আধুনিক যুগঃ ৪র্থ পর্যায় (সাংগঠনিক)

প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব 2099 বার পঠিত

আধুনিক যুগঃ ৪র্থ পর্যায় (সাংগঠনিক)

دور الجديد: المرحلة الرابعة (التنظيمى)

হিজরী দ্বাদশ শতাব্দী হ’ত চতুর্দশ মোতাবেক খৃষ্টীয় অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে যথাক্রমে শাহ অলিউল্লাহ (১১১৪-৭৬/১৭০৩-৬২) ও তাঁর ইল্মী পরিবার, শাহ ইসমাঈল শহীদ (১১৯৩-১২৪৬/১৭৭৯-১৮৩১), মিয়াঁ নাযীর হুসাইন দেহলভী (১২২০-১৩২০/১৮০৫-১৯০২) ও নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালী (১২৪৮-১৩০৭/১৮৩২-৯০) কর্তৃক সূচিত ও সর্বত্র বিস্তৃত ‘কিতাব ও সুন্নাহর দিকে ফিরে যাওয়ার’ আন্দোলন- যা ইতিহাসে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ নামে পরিচিত, ভারতবর্ষ ও দক্ষিণ এশিয়ার মুলসলমানদের মধ্যে যুগ যুগ ধরে চলে আসা তাকলীদী জড়তা, ইজতিহাদ বিমুখতা ও বে-দলীল রসমপ্রিয়তার বিরদ্ধে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিশেষ করে  মিয়াঁ নাযীর হুসাইন দেহলভীর মত ইল্মী মহীরুহের ছায়াতলে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন বিভিন্ন প্রান্তে এমন বহু আলিম জন্মলাভ করেন, যারা বুদ্ধিপ্রসূত কুটতর্ক পরিহার করে সরাসরি কুরআন ও হাদীছের আলোকে জীবন গড়ায় উদ্বুদ্ধ হন। ভারতবর্ষ ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা তাঁর বিপুল ছাত্রবাহিনী পরবর্তীতে উপমহাদেশে আহলেহাদীছ আন্দোলনকে সাংগঠনিকভাবে সমন্বিত রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন। মিয়াঁ ছাহেবের জীবনের শেষপ্রান্তে দিল্লীতেই এধরনের আহলেহাদীছ সংগঠন কায়েম হয়।

১ - জামাআতে গোরাবায়ে আহলেহদীছ

(প্রতিষ্ঠাকাল : দিল্ল­ী ১৩১৩ হিঃ/১৮৯৫ খৃঃ)

মিয়াঁ ছাহেবের অন্যতম ছাত্র হাফেয মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব মুহাদ্দিছ দেহলভী (১২৮১-১৩৫১/১৮৬৬-১৯৩৩ খৃঃ) কর্তৃক মিয়াঁ ছাহেবের মৃত্যুর সাত বৎসর পূর্বে ১৩১৩ হিজরীতে দিল্ল­ীতে উপস্থিত কিঞ্চিদধিক ১২ জন নেতৃস্থানীয় আহলেহাদীছ আলিম ও সরদার কর্তৃক তাঁর হাতে বায়‘আত গ্রহণের মাধ্যমে এই জামা‘আত প্রতিষ্ঠিত হয়। মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব ইতিপূর্বে তাঁর উস্তাদ মাওলানা আবদুল্লাহ গযনবীর (১২৩০-৯৮/১৮১৪-৮০) হাতে অমৃতসরে বায়‘আত হওয়ার কারণে নিজে অন্যদের বায়‘আত গ্রহণে অক্ষমতা প্রকাশ করেন। কিন্তু ভক্তদের চাপে অবশেষে বায়‘আত নিতে সম্মত হন। পরবর্তীতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকার আহলেহদীছ ওলামা ও নেতৃবৃন্দ তাঁর ‘ইমামত’ কবুল করে নেন।[1] ফলে নবপ্রতিষ্ঠিত এই নেতৃত্ব ব্যাপক রূপ লাভ করে। একজন আলিম বা-আমল মুত্তাক্বী নেতার ইমারতের অধীনে ঐক্যবদ্ধভাবে জামা‘আতী জীবন যাপনের বিষয়টি মুসলিম উম্মাহ্ ভুলতে বসেছিল। এই বিলুপ্তপ্রায় সুন্নাত পুনর্জীবিত করতে গিয়ে মাওলানাকে স্বগোত্রীয়দের নিকট থেকে বেশী বাধাপ্রাপ্ত হ'তে হয়েছে।[2] ইমারতের অপরিহার্যতা বিষয়ক ছহীহ হাদীছগুলিকে বিভিন্ন অজুহাতে এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল দেখে মাওলানা ব্যথিত হন। তিনি সাধ্যমত সকলকে বুঝাতে চেষ্টা করেন। পরিশেষে ১৩১৩ হিজরী মোতাবেক ১৮৯৫ খৃষ্টাব্দে ‘জামা‘আতে গোরাবায়ে আহলেহাদীছ’ নামে কিতাব ও সুন্নাতের আলোকে দিল্ল­ীতে একটি জামা‘আত প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি এই জামা‘আতের ‘ইমাম’ নিযুক্ত হন। আক্বীদা ও আমলের দিক দিয়ে এই জামা‘আত আহলেহাদীছের মধ্যে নতুন কোন জামা‘আত ছিল না।

