মৃত্যু যন্ত্রণার ভয়াবহতা
আব্দুর রহীম
ড. নূরুল ইসলাম 9110 বার পঠিত
الحمد لله رب العالمين والصلاة والسلام على سيد المرسلين وعلى آله وأصحابه أجمعين، أما بعد :
ভূমিকা :
ইসলামী কৃষ্টি-কালচার টিকে থাকার ব্যাপারে মাদরাসা, মক্তব ও সাংবাদিকতার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এজন্য ভারতের মুসলিম উম্মাহ ভারতে তাদের আগমনের সময় থেকেই ইলমে দ্বীনের প্রচার-প্রসারের ব্যাপারে চিন্তান্বিত ছিলেন। প্রত্যেক যুগে আল্লাহর এমন কিছু বান্দা মওজুদ ছিলেন, যারা তাদের গোটা জীবন ইসলামের খিদমতের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। বহু প্রতিকূল পরিস্থিতি সামনে এসেছিল, কিন্তু তারা হিম্মত না হারিয়ে ইসলাম ধর্মের প্রতিরক্ষায় সম্পূর্ণরূপে নিমগ্ন ও ব্যস্ত ছিলেন। ইসলামী মাদরাসাগুলির প্রতিষ্ঠা এবং পত্র-পত্রিকার প্রকাশ তারই একটা অংশ।
উপমহাদেশে আহলেহাদীছ জামা‘আতের জ্ঞানগত, রাজনৈতিক, সংস্কারমূলক ও তাবলীগী খিদমত এদেশের এক আলোকোজ্জ্বল অধ্যায়। এই জামা‘আত একদিকে যেমন মুসলমানদের আক্বীদাগত ও জ্ঞানগত গোমরাহী অবসানের জন্য চেষ্টা করেছে, অন্যদিকে তেমনি বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। সাথে সাথে গ্রন্থ রচনা, শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতার মাধ্যমে উপমহাদেশের জ্ঞান-গবেষণা আন্দোলনে গতি সঞ্চার করেছে।
নিকট ও দূর অতীতের অবস্থার প্রতি আমরা যখন দৃষ্টিপাত করব তখন জানতে পারব যে, আমাদের পূর্বসুরীরা সাংবাদিকতার মাধ্যমে জাতীয়, ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা সমূহ সমাধানের জন্য কেমন দিশারীর ভূমিকা পালন করেছেন। যেমন ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের পর ১৮৫৭ সালে দেশের স্বাধীনতার সৈনিকরা যখন সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে ময়দানে অবতীর্ণ হন, তখন সাংবাদিকতার মাধ্যমে পুরা ভারতবর্ষের জনগণের মাঝে স্বাধীনতার এমন রূহ ফুঁকে দেন যে, ভারতীয় জনগণ- চাই হিন্দু হৌক বা মুসলমান, মাথায় কাফন বেঁধে পথে নেমে আসে। এভাবে মাওলানা মুহাম্মাদ আলী জাওহারের ‘কমরেড’, মাওলানা আবুল কালাম আযাদের ‘আল-হেলাল’ ও ‘আল-বালাগ’, মাওলানা যা‘ফর আলীর ‘যমীনদার’, আগা সুরেশ কাশ্মীরীর ‘চাটান’ প্রভৃতি পত্র-পত্রিকা সমগ্র ভারতবর্ষের বাশিন্দাদের হৃদয়ে দেশের স্বাধীনতার এমন স্পৃহা সৃষ্টি করে দিয়েছিল, যা ব্রিটিশ সরকারকে ভারত ছাড়তে বাধ্য করেছিল। এ ব্যাপারে গোটা পৃথিবী অবগত আছে। এসব কীর্তি ঐসব পত্র-পত্রিকার অপরিসীম শক্তির নিদর্শন ছিল।
আহলেহাদীছ জামা‘আত সালাফী মাসলাকের যিম্মাদার। প্রত্যেক যুগে তারা সঠিকভাবে ইসলামী আক্বীদা ও ফিক্বহী মাসআলা-মাসায়েলের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে আসছে। বর্তমানে আমরা দেখছি যে, সাংবাদিকতা, গ্রন্থ রচনা ও সংকলনের ক্ষেত্রে আহলেহাদীছ জামা‘আতের নিকট ঐ মানদন্ড এখন মওজুদ নেই (যা পূর্বে ছিল)।
একটা সময় ছিল যখন শায়খুল ইসলাম মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ)-এর ‘আখবারে আহলেহাদীছ’ পত্রিকা হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল। মাওলানা আবুল কালাম আযাদের আল-হেলাল, আল-বালাগ এবং মাওলানা আব্দুল হালীম শারারের ‘দিলগুদায’ পত্রিকার স্রোতধারা (প্রচার-প্রসার) ঝর্ণাধারা থেকে অগ্রগামী ছিল। বর্তমানে আমাদের সাংবাদিকতা অনেক সীমিত হয়ে গেছে। অথচ আহলেহাদীছ জামা‘আতে পত্র-পত্রিকার কমতি নেই।
বাস্তবতা এই যে, যখন খালেছ নিয়ত এবং আল্লাহর বাণীকে সমুন্নত করার জন্য প্রবন্ধমালা লেখা হয়, তখন সেসব প্রবন্ধের একটা আলাদা মানদন্ড থাকে। সেগুলোর মান-মর্যাদা সর্বদা অবশিষ্ট থাকে। কিন্তু যখন এই অনুভূতি হারিয়ে যায় তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে এসব প্রবন্ধের কোন মর্যাদা অবশিষ্ট থাকে না।
