আটজন হাফেয সন্তানের মা শরীফাহ মাসতুরা
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
মাওলানা আব্দুল খালেক সালাফী 11499 বার পঠিত
[আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহীর
সম্মানিত প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুল খালেক সালাফী (জন্ম : ১৯৪৬ খ্রি.)
বাংলাদেশের অন্যতম প্রাজ্ঞ মুহাদ্দিছ। দীর্ঘ প্রায় ৪৭ বছর যাবৎ তিনি ছহীহ
বুখারীর দারস প্রদান করে আসছেন। পাকিস্তানের জামে‘আ সালাফিয়া থেকে ফারেগ এই
প্রবীণ মুহাদ্দিছ শিক্ষকতা জীবনে অসংখ্য ছাত্রকে পাঠদান করেছেন।
দেশে-বিদেশে রয়েছে তাঁর অসংখ্য ছাত্র ও শুভাকাঙ্খী। অন্তঃপ্রাণ শিক্ষক
হিসাবে পেয়েছেন ছাত্রদের অকুণ্ঠ ভালবাসা। তিনি বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি
খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতাসহ প্রিন্সিপ্যাল হিসাবে দায়িত্ব পালন
করেছেন। সম্প্রতি ২রা মে ২০১৯ আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফীতে স্বীয়
কার্যালয়ে তাঁর শিক্ষা ও কর্মজীবন সম্পর্কে একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন
তাওহীদের ডাক সম্পাদক ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব এবং আল-মারকাযুল ইসলামী
আস-সালাফীর ভাইস প্রিন্সিপাল ড. নূরুল ইসলাম। সাক্ষাৎকারটি ‘তাওহীদ ডাক’-এর
পাঠকদের খেদমতে পেশ করা হ’ল।- সহকারী সম্পাদক]।
তাওহীদের ডাক : আপনার জন্মতারিখ ও জন্মস্থান সম্পর্কে জানতে চাই।
আব্দুল খালেক সালাফী : আমার জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদা যেলার জালসা গ্রামে। জন্মতারিখ জানা নেই। তবে পাকিস্তান স্বাধীনতার পূর্বে আনুমানিক ১৯৪৬/৪৭ সনে আমার জন্ম। বাবা শিক্ষিত মানুষ ছিলেন না। কৃষিকাজ করতেন। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে আমি দ্বিতীয়। সবার বড় ভাই। পরিবারে আমিই একমাত্র শিক্ষিত। আমার জন্মের কিছুকাল পরই আমরা বাংলাদেশে চলে আসি। প্রথমে পোরশা থানার কোন এক গ্রামে বসবাস শুরু করি। সেখানে তিন বছর থাকার পর নওগাঁ যেলার নিয়ামতপুর থানার টিটিহার গ্রামে স্থায়ী হই। বাবা ও মা উভয়ের পরিবারই ছিলেন আহলেহাদীছ। সেদিক থেকে আমি ভাগ্যবান যে ছোটবেলা থেকে শিরক-বিদ‘আতমুক্ত পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলাম।
তাওহীদের ডাক : প্রাথমিক শিক্ষা কোথায় শুরু করেছিলেন?
আব্দুল খালেক সালাফী : আমার পড়াশোনার হাতেখড়ি হয় নওগাঁর রসূলপুর রহমানিয়া মাদরাসায়। এখানেই একটানা পড়াশোনা করি দাওরায়ে হাদীছ পর্যন্ত। তখন ১৯৬৮-৬৯ সাল হবে। এই মাদরাসায় মাওলানা বদীউয্যামান আমার ওস্তাদ ছিলেন। তাঁর কাছে আমি তাফসীর বায়যাভী পড়েছিলাম। এছাড়া মাওলানা আব্দুল হক্ব (নাচোল), আব্দুল ওয়াহ্হাব (দিনাজপুর), আব্দুল হক্ব (গোড়াগাড়ী), নূরুল হূদা (গোদাগাড়ী) প্রমুখ আমার শিক্ষক ছিলেন। পরে পাকিস্তানে গমন করি এবং সেখানে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত প্রায় চার বছর অবস্থান করি।
তাওহীদের ডাক : আপনার বৈবাহিক জীবন কি ছাত্রবয়সেই শুরু হয়?