১৯২০/১৩৩৮ হিজরীর শা‘বান মাসে তিনি দিল্লী থেকে মাসিক ‘ছহীফায়ে আহলেহাদীছ’ বের করেন, যা বর্তমানে করাচীর কেন্দ্রীয় অফিস থেকে পাক্ষিক হিসাবে বের হচ্ছে। সর্বদা দাওয়াত ও তাদরীসে ব্যস্ত থাকার কারণে মাওলানার পক্ষে লেখনীর দিকে বেশী মনোনিবেশ করা সম্ভব হয়নি। তবুও তিনি ৫/৬টি গ্রন্থ রচনা করেন। তন্মধ্যে ছালাতের নিয়ম-কানুন বিষয়ক ‘মুকাম্মাল নামায’, মিশকাত শরীফের আরবী হাশিয়া, যা দিল্লীর ফারূকী প্রেস প্রকাশ করেছে; বর্তমান যুগের প্রচলিত নিয়মকানুন সম্বলিত কুরআন মজীদের বিপরীতে প্রাথমিক যুগের ন্যায় নুকতা-হরকত বিহীন ‘মু‘আররা’  (معرى) কুরআন মজীদ সংকলন প্রভৃতি প্রকাশিত হয়েছে।[3]

তাঁর মৃত্যুর পরে জ্যেষ্ঠ পুত্র হাফেয মাওলানা আবদুস সাত্তার জামা‘আতের ‘ইমাম’ নিযুক্ত হন। দেশবিভাগের পরে জামা‘আতের কেন্দ্রীয় ‘দারুল ইমারত’ দিল্লী হ’তে ১নং বান্স রোড করাচীতে স্থানান্তরিত হয় এবং ‘মাদরাসা দারুস সালাম’ নামে তার সংলগ্ন কেন্দ্রীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কায়েম হয়। মাওলানা আবদুর রহমান সালাফী বর্তমানে উক্ত জামা‘আতের কেন্দ্রীয় আমীর। রংপুর হারগাছের মাওলানা আব্দুল হামীদ এই জামা’আতের বাংলাদেশ অঞ্চলের ‘আমীর’ বলে পরিচিত।

১৯৬৩ সালে গৃহীত গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এই জামা‘আতের একটি কেন্দ্রীয় বায়তুল মাল রয়েছে, যেখানে যাকাত, ফিৎরা, কুরবানী, ওয়াক্ফ, হেবা, অছিয়ত, সাধারণ ছাদাকা, শারঈ ও সাংগঠনিক জরিমানা, জামা‘আতী সম্পত্তি, জামা‘আতী প্রকাশনার মুনাফা প্রভৃতি জমা হয়। এর অধীনে তাবলীগ ও তাছনীফ শাখা ছাড়াও ‘দারুল ক্বাযা’ নামে একটি কেন্দ্রীয় বিচার বিভাগ রয়েছে, ‘ইমামে জামা‘আত’ সেখানে জামা‘আতী মোকাদ্দামা সমূহের শারঈ ফায়ছালা দিয়ে থাকেন।[4]

