বস্ত্তনিষ্ঠ ইতিহাসের আলোকে মুক্তিযুদ্ধ
আব্দুল্লাহ মাহমুদ
আব্দুল্লাহ মাহমুদ 10362 বার পঠিত
বইয়ের নাম : মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম।
সংকলক : পিনাকী ভট্রাচার্য।
প্রকাশক : গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স।
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১৪৪, মূল্য: ২৫০/-।
লেখক পরিচিতি :
'৯০-এর ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মাঠ থেকে উঠে আসা যে কয়জন রাজনৈতিক কর্মী সমসাময়িক বাংলাদেশে আলোচিত লেখক হয়েছেন, পিনাকী ভট্টাচার্য তাদের একজন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে দিশা খুঁজে ফেরা পিনাকীর রয়েছে বিচিত্র সব রাজনৈতিক চিন্তা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার অভিজ্ঞতা। লেখালেখির বিষয় বহুবর্ণ ও বিচিত্র। দর্শন, ইতিহাস আর রাজনীতি পিনাকীর লেখালেখির প্রিয় বিষয়। সফল কর্পোরেট চিফ এক্সিকিউটিভ থেকে এখন লেখালেখি ছাড়াও নিজের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কাজে সময় দেন। ‘একাদেমিয়া’ নামের একটি নিয়মিত পাঠচক্রের সভাপতি।
বাংলাদেশে ফেইসবুকের লেখালেখির জগতে পিনাকী ভট্টাচার্য ইতিমধ্যেই নিজের অবস্থান তৈরী করে নিয়েছেন। প্রশ্ন তুলতে ভালোবাসেন তিনি। নানা বিষয়ে বিস্ফোরক প্রশ্ন তুলে অনেক প্রচলিত বয়ানকে নড়বড়ে করে দেয়ার মতো দক্ষতা আছে পিনাকীর।
গ্রন্থ পর্যালোচনা :
আল্লাহ্ তা‘আলা মানবজাতিকে এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে সুশোভিত করেছেন যা অন্যদের মাঝে নেই; তা হল স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি বা স্বাধীনতা। অন্যান্য মাখলুকাতের জন্য আল্লাহ্ নির্ধারণ করে দিয়েছেন নির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা, যা তাদের জন্য দুর্লঙ্ঘনীয়। কিন্তু মানুষকে করেছেন স্বাধীনচেতা। তারা পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ থাকতে চায়না।
তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের মানুষকে নানামুখী পন্থায় পরাধীনতার শিকলে বেঁধে রাখার নীলনকশা আঁকে। বাঙালি জাতি তাদের নীলনকশা আঁচ করতে পেরে দীর্ঘ নয় মাস জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করে পরাধীনতার শিকলকে ছিন্নভিন্ন করে বাংলা আকাশে স্বাধীনতার বর্ণিল সূর্য উদিত করে।
কোন জাতিকে বাধাগ্রস্ত করতে কিংবা তাদের অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করে করার অন্যতম এক জোরালো মাধ্যম হ’ল তাদেরকে তথ্যসন্ত্রাসের জালে জড়িয়ে তাদের মনোবলকে দমিয়ে রাখা।
ইসলামের ঊষালগ্ন থেকে ইসলামের গলা চিপে রাখার পরিকল্পনায় একদল লোক ইসলামকে তথ্যসন্ত্রাসের শিকার বানায়। ওহুদ যুদ্ধে মুশরিক বাহিনী নবী (ছাঃ) মারা গেছেন' এই মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে মুসলিমদের মনোবল গুড়িয়ে দিয়ে মুসলিম বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে চেয়েছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসকে ঘিরেও ইসলাম তথ্য সন্ত্রাসের শিকার। মিথ্যা যে পাটাতনের উপর স্বাধীনতার বর্তমান ইতিহাস রচনা করা হয়েছে, তার প্রধান কথা হ’ল যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে সেক্যুলারিজমের উপর ভিত্তি করে এবং তৎকালীন আলেমসমাজ ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী পক্ষ। স্বাধীনতা ও ইসলামকে তারা পরস্পর বিরোধীভাবে দাঁড় করিয়েছে, যেন একটা থাকলে অন্যটা থাকবে না।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট কলামিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও এই মিথ্যা পাটাতনকে গুড়িয়ে দিয়ে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন তাঁর সুলিখিত ‘মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম’ বইয়ে। বিভিন্ন উৎসের আলোকে তিনি প্রমাণ করেছেন ইসলাম ও স্বাধীনতা পরস্পর বিরোধী ছিলনা। বরং স্বাধীনতার প্রতিটি পরতে পরতে ইসলামের পরশ লেগে আছে। পিনাকী ভট্টাচার্য গোটা বইটিকে ১৬টি অনুচ্ছেদে ভাগ করেছেন।
