তাওহীদের পরিচয়
মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন
আরীফা বিনতে আব্দুল মতীন সালাফী 1290 বার পঠিত
ইসলাম হ’ল একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান। আর ইসলামের মূলমন্ত্র বা কেন্দ্রীয় ভিত্তি হ’ল ঈমান। শেষ বিচারের দিবস সম্পর্কে প্রত্যেকেই বিশ্বাস রাখতে হবে। ইংরেজীতে প্রবাদ আছে, Islam not only a religion, but also a complete comprehenshive, dynamic and scientefic code of life. The belive in Almighty Allah is the fundamental thinks of Islamic code of life.
‘ইসলাম শুধুমাত্র ধর্মই নয় বরং ব্যাপকতায় পরিপূর্ণ, গতিময় ও বিজ্ঞানময় জীবন ব্যবস্থা। মহান আল্লাহতে বিশ্বাসই ইসলামিক জীবন ব্যবস্থার মূল ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু’।
জানা যরূরী যে, নিজস্ব কর্ম অনুযায়ী প্রত্যেকেই প্রতিদান পাবে। তার প্রতি বিশ্বাস করা অতীব যরূরী। এ প্রসঙ্গে আললাহ্ বলেন, يَوْمَ لَا تَمْلِكُ نَفْسٌ لِنَفْسٍ شَيْئًا وَالْأَمْرُ يَوْمَئِذٍ لِلَّه- ‘যেদিন কেউ কারও কোন উপকার করতে পারবে না এবং সেদিন সব কর্তৃত্ব হবে আল্লাহর’ (ইনফিত্বার ৮২/১৯)।
তিনি আরো বলেন, لَا يَتَكَلَّمُونَ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَنُ ‘দয়াময় আল্লাহ যাকে অনুমতি দিবেন সে ব্যতীত কেউ কথা বলতে পারবে না’ (নাবা ৭৮/৩৮)।
নিম্নে শাফা‘আত ও হাউযে কাউছার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়াস পাব ইনশাআললাহ।
شفاعة-এর আভিধানিক অর্থ :
شفاعة শব্দটি বাবে فتح-يفتح এর মাছদার। الشفع মূলধাতু থেকে নির্গত। এর শাব্দিক অর্থ : (১) সুফারিশ করা (To Recommend) (২) মধ্যস্থতা করা (To Mediate) (৩) সহানুভূতি দেখানো (To Sympathize) ।
شفاعة-এর পারিভাষিক অর্থ :
شفاعة-এর পারিভাষিক সংজ্ঞায় অধিকাংশ আলেমগণ বলেন, الشفاعة هي سؤال الخير للغير- অর্থাৎ شفاعة হ’ল অন্যের জন্য কল্যাণ কামনা করা।
শাফা‘আত বা সুপারিশ করার মাহাত্ম্য :
আল্লাহ বলেন, مَنْ يَشْفَعْ شَفَاعَةً حَسَنَةً يَكُنْ لَهُ نَصِيبٌ مِنْهَا وَمَنْ يَشْفَعْ شَفَاعَةً سَيِّئَةً يَكُنْ لَهُ كِفْلٌ مِنْهَا وَكَانَ اللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ مُقِيتًا- ‘যে ব্যক্তি ভাল কাজে সুফারিশ করে, সে
তার একটি অংশ পায় এবং যে ব্যক্তি মন্দ কাজে সুফারিশ করে সেও তার একটি অংশ পায়। বস্ত্ততঃ আল্লাহ সকল বিষয়ে শক্তি দানকারী’ (নিসা ৪/৮৫)।
হাদীছে এসেছে,عَنْ أَبِى مُوسَى قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا أَتَاهُ طَالِبُ حَاجَةٍ أَقْبَلَ عَلَى جُلَسَائِهِ فَقَالَ اشْفَعُوا فَلْتُؤْجَرُوا وَلْيَقْضِ اللَّهُ عَلَى لِسَانِ نَبِيِّهِ مَا أَحَبَّ- আবু মুসা আল-আশআরী (রাঃ) হ'তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে কোন চাহিদা প্রার্থী আসলে তিনি উপস্থিত লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতেন, ‘তোমরা সুফারিশ কর, তোমাদেরকে প্রতিদান দোয়া হবে। আল্লাহ যা পসন্দ করেন তা তাঁর নবীর মুখ দিয়ে প্রকাশ করান’।[1] রাসূল (ছাঃ) বলেন,لَوْ رَاجَعْتِهِ. قَالَتْ يَا رَسُولَ اللَّهِ تَأْمُرُنِى قَالَ إِنَّمَا أَنَا أَشْفَعُ. قَالَتْ لاَ حَاجَةَ لِى فِيه- নবী (ছাঃ) (বারীরাকে) বললেন, তুমি যদি তার (মুগীছ তার স্বামী) কাছে ফিরে যেতে চাও তাহলে ভাল হত। সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনি কি আমাকে আদশে দিচ্ছেন? তিনি বললেন, না। আমি কেবল সুপারিশ করছি মাত্র। সে বলল, তাহ’লে তার আমার কোন প্রয়োজন নেই’।[2]
পার্থিব জীবনে শাফা‘আত বা সুপারিশ :
দুনিয়াতে আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা মানুষ ব্যবহার করে প্রায় স্বাধীনভাবে। পার্থিব জীবনের সুপারিশ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে জেলখানায়। জেলখানায় তার নমুনা রয়েছে। এখানে কারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত কেউ কারো প্রতি সুপারিশ বা মানবিক সাহায্য পর্যন্ত করতে পারে না। এতেই আমাদের বোধগম্য হয় যে পার্থিব জীবনেই সুপারিশ পাওয়া অনেক কঠিন হয়ে যায়। আর পরকালের কি অবস্থা হবে একটু ভেবে দেখুন!
