কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ঈমানের শাখা
হাফেজ আব্দুল মতীন
আহমাদুল্লাহ 1704 বার পঠিত
ভূমিকা : নবী (ছাঃ) নূরের তৈরী-মর্মে আক্বীদা পোষণকারী ভাইদের পক্ষ হ’তে কতিপয় দলীল পেশ করা হয়ে থাকে। তাদের বক্তব্য হ’ল- মুহাম্মাদ (ছাঃ) মাটির সৃষ্টি হ’তেই পারেন না। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভ্রান্ত আক্বীদা। যার কোন অস্তিত্ব ইসলামে নেই। তারা তাদের দাবীর পক্ষে যে সকল দলীল উপস্থাপন করে থাকে সেগুলি কোনটাই গ্রহণযোগ্য নয়। নিমেণ দলীলগুলির সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা পেশ হ’ল।-
দলীল-১: মহান আল্লাহ বলেন,
قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُبِينٌ ‘তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ হ’তে ‘নূর’ ও ‘স্পষ্ট গ্রন্থ’ এসেছে’ (মায়েদা ৪/১৫)।
জবাব : কুরআনের সব চেয়ে বড় মুফাসসির হ’লেন স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা। তিনি ‘নূর’ শব্দটি দ্বারা কুরআনকে উদ্দেশ্য করেছেন।
(ক) মহান আল্লাহ বলেন,
فَالَّذِينَ آمَنُوا بِهِ وَعَزَّرُوهُ وَنَصَرُوهُ وَاتَّبَعُوا النُّورَ الَّذِي أُنْزِلَ مَعَهُ أُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ-
সুতরাং যে সকল লোক তাঁর উপর ঈমান এনেছে, তাঁর সাহচর্য অবলম্বন করেছে, তাঁকে সাহায্য করেছে এবং সেই নূরের অনুসরণ করেছে যা তাঁর সাথে নাযিল করা হয়েছে। তারাই হ’ল সফলকাম (আরাফ ৭/১৫৭)।
ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী (মৃঃ ৯১১ হিঃ) বলেছেন, (ونصروه) واتبعوا النور الذي أنزل معه أي القرآن ‘তাঁকে সাহায্য করেছে ‘এবং সেই নূরের অনুসরণ করেছে যা তাঁর সাথে নাযিল করা হয়েছে’- অর্থাৎ কুরআন’ (তাফসীরুল জালালাঈন (দারুল হাদীছ (মিছর, ১ম সংস্করণ) পৃঃ ২১৭)।
َ(খ) মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন,
فَآمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَالنُّورِ الَّذِي أَنْزَلْنَا وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ-
‘আর ঈমান আন আল্লাহর উপর, তাঁর রাসূলের প্রতি এবং সেই নূরের প্রতি যা আমি নাযিল করেছি। আর আল্লাহ তা জানেন যা তোমরা করে থাক’ (তাগাবুন ৬৪/৮)।
এখানে নূর দ্বারা কুরআনকে বুঝানো হয়েছে। তার মানে কি এই যে, কুরআনের প্রতিটি হরফ, আয়াত, সূরা, কাগজ বা পাতা নূরের সৃষ্টি? না, এই ধারণা করা যাবে না। বরং কুরআনের প্রতিটি বর্ণ বা হরফ, আয়াত ও সূরা আমাদের জন্য আলোর দিশারী। তাই একে নূর বলা হয়েছে।
(গ) মহান আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَكُمْ بُرْهَانٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكُمْ نُورًا مُبِينًا-