আব্দুল খালেক সালাফী : হ্যাঁ, রসূলপুর মাদরাসায় তিরমিযীর ক্লাসে থাকতেই আমি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। আমার শ্বশুরবাড়ি আমাদের গ্রাম থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে লক্ষীপুরে অবস্থিত। দাম্পত্য জীবনে আমার ৯টি সন্তান হয়। ছেলে ৩টা এবং মেয়ে ৫টা। একটা ছেলে জন্মের পর ২৯ দিন বয়সে মারা গেছে।
তাওহীদের ডাক : উচ্চশিক্ষার্থে পাকিস্তানকে কেন বেছে নিলেন এবং কিভাবে সেখানে গমন করলেন?
আব্দুল খালেক সালাফী : দাওরা শেষে পাকিস্তান যাওয়ার প্রেরণা যোগান শায়খ আব্দুছ ছামাদ সালাফীর ছোটভাই মাওলানা নূরুল হুদা। উনি তখন পাকিস্তানের করাচী দারুল হাদীছ রহমানিয়া থেকে লেখাপড়া শেষ করে রসূলপুর মাদরাসায় শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। উনি আমার শিক্ষক ছিলেন। তাঁকে দেখে আমার মনে হয় আমি কেন পারব না পাকিস্তানে পড়তে। তাঁর উৎসাহে আমরা রসূলপুর, আলাদীপুর প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের মোট ১০ জন ছাত্র তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে পড়াশোনা করার জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করি। এদের মধ্যে আব্দুস সাত্তার (সাপাহার, নওগাঁ), সাইফুদ্দীন (চাঁপাইনবাবগঞ্জ), আব্দুল মান্নান (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) প্রমুখের নাম এখন মনে আছে। মাওলানা নূরুল হুদা ততদিন মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশীপ পেয়ে ভর্তি হয়ে গেছেন। আমরা তাঁর নিকট পত্র লিখলে তিনি দিক-নির্দেশনা দেন। সেই মোতাবেক আমরা ঢাকা থেকে বিমানে চড়ে করাচী গমন করি এবং করাচী দারুল হাদীছ রহমানিয়ায় আবূদাউদ শ্রেণীতে ভর্তি হই। সেখানে বুখারী ১ম খন্ড ও মুসলিম ১ম খন্ড পর্যন্ত পাঠ করি। শায়খুল হাদীছ হাকাম আলী কানাল্লাহু লাহু, মাওলানা আব্দুল আযীয, মাওলানা আব্দুর রশীদ প্রমুখ আমাদের শিক্ষক ছিলেন। রাতে মিসরীয় শিক্ষকরা এসে আমাদের আরবী ভাষা শিখাতেন। শায়খ আব্দুল্লাহ নাছের রহমানী ছিলেন আমাদের জুনিয়র। ছাত্র বয়সেই তিনি অত্যন্ত মেধাবী এবং তুখোড় বক্তা হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। আমাদের মারকাযের বর্তমান শিক্ষক হাফেয লুৎফর রহমানও সে সময় দারুল হাদীছের হিফয বিভাগে ছিলেন। এছাড়া মাওলানা ওবাইদুল্লাহ গযনফর (সাতক্ষীরা) ছিলেন আমাদের সহপাঠী। মোট বাঙালী ছাত্র ১৩/১৪ জন ছিল।
