অমুসলিমদের প্রতি আচরণবিধি (শেষ কিস্তি)
আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ফায়ছাল মাহমূদ 9201 বার পঠিত
৫. লজ্জাশীলতা : হায়া বা লজ্জাশীলতা মুত্তাকীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গুণ। শয়তান আদিকাল থেকেই বনু আদমের পেছনে লেগে আছে তাকে বিবস্ত্র করে লজ্জাশীলতার ভূষণ কেড়ে নেবার জন্য। শয়তান প্রথমে পৃথিবীর প্রথম মানব-মানবী আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ)-কে তার কুমন্ত্রনায় প্ররোচিত করে জান্নাত থেকে বহিষ্কার করার প্রাণান্ত চেষ্টা চালায় এবং তাদেরকে আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ গাছ থেকে কিছু ভক্ষণ করাতে সক্ষম হয়। ফলে আদম ও হাওয়া (আঃ)-এর শরীর থেকে জান্নাতী পোশাক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অতঃপর তারা উভয়েই জান্নাতের পাতা দিয়ে তাদের লজ্জাস্থান ঢাকার চেষ্টা করেন। যার বর্ণনা পবিত্র কুরআন এভাবে দিয়েছে যে, فَدَلَّاهُمَا بِغُرُورٍ فَلَمَّا ذَاقَا الشَّجَرَةَ بَدَتْ لَهُمَا سَوْآتُهُمَا وَطَفِقَا يَخْصِفَانِ عَلَيْهِمَا مِنْ وَرَقِ الْجَنَّةِ وَنَادَاهُمَا رَبُّهُمَا أَلَمْ أَنْهَكُمَا عَنْ تِلْكُمَا الشَّجَرَةِ وَأَقُلْ لَكُمَا إِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمَا عَدُوٌّ مُبِينٌ ‘এভাবে তাদের দু’জনকে ধেঁাকার মাধ্যমে সে ধীরে ধীরে ধ্বংসে নামিয়ে দিল। অতঃপর যখন তারা উক্ত বৃক্ষের স্বাদ আস্বাদন করল, তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের সামনে প্রকাশ হয়ে পড়ল। ফলে তারা জান্নাতের পাতাসমূহ দিয়ে তা ঢাকতে লাগল। এ সময় তাদের প্রতিপালক তাদের ডাক দিয়ে বললেন, আমি কি এই বৃক্ষ থেকে তোমাদের নিষেধ করিনি? আর আমি কি তোমাদের একথা বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? (আ‘রাফ ৭/২২)।
এ
বিষয়ে হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِى مَسْعُودٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ
صلى الله عليه وسلم إِنَّ مِمَّا أَدْرَكَ النَّاسُ مِنْ كَلاَمِ
النُّبُوَّةِ الأُولَى إِذَا لَمْ تَسْتَحِ فَافْعَلْ مَا شِئْتَ. আবু
মাস‘উদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, পূর্ববর্তী
নবীদের (নছীহত) থেকে মানুষ যা লাভ করেছে তার একটা হ’ল, যদি তুমি লজ্জা না
কর, তবে যা ইচ্ছা তাই কর’।[1]
লজ্জাশীলতা নবীগণের ছিফাত বা গুণ। মানুষ লজ্জা পরিত্যাগ করলে অকল্যাণে পতিত হয়। নির্লজ্জ মানুষ যা খুশি তাই করতে পারে। লজ্জাশীলতা ঈমানী স্বভাব। লজ্জা মানুষকে দুনিয়াতে কল্যাণ ও আখেরাতে মুক্তি দিবে। লজ্জা মুসলিমের ঈমানের অন্যতম অঙ্গও বটে।
যেমন হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رضى الله عنه عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ الإِيمَانُ بِضْعٌ وَسِتُّونَ شُعْبَةً ، وَالْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنَ الإِيمَانِ. আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ঈমানের সত্তরোর্ধ বা ষাটোর্ধ্ব শাখা রয়েছে। এর মধ্যে সর্বোত্তম হ’ল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা। এর সর্বনিমণটি হ’ল রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্ত্ত সরিয়ে ফেলা। আর লজ্জাশীলতা ও ঈমানের একটি শাখা’।[2]
লজ্জা মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে
আনে। যে কল্যাণ প্রতিটি মানুষের কাম্য। কারণ কল্যাণের অন্বেষণেই মানুষের