১ম অনুচ্ছেদ ‘আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী রাজনৈতিক দলিলে ইসলাম’-এ পিনাকী প্রমাণ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক নেতৃত্বে থাকা আওয়ামী লীগ তার জন্মলগ্ন থেকে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত একটি ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল ছিল। ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করার পর তাদের সংবিধান কমিটি (ড. কামাল হোসেন যার চেয়ারম্যান ছিলেন) কর্তৃক প্রণীত খসড়া সংবিধানের প্রস্তাবনায় তদানীন্তন ‘পাকিস্তানের মুসলমানদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে কুরআন সুন্নাহর আলোকে গড়ে তোলার’ কথা স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছিল।
২য় অনুচ্ছেদ ‘মুক্তিযুদ্ধ নির্মাণের বয়ান-বক্তৃতায় ইসলাম’-এ পিনাকী বলেন, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘ইনশাআল্লাহ’ শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন। তাছাড়া ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি যে বেতার ভাষণ দিয়ে বিজয় ঘোষণা করেন সেখানে তিনি তাঁর বক্তৃতা শেষ করেন এই বলে, ‘আমি মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সব দেশবাসীকে আল্লাহর প্রতি শোকরিয়া জ্ঞাপনের জন্য ও একটি সুখী সমৃদ্ধশালী সমাজ গঠনে আল্লাহর সাহায্য ও নির্দেশ কামনা করার উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি’।
৩য় অনুচ্ছেদে তিনি লেখেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুক্তিকামী মানুষের পাকিস্তান বিরোধী বহ্নিশিখা যাতে ঝিমিয়ে না যায় এবং সর্বপ্রকারের লোক যেন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে, সে জন্য তাদেরকে উদ্দীপ্ত করতে স্বাধীন বেতার কেন্দ্র সবচেয়ে বড় ভূমিকা করে। এই বেতার কেন্দ্র মানুষদের উজ্জীবিত করতে ইসলামের বজ্রবাণী প্রচার করত। শোনাত মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে আল্লাহ তার জন্য কী মহান পুরস্কার রেখেছেন। সে বেতারের প্রথম অধিবেশন শুরু করা হয় পবিত্র কুর'আন তেলাওয়াতের মাধ্যমে। কবি আব্দুস সালাম প্রথম অধিবেশনে মুক্তিযুদ্ধের যে প্রথম বেতার ঘোষণা দেন তা তিনি শুরু করেন, ‘নাহমাদুহু ওয়ানুছাল্লীয়ালা রাছূলিহীন কারীম’ ও ‘আসসালামু আলাইকুম’ দিয়ে। তারপর তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতাহীন জীবনকে ইসলাম ধিক্কার দিয়েছে।...যে জানমাল কোরবানী দিচ্ছি, কোরআনে কারীমের ঘোষণা- ‘তারা মৃত নহে, অমর’।... আল্লাহর ফযল করমে বীর বাংলার বীর সন্তানেরা শৃগাল-কুকুরের মত মরতে জানে না। মরলে শহীদ, বাঁচলে গাযী।....‘নাছরুম মিনাল্লাহে ওয়া ফাতহুন কারীব’। আল্লাহর সাহায্য ও জয় নিকটবর্তী।
এছাড়া প্রত্যেকটি অধিবেশনে কুর'আন তেলাওয়াতসহ কুর'আন ও হাদীছের বাণী প্রচার করা হত এবং ইসলামী বিধানের মাধ্যমে প্রমাণ করা হত পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী যালিমের ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। অতএব ইসলামের বিধানানুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ফরয।
৪র্থ অনুচ্ছেদে দেখানো হয়েছে যে, ১৪ এপ্রিল দেশের জনগণের উদ্দেশ্যে অস্থায়ী সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনাবলী প্রচারিত হয়। তা শুরু করা হয় ‘আল্লাহু আকবর’ ও শেষ করা হয় ‘আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নিকটবর্তী’ বলে। তাতে আরও বলা হয় ‘বাঙালির অপরাধ আল্লাহর সৃষ্ট পৃথিবীতে, আল্লাহর নির্দেশ মতো সম্মানের সাথে শান্তিতে সুখে বাস করতে চেয়েছে। বাঙালির অপরাধ মহান স্রষ্টার নির্দেশমতো অন্যায়, অবিচার, শোষণ থেকে মুক্তি কামনা।...আমাদের সহায় পরম করুণাময় সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাহায্য।..মসজিদের মিনারে আযান প্রদানকারী মুয়াজ্জিন, মসজিদে-গৃহে ছালাতরত মুছল্লী ও দরগাহ-মাযারে আশ্রয়প্রার্থীরাও হানাদারদের গুলি থেকে বাঁচেনি।.. সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা‘আলার উপর বিশ্বাস রেখে ন্যায়ের সংগ্রামে অবিচল থাকুন’।