তিন বছর করাচীতে পড়াশোনা করে শেষ বর্ষে আমি কেন্দ্রীয় মাদরাসা লায়ালপুর তথা ফয়ছালাবাদের জামেআ‘ সালাফিইয়ায় গমন করি এবং সেখানে বুখারী ও মুসলিম পুনরায় পাঠ করি। এছাড়াও সেখানে ইরশাদুল ফুহূল, তাফসীরে বায়যাভী, কুৎবী, হেদায়াতুল হিকমাহ, মুনাযারা রাশিদিয়া প্রভৃতি কিতাব পড়ি। শায়খ আব্দুল্লাহ বুড্ডিমালভী, মাওলানা ছানাউল্লাহ, হাফেয বিন ইয়ামীন প্রমুখ আমাদের শিক্ষক ছিলেন। এছাড়া শায়খ আবান, আলী বিন মুশরিফ প্রমুখ মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রেরিত আরব শিক্ষক আমাদের আক্বীদাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান করতেন। যেদিন আমাদের খতমে বুখারী হয় সেদিন দারসদাতা হিসাবে উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানের বিখ্যাত আলেম ও জমঈয়তে আহলেহাদীছের তৎকালীন সভাপতি হাফেয মুহাম্মাদ গোন্দলভী। ফারাগাতের বছর আমি ইত্তিবায়ে সুন্নাতের উপর একটি ৫০ পৃষ্ঠার থিসিস লিখি। এখানে আমার বাঙালী সহপাঠী ছিলেন মাওলানা মুছত্বফা (নাচোল), মাওলানা ওবাইদুর রহমান (নাচোল) প্রমুখ। এখানেও প্রায় ১৪/১৫ জন বাঙালী ছাত্র ছিলেন।
ফয়ছালাবাদ গমনের পূর্বে কিছুদিন আমি রাওয়ালপিন্ডির দারুল কুরআন মাদরাসাতেও পড়াশোনা করি। সেটি হানাফী মাদরাসা ছিল। সেখানে শায়খ গোলামুল্লাহর নিকট তাঁর নিজের লিখিত তাফসীর পড়েছিলাম। এই তাফসীরে তিনি প্রত্যেক আয়াত দ্বারা তাওহীদের প্রমাণ উপস্থাপন করেছিলেন।
তাওহীদের ডাক : পাকিস্তানের কোন স্মৃতি বিশেষভাবে মনে পড়ে?
আব্দুল খালেক সালাফী : পাকিস্তানের বহু স্মৃতিই তো মনে ভাসে। আমরা মাদরাসায় নিয়মিত রুটি-সব্জি খেতাম। মহিষের দুধের তৈরী লাচ্ছি, দই খেতাম। পাঞ্জাবে সপ্তাহে দু’দিন গোশত দিত। তবে সেই দু’দিন আমাদের বাঙালীদেরকে মাছ দেওয়া হত। ভাত খেতাম সপ্তাহে এই দু’বারই। মাদরাসায় খাওয়া-দাওয়া ফ্রী ছিল। তবে অনেকে নিজেরাও রান্না করত।
শিক্ষকদের পাঠদানের পদ্ধতি ছিল খুব চমৎকার। হাদীছের ক্লাসে শিক্ষকগণ হাদীছুল বাব এবং তরজমাতুল বাবের সম্পর্ক ও প্রাসঙ্গিকতা আগে লিখে দিতেন। তারপর পড়ানো শুরু করতেন। আমি নিজে সেগুলি লিখে নিতাম। সেই নোটগুলো আমার কাছে বহুদিন যাবৎ লেখা ছিল এবং দেশে ফিরে এগুলো মুতা‘আলা করেই আমি ছাত্রদের পড়াতাম। পড়াশোনার জন্য অনেক পরিশ্রম করতাম। ক্লাসের বই শেষ করার এত চাপ ছিল যে, অন্য কোন বই পাঠের সুযোগই পেতাম না। সকাল ৭টা থেকে আছর পর্যন্ত খাবার ও ছালাতের বিরতি ছাড়া টানা ক্লাস হত। বিকালে ছাত্ররা বাইরে বের হত। কেউবা লাইব্রেরীতে সময় কাটাত।