সার্বিক চেষ্টা-প্রচেষ্টা। লজ্জাশীলতা যার মাঝে যত বেশী, প্রকাশ্যে কোন
অন্যায় করতে সে তত পরিমাণ সংকোচ বোধ করে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, الْحَيَاءُ لاَ
يَأْتِى إِلاَّ بِخَيْرٍ ‘লজ্জাশীলতা কল্যাণ ছাড়া কিছুই আনয়ন করে না’।[3]
লজ্জাশীলতায়
অবারিত কল্যাণ থাকায় লজ্জাশীলতার প্রতি নিরুৎসাহিতকারী ছাহাবীকে রাসূল
(ছাঃ) ধমক দিয়েছিলেন। হাদীছে এসেছে, عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ رضى
الله عنهما مَرَّ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم عَلَى رَجُلٍ وَهْوَ
يُعَاتَبُ فِى الْحَيَاءِ يَقُولُ إِنَّكَ لَتَسْتَحْيِى . حَتَّى
كَأَنَّهُ يَقُولُ قَدْ أَضَرَّ بِكَ . فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله
عليه وسلم دَعْهُ فَإِنَّ الْحَيَاءَ مِنَ الإِيمَانِ- আব্দুল্লাহ ইবনু
উমার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার নবী (ছাঃ) এক ব্যক্তির পাশ দিয়ে
যাচ্ছিলেন। এসময় তার অন্য ভাইকে সে লজ্জা সম্পর্কে ভৎর্সনা করছিল এবং বলছিল
যে, তুমি আমাকে অধিক লজ্জা করছ, এমনকি সে যেন এমন কথাও বলছিল যে, এটা
তোমাকে ক্ষতির সম্মুখীন করছে। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তুমি তাকে তার
অবস্থার উপর ছেড়ে দাও’।[4]
লজ্জা বলতে আমরা সাধারণত যে বিষয়টি বুঝি তা হ’ল মানুষ মানুষে পারস্পরিক লজ্জা। নিঃসন্দেহে এটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে এর চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা প্রদান করেছেন।
হাদীছে এসেছে, عَنْ
عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه
وسلم اسْتَحْيُوا مِنَ اللَّهِ حَقَّ الْحَيَاءِ. قَالَ قُلْنَا يَا
رَسُولَ اللَّهِ إِنَّا لَنَسْتَحْيِى وَالْحَمْدُ لِلَّهِ. قَالَ لَيْسَ
ذَاكَ وَلَكِنَّ الاِسْتِحْيَاءَ مِنَ اللَّهِ حَقَّ الْحَيَاءِ أَنْ
تَحْفَظَ الرَّأْسَ وَمَا وَعَى وَتَحْفَظَ الْبَطْنَ وَمَا حَوَى
وَتَتَذَكَّرَ الْمَوْتَ وَالْبِلَى وَمَنْ أَرَادَ الآخِرَةَ تَرَكَ
زِينَةَ الدُّنْيَا فَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ فَقَدِ اسْتَحْيَا مِنَ اللَّهِ
حَقَّ الْحَيَاءِ. ‘আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘উদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, তোমরা আল্লাহ তা‘আলাকে যথাযথভাবে লজ্জা কর। আমরা
বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা তো নিশ্চয়ই লজ্জা করি। সকল প্রশংসা আল্লাহর
জন্য। তিনি বলেন, তা নয় বরং আল্লাহ তা‘আলাকে যথাযথভাবে লজ্জা করার অর্থ এই
যে, তুমি তোমার মাথা এবং এর মাঝে যা কিছু রয়েছে তার হেফাযত করবে এবং পেট ও
এর মধ্যে যা কিছু রয়েছে তা হেফাযত করবে। মৃত্যুকে এবং এরপর পচে- গলে যাওয়ার
কথা স্মরণ করবে। আর যে লোক পরকালের আশা করে, সে যেন দুনিয়ার জঁাকজমকতা
পরিহার করে। যে লোক এ সকল কাজ করতে পারে সেই আল্লাহ তা‘আলাকে লজ্জা করে’।[5]
আর তাইতো ইসলামী শিষ্টাচারে উদ্বুদ্ধ মুসলিম যথার্থই লজ্জাশীলতা অবলম্বন করে। পথিমধ্যে সুন্দরী রমণী তার চোখে পড়লেও সে তাকাতে লজ্জাবোধ করে এবং আল্লাহকে ভয় করে। লজ্জা করে সে দুনিয়াতে যে কোন পাপাচারে লিপ্ত হ’তে। হোক তা প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য, হোক তা লোকচক্ষুর সম্মুখে বা অন্তরালে। কারণ সে জানে তার মহান রবের বাণী- أَلَمْ يَعْلَمْ بِأَنَّ اللَّهَ يَرَى ‘সে কি জানে না যে আল্লাহ দেখেন?’ (আলাক্ব ৯৬/১৪)।