পারলৌকিক জীবনে শাফা‘আত বা সুপারিশ :
মহান আললাহ বলেন, مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ তাঁর অনুমতি ব্যতীত এমন কে আছে যে তাঁর নিকটে সুফারিশ করতে পারে? (বাক্বারাহ ২/২৫৫) মহান আললাহ বলেন, وَلَا يَشْفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ارْتَضَى ‘আর তারা কেবল তার জন্যই সুফারিশ করে যার প্রতি তিনি (আল্লাহ) সন্তুষ্ট’ (আম্বিয়া ২১/২৮)। তিনি আরো বলেন, لَا تُغْنِي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا إِلَّا مِنْ بَعْدِ أَنْ يَأْذَنَ اللَّهُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَرْضَى ‘তাদের কোন সুপারিশ কাজে আসবে না। যতক্ষণ না আল্লাহ অনুমতি দেন যার জন্য তিনি ইচ্ছা করেন এবং যার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট’ (নাজম ৫৩/২৬)। এছাড়াও ছাফা পাহাড়ের দাঁড়িয়ে স্বীয় জাতির উদ্দেশ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর সেই যুগান্তকারী ভাষণ, يَا بَنِى عَبْدِ مَنَافٍ أَنْقِذُوا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ فَإِنِّى لاَ أَمْلِكُ لَكُمْ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا ‘হে বনু আবদে মানাফ! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও কেননা আমি তোমাদেরকে আললাহর হাত থেকে বাঁচানোর কোন ক্ষমতা রাখি না’। [3]
শাফা‘আত লাভের আশায় ব্যতিব্যস্ত হাশরবাসী :
হাশরের ময়দান বড় বিভীষিকাময় স্থান। সেদিন হাশরবাসী অত্যন্ত চিন্তাযুক্ত, ব্যতিব্যস্ত ও অস্থির হয়ে পড়বে। সেদিনটির পরিমাণ হবে হাযার বছরের সমান। এ প্রসঙ্গে আললাহ বলেন, يُدَبِّرُ الْأَمْرَ مِنَ السَّمَاءِ إِلَى الْأَرْضِ ثُمَّ يَعْرُجُ إِلَيْهِ فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ أَلْفَ سَنَةٍ مِمَّا تَعُدُّونَ ‘তিনি আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত সমুদয় কর্ম পরিচালনা করেন। অতঃপর (দুনিয়া শেষে) সেগুলি তাঁর নিকট পৌঁছবে (কিয়ামতের) এমন এক দিনে, যার (দীর্ঘতার) পরিমাণ হবে তোমাদের গণনায় হাযার বছরের সমান’ (সাজদাহ ৩২/৫)। কিয়ামতের দিন ঈমানদারদের হাশরের ময়দানে একত্র করে রাখা হবে। তারা অস্থির হয়ে ছুটাছুটি শুরু করবে সুফারিশ লাভের আশায়। এ প্রসঙ্গে হাদীছে এসেছে, হযরত আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন ঈমানদারদেরকে হাশরের দিন আটক রাখা হবে। এতে তারা অত্যন্ত চিন্তাযুক্ত ও অস্থির হয়ে পড়বে। এবং বলবে যদি আমরা আমাদের রবের কাছে কারো দ্বারা সুফারিশ করাই তাহ’লে হয়তো আমাদের বর্তমান অবস্থা হতে মুক্তি লাভ করে আরাম পেতে পারি। তাই তারা হযরত আদম (আঃ)-এর নিকট গিয়ে বলবে আপনি সমস্ত মানবমন্ডলীর পিতা। আললাহ নিজ হাতে আপনাকে সৃষ্টি করেছেন। জান্নাত বসবাস করতে দিয়েছেন। আপনি আমাদের জন্য আপনার রবের কাছে সুফারিশ করুন। যাতে করে তিনি আমাদেরকে কষ্টদায়ক স্থান হতে মুক্ত করে প্রশান্তি দান করেন। তখন হযরত আদম (আঃ) বলবেন আমি তোমাদের এই কাজের উপযুক্ত নই। বরং তোমরা পৃথিবীবাসীর জন্য প্রেরিত আললাহর প্রথম নবী নূহের কাছে যাও। সুতরাং তারা সবাই নূহ (আঃ)-এর কাছে গেলে তিনি তাদেরকে বলবেন, আমি তোমাদের এই কাজের উপযুক্ত নই। তখন তিনি বলবেন, বরং তোমরা অললাহর খলীল ইবরাহীমের কাছে যাও। রাসূল (ছাঃ) বললেন, এইবার তারা ইবরাহীম (আঃ)-এর কাছে আসবে। তখন তিনি বলবেন, আমি তোমাদের এই কাজের উপযুক্ত নই। বরং তোমরা মুসা (আঃ)-এর কাছে যাও। নবী (ছাঃ) বলেন, তখন সবাই হযরত মুসা (আঃ)-এর কাছে আসবে। তিনি বলবেন, আমি তোমাদের এই কাজের উপযুক্ত নই। বরং তোমরা হযরত ঈসা (আঃ)-এর কাছে যাও। তখন তারা সবাই ঈসা (আঃ)-এর নিকট আসবে। তিনি বলবেন, আমি তোমাদের এই কাজের উপযুক্ত নই। তোমরা বরং মুহাম্মাদের কাছে যাও। তিনি এমন এক বান্দা যাকে আললাহ তাঁর পূর্বের ও পরের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, তারা আমার কাছে আসবে। তখন আমি আমার রবের কাছে তাঁর দরবারে হাযির হওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করব। আমাকে তাঁর কাছে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে। আমি যখন তাকে দেখব তখনই তাঁর উদ্দেশ্যে সিজদায় পড়ে যাব। আললাহ আমাকে যতক্ষণ চাইবেন এই অবস্থায় রাখবেন। তারপর বলবেন হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও। আর বল তোমার কথা শুনা হবে। তুমি সুপারিশ কর তা কবুল করা হবে। আর প্রার্থনা কর যা চাইবে দেয়া হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, তখন আমি মাথা উঠাব। আমার রবের এমনভাবে প্রশংসা-স্ত্ততি বর্ণনা করব যা তিনি সে সময় আমাকে শিখিয়ে দিবেন। অতঃপর আমি শাফা‘আত করব, কিন্তু এই ব্যাপারে আমার জন্য একটি সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে। তখন আমি আললাহর দরবার হতে উঠে আসব এবং ঐ নির্দিষ্ট সীমার লোকদেরকে জাহান্নাম হতে বের করে জান্নাতে প্রবেশ করাব’।[4]
উম্মতের জন্য রাসূল (ছাঃ)-এর করুণ আর্তনাদ ও সুফারিশ :
হাশরের দিন রাসূল (ছাঃ) নিজ উম্মতের জন্য এতই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়বেন যে, তিনি শুধুই উম্মতের মুক্তির জন্য বলতে থাকবেন امتى امتى আমার উম্মত! আমার উম্মত! তিনি এই বলে করুণ আর্তনাদ করতে থাকবেন। এ প্রসঙ্গে হাদীছে এসেছে, عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم تَلاَ قَوْلَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ فِى إِبْرَاهِيمَ ( رَبِّ إِنَّهُنَّ أَضْلَلْنَ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ فَمَنْ تَبِعَنِى فَإِنَّهُ مِنِّى) الآيَةَ. وَقَالَ عِيسَى عَلَيْهِ السَّلاَمُ ( إِنْ تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَإِنْ تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ) فَرَفَعَ يَدَيْهِ وَقَالَ اللَّهُمَّ أُمَّتِى أُمَّتِى. وَبَكَى فَقَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ يَا جِبْرِيلُ اذْهَبْ إِلَى مُحَمَّدٍ وَرَبُّكَ أَعْلَمُ فَسَلْهُ مَا يُبْكِيكَ فَأَتَاهُ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ الصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ فَسَأَلَهُ فَأَخْبَرَهُ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم بِمَا قَالَ. وَهُوَ أَعْلَمُ. فَقَالَ اللَّهُ يَا جِبْرِيلُ اذْهَبْ إِلَى مُحَمَّدٍ فَقُلْ إِنَّا سَنُرْضِيكَ فِى أُمَّتِكَ وَلاَ نَسُوءُكَ. হযরত আব্দুললাহ ইবনু আমর ইবনুল আস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত একদা নবী (ছাঃ) ইবরাহীমের উক্তি সম্বলিত এই আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন (হে আমার রব! এই সমস্ত প্রতিমাগুলি বহু মানুষকে বিভ্রান্ত ও গোনাহগার করেছে। সুতরাং যে আমার অনুসরণ করবে সেই আমার দলভুক্ত কিন্তু কেউ আমার অবাধ্য হলে তুমি তো ক্ষমাশীল। পরম দয়ালু)। অতঃপর হযরত ঈসা (আঃ)-এর উক্তি পাঠ করলেন (অর্থাৎ যদি তুমি তাদেরকে ক্ষমা করে দাও তবে তুমি মহা পরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী)। অতঃপর নবী (ছাঃ) নিজের হস্তদ্বয় উঠিয়ে এই ফরিয়াদ করতে লাগলেন, হে আললাহ, আমার উম্মত! আমার উম্মত! তুমি তাদেরকে ক্ষমা কর। এই বলে তিনি অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। তখন আললাহ তা‘আলা হযরত জিবরাঈল (আঃ)-কে বললেন, তুমি মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নিকট যাও এবং তাঁকে জিজ্ঞেস কর তিনি কেন কাঁদছেন? অবশ্যই আললাহ ভালভাবে জানেন তাঁর কাঁদার কারণ কী? তখন জিবরাঈল (আঃ) এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, রাসূল (ছাঃ) তাঁকে এটাই অবহিত করলেন যা তিনি বলেছেন, অতঃপর আললাহ জিবরাঈলকে পুনরায় বললেন, মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর কাছে যাও এবং তাঁকে বল, আমি আপনাকে আপনার উম্মতের ব্যাপারে সন্তুষ্ট করে দেব এবং আপনাকে কষ্ট দেব না’। [5]
যারা শাফা‘আত লাভে ধন্য হবে :
হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رضى الله عنه قَالَ أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِى يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ . خَالِصًا مِنْ قِبَلِ نَفْسِهِ. ‘হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ'তে বর্ণিত, নবী (ছাঃ) বলেছেন, আমার শাফা‘আত লাভের ব্যাপারে কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তিই সর্বাপেক্ষা সৌভাগ্যবান হবে যে তার অন্তর বা মন হ’তে নিষ্ঠা সহকারে ‘লা ইলাহা ইললাহ’ বলেছে’।[6] এ সম্পর্কে অপর হাদীছ এসেছে,
عن حذيفة في حديث الشفاعة عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال وَتُرْسَلُ الأَمَانَةُ وَالرَّحِمُ فَتَقُومَانِ جَنَبَتَىِ الصِّرَاطِ يَمِينًا وَشِمَالاً-
হযরত হুযাইফা (রাঃ) রাসূল (ছাঃ) হ'তে শাফা‘আতের হাদীছ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন, তিনি বলেছেন, আমানত ও আত্মীয়তাকে প্রেরণ করা হবে। তখন উভয়ই পুলসিরাতের ডানে ও বামে উভয় পার্শ্বে দাঁড়াবে’।[7] অর্থাৎ যারা দুনিয়াতে আমানত ও আত্মীয়তার হক আদায় করেছে তাদের পক্ষে সুফারিশ করবে এবং যারা হক আদায় করে নাই তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করবে। অপর হাদীছে বলা হয়েছে, عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ : شَفَاعَتِى لأَهْلِ الْكَبَائِرِ مِنْ أُمَّتِى. হযরত আনাস (রাঃ) বলেন নবী (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের কবীরা গুনাহগারগণ বিশেষত আমার শাফা‘আত লাভ করবে’।[8] কেননা যে ব্যক্তি কবীরাগুনাহগার নয়, তার জন্য তো শাফা‘আতের প্রয়োজন নেই। অন্য একটি হাদীছে এসেছে শিরককারী ব্যতীত বাকিরা শাফা‘আত লাভ করবে’,
عَنْ عَوْفِ بْنِ مَالِكٍ الأَشْجَعِىِّ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم أَتَانِى آتٍ مِنْ عِنْدِ رَبِّى فَخَيَّرَنِى بَيْنَ أَنْ يُدْخِلَ نِصْفَ أُمَّتِى الْجَنَّةَ وَبَيْنَ الشَّفَاعَةِ فَاخْتَرْتُ الشَّفَاعَةَ وَهِىَ لِمَنْ مَاتَ لاَ يُشْرِكُ بِاللَّهِ شَيْئًا.
হযরত আওফ ইবনু মালেক (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমার প্রতিপালকের নিকট হ’তে একজন আগমনকারী ফেরেশতা আসলেন এবং তিনি (আললাহর পক্ষ হ'তে) আমাকে এই দু’য়ের মধ্যে একটির ইখতিয়ার প্রদান করলেন। হয়তো আমার উম্মতের অর্ধেক সংখ্যা জান্নাতে প্রবেশ করুক অথবা আমি (উম্মতের জন্য) শাফা‘আতের সুযোগ গ্রহণ করি। অতঃপর আমি শাফা‘আত গ্রহণ করলাম। অতএব ইহা ঐ সকল লোকদের যারা আললাহর সাথে শিরক না করে মৃত্যুবরণ করেছে। তাদের জন্য আমার শাফা‘আত কার্যকরী হবে। তারাই শাফা‘আত লাভে ধন্য হবে’।[9]
যারা শাফা‘আত লাভে ব্যর্থ হবে :
মহান আললাহ বলেন, فَمَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِينَ ‘অতএব সুফারিশকারীদের সুফারিশ তাদের কোন উপকারে আসবে না (মুদ্দাছি্ছর ৭৪/৪৮)। যারা ছালাত পড়ে না, কোন অভাবগ্রস্থ ফকীরদের আহার্য দেয়না, ইসলামের ও ঈমানের বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলে অথবা গোনাহ ও অশলীলতার কাজে লিপ্ত হয়, যারা কিয়ামত অস্বীকার করার মত কুফুরী করে, তাদের জন্য কারো সুফারিশ উপকারী হবে না। কেননা তারা কুফরীতে লিপ্ত। কাফেরদের জন্য সুফারিশ করার অনুমতি কাউকে দেয়া হবে না। কেউ করলে গ্রহণীয় হবে না। যদি সব সুফারিশাকারী একত্রিত হয়ে জোরে সোরে সুফারিশ করে তাতেও কোন উপকার হবে না।
যারা সুফারিশ করতে পারবে :
রাসূল (ছাঃ) ছাড়াও ফেরেশতাগণ, বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিবর্গ এবং অন্যান্য ছালেহ মুমিন ব্যক্তিগণ সুফারিশ করার অনুমতি পাবেন। এ মর্মে রাসূল (ছাঃ) বলেন, يَدْخُلُ الْجَنَّةَ بِشَفَاعَةِ رَجُلٍ مِنْ أُمَّتِى أَكْثَرُ مِنْ بَنِى تَمِيمٍ- ‘আমার উম্মতের এক ব্যক্তির সুফারিশে বনী তামীম গোত্রের লোক সংখ্যা অপেক্ষা অধিক মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[10]
কাওছার কী?