৫ম অনুচ্ছেদের শিরোনাম দিয়েছেন - ‘মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতাকারীদের বুঝাতে ইসলামের প্রতীক ও চিহ্নের বিকৃত উপস্থাপন’। এতে লেখক প্রমাণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের সময় ধৃত রাযাকার, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এদের যাদের ছবি এবং ভিডিও বিভিন্ন আর্কাইভে পাওয়া যায়, তাদের কারো মুখেই দাঁড়ি কিংবা মাথায় টুপি দেখা যায় না, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত এই দেশের প্রায় সকল নাটক-চলচ্চিত্রেই দেখা যায় রাযাকারদের মুখে দাঁড়ি আর মাথায় টুপির মত ইসলামী লেবাসে হাজির করা হয়।
৬ষ্ঠ অনুচ্ছেদে রাযাকার ছিল কারা- এই প্রশ্নের জবাবে লেখক রাযাকারদের সম্পর্কে অতি মূল্যবান তথ্য হাযির করেছেন এবং মানুষেরা রাযাকার বাহিনীতে কেন যোগদান করত তার কারণগুলো উল্লেখ করেছেন।
৭ম অনুচ্ছেদে পিনাকী যারা স্বাধীনতাকে ইসলামবিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে জনগণের হাতে তুলে দিয়েছেন, তাদের দাবীর অসারতা প্রমাণ করতে গিয়ে স্বাধীনতার বিভিন্ন ডকুমেন্ট উল্লেখ করেছেন এবং এর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন কখন ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি স্বাধীনতার ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। তিনি বলেন, ১৯৪৭-এর পর থেকে ২৩ নভেম্বর ১৯৭১ সাল পর্যন্ত স্বাধীনতার ইতিহাসের পাতায় ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটির কোনো অস্তিত্ব ছিলো না। বরং ১৯৪৭ থেকে নিয়ে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত সকল সংগ্রামের চালিকাশক্তি ও প্রাণ ছিল ধর্মীয় অনুভূতি ও ধর্মীয় অনুশাসন।
২৪ এপ্রিল ১৯৭১ সালে প্রবাসী সরকার ভারত সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি চেয়ে চিঠি দেয়। কিন্তু ৬ মাস পেরিয়ে গেলেও ভারত সরকারের কোনোরূপ সাড়া মেলেনি। তারপর ১৫ অক্টোবর আবার চিঠি দেয়া হয়। আবারও একমাস পেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও কোনো সাড়া মেলেনি। এবার প্রবাসী সরকার অত্যন্ত বিচলিত হয়ে ২৩ নভেম্বর ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে চিঠি দেয়। যাতে সর্বপ্রথম ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি উল্লেখ করা হয়।
৮ম থেকে ১১তম চারটি অনুচ্ছেদে তিনি মুক্তিযুদ্ধে আলেম ওলামাদের অবদান নিয়ে আলোকপাত করেছেন। বামপন্থী ও সেক্যুলার লেখকেরা স্বাধীনতা যুদ্ধকে ইসলামের বিপক্ষে দাঁড় করানোর হীন মানসিকতা চরিতার্থ করার জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধে আলেম-ওলামাদের অবদানকে বাক্সবন্দি করে রেখে প্রচারণা চালায় যে তাঁদের কোন অবদান মুক্তিযুদ্ধে নেই; বরং আলেম সমাজ মানেই স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি। পিনাকী সেসব আলেমসমাজের বাক্সবন্দী অবদানকে বের করে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। তিনি সে সময়ে বাংলাদেশের শীর্ষ আলেম হাফেজ্জী হুযুর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে রাজনৈতিক ও নৈতিক অবস্থান গ্রহণ এবং পাকিস্তানীদের যালেম এবং মুক্তিযুদ্ধকে যালেমের বিরুদ্ধে মযলুমের লড়াই বলে অভিহিত করার দৃপ্ত বক্তব্যকে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম’-এর পূর্ব পাকিস্তানের আমীর ছিলেন মরহুম শায়খুল হাদীছ মাওলানা আজিজুল হক, যিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন বলে এই বই থেকে জানা যায়। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা আরো অনেক আলেমদের ইতিহাস তিনি এ বইয়ের উপস্থাপন করেছেন।