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা পাকিস্তানেই ছিলাম। এসময় পাকিস্তানীরা আমাদের প্রতি কোন খারাপ আচরণ করেনি। আমরা পত্রিকায় দেখতাম যে যুদ্ধ হচ্ছে। তখন সেখানকার অধিকাংশ বাঙালী পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। কেননা তারা ভেবেছিল কিছু রাজনীতিবিদ ভারতের সঙ্গে অাঁতাত করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। প্রকৃতপক্ষে দেশে কি ঘটছে তা সেভাবে বুঝার সুযোগ ছিল না। বাংলাদেশ যেদিন স্বাধীন হ’ল সেদিন পত্রিকায় নিয়াজীকে ভারতবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে দেখে পাকিস্তানীরা কান্নায় ভেঙে পড়ে। পাকিস্তানের পরাজয়ে বাঙালীদের কেউ কেউ যেমন দুঃখ পেয়েছিল, তেমনি কেউ খুশীও প্রকাশ করেছিল। সবমিলিয়ে একটা হতভম্ব অবস্থা বিরাজ করছিল।
পাকিস্তানে আসার পর চার বছরে একবারও দেশে যাইনি। যখন পাকিস্তানে যাত্রা করি, তখন আমার কন্যার বয়স মাত্র দেড় বছর। পিতার কাছে পরিবারকে রেখে চলে এসেছিলাম। পড়ার প্রতি এমন ঝোঁক এসেছিল যে অন্য কোন দিকে মনোযোগ দেইনি। পরিবারের সাথে চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ হত। যখন যুদ্ধ চলছে, তখন লন্ডন হয়ে চিঠি পাঠাতাম এক বন্ধুর আত্মীয়ের মাধ্যমে। পড়াশোনা শেষে আর দেশে ফিরতে পারছিলাম না। কেননা আমাদের কাছে পাসপোর্ট ছিল না। ফলে রেডক্রসের মাধ্যমে দেশে ফেরার আবেদন জানালাম। আবেদন মঞ্জুর হ’ল। অতঃপর লাহোর বিমানবন্দর থেকে আমাদেরকে ঢাকার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেয়া হ’ল।
উর্দূ পত্রিকা নিয়মিত পড়তাম। যেমন ইমরোজ, জং, ইনক্বিলাব প্রভৃতি। আতাউল্লাহ হানীফ ভুজিয়ানীর আল-ই‘তিছাম পত্রিকাও মাদরাসাতে আসত। ছাত্রদের কেউ কেউ এসব পত্রিকায় লিখত। ইনক্বিলাবে ওবায়দুল্লাহ গযনফর লিখতেন। তবে আমি কখনও লিখিনি।
আর ভ্রমণের তেমন কোন সুযোগ বা আগ্রহ কোনটাই ছিল না। করাচী থাকতে কেবল ফ্লিফটন সী বীচে মাঝেমধ্যে ঘুরাঘুরি করতাম। এছাড়া ইসলামাবাদ, রাওয়ালপিন্ডি, লাহোর, গুজরানওয়ালা, ওকাড়া প্রভৃতি শহরেও যাওয়ার সুযোগ হয়েছে।
জামেআ‘ সালাফিয়াহর প্রাঙ্গনেই জমঈয়তে আহলেহাদীছ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় কনফারেন্স হ’ত। সেখানে আমরা উপস্থিত থাকতাম। তৎকালীন জমঈয়ত ছদর মাওলানা মুহাম্মাদ গোন্দলভীর সভাপতিত্বে আছরের ছালাতের পর কনফারেন্স শুরু হত। মাগরিবের পর থেকে খাওয়ার বিরতি থাকত। অতঃপর এশার ছালাতের পর থেকে রাত ১২/১টা পর্যন্ত কনফারেন্স চলত। এতে প্রচুর লোকসমাগম হত। বিশেষ কোন বক্তার নাম মনে নেই। কেবল মাওলানা আব্দুর রশীদ কামার নামক একজন বক্তার কথা মনে পড়ে। তিনি খুব উদ্দীপ্ত কণ্ঠে বক্তব্য রাখতেন।
তাওহীদের ডাক : পাকিস্তানে আপনার সাথে কোন কোন আলেমের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল?
