ফুতূহাত-ই-ফীরূজশাহী
ড. আব্দুল করিম
ড. নূরুল ইসলাম 811 বার পঠিত
আব্দুর
রহমান কাশগড়ী উপমহাদেশের একজন খ্যাতিমান আরবী কবি, সাহিত্যিক, সাহিত্য
সমালোচক, অভিধানবেত্তা ও ভাষাতাত্ত্বিক। তিনি ১৯১২ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর
চীনা তুর্কিস্তানের কাশগড়ে জন্মগ্রহণ করেন। কাশগড়ের স্থানীয় আলেমদের নিকট
তিনি প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। এরপর অভিবাসী হয়ে চলে আসেন ভারতে।
নাদওয়াতুল ওলামা, লাক্ষ্ণৌর ইয়াতীমখানায় তাঁর ঠাঁই হয়। ১৯২২-৩০ সাল পর্যন্ত
তিনি সেখানে তাফসীর, হাদীছ, আরবী সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে ব্যুৎপত্তি লাভ
করেন। ১৯৩১-৩৮ সাল পর্যন্ত ৭ বছর তিনি নাদওয়ায় শিক্ষকতা করেন। এ সময় তিনি
লাক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ফাযেলে আদব’ ডিগ্রী লাভ করেন।[1]
শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক বাংলার শিক্ষামন্ত্রী থাকা অবস্থায় একবার নাদওয়ার কোন এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। কাশগড়ী তখন সদ্য ফারেগ প্রতিভাদীপ্ত টগবগে তরুণ। তাঁর অসাধারণ পান্ডিত্যের পরিচয় পেয়ে শেরেবাংলা তাঁকে কলিকাতা আলিয়া মাদরাসায় যোগদান করতে বলেছিলেন। শেরেবাংলার আহবানে সাড়া দিয়ে ১৯৩৮ সালে তিনি নাদওয়া ত্যাগ করেন এবং কলিকাতা আলিয়া মাদরাসায় ফিক্বহ ও উছূলে ফিক্বহ-এর প্রভাষক নিযু্ক্ত হন। দেশ ভাগের পর ১৯৪৭ সালে তিনি ঢাকা আলিয়ায় যোগ দেন এবং ১৯৫৬ সালে ‘এডিশনাল হেড মওলানার’ পদে উন্নীত হন। উল্লেখ্য যে, দেশ ভাগের সময় কলিকাতা আলিয়ার জিনিসপত্র সমান দু’ভাগে ভাগ করা হয়। মাদরাসার লাইব্রেরীর মহামূল্যবান বইগুলি আব্দুর রহমান কাশগড়ী এবং অন্যান্য আসবাবপত্র ঢাকায় এনেছিলেন মাওলানা ওজীহুল্লাহ। ১৯৭১ সালের ১লা এপ্রিল তিনি ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। আজিমপুর কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।[2] নিম্নে তাঁর সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল-
সাহিত্যকর্ম :
ক. প্রকাশিত :
১. আয-যাহারাত : এটি তাঁর অনন্য কাব্যসংকলন। ১৩৫৪/১৯৩৫ সালে ১১০ পৃষ্ঠা সংবলিত এ দীওয়ানটি লাক্ষ্ণৌ থেকে প্রকাশিত হয়।
২. আল-মুফীদ : এটি কাশগড়ী রচিত একটি চমৎকার অভিধান। এটি দু’ভাগে বিভক্ত। প্রথমভাগ আরবী-উর্দূ-বাংলা এবং দ্বিতীয়ভাগ উর্দূ-বাংলা-আরবী শব্দকোষ। এর মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ১০০২। ১৩৮০/১৯৬১ সালে এটি ঢাকা আলিয়া মাদরাসার গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগ থেকে প্রকাশিত হয়ে সুধীমহলে প্রশংসিত হয়।
খ. অপ্রকাশিত :
১. মিহাক্কুন নাকদ : কুদামা বিন জা‘ফর রচিত ‘নাকদুশ শি‘র’ গ্রন্থের তাহকীক ও পর্যালোচনা।
২. আল-মুহাববার ফিল মুওয়ান্নাছি ওয়াল মুযাক্কার : ৩০০ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটিতে পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ সর্ম্পকে আলোচনা করা হয়েছে।
৩. শি‘রু ইবনে মুকবিল : কবি তামীম বিন উবাই বিন মুকবিল রচিত কবিতার সংকলন।
৪. ইযালাতুল খাফা আন খিলাফাতিল খুলাফা : শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী কর্তৃক ফার্সীতে রচিত উক্ত গ্রন্থটি তিনি আরবীতে অনুবাদ করেন।