১৯৬৩ সালে যখন জামে‘আ সালাফিইয়াহ, বেনারস (মারকাযী দারুল উলূম) প্রতিষ্ঠা লাভ করে, তখন তার অন্যতম একটা উদ্দেশ্য এটা ছিল যে, নিজেদের হিন্দুস্তানী পূর্বসুরীদের কীর্তিগুলোকে মানুষের সামনে তুলে ধরা। এজন্য ১৯৮০ সালে ‘মুতামারুদ দাওয়াহ ওয়াত তা‘লীম’ (দাওয়াত ও শিক্ষা সম্মেলন) নামে জামে‘আ একটি আন্তর্জাতিক মানের কনফারেন্সের ঘোষণা দেয়। সাথে সাথে এ উপলক্ষে শিক্ষকতায়, গ্রন্থ রচনায়, প্রচার ও সাংবাদিকতায় আহলেহাদীছ জামা‘আতের অবদান সংকলন করার মনস্থও করে এবং জামে‘আর কতিপয় শিক্ষককে তা সংকলনের দায়িত্ব প্রদান করে। জামে‘আর শিক্ষক মাওলানা আযীযুর রহমান সালাফীকে শিক্ষকতায় আহলেহাদীছ জামা‘আতের অবদান এবং আমাকে গ্রন্থ রচনায় অবদান লেখার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। আমরা দু’জন শিক্ষকতার পাশাপাশি নিজ নিজ কাজে লেগে যাই। মাওলানা আযীযুর রহমান শিক্ষকতায় অবদান সম্পন্ন করে জামে‘আর কাছে জমা দেন।
গ্রন্থ রচনায় আহলেহাদীছ জামা‘আতের অবদান লিপিবদ্ধ করার জন্য দেশ ও বিদেশের গ্রন্থাগারগুলোতে গেলে আমাদের পূর্বসুরীদের প্রকাশিত কিছু পত্র-পত্রিকাও আমি পাই। যার ফলে আমি ভাবি যে, এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে। এজন্য গ্রন্থ রচনায় আহলেহাদীছ জামা‘আতের অবদানের সাথে সাথে সাংবাদিকতায় অবদানও লিপিবদ্ধ করতে থাকব। যাতে আগামী প্রজন্ম এটা জানতে পারে যে, আমাদের পূর্বসুরীরা জনগণের দোরগোড়ায় ইসলামের শিক্ষাসমূহ পৌঁছানোর ক্ষেত্রে কেমন চেষ্টা ও মেহনত করেছেন।
সাংবাদিকতায় আহলেহাদীছ জামা‘আতের অবদান লিপিবদ্ধ করার সময় আমি নিমেণাক্ত বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি দিয়েছি।
১. পত্র-পত্রিকার প্রকাশকাল এবং সম্পাদকমন্ডলীর নাম। যদি কোন কারণে সম্পাদক পরিবর্তন হন তাহলে বিস্তারিতভাবে তা উল্লেখ করা। অতঃপর প্রত্যেক পত্র-পত্রিকার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও পর্যালোচনা পেশ করা।
২. সময়ের দৃষ্টিকোণ থেকে পত্র-পত্রিকাগুলোকে বিভক্ত করা। যেসব পত্র-পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে সেগুলোকে পুরাতন এবং যেগুলো চালু আছে সেগুলোকে নতুন শিরোনামের অধীনে উল্লেখ করা হয়েছে। অতঃপর প্রত্যেক অংশকে তার বিষয়বস্ত্তর দিক থেকে ৬ ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথম প্রকার ভ্রান্ত ধর্মগুলোর খন্ডন, দ্বিতীয় প্রকার শিরক, বিদ‘আত ও তাক্বলীদে শাখছীর খন্ডন, তৃতীয় প্রকার সাহিত্য ও ইতিহাস, চতুর্থ প্রকার সাহিত্য, রাজনীতি ও চরিত্র সংশোধন, পঞ্চম প্রকার ধর্মীয়, সংস্কারমূলক ও নৈতিক, ষষ্ঠ প্রকার আল্লাহর পথে জিহাদ।
এই বইয়ের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার জন্য গ্রন্থ রচনায় আহলেহাদীছ জামা‘আতের অবদান লিপিবদ্ধ করার পাশাপাশি আমাকে বহুবার পাক-ভারতের মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্যক্তিগত লাইব্রেরীগুলোতে ব্যাপক অনুসন্ধান চালাতে হয়েছে এবং পত্র-পত্রিকাগুলোর পাতা উল্টিয়ে দেখতে হয়েছে। এরপরেও এ বিষয়ে এ গ্রন্থের মর্যাদা প্রথম খন্ডের মতো। এখনো বহু আহলেহাদীছ আলেমের পত্র-পত্রিকা ছুটে যাচ্ছে। যেটা আমি অনুভব করছি। কিন্তু সেগুলো অনুসন্ধান করা অসম্ভব। কেননা আহলেহাদীছ জামা‘আতের নতুন নতুন পত্র-পত্রিকা বের হতে থাকবে।
এ বইটি আপনাদের সামনে আছে। আমার যোগ্যতা সম্পর্কে আমি অবগত আছি। ভুল-ত্রুটি মানুষের স্বভাবজাত। পাঠকবৃন্দের কাছে আরয হ’ল, বইয়ে কোন ভুলচুক দৃষ্টিগোচর হলে জানাবেন। কৃতজ্ঞ থাকব।
আহলেহাদীছ জামা‘আত এবং সাংবাদিকতা
(পুরাতন ও নতুন পত্র-পত্রিকা সমূহ) :
শিক্ষকতায়, গ্রন্থ রচনায় এবং ইসলামের প্রচার-প্রসারে আমাদের আহলেহাদীছ জামা‘আতের অবদান যেমন অন্যান্য জামা‘আতগুলোর তুলনায় বেশী, তেমনি সাংবাদিকতায় অবদানও কারো চেয়ে কম নয়। আমার জানা মতে এসব পত্র-পত্রিকার ৯৯টি পুরাতন এবং ৫০টি নতুন। এগুলি সময়ের বিবেচনায় প্রবন্ধমালা প্রকাশ এবং শিরক, বিদ‘আত ও বাতিল ধর্মগুলোর মূলোৎপাটন করে আসছে। আপনাদের নিকট ঐ সকল পত্র-পত্রিকার নামসমূহ, প্রকাশনা স্থান, সম্পাদকমন্ডলী, প্রকাশকাল এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সমূহ উল্লেখ করার পূর্বে তার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করা যুক্তিযুক্ত মনে করছি।
প্রেক্ষাপট :