বাংলাদেশের আলেম ওলামাদের পাশাপাশি উপমহাদেশের আলেম ওলামাগণও মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দিয়েছিলেন, যা এই বইতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এদের মধ্যে জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল ও ভারতীয় পার্লামেন্টের লোকসভার সদস্য হযরত আসআদ মাদানী (র.), পশ্চিম পাকিস্তানের আলেম জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম পাকিস্তানের সেক্রেটারি মুফতী মাহমুদ, শায়খুল ইসলাম হযরত হোসাইন আহমাদ মাদানী (র.) এবং মাওলানা কাওসার নিয়াযী অন্যতম। সবচেয়ে বড় কথা বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম ডাকটিই দিয়েছিলেন ‘রেড মওলানা’ হিসেবে বিশ্বখ্যাত মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী।
১২তম অনুচ্ছেদে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের চিঠিপত্রে ইসলামী ভাব-প্রভাব প্রসঙ্গে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সেসব চিঠি উল্লেখ করেছেন, যা তারা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাদের পরিবারকে দিয়েছিলেন। এসব চিঠি ইসলামী আলাপচারিতায় ভরপুর। তারা তাদের পরিবারকে এ বলে সান্ত্বনা দিতেন যে, আমরা শহীদ হতে যাচ্ছি। তাই আমাদের রক্ত বৃথা যাবে না। এমনকি তারা তাদের পরিবারের কাছে দো‘আ চাইতেন শহীদী মৃত্যুর জন্য। কারণ, তারা জানতেন ধর্মীয় লাভ না থাকলে তাদের পরিবার তাদের মরণকে সহজে মেনে নেবে না।
১৩তম অনুচ্ছেদে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠানসমূহে ইসলাম প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হয়েছে। এখানে তিনি স্বাধীন বেতার কেনেদ্রর কিছু অনুষ্ঠানের বর্ণনা দিয়েছেন, যে অনুষ্ঠানসমূহে নানাভাবে ইসলামী বয়ান ও ভাবনা দিয়ে সবাইকে উদ্দীপ্ত করা হত। যেমন অনুষ্ঠানের নাম ছিল, ‘আল্লাহর পথে জিহাদ’, ‘ইসলামের দৃষ্টিতে জিহাদ’, ‘রামাযানের ঈদের স্মৃতি-আলেখ্য’ ইত্যাদি।
১৪তম অনুচ্ছেদে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে যে ‘জয়বাংলা’ নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হত তাতে বর্ণিত মুসলিম দেশগুলোর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ইতিবাচক প্রতিক্রিয়াসমূহ তুলে ধরেছেন লেখক।
উপসংহারে লেখক একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন যে, ‘এই ঘটনা (যুদ্ধ) শুধু বাঙালির ইতিহাসের জন্য নয়, মুসলমান বা ইসলামের ইতিহাসের জন্যও এক গুরুত্বপূর্ণ লড়াই। কারণ বাংলাদেশের মানুষ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর নিজেদের অধিকার কায়েম করতে গিয়ে ইসলাম ত্যাগ করেননি, ইসলামের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ওপর তাদের হক তারা বিসর্জন দেননি।’
পরিশিষ্টে গৌতম দাস কর্তৃক লিখিত ‘মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম প্রসঙ্গ’ শীর্ষক এক প্রবন্ধ উল্লেখ করা হয়েছে। এতেও কিছু বিষয়ে অমূল্য কিছু তথ্য প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া কিছু বিষয়ে যে মিথ্যার মেঘ জমে আছে, তা তিনি অপসরণ করেছেন।
মোদ্দাকথা স্বাধীনতা কেন্দ্রিক ইসলাম বিরোধী যাবতীয় মিথ্যা তথ্যের অবগুণ্ঠন উন্মোচন করা হয়েছে পিনাকীর এই অমুল্য পুস্তকটিতে। যেই সত্য ইতিহাস বামপন্থী ও সেক্যুলারদের গ্রন্থে ঠাঁই করে না নিতে পারায় এতদিন ডুকরে কাঁদছিল, সেই ইতিহাস পিনাকী ভট্টাচার্যের এ গ্রন্থে সসম্মানে ঠাই করে নিয়েছে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস প্রসঙ্গে এক নব দিগন্তের উন্মোচন করেছে গ্রন্থটি। আমরা লেখককে সাধুবাদ জানাই তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী ও শিকড়সন্ধানী গবেষণাটি পুস্তকাকারে প্রকাশের জন্য। সত্যসন্ধানী পাঠকদের জন্য এটি যে একটি অবশ্য পাঠ্য বই, তা বলাই বাহুল্য।
লেখক : চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে।