পর্ণোগ্রাফীর আগ্রাসন ও তা থেকে মুক্তির উপায় (২য় কিস্তি)
মফীযুল ইসলাম
লিলবর আল-বারাদী 10315 বার পঠিত
ভূমিকা :
মানুষ শিশুকালে এমন অসহায় ও মুখাপেক্ষী যে তার নিজের কোন কাজ করার শক্তি থাকে না, পিতামাতার এই সময় সন্তানদেরকে অতি যত্নে লালন-পালন করেন। তারা কখনও বিরক্ত বোধ করেন না। যদি কখনও রাগ করেন পরক্ষণেই পরম মমতায় সন্তানকে বুকে জড়িয়ে নেন। আদরে-সোহাগে শান্ত হয় সন্তান। পিতামাতা নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাওয়ায়, নিজের প্রতি খেয়াল না করে সর্বদা তার সন্তানের চিন্তায় মশগুল থাকে। কিভাবে সন্তান মানুষের মত মানুষ হিসাবে গড়ে উঠবে? পিতামাতা পৃথিবীর সব কিছু ছাড় দেন তার সন্তানের কল্যাণ চিন্তায়।
অথচ সন্তান কি করে? যখন সে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়, তখন ভুলে যায় পিতামাতার কথা। যেমনটি পশু-পাখিরা করে থাকে। বৃদ্ধ পিতা-মাতা তাদের কাছে বোঝা হয়ে যায়। তাদেরকে নিজেদের কাছে রাখতে চায় না। তাদের বিষয়ে চরম অবহেলা করে, তাদেরকে সমাজে চলার অযোগ্য মনে করে। অফিসের বস-কলিগদের সাথে পরিচয় করে দিতেও লজ্জাবোধ করে। কারণ পিতা-মাতা সেকেলে, তারা আয় করতে পারে না। ভরণ-পোষণ ও চিকিৎসা খরচ অনেক, তাদের চিন্তা-চেতনা প্রগতিশীল নয়। তাদের সংস্পর্শে নতুন প্রজন্ম বড় হ’লে নিচু মনের হবে। সারাক্ষণ তারা এটা সেটার চাহিদা করে, সর্বদা বকবক করে, তারা সংসারের বোঝা। বাসায় নেওয়ার মত যথেষ্টও ঘর নেই। এরকম সহস্র অযুহাতে অপদার্থ ছেলে-মেয়েরা পিতামাতাকে একটি নিরাপদ স্থানে ফেলে আসে। যার নাম বৃদ্ধাশ্রম। বৃদ্ধাশ্রমে রাখার পর তাদের কোন খোঁজ-খবর রাখার প্রয়োজনও বোধ করে না। তাই এভাবে ধুঁকে ধুঁকে পিতা-মাতা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে তখন সন্তান তার অবহেলিত পিতা-মাতাকে বেশী বেশী স্মরণ করে। আর এ থেকেই গড়ে উঠেছে মা দিবস, বাবা দিবস ইত্যাদি। অথচ ইসলামে কোন দিবস পালনের বিধান নেই।
মা দিবসের সূচনা :
ঐতিহাসিক ও গবেষকগণ লিখেছেন, মা দিবস উদযাপন প্রথম শুরু হয়েছে গ্রিসে। গ্রিকরা তাদের মাতা-দেবীর পূজা করত। যার নাম হ’ল ‘রিয়া’। এটা তারা বসন্তকালীন উৎসবের একটি অংশ হিসাবে উদযাপন করত। প্রাচীন রোমেও এ রকম দিবস উদযাপন করা হ’ত ‘সাইবল’ দেবীর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশ্যে। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস মতে ‘সাইবল’ হ’ল সকল দেব-দেবীর মাতা। খৃষ্টপূর্ব প্রায় ২৫০ সালে রোমে ‘হিলারিয়া’ নামে একটি ধর্মীয় উৎসব পালন করা হ’ত, দেবী মাতা ‘রিয়ার’ সম্মানে। এটা উদযাপনের সময় ছিল ১৫ই মার্চ থেকে ১৮ই মার্চ। গ্রিক ও রোমান পৌত্তলিক সমাজে দেব-দেবীর মায়ের প্রতি ধর্মীয়ভাবে শ্রদ্ধা জানাতে এসব দিবস পালিত হ’ত। এটাই পরবর্তীকালে মা দিবস হিসাবে বিভিন্ন দেশে চালু হয়েছে ।
গবেষকগণ তাদের গবেষণায় আরো দেখিয়েছেন যে, রোমানরা খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করার ফলে যখন পৌত্তলিক ধর্ম পালনে বাধাগ্রস্ত হ’ল এবং তারা খৃষ্টধর্মকে বিকৃত করে তাতে অনেক পৌত্তলিক ধ্যান-ধারণা প্রবেশ করাল, তখন এরই অংশ হিসাবে খ্রিস্টান পাদ্রি ও ধর্মযাজকরা সংস্কার করে এ দিবসকে মাতা মেরী (মরিয়ম)-এর প্রতি সম্মান জানানোর জন্য বরাদ্দ করে দিল। এ থেকে মায়ের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য খ্রিস্টান সমাজে একটি দিবসের প্রচলন হয়। ১৬০০ খৃষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের যুবক-যুবতীরা এ দিনটাকে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, তাদের জন্য উপহার সামগ্রী ক্রয় ও প্রদান করার জন্য বেছে নিল। এটা হ’ল ইংল্যান্ডের কথা। আর আমেরিকার ঘটনা একটু ভিন্ন।
