রামাযানে ছিয়ামের ফযীলত
আসাদুল্লাহ আল-গালিব
হাফেজ আব্দুল মতীন 9350 বার পঠিত
(৩৮) যে সমস্ত পোষাক পরিধান করা ও যে পাত্রে খাওয়া অপসন্দীয় ও হারাম :
রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ لَبِسَ الْحَرِيرَ فِى الدُّنْيَا فَلَنْ يَلْبَسَهُ فِى الآخِرَةِ- ‘যে ব্যক্তি দুনিয়ায় রেশমী কাপড় পরিধান করবে সে আখিরাতে তা কখনোই পরিধান করতে পারবে না’।[1] তিনি অন্যত্র বলেন, لاَ تَلْبَسُوا الْحَرِيرَ وَلاَ الدِّيبَاجَ وَلاَ تَشْرَبُوا فِى آنِيَةِ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ، وَلاَ تَأْكُلُوا فِى صِحَافِهَا، فَإِنَّهَا لَهُمْ فِى الدُّنْيَا وَلَنَا فِى الآخِرَةِ- ‘তোমরা রেশমী বা রেশমী জাতীয় কাপড় পরিধান করো না এবং সোনা ও রুপার পাত্রে পানি পান করো না এবং এগুলির বাসনে আহার করো না। কেননা দুনিয়াতে এগুলি কাফিরদের জন্য আর আখিরাতে আমাদের জন্য’।[2] হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِى بُرْدَةَ قَالَ أَخْرَجَتْ إِلَيْنَا عَائِشَةُ كِسَاءً وَإِزَارًا غَلِيظًا فَقَالَتْ قُبِضَ رُوحُ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فِى هَذَيْنِ- আবু বুরদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আয়েশা (রাঃ) একবার একটি কম্বল ও মোটা ইযার নিয়ে আমাদের কাছে আসেন এবং তিনি বলেন, এ দু’টি পরা অবস্থায় নবী করীম (ছাঃ)-এর রুহ কবয করা হয়’।[3] অন্য একটি হাদীছে এসেছে, عَنِ ابْنِ عُمَرَ رضى الله عنهما أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ لاَ يَنْظُرُ اللَّهُ إِلَى مَنْ جَرَّ ثَوْبَهُ خُيَلاَءَ- ইবনু উমার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ সে লোকের দিকে (দয়ার দৃষ্টিতে) দেখবেন না যে অহংকারের সাথে তার (পরিধেয়) পোষাক টেনে চলে’।[4]
(৩৯) শরী‘আত বিরোধী খেলাধুলা ও বিনোদন হারাম :
যে সমস্ত খেলাধুলা, আনন্দ-বিনোদন, হাস্যকর বস্ত্ত শরী‘আতের বিরোধী, সে সমস্ত অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকা আবশ্যক কর্তব্য। মহান আল্লাহ বলেন, وَإِذَا رَأَوْا تِجَارَةً أَوْ لَهْوًا انْفَضُّوا إِلَيْهَا وَتَرَكُوكَ قَائِمًا قُلْ مَا عِنْدَ اللَّهِ خَيْرٌ مِنَ اللَّهْوِ وَمِنَ التِّجَارَةِ وَاللَّهُ خَيْرُ الرَّازِقِينَ- ‘আর তারা যখন ব্যবসা অথবা ক্রীড়া-কৌতুক দেখে তখন তারা তার দিকে ছুটে যায় আর তোমাকে দাঁড়ান অবস্থায় রেখে যায়। বল, আল্লাহর কাছে যা আছে তা ক্রীড়া কৌতুক হ’তে ও ব্যবসায় অপেক্ষা উত্তম। আর আল্লাহ সর্বোত্তম রিযিকদাতা’ (জুমুআ ৬২/১১)। তোমাদের ছালাত আদায়ের জন্য আল্লাহর নিকট যে ছওয়াব রয়েছে তা তোমাদের খেল-তামাশা, বিনোদন-নাট্যকর বস্ত্তর স্বাদ গ্রহণ ও ক্রয়-বিক্রয়ের ফায়দা থেকে অনেক উত্তম। তোমাদের জন্য আল্লাহর নিকট যে রিযিক বন্টন হয়ে আছে তা তোমাদের এগুলি থেকে অনেক উত্তম’ (তাফসীরে কুরতুবী ১৮/১০৮ পৃঃ)। হাদীছে এসেছে, عَنْ سُلَيْمَانَ بْنِ بُرَيْدَةَ عَنْ أَبِيهِ أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَنْ لَعِبَ بِالنَّرْدَشِيرِ فَكَأَنَّمَا صَبَغَ يَدَهُ فِى لَحْمِ خِنْزِيرٍ وَدَمِهِ. সুলায়মান বিন বুরায়দা থেকে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি টেবিলপাশা খেলল, সে যেন তার হাত শুকরের গোশতের সাথে ও তার রক্তের সাথে রঞ্জিত করল’।[5]
মোদ্দাকথা তাস, জুয়া, পাশা এবং যে সকল অন্যায় খেলাধুলা, বিনোদন, শরী‘আত বিরোধী ও ছালাতের অবহেলা করা হয় এমন সব খেলা থেকে বিরত থাকা কর্তব্য।
(৪০) খরচে মধ্যপন্থা অবলম্বন, কারো মাল ভক্ষণ না করা :
মহান আল্লাহ বলেন, وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلَى عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُومًا مَحْسُورًا- ‘আর তুমি তোমার হাত গলায় বেঁধে রেখ না (অর্থাৎ কৃপণ হয়ো না) এবং তাকে একেবারে খুলে দিয়ো না (অর্থাৎ অপচয় করো না)। তাহলে তুমি নিন্দিত ও নিঃস্ব হয়ে যাবে (বানী ইসরাইল ১৭/২৯)। প্রত্যেককে নিজের, পরিবারের এবং একে অপরে খরচের ব্যাপারে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা আবশ্যক। এমতাবস্থায় ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতে নিন্দিত হ’তে হবে। অপর পক্ষে এমনটিও নয় যে, সে সাধ্যের বাইরে দান করতে গিয়ে নিজেকেই মানুষের নিকট হাত বাড়াতে হয়। বরং তোমরা মধ্যমপন্থা অবলম্বন করবে নচেৎ তিরস্কৃত হবে (ইবনু কাছীর ৮/৪৭৬)। মহান আল্লাহ বলেন, وَالَّذِينَ إِذَا أَنْفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا- ‘তারা যখন ব্যয় করে, তখন অপব্যয় করেনা বা কৃপণতা করেনা। বরং তারা এতদুভয়ের মধ্যবর্তী অবস্থায় থাকে (ফুরক্বান ২৫/৬৭)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, كَانَ يَنْهَى عَنْ قِيلَ وَقَالَ وَكَثْرَةِ السُّؤَالِ، وَإِضَاعَةِ الْمَالِ، وَمَنْعٍ وَهَاتِ، وَعُقُوقِ الأُمَّهَاتِ، وَوَأْدِ الْبَنَاتِ- রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিষেধ করতেন অনর্থক কথা নিয়ে বাদানুবাদ করা, অধিক প্রশ্ন করা, মালের অপচয় করা, (কৃপনতা, ভিক্ষা বৃত্তি,) মাতাপিতার অবাধ্যতা এবং কন্যাদের জীবন্ত প্রোথিত করা করা হ’তে’।[6]