মহান আললাহর বাণী : إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ ‘নিশ্চয়ই আমরা তোমাকে ‘কাওছার’ দান করেছি’ (কাওছার ১০৮/১)। كَوْثَر -এর আভিধানিক অর্থ الخير الكثير অজস্র কল্যাণ। মাদ্দাহ হল الكثرة الكثرة থেকে كَوْثَرَ উৎকলিত। যেমন : الجهر থেকে الجوهر। হাউয কাওছার হ’ল যা জান্নাতে আললাহর রাসূল (ছাঃ)-কে দান করা হবে। উলেলখ্য যে, কাওছার হ'ল জান্নাতের একটি নদী যা আললাহ শুধু রাসূল (ছাঃ)-কে দিবেন। কাওছার জান্নাতের সর্বাপেক্ষা বড় ও সর্বোকৃষ্ট নদী। হাদীছে এসেছে, عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم الْكَوْثَرُ نَهَرٌ فِى الْجَنَّةِ حَافَتَاهُ مِنْ ذَهَبٍ مَجْرَاهُ عَلَى الْيَاقُوتِ وَالدُّرِّ تُرْبَتُهُ أَطْيَبُ مِنَ الْمِسْكِ وَمَاؤُهُ أَحْلَى مِنَ الْعَسَلِ وَأَشَدُّ بَيَاضًا مِنَ الثَّلْجِ. ‘কাওছার হ’ল জান্নাতের একটি নদী যার দুই তীর স্বর্ণের, গতিপথ মনি-মুক্তার, মাটি মিশকের চাইতে সুগন্ধিময় এবং পানি মধুর চাইতে মিষ্টি ও বরফের চাইতে স্বচছ’। [11] অপর একটি হাদীছে এসেছে, عَنْ أَنَسٍ قَالَ بَيْنَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ذَاتَ يَوْمٍ بَيْنَ أَظْهُرِنَا إِذْ أَغْفَى إِغْفَاءَةً ثُمَّ رَفَعَ رَأْسَهُ مُتَبَسِّمًا فَقُلْنَا مَا أَضْحَكَكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ أُنْزِلَتْ عَلَىَّ آنِفًا سُورَةٌ. فَقَرَأَ بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ (إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ إِنَّ شَانِئَكَ هُوَ الأَبْتَرُ). ثُمَّ قَالَ أَتَدْرُونَ مَا الْكَوْثَرُ. فَقُلْنَا اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ. قَالَ فَإِنَّهُ نَهْرٌ وَعَدَنِيهِ رَبِّى عَزَّ وَجَلَّ عَلَيْهِ خَيْرٌ كَثِيرٌ هُوَ حَوْضٌ تَرِدُ عَلَيْهِ أُمَّتِى يَوْمَ الْقِيَامَةِ آنِيَتُهُ عَدَدُ النُّجُومِ فَيُخْتَلَجُ الْعَبْدُ مِنْهُمْ فَأَقُولُ رَبِّ إِنَّهُ مِنْ أُمَّتِى. فَيَقُولُ مَا تَدْرِى مَا أَحْدَثَتْ بَعْدَكَ. زَادَ ابْنُ حُجْرٍ فِى حَدِيثِهِ بَيْنَ أَظْهُرِنَا فِى الْمَسْجِدِ. وَقَالَ مَا أَحْدَثَ بَعْدَكَ. আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের মাঝে ছিলেন, হঠাৎ তিনি তন্দ্রা গেলেন, অতঃপর হাসতে হাসতে মাথা তুললেন। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল কিসে আপনাকে হাসাচ্ছে?! তিনি বললেন, এ মুহূর্তে আমার ওপর একটি সূরা নাযিল করা হয়েছে, অতঃপর তিনি পড়লেন, إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ ‘নিশ্চয় আমি তোমাকে আল-কাওছার দান করেছি। অতএব তোমার রবের উদ্দেশ্যেই ছালাত পড় এবং নহর কর। নিশ্চয় তোমার প্রতি শত্রুতা পোষণকারীই নির্বংশ’। অতঃপর তিনি বললেন, তোমরা জানো কাউছার কী? আমরা বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভাল জানেন। তিনি বললেন, এটা একটা নহর, যার ওয়াদা আল্লাহ আমার নিকট করেছেন, তাতে রয়েছে প্রচুর কল্যাণ। এটা এমন হাউজ তাতে আমার উম্মত গমন করবে, তার পাত্রগুলো নক্ষত্রের সংখ্যার ন্যায়, তাদের থেকে এক বান্দাকে ছো মেরে নেয়া হবে। আমি বলব, হে আমার রব, সে তো আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত! তিনি বলবেন, তুমি জান না তোমার পর তারা (তোমার শরীআতের মাঝে) কি নব উদ্ভাবন ঘটিয়েছে’।[12] অন্য একটি হাদীছে এসেছে, عَنْ أَنَسٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم دَخَلْتُ الْجَنَّةَ فَإِذَا أَنَا بِنَهَرٍ حَافَتَاهُ خِيَامُ اللُّؤْلُؤِ فَضَرَبْتُ بِيَدِى إِلَى مَا يَجْرِى فِيهِ الْمَاءُ فَإِذَا مِسْكٌ أَذْفَرُ قُلْتُ مَا هَذَا يَا جِبْرِيلُ قَالَ هَذَا الْكَوْثَرُ الَّذِى أَعْطَاكَهُ اللَّهُ. আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন, আমি জান্নাতে প্রবেশ করলাম। হঠাৎ একটি নদী পেলাম। যার দুই তীর মনি-মুক্তা দিয়ে গড়া। আমি তখন ঐ নদীর পানিতে হাত দিলাম। দেখলাম তা আযফার মিশকের। আমি বললাম জিব্রাঈল এটা কী? তিনি বললেন, الْكَوْثَرُ এটা হ’ল কাওছার যা আললাহ আপনাকে দান করেছেন।[13] মুজাহিদ বলেন, هوالخير الكثير فى الدنيا والاخرة- কাওছার হ’ল দুনিয়া ও আখেরাতের অশেষ কল্যাণ সমূহ (ইবনু কাছীর)। যার মধ্যে রয়েছে তাঁকে দেয়া বিশ্বব্যাপী নবুঅত ও রিসালাত, কিতাব ও সুন্নাত, ইলম ও শাফা‘আত, হাউয কাউছার, মাক্বামে মাহমুদ, সর্বাধিক সংখ্যা উম্মত, সকল দ্বীনের উপরে ইসলামের বিজয়, শত্রুদের উপরে জয়লাভ, অসংখ্য বিজয়াভিযান এবং ইসলামী খেলাফতের প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি। উলেলখ্য যে, হাউযে কাওছার ও কাওছার নদী আলাদা জিনিস। কাওছার নদী জান্নাতের মধ্যভাগে থাকবে আর হাউযে কাওছার জান্নাতের বাইরে হাশরের মাঠে থাকবে। যেখানে রাসূল (ছাঃ) মিম্বরে আসন গ্রহণ করে নিজ হাতে ঈমানদারদের পানি পান করিয়ে তাদের পিপাসা নিবারণ করবেন।
হাউযে কাউছার কী?