আমেরিকার নারী চিন্তাবিদ, ‘অ্যানম জারাফস’ তার মাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। মায়ের ভালোবাসা অক্ষুণ্ণ রাখতে জীবনে বিবাহ করেননি। তিনি পড়াশোনা করেছেন পশ্চিম ভার্জিনিয়ায় চার্চ নিয়ন্ত্রিত একটি স্কুলে। তার মায়ের মৃত্যুর দু’বছর বছর পর তিনি আন্দোলন শুরু করলেন। মায়ের স্মরণে একদিন সরকারী ছুটির। তার ধারণা হ’ল, মায়েরা সন্তানদের জন্য সারা জীবন যা করেন, তা সন্তানেরা অনুভব করে না। তাই যদি এ উপলক্ষে একটি ছুটি দেয়া হয়, একটি দিবস পালন করা হয়, তাহ’লে সন্তানদেরকে মায়ের ভূমিকা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়া সম্ভব হবে। তার আন্দোলনে আমেরিকান কংগ্রেসের অনেক রাজনীতিবিদ একাত্মতা ঘোষণা করেন। এর ধারাবাহিকতায় ১৯০৮ সালের ১০ই মে প্রাথমিক ভাবে আমেরিকার পশ্চিম ভার্জিনিয়া, ফ্লোরিডা, ওকালাহোমা ও পেনসালভানিয়াতে মা দিবস পালন শুরু হয়। ১৯১০ সালে এসব অঙ্গরাজ্যে সরকারীভাবে মা দিবস ও তাতে ছুটি পালন শুরু হয়। এভাবে আমেরিকায় মা দিবস পালনের সূচনা হয়।
এরপর ১৯১১ সাল হ’তে সমগ্র আমেরিকায় সরকারীভাবে মা দিবস পালিত হয়। আমেরিকান কংগ্রেস ১৯১৩ সালের ১০ই মে এটা সরকারীভাবে অনুমোদন করে। তারা মে মাসের প্রথম রবিবারকে মা দিবস পালনের জন্য নির্ধারণ করে। আমেরিকার অনুকরণে মেক্সিকো, কানাডা, ল্যাটিন আমেরিকা, চীন, জাপান ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে শুরু হয় ‘মা দিবস’ পালন। বর্তমানে আমাদের দেশের প্রগতিশীল সম্প্রদায় এ দিবস ৮ই মে পালনে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে।[1] । উল্লেখ্য যে, ১৯শে জুন আবার বিশ্ব ‘পিতাদিবস’ পালিত হয়।
দেশে দেশে মা দিবস :
যদিও আমেরিকায় এটা পালিত হয় মে মাসের প্রথম রবিবারে। কিন্তু অন্যান্য দেশে কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা যায়। যেমন নরওয়েতে মা দিবস পালিত হয় মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারে। আর্জেন্টিনায় পালিত হয় অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় রবিবারে। দক্ষিণ আফ্রিকায় পালিত হয় মে মাসের প্রথম রবিবারে। ফ্রান্সে ও সুইডেনে পালিত হয় মে মাসের শেষ রবিবারে। জাপানে পালিত হয় মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারে (তদেব)। এখানে প্রতীয়মান হয় যে, তারিখের ভিন্নতা থাকলেও রবিবারে ‘মা দিবস’ পালনে সকলে একমত। এর দ্বারা মাধ্যমে স্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে, এটা খ্রিস্টানদের সংস্কৃতি। মুসলমানরা কখনো এটা পালন করতে পারে না। মনে রাখতে হবে যে, মুসলমান অন্য ধর্মাবলম্বীদের কাছে দায়বদ্ধ নয় যে, সকল ক্ষেত্রে তাদের আনুগত্য, দাসত্ব ও অন্ধ অনুকরণ বজায় রাখতে হবে। যারা এ দিবস পালনের মানসিকতা রাখে কেবল তারাই তাদের দলভুক্ত। কিন্তু কোন মুসলমান কোন প্রকার দিবস পালনে আগ্রহী হ’তে পারে না।
মা দিবস পালনের বিধান :
যারা মাকে যথার্থ গুরুত্ব দেয় না অধিকাংশ ক্ষেত্রে কেবল তারাই মা দিবস পালন করে থাকে। পিতার প্রতিও তেমন গুরুত্ব দেয় না অনেকে। অথচ পিতা-মাতাকে সম্মান করা, ভালোবাসা, তাদের সাথে সদাচরণ করা ফরয। ইসলাম মাকে যেভাবে গুরুত্ব দিয়েছে অন্য কোন ধর্ম ততটা দেয়নি। মায়ের জন্য একটি দিবস পালন করলে তাদের প্রতি কর্তব্য পালন হয়ে যায় না। ইসলাম পিতা-মাতার জন্য যে গুরুত্ব দিতে বলেছে, তা নিজের স্ত্রী, সন্তানদের চেয়েও অধিক। কিন্তু ইসলামে এই দিবস পালনের কোন স্থান নেই। কারণ রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীদের মাঝে এরূপ দিবস পালনের প্রমাণ নেই। বরং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا ، فَهْوَ رَدٌّ ‘যে কেউ এমন আমল করবে, যার ব্যাপারে আমাদের কোন নির্দেশ নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[2] তিনি অন্যত্র বলেছেন, مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ ‘যে ব্যক্তি আমাদের এ ধর্মে এমন নতুন কিছুর প্রচলন করবে, যার প্রতি আমাদের নির্দেশ নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[3]