এই জামা‘আতের দাবী অনুযায়ী হিন্দুস্থানে সাইয়িদ আহমাদ ব্রেলভী ও শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহঃ)-এর পরে এটাই প্রথম জামা‘আত, যা পূর্ণ ইসলামী নিয়মানুসারে পরিচালিত।[5]

পাকিস্তানে বর্তমানে এই জামা‘আতের অধীনে ৩০টি দ্বীনী মাদরাসা পরিচালিত হচ্ছে। করাচীর গুলশান ইকবাল ব্লক-৬ অবস্থিত ‘জামে‘আ সাত্তারিয়া’ এই জামা‘আতের কেন্দ্রীয় মাদরাসা। পাকিন্তানে এই জামা‘আতের একশোর মত শাখা সংগঠন রয়েছে। আমেরিকার হিউষ্টন (টেক্সাস) শহরেও এই জামা‘আতের একটি শাখা ও মসজিদ রয়েছে। পাক্ষিক ‘ছহীফায়ে আহলেহাদীছ’ বর্তমানে এই জামা‘আতের একমাত্র মুখপত্র।[6]

এই জামা‘আত শরীয়তবিরোধী কোন রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করেনা। অবশ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদি যা সরাসরি মুসলিম উম্মাহর সহিত সাধারণভাবে এবং জামা‘আতের সহিত বিশেষভাবে সম্পৃক্ত, সে সকল বিষয়ে এই জামা‘আত মতামত ব্যক্ত করে। এই জামা‘আতের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ পাশ্চাত্য গণতন্ত্র সমর্থন করেন না।[7]

বর্তমানে জামা‘আত নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সংঘটিত না থাক্লেও ভারত ও বাংলাদেশে এই জামা‘আতের অনুসারীর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। (চলবে)

[বিস্তারিত দ্রষ্টব্য : মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব প্রণীত আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতসহ (পিএইচ.ডি থিসিস) শীর্ষক গ্রন্থ পৃঃ ৩৬২-৩৬৪)]

[1]. আবদুস সাত্তার দেহলভী, খুৎবায়ে ছাদারত (১৩৫১/১৯৩২-এর পরে ও ১৩৫৬/১৯৩৭-এর পূর্বে প্রকাশিত) পৃঃ ১৪-১৫; ৮৩ জন আলেমের নাম প্রকাশিত হয়েছে। তন্মধ্যে দিল্লীর ২ জন বাদে রংপুরের ২১ জন, ময়মনসিংহের ৬ জন, দিনাজপুরের ১ জন, মুর্শিদাবাদের ৬ জন ও মালদহের ৮ জন (মাওলানা ইবরাহীম শেরশাহী যার মধ্যে অন্যতম)- মোট ৪২ জন বাংগালীসহ বাকী ভারতের বিভিন্ন বিভিন্ন এলাকার ওলামায়ে আহলেহাদীছ।- আবদুর রহমান ঝাংগুরী সংকলিত ‘ফাতাওয়া উলামায়ে কেরাম দর বারায়ে তাক্বার্রুরে ইমাম’ (দিল্ল­ীঃ আর্মী প্রেস, সালবিহীন) পৃঃ ৮১-৮৩; উক্ত সংকলনের ইমামত-এর পক্ষে হাফেয আবদুল্ল­াহ গাযীপুরীর ফৎওয়া এবং তার সপক্ষে মাওলানা আবদুন নূর দারভাঙ্গাবী, মাওলানা আবদুল জলীল সামরূদীসহ অন্যান্য উলামায়ে কেরামের ফৎওয়া সংকলিত হয়েছে। সাথে সাথে মাওলানা এনায়াতুল্লাহ ও মাওলানা জুনাগড়ীর মধ্যে ইমামত-এর পক্ষে ও বিপক্ষে দিল্ল­ীতে অনুষ্ঠিত প্রসিদ্ধ ‘মুনাযারা’ সংকলিত হয়েছে।-ঐ, পৃঃ ১৮-৮১।