আব্দুল খালেক সালাফী : ফয়ছালাবাদে ইদারাতুল উলূম আল-আছারিয়াহ-এ মাঝে মধ্যে আমরা যেতাম। সেখানে মাওলানা আব্দুহু, মাওলানা ছিদ্দীক, মাওলানা ইসহাক চীমা প্রমুখের সাথে সাক্ষাৎ হত।
এছাড়া ইহসান ইলাহী যহীরের সাথে দেখা হয়েছিল। তবে পাকিস্তানে থাকতে তাঁর কোন বক্তব্য শোনা হয় নি। ১৯৮৪ সালে যখন তিনি বাংলাদেশে আসেন তখন তাঁর বক্তব্য শোনার সুযোগ হয়। তাঁর বক্তব্যের একটা অংশ এমন ছিল যে, ‘আমাদের আহলেহাদীছদের কোন বক্তব্য যদি কুরআন-হাদীছের বিপরীত হয়, তবে কাল সূর্য ওঠার পূর্বেই আমরা সেটা ছেড়ে দেব। অনুরূপভাবে আপনারা মাযহাবীরাও ঘোষণা করুন যে, আপনাদের বক্তব্য যদি কুরআন-হাদীছের সাথে সাংঘর্ষিক হয় তবে সেটা ত্যাগ করবেন। তাহলেই আমাদের সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে’। রাত এগারোটার ভাষণে তিনি এই কথা বলেন।
একবার মাওলানা আতাউল্লাহ হানীফ ভূজিয়ানীর সাথেও সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি কোন এক উপলক্ষ্যে জামেআ‘ সালাফিয়াতে আসলেন। পোষাক ছিল মার্কিন থান কাপড়ের পাঞ্জাবী ও লুঙ্গি। তাঁকে এভাবে খুব সাধারণ বেশভূষায় দেখে অবাক হয়েছিলাম। সবাই তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন। অথচ তিনি তাদেরকে রেখে মসজিদের এক কোনে ছালাত আদায় করতে দাঁড়িয়ে গেলেন। দৃশ্যটি মনে বেশ রেখাপাত করেছিল।
ছূফী আব্দুল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল গুজরানওয়ালাতে। তিনি মুস্তাজাবুদ দাওয়াহ হিসাবে পাকিস্তানে সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর নিকট অনেক লোককে দো‘আ নিতে দেখেছিলাম।
তাওহীদের ডাক : দেশে ফিরে কোথায় শিক্ষকতা শুরু করেন?
