ইসলাম শাশ্বত জীবন ব্যবস্থা
মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ
ফাহিমুল ইসলাম 11032 বার পঠিত
পৃথিবীতে তারাই সবচাইতে উৎকৃষ্ট ব্যক্তি, যারা দ্বীনী ইলম অর্জন করে তা মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেয় এবং নিজে সে অনুযায়ী আমল করে। ফেরেশতারা তাদের পায়ের নীচে ডানা বিছিয়ে দেয়, আল্লাহর সৃষ্টি জীব সমূহ তাদের কল্যাণের দু‘আ করতে থাকে। আল্লাহ যাদের পর্যাপ্ত কল্যাণ দান করেন, কেবলমাত্র তাদেরকেই এ জ্ঞানার্জনের তাওফীক প্রদান করে থাকেন। তবে দ্বীনী জ্ঞান অন্বেষণে কিছু বিষয়ের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা আবশ্যক। নিম্নে সে বিষয়ে আলোকপাত করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
বাহাদুরি, ঝগড়া ও বড়ত্ব প্রকাশ :
জ্ঞানার্জনের
উদ্দেশ্য বাহাদুরি, ঝগড়া অথবা বড়ত্ব প্রকাশ হওয়া যাবে না। ‘জাবির বিন
আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ‘তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, لاَ تَعَلَّمُوا
الْعِلْمَ لِتُبَاهُوا بِهِ الْعُلَمَاءَ وَلاَ لِتُمَارُوا بِهِ
السُّفَهَاءَ وَلاَ تَخَيَّرُوا بِهِ الْمَجَالِسَ فَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ
فَالنَّارُ النَّارُ ‘তোমরা আলেমদের উপর বাহাদুরি প্রকাশের জন্য,
নির্বোধদের সাথে ঝগড়া করার জন্য এবং জনসভার উপরে বড়ত্ব প্রকাশের জন্য
ধর্মীয় জ্ঞানার্জন করোনা। যে ব্যাক্তি এরুপ করবে ,তার জন্য রয়েছে আগুন আর
আগুন’।[1]
অপর হাদীছে এসেছে, ‘ইবনু উমর (রাঃ)
হ‘তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ لِيُمَارِىَ
بِهِ السُّفَهَاءَ أَوْ لِيُبَاهِىَ بِهِ الْعُلَمَاءَ أَوْ لِيَصْرِفَ
وُجُوهَ النَّاسِ إِلَيْهِ فَهُوَ فِى النَّارِ ‘যে ব্যাক্তি নির্বোধের
সাথে ঝগড়া করার জন্য অথবা আলেমদের উপরে বাহাদুরী প্রকাশের জন্য অথবা তার
প্রতি জন-সাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য জ্ঞানার্জন করে সে জাহান্নামী’।[2]
অপর হাদীছে পাওয়া যায়, ‘কা‘ব বিন মালিক (রাঃ) হ‘তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলূল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ لِيُجَارِىَ بِهِ الْعُلَمَاءَ أَوْ لِيُمَارِىَ بِهِ السُّفَهَاءَ أَوْ يَصْرِفَ بِهِ وُجُوهَ النَّاسِ إِلَيْهِ أَدْخَلَهُ اللَّهُ النَّار ‘যে লোক আলিমদের সাথে তর্ক-বাহাছ করার অথবা মূর্খদের সাথে বাক-বিতন্ডা করার জন্য এবং মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে ইলম (জ্ঞান) অধ্যয়ন করেছে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন’।[3]
প্রিয় পাঠক! হাদীছগুলো থেকে আরো স্পষ্ট হয় যে, গ্রাম্য মূূর্খ লোকেরা ইসলামের অনেক বিধান নিয়ে তর্ক করে থাকে, তাদেরকে তর্কে হারানোর জন্য বা তাদের সাথে তর্ক করার জন্য জ্ঞানার্জন করা যাবে না। দেশের আলেমদের মাঝে আমাকেই যেন বড় আলেম বলা হয় এজন্য বা এই উদ্দেশ্য নিয়ে জ্ঞানার্জন করা যাবে না। এমন কি সাধারণ মানুষেরা অন্য আলেমদের তুলনায় আমাকেই সবচাইতে বেশী পসন্দ করবে এবং বেশী বেশী তাদের মাঝে বা খেদমতে ডাকবে, বড় মাওলানা বলে দেশের সর্বস্তরের মানুষ আমাকেই সম্মান করবে এমন সব উদ্দেশ্য নিয়ে জ্ঞানার্জন করা নিষিদ্ধ। আর এমন দুষ্ট উদ্দেশ্যের কারণে উক্ত জ্ঞানী হবে জাহান্নামী।