[2]. মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব, ‘মুকাম্মাল নামায’ (করাচীঃ মাকতাবা ইশা‘আতুল কিতাবে ওয়াস্ সুন্নাহ, ভূমিকা (লেখকঃ আবু মুহাম্মাদ মিয়াঁওয়ালী, ১৪০৪/১৯৮৪) পৃঃ ২৭।

০ মাওলানা আবদুল ওয়াহ্হাবঃ আবদুল ওয়াহ্হাব বিন খোশহাল বিন ফাৎহ বিন ক্বায়েম ১২৮০ অথবা ১২৮১ হিজরীতে পাঞ্জাবের ঝং যেলার ‘ওয়াসুআস্তানা’ (واسوآستانه) শহরে এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে মুলতান যেলার মুবারকাবাদ শহরে হিজরত করেন ও সেখানেই স্থায়ী ভাবে বসতি স্থাপন করেন। প্রথমে নিকটস্থ মসজিদে কুরআন মজীদ পড়া শেখেন ও পরে হেফ্য সমাপ্ত করেন। ৬ হ’তে ২০ বছর বয়সের মধ্যে তিনি সে যুগের সেরা চারজন উস্তাদ- হাফেয মুহাম্মাদ লাক্ষাবী, আবদুল্লাহ গযনবী, মানছূরুর রহমান (পরে ঢাকাভী) ও শায়খুল কুল মিয়াঁ নাযীর হুসাইন দেহলভী (রহঃ)-এর নিকটে ইসলামী শরীয়তের বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শিতা লাভ করেন। পরে ১৮৮২ খৃঃ মোতাবেক ১৩০০ হিজরীর প্রথম দিকে তিনি দিল্লীতে ‘দারুল কিতাবে ওয়াস্ সুন্নাহ’ নামে মাদরাসা কায়েম করেন- যা আজও আছে।

মোর্দা সুন্নাত যেন্দা করা দিকে তাঁর বিশেষ নযর ছিল। যেমন- (১) তিনিই দিল্লীতে প্রথম প্রকাশ্য ময়দানে ১২ তাকবীরে ঈদের জামা‘আত কায়েম করেন (২) তিনিই প্রথম নিজের স্ত্রী-কন্যাদের সাথে নিয়ে পুরুষদের সাথে পর্দার মধ্যে মহিলাদের ঈদের জামা‘আত চালু করেন (৩) তিনিই দিল্লীতে প্রথম মুছল্ল­ীদের মাতৃভাষায় জুম‘আর খুৎবা চালু করেন (৪) তিনিই প্রথম ‘ছালাতে জানাযা’র কিরাআত সশব্দ পাঠ করা শুরু করেন (৫) তিনিই প্রথম দুষ্ট স্বামীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ মযলূম স্ত্রীদেরকে স্বেচ্ছায় বিবাহ-বিচ্ছেদের অধিকার দিয়ে মযবুত দলীল সহকারে ফৎওয়া প্রকাশ করেন (৬) খতীব মিম্বরে বসার পরে জুম‘আর জন্য একটি মাত্র আযান দেওয়ার সুন্নাতে নববী তিনিই দিল্ল­ীতে পুনঃপ্রবর্তন করেন (৭) লোকেরা কালেমায়ে ত্বাইয়িবার দুই অংশকে একত্রে ‘কালেমায়ে তাওহীদ’ বা ‘একত্ববাদের ঘোষণা’ মনে করত। তিনি পরিষ্কারভাব বুঝিয়ে দেন যে, কালেমায়ে ত্বাইয়িবার প্রথম অংশটিই মাত্র ‘কালেমায়ে তাওহীদ’ এবং দ্বিতীয় অংশটি হ’ল ‘কালেমায়ে রিসালাত’ (৮) জীবনমরণ সমস্যা দেখা দিলে হৃদয়ে ঈমান ঠিক রেখে ‘কুফরী কালেমা’ উচ্চারণ করার পক্ষে সূরায়ে নাহ্ল ১০৬ আয়াতের আলোকে তিনি ফৎওয়া প্রদান করেন- যা ছিল সে যুগের হিসাবে বড়ই ঝুঁকিপূর্ণ ফৎওয়া (৯) হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের অজুহাতে মাওলানার সময়ে দিল্ল­ীতে মুসলমানেরা গরু কুরবানী এবং সাধারণ ভাবে গরু যবাই করত না। গরুর গোস্তের ত্রুটি বর্ণনায় মুসলমানেরা বাড়াবাড়ি করতে থাকে। কোন কোন মৌলবী ছাহেব তো গরুর গোস্ত খাওয়াকে শুকরের গোস্ত খাওয়ার মত হারাম ফৎওয়া দেওয়া শুরু করেন। মুসলমানদের এই হীনমন্যতা দেখে মাওলানা দারুণ ক্ষুব্ধ হন এবং প্রবল হিম্মত নিয়ে কুরবানীর জন্য গরু খরিদ করেন। কিন্তু প্রথম গরুটি বিরোধীরা ছিনিয়ে নেয়। পুনরায় খরিদ করলে মুসলমান কসাইরা তা যবহ করতে অস্বীকার করলে তিনি নিজে যবহ করেন। পরে গরুর গাড়ীতে করে গোস্ত আনার সময় বিরোধীরা রাস্তায় আটকিয়ে গরু দু’টি ছেড়ে দেয় ও গাড়ীর চাকা খুলে নেয়। অবশেষে ছাত্ররা গোস্ত মাথায় করে বাড়ীতে আনে।

