمُتَّقِينَ-
‘অতঃপর আমরা তোমাকে রেখেছি ধর্মের এক বিশেষ শরী‘আতের উপর। অতএব তুমি এর অনুসরণ কর এবং অজ্ঞদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করবে না। আল্লাহর সামনে তারা তোমার কোন উপকারে আসবে না। যালেমরা একে অপরের বন্ধু। আর আল্লাহ পরহেযগারদের বন্ধু’ (জাছিয়া ৪৫/১৮-১৯)। এতে পরিস্কারভাবেই বুঝা যায় একজন মাত্র ব্যক্তির মাধ্যমে শরী‘আত হয় তার নাম মুহাম্মাদ (ছাঃ)। সর্বশেষ এ কথা স্পষ্টই বলা যায় যে, যত বিধানাবলীর নির্দেশিকা আল্লাহ তা‘আলা দিয়েছেন তা অনুসরণে বাধ্যবাদকতার আদেশ দানে নবীকে স্বয়ং আল্লাহ বলতে আদেশ দিয়েছেন,
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ-
‘আর এটিই আমার সরল পথ। অতএব তোমরা এ পথেরই অনুসরণ কর। অন্যান্য পথের অনুসরণ করো না। তাহলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুৎ করে দেবে। এসব বিষয় তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যাতে তোমরা (ভ্রান্ত পথ সমূহ থেকে) বেঁচে থাকতে পার’ (আন’আম ৬/১৫৩)।
পূর্বোল্লিখিত শর্ত সাপেক্ষে একজন মানুষ মুমিন হিসাবে পরিচয় দিতে পারে। শর্ত অপূর্ণ রেখে কেউ মুমিন দাবী করলেও মূলত মুমিন হ’তে পারবে না। বহু স্বঘোষিত মুমিনকে আল্লাহ তা‘আলা বেঈমান, মুশরিক বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন,
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَقُولُ آمَنَّا بِاللَّهِ وَبِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَمَا هُمْ بِمُؤْمِنِينَ-
‘আর লোকদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে, যারা বলে আমরা আল্লাহ ও বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি। অথচ তারা বিশ্বাসী নয়’ (বাক্বারাহ ২/৮)। তিনি আরো বলেন,
وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلَّا وَهُمْ مُشْرِكُونَ-
‘তাদের অধিকাংশ আল্লাহকে বিশ্বাস করে। অথচ সেই সাথে শিরক করে’ (ইউসুফ ১২/১০৬)।
পরিশেষে বলব, কালিমার শর্তসমূহ বাস্তবায়নের মাধ্যমে মহান আল্লাহ আমাদেরকে খাঁটি ঈমানদার হওয়ার তাওফীক দান করুন-আমীন!
লেখক : ভেরামতলী, শ্রীপুর, গাজীপুর।
[1]. বুখারী হা/৭৪০৫।
[2]. মুসলিম হা/৭৪১২।
[3]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫০২৮।
[4]. লিসানুল আরব ১৫/৮ পৃ.।
[5]. ফাতহুল মাজীদ শারহু কিতাবুত তাওহীদ পৃ. ৪৪ ।
[6]. লিসানুল আরব ১৫/৯ পৃ.।।
[7]. ফাতাওয়া ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) ২৮/২০০।
[8]. মাজমু‘ আত-তাওহীদ পৃ. ৯।
[9]. তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন ১/২৯২ পৃ.।
[10]. ফাতহুল মাজীদ ১/১৬ পৃ.।
[11]. ঐ।
[12]. মুসতাদরাক হাকেম হা/২৪২।
[13]. বুখারী হা/৪২৫; মুসলিম হা/১৫২৮।
[14]. বুখারী হা/৯৯।
[15]. বুখারী হা/৭২৮০।
[16]. ইবনু কাছীর ২/৯৩ পৃ.।
[17]. আবুদাউদ হা/১৬২।