হাউযে কাওছার এমন একটি হাউয যা রাসূল (ছাঃ)-কে আললাহ রাববুল আলামীন দান করবেন। এ হাউযের পানি পান করানোর দায়িত্ব স্বয়ং রাসূল (ছাঃ) পালন করবেন। ইয়ামানবাসীদের সম্মানার্থে রাসূল (ছাঃ) অন্যদের হাউযে কাওছার হতে দূর করে দিবেন। হাউযে কাওছারের প্রশস্ততা মদীনা ও আম্মানের দূরত্বের সমান (প্রায় এক হাযার কি.মি)। হাউযে কাওছারের পানি দুধ অপেক্ষা শুভ্র ও মধু অপেক্ষা মিষ্টি হবে। এ প্রসঙ্গে হাদীছ বর্ণিত হ'ল, عَنْ ثَوْبَانَ أَنَّ نَبِىَّ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنِّى لَبِعُقْرِ حَوْضِى أَذُودُ النَّاسَ لأَهْلِ الْيَمَنِ أَضْرِبُ بِعَصَاىَ حَتَّى يَرْفَضَّ عَلَيْهِمْ. فَسُئِلَ عَنْ عَرْضِهِ فَقَالَ مِنْ مَقَامِى إِلَى عَمَّانَ. وَسُئِلَ عَنْ شَرَابِهِ فَقَالَ أَشَدُّ بَيَاضًا مِنَ اللَّبَنِ وَأَحْلَى مِنَ الْعَسَلِ يَغُتُّ فِيهِ مِيزَابَانِ يَمُدَّانِهِ مِنَ الْجَنَّةِ أَحَدُهُمَا مِنْ ذَهَبٍ وَالآخَرُ مِنْ وَرِقٍ- ছাওবান (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, হাউযে কাওছারের নিকটে আমি ইয়ামনবাসীর সম্মানে অন্য লোকদের স্বীয় লাঠি দ্বারা দূর করে দিব। এমনকি পানি ইয়ামনবাসীর প্রতি প্রবাহিত হবে। আর তারা তা পান করে তৃপ্তি লাভ করবে। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হ'ল যে হাউযের প্রশস্ততা কী পরিমাণ? তিনি বললেন, মদীনা হ'তে আম্মানের দূরত্বের সমান। এরপর হাউযের পানি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হ'লে যে তা কেমন হবে? তিনি বললেন, দুধ অপেক্ষা অধিক সাদা, মধু অপেক্ষা মিষ্টি। এরপর তিনি বললেন, আমার হাউযে জান্নাত থেকে দু’টি নালা প্রবাহিত হ’তে থাকবে, তার একটি হবে স্বর্ণের অন্যটি হবে রৌপ্যের’।[14]
হাউযে কাওছারের পাশে সোনা-চাঁদীর পানপাত্র থাকবে, যার সংখ্যা হবে আকাশের নক্ষত্রের সমান। যেমন হাদীছে এসেছে, قَالَ أَنَسٌ قَالَ نَبِىُّ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم تُرَى فِيهِ أَبَارِيقُ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ كَعَدَدِ نُجُومِ السَّمَاء- আনাস (রাঃ) হ'তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘হাউযে কাওছারের পাশে তোমরা আকাশের নক্ষত্রের সমান সংখ্যক পানপাত্র দেখতে পাবে’।[15]
তিনি আরও বলেন, عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رضى الله عنه عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَا بَيْنَ بَيْتِى وَمِنْبَرِى رَوْضَةٌ مِنْ رِيَاضِ الْجَنَّةِ، وَمِنْبَرِى عَلَى حَوْضِى- আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমার ঘর মিম্বারের মধ্যবর্তী যে স্থান রয়েছে তা জান্নাতের উদ্যানসমূহের মধ্যে একটি উদ্যান। আর আমার মিম্বর কিয়ামতের দিন আমার হাউযের পার্শ্বে রাখা হবে’।[16]
রাসূল (ছাঃ) বলেন, عَنْ عَبْدِ اللَّهِ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنَّ أَمَامَكُمْ حَوْضًا كَمَا بَيْنَ جَرْبَا وَأَذْرُحَ فِيهِ أَبَارِيقُ كَنُجُومِ السَّمَاءِ مَنْ وَرَدَهُ فَشَرِبَ مِنْهُ لَمْ يَظْمَأْ بَعْدَهَا أَبَدًا. ‘জান্নাতে তোমার সম্মুখে একটি হাউয থাকবে যার একটি কংকর যাররা থেকে আজরার মর্ধবর্তী স্থানের দূরত্বের সমান। যার পার্শ্বে আকাশের নক্ষত্র সংখ্যক পানপাত্র রাখা হবে। যে ব্যক্তি সেখানে থেকে একবার পানি পান করবে সে আর কখনো তৃষ্ণার্ত হবে না’।