(৪১) হিংসা-বিদ্বেষ শত্রুতা পরিত্যাগ করা :
আমাদের সবার উচিত সকাল-সন্ধায় হিংসুকের হিংসা এবং শত্রুদের শত্রুতা থেকে মহান আল্লাহর নিকট পরিত্রাণ চাওয়া। মহান আল্লাহ বলেন, وَمِنْ شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ ‘এবং হিংসুকের অনিষ্ট হ’তে যখন সে হিংসা করে’ (ফালাক্ব ১১৩/৫)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, أَمْ يَحْسُدُونَ النَّاسَ عَلَى مَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ فَقَدْ آتَيْنَا آلَ إِبْرَاهِيمَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَآتَيْنَاهُمْ مُلْكًا عَظِيمًا- ‘তবে কি তারা লোকদের (মুসলমানদের) প্রতি এজন্য হিংসা করে যে, আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহ থেকে তাদের কিছু দান করেছেন। আর আমরা তো ইবরাহীমের বংশধরগণকে কিতাব ও হিকমত দান করেছিলাম এবং তাদেরকে দান করেছিলাম বিশাল সাম্রাজ্য’ (নিসা ৪/৫৪)। তারা (ইহুদী-নাছারা) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ করে এজন্য যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনি মহা সম্মানিত রিযিক ও নবুঅত লাভ করেছেন, তারা হিংসা-বিদ্বেষ বশত নিজেরা তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেনি এবং অপরকে বাধা প্রদান করেছে। কেননা তিনি আরব বংশের, বনী ইসরাঈল বংশের নন (এটি ইহুদী-নাছারাদেও গোঁড়ামী মাত্র) (ইবনু কাছীর ৪/১১৯)। হাদীছে এসেছে, عَنْ أَنَسٍ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: لَا تَحَاسَدُوا، وَلَا تَبَاغَضُوا، وَلَا تَقَاطَعُوا، وَكُونُوا عِبَادَ اللهِ إِخْوَانًا- আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা একে অপরের প্রতি হিংসা করোনা, একে অপরের প্রতি ঘৃণা পোষণ করো না, একে অপরের মাঝে সম্পর্ক ছিন্ন করো না বরং তোমরা একে অপরে আল্লাহর জন্য ভাই-ভাই হয়ে যাও’।[7] অন্য হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ لاَ تَبَاغَضُوا، وَلاَ تَحَاسَدُوا، وَلاَ تَدَابَرُوا، وَكُونُوا عِبَادَ اللَّهِ إِخْوَانًا، وَلاَ يَحِلُّ لِمُسْلِمٍ أَنْ يَهْجُرَ أَخَاهُ فَوْقَ ثَلاَثِ لَيَالٍ-
আনাস বিন মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা একে অপরকে ঘৃণা করো না (শত্রুতা করো না), পরস্পর হিংসা করো না, একে অপরের পিছনে লেগো না (পরস্পর বিছিন্ন হয়ো না)। আর তোমরা সবাই আল্লাহর বান্দা ও পরস্পর ভাই-ভাই হয়ে যাও। কোন মুসলিমের জন্য বৈধ নয় যে, সে তার ভাই থেকে তিন দিনের অধিক সম্পর্ক ছিন্ন করে থাকবে’।[8] হাদীছে আরো বর্ণিত হয়েছে, عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِيَّاكُمْ وَالظَّنَّ، فَإِنَّ الظَّنَّ أَكْذَبُ الْحَدِيثِ، وَلاَ تَحَسَّسُوا، وَلاَ تَجَسَّسُوا، وَلاَ تَحَاسَدُوا، وَلاَ تَدَابَرُوا، وَلاَ تَبَاغَضُوا، وَكُونُوا عِبَادَ اللَّهِ إِخْوَانًا. আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা সাবধান! (একে অপরের প্রতি খারাপ) ধারণা কর থেকে বিরত থাকো। কারণ অধিকাংশ ধারণা মিথ্যা হয়ে থাকে। তোমরা (একে অপরের) দোষ তালাশ করো না, গোয়েন্দাগিরি করো না, একে অপরে পরস্পর হিংসা বিদ্বেষ করো না, একে অপরের পিছনে লেগো না (শত্রুতা করো না), একে অপরের প্রতি ঘৃণা (পরস্পর হিংসা বিরোধে লিপ্ত হয়ো না) বরং তোমরা সবাই আল্লাহর বান্দা ও ভাই-ভাই হয়ে যাও’।[9]
মোদ্দাকথা পরিপূর্ণ মুমিন ব্যক্তি হ’তে চাইলে নিজের জন্য যা ভালোবাসবে অপর ভাইয়ের জন্য তাই ভালোবাসবে। একে অপরের প্রতি হিংসা বিদ্বেষ নয়, শত্রুতা নয়, গীবত-বুহতান নয়, বরং পরস্পরের কল্যাণ কামনা করতে হবে, দ্বীনী ভালোবাসা তৈরী করতে হবে। তবেই ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ ও মুক্তির আশা করা যেতে পারে।
(৪২) মানুষের মানহানী করা হারাম :
মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَنْ تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ آمَنُوا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ ‘যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে, নিশ্চয়ই তাদের জন্য ইহকালে ও পরকালে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। বস্ত্ততঃ আল্লাহ জানেন কিন্তু তোমরা জানো না’ (নূর ২৪/১৯)। কোন ব্যক্তি যখন কারো নিকট থেকে কোন খারাপ কথা শুনবে তখন সে যেন এ কথাগুলি বেশী না করে বলে বেড়ায় ও প্রচার না করে। গীবতকারীর জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে কঠিন শাস্তি রয়েছে (ইবনু কাছীর ১০/১৯৫)। মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ الَّذِينَ يَرْمُونَ الْمُحْصَنَاتِ الْغَافِلَاتِ الْمُؤْمِنَاتِ لُعِنُوا فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ ‘যারা সতী-সাধ্বী, সরলা ঈমানদার নারীদের প্রতি (যেনার) অপবাদ দেয়, তারা ইহকালে ও পরকালে অভিশপ্ত এবং তাদের জন্য রয়েছে গুরুতর শাস্তি’ (নূর ২৪/২৩)। অতএব এক মুসলমান অপর মুসলমান ভাইয়ের প্রতি তার ধন-সম্পদ, রক্ত, ও মান-মর্যাদা হানি করা হারাম’।[10]