আজ আমরা সভ্য সমাজের প্রগতিশীল মানুষ। বিজাতীয় সংস্কৃতিকে বুকে লালন করে নিজেদের ইয্যত সম্মান ধুলায় মিশিয়ে দিতে বসেছি। মুসলমান হিসাবে ঐ সকল বিজাতীয় আচার-অনুষ্ঠানকে পরিহার করতে হবে।
ছাহাবী আবু ওয়াকেদ (রাঃ) বলেন, ‘রাসূল (ছাঃ) খায়বার যাত্রায় মুশরিকদের একটি গাছ অতিক্রম করলেন। যার নাম ছিল ‘যাতু আনওয়াত’। এর উপর তারা অস্ত্র ঝুলিয়ে রাখত। তখন কতক ছাহাবী রাসূল (ছাঃ)-কে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের জন্যও এমন একটি ‘যাতু আনওয়াত’ নির্ধারণ করে দিন। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, سُبْحَانَ اللَّهِ هَذَا كَمَا قَالَ قَوْمُ مُوسَى (اجْعَلْ لَنَا إِلَهًا كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ) وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لَتَرْكَبُنَّ سُنَّةَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ ‘সুবহানাল্লাহ, এ তো মূসা (আঃ)-এর জাতির মত কথা। আমাদের জন্য একজন প্রভু তৈরি করে দিন, তাদের প্রভুর ন্যায়। আমি ঐ সত্তার শপথ করে বলছি যাঁর হাতে আমার প্রাণ! তোমরা পূর্ববর্তীদের আচার-অনুষ্ঠানের অন্ধানুকরণ করবে’।[4] আজ আমরা যদি মুসলমান হয়ে তাদের আচার-অনুষ্ঠান পালন করি বা অনুকরণ করি তবে আমরা আর মুসলমান থাকব না, আমরা তাদের দলভুক্ত হয়ে যাব। এ মর্মে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ ‘যে ব্যক্তি কোন জাতির অনুকরণ করবে, ঐ ব্যক্তি তাদের মধ্যে গণ্য হবে’।[5]
মুসলমান এমন একটি জাতি, যাদের নিজস্ব অতীব উৎকৃষ্ট ও সাবলীল সংস্কৃতি আছে। অমুসলিমদের অনুকরণে মা দিবস পালন করার অর্থ হ’ল তাদের ও সাদৃশ্য অবলম্বন করা। যা ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম। কোন অমুসলিমদের আচার-অনুষ্ঠান কিংবা কৃষ্টি-কালচার মুসলমানদের জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় নয়।
বৃদ্ধাশ্রমের সূচনা :
বৃদ্ধাশ্রম শব্দটি মূলত বৃদ্ধ+আশ্রম ছিল। বৃদ্ধাশ্রম হ’ল অবহেলিত বৃদ্ধ-বৃদ্ধার জন্য আবাসস্থল বা আশ্রয়। তাদের সারাজীবনের অবদানের যথার্থ স্বীকৃতি শেষ সময়ের সম্মান ও নিরাপত্তা দেয়া হয় এসব বৃদ্ধাশ্রমে। এখানে তারা নির্ভাবনায়, সম্মানের সঙ্গে, আনন্দের সঙ্গে বাকী দিনগুলো কাটাতে পারেন। বৃদ্ধাশ্রমে চিকিৎসাসহ সকল ব্যবস্থা আছে। পৃথিবীর প্রথম বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রাচীন চীনে। ঘর ছাড়া অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের এই উদ্যোগ ছিল শান রাজবংশের। খ্রিষ্টপূর্ব ২২০০ শতকে পরিবার থেকে বিতাড়িত বৃদ্ধদের জন্য আলাদা এই আশ্রয়কেন্দ্র তৈরী করে ইতিহাসে আলাদা জায়গাই দখল করে নিয়েছে এই শান রাজবংশ। পৃথিবীর প্রথম প্রতিষ্ঠিত সেই বৃদ্ধাশ্রমে ছিল বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের আরাম-আয়েশের সব রকম ব্যবস্থা। ছিল খাদ্য ও বিনোদন ব্যবস্থা। ঐতিহাসিকগণ এই বৃদ্ধাশ্রমকে প্রাচীন চীনে গড়ে ওঠা সভ্যতারই অন্যতম প্রতিষ্ঠান হিসাবে অভিহিত করেছেন। তবে বর্তমানে চীন, জাপান ও তাইওয়ানের মত দেশের উচ্চবিত্ত সম্পদশালীরা তাদের পিতামাতাকে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন থেকে নারী কর্মী নিয়োগ করে তাদের তত্ত্বাবধানে রেখে পিতা-মাতার সেবা করান। সাপ্তাহিক ছুটিতে তাদের পিতামাতাদের সঙ্গ দেন এবং প্রয়োজনীয় খোঁজ-খবর নেন।[6]