পরবর্তীতে সুধী ওলামায়ে কেরাম একবাক্যে স্বীকার করেন যে, যদি মাওলানা আবদুল ওয়াহ্হাব ঐ সময় ঐ দুঃসাহসিক পদক্ষেপ না নিতেন, তাহ'লে ভারতের বুক থেকে সম্ভবতঃ গরু কুরবানীর সুন্নাত উঠে যেত। কারণ এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হ’য়ে যখন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের নেতারা গরু কুরবানী সরকারীভাবে নিষিদ্ধ করার দাবী নিয়ে ইংরেজ ভাইসরয়ের নিকটে দরখাস্ত পেশ করেন, তখন ইংরেজ সরকার এই মর্মে ঘোষণা প্রদান করেন যে, ‘কোথাও গরু কুরবানী না হওয়ার শর্তে এই বৎসর থেকে গরু কুরবানী আইনগতঃ দন্ডণীয় ঘোষণা করার জন্য আমরা দৃঢ় আশা পোষণ করেছিলাম। কিন্তু কসাইখানার রেজিষ্টারে দেখা গেল যে, মৌলবী আবদুল ওয়াহ্হাব নামক দিল্লীর জনৈক মুসলমান এবছর গরু কুরবানী করেছেন। অতএব মুসলমানদের মধ্যে ভিন্নমত থাকায় আমরা গরু কুরবানীকে আইনগতঃ দন্ডণীয় ঘোষণা করতে পারিনা।’ (১০) শারঈ ইমারতের ভিত্তিতে জামা‘আত গঠনের মাধ্যমে ইসলামী শরীয়তের বিধান অনুযায়ী সার্বিক জীবন পরিচালনার চিরন্তন সুন্নাত মুসলিম সমাজ ভুলতে বসেছিল। তারা বিচ্ছিন্ন জীবন যাপনে অভ্যন্ত হয়ে পড়েছিল। ফলে শেরেকী, বিদ‘আতী ও অনৈসলামী সামাজিক নেতৃত্বের অধীনে তাদের ঈমান-আমল সব প্রায় খুবই খুইয়ে বসেছিল। এই অবস্থা দর্শনে মাওলানা খুবই ব্যথিত হ’লেন এবং রেওয়াজপন্থী আলিম সমাজও শরীয়ত অনভিজ্ঞ সমাজনেতাদের সকল ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে প্রথমে কিঞ্চিদধিক ১২ জন ভক্ত সাথীকে নিয়ে ১৮৯৫/১৩১৩ হিজরী সনে ‘জামা‘আতে গোরাবায়ে আহলেহাদীছ’ কায়েম করেন। অথচ তখনও তাঁর উস্তাদ মিয়াঁ ছাহেব (১২২০-১৩২০ হিঃ) বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন। আল্লাহ পাক তাঁর কোন একজন বান্দাকে সকল প্রকারের তাওফীক প্রদান করেন না। বলা বাহুল্য এটাই ছিল আল্লামা ইসমাঈল শহীদ ও সাইয়িদ আহমাদ ব্রেলভী প্রতিষ্ঠিত জামা‘আতে মুজাহেদীনের পরে ভারতের প্রথম ইমারত ভিত্তিক ইসলামী জামা‘আত। এর ফলে তাঁকে অমানুষিক নির্যাতনের সম্মুখীন হ’তে হয়। যেমন খাবার দাওয়াত দিয়ে খাদ্যে বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা, দাড়ি চেঁছে দেওয়া, বিভিন্ন তোহমত ও কুৎসা রটনা করা, হত্যার জন্য গুন্ডা ভাড়া করা ও রাস্তায় ওঁৎ পেতে থাকা, সমাজনেতাদের ইংগিতে আলিমদের পক্ষ হ’তে তাকে ‘কাফের’ ইত্যাদি ফৎওয়া দেওয়া প্রভৃতি।