৫. ফরহাঙ্গে কাশগড়ী : এটি ইংরেজী-উর্দূ-বাংলা অভিধান। শতাধিক পৃষ্ঠার এ পান্ডুলিপিটি ঢাকা আলিয়া মাদরাসার গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে।
কাশগড়ীর অভিবাসী হওয়ার কাহিনী অত্যন্ত করুণ ও হৃদয়বিদারক। চীনা তুর্কিস্তানের কাশগড়ের এক অভিজাত পরিবারে তাঁর জন্ম। সোনার চামচ মুখে নিয়েই তিনি এ পৃথিবীর আলো-বাতাসে চোখ মেলেছিলেন। তার পিতা ছিলেন কাশগড়ের সর্বাপেক্ষা বড় আমীর। তিনি একজন বড় আলেম ও সকলের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। দুই ভাই, দুই বোন এবং পিতা-মাতা ৬ সদস্যের সংসারে আনন্দেই দিন কাটছিল কাশগড়ীর। চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লব সাধিত হওয়ার পর দেশের গণ্যমান্য মুসলিম নেতৃবৃন্দের সাথে তার পিতাকেও ধরে নিয়ে গিয়েছিল কমিউনিস্ট সন্ত্রাসীরা। কয়েকদিন পর তারা তার বড় ভাই ও দু’বোনকেও ধরে নিয়ে যায়। তাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাও জানা যায় না। কাশগড়ীর ভাষায়, আমাদের বাগান, খামার, পশুপাল এবং সহায়-সম্পদের সব কিছুই দখল করে নেয়া হয়েছিল। আমাকে এবং আমার আম্মাকে খামারের একটা ছোট বাড়ী দেয়া হ’ল থাকার জন্য। আম্মা ততদিনে শোকে বেদনায় মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেছেন। তখন আমার বয়স চৌদ্দ-পনের বছর। ভাল-মন্দ সবকিছুই বুঝার ক্ষমতা হয়েছে। বিশেষতঃ আমরা যে একেবারে নিঃস্ব এবং ধ্বংস হয়ে গেছি, এতটুকু অন্তত আমি বুঝতে পারছি। এমনি অবস্থাতেই একরাতে আমার এক মামা গোপনে আম্মার সাথে সাক্ষাৎ করতে এলেন। তিনি খবর দিলেন, কিছুসংখ্যক সাহসী মুসলিম যুবক একটা গোপন দল গঠন করে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছে। উদ্দেশ্য কমিউনিস্ট সন্ত্রাসীদের শ্যেনদৃষ্টি থেকে হতোদ্যম মুসলমানদেরকে যথাসম্ভব আড়াল করে রাখা এবং তাদেরকে দেশ ছেড়ে অন্যত্র হিজরত করার সুযোগ করে দেয়া। তিনি আরও খবর দিলেন, দু’এক দিনের মধ্যেই একটি কাফেলা হিন্দুস্তানের পথে রওয়ানা হয়ে যাবে। আমাকে যেন সে কাফেলার সাথে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
আম্মাকেও দেশ ছাড়ার জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু আমার দুই বোন ও ভাইয়ের আশা তিনি তখনও ছাড়েননি। হয়ত ওরা যালেমদের হাত থেকে ছাড়া পাবে অথবা অন্তত একটা খবর আসবে। নির্ধারিত সময়ে একটা পুটলি হাতে দিয়ে আমাকে কাফেলার সঙ্গী করে দেয়া হ’ল। সেদিন আকাশে চাঁদ ছিল না। সন্ধ্যারাতের আবছা অন্ধকারে মা আমাকে কিছুদূর এগিয়ে দিতে এসেছিলেন। শেষটায় একটা টিলার উপর দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন বিলীয়মান কাফেলাটার দিকে।
শেষবারের মত মায়ের কণ্ঠ শুনতে পেয়েছিলাম। তিনি চিৎকার করে আমার নাম ধরে ডাকছিলেন। আমাদের কাফেলাটি তখন পাহাড়ী পথের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। আমার পরে যারা দেশ ছেড়ে এসেছিল তাদের মুখে শুনেছি, আমাকে বিদায় দেয়ার পর মা পুরোপুরি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। প্রতিদিনই সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে তিনি পাহাড়ী টিলাটার উপর এসে দাঁড়াতেন। কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে একসময় চিৎকার করে ডাক দিতেন, আব্দুর রহমান! আব্দুর রহমান!