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়াংশে বিজ্ঞানের অভাবনীয় সাফল্য, চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নয়ন সমগ্র বিশ্বে জীবন প্রত্যাশার মান বৃদ্ধি করে এক বিরাট পরিবর্তন এনেছে। এর ফলে সারা বিশ্বে বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে নর-নারীর গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে। একবিংশ শতাব্দীকে কেউ কেউ বার্ধক্যের যুগ বলেও উল্লেখ করেছেন। তবে বার্ধক্যের মোকাবেলা করা বিশ্ব সমাজের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
বাংলাদেশ পৃথিবীর দরিদ্রতম ও ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। বার্ধক্য বাংলাদেশের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ, যার মোকাবেলা করা নিতান্তই কঠিন কাজ। জাতিসংঘ ৬০ বছর বয়সকে বার্ধক্য হিসাবে চিহ্নিত করেছে। এ হিসাবে জনসংখ্যার ৬.১ শতাংশ প্রবীণ নর-নারী। ২০২৫ সালে এই সংখ্যা বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে ১০.১ শতাংশে। উদ্বেগের বিষয় হ’ল, বাংলাদেশে এর প্রভাব অত্যন্ত গুরুতর হয়ে দেখা দিবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রবীণ সাধারণ পরিবারে বসবাস করেন এবং তখন তাদের ভরণ-পোষণ, চিকিৎসা ইত্যাদির ভার সন্তানদের ওপর বর্তায়। কিন্তু বর্তমান আধুনিক প্রগতিশীল বস্ত্তদাবী সমাজে মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা পরিবর্তনের কারণে যৌথ পরিবারে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এতে করে প্রবীণরা তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার অর্থাৎ আশ্রয় ও বাসস্থান হারাচ্ছে। এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের শতকরা ৮৮ ভাগ প্রবীণের, কোন না কোন সন্তান বাইরে থাকে। অর্থাৎ এদের সঙ্গে পিতামাতার যোগাযোগ খুব কম হয়। এতে করে বৃদ্ধ পিতা-মাতারা আর্থ-সামাজিক সমস্যায় ভোগেন। বাংলাদেশে শতকরা ২০ জন হয় একাকী থাকেন অথবা স্বামী-স্ত্রী এক সঙ্গে থাকেন। দরিদ্র প্রবীণদের সংখ্যা শতকরা ৩৭ জন। বর্তমান সরকার প্রবীণদের জন্য বয়স্ক ভাতা চালু করেছে। এ কার্যক্রমের আওতায় ১৭ লাখ দরিদ্র প্রবীণ সাহায্য পাচ্ছে (সূত্র : বাংলাপিডিয়া)।
তবে পিতা-মাতার এই অবমাননার জন্য তারা নিজেরাও অনেকাংশে দায়ী। পিতা-মাতা ও সন্তান উভয় পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ সম্মত শিক্ষা দিতে পারেন নি। যে শিক্ষা মানুষকে তাক্বওয়াশীল করে। যদি ঐ পিতা-মাতা একটি কিংবা দু’টির বেশী সন্তান গ্রহণ করতেন তা’হলে তাদের মধ্য থেকে কোন না কোন সন্তান পিতামাতার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পরায়ণ হ’ত। অপরদিকে সন্তানদের মধ্যে বৈষম্য তাছাড়া অনেকে ইসলামী শরী‘আত মোতাবেক তাদের মধ্যে সম্পদের সুষম বন্টন না করে কম-বেশী করে থাকে ইত্যাদি। অনেকে নিজেদের জীবনের সকল ধন-সম্পদ সন্তাদের মধ্যে বন্টন করে দেয়, নিজের জন্য কিছুই রাখেন না । কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের কাছ থেকে এর একটি ক্ষুদ্র অংশও তারা পাচ্ছেন না। আবার এমনও দেখা যায় যে, সন্তানের টাকা-পয়সার অভাব নেই, কিন্তু পিতা-মাতাকে নিজের কাছে রাখার প্রয়োজনবোধ করছে না, বা বোঝা মনে করছে। নিজেই পিতামাতাকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন বৃদ্ধাশ্রমে, নতুবা অবহেলা ও দুর্ব্যবহার করে এমন অবস্থার সৃষ্টি করে, যেন পিতা-মাতা নিজেরাই সরে যান। তার সাধের পরিবার থেকে। আবার এমনও হয়, টাকার অভাব না থাকলেও তার পর্যাপ্ত সময়ের অভাব, তাই পিতা-মাতার দেখাশুনা করা বা তাদের সঙ্গে কথা বলার মত যথেষ্ট সময় নেই। অতএব সন্তান বৃদ্ধ পিতামাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে অন্যদের সঙ্গে একত্রে সময় কাটানোর সুযোগ করে দেয়। এভাবে নানা অজুহাতে পিতা-মাতাকে দূরে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। অনেক