প্রকৃতপক্ষে কোন নিষিদ্ধ কাজ করতে একজন ইসলামের অনুসারী ভাবেন যে, এ ক্রিয়া সম্পাদনে আমার শাস্তি রয়েছে। এই চেতনা তাকে পাপকাজ হ’তে বিরত রাখে। ফলশ্রুতিতে তার মাধ্যমে সমাজে বা দেশে কোন ক্ষতি সাধিত হয় না এবং কোন মানুষ ও তার ক্রিয়া-কর্মে কষ্টও পায় না। এ ছাড়া মুসলিম তার হৃদয়ে লালন করে মহান আল্লাহর আরেক বাণী। আল্লাহ বলেন,إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে সচেতন’ (নিসা ৪/১)। আল্লাহ আরো বলেন,الَّذِي لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ ‘যার হাতে রয়েছে আসমান ও যমীনের মালিকানা; বস্ত্ততঃ আল্লাহ সবকিছু প্রত্যক্ষ করেন’ (বুরূজ ৮৫/৯)।
৬. আদল-ইনছাফ তথা ন্যায়পরায়ণতা : আদল আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ- ন্যায়, ন্যায্যতা, ইনছাফ, নিরপেক্ষতা, ন্যায়বিচার ইত্যাদি।[6] আর পরিভাষায় أعطى لكل ذي حق حقه অর্থাৎ ‘প্রত্যেককেই তার প্রাপ্য অধিকার প্রদান করাই আদল’।[7]
সুতরাং আমরা বলতে পারি, কুরআন এবং সুন্নাহ দ্বারা নির্দেশিত বিধি-বিধান আনুযায়ী যার যা হক্ব বা অধিকার রয়েছে, তা সুষ্ঠুভাবে আদায় করাকে আদল বলে। যাকে ইনছাফও বলা হয়।
মানুষের পার্থিব জীবন তথা ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে যদি আদল-ইনছাফ প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহ’লে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি সম্ভব, অন্যথায় নয়। আর এ রকম আদেশই প্রদান করেছেন মানুষের স্রষ্টা মহান আল্লাহ। যেমন আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয়-স্বজনকে দান করার নির্দেশ দেন এবং অশ্লীলতা, অন্যায় কাজ ও অবাধ্যতা হ’তে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর’ (নাহল ১৬/৯০)।
এ পৃথিবীতে মানুষের মাঝে কেউ রাজা, কেউ প্রজা কেউবা আমীর আর কেউ মা’মুর। সবাই সবার উপর যেন ন্যায় ইনছাফ প্রতিষ্ঠা করে এই বিষয়ে ইসলাম সঠিক রূপরেখা প্রদান করেছেন। যারা মানুষের নেতৃত্ব প্রদান করবে তারা অন্যায় পরিহার করে যেন ন্যায় তথা আদলের পথ গ্রহণ করে সেই বিষয়টি ইসলাম সুন্দর ও স্পষ্ট ভাষায় উপস্থাপন করেছে। যেমন-আল্লাহর বাণী يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ وَلَوْ عَلَى أَنْفُسِكُمْ أَوِ الْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ إِنْ يَكُنْ غَنِيًّا أَوْ فَقِيرًا فَاللَّهُ أَوْلَى بِهِمَا فَلَا تَتَّبِعُوا الْهَوَى أَنْ تَعْدِلُوا وَإِنْ تَلْوُوا أَوْ تُعْرِضُوا فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থাকবে এবং কোন সম্প্রদায়ের শক্রতার কারণে কখনও ন্যায়বিচার পরিত্যাগ করো না। সুবিচার কর, এটাই আল্লাহভীতির অধিক নিকটবর্তী। আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ সে বিষয়ে খুব জ্ঞাত ’(মায়েদাহ ৫/৮)।
ইসলাম আরো বলে দিয়েছে মানুষের মাঝে ন্যায় বা ন্যায় বিচারের মূলনীতি, যে নীতিতে সবার মান মর্যাদা রক্ষা হবে এবং সবাই সবার অধিকার পূর্ণভাবে পাবে। যেমন আল্লাহ বলেন, لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنْزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ وَأَنْزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيهِ بَأْسٌ شَدِيدٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ مَنْ يَنْصُرُهُ وَرُسُلَهُ بِالْغَيْبِ إِنَّ اللَّهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ ‘নিশ্চয়ই আমরা আমাদের রাসূলগণকে সুস্পষ্ট প্রমাণাদিসহ প্রেরণ করেছি এবং তাদের সঙ্গে প্রেরণ করেছি কিতাব ও মীযান, যাতে মানুষ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আর নাযিল করেছি লৌহ, যাতে আছে প্রচন্ড শক্তি এবং রয়েছে মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ। এটা এজন্য যে, আলাহ জেনে নিবেন কে তঁাকে ও তঁার রাসূলগণকে না দেখেও সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী’ (হাদীদ ৫৭/২৫)।
