বাঘা মাযার
আব্দুল্লাহ ছাকিব
ভূমিকা : বাংলাদেশ
তথা ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম ইসলামের আগমন ঘটে প্রধানত দুইভাবে (১) আরব বণিক
ওলামায়ে দ্বীনের দাওয়াতের মাধ্যমে (২) ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈদের নেতৃত্বে
সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে।[7] ওলামায়ে দ্বীনের মধ্যে যারা এদেশে নিঃশর্তভাবে
দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন, ১.
শাহ জালাল (রহঃ) ২. শাহ পরান (রহঃ) (সিলেট) ৩. শাহ সুলতান (রহঃ) (বগুড়া)
৪. খানজাহান আলী (রহঃ) (বাগেরহাট) ৫. শাহমখ্দুম রূপোশ (রহঃ) (রাজশাহী)
অন্যতম। যাঁদের বদৌলতে কুসংস্কার থেকে মানুষেরা আলোর মুখ দেখেছিল। তাঁরা
নিঃস্বার্থভাবে জনগণের সামনে কুরআন হাদীছের অমীয় বাণী প্রচার করছিলেন।
ইসলামের সরল পবিত্র ও অনাড়ম্বর জীবনাদর্শ তাঁদের কথা, কাজ, ব্যক্তিগত আচরণ
জনমনে জায়গা করে নিয়েছিল। সদলবলে লোক তাঁদের হাতে বায়‘আত করে ইসলামের
সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিল। ভারতবর্ষে যে সমস্ত স্থানকে কেন্দ্র করে
তাঁরা ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছিল। রাজশাহীর বাঘা অঞ্চল অন্যতম। সাধকদের
আগমনের পূর্বে এতদঅঞ্চলে মুসলমানদের অবস্থা অতীব শোচনীয় ছিল। মানুষেরা
নিজেদের ব্যক্তিত্ব ও যথা সর্বস্থ হারিয়ে উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে অত্যন্ত
হীন অবস্থায় জীবন যাপন করত। যখন জনগণ তাদের দ্বীনী আলোর ছোঁয়া পেল তখন
জনজীবন-যাত্রার মান দুর্বার গতিতে আমূল পাল্টে গেল। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে
ইসলামী কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের বিকাশ ঘটল।
তাঁরা এদেশে এসে দেশের সার্বিক প্রেক্ষাপটকে বিবেচনা করে যার যার মত নিজস্ব দাওয়াতী মারকায স্থাপন করেন। তাঁদের দ্বীন প্রচার ছিল মূলত ব্যক্তি কেন্দ্রিক। যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন উন্নত না থাকা এবং সরকারের (বৃটিশ) বৈরী মনোভাবের কারণে তাঁরা এদেশে প্রকাশ্য দ্বীন প্রচারের সুযোগ না পাওয়ায় নিজস্ব দাওয়াতী গৃহে বসেই দাওয়াতী কাজে আঞ্জাম দিতেন। সময়ের ব্যবধানে তাঁদের ঐসব মারকাযগুলো দ্বীন প্রচারের একেকটা দূর্গে রূপ নেয়। যত দিন যায় সাধারণ মানুষের আনাগোনা তত বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর ফলে কালের আবর্তে তাঁরা যখন পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। তখন তাঁদের ভক্ত-অনুরক্তরা তাঁদের কবরকে মাযার বানিয়ে নিয়ে পীর-মুরীদী মুহাববতের ছদ্দাবরণে ইসলামের নামে নানা ধরনের অনৈতিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হয় যা কিনা সেই সমস্ত মনীষীগণের শিক্ষার পুরো উল্টো। তেমনি একটি অন্যতম দাওয়াতী কেন্দ্র রাজশাহীর বাঘায় যা ‘মাযার শরীফ’ নামে সমধিক পরিচিতি। বাঘা কেন্দ্রের সর্বপ্রথম ইসলাম প্রচারক মাওলানা শাহ্ মুয়াযযাম দাওলা দানিশ্মান্দ (রহঃ) সাধারণত হযরত শাহদ্দৌলা (রহঃ) নামে পরিচিত।
বাঘা মসজিদের পরিচিতি
বাঘা এমন একটি নাম যার ইতিহাস এখনও অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েনি। এ স্থানে এমন কিছু কীর্তি বিদ্যমান যা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সাথের পরিচয় করে দেয়। বর্তমান যান্ত্রিক যুগের নিষ্পেষণ হ’তে ক্ষণিকের জন্য হ’লেও এর আলোচনা আমাদের এমন এক কালের সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দেয় যেখানে সভ্যতার আমেজ ও শান্তির আশ্বাস খুঁজে পাওয়া যায়। বাঘা মসজিদ রাজশাহী যেলা সদর হ’তে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে বাঘা উপজেলায় জনবসতিশূন্য বাঘা গ্রামে মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদ সংলগ্ন স্থান ও চারপার্শ্বে প্রাচীন ধ্বংসস্ত্তপে পূর্ণ। মসজিদের উত্তর-দক্ষিণ পার্শেব খিলান বিশিষ্ট প্রাচীর ফটক। অবশ্য উত্তরের ফটকটি বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়। মসজিদটি ১৫২৩-১৫২৪ সালে (৯৩০ হিজরী) হুসেন শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দীন শাহের পুত্র সুলতান নাছিরুদ্দীন নুসরাত শাহ মসজিদটি নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে এই মসজিদের সংস্কার করা হয়, এবং মসজিদের গম্বুজগুলো ভেঙ্গে গেলে ধ্বংস প্রাপ্ত মসজিদে নতুন করে ছাদ দেওয়া হয় ১৮৯৭ সালে। পুনরায় প্রবল ভূমিকম্পে গম্বুজগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। ১৯৮০ সালে গম্বুজগুলি নতুন করে নির্মাণ করে। উল্লেখ্য যে, ভূমিকম্পের পর বৃটিশ ভারত পুরাকীর্তি বিভাগ মসজিদে রক্ষণা-বেক্ষণের ভার গ্রহণ এবং সাময়িকভাবে ছালাত আদায় হ’তে জন সাধারণকে বিরত রাখে। প্রাচীর ঘেরা মসজিদ অঙ্গনের উত্তর-পূর্ব কোণে মাওলানা শাহদ্দৌলা দানিশ্মান্দ (রহঃ) তাঁর পাঁচ সঙ্গী ও আরো অনেকের মাযার অবস্থিত। শাহ আব্দুল হামিদ দানিশ্মান্দ (রহঃ) মাওলানা শের আলীর মাযারও একই স্থানে অবস্থিত আছে। মসজিদের দুইটি শিলালিপি হ’তে জানা যায় (৩৯০ হিজরী) ১৫২৩-১৫২৪ সালে সুলতান নাছিরউদ্দীন নুছরাত শাহ্ কর্তৃক এই মসজিদ নির্মিত হয়। এতে শাহদ্দৌলা (রহঃ)-এর কোন উল্লেখ নেই। শিলালিপিটি বর্তমানে পাকিস্তানের করাচী জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। সুলতান নুছরাত শাহ্ ওয়ালী শাহদ্দৌলা দানিশ্মান্দ-এর প্রতি শ্রদ্ধাবশত এই মসজিদ নির্মাণ করেন।
