সামাজিক সম্পর্ক

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 795 বার পঠিত

আল-কুরআনুল কারীম :

1- يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ-

(১) ‘হে মানব জাতি! আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী হ’তে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হ’তে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে-ই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাক্বওয়া সম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত’  (হুজুরাত ৪৯/১৩)

2- وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَكُمْ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ إِذَا أَنْتُمْ بَشَرٌ تَنْتَشِرُون- وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ- وَمِنْ آيَاتِهِ خَلْقُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافُ أَلْسِنَتِكُمْ وَأَلْوَانِكُمْ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِلْعَالِمِينَ-

(১) ‘তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে অন্যতম এই যে, তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমরা এখন (জীবিত) মানুষ হিসাবে (সারা পৃথিবীতে) ছড়িয়ে পড়েছ। তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে অন্যতম এই যে, তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি লাভ কর। আর তিনি তোমাদের (স্বামী-স্ত্রীর) মধ্যে পরস্পরে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এর মধ্যে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য (আল্লাহর একত্বের ও অসীম ক্ষমতার) বহু নিদর্শন রয়েছে। তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে অন্যতম হ’ল, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করা এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের মধ্যে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করা। নিশ্চয়ই এর মধ্যে জ্ঞানীদের জন্য (আল্লাহর একক পালনকর্তা হওয়ার) নিদর্শন সমূহ রয়েছে’ ( রূম ৩০/২০-২২)

3- يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًاٌ-

(৩) ‘হে মানব জাতি! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর। যিনি তোমাদেরকে একজন মানুষ থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর ঐ দু’জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামে তোমরা একে অপরের নিকট যাচ্ঞা করে থাক এবং আত্মীয়তার বন্ধন সম্পর্কে সতর্ক হও। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপর সদা সতর্ক তত্ত্বাবধায়ক’ (নিসা ৪/১)

4- إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِنْ قَوْمٍ عَسَى أَنْ يَكُونُوا خَيْرًا مِنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِنْ نِسَاءٍ عَسَى أَنْ يَكُنَّ خَيْرًا مِنْهُنَّ وَلَا تَلْمِزُوا أَنْفُسَكُمْ وَلَا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الْإِيمَانِ وَمَنْ لَمْ يَتُبْ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَِ-

(৪) নিশ্চয় মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। কাজেই তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে আপোষ মীমাংসা করে দাও। আর তোমরা আল্লাহর তাক্বওয়া অবলম্বন কর, আশা করা যায় তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হবে। হে ঈমানদারগণ, কোন সম্প্রদায় যেন অপর কোন সম্প্রদায়কে বিদ্রুপ না করে, হ’তে পারে তারা বিদ্রুপকারীদের চেয়ে উত্তম এবং কোন নারীরাও যেন অন্য নারীদের বিদ্রূপ না করে, হ’তে পারে তারা বিদ্রূপকারী দের চেয়ে উত্তম। আর তোমরা একে অপরের নিন্দা করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ উপনামে ডেকো না। ঈমানের পর মন্দ নাম কতই না নিকৃষ্ট। আর যারা তওবা করে না, তারাই তো যালিম’ (হুজুরাত ৪৯/১০-১১)

হাদীছে নববী :

5- عَنْ أَبِى مَسْعُودٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم حُوسِبَ رَجُلٌ مِمَّنْ كَانَ قَبْلَكُمْ فَلَمْ يُوجَدْ لَهُ مِنَ الْخَيْرِ شَىْءٌ إِلاَّ أَنَّهُ كَانَ يُخَالِطُ النَّاسَ وَكَانَ مُوسِرًا فَكَانَ يَأْمُرُ غِلْمَانَهُ أَنْ يَتَجَاوَزُوا عَنِ الْمُعْسِرِ قَالَ قَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ نَحْنُ أَحَقُّ بِذَلِكَ مِنْهُ تَجَاوَزُوا عَنْهُ-

