মৃত্যুর আগে যা বললেন ইসলামে দীক্ষিত যাজক

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 9031 বার পঠিত

[রোমান ক্যাথলিক যাজক ইদ্রিস তৌফিক্ব। প্রায় ১৫ বছর আগে তিনি কিসের টানে ইসলামে ধর্মান্তরিত হন তার সেই অভিজ্ঞতা সবার সঙ্গে শেয়ার করেছেন। তিনি ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারীতে অসুস্থতাজনিত কারণে যুক্তরাজ্যে মারা যান। তিনি বেশ কয়েক বছর যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এখানে তুলে ধরা হল তার সেই জীবনের মোড় পরিবর্তনকারী সুমহান ইসলামে আসার কাহিনী যা তিনি মৃত্যুর আগে নিজের জীবন সম্পর্কে লিখে গেছেন]।

আমি একজন যাজক হিসেবে কয়েক বছর মানুষের সেবা করেছি এবং তা আমি উপভোগ করেছি। যাইহোক, এর পরেও ভিতরে ভিতরে আমি খুশী ছিলাম না এবং আমার কাছে কেবল মনে হয়েছে, সেখানে কিছু একটা সঠিক নয়। সৌভাগ্যবশত এবং আল্লাহর ইচ্ছায় আমার জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা কাকতালীয়ভাবে আমাকে ইসলামের পথে নিয়ে যায়।

আমার ধারণা ছিল মিসর হচ্ছে পিরামিড, উট, বালি এবং খেজুর গাছের দেশ। আসলে আমি মিসরের হুর্ঘদায় একটি সফরে গিয়েছিলাম। এটা মিসরের প্রধান পর্যটন কেন্দ্র এবং দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। শহরটি লোহিত সাগর উপকূলে অবস্থিত।

এটা অনেকটা ইউরোপীয় কিছু সমুদ্র সৈকতের অনুরূপ, যা আমাকে বিস্মিত করেছিল। আমি প্রথমে বাসযোগে কায়রো যাই। সেখানে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর একটি সপ্তাহ অতিবাহিত করি। প্রথমবারের মতো আমি সেখানে ইসলাম ও মুসলমানদের সান্নিধ্যে আসি। সেখানে আমি খেয়াল করলাম, মিসরীয়রা কতটা ভদ্র ও ভাল মানুষ; কিন্তু দৈহিকভাবে খুবই শক্তিশালী।

ওই সময় মুসলমানদের সম্পর্কে সব ব্রিটিশদের মতো আমার চিন্তাধারাও ছিল একই রকম। মুসলিমরা হচেছ বোমাবাজ ও যোদ্ধা, যা মিডিয়া ও টেলিভিশন থেকে বারবার শুনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। অন্য সবার মতো আমারও ধারণা ছিল, ইসলাম একটি অশান্তির ধর্ম। তবে কায়রোতে এক সপ্তাহ অতিবাহিত করার পর আমি আবিষ্কার করলাম ইসলাম কতটা সুন্দর ও শান্তির ধর্ম।

মসজিদ থেকে আযানের শব্দ শুনতে পেয়ে রাস্তায় পণ্য বিক্রি করা অত্যন্ত সাধারণ মানুষগুলোকে তাদের বেচাকেনা ফেলে রেখে আল্লাহর দিকে তাদের মুখ নির্দেশ করে মুহূর্তের মধ্যে ছালাতে দাঁড়িয়ে যেতে দেখেছি। আল্লাহর প্রতি তাদের দৃঢ় বিশ্বাস আমাকে মুগ্ধ করে। মৃত্যুর পর স্বর্গ লাভের প্রত্যাশায় তারা নিয়মিত ছালাত ও ছিয়াম পালন করা, অভাবগ্রস্তকে সাহায্য করে এবং মক্কায় গিয়ে হজ্জ পালনের স্বপ্ন দেখে।

সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর আমি আমার পুরানো পেশা ধর্মীয় শিক্ষার কাজে ফিরে যাই। ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যবস্থায় একমাত্র বাধ্যতামূলক বিষয় হচ্ছে ধর্ম শিক্ষা অধ্যয়ন। আমি খ্রিস্টান, ইসলাম, ইহুদীধর্ম, বৌদ্ধ এবং অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কে শিক্ষা দিতাম। তাই প্রতিদিন আমাকে এসব ধর্ম সম্পর্কে পড়তে হতো। আমার ছাত্রদের অনেকে ছিল আরবের মুসলিম শরণার্থী। মোটকথা, ইসলাম সম্পর্কে শিক্ষা দিতে গিয়ে আমি এ ধর্ম সম্পর্কে অনেক কিছু শিখতে পারি।

সাধারণত কিশোর-কিশোরী বয়সে অনেক ছেলে-মেয়েই কিছুটা দুষ্টু প্রকৃতির হয়ে থাকে। কিন্তু এই আরব মুসলিম শরণার্থী শিশুরা ভাল মুসলমানের উদাহরণ স্থাপন করে। এই ছাত্র-ছাত্রীরা ছিল খুবই ভদ্র এবং দয়ালু। তাই তাদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গভীর হতে থাকে। রামাযান মাসে ছালাতের জন্য আমার শ্রেণীকক্ষ তারা ব্যবহার করতে পারবে কিনা সে সম্পর্কে তারা আমার মতামত জিজ্ঞাসা করে।

