আত্মার শান্তি
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ড. নূরুল ইসলাম 1074 বার পঠিত
অষ্টাদশ
শতাব্দীর শেষপ্রান্তে শুরু হয়েছিল যে অন্তহীন যাত্রা, তার শেষ হল না আজ
অবধি। বিগত ২০০ বছর ধরে মগ দস্যুদের বর্বরতার মুখে এক অদ্ভুত অজানার পথে
অবিশ্রান্ত ছুটে চলেছে আরাকানের এই রোহিঙ্গা প্রজাতির মানুষগুলো। পদে পদে
সয়ে চলেছে আদিম গোত্রবাদ, বর্ণবাদ আর পাশবিক বর্বরতার নির্বিরাম খোঁচা।
ভাবতে কষ্ট হয় যে তারা আমাদের মতই মনুষ্য প্রজাতির অংশ। বিংশ শতাব্দীর
সভ্যতাগর্বী বিশ্বে যেখানে গলির নেড়ি কুকুরের অধিকার সংরক্ষণে হাযারও সংগঠন
বিদ্যমান, সেখানে জলজ্যান্ত মানুষ হয়ে তারা পশুর মত স্রেফ কচুকাটা হচ্ছে,
তাবৎ বিশ্বকে নিশ্চল স্বাক্ষী রেখে।
১৭৯৯ সালে তারা প্রথম জীবনবাজি রেখে দলে দলে শরণার্থী হয়েছিল চট্টগ্রাম অঞ্চলে। তারপর আবারও ১৯৭৮, ১৯৯১, ২০১২, ২০১৬ সালে। প্রতিবারই মগেরা তাদেরকে পশুর মত হাঁকিয়ে তাড়ানোর চেষ্টা করেছে। ১৯৮২ সাল থেকে তাদেরকে তো নাগরিক হিসাবেই স্বীকার করা হয় না। তারপরও যেসকল ভূমিপুত্র বাপ-দাদার ভিটার মায়ায় মুখ বুজে থেকে গিয়েছে তারা যেন বাস করে আসছিল আসমানের নিচে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ উন্মুক্ত কারাগারে। রোহিঙ্গাদের ভাষায় একই খাঁচায় ক্ষুধার্ত বিড়ালের সাথে ইঁদুরের বসবাসের বাস্তব প্রতিকল্প সে জীবন। কয়েক লক্ষ বনু আদম। আমাদের মতই অনুভুতিসম্পন্ন মানুষ। অথচ তাদের জীবনে ন্যূনতম স্বাধীনতা নেই, শিক্ষা নেই, আশা-ভরসা নেই, নেই নতুন দিনের হাতছানি। অবলা পশুর মত একঘেয়ে বয়ে চলা জীবন তাদের। রক্তের নদী, লাশের মিছিল, সম্ভ্রমহারার আর্তচিৎকার, ইয়াতীমের হাহাকার মিলে-মিশে এক মর্মন্তুদ শোকগাঁথা তাদের উপরকার আকাশ-বাতাস। সর্বশেষ আগ্রাসনে সেই ভিটে-মাটিটুকুও তাদের হারিয়ে আসতে হল।
তাদের অপরাধ অনেক। তারা গরীব, খেটে খাওয়া মানুষ; তারা দেখতে অসুন্দর, কালো বর্ণের। তারা স্বাধীন জীবনের প্রত্যাশী। তারা যুলুম থেকে বাঁচতে আগ্রহী। তারা মানুষের মত বাঁচতে চায়। তারা তাদের মানবিক অধিকার চায়। তবে সবচেয়ে বড় অপরাধ তারা মুসলমান। যে অপরাধে ফিলিস্তীন, কাশ্মীর, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, কসোভো, ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইয়ামনের নৃশংসতম গণহত্যাগুলো স্রেফ লাশের সংখ্যায় রূপ নিয়েছে, সেই একই অপরাধে অপরাধী রোহিঙ্গারাও। সুতরাং তাদেরকেও কেবল লাশের সংখ্যা গুণে যেতে হবে এবং নিজ নিজ পালার অপেক্ষায় থাকতে হবে, এটাই ভবিতব্য। এখানেই লুকিয়ে আছে বিশ্বমোড়লদের নীরব উপভোগের রহস্য। প্রথম আলো পত্রিকায় বাংলাদেশের জনৈক সেক্যুলার নিরাপত্তা বিশ্লেষক এএনএম মুনিরুযযামান রোহিঙ্গাদের বিষয়ে জাতিসংঘের দূর্বল অবস্থান দেখে কষ্ট হলেও বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, ‘তারা মুখে না বললেও এখানে একটি ধর্মীয় দিক আছে। অন্য ধর্মের হলে হয়তো প্রতিক্রিয়া ভিন্ন হতো’।