নামী-দামী বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, চাকরিজীবী যারা এক সময় খুব বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন, বৃদ্ধ বয়সে এসে নিজের সন্তানের দ্বারাই অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়ে বৃদ্ধাশ্রমের স্থায়ী বাশিন্দা হ’তে বাধ্য হচ্ছেন। অনেক সন্তান বা আত্মীয়-স্বজন আর তাদের কোন খবরও নেন না। তাদের দেখতেও আসেন না, এমনকি প্রয়োজনীয় টাকা-পয়সা বা জিনিসপত্রও পাঠান না। বাড়িতে কোন অনুষ্ঠানে বা ঈদের আনন্দের সময়ও পিতা-মাতাকে বাড়িতে নেন না। এমনও শোনা যায়, অনেকে পিতা বা মাতার মৃত্যুশয্যায় বা মৃত্যুর পরও শেষবারের মতও দেখতে যান না। বৃদ্ধাশ্রমের কর্তৃপক্ষই কবর দেয়াসহ সকল ব্যবস্থা করেন। তার সন্তানেরা কোন খবর রাখেন না।
কেস স্টাডি :
১. সদ্য বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো এক মা তার ছেলেকে চিঠি লিখেছেন- ‘খোকা! তুই কেমন আছিসরে? বউমা আর আমাদের ছোট দাদুভাই সবাই ভালো আছে তো? জানি, তোদের তিন জনের ছোট সংসারে প্রত্যেকেরই খুব কাজ। তবুও তোদের কাছে আমার একান্ত অনুরোধ। একদিন একটু সময় করে এই বুড়ি মাকে দেখতে আয় না! কিরে, আসবি না? ও বুঝতে পেরেছি, এখনো আমার উপর থেকে তোদের অভিমান যায়নি। আমাকে যেদিন বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলি, সেদিন ঝগড়া করেছিলাম বৃদ্ধাশ্রম থেকে আমাকে নিতে আসা লোকজনদের সঙ্গে। জানি শেষ দিনটাতে একটু বেশী রকমেরই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলাম, তাছাড়া আর কী বা আমি করব বল? সময়মত ওরা এসে আমার জিনিসপত্র সব জোর করে গাড়িতে উঠিয়ে নিল, তারপর বারবার তাগাদা দিতে লাগল। আমি তোর সঙ্গে দেখা করে আসার জন্য তাদের কাছে সময় চেয়েছিলাম, তারা সময় দিলেও শেষ পর্যন্ত তুই আসিসনি। তুই কাজে এত ব্যস্ত থাকিস তখন আমার মনে ছিল না। পরে মনে পড়েছিল, তাই তোর সঙ্গে দেখা না করেই চলে এসেছি। তুই রাগ করিসনি তো? আর সেদিন আমার সেই যিদ দেখে বউমা তো রেগেই আগুন। তাছাড়া তার তো রাগবারই কথা। আমাকে নিয়ে যেতে যারা এসেছিল, তাদের তড়িঘড়িতে পাশের বাড়ি থেকে কেউ কেউ উঁকি দিতে লাগল। এতে তো বউমার একটু লজ্জাবোধ হবেই। সেদিন তোদের যে অপমান করে এসেছি তোরা সেসব ভুলে যাস কেমন করে? আমার কথা ভাবিস না। আমি খুব ভালো আছি। আর কেনইবা ভালো থাকব না বল? তোরা তো আমার ভালো থাকবারই বন্দোবস্ত করে দিয়েছিস। তবে একটা কথা, আমার কথা যদি তোর কখনো বা কোনদিন মনে পড়ে, তখন যেন নিজেকে তুই শেষ করে দিস না। তুই এখনো একশ’ বছর বেঁচে থাক’।
২. বৃদ্ধাশ্রম থেকে আরেকজন মায়ের চিঠি, ‘আমার আদর ও ভালোবাসা নিও। অনেক দিন তোমাকে দেখি না, আমার খুব কষ্ট হয়। তোমার ছোটবেলার একটি ছবি আমার কাছে রেখে দিয়েছি। ছবিটা দেখে দেখে মনে মনে ভাবি, এটাই কি আমার সেই খোকা! কান্নায় আমার বুক ভেসে যায়। আমার জন্য তোমার কী অনুভূতি আমি জানি না। তবে ছোটবেলায় তুমি আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝতে না। আমি যদি কখনও তোমার চোখের আড়াল হ’তাম, মা.. মা.. বলে চিৎকার করতে। মাকে ছাড়া কারও কোলে তুমি যেতে না। তুমি একমুহূর্ত আমাকে না দেখে থাকতে পারতে না। সাত বছর বয়সে তুমি আমগাছ থেকে পড়ে হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছিলে। তোমার বাবা হালের বলদ বিক্রি করে তোমার চিকিৎসা করিয়েছিলেন। তখন তিন দিন, তিন রাত তোমার পাশে না ঘুমিয়ে, না খেয়ে, গোসল না করে কাটিয়েছিলাম। এগুলো তোমার মনে থাকার কথা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার বিয়ের গয়না বিক্রি করে তোমার পড়ার খরচ জুগিয়েছিলাম। হাঁটুর ব্যথাটা তোমার মাঝে মধ্যেই হ’ত। বাবা, এখনও কি তোমার সেই ব্যথাটা আছে? রাতের বেলায় তোমার