স্থাপত্য, বৈশিষ্ট্য ও বিবরণ : মসজিদটি ২৫৬ বিঘা জমির উপর অবস্থিত। সমভূমি থেকে ৮-১০ ফুট উঁচু করে মসজিদের আঙ্গিনা তৈরী করা হয়েছে। উত্তর পার্শ্বের ফটকের ওপরের স্তম্ভ ও কারুকার্য ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছে। মসজিদটিতে ১০টি গম্বুজ আছে। আর ভেতরে আছে ৬টি স্তম্ভ। মসজিদটিতে ৪টি মেহরাব আছে যা অত্যন্ত কারুকার্য খচিত দৈর্ঘ্য ৭৫ ফুট প্রস্থ ৪২ ফুট, উচ্চতা ২৪ ফুট ৬ ইঞ্চি। দেওয়াল চওড়া ৮ ফুট, গম্বুজের ব্যাস ৪২ ফুট উচ্চতা ১২ ফুট। চৌচালা গম্বুজের ব্যাস ২০ ফুট, উচ্চতা প্রায় ৩০ ফুট। মাঝখানের দরজার ওপর ফারসি ভায়ায় লেখা একটি শিলা লিপি আছে। মসজিদটির গাঁথুনি চুন সুরকি দিয়ে। ভেতরে এবং বাইরের দেওয়ালে মেহরাব ও স্তম্ভ রয়েছে। বাঘা মসজিদের দৈর্ঘ্য ২২.৯২ মিটার, প্রস্থ ১২.১৮ মিটার, এবং উচ্চতা ২৪ ফুট ৬ ইঞ্চি। এর দেওয়াল ২.২২ মিটার পুরু। মসজিদটিতে সর্বমোট ১০ গম্বুজ ৪টি মিনার, (যার শীর্ষদেশ গম্বুজাকৃতির) এবং ৫টি প্রবেশদার আছে। এই মসজিদটি চারদিক হ’তে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এবং প্রাচীরের দুই দিকে দু’টি প্রবেশদার আছে। মসজিদের ভেতরে বাইরে সর্বত্রই টেরাকোটার নকশা। বর্তমান মসজিদের পাশে বিশাল দীঘি ও একটি দর্শনীয় স্থান। এছাড়া বাঘা মসজিদের পাশেই রয়েছে একটি মাযার। এছাড়া মসজিদ প্রাঙ্গনের উত্তর পার্শ্বেই রয়েছে হযরত শাহদ্দৌলা ও তাঁর পাঁচ সঙ্গীর মাযার। বাংলার স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হুসাইন শাহর পুত্র নাছির উদ্দীন নুছরাত শাহ্ জনকল্যাণার্থে মসজিদের সামনে একটি দীঘি খনন করেন। শাহী মসজিদ সংলগ্ন এ দীঘি ৫২ বিঘার জমির উপর রয়েছে। দীঘির চারপাশে আছে সারিবদ্ধ নারিকেল গাছ। প্রতি বছর শীতের সময় এ দীঘিতে অসংখ্য অতিথি পাখির ডাকে এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে। বর্তর্মা দীঘিটির চারটি বাঁধানো পাড় নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও এ মসজিদ সংলগ্ন জহর খাকী পীরের মাযার আছে। মূল মাযারের উত্তর পার্শ্বে তার কবর রয়েছে। মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় প্রতিবছর বিগত দিনের রেওয়াজ অনুযায়ী ঈদুল ফিতরের দিন থেকে তিন দিন পর্যন্ত বাঘায় বিশাল মেলার আয়োজন করা হয়। বর্তমানে এই মেলা এক মাসব্যাপী হয়। মেলাটি ৫০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী। বর্তমানে বিশাল দীঘির পশ্চিম পাড়ে ও হযরত শাহ্ আব্দুল হামিদ দানিশ্মান্দ (রহঃ) এর মাযারের উত্তরে বাঘা জাদুঘর আছে। ২০১১ সালের জুন মাসে বাঘা ওয়াক্ফ এষ্টটের জায়গায় ৬২ লাখ টাকা ব্যয়ে জাদুঘর নির্মাণ কাজ শুরু করেন। যার নির্মান কাজ শেষ হয় ২০১২ সালের জুলাই মাসে।
মাওলানা শাহ মুয়াযযাম দানিশমান্দ সুদূর বাগদাদ হ’তে ১৫১৮-১৫১৯ সালে বাঘার এই গভীর বিপদ সংকুল অরণ্যে বাসস্থান স্থাপন করে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। তাঁর অনুপ্রেরণায় বহু লোক ইসলামে দীক্ষিত হয়। তিনি শুধুমাত্র তাওহীদের প্রচার ও প্রসারের কাজ করে গেছেন এবং ইসলামের খিদমাত করে গেছেন। তিনি যত দিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তাঁর অনুসরণে কোন মাযার নির্মাণ হয়নি। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ভক্ত-অনুরাগীরা তাঁর নামে মাযার তৈরী করে ধর্ম ব্যবসা শুরু করে।
