পর্বত রাজধানী গিলগিত-বালতিস্তানে (শেষ কিস্তি)

ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 1283 বার পঠিত

চায়না বর্ডারে ঘন্টাখানেক অবস্থানের পর আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। মাঝে সোস্ত বাযারে মাগরিবের ছালাতের বিরতি হল। পেট্রোল পাম্পের সাথেই মসজিদ। মসজিদে কালো কাপড়ের ফ্লাগ ঝুলছে। শীআ মসজিদ। ঢুকব কিনা দ্বিধায় পড়ি। শেষতক উপায়ন্তর না দেখে সেখানেই একাকী ছালাত আদায় করলাম। পুরো গিলগিত-বালতিস্তান প্রদেশ শীআ অধ্যুষিত। ফলে এই অঞ্চলে সুন্নী মসজিদের সংখ্যা কম। ছালাতের বিরতি শেষে হুনজায় এসে পৌঁছতে রাত ৯টা বেজে যায়। বাবুর্চিদের রান্না করা চিকেন কড়াই দিয়ে রাতের খাবার সারলাম। পরে বাযারে মধু ও কাজু বাদামসহ কিছু কেনাকাটা করে হোটেলে এসে ঘুমিয়ে গেলাম।

১৯শে আগস্ট’১৬ সকালে উঠে গিলগিত-বালতিস্তানের অন্যতম প্রসিদ্ধ শহর স্কার্ডু যাওয়ার জন্য প্রস্ত্ততি শুরু হ’ল। গতরাতের স্নোফলে হুনজা শহরের চারপার্শ্বের পাহাড়চুড়াগুলো ধবধবে সাদা হয়ে গেছে। আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা। নাস্তার সাথে আয়েশ করে এক কাপ গরম চা পান করে আমরা বাসে উঠলাম। বেলা ১০টা বাজে তখন। ক’জন সাথীভাই ভোরে উঠে ঈগলস্ নেস্ট ও বালটিট ফোর্ট দেখে এসেছে। এত ঠান্ডায় কম্বলের মায়া ত্যাগ করতে না পারায় আমরা বাকিরা অবশ্য সে সুযোগটা হারিয়েছি। বেলা বাড়ার সাথে সাথে আবহাওয়া কুয়াশামুক্ত হ’তে থাকে, আর হুনজা শহরের সবুজে ভরা ফলমুলের বাগানগুলোতে রোদের স্বর্ণরেণু প্রতিফলিত হয়ে ঝলমল করতে থাকে। আমরা রাকাপোশী পর্বতশিখরের পাদদেশে কিছুক্ষণ বিরতি নেই। দৃষ্টিনন্দন শ্বেত-শুভ্র এই পর্বতচুড়াটি দূর থেকে আকণ্ঠ মুগ্ধতার আবেশ ছড়ায়। পর্বতশিখর থেকে যেখানে গ্লেসিয়ার ও ঝর্ণাধারা নেমে এসেছে সেখানে গড়ে উঠেছে বেশ জমজমাট এক বাজার। পর্যটকরা এসে এখানে সময় কাটায়। প্রকৃতির সাথে মিতালী গড়ে। সেখান থেকে বের হয়ে আমরা গিলগিত শহরের দিকে এগিয়ে চললাম। যোহরের সময় শহরের নিকটবর্তী এক হোটেলে যাত্রাবিরতি হ’ল। দুপুরের খাবার সেরে আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম। জাগলোট পৌঁছে সেখান থেকে গিলগিত নদী অতিক্রম করে গাড়ী ওঠে স্কার্ডু রোডে।