মাথায় হাত না বুলিয়ে দিলে তুমি ঘুমাতে না। এখন তোমার কেমন ঘুম হয়? আমার কথা কি তোমার একবারও মনে হয় না? তুমি দুধ না খেয়ে ঘুমাতে না। তোমার প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। আমার কপালে যা লেখা আছে হবেই। আমার জন্য তুমি কোন চিন্তা করো না। আমি খুব ভালো আছি। কেবল তোমার চাঁদ মুখখানি দেখতে আমার খুব মনে চায়। তুমি ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করবে। তোমার বোনেরও খবরা-খবর নিব। আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বল আমি ভালো আছি। আমি দো‘আ করি, তোমাকে যেন আমার মত বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে না হয়। কোন এক জ্যোৎস্না ভরা রাতে আকাশ পানে তাকিয়ে জীবনের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত নিয়ে একটু ভেবে নিও। বিবেকের কাছে উত্তর পেয়ে যাবে। তোমার কাছে আমার শেষ একটা ইচ্ছা আছে। আমি আশা করি তুমি আমার শেষ ইচ্ছাটা রাখবে। আমি মারা গেলে বৃদ্ধাশ্রম থেকে নিয়ে আমাকে তোমার বাবার কবরের পাশে কবর দিও। এজন্য তোমাকে কোন টাকা খরচ করতে হবে না। তোমার বাবা বিয়ের সময় যে নাকফুলটা দিয়েছিল সেটা আমার কাপড়ের আঁচলে বেঁধে রেখেছি। নাকফুলটা বিক্রি করে আমার কাফনের কাপড় কিনে নিও।
৩. ২০০৬ সালে অবসর নেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম আব্দুল আউয়াল (৭০)। দীর্ঘ ১৭ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পেশা থেকে অবসরের পর কিছুদিন ভালোই চলছিল তার। অধ্যাপক আব্দুল আউয়ালের সংসারে দুই ছেলে, এক মেয়ে। তিন সন্তানের মধ্যে মেয়ে সবার বড়, নাম রোজিনা ইয়াসিন আমেরিকা প্রবাসী। এরপর বড় ছেলে উইং কমান্ডার (অব.) ইফতেখার হাসান। সবার ছোট ছেলে রাকিব ইফতেখার হাসান অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। জীবনে এত কিছু থাকার পরও আজ তার দু’চোখে অন্ধকার। থাকেন আগারগাঁও প্রবীণ নিবাসে।
৪. আমেরিকার এক নামকরা ব্যবসায়ী ছিল। তার টাকা পয়সা, ধন-সম্পদে কোন কিছুরই অভাব ছিল না। কিন্তু সে মডার্ণ সোসাইটিতে মুখ দেখাতে পারত না শুধু তার মায়ের জন্য। কারণ তার মা ছিল অন্ধ ও কুৎসিত-কদাকার। মায়ের মুখে ছিল আগুনে পোড়া বিশ্রী কালো দাগ। আর মাথার চামড়া পুড়ে গিয়েছিল, মাথায় চুল ছিল না। সব মিলিয়ে তার মা একজন কুশ্রী-কদাকার সেকেলে মানুষ। তাই মডার্ণ সোসাইটিতে নিজের মান-সম্মান ও আভিজাত্য বজায় রাখার জন্য একদিন সে মাকে বাসা থেকে বের করে দিল। বেচারী একেতো অন্ধ মানুষ তারপরে বৃদ্ধা। কেঁদে কেঁদে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। হঠাৎ একটি গাড়ি এসে ধাক্কা দিল, ছিটকে পড়ে বৃদ্ধা মা ঘটনাস্থলে মৃত্যুবরণ করেন। তার ছেলে জেনে-শুনে কষ্ট পেল না, ভাবলো আপদ বিদায় হয়েছে। কিছুদিন পর ছেলে তার বিশেষ কিছু কাগজপত্র খুঁজতে খুঁজতে তার মায়ের লেখা একটা ডাইরি পেল। ডাইরিতে লেখা ছিল-
০৫-১২-১৯৮০ : আজ আমি সুন্দরী ‘মিস্ আমেরিকা’-এর খেতাব পেয়েছি।
০২-০৫-১৯৮৩ : আজ আমার গর্ভপাত না ঘটানোর জন্য আমার প্রিয় স্বামী আমাকে তালাক দিয়েছে।
০৭-০৩-১৯৮৫ : আজ আমার বাড়িতে আগুন লেগেছিল। আমি বাহিরে ছিলাম। আর আমার কলিজার টুকরা ছেলে বাড়ির ভিতরে ছিল। নিজের জীবন বাজি রেখে শুধু ছেলের জীবন বাঁচাতে গিয়ে আগুনে আমার চুল এবং মুখমন্ডলসহ আমার সমস্ত সৌন্দর্য পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তথাপি আমার কোন দুঃখ নেই। কিন্তু আমার কলিজার টুকরা ছেলের চোখদু’টো আমি বাঁচাতে পারিনি।
০৭-৫-১৯৮৫ : আজ আমার নিজের চোখ দু’টো আমার ছেলেকে দিতে যাচ্ছি। আজকের পর থেকে আর কখনো ডাইরি লিখতে পারব না।
এই ডাইরিটি পড়ে ছেলে পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে দেওয়ালে মাথা আছড়াতে লাগল। হায়! আমি কি করেছি?
ইসলামের আলোকে পিতা-মাতার গুরুত্ব :
ইসলাম চিরন্তন ও সার্বজনীন জীবন বিধান পিতা-মাতার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছে। কেননা মহান আল্লাহ বলেন, وَوَصَّيْنَا الْإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْناً ‘আমরা মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে’ (আনকাবূত ২৯/৮)। অন্যত্র তিনি আরো বলেন,
وَقَضَى رَبُّكَ أَلاَّ تَعْبُدُواْ إِلاَّ إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَاناً إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِندَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاَهُمَا فَلاَ تَقُل لَّهُمَا أُفٍّ وَلاَ تَنْهَرْهُمَا وَقُل لَّهُمَا قَوْلاً كَرِيْماً، وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُل رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِيْ صَغِيْرا -
‘তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত না করতে ও পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হ’লে তাদেরকে ‘উফ’ শব্দ বল না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বল’, মমতাবশে তাদের প্রতি, নম্রতার সাথে পক্ষপুট অবনমিত কর এবং বল, ‘হে আমার প্রতিপালক! দয়া কর তাদের প্রতি যেভাবে তারা আমাকে শৈশবে প্রতিপালন করেছিলেন’ (ইসরা ১৭/২৩-২৪)।
পিতা-মাতার সাথে সম্পর্ক রক্ষার ব্যাপারে হাদীছে অনেক নির্দেশ এসেছে। তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করাকে বড় গোনাহ বলা হয়েছে। এ সর্ম্পকে রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَلاَ أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الْكَبَائِرِ. ثَلاَثًا. قَالُوْا بَلَى يَا رَسُوْلَ اللهِ. قَالَ الإِشْرَاكُ بِاللهِ، وَعُقُوْقُ الْوَالِدَيْنِ. ‘আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহগুলো সম্পর্কে অবহিত করব না? একথা তিনি (তিনবার) বললেন। সকলেই বললেন, হ্যাঁ, বলুন হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শরীক করা এবং পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা’।[7]
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, এক বেদুঈন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কবীরা গুনাহসমূহ কি? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, اَلْإِشْرَاكُ بِاللهِ. قَالَ ثُمَّ مَاذَا قَالَ ثُمَّ عُقُوقُ الْوَالِدَيْنِ- ‘আল্লাহর সাথে শরীক করা’। সে বলল, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, ‘পিতামাতার অবাধ্যতা করা’।[8] আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, أَىُّ الْعَمَلِ أَحَبُّ إِلَى اللهِ قَالَ الصَّلاَةُ عَلَى وَقْتِهَا. قَالَ ثُمَّ أَىُّ قَالَ ثُمَّ بِرُّ الْوَالِدَيْنِ- ‘কোন আমল আল্লাহর নিকটে অধিক প্রিয়। তিনি বললেন, যথাসময়ে ছালাত আদায় করা। ইবনু মাসউদ (রাঃ) বললেন, অতঃপর কোনটি? তিনি বললেন, ‘অতঃপর পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা’।[9] একদা রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘তার নাক ধূলায় ধুসরিত হোক। তার নাক ধূলায় ধুসরিত হোক। তার নাক ধূলায় ধুসরিত হোক’। বলা হ’ল, কার হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)? তিনি বললেন, مَنْ أَدْرَكَ أَبَوَيْهِ عِنْدَ الْكِبَرِ أَحَدَهُمَا أَوْ كِلَيْهِمَا فَلَمْ يَدْخُلِ الْجَنَّةَ- যে ব্যক্তি তার পিতামাতার একজনকে অথবা উভয়কে বার্ধক্যে পেল। কিন্তু (তাদের সেবা করে) জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না’। [10] এজন্যই বলা হয় পিতামাতা সন্তানের জান্নাত। যে ব্যক্তি তাদের সেবা-যত্ন ও সম্মান করবে, সে জান্নাতের অধিবাসী হবে। পিতামাতা যদি কাফির-মুশরিকও হয় তবুও তাদের সাথে সন্তানের সুসম্পর্ক বজায় রাখাতে হবে। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন, وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوْفًا ‘তবে পৃথিবীতে তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস করবে’ (লুক্বমান ৩১/১৫)।
আসমা বিনতে আবূবকর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ(ছাঃ)-এর যুগে আমার মা মুশরিক অবস্থায় আমার নিকট আসলেন। আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে জিজ্ঞেস করলাম, আমার মা আমার নিকটে এসেছেন, তিনি আমার প্রতি (ভাল ব্যবহার পেতে) খুবই আগ্রহী, এমতাবস্থায় আমি কি তার সঙ্গে সদাচরণ করব? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমি তোমার মায়ের সাথে সদাচরণ কর’।[11] আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এর দরবারে হাযির হয়ে জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার সুন্দর আচরণের বেশি হকদার কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে পুনরায় জিজ্ঞেস করল, এরপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে পুনরায় জিজ্ঞেস করল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে আবারও জিজ্ঞেস করল এরপর কে? তিনি বললেন, তোমার পিতা’।[12] পিতামাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য অত্যধিক। সন্তান সারা জীবন তাদের পেছনে অতিবাহিত করলেও পিতামাতার ঋণ শোধ করতে পারবে না। পিতামাতার যথাযথ সেবাযত্ন করা আমাদের জন্য যরূরী।
শেষ কথা :
ইসলাম সার্বজনীন, চিরন্তন এবং শ্বাশত জীবনাদর্শ। কিন্তু বর্তমানে আধুনিকতার নামে কিছু তথাকথিত প্রগতিশীল মানুষ বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করে সন্তানকে তার পিতামাতার নিকট থেকে কেড়ে নিয়ে তাদেরকে পাঠিয়ে দিচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। সেখানে সকল কিছু প্রাপ্তির মাঝেও যা পাওয়া যায় না তা হ’ল নিজের পরিবারের সান্নিধ্য। বৃদ্ধ বয়সে মানুষ তার সন্তান, নাতী-নাতনীদের সঙ্গে একত্রে থাকতে চায়। তাদের সঙ্গে জীবনের আনন্দ ভাগাভাগী করে নিতে চায়। সারাজীবনের কর্মব্যস্ত সময়ের পর অবসরে তাদের একমাত্র অবলম্বন এই আনন্দটুকুই। বলা যায়, এর জন্যই মানুষ সারা জীবন অপেক্ষা করে থাকে। যারা অবহেলা করে পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়ে তাদের কথা ভুলে যান, তাদেরকে স্মরণ রাখা দরকার যে, এমন সময় তাদের জীবনেও আসতে পারে। যে পিতামাতা একসময় নিজে না খেয়েও সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতেন, তারা আজ কোথায়? কেমন আছেন, সেই খবর নেয়ার সময় যার নেই, তার নিজের সন্তানও হয়ত একদিন তার সঙ্গে এমনই আচরণ করবে। ঈদের দিনে যখন তারা তাদের সন্তানদের কাছে পান না, এমনকি সন্তানের কাছ থেকে একটি ফোনও পান না, তখন অনেকেই নীরবে অশ্রুপাত করেন আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। এমনকি সেই সন্তানকে অভিশাপ দিয়ে থাকেন, তার সন্তান তার সঙ্গে যে আচরণ করল, ভবিষ্যতে তার সাথেও যেন একই আচরণ করে। মনে রাখা উচিত যে, আজ যিনি সন্তান, তিনিই আগামীদিনের পিতা কিংবা মাতা। বৃদ্ধ বয়সে এসে পিতা-মাতা যেহেতু শিশুদের মতো কোমলমতি হয়ে যায়, তাই তাদের জন্য সুন্দর জীবনযাত্রার পরিবেশ তৈরী করাই সন্তানের কর্তব্য। যদি কোন সন্তান তা পূরণে ব্যর্থ হয়, তবে সে ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি হারাবে। আর ইলম অর্জন কিংবা ইসলামী অনুশাসন ব্যতীত এই ভয়াবহ পরিণতির সমাধান কখনও সম্ভব নয়। সন্তানের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য আজীবন বৃদ্ধ পিতামাতা নীরবে নিভৃতে অশ্রু বিসর্জন দিবেন। মনে রেখ, হে আদম সন্তান! পিতা-মাতা যখন সন্তানের জন্য দো‘আ করেন তখন মহান আল্লাহ কবুল করেন। আজকের এই তথাকথিত প্রগতিশীল সকল সন্তান তথা গোটা জাতির কাছে প্রশ্ন, মা দিবস, পিতা দিবস পালন কিংবা বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো ও তাদেরকে কাঁদানো কি প্রগতির নামে প্রহসন নয়?
অতএব আসুন, আমরা পিতামাতাকে বোঝা মনে না করে পরিবারেই তাদের জন্য যথাসম্ভব সুন্দর পরিবেশ করে দেই। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন- আমীন!
[1]. দৈনিক মানবকন্ঠ, ১২ই মে ২০১৩, শিরোনাম: বিশ্ব মা দিবসের ইতিহাস।
[2]. বুখারী হা/২০; মুসলিম হা/১৮।
[3]. বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/১৪০।
[4]. তিরমিযী, মিশকাত হা/৫৪০৮।
[5]. আহমাদ, আবূ দাঊদ হা/৪৩৪৭।
[6]. দৈনিক বিজয় সংবাদ, ৩রা জানুয়ারী ২০১৫; শিরোনাম: বৃদ্ধাশ্রম নয়, পরিবারই হোক পিতামাতার নিরাপদ আবাস।
[7]. বুখারী হা/২৬৫৪; মুসলিম হা/৮৭; তিরমিযী হা/১৯০১।
[8]. বুখারী হা/৬৯২০; আবু দাউদ হা/২৮৭৫।
[9]. বুখারী হা/৫২৭; মুসলিম হা/৮৫।
[10]. মুসলিম হা/২৫৫১।
[11].বুখারী হা/২৬২০; মুসলিম হা/১০০৩।
[12].বুখারী হা/৫৯৭১।