পার্থিব স্বার্থ সিদ্ধি :
অনেকেই জ্ঞানার্জন করে থাকে দুনিয়া লাভের আশায়। দুনিয়ার ক্ষমতা, অর্থ সম্পদ, সম্মান ইত্যাদি পাওয়ার জন্য। মূলত জ্ঞানার্জন করতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে। অথচ অধিকাংশ জ্ঞান অন্বেষণকারী এ ব্যপারে গাফেল। জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যই যেন দুনিয়ার চাকরী, বাড়ি, গাড়ি ইত্যাদি হাছিল করাই যেন লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيهَا وَهُمْ فِيهَا لَا يُبْخَسُونَ أُولَئِكَ الَّذِينَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الْآخِرَةِ إِلَّا النَّارُ وَحَبِطَ مَا صَنَعُوا فِيهَا وَبَاطِلٌ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ‘যে কেউ পার্থিব জীবন ও তার শোভা কামনা করে, দুনিয়ায় আমি তাদের কর্মের পূর্ণফল দান করি এবং সেখানে তাদেরকে কম দেওয়া হইবে না। তাদের জন্য আখিরাতে দোযখ ব্যতীত অন্য কিছুই নাই এবং উহা যা করে আখিরাতে তারা নিস্ফল হবে এবং তারা যা করিয়া থাকে তাহা নিরর্থক’ (হূদ-১৫/১৬ )।
প্রিয় পাঠক! ভেবে দেখেছেন কি? অত্র আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তা‘আলা কি বলতে চেয়েছেন? অতএব আমাদের জ্ঞানার্জন করাটা আল্লাহর জন্য হতে হবে, দুনিয়া লাভের জন্য হওয়া একেবারেই ঠিক হবে না।
আপনি এবার বলতে পারেন যে, শুধু আল্লাহকে
খুশী করার জন্য এবং পরকালের জন্য জ্ঞানার্জন করবো তো দুনিয়া কিভাবে
অতিবাহিত করবো? দুনিয়ায় চলতে গেলে তো সম্পদ, সম্মান সব কিছুরই প্রয়োজন
রয়েছে। এ কথার জবাবে বলা যেতে পারে, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে
জ্ঞানার্জন করলে তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট হয়ে যাবেন। শুধু তাই নয়,
আল্লাহই তখন খুশী হয়ে তাকে দুনিয়াবী অনেক কিছু দিয়ে দিবেন। এ সম্পর্কে
হাদীছে এসেছে, ‘আব্দুলাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) হ‘তে বর্ণিত, তিনি বলেন, لَوْ
أَن أَهْلَ الْعِلْمِ صَانُوا الْعِلْمَ وَوَضَعُوهُ عِنْدَ أَهْلِهِ
لَسَادُوا بِهِ أَهْلَ زَمَانِهِمْ وَلَكِنَّهُمْ بَذَلُوهُ لأَهْلِ
الدُّنْيَا لِيَنَالُوا بِهِ مِنْ دُنْيَاهُمْ فَهَانُوا عَلَيْهِمْ
سَمِعْتُ نَبِيَّكُمْ -صلى الله عليه وسلم- يَقُولُ مَنْ جَعَلَ
الْهُمُومَ هَمًّا وَاحِدًا هَمَّ آخِرَتِهِ كَفَاهُ اللَّهُ هَمَّ
دُنْيَاهُ وَمَنْ تَشَعَّبَتْ بِهِ الْهُمُومُ فِى أَحْوَالِ الدُّنْيَا
لَمْ يُبَالِ اللَّهُ فِى أَىِّ أَوْدِيَتِهَا هَلَكَ ‘আলেমরা যদি
জ্ঞানার্জনের পর তা সংরক্ষণ করে এবং তা যোগ্য আলেমদের সামনে রেখে দেয়,
তাহলে অবশ্যই তারা নিজ যুগের জনগণের নেতৃত্ব দিবে। কিন্ত তারা তা
দুনিয়াদারদের নিকট পেশ করেছে পাথিব স্বার্থ লাভের জন্য। ফলে তারা তাদের
নিকট হেয় প্রতিপন্ন হয়েছে। আমি তোমাদের নবী করীম (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, যে
ব্যক্তি তার সমস্ত চিন্তাকে একই চিন্তায় অর্থাৎ আখিরাতের চিন্তায়