জাগলোট থেকে স্কার্ডু শহর পর্যন্ত ১৬৭ কি.মি. রোডটি বিশ্বের অন্যতম খতরনাক রোড হিসাবে পরিচিত। ষাটের দশকে এর নির্মাণকাজ শুরু করে পাক সেনাবাহিনী। আশির দশকে সাধারণ জনগণের জন্য রোডটি খুলে দেওয়া হয়। দূর্গম পাথুরে পাহাড় কেটে কেটে অনেক শ্রমিকের প্রাণের বিনিময়ে এই রাস্তা নির্মিত হয়। রাস্তায় যেতে বিভিন্ন স্থানে এমন সাইনপোস্ট দেখা যায় যাতে সেসব লোকের নাম লিখিত রয়েছে যারা এই নির্মাণকাজে প্রাণ হারিয়েছেন। তাছাড়া মাঝে মাঝেই পাহাড়ধ্বস হয়। এতে কয়েকদিন পর্যন্ত যানবাহন আটকা পড়ে থাকে। ড্রাইভার একটি উঁচু রাস্তা অতিক্রম করতে গিয়ে বললেন রাস্তাটি একটি বিরাট পাহাড়ধ্বসের কারণে সৃষ্ট হয়েছে। আর এর নীচে চাপা পড়ে আছে ২টি ট্রাক এবং ড্রাইভারসহ কয়েকজন যাত্রী। যাদেরকে আর বের করার সুযোগ হয়নি। চলার পথে এমন অসংখ্য বাঁক রয়েছে যেখান থেকে কয়েক ইঞ্চি এদিক-সেদিক হ’লেই গাড়ি সোজা নীচে গড়িয়ে তুমুল খরস্রোতা সিন্ধু নদের গর্ভে হারিয়ে যাবে। রাস্তার অবস্থাও তথৈবচ। নিয়মিত পাহাড়ধ্বসের কারণে বড় অংশেই রাস্তায় কোন পীচ নেই। ভাঙ্গাচোরা আর ইট-পাথরে ভরা। কোন কোন স্থানে রাস্তা এত সরু যে একটির বেশী গাড়ী অতিক্রম করতে পারে না। ফলে মাত্র ১৬০ কি. মি. রাস্তা পাড়ি দিতে লেগে যায় প্রায় ৮ ঘন্টা।

গাড়ি যখন এই রাস্তায় চলা শুরু করে তখন তটস্থ না হ’লেও কেমন দমবন্ধ লাগে। দুই পাহাড়ের মাঝে বিশাল বিশাল পাথরের বাঁধা মাড়িয়ে বিপুল বিক্রমে বয়ে চলেছে প্রচন্ড খরস্রোতা সিন্ধু নদ। তার গর্জন দু’ধারে পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে বজ্রপাতের মত শোনায়। ধুসর পাহাড়ের কোলে মাঝে মাঝে দেখা যায় সবুজের ঢালু আস্তরণ। তাতে থরে থরে সাজানো গমের ক্ষেত আর কয়েকটি বাড়ি। ঝুলন্ত ব্রীজ দিয়ে এপার-ওপার যাতায়াতের ব্যবস্থা। বড় কঠিন এদের জীবন যাত্রা। স্বাভাবিক জনসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের মত রাজ্যে তাদের অবস্থান। যেখানে রাত-দিন হামেশা শোনা যায় নদীর গর্জন। চোখ মেললেই নিশ্চল সুউচ্চ ধুসর পাহাড়ের সারি আর এক চিলতে নীলাকাশ। এদের জীবনে কি রয়েছে কোন বৈচিত্র্য! রয়েছে কি স্বপ্নের ঝিলিক! নাকি এখানকার বর্ণহীন পর্বতমালার মতই একঘেয়ে আর গৎবাধা! বড় জানতে ইচ্ছা করে।

গাড়ি এগিয়ে চলে। আমি সামনের সীটে বসে প্রকৃতির বৈচিত্র্য প্রাণভরে উপভোগ করি। কখনও পাহাড়ের মধ্যে খন্দক সৃষ্টি করে এমনভাবে পাহাড়ের তলদেশ দিয়ে রাস্তা বানানো হয়েছে যে, হিমাদ্রীসম পাহাড়কে ভয়ংকরভাবে মাথার উপর কালো ছাতার মত ঝুলতে দেখা যায়। মনে হয় এই বুঝি পাহাড় টুপ করে খসে পড়ে বাস সমেত আমাদের ভূতল সমাধি ঘটাবে। কখনও দেখা যায় মেইন রোড থেকে ঝুলন্ত সাঁকো সিন্ধু নদ পেরিয়ে ওপারের ছোট্ট গ্রামে মিলেছে। কোন কোনটা বেশ চওড়া। ছোট ছোট পিকআপ অনায়াসে অতিক্রম করছে। মাঝে মাঝে পাহাড়ের গায়ে দেখা যায় ফসলের ক্ষেত কিংবা তৃণের খোঁজে চরে বেড়ানো লম্বা শিংওয়ালা ছাগপাল।