শুনেছি, একদিন আমার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে আমার মা টিলাটার উপরেই মৃতুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন।
বিশ্বাস কর, প্রতি সন্ধ্যায় এখনও আমি আমার সেণহময়ী মায়ের কণ্ঠ শুনতে পাই। তিনি যেন ‘আব্দুর রহমান, আব্দুর রহমান’ বলে আমাকে ডাকছেন।[3]
এটাই হ’ল আল্লামা কাশগড়ীর অভিবাসী হওয়ার করুণ কাহিনী। আরবী সাহিত্যের ছাত্র হিসাবে কাশগড়ীর জীবনী বিভিন্ন বইয়ে পড়েছি। কিন্তু এ মর্মান্তিক কাহিনী কোথাও পাইনি। সেজন্যই এই বিষয়ে লেখার অবতারণা।
কাশগড়ী চিরকুমার ছিলেন। পৃথিবীতে আপনজন বলতে তাঁর কিছুই ছিল না। তাঁর খ্যাতিমান ছাত্র মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের ভাষায়, ‘হোস্টেলের ছেলেগুলিকেই তিনি সন্তানের ন্যায় মনে করতেন। তার চাকুরী ছিল সরকারী প্রফেসর পোস্টের। তখনকার হিসাবে প্রচুর বেতন পেতেন। শখের মধ্যে ছিল নতুন নতুন বই কেনা। ছোট্ট একটা বাড়ী করেছিলেন। তাতে প্রচুর বই-পুস্তকের সংগ্রহ ছিল। কিন্তু ৭২ সনে সে বাড়ীটি স্থানীয় একটা ক্লাব কর্তৃক বেদখল হয়ে শেষ পর্যন্ত সঙ্গীত বিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছিল। তার মূল্যবান লাইব্রেরী ওযনদরে বিক্রয় করে দেয়া হয়েছিল বলে শুনেছি’।[4]
পিতা-মাতা, ভাই-বোন সব হারিয়ে দুঃখ-বেদনার মহাসাগরে আকণ্ঠ নিমজ্জিত কাশগড়ী ছিলেন ধৈর্যের মূর্তপ্রতীক এক অনন্য জ্ঞানসাধক। মুহিউদ্দীন খানের ভাষায় ‘জ্ঞানসাধনার দ্বারা বেদনার এক তপ্তসাগর যেন তিনি সবসময় আড়াল করে রাখতেন’।[5]
যে চীন থেকে অভিবাসী হয়ে একদিন কাশগড়ী ভারতে হিজরত করেছিলেন। সেখানে আজো উইঘুর মুসলমানরা নির্যাতিত হচ্ছে। এমনকি সম্প্রতি চীনা কর্তৃপক্ষ জিনজিয়াং প্রদেশে বসবাসরত উইঘুর মুসলমানদের ঘরে থাকা কুরআন, জায়নামায ও তাসবীহ সরকারের কাছে জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। যথাসময়ে জমা না দিলে শাস্তিরও ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ঐ অঞ্চলের জাতিগত কাযাখ ও কিরগিজ মুসলমানদেরকেও একই নির্দেশ দেয়া হয়েছে।[6] একদিন এই যুলুমের অবসান হবে ইনশাল্লাহ। চীনের যমীনে ইসলামের বিজয় নিশান উড়বে পতপত করে। সেদিন হয়ত বেশী দূরে নয়। আল্লাহই উত্তম পরিকল্পনাকারী।
[লেখক : ভাইস প্রিন্সিপাল, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী]
[1]. ড. মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ, বাংলাদেশের খ্যাতনামা আরবীবিদ (ঢাকা : ইফাবা. ১৯৮৬), পৃঃ ৬৫।
[2]. মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, জীবনের খেলা ঘরে (ঢাকা : মদীনা পাবলিকেশন্স, ৫ম সং, এপ্রিল ২০১৪), পৃঃ ১৫১, ১৫৫; বাংলাদেশের খ্যাতনামা আরবীবিদ, পৃঃ ৬৫।
[3]. জীবনের খেলা ঘরে, পৃঃ ১৫৬-৫৭।
[4]. ঐ, পৃঃ ১৫৭।
[5]. ঐ, পৃঃ ১৫৩।
[6]. রিপোর্ট দ্রঃ মাসিক আত-তাহরীক, নভেম্বর ২০১৭, পৃঃ ৪১।