হাদীছে এসেছে,عَنْ أَبِى ذَرٍّ رضى الله عنه أَنَّهُ سَمِعَ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ لاَ يَرْمِى رَجُلٌ رَجُلاً بِالْفُسُوقِ، وَلاَ يَرْمِيهِ بِالْكُفْرِ، إِلاَّ ارْتَدَّتْ عَلَيْهِ، إِنْ لَمْ يَكُنْ صَاحِبُهُ كَذَلِكَ. আবু যার হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, একজন অপরজনকে ফাসিক বলে যেন গালি না দেয় এবং একজন অন্যজনকে কাফির বলে অপবাদ না দেয়। কেননা অপরজন যদি তা না হয় , তবে সে অপবাদ তার নিজের উপরই আপতিত হবে’।[11]
(৪৩) লৌকিকতা ও শিরক বির্বজিত ইবাদতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন :
মহান আল্লাহ বলেন, وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِينُ الْقَيِّمَة-ِ ‘অথচ তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি যে, তারা খালেছ অন্তরে একনিষ্ঠভাবে কেবলমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে’ (বাইয়্যিনাহ ৯৮/৫)। সমস্ত ইবাদত একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করা এবং পরকালে নাজাতের জন্য রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণ-অনুকরণ করা। মহান আল্লাহ বলেন, مَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الْآخِرَةِ نَزِدْ لَهُ فِي حَرْثِهِ وَمَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الدُّنْيَا نُؤْتِهِ مِنْهَا وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ نَصِيبٍ ‘যে আখিরাতের ফসল কামনা করে, আমি তার জন্য ফসলে প্রবৃদ্ধি দান করি, আর যে দুনিয়ার ফসল কামনা করে আমি তাকে তা থেকে কিছু দেই এবং আখিরাতে তার জন্য কোন অংশই থাকবে না’ (শুরা ৪২/২০)। মহান আল্লাহ বলেন, مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيهَا وَهُمْ فِيهَا لَا يُبْخَسُونَ- أُولَئِكَ الَّذِينَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الْآخِرَةِ إِلَّا النَّارُ وَحَبِطَ مَا صَنَعُوا فِيهَا وَبَاطِلٌ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ‘যে ব্যক্তি পার্থিব জীবন ও তার জাঁকজমক কামনা করে, আমরা তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের ফল দুনিয়াতেই পূর্ণভাবে দিয়ে দিব। সেখানে তাদেরকে কোনই কমতি করা হবে না। এরা হ’ল সেইসব লোক যাদের জন্য পরকালে জাহান্নাম ছাড়া কিছুই নেই। দুনিয়াতে তারা যা কিছু (সৎকর্ম) করেছিল আখেরাতে তা সবটাই বরবাদ হবে এবং যা কিছু উপার্জন করেছিল সবটুকুই বিনষ্ট হবে (বাতিল আক্বীদা ও লোক দেখানো সৎকর্মের কারণে) (হুদ ১১/১৫-১৬)। মহান আল্লাহ বলেন, فَمَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا ‘অতএব যে ব্যক্তি তার প্রভুর সাক্ষাত কামনা করে। সে যেন সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার ইবাদতে কাউকে শরীক না করে’ (কাহাফ ১৮/১১০)। শিরকী আমল থেকে দূরে থাকতে কারণ এটি মহা পাপ। মহান আল্লাহ লুক্বমান সম্পর্কে বলেন, وَإِذْ قَالَ لُقْمَانُ لِابْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ ‘স্মরণ কর, যখন লোকমান উপদেশ দিয়ে তার পুত্রকে বলেছিল, হে বৎস! আল্লাহর সাথ কাউকে শরীক করো না। নিশ্চয়ই শিরক সবচেয়ে বড় পাপ’ (লুক্বমান ৩১/১৩)। শিরকী পাপ মহান আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدِ افْتَرَى إِثْمًا عَظِيمًا ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন না, যে তাঁর সাথে অন্যকে শরীক করে। এতদ্ব্যতীত তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে থাকেন’ (নিসা ৪/৪৮)। যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে অংশীস্থাপন করবে তার জন্য তিনি জান্নাত হারাম করে দিবেন। মহান আল্লাহ বলেন, مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنْصَارٍ ‘বস্ত্ততঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করে, আল্লাহ অবশ্যই তার উপরে জান্নাতকে হারাম করে দেন এবং তার ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম। আর যালেমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই’ (মায়েদাহ ৫/৭২)।
হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: قَالَ اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى: أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ، مَنْ عَمِلَ عَمَلًا أَشْرَكَ فِيهِ مَعِي غَيْرِي، تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ- আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমাকে যাদের সাথে অংশীস্থাপন করা হচ্ছে তাদের থেকে আমি অনেক উর্ধ্বে। অতএব যে ব্যক্তি কোন আমল করে এবং সে তার আমলে আমাকে অন্যের সাথে অংশীস্থাপন করে, আমি তার শিরকী কাজ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত’।[12] লোক দেখানো আমল এবং লোককে শুনানো আমল করা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। নাবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ سَمَّعَ سَمَّعَ اللَّهُ بِهِ، وَمَنْ يُرَائِى يُرَائِى اللَّهُ بِهِ. ‘যে ব্যক্তি লোককে শোনানোর জন্য ইবাদত করে আল্লাহ এর বিনিময়ে লোককে শোনানোর উদ্দেশ্যে প্রকাশ করে দিবেন। আর যে ব্যক্তি লোক দেখানো জন্য ইবাদত করে আল্লাহ এর বিনিময়ে তার লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে প্রকাশ করে দিবেন’।[13]
মোর্দ্দকথা মানবজাতি শিরকী আমল থেকে দূরে থাকবে। যেমন কবরে সিজাদাহ করা, মানত মানা, কবর-মাযারের উদ্দেশ্যে ছাগল-গরু যবেহ করা, কবর থেকে বরকত নেওয়া, মৃত ব্যক্তির নিকট শাফা‘আত চাওয়া, বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য কবরের দাফনকৃত ব্যক্তির নিকট সাহায্য চাওয়া। মৃত ব্যক্তির নিকট তার মাধ্যমে অসীলা ধরা, কবরে ফুল দেওয়া, টাকা দেওয়া, তাবীয পড়া, ব্যাথা ভাল হবে বলে হাতে বালা-লাল-নীল সুতা পরা ইত্যাদি শরী‘আত বিরোধী কাজ পরিত্যাগ করতে হবে। লোক দেখানো ছালাত পড়া, মানুষকে শোনানোর জন্য কোন আমল করা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং সকল প্রকার বিদ‘আতী আমল ত্যাগ করে কুরআন সুন্নাহকে মজবুত করে অাঁকড়ে ধরতে হবে। আর সালাফে ছালেহীনদের বুঝ অনুযায়ী সরল সঠিক পথ ধরে সকল আমল-ইবাদত করতে হবে। তাহ’লে ইহলৌকিক ও পরলৌকিক কল্যাণ সাধিত হবে। মনগড়া ইবাদত দ্বারা আমল কবুল হবে না।
(৪৪) ভাল কাজে আনন্দ এবং খারাপ কাজে দুঃখ পাওয়া : হাদীছে এসেছে,
مَنْ سَرَّتْهُ حَسَنَتُهُ وَسَاءَتْهُ سَيِّئَتُهُ فَذَلِكَ الْمُؤْمِنُ-
‘নেক আমল যাকে আনন্দিত করে এবং মন্দ আমল যাকে দুঃখিত করে সেই হ’ল মুমিন’।[14]
(৪৫) সকল পাপের চিকিৎসা হ’ল তওবা :
মহান আল্লাহ বলেন, وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ‘আর হে মুমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর দিকে ফিরে যাও যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার’ (নূর ২৪/৩১)। মহান আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَصُوحًا- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কর, খাঁটি তাওবা’ (তাহরীম ৬৬/৮)। মহান আল্লাহ বলেন,وَأَنِيبُوا إِلَى رَبِّكُمْ وَأَسْلِمُوا لَهُ ‘আর তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অভিমুখী হও এবং তাঁর আজ্ঞাবহ হও’ (যুমার ৩৯/৫৪)। মানবজাতি তওবা ইসতিগফার করলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন এবং আসমান থেকে পানি বর্ষণ করবেন এবং তার ধন-সম্পদ বৃদ্ধি করবেন, তাকে সন্তান- সন্তুতি দান করবেন। সাথে সাথে জান্নাত দান করবেন। মহান আল্লাহ বলেন, فَقُلْتُ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ إِنَّهُ كَانَ غَفَّارًايُرْسِلِ السَّمَاءَ عَلَيْكُمْ مِدْرَارًا- وَيُمْدِدْكُمْ بِأَمْوَالٍ وَبَنِينَ وَيَجْعَلْ لَكُمْ جَنَّاتٍ وَيَجْعَلْ لَكُمْ أَنْهَارًا ‘তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও; নিশ্চয়ই তিনি পরম ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টি প্রেরণ করবেন, এবং তোমাদেরকে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দিয়ে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের জন্য বাগ-বাগিচা দেবেন আর দেবেন নদী-নালাসমূহ’ (নুহ ৭১ /১০-১২)। হাদীছে এসেছে, عَنِ ابْنَ عُمَرَقَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَا أَيُّهَا النَّاسُ تُوبُوا إِلَى اللَّهِ فَإِنِّى أَتُوبُ فِى الْيَوْمِ إِلَيْهِ مِائَةَ مَرَّةٍ- ইবনু উমার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, হে মানব জাতি! তোমরা আল্লাহর নিকট তওবা কর, কেননা যে, আমি প্রত্যেক দিন আল্লাহর নিকট একশত বার করে তওবা করি’।[15]
(৪৬) কুরবানী, আক্বীক্বা এবং অন্যান্য ভাল কাজের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন :
মহান আল্লাহ বলেন, فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ‘অতএব তোমার প্রভুর উদ্দেশ্যে ছালাত আদায় কর ও কুরবানী কর’ (কাওছার ১০৮/২)। মহান আল্লাহ বলেন,قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ বল, আমার ছালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ, সবই বিশ্বপালক আল্লাহর জন্য’ (আন‘আম ৬/১৬২)। অতএব মহান আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক স্থাপন করা যাবে না। যবেহ কুরবানী কোন মাজার বা পীরের নামে করা যাবে না। সকল কিছুই আল্লাহরই জন্য করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ ‘তাঁর কোন শরীক নেই। আর এ ব্যাপারেই (অর্থাৎ শরীক না করার ব্যাপারে) আমি আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলিম’ (আন‘আম ৬/৬৩)। মহান আল্লাহ বলেন, وَالْبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُمْ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ لَكُمْ فِيهَا خَيْر- ‘আর কুরবানীর উটকে আমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন করেছি। এতে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে’ (হজ্জ ২২/৩৬)। মহান আল্লাহ বলেন, ذَلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ ‘উপরের গুলি এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর আদেশ সমূহকে সম্মান করে, নিশ্চয়ই সেটি হৃদয় নিঃসৃত আল্লাহভীতির প্রকাশ’ (হজ্জ ২২/৩২)।
হাদীছে এসেছে, عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رضى الله عنه قَالَ كَانَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم يُضَحِّى بِكَبْشَيْنِ وَأَنَا أُضَحِّى بِكَبْشَيْنِ আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) দু’টি ভেড়া দিয়ে কুরবানী আদায় করতেন। আমিও কুরবানী আদায় করতাম দু’টি ভেড়া দিয়ে’।[16] অন্য হাদীছে এসেছে, عَنْ أَنَسٍ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم انْكَفَأَ إِلَى كَبْشَيْنِ أَقْرَنَيْنِ أَمْلَحَيْنِ فَذَبَحَهُمَا بِيَدِهِ আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দু’টি সাদা-কালো রং এর শিং ওয়ালা ভেড়ার দিকে এগিয়ে গেলেন এবং নিজ হাত দিয়ে সে দু’টিকে যবেহ করলেন’।[17]
(৪৭) আল্লাহর আনুগত্য, রাসূলের আনুগত্য ও নেতৃবৃন্দের আনুগত্য :
মহান আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর ও তোমাদের নেতৃবৃন্দের আনুগত্য কর’ (নিসা ৪/৫৯)।
হাদীছে এসেছে,عَنِ أَبيَ هُرَيْرَةَ رضى الله عنه أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَنْ أَطَاعَنِى فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ، وَمَنْ عَصَانِى فَقَدْ عَصَى اللَّهَ، وَمَنْ أَطَاعَ أَمِيرِى فَقَدْ أَطَاعَنِى، وَمَنْ عَصَى أَمِيرِى فَقَدْ عَصَانِى. আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে আমার আনুগত্য করল সে আল্লাহরই আনুগত্য করল। আর যে আমার নাফরমানী করল সে আল্লাহরই নাফরমানী করল। যে আমার আমীরের আনুগত্য করল সে আমারই আনুগত্য করল। যে আমার আমীরের নাফরমানী করল সে আমারই নাফরমানী করল’।[18] অন্য হাদীছে এসেছে, عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رضى الله عنه قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم اسْمَعُوا وَأَطِيعُوا وَإِنِ اسْتُعْمِلَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌ حَبَشِىٌّ كَأَنَّ رَأْسَهُ زَبِيبَةٌ. আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যদি তোমাদের উপর এমন কোন হাবশী দাসকেও শাসক নিযুক্ত করা হয় যার মাথাটি কিসমিসের মত তবুও তার কথা শোন ও তার আনুগত্য কর’।[19]
(৪৮) জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপন করা :
মহান আল্লাহ বলেন, وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ‘তোমরা সকলে সমবেতভাবে আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ কর এবং পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (আলে ইমরান ২/১০৩)। হাদীছে এসেছে, عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ يَرْوِيهِ قَالَ قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم مَنْ رَأَى مِنْ أَمِيرِهِ شَيْئًا فَكَرِهَهُ فَلْيَصْبِرْ، فَإِنَّهُ لَيْسَ أَحَدٌ يُفَارِقُ الْجَمَاعَةَ شِبْرًا فَيَمُوتُ إِلاَّ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً. ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, কেউ যদি তার আমীর (ক্ষমতাসীন) থেকে এমন কিছু দেখে যা সে অপসন্দ করে তাহ’লে সে যেন ধৈর্য ধারণ করে। কারণ যে কেউ জামা‘আত থেকে এক বিঘত পরিমান দূরে সরে মারা যাবে তার মৃত্যু হবে জাহেলিয়াতের মৃত্যু’।[20] এ বিষয়ে অন্য একটি হাদীছ, عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ خَرَجَ مِنَ الطَّاعَةِ وَفَارَقَ الْجَمَاعَةَ ثُمَّ مَاتَ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি (আমীরের) আনুগত্য থেকে বের হ’ল এবং জামা‘আত পৃথক করল। অতঃপর মৃত্যুবরণ করল সে যেন জাহেলিয়াতের অবস্থায় মৃত্যু বরণ করল’।[21]
(৪৯) মানুষের মাঝে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা :
মহান আল্লাহ বলেন, وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ ‘আর যখন তোমরা লোকদের মধ্যে বিচার করবে, তখন ন্যায়বিচার করবে’ (নিসা ৪/৫৮)। পবিত্র কুরআন-সুন্নাহর আইন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই মানবজাতির শান্তি নিহিত রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللَّهُ وَلَا تَكُنْ لِلْخَائِنِينَ خَصِيمًا ‘নিশ্চয়ই আমরা তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি সত্য সহকারে। যাতে তুমি সে অনুযায়ী লোকদের মধ্যে বিচার-ফায়ছালা করতে পার, যা আল্লাহ তোমাকে জানিয়েছেন। আর তুমি বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষে বাদী হয়ো না’ (নিসা ৪/১০৫)।
মহান আল্লাহ বলেন, وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّى تَفِيءَ إِلَى أَمْرِ اللَّهِ فَإِنْ فَاءَتْ فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ- ‘আর যদি মুমিনদের দু’দল যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তাহ’লে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। অতঃপর যদি তাদের একদল অপর দলের উপর বাড়াবাড়ি করে, তাহ’লে যে দলটি বাড়াবাড়ি করবে, তার বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ কর, যতক্ষণ না সে দলটি আললাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। তারপর যদি দলটি ফিরে আসে তাহ’লে তাদের মধ্যে ইনছাফের সাথে মীমাংসা কর এবং ন্যায়বিচার কর। নিশ্চয় আললাহ ন্যায়বিচারকারীদের ভালবাসেন’ (হুজুরাত ৪৯/৯)। মুমিনগণ পরস্পর ভাই-ভাই। সুতরাং তাদের মাঝে সুবিচারই করতে হবে।
মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ ‘নিশ্চয় মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। কাজেই তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে আপোষ মীমাংসা করে দাও। আর তোমরা আললাহর তাক্বওয়া অবলম্বন কর, আশা করা যায় তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হবে’ (হুজুরাত ৪৯/১০)।
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-কে বলতে শুনেছি তিনি বলেন, يَقُولُ لاَ حَسَدَ إِلاَّ فِى اثْنَتَيْنِ رَجُلٌ آتَاهُ اللَّهُ مَالاً فَسَلَّطَهُ عَلَى هَلَكَتِهِ فِى الْحَقِّ، وَرَجُلٌ آتَاهُ اللَّهُ حِكْمَةً فَهْوَ يَقْضِى بِهَا وَيُعَلِّمُهَا রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, কেবল দু’টি বিষয়ে ঈর্ষা করা বৈধ- ১. সে ব্যক্তির উপর যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন, অতঃপর তাকে বৈধ পন্থায় অকাতরে ব্যয় করার ক্ষমতা দিয়েছেন। ২. সে ব্যক্তির উপর যাকে আল্লাহ তা‘আলা প্রজ্ঞাদান করেছেন, অতঃপর সে তার মাধ্যমে বিচার ফায়সালা করে ও অন্যকে শিক্ষা দেয়’।[22]
(৫০) সৎ কাজের আদেশ অসৎকাজের নিষেধ :
মহান আল্লাহ বলেন,وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونََ ‘আর তোমাদের মধ্যে একটা দল থাকা চাই, যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহবান করবে ও অন্যায় থেকে নিষেধ করবে। বস্ত্ততঃ তারাই হ’ল সফলকাম’ (আলে ইমরান ৩/১০৪)।
আল্লাহ বলেন, ‘তোমরাই হ’লে শ্রেষ্ঠ জাতি। যাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে মানবজাতির কল্যাণের জন্য। তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে ও অন্যায় কাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখবে’ (আলে ইমরান ৩/১১০)। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট ইবাদত হ’ল তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা, সকল ইবাদত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা, আর সর্ব নিকৃষ্ট কাজ হ’ল আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে অংশী স্থাপন করা।
মহান আল্লাহ বলেন, الَّذِينَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُور- ‘তারা এমন লোক, যাদেরকে আমরা যদি পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করি, তাহ’লে তারা ছালাত কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, সৎকাজের আদেশ দেয় ও অসৎকাজে নিষেধ করে। আর সকল কাজের পরিণাম আল্লাহর ইচ্ছাধীন’ (হজ্জ ২২/৪১)। ‘আয়াতটি আদেশ দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল সর্ব প্রথম কাজ হ’ল তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা, সকল ইবাদত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা ও যাবতীয় শিরকী কাজ থেকে দূরে থাকা’।[23]