রোমাঞ্জে ভরা এই সুদীর্ঘ পার্বত্য পথ অতিক্রম করে আমরা যখন স্কার্ডু শহরের নিকটবর্তী হই তখন রাত প্রায় আটটা বেজে গেছে। দূর থেকে শহরের আলো ফুটে ওঠে। সেই আলোয় নযরে আসে বিখ্যাত শাংগ্রীলা লেক। এই শান্ত সমাহিত সুউচ্চ পর্বতবেষ্টিত মনোহারী লেকটি কেন্দ্র করে শাংগ্রীলা রিসোর্ট গড়ে উঠেছে, যেটি এখন বিশ্বব্যাপী সুপ্রসিদ্ধ। পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং বিদেশী অতিথিদের অন্যতম প্রধান গন্তব্য হ’ল এই লেক। শহরে ঢুকে কলেজ রোডে অবস্থিত নির্ধারিত হোটেলে পৌঁছে গেলাম। দীর্ঘ জার্নিতে সবাই ক্লান্ত। খাওয়া-দাওয়া সেরেই যার যার কক্ষে ঘুমিয়ে গেলাম।

স্কার্ডু শহর :



২০ আগস্ট’১৬ সকালে ঘুম থেকে উঠে হোটেলের ব্যালকনি থেকে আবিষ্কার করি ধুসর সুউচ্চ পাহাড় ঘেরা সবুজ স্কার্ডু শহর। টুকরো সোনালী মেঘে ছাওয়া নিলাকাশ। নতুন দিনের উদ্ভাসকালে বড় ভাল লাগে। নতুন এক শহরে নতুন এক সকাল। প্রতিটি দিন যদি এমন স্নিগ্ধ বিস্ময়ের হ’ত! সফেন অনুভূতির ওড়াওড়িতে জীবনের রংগুলো সুখের কোমল রেনু ছড়াতো! রঙ্গিন কল্পনার জগতে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আবার রুমে ফিরে আসি। সহযাত্রীরা ক্লান্ত। ওদের ঘুম শেষ হয় না। ওদিকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আজ এসেছেন বলে শাংগ্রীলা লেক এলাকা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সকালে সেখানে যাওয়ার কথা ছিল আমাদের। সেটা বাতিল হওয়ায় নাস্তার পর মূল শহরের প্রাণকেন্দ্র শহীদী চত্বর এলাকা ঘুরে দেখলাম কিছুক্ষণ। কিছু ড্রাই ফ্রুটস তথা কাজু বাদাম, আখরোট প্রভৃতি কেনাকাটাও হ’ল। ছেলেরা অনেকে ট্রাডিশনাল পোষাক কিনল। পর্যটন শহর হওয়ার সবকিছুর দাম বেশী।  

একবার ভেবেছিলাম গিলগিত-বালতিস্তানের একমাত্র আহলেহাদীছ মারকাযটি দেখে আসব। শহর থেকে দূরত্ব প্রায় চল্লিশ কি.মি.। জামেআ ইসলামিয়া নামে পরিচিত এই মাদরাসার কারণে এ অঞ্চলে বিগত প্রায় শতাধিক বছর ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ শী‘আদের বিপরীতে তাওহীদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। এ অঞ্চলে এখন সুন্নীদের মধ্যে আহলেহাদীছরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে জানা গেল। শায়খ বিন বাযের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় প্রাচীন এই মাদরাসাটি থেকে বহুসংখ্যক ছাত্র মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছে। পাকিস্তানের আহলেহাদীছদের মধ্যে এই মাদরাসাটির রয়েছে যথেষ্ট সুনাম। এখান থেকে ফারেগ হওয়া শিক্ষকরা পাকিস্তানের নানা প্রান্তে আহলেহাদীছ মাদরাসাগুলো খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছেন। করাচী, ইসলামাবাদ ও রাওয়ালপিন্ডিতে এই মারকাযের অনেক ছাত্র ও শিক্ষকের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের অনুষদেই বেশ কয়েকজন পরিচিত শিক্ষক ও ছাত্র ছিল এই মাদরাসার। দূরত্বের কথা ভেবে সেখানে আর যাওয়া হ’ল না।