আব্দুল খালেক সালাফী : ১৯৭৩ সালে ঈদুল ফিৎরের পর দেশে ফিরে প্রথমে রসূলপুর মাদরাসাতেই শিক্ষকতা শুরু করি। আমার জন্য মাদরাসা কর্তৃপক্ষ অপেক্ষা করছিলেন। দেশে এসে তাই প্রথমেই মাদরাসায় যোগ দেই। অতঃপর এক সপ্তাহের ছুটি পেলে বাড়িতে যাই। এই মাদরাসায় প্রথম বছর নাসাঈ পড়িয়েছিলাম। আর দ্বিতীয় বছর তথা ১৯৭৪ সাল থেকে প্রথম বুখারী পড়ানো শুরু করি। ঐ বছরেই আমি রসূলপুর মাদরাসার প্রিন্সিপাল হিসাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হই। সেখানে ৩/৪ বছর থাকার পর ভায়ালক্ষীপুর মাদরাসায় আসি। এখানেও প্রিন্সিপাল হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছি। প্রত্যেক মাদরাসাতেই ছহীহ বুখারী পড়ানোর সুযোগ হয়েছে। বিগত ৪৭ বছরে ২/১ বছর বাদ দিয়ে প্রতি বছরই ছহীহ বুখারী পড়িয়েছি আলহামদুলিল্লাহ।
ভায়ালক্ষীপুরে প্রায় ১০ বছর কাটিয়ে পুনরায় রসূলপুরে ফিরে যাই। এরপর বিভিন্ন সময়ে আলাদীপুর, কদমডাঙ্গা, কলমুডাঙ্গা ও মাকলাহাট মাদরাসায় শিক্ষকতা করেছি। ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় প্রিন্সিপাল হিসাবে দায়িত্ব পালন করি। ঢাকা শহরের মাদরাসা হওয়ায় এখানে আমি প্রিন্সিপাল হিসাবে যোগ দিতে চাইনি। কিছুটা ভীত-সন্ত্রস্ত ছিলাম। তবুও ড. এম. এ. বারী ছাহেবের নির্দেশে আমাকে প্রিন্সিপ্যাল হিসাবে যোগদান করতে হয়। তিনি আমাকে বিশেষ স্নেহ করতেন। পরে কমিটির সাথে কিছুটা দ্বন্দ্ব ও দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ায় সেখান থেকে চলে আসি। অতঃপর পুনরায় ভায়ালক্ষীপুর মাদরাসায় যোগদান করি। সেখানে কয়েক বছর কাটিয়ে চাঁপাই দারুল হাদীছে শিক্ষকতা শুরু করি। সর্বশেষ ২০১০-১১ সনে নওদাপাড়া মাদরাসায় যোগদান করি। অতঃপর ২০১৪ সাল থেকে এখানে প্রিন্সিপাল হিসাবে দায়িত্বরত আছি।
তাওহীদের ডাক : একজন মুহাদ্দিছ হিসাবে হাদীছ পাঠদানকালে কোন বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেন?
আব্দুল খালেক সালাফী : যেভাবে পাকিস্তানে পড়াশোনা করেছি এবং সেখানকার শিক্ষকদের যেভাবে পাঠদান করতে দেখেছি তার অনুসরণেই আমি দারস প্রদান করি। আগে তর্জমাতুল বাব ও হাদীছুল বাবের মধ্যে সম্পর্কটা বলে দেই। তারপর কঠিন শব্দগুলো অর্থসহ বিশ্লেষণ করে দেই। তারপর তর্জমা করি। সবশেষে হাদীছ থেকে কোন মাসআলা ইস্তিম্বাত করার থাকলে করে দেই। এই নিয়মেই আমি পড়িয়ে আসছি। মুতা‘আলা দেখার জন্য শুরু থেকে ফাতহুল বারীই দেখি। এছাড়া অন্য কোন গ্রন্থ দেখার সময় হয় না।
তাওহীদের ডাক : শিক্ষক হিসাবে সফল হতে গেলে করণীয় কি?
আব্দুল খালেক সালাফী : যে বিষয়ে পাঠদান করবে সে বিষয়টি নিজেকে ভালভাবে পড়তে হবে ও গভীরভাবে জানতে হবে। ক্লাসের পূর্বে মুতা‘আলার কোন বিকল্প নেই। বিশেষ করে ক্লাসে ছাত্ররা যদি মেধাবী হয় এবং তারাও যদি নিয়মিত মুতা‘আলা করে তবে সেটা শিক্ষকদেরকে মধ্যেও অগ্রগতি সৃষ্টি করে। এজন্য ছাত্রদেরকে সবসময় পড়ে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাদেরকেও পরিশ্রম করাতে হবে। তাদেরকে প্রশ্ন শেখাতে হবে। এতে করে ক্লাসে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে ছাত্র যেমন উপকৃত হবে, তেমনি নিজেও শিক্ষক হিসাবে সফল হওয়া যাবে। একজন ভাল শিক্ষক কেবল পড়ান না বরং ছাত্রদেরকে বাস্তবভিত্তিক অনুশীলনীর মাধ্যমে শেখান। এতেই ছাত্রদের মধ্যে প্রকৃত যোগ্যতা তৈরী হয়। কেবল পাঠদান করার নাম শিক্ষকতা নয়, বরং যোগ্য ও আদর্শবান ছাত্র তৈরী করার নাম শিক্ষকতা।
তাওহীদের ডাক : উল্লেখযোগ্য কোন ছাত্রের নাম বলুন।
আব্দুল খালেক সালাফী : অসংখ্য ছাত্র রয়েছে। সবার নাম মনে রাখা কঠিন। তবে রাণীবাজারের সাবেক প্রিন্সিপাল আলাউদ্দীন সালাফী, আব্দুল হামীদ (গাইবান্ধা), আফতাবুদ্দীন (চাঁপাইনবাবগঞ্জ), আব্দুর রহীম (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) প্রমুখের নাম বলতে পারি।
তাওহীদের ডাক : আপনার লিখিত কোন গ্রন্থ রয়েছে কি?