১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ পুরা ভারতবর্ষকে পুরাপুরি কব্জা করে নেয়, দেশের মুজাহিদদেরকে নির্মূল করতে সফলতা অর্জন করে এবং নিশ্চিন্তভাবে দেশ শাসন করতে শুরু করে, তখন তাদের শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য এ সিদ্ধান্ত নেয় যে, টাকা-পয়সা ব্যয় সহ সকল উপায় অবলম্বন করে এখানকার বাশিন্দাদেরকে বিশেষ করে যুবকদেরকে খ্রিষ্টান ধর্মের দাওয়াত দিতে হবে। এই পরিকল্পনার আলোকে তারা হিন্দুস্তানে পাদ্রী ও সুন্দরীদের ফাঁদ পাতে। এবার খ্রিষ্টানদের ধোঁকা, টাকা-পয়সার লোভ এবং সুন্দরী খ্রিষ্টান যুবতীদের সঙ্গ হিন্দুস্তানের যুবসমাজের উপর অত্যন্ত খারাপ প্রভাব ফেলে। তাদের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বাড়তে থাকে। অর্থ ও সুন্দরী ললনাদের নিকট সস্তায় বিক্রি হওয়া অনেক যুবক ও মোল্লা খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে তার প্রচারে নেমে পড়ে। এমন নাযুক সময়ে আহলেহাদীছ জামা‘আতের এক কনফারেন্সে শায়খ গোলাম মহিউদ্দীন (কাছূরের উকিল, যেলা লাহোর) সকল আলেমকে বিশেষ করে আহলেহাদীছ আলেমদেরকে সম্বোধন করে বলেন, ‘এখন ইসলাম ও খ্রিষ্টবাদের মুকাবিলা চলছে। পাদ্রীদের আশংকা রয়েছে যে, কুরআন যদি উন্নতি করে ফেলে তাহলে মাসীহ-এর পুত্র ও উপাস্য হওয়া হোঁচট খাবে। এজন্য খ্রিষ্টানরা প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু আমরা মুসলমান হয়েও নিদ্রাবিভোর হয়ে আছি। এখন পাঁচশ খ্রিষ্টান মহিলা প্রচারের কাজ করছে। পুরুষদের কথা বাদই দিলাম’।[1]
এ বক্তব্যের ফলে আহলেহাদীছ আলেমদের মধ্যে আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয় এবং তারা কোমর বেঁধে সাহসের সাথে ময়দানে নেমে পড়েন। নিজেদের বক্তব্য ও লেখনী এবং বই ও প্রচারপত্রের মাধ্যমে ধাবমান এই স্রোতকে বাধা দিতে আত্মনিয়োগ করেন। যার ফলে খ্রিষ্টানদের রাজপ্রাসাদে ভূমিকম্প শুরু হয়ে যায়। এ বিষয়ে আফসোস করে কলকাতার সিভিল সার্ভিস পুলিশ কমিশনার এইচ.জে. কাটন তার New India গ্রন্থে লিখেছেন যে, ‘যেখানে কোন সুন্দর ধর্মীয় আলোচনা হ’ত সেখানে খ্রিষ্টান ধর্ম খ্রিষ্টান বানাতে ব্যর্থ হ’ত এবং সংখ্যা বেশী বাড়াতে পারত না’।[2]
ইংরেজরা যখন তাদের এই মিশনে ব্যর্থ হ’ল, তখন দ্বিতীয় অস্ত্র এটা ব্যবহার করল যে, কতিপয় ঈমান বিক্রেতা আলেমকে তৈরী করে কিছু মাযহাবী ঝগড়া দাঁড় করিয়ে দিল। যেমন ব্রেলভী, কাদিয়ানী, বাহাঈ এবং প্রক…ৃতবাদী জাতীয় ফিরকাগুলো মুসলমানদের মধ্যে জোরেশোরে উঠে দাঁড়াল এবং সাথে সাথে আর্য ধর্মও মাথাচাড়া দিল। এমন নাযুক সময়ে আহলেহাদীছ আলেমগণ পরামর্শ করে এই সিদ্ধান্ত নিলেন যে, শুধু ওয়ায-নছীহত, বই, প্রচারপত্র এবং অন্যদের পত্র-পত্রিকার উপর নির্ভর করে ধর্মহীনতার এই শ্রোতকে রোখা সম্ভব হবে না। নিজেদের এবং নিজেদের জামা‘আতেরও পত্র-পত্রিকা থাকা দরকার।
অতএব দ্রুত আল্লামা আবূ সাঈদ মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভী (১৮৪১-১৯২০) ‘ইশা‘আতুস সুন্নাহ’ নামে একটি মাসিক এবং মোল্লা মুহাম্মাদ বখশ লাহোরী ‘জা‘ফর যেটলী’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। মোল্লা বখশ লাহোরী যখন তাঁর উক্ত পত্রিকাকে প্রকৃতিবাদী (নাস্তিক)দের জন্য নির্দিষ্ট করে দেন, তখন শায়খুল ইসলাম আল্লামা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী ‘মুসলমান’ নামে একটি মাসিক এবং ‘আখবারে আহলেহাদীছ’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করে দেন। অতঃপর প্রয়োজন অনুপাতে অন্যান্য পত্র-পত্রিকা বের হ’তে থাকে। এবার আহলেহাদীছ আলেমগণ পরিপূর্ণরূপে তাদের ওয়ায-নছীহত, বাহাছ-মুনাযারা, বই ও প্রচারপত্র এবং পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে ইসলামের দুশমনদের মুকাবিলায় বুকটান করে দাঁড়িয়ে গেলেন। আর তাদের সকল হামলা পিছিয়ে দিয়ে অধিকাংশ মুসলমানকে গোমরাহী থেকে মুক্তি দেন। যার উপর কেবল বিভিন্ন ঘরানার ইসলামী চিন্তাবিদরাই নন; বরং আর্য সমাজের একজন পন্ডিতও প্রশংসা না করে পারেননি।
উদাহরণস্বরূপ শুধু ‘আখবারে আহলেহাদীছ’-এর সম্পাদক শায়খুল ইসলাম আল্লামা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী সম্পর্কে আহলেহাদীছ নন এমন দু’জন ইসলামী চিন্তাবিদ এবং একজন আর্য সমাজনেতার উদ্ধৃতি আপনাদের সামনে পেশ করা যুক্তিযুক্ত মনে করছি।
(১) কাযী মুহাম্মাদ আদীল আববাসী এডভোকেট বাস্তী লিখেছেন যে, ‘পঞ্চান্ন বছরের বেশী হয়েছে। আমার তরুণ বয়সে যখন আমি সরকারী হাইস্কুল বাস্তীতে পড়াশুনা করছিলাম। এমন সময় আর্য সমাজের পক্ষ থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে জোরেশোরে সমালোচনার বজ্রবৃষ্টি শুরু হয়। মনে হ’ত কোন শত্রু পুরাপুরি অস্ত্রে-শস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে ইসলামের দুর্গে এমনভাবে গোলা বর্ষণ শুরু করে দিয়েছে যে, এখন তার বাঁচা যাবে না। আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দজী একজন পরিচ্ছন্ন মনের মানুষ ছিলেন। তিনি বিয়ে করেননি। হিন্দু ধর্মের পরিভাষায় তিনি বাল ব্রহ্মচারী ছিলেন। এজন্য তার গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা বেড়ে গিয়েছিল। তিনি ‘বেদ’কে প্রথম ও শেষ ঐশীবাণী আখ্যা দিয়ে মূর্তিপূজাকে ভুল আখ্যা দেন এবং একত্ববাদের ধ্বনি উচ্চারণ করেন। তিনি হিন্দুদের ধর্মীয় পুস্তকগুলোকে অস্বীকার করেন এবং শ্রী সীতারাম ও কৃষ্ণ মহারাজকে ছেড়ে ‘ওম’ (আল্লাহ)-এর ডংকা বাজান। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময়কে ইবাদতের সময় বলে আখ্যা দেন। মূর্তিবিহীন সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যায় পূজার (سندهيا) পদ্ধতি বাৎলিয়ে দেন। অর্থাৎ হাঁটু গেড়ে বসে যান এবং ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে পড়েন। আসলে ইসলামের বিপরীতে এটি একটি ভারসাম্যপূর্ণ রীতি ছিল এবং প্রত্যেকটি পদক্ষেপে ইসলামের বিরোধিতা উদ্দেশ্য ছিল। নিজ ধর্মে এই নির্মাণ ও সংস্কার কার্যক্রম থেকে মুক্ত হয়ে তিনি ইসলামকে ধ্বংসের দিকে মুখ ফিরান এবং ‘বিসমিল্লাহ’ থেকে ‘ওয়ান্নাস’ পর্যন্ত গোটা কুরআনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেন। তিনি নিজ দলের মধ্যে এমন জোশ সৃষ্টি করে দেন যে, তাদের মধ্যে বিজয় ও বিশ্বাস সৃষ্টি হয়ে যায়। স্বমীজীর অভিযোগগুলো অগভীর ছিল না। বরং সেগুলোর মধ্যে গভীরতা ছিল। তিনি সর্বদা নিজেও গাম্ভীর্যপূর্ণ ছিলেন। ইসলামকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপও করতেন। এর মাধ্যমে তার উদ্দেশ্য এটা ছিল যে, তিনি মুসলমান যুবকদের মনে সন্দেহকে ঘনীভূত করে দিবেন। তিনি নিজ থেকে প্রত্যেকটি কথা চিন্তা-ভাবনা করে মন-মগজের উপর হামলাকারী ছিলেন। হামলা এমন অকস্মাৎ এবং জোরেশোরে ছিল যে, মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার হয়। অবস্থাদৃষ্টে এমন মনে হচ্ছিল যে, ইসলামের দুর্গের খুঁটিগুলি এই ঝড়ের মুকাবিলা করতে পারবে না এবং উপড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। বস্ত্ততঃ নতুন হিন্দু ধর্মকে তিনি সংস্কারকের ধাঁচে যে সুসংবদ্ধ করেছিলেন, তার মূলনীতি ও শাখা-প্রশাখা সমূহ সবই ছিল ইসলাম থেকেই নেওয়া।
মাওলানা ছানাউল্লাহর আবির্ভাব :
হৃদস্পন্দন রহিতকারী এই ভূমিকম্পসদৃশ অবস্থায় একজন মর্দে মুজাহিদের আবির্ভাব ঘটে। যিনি সামগ্রিক গুণে গুণান্বিত ছিলেন। তিনি ছিলেন আলেম, গভীর জ্ঞানের অধিকারী, মুফাসসির, মুহাদ্দিছ, বাগ্মী, তার্কিক, গবেষক, চিন্তাবিদ, লৌহ মানব, দৃঢ় বিশ্বাসের প্রচারক এবং দৃঢ় চিত্তের বার্তাবাহক।
اگر ہو رز م تو شيران غاب كے مانند
دگر ہو بزم تو رعنا غزال تا تارى
কবি বলেন,
যদি হয় যুদ্ধ তবে বনের সিংহের মতো
আর যদি হয় মজলিস, তবে চঞ্চল তাতারী হরিণের মতো।
তিনি ঘৃণার জবাব ভালবাসার মাধ্যমে, হাসি-ঠাট্টার জবাব গাম্ভীর্যের মাধ্যমে, ক্রোধের জবাব মুচকি হাসির মাধ্যমে এবং জটিল প্রশ্নের জবাব প্রমাণপঞ্জিসহ এমনভাবে দেন যে, প্রতিটি পদক্ষেপে সবদিক থেকে আওয়ায আসতে থাকে-
چوں بشنوى سخن اہل دل مگو كہ خطا است
سخن شناس نئی دلبرا خطا ايں جا است
কবি বলেন,
যখনই বিষ্ণুভক্ত বলবে না যে, এটি ভুল,
তখনই বাক্যদর্শী নতুন প্রেমিক বলবে যে, ভুল তো এখানেই!
ইনি ছিলেন যুগ সংস্কারক, মহান মুবাল্লিগ, বড় মুহাক্কিক মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (আল্লাহ তাঁর কবরকে আলোকিত করুন)। এ যুগের নতুন মুসলিম বংশধরদের প্রতি তাঁর ইহসান অপরিসীম। আজ আমরা যদি এই ধরাধামে ঈমান ও ইয়াক্বীনের (দৃঢ় বিশ্বাস) দ্বারা সৌভাগ্যবান হয়ে থাকি, তাহ’লে এটা সেই মর্দে মুজাহিদের অসীলায়। আগামী বংশধরগণের উপর তাঁর ইহসান যথারীতি বাকী আছে এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত বাকী থাকবে।
ইসলামের এই সিপাহসালার যখন যুদ্ধের ময়দানের দিকে রওয়ানা হলেন, তখন তাঁর চারপাশে খ্যাতিমান আলেমগণ দলে দলে একত্রিত হয়ে গেলেন...। ‘সত্যার্থ প্রকাশ’-এর[3] জবাব ‘হক প্রকাশ’ একটি এ্যাটম বোমা ছিল। যেটি সকল সমালোচনাকে ধোঁয়ার মত উড়িয়ে দিল। আমি এমন দিনও দেখেছি যখন আর্য সমাজভুক্ত আমার সহপাঠীরা ইংরেজী ভাষায় আমাদেরকে বলত, ‘নিজ (হিন্দু) ধর্ম ত্যাগ কর। এতে কোন সত্যতা নেই’। আর এটাও দেখেছি যে, মৌলভী মুহাম্মাদ ওমর একটি টুল হাতে নিয়ে এবং বাজারে তার উপর দাঁড়িয়ে চিৎকার দিয়ে আহবান জানাতেন, এসো মুনাযারা কর। তিনি এটাও বলতেন যে, দিওরিয়া মুনাযারার পরে (যেই বিশাল রণক্ষেত্রের বীর যোদ্ধা ছিলেন মাওলানা ছানাউল্লাহ) আশা ছিল না যে, আর্য সমাজ পুনরায় ময়দানে আবির্ভূত হবে। অথচ বর্তমানে এমন অবস্থা যে, মুসলমান বাচ্চাদেরকে বলা হয়, ‘নিজ ধর্ম ত্যাগ কর। এতে কোন সত্যতা নেই’।
ফলকথা এই যে, এভাবে সারা ভারতবর্ষ ঈমান ও ইয়াক্বীনের আলোতে আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠে। তিনি এমনভাবে কথা বলতেন যে, তা মনে প্রভাব বিস্তার করত। যুক্তিপূর্ণ দলীলসমূহ এত মযবূত হত যে, তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকত না। মাওলানা শুধু আহলেহাদীছদের ছিলেন না; বরং তিনি পুরা মুসলিম মিল্লাতের (সম্পদ) ছিলেন’।[4]
(২) মাওলানা আব্দুল মাজেদ দরিয়াবাদী (১৮৯২-১৯৭৭) লিখেছেন যে, ‘আমি ঐ সময় মাওলানার নাম জেনেছিলাম যখন এক মুরতাদের বই ‘তারকে ইসলাম’ (ইসলাম ত্যাগ)-এর কারণে আমার অন্তর অত্যন্ত দগ্ধীভূত ছিল। স্বল্প সময়ে ‘তুরকে ইসলাম’ (ইসলামের সৈনিক) নামে মাওলানা তার জবাব লিখেছিলেন। সৈনিকের জবাবে মুরতাদ তখনই শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং অবশেষে নতুনভাবে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে হয়েছিল।[5] আমি তখন স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম এবং বয়স ১১ বছরের বেশী ছিল না। এক হিন্দু ছেলের কাছ থেকে ‘তারকে ইসলাম’ নিয়ে এক ঝলক দেখে নিয়েছিলাম এবং এতে সমস্ত শরীরে আগুন ধরে গিয়েছিল। কিছুদিন পরেই ‘তুরকে ইসলাম’ দেখার সৌভাগ্য হয় এবং এটি ক্ষতের উপরে ঠান্ডা মলম লাগিয়ে দেয়। এটা ১৯০২ বা ১৯০৩ সালের গোড়ার দিকের কথা। তখন থেকেই আমার মন মাওলানার অত্যন্ত ভক্ত-অনুরক্ত হয়ে গিয়েছিল। তাঁর লেখনী এই ভক্তি বৃদ্ধি করতেই থাকে। তাঁর সাপ্তাহিক ‘আহলেহাদীছ’ও কিছুদিন পরে পড়া শুরু করে দেই। আক্বীদাগত গোঁড়ামিতে বহু বছর পর মধ্যমপন্থা ও ভারসাম্য সৃষ্টি হয়েছিল। মাওলানার উর্দূ তাফসীরও সংক্ষিপ্ত তাফসীরগুলোর মধ্যে ভাল। কিন্তু আরবী তাফসীরের মর্যাদা এর চেয়ে বেশী। এতে তিনি কুরআনের তাফসীর কুরআন দিয়েই করেছেন। একই মর্মের আয়াতগুলি সুন্দরভাবে একই স্থানে পাওয়া যায়। মুনাযারা শিল্পের তো বলা চলে তিনি ইমাম ছিলেন। বিশেষ করে আর্য সমাজের অনুসারীদের মুকাবিলায়। যারা মন্দ বুঝ ও জ্ঞানহীনতার পাশাপাশি গালমন্দকারীও ছিল। বিংশ শতকের শুরুতে তাদের ফিৎনা সে সময়ের সবচেয়ে বড় ফিৎনা ছিল। যদি মাওলানা ছানাউল্লাহ তাদের সামনে না আসতেন, তাহলে আল্লাহ জানেন মুসলমানদের উপর ভর করা ভয়-ভীতি কতদূর গিয়ে ঠেকত। প্রতিপক্ষের নাড়ি-নক্ষত্র জানার ব্যাপারে মাওলানা অনেক অগ্রগামী ছিলেন। এমন কথা খুঁজে বের করতেন যে, আর্য সমাজীরা দিশেহারা হয়ে যেত। কত যে মুনাযারা করেছেন[6] এখন তা মনে নেই। সব জায়গায় তিনি বিজয়ীই থাকতেন।
এক জায়গায় আর্য সমাজের এক খ্যাতিমান তার্কিক বিতর্কের শুরুতেই উরুতে হাত মেরে বলে ফেলেন যে, ‘আপনি মুসলমানই বা কখন হ’লেন যে ইসলামের প্রতিনিধি হয়ে এসেছেন। মুসলমান আলেমদের ফৎওয়াগুলি দেখুন! এগুলি সব আপনাকে কাফের সাব্যস্ত করার ব্যাপারে’। এ কথা বলে টেবিলের ওপরে ঐ ফৎওয়াগুলোর গাদা বিছিয়ে দেন। মাওলানা ধৈর্যের সাথে নিজের কাফের হওয়ার ডুগডুগি শুনতে থাকেন। অতঃপর তিনি কথা শেষ করার সাথে সাথে মাওলানা জোরে বলে ওঠেন, ‘ঠিক আছে জনাব! আমি এখন মুসলমান হচ্ছি। আপনারা সব মুসলমান সাক্ষী থাকেন যে, আমি আপনাদের সবার সামনে কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করছি, أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا رَّسُولُ اللهِ ‘আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল’। এখন বলুন, আর তো কোন অজুহাত বাকী থাকল না। মুসলমানরা খুশীতে বাগবাগ হয়ে গেল। আর্য তার্কিকের পক্ষ থেকে আর কোন উত্তর এল না। এরপর মাওলানা নিজের কাজ শুরু করে দিলেন।
তিনি খ্রিষ্টানদের সাথে মুকাবিলা করার জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্ত্তত থাকতেন। সে সময়টাও ছিল বাহাছ-মুনাযারার। আর্য সমাজের লোকেরা খ্রিষ্টানদের কাছ থেকে মুসলমানদের মুখোমুখি হওয়া শিখেছিল। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই খ্রিষ্টান মিশনারীরা মুসলমানদের পিছে লেগেছিল। খ্রিষ্টানদের সাথে মুকাবিলা করার জন্য মাওলানা সম্ভবতঃ কিছু ইংরেজীও শিখে নিয়েছিলেন। যদি ইংরেজী আরেকটু বেশী অধ্যয়ন করতেন তাহলে স্বীয় শিল্পে অতুলনীয় হয়ে যেতেন। কালেমা পাঠকারী ফিরকাগুলোর মধ্যে আহমাদিয়াদের (কাদিয়ানী) দিকে মনোযোগ থাকত বেশী । এমনকি একবার তো পুরস্কার ঘোষিত এক বিতর্কে কাদিয়ানী প্রতিদ্বন্দ্বীর নিকট থেকে পুরস্কারও জিতেছিলেন’। [7]
(৩) আর্য পন্ডিত ধর্মপাল লিখেছেন যে,
‘যখন মৌলভী নূরুদ্দীন কাদিয়ানী ‘নূরুদ্দীন’ নামক বইয়ের মাধ্যমে এবং মৌলভী ছানাউল্লাহ ছাহেব ‘তুরকে ইসলাম’ নামক বইয়ের মাধ্যমে ইসলাম ও মোল্লাইযমের (ব্যক্তির মত বা আলেমদের তাক্বলীদ) মধ্যে পার্থক্য রেখা টেনে দেন, তখন আমার রচনাবলীর মূল্য একটা দিয়াশলাই-এর মতো থেকে যায়। আমার অভিযোগগুলোর জবাব দেয়ার ক্ষেত্রে ‘নূরুদ্দীন’-এর লেখকের নিশানা ইলমী তথ্যাবলীর কারণে নির্ভুল হত। কিন্তু ‘তুরকে ইসলাম’-এর আঘাত আমাকে বেশী কষ্ট দিত। আমি প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে তাফসীরের ভিতের উপর যে দুর্গ নির্মাণ করতাম, তিনি স্রেফ এ বাক্যটুকু বলেই তা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতেন যে, ‘তাফসীরের জওয়াব তাফসীর লেখকদের কাছ থেকে নাও। কুরআন মাজীদ এর যিম্মাদার নয়’। এই একটিমাত্র বাক্য আমার ‘তারকে ইসলাম’ ও আমার অন্য আরেকটি রচনা ‘তাহযীবুল ইসলাম’-কে চালুনি করে দেয় এবং আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি যে, ‘নূরুদ্দীন’-এর লেখকের সাথে বিতর্ক চলতে পারে, কিন্তু ‘তুরকে ইসলাম’-এর লেখকের সাথে বিতর্ক চলা মুশকিল। যিনি মোল্লাইযমকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকারকারী। মজার ব্যাপার হ’ল ‘নূরুদ্দীন’-এর লেখক আমার বিরুদ্ধে দ্বিতীয়বার কলম ধরেননি। অথচ আমি আশা করেছিলাম যে, তার সাথে বিতর্ক অব্যাহত থাকুক। কিন্তু ‘তুরকে ইসলাম’-এর লেখক ‘তাহযীবুল ইসলাম’-এর জবাবে আবার কলম ধরেন। তখন আমি ‘তুরকে ইসলাম’-এর লেখকের মুকাবিলায় পুনরায় কলম ধরতে অস্বীকার করি। এভাবে আমাদের প্রথম যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে’।[8]
‘আমার গত এক বছরের কাউকে কষ্ট না দেয়া জীবন আমার মুসলমান ভাইদের মনেও আমার জন্য এমন মহববত সৃষ্টি করে দেয় যে, যখন তারা আমার অসুস্থতার কথা জানে তখন তারা দলে দলে আমার কাছে আসতে শুরু করে। তন্মধ্যে মৌলভী ছানাউল্লাহ ছাহেবের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মৌলভী ছাহেবের সাথে লিখিত যুদ্ধ তো বছরের পর বছর চলতে থাকত। কিন্তু মুখোমুখি হওয়ার সম্ভবতঃ এটাই প্রথম সুযোগ ছিল। যেটাকে একটা সুবর্ণ সুযোগই বলতে হবে। যদিও সেটা অসুস্থ অবস্থায় এসেছিল।
মৌলভী ছাহেব স্বভাবগতভাবে রসিক মানুষ। এজন্য বুঝতে হবে যে, একদিকে যেমন তারকে ইসলাম, তাহযীবুল ইসলাম বরং নাখলে ইসলাম-এর লেখক বিছানায় অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে, অন্যদিকে তেমন তুরকে ইসলাম, তাগলীবুল ইসলাম (৪ খন্ড) বরং তিবরে ইসলাম (ইসলামের কুঠার)-এর লেখক তার বালিশের পাশে বসে তার সেবা-শুশ্রুষা করছেন। সেখানে যদি আকাশ ও যমীনের ফেরেশতামন্ডলী আনন্দচিত্তে নিমেণাক্ত কবিতা পড়তে থাকেন, তাহ’লে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।
شكر ايزد كہ ميان من دادصلح فتاد
حورياں رقص كناں ساغر شكرا نہ زدند
কবির কথায়-
আল্লাহর শোকর যে, আমার মধ্যে সন্ধির ফরিয়াদ এসে গেছে
মদের পেয়ালা নিয়ে হুর-পরীগণ শুকরিয়ার নাচ নাচছে।
ইতিপূর্বে আমার এরূপ ধারণা ছিল যে, মৌলভী ছানাউল্লাহ, যিনি আহমাদিয়া ফিরকার সাথে মোল্লাদের মতো ঝগড়াঝাটি করে থাকেন, তিনি নিজেও কোন কাটমোল্লা হবেন। এ কারণে তাঁর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমি কখনো তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে চাইতাম না। কিন্তু প্রথম সাক্ষাতেই জেনে যাই যে, মৌলভী ছানাউল্লাহ একজন খোশ মেযাজী, রসিক, সুন্দর এবং চরিত্রবান ভদ্র মানুষ (Gentleman)। আল্লাহ তাকে একটা চিত্তাকর্ষক স্টাইল দিয়েছিলেন। সত্য তো এটাই যে, এই ‘ইয়াকুব পুত্র’কে দেখে আমার মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে বেশ সময় লেগে যায়। মৌলভী ছানাউল্লাহ প্রতি তিনদিন পর আমার খবর নেয়ার জন্য লাহোর আসতেন’।[9]
‘কিছুদিন পর আমার আবার মোল্লাইযমকে উসকানোর চিন্তা মাথায় আসে। এবার আমি ইতিহাসের বই সমূহের সাহায্য নেই এবং ‘নাখলে ইসলাম’ নামে বিদ্রুপাত্মক একটি বই প্রকাশ করি। আর্য সমাজের পত্রিকাগুলো অত্যন্ত জোরালো ভাষায় এই বইয়ের পর্যালোচনা করে এবং মুসলিম পত্রিকাগুলো এর বিরুদ্ধে হৈচৈ ফেলে দেয়। আমি চাচ্ছিলাম যে, পুরানো ধ্যান-ধারণার মোল্লা টাইপের মানুষ আমার মুকাবিলায় আসুক। যাতে আমার এ কথা জানার সুযোগ হয় যে, তারা ঐ সকল বক্তব্যের কি উত্তর দেয়। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য এবারও ঐ ‘তুরকে শীরাযী’ (শীরাযের বীর সৈনিক) একথা বলে জবাব দেন যে, ‘কুরআন মাজীদ বা ইসলাম কোন ইতিহাস বা তাফসীরের জবাব দানকারী নয়’।
‘নাখলে ইসলাম’ (ইসলামের খর্জুর বৃক্ষ)-কে (আমার আরেকটি বইয়ের নাম) ‘তিবরে ইসলাম’ (মাওলানার পক্ষ থেকে তার জবাব) আঘাত করতে থাকে। এভাবে পুরানো ধ্যান-ধারণার যেসব মোল্লাকে উসকানোর জন্য আমি এটা দ্বিতীয় চেষ্টা করেছিলাম, তারা পুনরায় বেঁচে যায়।
অবশেষে যখন আমি দেখলাম যে, মোল্লাইযম-এর অনুসারীরা তো ময়দানে আসে না এবং যে ময়দানে আসে সে মোল্লাইযমকে মানে না। তখন আমি ঐ সকল বির্তকের চূড়ান্ত ফায়ছালা করে ফেলি এবং ‘তারকে ইসলাম’ থেকে শুরু করে আমার সর্বশেষ রচনা পর্যন্ত যত বই ছিল সেগুলোকে আমি ১৯১১ সালের ১৪ই জুন জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দেই’ (এবং নিজের মুসলমান হওয়ার ঘোষণা দেই)।[10] (ক্রমশঃ)
[লেখক : সাবেক শায়খুল জামে‘আহ, জামে‘আ সালাফিইয়াহ, বেনারস, ভারত। অনুবাদক : গবেষণা সহকারী, হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এবং ভাইস প্রিন্সিপ্যাল, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী]
[1]. রোয়েদাদে কনফারেন্স অমৃতসর বা অমৃতসর কনফারেন্সের রিপোর্ট।
[2]. New India (London : 1885), p.155.
[3]. বাংলাদেশের কৃতীসন্তান মুন্সী মেহেরুল্লাহ (যশোর) উক্ত গ্রন্থের জবাবে ‘হিন্দু ধর্ম রহস্য’ ও ‘বিধবা গঞ্জনা’ নামে দু’টি গ্রন্থ লিখেছিলেন (মুহিউদ্দীন খান, জীবনের খেলা ঘরে (আত্মজীবনী) ( ঢাকা : মদীনা পাবলিকেশন্স, ৫ম সংস্করণ, ২০১৪), পৃঃ ৭০।- অনুবাদক।
[4]. আখবারে আহলেহাদীছ, ২১শে নভেম্বর ১৯৭১।
[5]. আব্দুল গফূর নামে এক ব্যক্তি মাহবূবে আলম ইসলামিয়া হাইস্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। তার সাথে আর্য সমাজের এক মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। মেয়েটি তাকে বলে, আমি আর্য সমাজী আর তুমি মুসলমান। এমতাবস্থায় তোমার ও আমার সম্পর্ক কিভাবে চলতে পারে? ফলে মাস্টার ছাহেব ইসলাম ধর্ম ত্যাগের ঘোষণা দেন। সে সময় আর্যদের স্কুল ছিল গোরকল। বর্তমানে এটি ইকবাল হাইস্কুল নামে পরিচিত। সেখানে গিয়ে তিনি ইসলামের বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রদান করেন। আর্য সমাজীরা মাস্টার ছাহেবের নাম আব্দুল গফূরের পরিবর্তে ধর্মপাল রেখে দেয়। এতে মুসলমানদের মধ্যে ক্ষোভ ধূমায়িত হলে আর্যসমাজীরা ধর্মপালকে গুজরানওয়ালা (পাকিস্তান) থেকে লুধিয়ানায় পাঠিয়ে দেয়। সেখানে গিয়ে তিনি ‘তারকে ইসলাম’ (ইসলাম ত্যাগ) নামে একটি বই লিখেন। এর জবাবে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী ‘তুরকে ইসলাম’ (ইসলামের সৈনিক) শীর্ষক গ্রন্থটি রচনা করেন। তাঁর প্রচেষ্টা ও সুন্দর চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে ধর্মপাল পুনরায় মুসলমান হন। এবার তার নাম রাখা হয় গাযী মাহমূদ। হাজীপুরা মহল্লার লোকজন গাযী মাহমূদকে পুনরায় গুজরানওয়ালায় বাবু আতা মুহাম্মাদ ছাহেবের বাংলোতে অনুষ্ঠিত জালসায় দাওয়াত দেয়। তিনি সেখানে আর্য সমাজের বিরুদ্ধে এবং ইসলামের পক্ষে লা-জওয়াব বক্তব্য পেশ করেন। উক্ত জালসার সভাপতি ছিলেন মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (আবুল বাশীর আব্দুল্লাহ, তারীখে আহলেহাদীছ (শহর গুজরানওয়ালা), (লাহোর : উমনী প্রিন্টার্স, ১৪০১ হিঃ/১৯৮০ খৃঃ), পৃঃ ১০-১৩)।- অনুবাদক।
[6]. মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী পঞ্চাশের অধিক মুনাযারা করেছেন (পাক্ষিক তারজুমান, দিল্লী, ৩৬/২০ সংখ্যা, ১৬-৩১শে অক্টোবর, ২০১৬, পৃঃ ২৬)।-অনুবাদক।
[7]. মাওলানা আব্দুল মাজেদ দরিয়াবাদী, মু‘আছিরীন (কলকাতা : কোহে নূর আর্ট প্রেস), ১২৪ পৃঃ।
[8]. আল-মুসলিম, ডিসেম্বর ১৯১৪, পৃঃ ৩৯৩।
[9]. আন্দার, ডিসেম্বর ১৯১২, পৃঃ ৯২। এটি গাযী মাহমূদের একটি মাসিক পত্রিকা ছিল।
[10]. আল-মুসলিম, ডিসেম্বর ১৯১৪, পৃঃ ৩৯৩।