জাতিসংঘসহ অভিজাত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো একধরণের মানবাধিকার প্রচার করে থাকেন। তবে সেটা এতটাই সুনির্দিষ্ট পরিমাণে ও সুনির্দিষ্ট স্থানে যে, মানবাধিকার ধারণাটাই সেখানে কতটুকু অবশিষ্ট রয়েছে তা গবেষণার বিষয়। পুঁজিবাদী স্বার্থই সেখানে এক এবং একমাত্র সত্য। পুঁজির সুরক্ষায় যেখানে যতটুকু প্রয়োজন, তার ভিত্তিতেই ওঠানামা করে সেই মানবাধিকারের নিক্তি। ফলে সেই নিক্তিতে মিয়ানমারের শত অপরাধও ধরা পড়ে না। আদিম বর্বরতায় শত শত গ্রাম পুড়ানো, শত-সহস্র নিরপরাধ মানুষের জীবন হরণের করার পরও সেটা যুলুম হিসাবে গণ্য হয় না, বরং আখ্যা পায় পুঁজিপতি বিশ্বের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ হিসাবে। অপরদিকে অপরাধী হয় তারা যারা যুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, যারা প্রতিবাদী হন, যারা নিজের মা-বোন হত্যার প্রতিকার চান। কেননা তারা পুঁজির শত্রু। আর সেই শত্রু যদি মুসলমান হয়, তবে তো কথাই নেই। জঙ্গী বা সন্ত্রাসী শব্দবন্ধ তো প্রস্ত্ততই। যুৎসই প্রয়োগের অপেক্ষাও করতে হয় না। নৃশংস গণহত্যা চালানোর পরও যখন ভারত ও চীনকে প্রকাশ্যে মিয়ানমারের সমর্থনে এগিয়ে আসতে দেখা গেল, তখন বোঝার আর বাকি রইল না পুঁজির কাছে মানবতা কত বড় অসহায়। বোঝা গেল কেন জাতিসংঘ মিয়ানমারের এত জঘন্য অপরাধের চিত্র প্রকাশিত হওয়ার পরও দ্বিধান্বিত এই বিষয়ে যে, একে ‘গণহত্যা’ বলা যাবে কি যাবে না কিংবা এটি ‘জাতিগত নিধন’ আখ্যা দেয়া ঠিক হবে কি হবে না।
গত ২৪শে আগস্ট কফি আনান কমিশন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান ও চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু সেখানেও রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিশ্চিতের চেয়ে তার কাছে গুরুত্ব পেয়েছে মৌলবাদ (র্যাডিকালাইজেশন) ঠেকানো! অর্থাৎ যতটুকু মানবিকতা দেখানোর সুফারিশ করেছেন তাও সরল মানবতার জন্য নয়, বরং পুজিপতি বিশ্বের স্বার্থ রক্ষার জন্য! সেই সাথে বছরের পর বছর রোহিঙ্গাদের ওপর চলা গণহত্যার জন্য দায়ীদের বিচারের কথা কোথাও বলা হয় নি কমিশনের রিপোর্টে। যেন গণহত্যাগুলো রোহিঙ্গাদের প্রাপ্য ছিল! এভাবে তথাকথিত মানবতাময় বিশ্বে মানবতা যে কত তুচ্ছ মূল্যের জিনিস তা আরও একবার বেরিয়ে এল।
বাংলাদেশের সেক্যুলার চেতনাজীবীদের একটা অংশ আবার একে ধর্মীয় সংঘাত হিসাবে মানতে নারায। তাদের জন্য এটা মেনে নেয়া কঠিন যে মগ বৌদ্ধরা ধর্মীয় কারণে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করতে আগ্রহী। কেননা তাদের কাছে মুসলমান ব্যতীত পৃথিবীর আর সকলেই মানবতাবাদী, অসাম্প্রদায়িক এবং শান্তিবাদী। তাদের কাছে বরং রোহিঙ্গারাই সন্ত্রাসী, ইয়াবা ব্যবসায়ী, চোর-বাটপার। সে কারণেই বৌদ্ধরা তাদের ওপর আক্রমণ করেছে। অতএব তাদের একমাত্র চিন্তার বিষয় যে, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা যেন দেশে ইয়াবার বিস্তার না ঘটায় এবং আইন-শৃংখলার অবনতি না ঘটাতে পারে। এভাবে এই শ্রেণীর মানবতাও এক বিকট মুনাফেকী চেতনার কাছে বন্ধকীকৃত।
মানবতার কল্যাণের জন্য পৃথিবীর সর্বোচ্চ মর্যাদাবান যে নোবেল শান্তি পুরষ্কার, তাও এখন এক আতংকের নাম। কেননা যারা এই শান্তি পুরস্কার পাচ্ছেন, তারা অচিরেই অশান্তির নায়ক কিংবা পুজিপতিদের বরকন্দাজ হিসাবে আবির্ভুত হচ্ছেন। অংসান সুকি, বারাক ওবামা প্রমুখ তার বাস্তব প্রতিমূর্তি।
আধুনিক বিশ্বের এই স্বার্থবাদী ও প্রতারক মানবতাবাদের একটি প্রকৃষ্টতম উদাহরণ রোহিঙ্গা নির্যাতন। ২০০ বছর হয়ে গেল তাদের দুঃস্বপ্ন দেখার শুরু। আজও সে দুঃস্বপ্নের রাত কাটেনি তাদের জীবনে। প্রতিটি রাত তাদের জন্য জন্য আসে পুরোনো দুঃস্বপ্ন ভোলার এবং নতুন দুঃস্বপ্নের আশংকায়। আর কত প্রজন্ম ধরে চলবে রোহিঙ্গাদের ওপর এই বর্বরতা? আর কত মানবতার বুলি কপচানো হলে তারা ফিরে পাবে তাদের মানবীয় অধিকার?