দেওসাই প্লেইন :



রুমে ফিরেই প্রস্ত্ততি শুরু হ’ল পরবর্তী গন্তব্যের জন্য। বেলা ১১টার দিকে ফোর হুইলার জীপ আমাদের নিয়ে রওয়ানা হয় বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত সমতল (High-altitude alpine plain) দেওসাই উদ্যানের উদ্দেশ্যে। দেওসাই অর্থ দৈত্যদের ভূমি। স্কার্দু শহর থেকে প্রায় ৩০ কি. মি. দূরত্বে অবস্থিত এই মালভূমির গড় উচ্চতা ৪১১৪ মিটার। আয়তন তিন হাজার বর্গকিলোমিটার। এই মালভূমির একটি বড় অঞ্চল জুড়ে সরকারীভাবে উদ্যান গড়ে তোলা হয়েছে বিশেষ করে বাদামী ভল্লুক সংরক্ষণের জন্য। বছরের অধিকাংশ সময়ই বরফে ঢাকা থাকে এই মালভুমি। কেবল গ্রীষ্মকালের কয়েকটি মাস উপযুক্ত থাকে ভ্রমণের জন্য। পুরো মালভূমিতে কোন উঁচু গাছ নেই। কেবলই সমতল ভূখন্ড। অনুচ্চ ঢেউ খেলানো নিরাভরণ পাহাড় আর অদ্ভুত সুন্দর লাল-হলুদ বর্ণের বুনো ফুলের সমারোহ চারিদিকে। পাহাড়গুলোর ঢালে সবুজ ঘাসের আস্তরণ চোখে-মুখে সজীবতার পরশ বুলিয়ে দেয়।

ঝপথে আমরা একজায়গায় থেমে পার্সেল করে নিয়ে আসা দুপুরের খাবার খাই। তীব্র বাতাসে স্থির থাকা দায়। উজ্জ্বল রোদের মাঝেও শরীরে সূঁচ ফোটানোর মত ঠান্ডা সে বাতাস। পীঠ দিয়ে আড়াল করে খাবার প্লেটের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখি। খাবার শেষে ফের যাত্রা শুরু হয়। পথে বাড়াপানি নামে একটি নদী পড়ে। বরফ ঠান্ডা স্বচ্ছ-টলটলে নদীর পানি। এই সুউচ্চ পর্বত সমতলে এসে নদীও দেখতে পাব! আর কত যে বিস্ময় অপেক্ষা করছে এ জগতে! সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি। ব্রীজের পার্শ্বে নদীর উপর কয়েকটি তার পাশাপাশি ঝুলানো। আমাদের সাহসী কয়েকজন সেই তার বেয়ে নদী অতিক্রম করে বীরত্ব দেখায়। পার্শ্বেই সাইনবোর্ডে লেখা ‘বাদামী ভল্লুকের আবাসস্থল’। আমরা দূর পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত গভীর নিরিখে দেখি। কোথাও কোন ভল্লুকের আভাস পেলাম না। সাধারণতঃ ফজরের সময় এবং শেষ বিকেলে নাকি দেখা যায়।স্কার্ডু শহর থেকে দক্ষিণের দিকে প্রায় এক ঘন্টা গেলেই দেওসাই প্লেইন শুরু। পথে কিছু দূর এগুতে চোখে পড়ে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সাদপাড়া লেক। এই লেকই স্কার্ডু শহরের মূল পানির জোগানদাতা। খাঁজকাটা পাহাড়ের সারির গায়ে গায়ে এর নীল-সবুজাভ পানির নিঃশব্দ ছোয়া রীতিমত সম্মোহিত করে তোলে। ফটোসেশনের পর আমরা আবার ফোর হুইলারে চড়ি। গন্তব্যস্থানের নিকটবর্তী হ’তে রাস্ত্তা উঁচু হ’তে থাকে। এক পর্যায়ে অনেকটা জানান না দিয়েই হঠাৎ দেওসাই প্লেইন শুরু হয়। দৃষ্টিসীমা যতদূর যায় কেবলই সমতল ভূমি। মূল ভূখন্ড থেকে সাড়ে তের হাজার ফুট উচ্চতায় এমন সরল সমতল ভূমি স্বচক্ষে না দেখেও বিশ্বাস করার মত নয়। আল্লাহর সৃষ্টির এই অপার বৈচিত্র্য আর তুলনারহিত রূপসম্ভার অকল্পনীয় লাগে। সুবহানাল্লাহ। মাইলের পর মাইল ইষৎ চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে গাড়ি চলতে থাকে। কোথাও কোন জনবসতি, গাছ-পালা নেই। বহু দূরের দৃশ্যপটও সুস্পষ্টভাবে নজরে আসে। মনে হয় দিগন্তপ্রান্তে যেখানে গিয়ে ভূখন্ড শেষ হয়েছে, সেখানে গিয়ে দাঁড়ালে বোধহয় কেউ ঝুপ করে নীচে গড়িয়ে পড়বে। পৃথিবীর ছাদ তো আর এমনিই বলা হয় না।