সৌভাগ্যবশত কেবল আমার রুমটিতেই কার্পেট বিছানো ছিল। আমি কার্পেটের ওপর শিশুদের মাসব্যাপী ছালাত পড়ার অনুমতি দেই। এসময় প্রতিদিন আমি পিছনে বসে তাদের প্রার্থনা পর্যবেক্ষণ করতাম। এটা আমাকে তাদের সাথে রামাযানের ছিয়াম রাখতে উৎসাহ যুগিয়েছিল। যদিও আমি তখনো পর্যন্ত মুসলিম ছিলাম না।

একবার ক্লাসে পবিত্র কুরআনের অনুবাদ পড়াতে গিয়ে করতে গিয়ে আমি একটি আয়াতে পৌঁছাই। এতে বলা হয়েছে, وَإِذَا سَمِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَى الرَّسُولِ تَرَى أَعْيُنَهُمْ تَفِيضُ مِنَ الدَّمْعِ مِمَّا عَرَفُوا مِنَ الْحَقِّ يَقُولُونَ رَبَّنَا آمَنَّا فَاكْتُبْنَا مَعَ الشَّاهِدِينَ ‘আর যখন তারা শোনে যা রাসূলের প্রতি নাযিল হয়েছে (অর্থাৎ কুরআন), তখন তুমি তাদের চক্ষুগুলিকে দেখবে, অবিরল ধারে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে, এ কারণে যে, তারা সত্যকে চিনে নিয়েছে। তখন তারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক, আমরা ঈমান এনেছি। তখন তারা বলে,  হে আমাদের প্রতিপালক, আমরা ঈমান এনেছি। অতএব তুমি আমাদেরকে মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত করে নাও’ (মায়েদাহ ৫/৮৩)

আমি আবেগে বিস্মিত হয়ে যাই। আমি অনুভব করলাম আমার চোখে অশ্রু ছলছল করছে এবং আমি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তা আড়াল করতে কঠোর চেষ্টা করলাম।

পরের দিন আমি আন্ডারগ্রাউন্ডে যাই এবং সেখানে গিয়ে খেয়াল করলাম মানুষ ইসলাম সম্পর্কে কতটা আতঙ্কগ্রস্ত। ব্রিটেনে মানুষের এই ধরণের মনোভাবে আমি ভয় পেয়ে যাই। ওই সময়ে পশ্চিমারা এই ধর্ম নিয়ে ভয় পেতে শুরু করে এবং তারা এটিকে সন্ত্রাসবাদের জন্য দায়ী করে।

তবে মুসলমানদের সঙ্গে আমার আগের অভিজ্ঞতা আমাকে একটি ভিন্ন দিকে নিয়ে যায়। আমি ভাবতে শুরু করি, কেন আমরা কিছু মানুষের সন্ত্রাসীদের কর্মের জন্য ধর্ম হিসেবে ইসলামকে দোষারোপ করি। যখন কিছু  খ্রীষ্টান একই কাজ করছে; তখন কেন কেউ খ্রীষ্টধর্মকে সন্ত্রাসবাদের ধর্ম বলে অভিযুক্ত করে না?

এই ধর্ম সম্পর্কে জানতে আমি একদিন লন্ডনের সবচেয়ে বড় মসজিদে যাই। লন্ডনের কেন্দ্রীয় মসজিদের প্রবেশ পথে আমি ইউসুফ ইসলামকে পাই। তিনি ছিলেন একজন পপ গায়ক। সেখানে বৃত্তাকারে বসে ইসলাম সম্পর্কে কিছু মানুষের কথা শুনলাম। একটা সময় আমার মন আমাকে জিজ্ঞাসা করতে থাকে, আপনি কি সত্যিই একজন মুসলিম হ’তে চলেছেন?

সেখানে আমাকে একজন বললেন, মুসলমানেরা এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাস করে, প্রতিদিন পাঁচবার ছালাত আদায় করে এবং রামাযান মাসে ছিয়াম পালন করে। আমি তাকে এই বলে থামিয়ে দিলাম, আমি এর সবই বিশ্বাস করি এবং এমনকি রামাযানে আমি ছিয়ামও রেখেছি।

তখন তিনি আমাকে বললেন, তাহলে আপনি কিসের জন্য এখনো অপেক্ষা করছেন? কোন জিনিস আপনাকে এ পথে আসতে বাধা দিচ্ছে?

আমি বলেছিলাম, না, আমি ধর্মান্তরিত হ’তে মনস্থ করিনি।

সেই মুহূর্তে মসজিদটিতে আযান দেয়া হলে সবাই প্রস্ত্তত হয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ছালাতে দাঁড়িয়ে যায়। আর আমি পিছনে বসে অনবরত ক্রন্দন করতে লাগলাম। তারপর আমি নিজেকে বললাম, আমি মূর্খের মত কি করছি?

তাদের ছালাত শেষ হলে আমি ইউসুফ ইসলামের কাছে যাই এবং তাকে অনুরোধ করি আমাকে কালেমা শিক্ষা দেয়ার জন্য; যাতে আমি ইসলামে ধর্মান্তর হতে পারি। তিনি প্রথমে আমাকে ইংরেজিতে কালেমার অর্থ ব্যাখ্যা করে শোনান। পরে আমি তার সঙ্গে সঙ্গে আরবিতে এটি পাঠ করি। এর অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য মাবূদ নেই এবং মুহাম্মাদ (ছা্ঃ) আল্লাহর রাসূল

কালেমা পাঠ করার পরে আমি আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। 

 

 

Comments

Top of Form

 



বিষয়সমূহ: ইসলামগ্রহণ
আরও