কেন্দ্রীভূত করেছে, আল্লাহ তার দুনিয়ার চিন্তার জন্য যথেষ্ট, অপর দিকে যে
ব্যক্তি যাবতীয় পার্থিব চিন্তায় নিমগ্ন থাকবে, সে যে উন্মুক্ত মাঠে ধ্বংস
হোক তাতে আল্লাহর কিছুই আসে যায় না’।[4]
অপর
হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হ‘তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ)
বলেছেন, مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَى بِهِ وَجْهُ اللَّهِ لاَ
يَتَعَلَّمُهُ إِلاَّ لِيُصِيبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدْ
عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَعْنِى رِيحَهَ ‘যে জ্ঞান দ্বারা
আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষণ করা হয়, যদি কেউ সেই জ্ঞান পার্থিব স্বার্থ
সিদ্ধির জন্য শিক্ষা করে, তাহলে সে ক্বিয়ামতের দিন জান্নাতের সুবাসও পাবে
না’।[5]
একদা লোকজন যখন আবু হুরায়রাহ (রাঃ)-এর নিকট থেকে বিদায় নিচ্ছিল, তখন সিরিয়া অধিবাসী নাতিল (রহঃ) বলেন, হে শায়খ! আপনি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট থেকে শুনেছেন এমন একটি হাদীছ আমাদেরকে শুনান। তিনি বলেন, হ্যাঁ। আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ক্বিয়ামতের দিন সর্ব প্রথম যার বিচার করা হবে সে হচ্ছে- এমন একজন ব্যক্তিকে যিনি শহীদ। তাকে উপস্থিত করা হবে এবং আল্লাহ তার নি‘আমতরাজীর কথা তাকে বলবে সে তার সবটাই চিনতে পারবে (যথারীতি তার স্বীকারোক্তিও করবে)। তখন আল্লাহ বলবেন, এর বিনিময়ে কি আমল করেছিলে? সে বলবে, আমি তোমারই পথে যুদ্ধ করেছি, এমনকি শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি তখন আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো, বরং তুমি এজন্যই যুদ্ধ করেছিলে, যাতে লোকে তোমাকে বলে তুমি বীর, তা বলা হয়েছে। অতঃপর, নির্দেশ মোতাবেক তাকে উপুড় করে হেঁচড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’।
অতঃপর এমন এক ব্যক্তির বিচার করা হবে যে জ্ঞানার্জন ও তা বিতরণ করেছে এবং কুরআন অধ্যয়ন করেছে। তাকে হাযির করে আল্লাহ তাঁর প্রদত্ত নে‘মত সমেূহের কথা বলবেন এবং সে তা চিনতে পারবে (যথারীতি তার স্বীকারোক্তিও দিবে) তখন আল্লাহ বলবেন এত বড় নে‘মতের বিনিময়ে তুমি কি করেছো? সে বলবে আমি জ্ঞানার্জন করেছি এবং তা শিক্ষা দিয়েছি ও কুরআন অধ্যয়ন করেছি তোমারই সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো তুমি তো জ্ঞানার্জন করেছিলে এজন্য যে লোক তোমাকে জ্ঞানী বলে। কুরআন অধ্যয়ন করেছিলে এজন্য যে যাতে লোকে বলে তুমি একজন ক্বারী, তা তো বলা হয়েছে অতঃপর নির্দেশ মোতাবেক তাকেও উপুড় করে হেঁচড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
অতঃপর এমন এক ব্যক্তির বিচার হবে, যাকে
আল্লাহ স্বচ্ছলতা এবং সার্বিক বিত্ত-বৈভব দান করেছেন, তাকে প্রদত্ত
নে‘মতরাজির কথা বলবেন। সে তা চিনতে পারবে (স্বীকারোক্তিও দিবে) তখন
আল্লাহ বলবেন, এসব নে‘মতের বিনিময়ে তুমি কি আমল করেছো? সে বলবে, সম্পদ
ব্যয়ের এমন কোন খাত নেই যাতে সম্পদ ব্যয় করা তুমি পসন্দ কর আমি সে খাতে
তোমার সন্তুষ্টির জন্য ব্যয় করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো। বরং