আবারও গাড়ী ছুটে চলে পৃথিবীর ছাদের বুক চিরে। সীমানাহীন তেপান্তরের মাঠ আর লাল-নীল বুনো ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে মন মাঝারে জমে থাকা কত কথাই না বাষ্প হয়ে উড়তে চায়। কবিতার ছন্দে, সুরের লহরীতে কিংবা সরল গদ্যে সেসব অনুভূতির প্রকাশ ঘটাতে গিয়েও আবার ক্ষান্তি দিতে হয়। অনুমান করি এই অপার্থিব জগতের সৌন্দর্য ধারণ করার মত প্রকাশভঙ্গি আমার আয়ত্বে নেই। স্বয়ং কবিরাও যে রাজ্যে নিরব, সে রাজ্যে আম আদমী হিসাবে কেবল নিঃশব্দ রুহানী উপভোগ করে যাওয়াই বেহতর। অতি উৎসাহীরা অবশ্য কেউ ইক্ববালের পংক্তি আওড়ায়.. সারা জাহা সে আচ্ছা পাকিস্তান হামারা...। কেউবা ধরে পাক সার যমীন সাদ বাদ...।

প্রায় ২ঘন্টা যাত্রার পর আমরা শান্ত সুনীল পানির শোসার লেকে এসে উপনীত হই। চার হাজার মিটার উচ্চতায় এই বিশাল লেক প্রকৃতির আরেক অপরূপ বিস্ময়। অনুচ্চ পাহাড় ঘেরা এই গভীর নীলাভ লেকের চারিপার্শ্বে লাল-সাদার মিশ্রণে কাশফুলের মত ছেয়ে যাওয়া ফুলের সমাহার কেবলই রোমান্সের হাতছানি জাগায়। মেরি যিন্দেগী মে বাস এক কিতাব হ্যাঁয়, এক চেরাগ হ্যাঁয়, এক খাওয়াব হ্যাঁয়.. আওর তুম হো এ কিতাব ওয়া খাওয়াব কি দারমিয়ান জো মানযিলি হ্যাঁয়...।

আমরা আবার এগিয়ে চলি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলে যেভাবে হঠাৎ প্রবেশ করেছিলাম ঠিক সেভাবে হঠাৎই বেরিয়ে এলাম দেওসাই প্লেইন থেকে। চিলাম নামে ছোট্ট একটি লোকালয়ে এসে জীপ এসে থামে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িগুলোকে সকালেই স্কার্ডু থেকে এ্যাস্টোর ভ্যালি হয়ে দীর্ঘ চিলামের দিকে আসতে বলা হয়েছিল। কিন্তু এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে গাড়ীগুলো সময়মত আসতে পারল না। আমরা ভুখা অবস্থায় প্রায় রাত ৯টা পর্যন্ত লোকালয়ের এক ছোট্ট সেমি-সরাইখানায় অপেক্ষা করতে লাগলাম। ঠান্ডার প্রকোপে আর দীর্ঘ সফরের ক্লান্তিতে অনেকে বেশ কাহিল হয়ে পড়ল। যদিও এর মাঝে কেউ শায়েরীর আসর বসালো। আমার সাথে ৮/১০ জন জুটলো যারা বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে খুব আগ্রহী। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, আবহাওয়া, মানুষ, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে থাকল। কম্বল মুড়ি দিয়ে চা পান করতে করতে তাদের সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকি। সময়টা খুব খারাপ কাটলো না।

শোসার লেক



গাড়ী এসে পৌঁছানোর পর আমরা এ্যাস্টোর ভ্যালির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। রাত প্রায় ১টার দিকে ভ্যালিতে পৌঁছলাম। সে রাতে এক হোটেলে বিশ্রাম নিয়ে পরদিন ২১শে আগস্ট সকালে রওয়ানা হলাম চিলাসের উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে সারাদিন পথ চলার পর বাবুসার পাস অতিক্রম করে পৌঁছলাম নারান ভ্যালিতে। রাত তখন ৯টা। সন্ধ্যার পর পথে বৃষ্টির কারণে বেশ কয়েকবার ল্যান্ডসলাইডের সম্মুখীন হলাম। আমাদের গাড়ির সামান্য আগে রাস্তার ওপর পাহাড় থেকে একবার বড় পাথরের স্ত্তপ এসে গড়িয়ে পড়ল। দারুন ভয় পেয়ে গেলাম। শেষতক আলহামুদুলিল্লাহ নিরাপদেই পৌঁলাম নারানে। হোটেলে এসে রাতের খাবার খেয়েই সবাই বিশ্রামে চলে গেল।

ক্লান্ত মুসাফিরের ঘরে ফেরা :

পরদিন ২২শে আগস্ট সকালে উঠে রূপকথার সেই ‘সয়ফুল মুলক’ ঝিল পরিদর্শনে গেলাম। ২০১৪ সালের ২২শে জুন একবার এসেছিলাম এই ঝিল পরিদর্শনে। সেবার অনেক ঠান্ডা এবং বরফাবৃত ছিল এই লেক। পরিবেশটাও ছিল অসাধারণ। প্রথম আলো পত্রিকায় সেই সফর নিয়ে একটা লেখাও পাঠিয়েছিলাম, যা প্রকাশিত হয়েছিল। তবে এবার আগস্ট মাস হওয়ায় বরফের আধিপত্য কিছুটা কম। আবহাওয়াও বেশ ম্যাড়মেড়ে। তবুও সবুজাভ পানি যথারীতি স্বপ্নাতুর করে তোলে। রূপকথার রাজ্যে টেনে নিয়ে যায় এক নিমিষে। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা এবার ফিরতি গন্তব্যের পথে রওয়ানা হই। নারান-কাগান ভ্যালির উন্মত্ত পাহাড়ী সৌন্দর্য দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। বালাকোটে এসে মাগরিবের ছালাত আদায় করি। তারপর সেখান থেকে ইসলামাবাদ ফিরতে রাত ১২টা বেজে যায়। এভাবেই শেষ হয় জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও দীর্ঘতম সফরটি। সন্দেহ নেই যিন্দেগী যতদিন রবে, গিলগিত-বালতিস্তানের খাঁজে খাঁজে অবলোকন করা মহান স্রষ্টার সৃষ্টির অপরূপ ঐ রূপসম্ভার সহসাই কখনো কখনো অমীয় সুধা হয়ে পরিতৃপ্তি যুগিয়ে যাবে। হয়ত নাতি-নাতনিদের সাথে গল্প বলার ক্ষণে কোন আশীতিপর বৃদ্ধের স্বপ্নঝিলিক হয়ে আলো ছড়াবে। সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি  






বিষয়সমূহ: ভ্রমণস্মৃতি
আরও