আব্দুল খালেক সালাফী : না, লেখালেখির অভ্যাস আমার নেই। তবে উছূলে হাদীছের একটি পুস্তক ‘মিন আতয়াবিল মিনাহ’ অনুবাদ করেছি, যেটি প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া তাওহীদ পাবলিকেশন্স প্রকাশিত ছহীহ বুখারীর অনুবাদ সম্পাদনা করেছি। এছাড়া মাসিক আত-তাহরীকের ফৎওয়া বোর্ডের সদস্য হওয়ার পর বেশ কিছুদিন ফৎওয়া লিখেছিলাম। এমনকি এজন্য এই বৃদ্ধ বয়সে কম্পিউটারও শিখেছিলাম। তবে অসুস্থতার কারণে এখন আর লিখতে পারি না।
তাওহীদের ডাক : আপনি হাদীছশাস্ত্রে কার নিকট থেকে ইজাযতপ্রাপ্ত হয়েছেন?
আব্দুল খালেক সালাফী : জামেআ সালাফিয়া থেকে ফারাগাতের পর শায়খ আব্দুল্লাহ বুড্ডিমালভী আমাকে খাছ ইজাযাত প্রদান করেন। পরে আমার নিকট থেকেও অনেক ছাত্র ইজাযত গ্রহণ করেছে। একবার সঊদী দুতাবাসের ইয়াতীম বিভাগের পরিচালক জনৈক আরব ছাত্র আমার নিকট ছহীহ বুখারীর দারস গ্রহণ করে ‘ইজাযত’ নেন।
তাওহীদের ডাক : বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ-এর নাম প্রথম কখন শুনেছিলেন?
আব্দুল খালেক সালাফী : বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ-এর নাম আমি প্রতিষ্ঠার পরই শুনেছি। আমীরে জামাআত ড. আসাদুল্লাহ আল-গালিবকেও তখন থেকে চিনতাম। পরে যখন নওদাপাড়ায় বার্ষিক ইজতেমা শুরু হল তখন থেকেই আমাকে বক্তা হিসাবে আমন্ত্রণ জানানো হত। সেই হিসাবে সংগঠনের সাথে আন্তরিকতার সম্পর্ক শুরু থেকেই ছিল।
তাওহীদের ডাক : তাওহীদের ডাক পাঠকদের জন্য নছীহতমূলক কিছু বলুন!
আব্দুল খালেক সালাফী : তাওহীদের ডাক যদিও সেভাবে আমি পড়িনি, তবে যুবকরা এর মাধ্যমে তাওহীদ ও সুন্নাহর প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যে ভূমিকা রাখছে, তা প্রশংসনীয়। আমি তাদের উত্তরোত্তর সফলতা কামনা করি এবং তাদের জন্য দো‘আ করি।
তাওহীদের ডাক : এতক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। জাযাকাল্লাহু খাইরান।
আব্দুল খালেক সালাফী : আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।