তুমি এজন্য তা করেছিলে যাতে লোকে তোমাকে দানবীর বলে অভিহিত করে, আর তা বলা
হয়েছে। তারপর নির্দেশ মোতাবেক তাকেও উপুড় করে হেঁচড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে এবং
জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।[6]
প্রিয় পাঠক! হাদীছগুলো হতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে দুনিয়া লাভের আশায় বা দুনিয়ার কোন কিছু পাওয়ার আশায় জ্ঞার্নাজন করলে সে জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না। পক্ষান্তরে আল্লাহর জন্য জ্ঞার্নাজন করলে আল্লাহর পক্ষ হতে তাকে উভয়কালে সফলতা প্রদান করা হবে। তাই সবাইকে জ্ঞার্নাজন করতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
ইল্ম বা জ্ঞান গোপন করা :
বর্তমান সময়ের আলেম সমাজে সবচাইতে বড় সমস্যা ইল্ম বা জ্ঞান গোপন করা অর্থাৎ জানা বিষয় অন্যের কাছে গোপন রাখা। তবে আলেম সমাজের অনেকেই বিভিন্ন কারণে জ্ঞান গোপন করে যাচ্ছে কারো চাপে, ভয়ে, ফেৎনা অথবা নিজ স্বার্থ রক্ষার্থে আবার কেউ নিজ নেতৃত্ব রক্ষার্থে বা মাযহাব ও দলের স্বার্থে। মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ مِنَ الْكِتَابِ وَيَشْتَرُونَ بِهِ ثَمَنًا قَلِيلًا أُولَئِكَ مَا يَأْكُلُونَ فِي بُطُونِهِمْ إِلَّا النَّارَ وَلَا يُكَلِّمُهُمُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَا يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ- أُولَئِكَ الَّذِينَ اشْتَرَوُا الضَّلَالَةَ بِالْهُدَى وَالْعَذَابَ بِالْمَغْفِرَةِ فَمَا أَصْبَرَهُمْ عَلَى النَّارِ ‘আল্লাহ যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, যারা তা গোপন রাখে ও বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করে তারা নিজেদের পেটে আগুন ব্যতীত আর কিছুই ভরেনা। ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না এবং তাদেরকে পবিত্র করবেন না। তাদের জন্য আছে কষ্টদায়ক শাস্তি। তারাই সৎপথে বিনিময়ে ভ্রান্ত পথ এবং ক্ষমার পরিবর্তে শাস্তি ক্রয় করেছে আগুন সহ্য করতে তারা কতই না ধৈর্যশীল’ (বাক্বারাহ ২/৭৪-৭৫)।
মহানবী মুহাম্মাদ (ছঃ) তাঁর ছাহাবীদেরকে এসম্পর্কে সাবধান করে গিয়েছেন। হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হ‘তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ سُئِلَ عَنْ عِلْمٍ عَلِمَهُ ثُمَّ كَتَمَهُ أُلْجِمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِلِجَامٍ مِنْ نَارٍ ‘যে লোক এমন ইলম (জ্ঞান) সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়, যা সে জানে, অতঃপর সে তা গোপন করে, তাকে ক্বিয়ামতের দিন আগুনের লাগাম পরানো হবে’।[7]
অন্য হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ)
হ‘তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, مَا مِنْ رَجُلٍ يَحْفَظُ عِلْمًا
فَيَكْتُمُهُ إِلاَّ أُتِىَ بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مُلْجَمًا بِلِجَامٍ
مِنَ النَّار ‘কোন ব্যক্তি (দ্বীনের) জ্ঞানের কথা শিক্ষা করার পর তা গোপন
করে রাখলে ক্বিয়ামতের দিন তাকে আগুনের লাগাম পরানো অবস্থায় উপস্থিত করা
হবে’। [8]