‘হে লোক সকল! তোমাদের কাছে তোমাদের রবের পক্ষ হ’তে স্পষ্ট দলীল এসেছে। আর আমি তোমাদের প্রতি ‘স্পষ্ট নূর’ নাযিল করেছি’ (নিসা ৪/১৭৪)।
উপরোক্ত তিনটি আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, আল্লাহ এখানে নূর দ্বারা কুরআনুল কারীমকে বুঝিয়েছেন। মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে নয়।
দলীল-২ : হাদীছে এসেছে,
قلت: يا رسول الله، بأبي أنت وأمي، أخبرني عن أول شيء خلقه الله قبل الأشياء. قال: يا جابر، إن الله تعالى خلق قبل الأشياء نور نبيك من نوره -
হযরত আব্দুল্লাহ বিন জাবের (রাঃ) বলেছেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা-মাতা আপনার উপরে কুরবান হোক। আমাকে সংবাদ দিন যে, কোন বস্ত্তটি আল্লাহ সকল বস্ত্তর পূর্বে সৃষ্টি করেছেন? তিনি বললেন, হে জাবের! নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নূর হতে তোমার নবীকে সর্ব প্রথম সৃষ্টি করেছেন’ (তাহেরুল ক্বাদরী, মীলাদুন্নবী (ছাঃ) পৃঃ ১১১)।
জবাব : কোন নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে তাহেরুল ক্বাদরী ছাহেব হাদীছটি নিয়ে আসেননি। তিনি ইমাম আব্দুর রায্যাক (রহঃ)-এর নাম উল্লেখ করেছেন ইমাম ক্বাসত্বালানীর উদ্ধৃতি দিয়ে। কিন্তু নিজে সরাসরি এর কোন সনদ উল্লেখ করেন নি। এমনকি ইমাম আব্দুর রায্যাক (রহঃ) লিখিত কোন গ্রন্থের বরাতও উল্লেখ করতে সক্ষম হন নি। সুতরাং এটি জাল বর্ণনা, যার কোনই গ্রহণযোগ্যতা নেই।
দলীল-৩ : হাদীছে এসেছে,
إن الله تبارك وتعالي خلق نور محمد صلي الله عليه وسلم-
‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নূরকে সৃষ্টি করেছেন’।
জবাব : ভিত্তিহীন বর্ণনা। এর কোন সনদ আমাদের জানা নেই। ইমাম মুসলিম (রহঃ) লিখেছেন,
الْإِسْنَادُ مِنَ الدِّينِ، وَلَوْلَا الْإِسْنَادُ لَقَالَ مَنْ شَاءَ مَا شَاءَ-
‘সনদ হ’ল দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত। যদি সনদ না থাকত তবে যার যা মন চাইত সে তাই বলত’ (মুসলিম, মুক্বাদ্দামা ১/১৫)।
দলীল-৪: রাসূল (ছাঃ) বলেন,
قال صلي الله عليه و سلم أول ما خلق الله نوري ومن نوري خلق كل شيء-
মুহাম্মাদ (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ সর্বপ্রথম আমার নূরকে সৃষ্টি করেছেন। এরপর আমার নূর থেকে সবকিছু সৃষ্টি করেছেন (তাহেরুল কাদরী, মীলাদুন্নবী (ছাঃ) পৃঃ ১২৩)।
জবাব : এটিও ভিত্তিহীন, যার কোন অস্তিত্ব হাদীছ গ্রন্থসমূহে পাওয়া যায় না। তর্কসাপেক্ষে হাদীছটি সাময়িকভাবে মেনে নিলে মানুষ, পশু-পাখী, নোংরা-আবর্জনা, সবই রাসূলের নূর দ্বারা তৈরী প্রমাণিত হয়ে যায় (নাঊযুবিল্লাহ)।
দলীল-৫ : রাসূল (ছাঃ) বলেন,
أنا نور من نور الله-
‘(আমি) আল্লাহর নূর হ’তে এসেছি’ (বিস্তারিত দেখুন : ফাতাওয়া লাজনাহ দায়েমাহ ৩/১০)।