[17] অন্য এক হাদীছে এসেছে,عنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم حَوْضِى مَسِيرَةُ شَهْرٍ، مَاؤُهُ أَبْيَضُ مِنَ اللَّبَنِ، وَرِيحُهُ أَطْيَبُ مِنَ الْمِسْكِ، وَكِيزَانُهُ كَنُجُومِ السَّمَاءِ، مَنْ شَرِبَ مِنْهَا فَلاَ يَظْمَأُ أَبَدًا- হযরত আব্দুললাহ ইবনু আমর (রাঃ) হ'তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমার হাউযের প্রশস্ততা একমাসের পথের সমপরিমাণ এবং এর চতুর্দিক সমপরিমাণ এবং এর পানি দুধের চেয়ে সাদা ও ঘ্রাণ মৃগনাভী অপেক্ষা অধিক খুশবুদার। আর তার পান পাত্রসমূহ আকাশের তারকার ন্যায়। যে এটি হ'তে একবার পানি পান করবে সে আর কখনো তৃষ্ণার্ত হবে না’।[18]
যারা হাউযে কাওছারের পানি পানে ধন্য হবে :
হাউযে কাওছারের পানি সর্বাগ্রে পান করবে গরীব মুহাজিরগণ (মক্কা হ'তে মদীনায় হিজরতকারীরা)। এ প্রসঙ্গে হাদীছে এসেছে, حَدَّثَنِى ثَوْبَانُ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ حَوْضِى مِنْ عَدَنَ إِلَى عَمَّانَ الْبَلْقَاءِ مَاؤُهُ أَشَدُّ بَيَاضًا مِنَ اللَّبَنِ وَأَحْلَى مِنَ الْعَسَلِ وَأَكَاوِيبُهُ عَدَدُ نُجُومِ السَّمَاءِ مَنْ شَرِبَ مِنْهُ شَرْبَةً لَمْ يَظْمَأْ بَعْدَهَا أَبَدًا أَوَّلُ النَّاسِ وُرُودًا عَلَيْهِ فُقَرَاءُ الْمُهَاجِرِينَ الشُّعْثُ رُءُوسًا الدُّنْسُ ثِيَابًا الَّذِينَ لاَ يَنْكِحُونَ الْمُتَنَعِّمَاتِ وَلاَ تُفْتَحُ لَهُمُ السُّدَدُ- ছাওবান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমার হাউযে সর্বাগ্রে আগমণকারী হবে গরীব মুহাজিরগণ। যারা বিক্ষিপ্ত কেশধারী, ময়লা কাপড় পরিধানকারী, সুখ-সমৃদ্ধশালী রমনীদের বিবাহ করতে অক্ষম ব্যক্তি, যাদের জন্য আমীর-ওমারাদের দরজা খোলা থাকেনা।[19]
কিয়ামতের দিন সকল নবীকে হাউয দান করা হবে যা থেকে তাঁর উম্মতরা পানি পান করবে।
যারা হাউযে কাওছরে পানি পানে ব্যর্থ হবে:
প্রথমত : বিদআতী ব্যক্তি : যারা বিদআত করে তারা হাউযে কাওছারের পানি পানে ব্যর্থ হবে। কিয়ামতের দিন হাউযে কাউছারে রাসূল (ছাঃ)-এর উম্মতগণ অবতরণ করবে যার পাত্ররাজির সংখ্যা হবে নক্ষত্ররাজির ন্যায় অগণিত। অবতরণকারী উম্মতদের কাছ থেকে তখন কিছু লোককে সেখানে থেকে তাড়িয়ে দেয়া হবে। তখন রাসূলুললাহ (ছাঃ) বলবেন, يا رب انه من امتى সাহল বিন সাদের বর্ণনায় এসেছে, ‘এরা তো আমার উম্মত!’ তখন বলা হবে فَيُقَالُ إِنَّكَ لاَ تَدْرِى مَا بَدَّلُوا بَعْدَكَ ‘তুমি জানো না তোমার পরে এরা দ্বীনের মধ্যে কত পরিবর্তন করেছিল’। তখন আমি বলব, سُحْقًا سُحْقًا لِمَنْ بَدَّلَ بَعْدِى ‘দূর হও! দূর হও! যে আমার পরে আমার দ্বীনের পরিবর্তন করেছে’।[20]
দ্বিতীয়ত :
কাফেররা হাউযে কাওছারের কাছে এসে পানি পান করতে চাইবে কিন্তু রাসূল (ছাঃ) তাদের দূরে সরিয়ে দিবেন। আর তাঁর উম্মতদের ওযুর উজ্জ্বল হাত ও কপাল দেখে চিনে নিবেন। এ প্রসঙ্গে নিম্নের হাদীছ, عَنْ حُذَيْفَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ حَوْضِى لأَبْعَدُ مِنْ أَيْلَةَ إِلَى عَدَنَ وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لآنِيَتُهُ أَكْثَرُ مِنْ عَدَدِ النُّجُومِ وَلَهُوَ أَشَدُّ بَيَاضًا مِنَ اللَّبَنِ وَأَحْلَى مِنَ الْعَسَلِ وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ إِنِّى لأَذُودُ عَنْهُ الرِّجَالَ كَمَا يَذُودُ الرَّجُلُ الإِبِلَ الْغَرِيبَةَ عَنْ حَوْضِهِ. قِيلَ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَتَعْرِفُنَا قَالَ نَعَمْ تَرِدُونَ عَلَىَّ غُرًّا مُحَجَّلِينَ مِنْ أَثَرِ الْوُضُوءِ لَيْسَتْ لأَحَدٍ غَيْرِكُمْ. হুযায়ফা (রাঃ) হ'তে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ঐ সত্তার শপথ যার হাতে আমার জীবন! আমি হাউয থেকে অন্যদেরকে এমনভাবে দূর করে দিব যেমন উটের মালিকরা তাদের পাল থেকে অন্য মালিকের উটকে তাড়িয়ে দেয়। প্রশ্ন করা হ'ল ; হে আললাহর রাসূল (ছাঃ) আপনি কি আমাদের চিনবেন? তিনি বললেন হ্যাঁ; তোমরা আমার কাছে আসবে এমনভাবে যে ওযুর কারণে তোমাদের হাত, পা, কপাল ইত্যাদি চমকাতে থাকবে। এগুলি তোমাদের ছাড়া অপর কোন উম্মাতের ক্ষেত্রে হবে না’।[21]