মাওলানা জীবন সাতবার হজ্জ করেন। বিভিন্ন সময়ে ১০ জন স্ত্রীর পাণি গ্রহণ করেন। ৯ জন পুত্র ও ৬ জন কন্যা রেখে ১৯৩৩ খৃঃ মোতাবেক ১৩৫১ হিজরীর ৮ই রজব সোমবার দিবাগত রাত ১১টায় ৭০ বছর বয়সে দিল্লীতে মৃত্যুবরণ করেন এবং স্বীয় উস্তাদ শায়খুল কুল মিয়াঁ নাযীর হুসাইন দেহলভীর কবরের পূর্বপাশ্বে সমাহিত হন। তাঁর মৃত্যুর খবর শুনে ঘোর বিরোধী স্বাগোত্রীয় ও হানাফী আলিমগণ ছাত্রদেরকে এই বলে পড়ানো থেকে বিরত থাকেন যে, ‘আজ হিন্দুস্থান থেকে হাদীছের প্রদীপ গেল’(آج  ہند ميں حديث كا چراغ بجہ گيا ہے)  -দ্রঃ মুকাম্বাল নামায- ভূমিকা, লেখকঃ ঐ, পৃঃ ১৯-২৮, ৩১-৩৩।

[3]. প্রাগুক্ত ভূমিকা, পৃঃ ২৮-৩০।

[4]. ৪ঠা নভেম্বর ১৯৬৩- তে জামা‘আতের ৮ম বার্ষিক সম্মেলনে গৃহীত ‘দাস্তূর’ (প্রকাশকঃ আবদুল গাফ্ফার সালাফী-নাযেমে আ‘লা; উক্ত গঠনতন্ত্র ৫০টি শিরোনাম ও ফুলস্কেপ সাইজের হস্তলিখিত ১৩ পৃষ্ঠায় সমাপ্ত) পৃঃ ১৩।

[5]. ‘মুকাম্মাল নামায’ ভূমিকা, পৃঃ ২৮।

[6]. ২১-১২-১৯৮৮ ইং তারিখে করাচীর ‘দারুল ইমারত’ থেকে স্বয়ং আমীর আব্দুর রহমান সালাফী এবং জামে‘আ সাত্তারিয়ার পরিচালক (মুদীর) মাওলানা মুহাম্মাদ সালাফী প্রদত্ত লিখিত হিসাবে অনুযায়ী অত্র তথ্য পরিবেশিত হ’ল।

[7]. প্রাগুক্ত রিপোর্ট অনুযায়ী।



বিষয়সমূহ: সংগঠন
আরও