শাহ্ মাওলানা মুয়াযযাম দাওলা দানিশমান্দ (র)-এর জীবনীঃ
শাহ্ মাওলানা মুয়াযযাম দাওলা দানিশ্মান্দ (রহঃ) (১৫১৮-১৯ সাল) ছিলেন অত্যন্ত উচ্চস্তরের সাধক পুরুষ। কথিত আছে যে, তিনি বাগদাদের খলীফা হারূনুর রশীদের জ্ঞাতী এবং বাগদাদের অধিবাসী ছিলেন। ৯২৪/২৫- ১৫১৮ সালে তিনি বাঘায় আগমন করেন। তাঁর পিতা শাহ্ আববাস বাগদাদীও ছিলেন অত্যন্ত উঁচু স্তরের বুযুর্গ। তিনি প্রাক্তন মুখদুমপুরের আলাবখস-এর কন্যা জেবুন্নিসাকে বিবাহ করেন। এই জেবুন্নিসার গর্ভে শাহ্ দানিশমান্দ (রহঃ)-এর চারটি পুত্র সন্তান লাভ করেন। আব্দুল হামিদ দানিশ্মান্দ (রহঃ) তাঁদের অন্যতম। তিনি বাঘাতে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন। দেশ-বিদেশে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৩০ খৃষ্টাব্দে শিক্ষা বিভাগের জরীপে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির উল্লেখ পাওয়া যায়।[8] ১৮৯৭ সালে ভয়াবহ ভূমিকম্পে বাঘা মসজিদের সঙ্গে মাদ্রাসাটিও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। মাদ্রাসা সংলগ্ন একটি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। বর্তমানে সেই গ্রন্থাগার বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছিলেন প্রখ্যাত পন্ডিত শের আলী। তাঁর উত্তরসূরীরা মাদ্রাসাটিকে নিযামিয়া কলেজে উন্নীত করেন। কথিত আছে ঢাকা যাওয়ার পথে একবার সম্রাট জাহাঙ্গীর-এর পুত্র শাহযাদা শাহযাহান পেটের কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হন। পীড়া দুরারোগ্য বোধ হওয়ায় যুবরাজ দানিশ্মান্দের খিদমতে উপস্থিত হন। পীর তাকে অলৌকিকভাবে আরোগ্য করেন। এতে খুশি হয়ে তিনি পীরকে ৪২টি গ্রাম লায়েবাজ দান করতে চান। তিনি স্বীকৃত না হওয়ায় তদীয় পুত্র শাহ্ দানিশ্মান্দ (র) গ্রহণ করতে রাযী হন। অতঃপর সম্রাট হয়ে শাহজাহান ৪২টি গ্রামের সনদ পাঠান। এটা পরে বাঘা ওয়াক্ফ স্টেটে পরিণত হয়। ওয়াক্ফ স্টেটের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মুহাম্মাদের নামানুসারে এটা রইস-ই- বাঘা নামে পরিচিত হয়। মসজিদের উত্তর পার্শ্বে শাহ্ মুহাম্মাদ রইসের মাযার অবস্থিত। এখানে বাগদাদের দুই সায়্যিদের আরো দুইটি ছোট মাযার আছে। ১৮০৬ সালে এই স্টেট ভারতের বড় লাট কর্তৃক স্বীকৃত প্রাপ্ত হয়। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে আমীরুল ইসলাম বাঘার ‘রইস’ উপাধিতে এই স্টেটে গদীনশীন ছিলেন।[9]
ইন্তিকালঃ মাওলানা শাহ্ মুয়াযযাম দাওলা দানিশ্মান্দ (রহঃ) বাঘাতে তাঁর মারকাযেই মৃত্যুবরণ করেন। প্রাচীর ঘেরা মসজিদ অঙ্গনের উত্তর পূর্ব কোনে মাওলানা শাহ্ দানিশ্মান্দ (রহঃ) ও মাওলানা শের আলীর মাযারও এই স্থানে আছে।
বাঘা মাযারের কার্যক্রম : রাজশাহী যেলার মধ্যে বাঘা থানা এটা একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান। বাঘা শাহী মসজিদের পাশাপাশি বাঘা মাযার ধীরে ধীরে প্রচার ও প্রসার লাভ করেছে। বাঘা মাযারে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা হ’তে বহু মানুষ সফর করতে আসে এবং ওরছে এসে দান ছাদকা করে। তারা মনে করে এখানে কিছু বাবার দরবারে দিলে বাবা খুশী হলে আমরা তার অসীলায় জান্নাতে চলে যাব। নিম্নে বাঘা মাযারের কিছু কার্যক্রম উল্লেখ করা হ’ল।
বাঘা মাযারের অবস্থানঃ বাঘা শাহী মসজিদের উত্তরে বাঘা মাযারের অবস্থান। পশ্চিমে ইসলামীয়া মাদ্রাসা ও একটি পুরাতন ৩টি গম্বুজ বিশিষ্ট ছোট মসজিদ আছে। তাতে কাতার একটি, তবে বর্তমানে সেটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। মাযারের পশ্চিমে কেন্দ্রীয় ঈদগাহ্ ময়দান অবস্থিত। দক্ষিণে বাঘা আলিয়া ফাযিল মাদ্রাসা ও পূর্বে বিরাট দীঘি-এর পূর্বে কেন্দ্রীয় কবরস্থান এবং একটি প্রতিবন্ধী স্কুল আছে। দক্ষিণে বাঘা শাহী মসজিদ থেকে শাহ্ দৌলা ডিগ্রী কলেজ-এর পশ্চিমে পৌরসভা অবস্থিত আছে।
বর্তমান বাঘাঃ বাঘা শাহী মসজিদের বর্তমান ইমামের নাম মুহাম্মাদ আশরাফ আলী। মুয়াযযিনের নাম মুহাম্মাদ শফীকুল ইসলাম এবং খাদেমের নাম মুকুল। হযরত শাহ্ সূফী আব্দুল হামিদ দানিশ্মান্দ কুতুবুল আফতাব (রহঃ)-এর কবরের সাথে আরো অনেকের কবর আছে। কবরের বাম পাশে মহিলাদের ছালাতের জায়গা আছে। মাযারের ভেতরে মোট ৩৩টি কবর আছে। এর বর্তমান সভাপতি খন্দকার মুনছুর আলী। তবে তাকে সবাই রইছ নামে চিনে। আরো দায়িত্বরত আছেন- (১) বাচ্চু মিয়া (২) মুহাম্মাদ নিযামুদ্দিন (এরা আপন দুই ভাই। এরা আগে এই মাযারের খাদের ছিল) এবং (৩) মুহাম্মাদ রওশন মিয়া। মাযারের সাথে একটি মসজিদ আছে। ইমামের নাম মুহাম্মাদ মহসীন আলী (প্রধান)। মুয়ায্যীনের নাম মুহাম্মাদ রকিবুল ইসলাম। তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হ’লে তারা বলল এসব কবর নাকি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর ছাহাবীদের কবর! তাদের অজ্ঞতা দেখে হতবাক হতে হয়। ইমাম মুহাম্মাদ মহসীন আলী বলেন, সম্রাট শাহ্জাহান-এর পুত্র এই বাঘা মসজিদে এসেছিলেন এবং তিনি এই মসজিদে জমি দান করেন। তখন ৪২টি মৌজা ছিল। প্রতিটি মৌজার জমি ছিল ২০০০ বিঘা। মোট ৮৪ হাজার বিঘা জমি তিনি দান করেছিলেন। বর্তমানে অধিকাংশ জায়গায় মানুষ বসতবাড়ি করে আছে এবং বাকি গুলো সরকারী খাস জমি হিসাবে আছে।
বাঘায় প্রতিবছর বার্ষিক মেলা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি বছর রামাযান মাসের শেষ দশদিন থেকে ঈদুল ফিতরের দশ দিন পর্যন্ত মেলা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিবছর মেলার ডাক হয় ২৫ লক্ষ টাকা। তার মধ্যে বাঘা পৌরসভা নেয় ৫ লক্ষ টাকা। আর বাকি ২০ লক্ষ টাকা মাযারের সভাপতির কাছে থাকে। ঈদুল ফিতরের তৃতীয় দিন মাযারের আশপাশের সবাইকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো হয়। মাযারের সভাপতি খন্দকার মুনছুর আলী খুব প্রভাবশালী কোটিপতি। তাঁর বাড়ি রাজশাহী শহরের ফায়ার সার্ভিসের সাথে।[10]
বাঘা মাযারের আয়ের উৎস হ’ল মানুষের দান, ছাদাক্বা, গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল এবং আমের বাগান ও দীঘির মাছ বিক্রয়।
প্রতি শুক্রবার দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসে বাঘা শাহী মসজিদে। আবার কেউ আসে দান ছাদক্বা করতে, দরবারে মানত করতে। কেউবা যিকরের আখড়া বানায়। মানুষ মন ভরে গান বাজনাও করে।
সেখানে গিয়ে দেখা যায়, মানুষ মাযারে সিজদা করছে। টাকা-পয়সা, ছাগল, গরু, ভেঁড়া, মহিষ, হাঁস, মুরগি, কবুতর ইত্যাদি দান করছে। বিশেষ করে মাযারের কবরের উপর প্রচুর পরিমান মানুষ টাকা পয়সা দান করছে। সে এক মহা জমজমাট ব্যবসার আয়োজন।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলতে চাই ভারতীয় উপমহাদেশে পীর- আওলিয়া কেন্দ্রিক মাযার ব্যবসা অতি জনপ্রিয়। এসব ঘিরে আড্ডা বসে কবর পূজারীদের। বাংলাদেশে পীর-আওলিয়া, মাযারের কারণে এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সঠিক ধর্ম থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে কবরে গিয়ে সিজদা করেছে। মানুষ ধারণা করে যে, কবরে সিজদা করলে আল্লাহ তা‘আলা এই পীর বাবার অসীলায় আমার সব গুনাহ খাতা মাফ করে দেবেন। অথচ যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না। আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন শুধুমাত্র তাঁর ইবাদত করার জন্য, অন্য কারও নয়। বাঘা মাযার হ’ল এদেশের অন্যতম ধর্মীয় ব্যবসা কেন্দ্র। অথচ মাযারের দেওয়ালে লেখা আছে ‘এখানে সিজদা করিবেন না’। তবুও মানুষ কবরে সিজদা করে ক্ষমা ভিক্ষা চাচ্ছে। মানুষকে অবশ্যই সচেতন হ’তে হবে যে, আসল ধর্ম কোনটি, যা মানুষকে জান্নাতের পথে নিয়ে যাবে। মানুষকেই হক্ব খুঁজে বের করতে হবে কোনটি ঠিক আর কোনটি বেঠিক। এটাই তাদের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা। অতএব আসুন! হক্ব খুঁজে হক্বের অনুসারী হয়ে পৃথিবী থেকে যেন আমরা ঈমানের সাথে বিদায় নিতে পারি। আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে যেন সত্য ও সঠিককে জানার তাওফীক দান করেন। আমীন!
লেখক : বাউসা হেদাতীপাড়া, বাঘা, রাজশাহী।
[1]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, দাওয়াত ও জিহাদ, পৃ. ৬।
[2]. ইসলামী বিশ্বকোষ ৪০৪ পৃ.।
[3]. বাঘা মাযারের সেই গেটের দরজার ডান পার্শ্বে বড় করে একটি সাইনবোর্ড ঝুলানো আছে।
[4]. তথ্যগুলো দিয়েছেন - (১) হাজী মুনছুরুদ্দীন, উত্তর মিলিক, বাঘা, বয়স ৭৭। (২) মোঃ আব্দুল কদ্দুছ, স্থানীয়, বয়স ৭২। (৩) মোঃ জামালুদ্দীন খান, স্থানীয়, বয়স ৬৬। এরা সবাই মাযার ভক্ত।