মহান আল্লাহ লোকমান সম্পর্কে বলেন, وَإِذْ قَالَ لُقْمَانُ لِابْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ ‘স্মরণ কর, যখন লোকমান উপদেশ দিয়ে তার পুত্রকে বলেছিল, হে বৎস! আল্লাহর সাথ কাউকে শরীক করো না। নিশ্চয়ই শিরক সবচেয়ে বড় পাপ’ (লোকমান ৩১/১৩)। মহান আল্লাহ লোকমান সম্পর্কে আরো বলেন, يَا بُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِِ ‘হে বৎস! ছালাত কায়েম কর, সৎ কাজের আদেশ দাও ও অসৎকাজে নিষেধ কর এবং বিপদে ধৈর্যধারণ কর। নিশ্চয় এটি শ্রেষ্ঠ কর্মসমূহের অন্তর্ভুক্ত (লোকমান ৩১/১৭)। প্রত্যেক নবী-রাসূলগণ মানবজাতিকে তাগুত পরিহার করে একমাত্র আল্লাহ আল্লাহর দাসত্ব করার আদেশ দিয়ে গেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ ‘প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিকট আমরা রাসূল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং ত্বাগূত থেকে দূরে থাক’ (নাহল ১৬/৩৬)। অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্য সকল তাগুতী পথ (শিরকী কাজ) কে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে সে দৃঢ়তর রজ্জুকে অাঁকড়ে ধরলো যা কখনো ও ছিন্ন হওয়ার নয়। আল্লাহ বলেন, لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ قَدْ تَبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ‘দ্বীনের ব্যাপারে কোন যবরদস্তি নেই। নিশ্চয়ই সুপথ ভ্রান্তপথ হ’তে স্পষ্ট হয়ে গেছে। এক্ষণে যে ব্যক্তি তাগূতে অবিশ্বাস করবে এবং আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন করবে, সে ব্যক্তি এমন এক মযবুত হাতল অাঁকড়ে ধরল, যা কখনোই ভাঙ্গবার নয়। বস্ত্ততঃ আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (বাক্বারাহ ২/২৫৬)। শান্তিতে জীবন-যাপন করতে চাইলে নিজের জীবনে তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করবে এবং অপরকে আদেশ করবে, নিজেকে শিরকী কাজ থেকে বেঁচে থাকতে হবে এবং অপরকে শিরকী কাজ করা থেকে নিষেধ করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, الَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُولَئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُمْ مُهْتَدُونَ ‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানের সাথে শিরককে মিশ্রিত করেনি, তাদের জন্যই রয়েছে (জাহান্নাম থেকে) নিরাপত্তা এবং তারাই হেদায়াতপ্রাপ্ত’ (আন‘আম ৬/৮২)। সমাজে ক্ষমতা পেতে চাইলে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেতে চাইলে তাকে অবশ্যই প্রথমে আদেশ করতে হবে তাওহীদ প্রতিষ্ঠার এবং সর্ব প্রথম নিষেধ করতে হবে শিরক থেকে। মহান আল্লাহ বলেন, وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَى لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا وَمَنْ كَفَرَ بَعْدَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্মসমূহ সম্পাদন করে, আল্লাহ তাদের ওয়াদা দিয়েছেন যে, তিনি তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে শাসন ক্ষমতা দান করবেন, যেমন তিনি দান করেছিলেন পূর্ববর্তীদেরকে। আর তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন তাদের ধর্মকে যা তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তিনি তাদেরকে ভয়-ভীতির বদলে অবশ্যই নিরাপত্তা দান করবেন। (শর্ত হ’ল) তারা কেবল আমারই দাসত্ব করবে এবং আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না। এরপরে যারা অবাধ্য হবে তারাই হবে পাপাচারী’ (নূর ২৪/৫৫)। জান্নাত পেতে হলে সৎ কাজের আদেশ অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করতেই হবে, আর এ দাওয়াতী কাজে নবী-রাসূলের পথ সালফে সালেহীনদের পথ ধরতে হবে।
মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ وَالْقُرْآنِ وَمَنْ أَوْفَى بِعَهْدِهِ مِنَ اللَّهِ فَاسْتَبْشِرُوا بِبَيْعِكُمُ الَّذِي بَايَعْتُمْ بِهِ وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ-التَّائِبُونَ الْعَابِدُونَ الْحَامِدُونَ السَّائِحُونَ الرَّاكِعُونَ السَّاجِدُونَ الْآمِرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّاهُونَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَالْحَافِظُونَ لِحُدُودِ اللَّهِ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের নিকট থেকে তাদের জান ও মাল খরিদ করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে। তারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে। অতঃপর তারা হত্যা করে অথবা নিহত হয়। এর বিনিময়ে তাদের জন্য (জান্নাত লাভের) সত্য ওয়াদা করা হয়েছে তওরাত, ইনজীল ও কুরআনে। আর আল্লাহর চাইতে নিজের অঙ্গীকার অধিক পূরণকারী আর কে আছে? অতএব তোমরা এই ক্রয়-বিক্রয়ের বিনিময়ে (জান্নাতের) সুসংবাদ গ্রহণ কর যা তোমরা তাঁর সাথে করেছ। আর এটাই হ’ল মহান সফলতা। (যাদেরকে আল্লাহ জান্নাতের বিনিময়ে খরিদ করে নিয়েছেন, তারা হ’ল) তওবাকারীগণ, ইবাদতকারীগণ, (সুখে-দুঃখে) আল্লাহর প্রশংসাকারীগণ, আল্লাহর পথে ভ্রমণকারীগণ, রুকু ও সিজদাকারীগণ, সৎকাজের আদেশ দানকারী ও অসৎকাজে নিষেধকারীগণ এবং আল্লাহর সীমারেখা সমূহের হেফাযতকারীগণ। আর তুমি বিশ্বাসীদের (জান্নাতের) সুসংবাদ শুনিয়ে দাও’ (তাওবাহ ৯/১১১-১১২)। ভাল কাজের আদেশ, খারাপ কাজের নিষেধ অবশ্যই করতে হবে, যার যতটুকু সমর্থ রয়েছে। নচেৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে গযব নাযিল হবে। আর আদেশ এবং নিষেধের আগে দাঈর অবশ্যই সে সম্পর্কে জ্ঞান থাকা লাগবে।