জবাব : এটিও ভিত্তিহীন। এর কোন সনদ আমরা অবগত হতে পারি নি। বিদ‘আতী বক্তাদের মুখেই কেবল শ্রবণ করা যায় মাত্র। এ ব্যাপারে মুফতী মুবাশ্বির আহমাদ রববানী বলেছেন, যে ব্যক্তি এই রেওয়ায়াতটির বিশুদ্ধতার দাবীদার তিনি মুহাদ্দিছদের কায়েদা মোতাবেক এর একটি মাত্র ছহীহ সনদ পেশ করুক। আজ পর্যন্ত কেউ এর একটিও ছহীহ সনদ পেশ করতে সক্ষম হন নি (আহকাম ও মাসায়েল পৃঃ ৬১)। শায়খ বিন বায (রহঃ) বলেছেন, هو نور من نور الله الذاتي ليس هذا الاعتقاد صحيحا؛ لأنه مخالف للقرآن বরং তিনি আল্লাহর সত্ত্বাগত নূর হতে এসেছেন-মর্মে আক্বীদা পোষণ করা সঠিক নয়। কেননা তা কুরআন বিরোধী আক্বীদা (ফাতাওয়া লাজনাহ দায়েমাহ ৩/১০)।
দলীল-৬ : ‘এক রাতে আয়েশার সূঁচটি হাত থেকে পড়ে যায়। এরপর নবীর নূরে সেটি দৃষ্টিগোচর হয়...’।
জবাব : ভিত্তিহীন। এর কোন সূত্র বিদ্যমান নেই।
দলীল-৭ : হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, خُلِقْتُ أَنَا وَعَلِيٌّ مِنْ نُورٍ ‘আমি ও আলী নূর হ’তে সৃষ্ট...’ (ইবনুল জাওযী, আল-মাউযূআত ১/৩৪০)।
জবাব : বানোয়াট বক্তব্য।
(ক) ইবনুল জাওযী (রহঃ) বলেছেন, ‘এটা জা‘ফর বিন আহমাদ তৈরী করেছেন। আর তিনি রাফেযী ছিলেন, হাদীছ বানাতেন। ইবনে আদী বলেছেন, আমরা নিশ্চিৎরূপে বলতাম যে, তিনি হাদীছ জাল করতেন (আল-মাওযূআত ১/৩৪০)।
(খ) তালখীছু কিতাবিল মাওযূআত গ্রন্থে আছে, ‘জাফর বিন আহমাদ রাফেযী এবং হাদীছ জালকারী ছিলেন’ (হা/২৪২)।
(গ) ইমাম সুয়ূত্বী (রহঃ) বলেছেন, ‘এটা জাফর বানিয়েছেন। এবং তিনি রাফেযী ও হাদীছ জালকারী ছিলেন’ (আল-লাআলী আল-মাছনূআহ ১/২৯৪)।
দলীল-৮ : রাসূল (ছাঃ) বলেন,
خَلَقَنِي اللَّهُ مِنْ نُورِهِ، وَخَلَقَ أَبَا بَكْرٍ مِنْ نُورِي، وَخَلَقَ عُمَرَ مِنْ نُورِ أَبِي بَكْرٍ، وَخَلَقَ أُمَّتِي مِنْ نُورِ عُمَرَ، وَعُمَرُ سِرَاجُ أَهْلِ الْجَنَّةِ-
‘আল্লাহ আমাকে তার নূর হ’তে সৃষ্টি করলেন। এরপর তিনি আবূ বকরকে আমার নূর হ’তে সৃষ্টি করলেন। তারপর তিনি আবূ বকরের নূর হ’তে ওমরকে সৃষ্টি করলেন এবং আমার উম্মতকে ওমরের নূর হ’তে সৃষ্টি করলেন। আর ওমর হ’লেন জান্নাতবাসীদের বাতি স্বরূপ’ (তানযীহুশ শারী‘আহ হা/২৫)।
জবাব : এটি জাল বর্ণনা। ইমাম ইবনুল আর্রাক্ব (রহঃ) বলেছেন, وَقَالَ أَبُو نعيم هَذَا بَاطِل، أَبُو معشر والهيثم وَأَبُو شُعَيْب متروكون ‘আবূ নু‘আইম বলেছেন, এটা বাত্বিল। আবূ মাশার, হায়ছাম ও আবূ শুআইব- তিনজনই পরিত্যাক্ত (ঐ)। চার নম্বর দলীলে বলা হয়েছে যে, সব কিছুই নবীর নূর দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে। আর এখানে বলা হয়েছে যে, আমার উম্মতকে ওমরের নূরের হ’তে সৃষ্টি করা হয়েছে। দু’টিই পরস্পর বিরোধী বক্তব্য।
দলীল-৯ : রাসূল (ছাঃ) বলেন,
الأُرْزُ مِنِّي وَأَنَا مِنَ الأُرْزِ خَلَقْتُ الأُرْزَ مِنْ بَقِيَّةِ نُورِي
চাউল আমার হতে, আর আমি চাউল হতে সৃষ্ট। আমি আমার অবশিষ্ট নূর হতে চাউলকে বানিয়েছি... (ত্বাহের পাটনী, তাযকিরাতুল হুফ্ফায ১/১৪৭)।