প্রিয় পাঠক! উক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় সে জ্ঞান গোপন করা যাবে না। কিন্তু বর্তমানে আলেম (জ্ঞানী) সমাজ কোন বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হলে, সঠিক উত্তর প্রদান না করে মনগড়া কিছু কথার মাধ্যমে উত্তর প্রদান করে। মনগড়া কথার মাধ্যমে জবাব দিতে গিয়ে অগণিত আয়াত ও হাদীছকে গোপন করে যাচ্ছে। কেননা উক্ত আলেমরা স্পষ্ট আয়াত ও হাদীছকে গোপন না করলে ঝোলার বিড়াল বের হয়ে পড়বে এবং নিজের মান ঠিক থাকবে না। কিন্ত শত সমস্যা থাকলেও জ্ঞান গোপন করার মত জঘন্য কাজ হতে বেঁচে থাকা অতীব যরূরী।
মনগড়া ফৎওয়া প্রদান করা :
মুসলিম সমাজের কল্যানার্থে ফৎওয়া প্রদান করতে হবে। কিন্ত সকলেই ফৎওয়া প্রদান করতে পারবে না। কেবলমাত্র জ্ঞানী ও যোগ্য আলেমরাই এ কাজের দায়িত্ব পালন করবেন। তবে ফৎওয়া প্রদানে নিজ মতামতকে উপেক্ষা করে কেবলমাত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মাধ্যামে সমাধান দিতে হবে। বর্তমানে কিছু আলেম ফৎওয়া প্রদান করে যাচ্ছেন মনগড়া ভাবে নিজ দল, মত, সম্মান ইত্যাদি রক্ষার্থে, যা একেবারেই ঠিক নয়। জ্ঞানার্জনকারীরা যেহেতু আগামী দিনের আলেম সমাজ, তাই তাঁদেরকে উক্ত বিষয়ে সতর্ক থাকা আবশ্যক। মহান আল্লাহ বলেন, فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ بِالْبَيِّنَاتِ وَالزُّبُرِ ‘তোমরা যদি না জান তাহলে জ্ঞানীগণকে জিজ্ঞাসা কর (জেনে নাও) স্পষ্ট ভাবে দলীল- প্রমাণসহ’ (নাহল ১৬/৪৩-৪৪)।
সালাফে ছালেহীন ও তাবেঈদের জীবনের দিকে লক্ষ্য করলে জানা যায় তাঁরা কোন বিষয় না জানলে সরাসরি বলে দিতেন আমি জানি না। রাসূল (ছাঃ) এ বিষয়ে ভবিষৎদ্বাণী উচ্চারণ করেছেন।
হাদীছে
এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস (রাঃ) হ‘তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ اللَّهَ لاَ يَقْبِضُ الْعِلْمَ انْتِزَاعًا
يَنْتَزِعُهُ مِنَ النَّاسِ وَلَكِنْ يَقْبِضُ الْعِلْمَ بِقَبْضِ
الْعُلَمَاءِ حَتَّى إِذَا لَمْ يَتْرُكْ عَالِمًا اتَّخَذَ النَّاسُ
رُءُوسًا جُهَّالاً فَسُئِلُوا فَأَفْتَوْا بِغَيْرِ عِلْمٍ فَضَلُّوا
وَأَضَلُّوا ‘(শেষ যামানায়) আল্লাহ মানুষের নিকট হতে একটানে ইলম (জ্ঞান)
উঠিয়ে নিবেন না, বরং আলেমদেরকে উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমেই ইলম (জ্ঞান) উঠিয়ে
নিবেন। অবশেষে যখন কোন আলেমই অবশিষ্ট রাখবেন না, তখন মানুষেরা অজ্ঞ
জাহেলদেরকে নেতা হিসাবে গ্রহণ করবে অতপর, তাদের নিকটে বিভিন্ন বিষয়ে
প্রশ্ন করা হবে, আর তারা (নেতারা) ইলম ছাড়াই ফৎওয়া দিবে। ফলে তারা নিজেরাও
পথভ্রষ্ট হবে এবং অন্যকেও পথভ্রষ্ট করবে। [9]
যে জ্ঞান অর্জন করা উচিৎ :
জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উপকারী জ্ঞানার্জনের বিষয়ে খেয়াল রাখা দরকার। যে জ্ঞান দ্বারা উভয়কালে উপকার এবং মুক্তি লাভ করা যাবে ঠিক সেই জ্ঞানটাই অর্জন করতে হবে। আর উপকারী ও কল্যাণকর জ্ঞান লাভের জন্য মহান আল্লাহর বিশেষ সাহায্য কামনা করতে হবে। কেননা মহানবী (ছাঃ) নিজেও উপকারী জ্ঞানের জন্য প্রতিপালকের দরবারে প্রার্থনা বা দো‘আ করেছেন।
হাদীছে এসেছে, আবু
হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন,كَانَ مِنْ دُعَاءِ النَّبِىِّ صلى
الله عليه وسلم اللَّهُمَّ إِنِّى أَعُوذُ بِكَ مِنْ عِلْمٍ لاَ يَنْفَعُ
وَمِنْ دُعَاءٍ لاَ يُسْمَعُ وَمَنْ قَلْبٍ لاَ يَخْشَعُ وَمِنْ نَفْسٍ لاَ
تَشْبَع ‘নবী (ছাঃ)-এর একটি দো‘আ এই যে, হে আল্লাহ! আমি সেই জ্ঞান থেকে
তোমার নিকট আশ্রয় চাই যা কোন উপকারে আসে না এমন দো‘আ থেকে যা শোনা হয় না।
সেই অন্তর থেকে যা ভীত হয় না এবং সেই দেহ থেকে যা তৃপ্ত হয় না’। [10]
অন্য
হাদীছে এসেছে, ‘আবু হুরায়রা (রাঃ) হ‘তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ)
বলতেন, اللَّهُمَّ انْفَعْنِى بِمَا عَلَّمْتَنِى وَعَلِّمْنِى مَا
يَنْفَعُنِى وَزِدْنِى عِلْمًا ‘হে আল্লাহ! তুমি যে
জ্ঞান আমাকে শিখিয়েছ তার দ্বারা আমাকে উপকৃত কর, আমাকে এমন জ্ঞান দান কর যা
আমার উপকারে আসে, আমার জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়ে দাও’। [11] হাদীছে আরো এসেছে,
আব্দুল্লাহ বিন আবু কাতাদাহ তিনি তার পিতা হ‘তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,
রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, خَيْرُ مَا يُخَلِّفُ الرَّجُلُ مِنْ بَعْدِهِ
ثَلاَثٌ وَلَدٌ صَالِحٌ يَدْعُو لَهُ وَصَدَقَةٌ تَجْرِى يَبْلُغُهُ
أَجْرُهَا وَعِلْمٌ يُعْمَلُ بِهِ مِنْ بَعْدِهِ ‘মানুষ তার (মৃত্যুর) পরে
যা কিছু রেখে যায়- তার মধ্যে তিনটি জিনিস কল্যাণ কর সৎকর্ম পরায়ন সন্তান
যে তার জন্য দো‘আ করে, ছাদকায়ে জারিয়া যার ছওয়াব তার কাছে পৌঁছে এবং এমন
জ্ঞান যা তার মৃত্যুর পরও কাজে লাগানো যায়।[12]
হাদীছে এসেছে, ‘উম্মু সালামা (রাঃ) হ‘তে বর্ণিত তিনি বলেন,
أَنَّ النَّبِىَّ -صلى الله عليه وسلم كَانَ يَقُولُ إِذَا صَلَّى
الصُّبْحَ حِينَ يُسَلِّمُ اللَّهُمَّ إِنِّى أَسْأَلُكَ عِلْمًا نَافِعًا
وَرِزْقًا طَيِّبًا وَعَمَلاً مُتَقَبَّلاً ‘নবী করীম (ছাঃ) ফজরের ছালাত
পড়ে সালাম ফিরিয়ে বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে উপকারী জ্ঞান,
পবিত্র রিযিক ও এমন আমল যা কবুল হওয়ার যোগ্য, তা প্রার্থনা করি। [13]
পরিশেষে বলব, জ্ঞান অমূল্য সম্পদ যা ইহকালে ও পরকালে উভয় জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারে অথবা বরবাদ করে দিতে পারে। তাই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই যেন আমরা জ্ঞান অর্জন করতে পারি। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক দান করুন- আমীন!
[1]. ইবনু মাজাহ হা/২৫৪; ছহীহ আত-তারগীব হা/১০২।
[2]. ইবনু মাজাহ হা/২৫৩; তিরমিযী হা/২৬৫৪।
[3]. তিরমিযী হা/২৬৫৪; মিশকাত হা/২২৩-২৫।
[4]. ইবনু মাজাহ হা/২৫৭।
[5]. আবু দাউদ হা/৩৬৬৪; আহমাদ হা/৮২৫২; ইবনু মাজাহ হা/২৫২।
[6]. মুসলিম হ/ ৫০৩২; সিলসিলাতুস ছহীহাহ/ ৩৫১৮।
[7]. তিরমিযী হা/২৬৪৯; ইবনু মাজাহ হা/২৬৪; মিশকাত হা/২২৩৪।
[8]. ইবনু মাজাহ হা/২৬১।
[9]. তিরমিযী হা/ ২৬৫২ ; ইবনু মাজাহ হা/ ৫২; বুখারী হা/ ১০০, ৭৩০৭; মুসলিম হা/ ২৬৭৩।
[10]. ইবনু মাজাহ হা/ ২৫০; নাসাঈ হা/ ৫৫৩৬, ৩৭; আবু দাউদ হা/ ১৫৪৮।
[11]. ইবনু মাজাহ হা/২৫১; তিরমিযী হা/ ৩৫৯৯; মিশকাত হা/৩৪৯৪।
[12]. ইবন মাজাহ হা/২৪১।
[13]. ইবনু মাজাহ হা/২৪১।