মহান আল্লাহ বলেন, لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَى لِسَانِ دَاوُودَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ -كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ ‘বনু ইস্রাঈলের মধ্যে যারা কাফির ছিল তাদেরকে লা‘নত করা হয়েছিল দাঊদ ও মরিয়াম-তনয় ঈসার যবানীতে। সেটা এজন্য ছিল যে, তারা অবাধ্যতা করেছিল এবং সীমালংঘন করেছিল। তারা যেসব মন্দকাজ করত, তা থেকে পরস্পরকে নিষেধ করত না। এভাবে তারা অবশ্যই গর্হিত কাজ করত’ (মায়েদাহ ৪/৭৮-৭৯)। তারা পাপ কাজ, অন্যায় কাজ করত কিন্তু কেউ কাউকে বাধা দিতো না, যারা জেনে-শুনে পাপ কাজ কর্মে দেখে অথচ নিষেধ করে না, বাধা দেয় না তারা যেন সে পাপ কর্মে শামিল।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أَضْعَفُ الإِيمَانِ. ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কোন অন্যায় কাজ দেখবে সে যেন সেটাকে হাত দিয়ে বাধা দেয়, এটিতে যদি সে সক্ষম না হয় তবে যেন মুখ দিয়ে বাধা দেয়, এটিতেও যদি সে সক্ষম না হয় তবে সে অন্তর থেকে ঘৃণা করে, আর এটা হ’ল দুর্বল ঈমান’।[24]
হাদীছে এসেছে, عَنْ زَيْنَبَ ابْنَةِ جَحْشٍ رضى الله عنهن أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم دَخَلَ عَلَيْهَا فَزِعًا يَقُولُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ، وَيْلٌ لِلْعَرَبِ مِنْ شَرٍّ قَدِ اقْتَرَبَ فُتِحَ الْيَوْمَ مِنْ رَدْمِ يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ مِثْلُ هَذِهِ. وَحَلَّقَ بِإِصْبَعِهِ الإِبْهَامِ وَالَّتِى تَلِيهَا. قَالَتْ زَيْنَبُ ابْنَةُ جَحْشٍ فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَنَهْلِكُ وَفِينَا الصَّالِحُونَ قَالَ نَعَمْ، إِذَا كَثُرَ الْخُبْثُ. যয়নব বিনতে জাহশ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত একবার রাসূল (ছাঃ) ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় তাঁর নিকট আসলেন এবং বলতে লাগলেন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য মা‘বুদ নেই)। আরবের লোকদের জন্য সেই অনিষ্টের কারণ ধ্বংসে অনিবার্য যা নিকটবর্তী হয়েছে। আজ ইয়াজুজ ও মাজুজের প্রাচীর এ পরিমাণ খুলে গেছে। এ কথা বলার সময় তিনি তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলির অগ্রভাগকে তার সঙ্গের শাহাদত আঙ্গুলির অগ্রভাগের সঙ্গে মিলিয়ে গোলাকার করে ছিদ্রের পরিমান দেখালেন। যয়নব বিনতে জাহশ (রাঃ) বলেন, তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাদের মধ্যে পুন্যবান লোকজন থাকা সত্ত্বেও কি আমরা ধ্বংস হয়ে যাব? তিনি বললেন, হ্যাঁ যখন পাপ কাজ অতি মাত্রায় বেড়ে যাবে'।[25] উমার বিন আব্দুল আযীয বলেন, বলা হ’ত যে নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা সাধারণ মানুষের উপর নিদিষ্ট ব্যক্তির পাপের কারণে আযাব নাযিল করবেন না। কিন্তু যখন অন্যায় কাজ প্রকাশ্যে করা হবে অথচ কেউ সেটি বাধা দিবে না তখনই তারা সবাই শাস্তি ভোগের উপযোগী হবে (আল্লাহর গযব নাযিল হবে) (মুখতাছার শু‘আবিল ঈমান পৃঃ ৮৩)। (ক্রমশঃ)
[লেখক : লিসান্স ও এম.এ, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সঊদী আরব]
[1]. বুখারী হা/৫৮৩২; আহমাদ হা/১২০০৪; মুসলিম হা/৫৫৪৬।
[2]. বুখারী হা/৫৪২৬; আহমাদ হা/২৩৩৬৪; মুসলিম হা/২০৬৭।
[3]. বুখারী হা/৫৮১৮; আহমাদ হা/২৪০৩৭; মুসলিম হা/২০৮০।
[4]. বুখারী হা/৫৭৮৩; আহমাদ হা/৪৪৮৯; মুসলিম হা/২০৮৫।
[5]. মুসলিম হা/২২৬০; আহমাদ হা/২৩০৫৬।
[6]. বুখারী হা/৬৪৭৩; আহমাদ হা/১৮১৯২; মুসলিম হা/১৭১৫; ইমাম বায়হাক্বী, শুয়াবুল ঈমান, পৃ. ৮/৪৮৮।
[7]. মুসলিম হা/২৫৫৯; আহমাদ হা/১৩১৭৯।
[8]. বুখারী হা/৬০৭৬; মুসলিম হা/২৫৫৯; আহমাদ হা/১৩১৮০।
[9]. বুখারী হা/৬০৬৪; মুসলিম হা/২৫৬৩; আহমাদ হা/৮১১৮।
[10]. আহমাদ হা/৭৭২৭; মুসলিম হা/২৫৬৪।
[11]. বুখারী হা/৬০৪৫; আহমাদ হা/২১৫৭১।
[12]. আহমাদ হা/৭৯৯৯; মুসলিম হা/২৯৮৫।
[13]. বুখারী হা/৬৪৯৯; আহমাদ হা/১৮৮০৮; মুসলিম হা/২৯৮৭।
[14]. তিরমিযী হা/২১৬৫।
[15]. মুসলিম হা/৭০৩৪; আহমাদ হা/১৭৮৫০।
[16]. বুখারী হা/৫৫৫৩; আহমাদ হা/১৩৯৯৫।
[17]. বুখারী হা/৫৫৫৪; মুসলিম হা/১৯৬৬।
[18]. বুখারী হা/৭১৩৭; আহমাদ হা/৭৬৫৬; মুসলিম হা/১৮৩৫।
[19]. বুখারী হা/৭১৪২; আহমাদ হা/১২১২৬।
[20]. বুখারী হা/৭১৪৩; আহমাদ হা/২৪২৭; মুসলিম হা/১৮৪৯।
[21]. মুসলিম হা/৪৮৯৪; আহমাদ হা/৭৯৪৪।
[22]. বুখারী হা/৭৩; আহমাদ হা/৩৬৫১; মুসলিম হা/৮১৬।
[23]. ইমাম আলুসী রুহুল মা‘আনী ১/২১৪; দার ইহয়া আত-তুরাছ আল-আরাবী, বৈরূত লুবনান, ১ম সংস্করণ ১৪২০ হিঃ।
[24]. আহমাদ হা/১১৫১৪; মুসলিম হা/১৮৬।
[25]. বুখারী হা/৩৩৪৬; আহমাদ হা/২৭৪১৩; মুসলিম হা/২৮৮০।