জবাব : এটা বানোয়াট। আল্লামা তাহের পাটনী (রহঃ) বলেছেন, এটি মাওযূ বা বানোয়াট (ঐ)।
দলীল-১০ : রাসূল (ছাঃ) বলেন,
وَرَأَتْ أُمِّي أَنَّهُ خَرَجَ مِنْهَا نُورٌ أَضَاءَتْ لَهُ قُصُورُ الشَّامِ-
‘আমার মা দেখলেন যে, তার মধ্য থেকে নূর বের হয়েছে যা শামের প্রাসাদগুলিকে আলোকিত করে দিয়েছে’ (মুসনাদে আহমাদ হা/১৭১৬৩; মিশকাত হা/৫৭৫৯)।
জবাব : হাদীছটি ছহীহ। তবে তার অর্থ এই নয় যে, কোন কিছু আলো ছড়ালেই তা নূরের সৃষ্টি হয়ে যাবে। যেমন বাতি আমাদেরকে আলো তথা নূর দিয়ে থাকে। তার মানে এই নয় যে, বাতি, মোমবাতি ইত্যাদি বস্ত্তগুলি নূরের সৃষ্ট।
দলীল-১১ : হাদীছে এসেছে,إِذَا تَكَلَّمَ رُئِيَ كَالنُّورِ يَخْرُجُ مِنْ بَيْنِ ثَنَايَاهُ রাসূল (ছাঃ) যখন কথা বলতেন তখন তাঁর দাঁতের মধ্য হ’তে আলোর ছটা বের হ’ত’ (সুনানে দারেমী হা/৫৯; আল-মুজামুল আওসাত্ব হা/৭৬৭; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ হা/৩৬৪৪; মিশকাত হা/৫৭৯৭)।
জবাব:
(ক) আলবানী (রহঃ) খুবই যঈফ বলেছেন (মুখতাছারুশ শামায়েল হা/১৩; যঈফাহ হা/৪২২০)।
(খ) হাফেয যুবায়ের আলী যাঈ (রহঃ) বলেছেন, ‘অত্যন্ত যঈফ। উপরোক্ত বর্ণনাটির প্রধান রাবী আব্দুল আযীয বিন আবূ ছাবেত ইমরান আয-যুহরী আল-মাদানী খুবই সমালোচিত ও পরিত্যক্ত ছিলেন। ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেছেন, তিনি মুনকারুল হাদীছ। তার বর্ণিত হাদীছ লেখা যাবে না’ (বুখারী, কিতাবুয যুআফা হা/২২৫)।
মুনকারুল হাদীছ রাবী সম্পর্কে ইমাম বুখারী বলেছেন, ‘যাকে মুনকারুল হাদীছ বলা হয় তার হতে আমি বর্ণনা গ্রহণ করার প্রবক্তা নই’ (আত-তারীখুল আওসাত্ব ২/১০৭) ।
এর দ্বারা ঐ রাবী উদ্দেশ্য যিনি জমহূর মুহাদ্দিছদের নিকটে সমালোচিত ও মুনকারুল হাদীছ (যুবায়ের আলী যাঈ, তাহক্বীক্ব শামায়েলে তিরমিযী হা/১৫, পৃঃ ৬৯) ।
নবী (ছাঃ) মাটির সৃষ্টি : আল্লাহ তাআলা নবীকে বাশার বলে উল্লেখ করেছেন (কাহফ ১৮/১১০)। আর বাশারকে তিনি মাটি হতে সৃষ্টি করেছেন মর্মে ঘোষণা করেছেন (হিজর ১৫/২৮; ছা-দ ৩৮/৭০)। অতএব কুরআন দ্বারা প্রমাণিত হয়ে গেল যে, আল্লাহ বাশারকে মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। নূর দিয়ে নয়।
উপসংহার : উপরোক্ত এগারোটি দলীলের পর্যালোচনা দ্বারা এটা প্রতীয়মান হয় যে, নবী (ছাঃ) নূরের সৃষ্টি মর্মে পেশকৃত কোন দলীলই গ্রহণযোগ্য নয়। বরং এটি একটি বিদ‘আতী আক্বীদা যা থেকে বেঁচে থাকা যরূরী। কেননা মুহাম্মাদ (ছাঃ) আদম সন্তান হিসাবে রক্তমাংসের মাটির মানুষ। যা উপরোক্ত আলোচিত হয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক আক্বীদা পোষণ করার তাওফীক্ব দান করুন। আমীন!
[লেখক : প্রশিক্ষণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, সৈয়দপুর উপযেলা, নীলফামারী]