(৫) আবূ মাসউদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির মধ্যে কোন এক লোকের হিসাব নেওয়া হ’লে তার কোন ভাল কাজ পাওয়া গেল না। সে ছিল ধনীলোক। সে যখন লোকদের সাথে লেন-দেন করত তখন নিজ গোলামদের হুকুম প্রদান করত, অভাবী ঋণগ্রস্তদের সাথে সহানুভূতিপূর্ণ আচরণ কর। এতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমি ক্ষমা ও সহানুভূতির ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি উপযোগী। অতএব, (হে ফেরেশতাগণ!) তাকে মুক্তি প্রদান কর’।[1]

6- عَنْ يَحْيَى بْنِ وَثَّابٍ عَنْ شَيْخٍ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنَّ الْمُسْلِمَ إِذَا كَانَ مُخَالِطًا النَّاسَ وَيَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ خَيْرٌ مِنَ الْمُسْلِمِ الَّذِى لاَ يُخَالِطُ النَّاسَ وَلاَ يَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ-

(৬) ইয়াহইয়া বিন ওয়াছছাব হ’তে বর্ণিত, একজন ছাহাবী নবী করীম (ছাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন যে মুসলমান (সমাজের) মানুষের সাথে মেশে এবং তাদের দেয়া কষ্টে ধৈর্য ধারণ করে, সে ঐ মুসলমানের চেয়ে উত্তম, যে মানুষের সাথে মেশে না এবং তাদের দেয়া কষ্টে ধৈর্য ধারণও করে না’।[2]

7-  عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم خَيْرُ الأَصْحَابِ عِنْدَ اللَّهِ خَيْرُهُمْ لِصَاحِبِهِ وَخَيْرُ الْجِيرَانِ عِنْدَ اللَّهِ خَيْرُهُمْ لِجَارِهِ- 

(৭)  আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে উত্তম সাথী সে, যে তার সঙ্গী-সাথীর নিকট উত্তম। আর আল্লাহর নিকট সবচেয়ে উত্তম প্রতিবেশী সে, যে তার পড়শীর নিকট উত্তম’ ।[3]

8- عَنْ أَبِى ذَرٍّ قَالَ قَالَ لِى رَسُولُ اللَّهِ  كَيْفَ أَنْتَ إِذَا كَانَتْ عَلَيْكَ أُمَرَاءُ يُؤَخِّرُونَ الصَّلاَةَ عَنْ وَقْتِهَا أَوْ يُمِيتُونَ الصَّلاَةَ عَنْ وَقْتِهَا. قَالَ قُلْتُ فَمَا تَأْمُرُنِى قَالَ صَلِّ الصَّلاَةَ لِوَقْتِهَا فَإِنْ أَدْرَكْتَهَا مَعَهُمْ فَصَلِّ فَإِنَّهَا لَكَ نَافِلَةٌ-

(৮) ‘আবূ যার গিফারী (রাঃ) বলেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বললেন, হে আবূ যার! কি অবস্থা হবে তোমার যখন তোমাদের ওপর এমন সব শাসনকর্তা হবেন যাঁরা ছালাতের প্রতি অমনোযোগী হবেন অথবা নির্ধারিত সময় হ’তে তা পিছিয়ে দিবেন? আমি বললাম আপনি আমাকে কি আদেশ দেন? তিনি বললেন ছালাত তার ঠিক সময়ে পড়বে অতঃপর যদি তাদের সাথে তা পাও পুনরায় পড়বে আর এটা তোমার জন্য নফল হবে’।[4]

9- عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّ رَجُلاً زَارَ أَخًا لَهُ فِى قَرْيَةٍ أُخْرَى فَأَرْصَدَ اللَّهُ لَهُ عَلَى مَدْرَجَتِهِ مَلَكًا فَلَمَّا أَتَى عَلَيْهِ قَالَ أَيْنَ تُرِيدُ قَالَ أُرِيدُ أَخًا لِى فِى هَذِهِ الْقَرْيَةِ. قَالَ هَلْ لَكَ عَلَيْهِ مِنْ نِعْمَةٍ تَرُبُّهَا قَالَ لاَ غَيْرَ أَنِّى أَحْبَبْتُهُ فِى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ. قَالَ فَإِنِّى رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكَ بِأَنَّ اللَّهَ قَدْ أَحَبَّكَ كَمَا أَحْبَبْتَهُ فِيهِ.

(৯) আবু হুরায়রা (রাঃ) নবী (ছাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন,  এক ব্যক্তি অন্য এক গ্রামে তার মুসলমান ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে বের হ’ল। আল্লাহ তা‘আলা তার গমন পথে একজন অপেক্ষমান ফেরেশতা বসিয়ে রাখলেন। লোকটি  যখন সেখানে পোঁছাল তখন ফেরেশতা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথায় যাচ্ছ? সে বলল, ঐ গ্রামে একজন ভাই আছে, তার সাথে সাক্ষাতে যাচ্ছি। ফেরেশতা জিজ্ঞেস করলেন, তার কাছে তোমার কি কোন চাওয়ার আছে, যা পাওয়ার জন্য তুমি যাচ্ছ? সে বলল, না; আমি তাকে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ভালবাসি। তখন ফেরেশতা বললেন, আমি আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তোমার কাছে এই সংবাদ দেওয়ার জন্য প্রেরিত হয়েছি যে, আল্লাহ তোমাকে অনুরূপ ভালবাসেন, যেরূপ তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তাকে ভালবাস’।[5]

মনীষীদের বক্তব্য :

১. আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বক্তব্য দেওয়ার সময় বলেন, হে মানবমন্ডলী! তোমাদের আনুগত্য ও জামা‘আতবদ্ধ জীবনযাপন আবশ্যক। কেননা এ দু’টি আল্লাহর্ রশি যার ব্যাপারে আল্লাহ আদেশ করেছেন’ ।[6]

২. আবুল আলীয়া বলেন, আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধর’ অর্থাৎ একনিষ্টভাবে শুধু তাকেই অাঁকড়ে ধর আর তোমরা পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়ো না এবং হিংসা-বিদ্বেষ করো না। আল্লাহ ওয়াস্তে পরস্পরে ভাই ভাই হয়ে যাও’।[7]

৩. উমাইয়া ইবনু ছালত বলেন, আমি যখন মাটিতে ছালাত আদায় করি তখন পুরো দুনিয়াকে আমার নিজের দেশ মনে হয় আর সমস্ত দুনিয়াবাসীকে আমার আত্মীয়’।[8]

সারবস্ত্ত :

১. সামাজিক সর্ম্পক মানুষের যাবতীয় মানসিক অসুখের যেমন দুশ্চিন্তা, মনোকষ্টের অত্যন্ত কার্যকরী ঔষধ হিসাবে কাজ করে। ফলে মানুষ পরস্পরের সাক্ষাতে ও ভালবাসায় প্রশান্তি লাভ করে।

২. সামাজিক সম্পর্কে অগ্রগামী ব্যক্তি মানবসমাজে এবং আল্লাহর কাছে অধিকতর প্রিয় হয়।

৩. মানুষ সামাজিক জীব। আর সমাজ জীবন ব্যবহারিক জীবনের শিক্ষালয়ও বটে। মানুষ সেখানেই বেড়ে উঠে। সমাজের ভাল পরিবেশে সে অসাধারণ মানুষে পরিণত হয়।

৪. সামাজিক সর্ম্পক সুদৃঢ় হ’লে তা শত্রুদের জন্য ভয়ের কারণ হয়। ফলে তা মুসলমানের জন্য নিরাপত্তা ও সম্মানের প্রতীক হিসাবে পরিগণিত হয়।

৫. সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করার মাধ্যমে ইহকালে শান্তি ও পরকালে মুক্তি নিশ্চিত হয়।


[1]. মুসলিম হা/৪০৮০; তিরমিযী হা/১৩০৭;।

[2]. তিরমিযী হা/২৫০৭।

[3]. তিরমিযী, দারেমী, মিশকাত হা/৪৯৮৭।

[4]. মুসলিম হা/১৪৯৭; মিশকাত হা/৬০০।

[5]. মুসলিম হা/৬৭১৪,২৫৬৭; মিশকাত হা/৫০০৭।

[6]. আদ-দুররুল মানছুর ২/২৫৭।

[7]. ঐ, ২/২৫৭।

[8].  আল-হামাসাতুল মাগরীবিয়্যাহ ১/৭৭৬ পৃ.।



আরও