হাউযে আগমনকারীর সংখ্যা :
উল্লেখ্য যে, রাসূল (ছাঃ)-এর হাউযে আগতদের সংখ্যা অন্যান্য নবীদের উম্মত অপেক্ষা অধিক হবে। এ প্রসঙ্গে হাদীছ, عَنْ سَمُرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم إِنَّ لِكُلِّ نَبِىٍّ حَوْضًا وَإِنَّهُمْ يَتَبَاهَوْنَ أَيُّهُمْ أَكْثَرُ وَارِدَةً وَإِنِّى أَرْجُو أَنْ أَكُونَ أَكْثَرَهُمْ وَارِدَةً সামুরা (রাঃ) হ'তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুললাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সকল নবীর জন্য একটি করে হাউয থাকবে। আর প্রত্যেক নবী পরস্পর গর্ব করবে যে, কার হাউযে পানি পানকারীর সংখ্যা বেশী। আমি আশা করছি যে আমি আমার হাউযে আগতদের সংখ্যা বেশী হবে’।[22] অন্য একটি হাদীছে এসেছে, عَنْ زَيْدِ بْنِ أَرْقَمَ قَالَ : كُنَّا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَنَزَلْنَا مَنْزِلاً فَقَالَ : مَا أَنْتُمْ جُزْءٌ مِنْ مِائَةِ أَلْفِ جُزْءٍ مِمَّنْ يَرِدُ عَلَىَّ الْحَوْضَ. قَالَ قُلْتُ : كَمْ كُنْتُمْ يَوْمَئِذٍ قَالَ : سَبْعَمِائَةٍ أَوْ ثَمَانَمِائَةٍ. হযরত যায়েদ ইবনু আরকাম (রাঃ) বলেন, ‘একবার আমরা রাসূলুললাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে কোন এক সফরে ছিলাম। এক মঞ্জিলে আমরা অবস্থান করলাম। তখন তিনি উপস্থিত লোকদিগকে লক্ষ করে বললেন, হাউযে কাওছারের যে সমস্ত লোকেরা আমার নিকট উপস্থিত হবে তোমাদের সংখ্যা ইহাদের লক্ষ ভাগও নহে। লোকেরা যায়েদ ইবনু আরকামকে জিজ্ঞেস করল, সেই দিন আপনাদের সংখ্যা কত ছিল? তিনি বললেন, সাতশত অথবা আটশত’।[23]
উপসংহারঃ আলোচনার শেষ প্রান্তে এ কথাই বলতে চাই যে, ইচ্ছা করলে আল্লাহ তা‘আলা জীন ও মানুষের মধ্যকার মুমিন ও কাফের সকলকে জান্নাত দান করতে পারতেন। কিন্তু আমল ব্যতীত আল্লাহর অনুগ্রহের আশায় থাকা মুমিনের কাজ নয়। দ্বীনী ভাই-বোনদের মনে রাখতে হবে যে, কাল ক্বিয়ামতের দিন যখন হাউযে কাওছারে রাসূল (ছাঃ)-এর উম্মতগণ অবতরণ করবে তখন রাসূল (ছাঃ) কিছু লোককে বলবেন, سُحْقًا سُحْقًا لِمَنْ غَيَّرَ بَعْدِى দূর হও! দূর হও! যে আমার পরে দ্বীনে পরিবর্তন এনেছে। আমরা যেন এই বাণীটি জানার পর বদনছীবের অধিকারী না হই। আমরা যেন শাফা‘আত লাভে ধন্য হই এবং হাউযে কাওছারের পানি পানে বিতাড়িত না হই। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক দান করুন-আমীন!
[1]. মুসলিম হা/৬৮৫৮।
[2]. বুখারী হা/৫২৮৩।
[3]. মুসলিম হা/৫২২।
[4]. বুখারী হা/৭৪৪০।
[5]. মুসলিম হা/৫২০।
[6]. বুখারী হা/৬৫৭০।
[7]. মুসলিম হা/৫০৩।
[8]. তিরমিযী, মিশকাত হা/৫৫৯৮।
[9]. তিরমিযী, ইবনু মাজাহ মিশকাত হা/৫৬০০।
[10]. তিরমিযী হা/২৬২৫।
[11]. ইবনু মাজাহ হা/৪৪৭৮।
[12]. মুসলিম হা/৯২১।
[13]. তিরমিযী হা/৩৩৫৯।
[14]. মুসলিম হা/৬১৩০।
[15]. মুসলিম হা/৬১৪০।
[16]. বুখারী হা/১১৯৫।
[17]. মুসলিম হা/৬১২৮।
[18]. বুখারী হা/৬৫৭৯।
[19]. তিরিমিযী হা/২৬৩২।
[20]. বুখারী হা/৬৫৮৪।
[21]. ইবনু মাজাহ হা/৪৩০২।
[22]. তিরমিযী হা/২৪৪৩।
[23]. আবু দাঊদ হা/৪৭৪৬।