এছাড়াও মু’মিন হ’তে হ’লে অন্যতম শর্ত আদল তথা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা। যদিও সেই আদলের কারণে নিজের ও নিজের আত্মীয় স্বজনেরও ক্ষতি হয়।
আল্লাহ বলেন, يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ وَلَوْ عَلَى أَنْفُسِكُمْ أَوِ الْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ إِنْ يَكُنْ غَنِيًّا أَوْ فَقِيرًا فَاللَّهُ أَوْلَى بِهِمَا فَلَا تَتَّبِعُوا الْهَوَى أَنْ تَعْدِلُوا وَإِنْ تَلْوُوا أَوْ تُعْرِضُوا فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতা হিসাবে, যদিও সেটি তোমাদের নিজেদের কিংবা তোমাদের পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে যায়। (বাদী-বিবাদী) ধনী হৌক বা গরীব হৌক (সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করো না)। কেননা তোমাদের চাইতে আল্লাহ তাদের অধিক শুভাকাংখী। অতএব ন্যায়বিচারে প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বল অথবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে জেনে রেখ আল্লাহ তোমাদের সকল কর্ম সম্পর্কে অবহিত’ (নিসা ৪/১৩৫)।
হে চিন্তাশীল পাঠক! একটু ভাবুন তো, ইসলাম বিচারে আদল তথা ন্যায়-ইনছাফ করার ক্ষেত্রে কি চমৎকার রূপরেখা প্রদান করেছে!
মহান স্রষ্টা আল্লাহ এ পৃথিবীবাসীর জন্য রহমত স্বরূপ যে শেষ নবী মুহাম্মদ (ছাঃ)-কে প্রেরণ করেছেন, তাকেও ন্যায়বিচার করার আদেশ প্রদান করেছেন।
মহান আল্লাহ বলেন, وَأَنِ احْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَاحْذَرْهُمْ أَنْ يَفْتِنُوكَ عَنْ بَعْضِ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ إِلَيْكَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَاعْلَمْ أَنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ أَنْ يُصِيبَهُمْ بِبَعْضِ ذُنُوبِهِمْ وَإِنَّ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ لَفَاسِقُونَ ‘আর আমরা নির্দেশ দিচ্ছি যে, তুমি তাদের মধ্যে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফায়ছালা করবে এবং তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করবে না। আর তাদের ব্যাপারে সতর্ক থেকো যেন তারা তোমাকে আল্লাহ প্রেরিত কিছু বিধানের ব্যাপারে বিভ্রান্তিতে না ফেলে। কিন্তু তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে জেনে রেখ যে, আল্লাহ চান তাদেরকে তাদের কিছু কিছু পাপের দরুণ (পার্থিব জীবনে) শাস্তি প্রদান করতে। বস্ত্ততঃ বহু লোক নাফরমান হয়ে থাকে’ (মায়েদা ৫/৪৯)।
আর
তিনি মুহাম্মদ (ছাঃ) সেটাই অনুসরণ করেছেন। বাস্তব জীবনে যার বহু উপমা
রয়েছে তঁার জীবনীতে। যেমন হাদীছে এসেছে, عَنْ عُرْوَةَ عَنْ عَائِشَةَ رضى
الله عنها أَنَّ قُرَيْشًا أَهَمَّهُمْ شَأْنُ الْمَرْأَةِ
الْمَخْزُومِيَّةِ الَّتِى سَرَقَتْ فَقَالُوا مَنْ يُكَلِّمُ فِيهَا
تَعْنِى رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم. قَالُوا وَمَنْ يَجْتَرِئُ
إِلاَّ أُسَامَةُ بْنُ زَيْدٍ حِبُّ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم
فَكَلَّمَهُ أُسَامَةُ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَا
أُسَامَةُ أَتَشْفَعُ فِى حَدٍّ مِنْ حُدُودِ اللَّهِ. ثُمَّ قَامَ
فَاخْتَطَبَ فَقَالَ إِنَّمَا هَلَكَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ أَنَّهُمْ
كَانُوا إِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الشَّرِيفُ تَرَكُوهُ وَإِذَا سَرَقَ فِيهِمُ
الضَّعِيفُ أَقَامُوا عَلَيْهِ الْحَدَّ وَايْمُ اللَّهِ لَوْ أَنَّ
فَاطِمَةَ بِنْتَ مُحَمَّدٍ سَرَقَتْ لَقَطَعْتُ يَدَهَا. আয়েশা (আঃ) থেকে
বর্ণিত তিনি বলেন, জনৈক মাখযূমী মহিলার চুরী সংক্রান্ত অপরাধ কুরাইশদের
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুললো। তারা বললো, এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-বনে
সঙ্গে কে আলোচনা করবে? তারা বললো, নবী করীম (ছাঃ)-এর প্রিয়পাত্র উসামা বিন
যায়েদই এ প্রসঙ্গে কথা বলতে সাহস করতে পারে। অতঃপর উসামা রাসূল (ছাঃ)-এর
নিকট এ কথা বলাতে তিনি বলেন, হে উসামা! তুমি কি মহান আল্লাহর নির্ধারিত
শাস্তি মওকুফের সুফারিশ করছো? অতঃপর তিনি ভাষণ দিতে দাঁড়িয়ে বলেন, তোমাদের
পূর্ববর্তী জাতিরা এজন্য ধ্বংস হয়েছে যে, তাদের মধ্যকার মর্যাদাশীল কেউ
চুরি করলে তারা তাকে ছেড়ে দিত, আর তাদের দুর্বল কেউ চুরি করলে তার উপর
শাস্তি বাস্তবায়িত করত। আমি আল্লাহর কসম করে বলছি, মুহাম্মাদের কন্যা
ফাতিমাও যদি চুরি করতো, তাহলে অবশ্যই আমি তার হাত কাটতাম।[8]
হাদীছের অন্যতম প্রধান বিষয়বস্ত্ত হ’ল- আমি মুহাম্মাদ (ছাঃ) বলছি, ইসলাম ন্যায় প্রতিষ্ঠার ধর্ম। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি, আত্মীয়-স্বজন বা অন্যান্য পরিজনের মূল্য ইসলামী আদল বা ইসলামী বিচারব্যবস্থার কাছে তুচ্ছ। এভাবে মহান আল্লাহ এ পৃথিবীতে প্রেরণকৃত অন্যান্য নবীদেরও আদেশ করেছিলেন মানুষের মাঝে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য। যেমন আল্লাহ তা‘আলা দাঊদ (আঃ)-কে লক্ষ্য করে বলেন, يَادَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِ فَاحْكُمْ بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ وَلَا تَتَّبِعِ الْهَوَى فَيُضِلَّكَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ إِنَّ الَّذِينَ يَضِلُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدٌ بِمَا نَسُوا يَوْمَ الْحِسَابِ ‘হে দাঊদ! আমরা তোমাকে পৃথিবীতে শাসক নিযুক্ত করেছি। অতএব তুমি লোকদের মধ্যে ন্যায়বিচার কর। এ বিষয়ে প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। তাহ’লে তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়, তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। এ কারণে যে, তারা বিচার দিবসকে ভুলে গেছে’ (ছাদ ৩৮/২৬)।
৭. দয়া ও পারস্পরিক সহযোগিতা : ইসলাম সকল ব্যক্তি, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে পরস্পরের মাঝে দয়া ও সহযোগিতার বন্ধনের রচনা করেছে।
যেমন
হাদীছে এসেছে, عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ قَالَ رَسُولُ
اللَّهِ صلى الله عليه وسلم الرَّاحِمُونَ يَرْحَمُهُمُ الرَّحْمَنُ
ارْحَمُوا مَنْ فِى الأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِى السَّمَاءِ الرَّحِمُ
شُجْنَةٌ مِنَ الرَّحْمَنِ فَمَنْ وَصَلَهَا وَصَلَهُ اللَّهُ وَمَنْ
قَطَعَهَا قَطَعَهُ اللَّهُ. আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি
বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা দয়ালুদের উপর দয়া ও অনুগ্রহ করেন।
তোমরা যমীনবাসীদের উপর দয়া কর, আকাশবাসী তোমাদের উপর রহম করবেন। রেহেম হ’ল
রহমান শব্দ থেকে উৎগত। যে ব্যক্তি রেহেমের বন্ধন মিলাবে আল্লাহ তার সাথে
সম্পর্ক রাখবেন। আর যে ব্যক্তি রেহেমের বন্ধন ছিন্ন করবে আল্লাহ তার সাথে
সম্পর্ক ছিন্ন করবেন’।[9]
রাসূল (ছাঃ) মুমিনের পারস্পরিক মুহাববতের কথা বলতে গিয়ে বলেন, إِنَّ الْمُؤْمِنَ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ، يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضًا. وَشَبَّكَ أَصَابِعَهُ ‘একজন মু‘মিন ব্যক্তি অপর মু‘মিনের জন্য একটি অট্টালিকা সদৃশ। যার একাংশ অন্য অংশকে শক্তিশালী করে’।[10]
এছাড়াও রাসূল (ছাঃ) মুমিনদেরকে একটি মানব দেহের সাথে তুলনা করেছেন, যাতে পারস্পরিক দয়া ও সহানুভূতি ও সহমর্মিতার বাস্তব রূপ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়।
হাদীছে এসেছে, عَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَثَلُ الْمُؤْمِنِينَ فِى تَوَادِّهِمْ وَتَرَاحُمِهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ مَثَلُ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى مِنْهُ عُضْوٌ تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ الْجَسَدِ بِالسَّهَرِ وَالْحُمَّى.
ন‘ুমান ইবনু বাশীর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, মুমিনরা পারস্পরিক ভালোবাসা, দয়ার্দ্রতা ও সহানুভূতির দিক থেকে একটি মানব দেহের ন্যায়। যখন তার একটি অঙ্গ আক্রান্ত হয়, তখন তার সমস্ত দেহ ডেকে আনে তাপ ও অনিদ্রা’।[11]
মুমিনরা কিভাবে জীবন যাপন করেছে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও তার ছাহাবীগণ। যার প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলা নিজেই করেছেন।
আল্লাহ বলেন, مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ تَرَاهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِنَ اللَّهِ وَرِضْوَانًا سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِمْ مِنْ أَثَرِ السُّجُودِ ذَلِكَ مَثَلُهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَمَثَلُهُمْ فِي الْإِنْجِيلِ كَزَرْعٍ أَخْرَجَ شَطْأَهُ فَآزَرَهُ فَاسْتَغْلَظَ فَاسْتَوَى عَلَى سُوقِهِ يُعْجِبُ الزُّرَّاعَ لِيَغِيظَ بِهِمُ الْكُفَّارَ وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ مِنْهُمْ مَغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا ‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। আর যারা তার সাথী, তারা অবিশ্বাসীদের প্রতি কঠোর ও নিজেদের মধ্যে রহমদিল। তুমি তাদেরকে দেখবে আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় রুকুকারী ও সিজদাকারী। তাদের চেহারা সমূহে সিজদার চিহ্ন থাকবে। তাদের এরূপই নমুনা বর্ণিত হয়েছে তওরাতে ও ইনজীলে। তাদের দৃষ্টান্ত একটি চারা গাছের ন্যায়। প্রথমে যার কলি বের হয়। অতঃপর তা শক্ত হয় ও পুষ্ট হয়। অতঃপর তা নিজ কান্ডে শক্ত হয়ে দঁাড়ায়, যা কৃষককে আনন্দিত করে। যাতে আল্লাহ তাদের দ্বারা কাফেরদের অন্তর্জ্বালা সৃষ্টি করেন। তাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্মসমূহ সম্পাদন করে, তাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা ও মহা পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন’ (ফাৎহ ৪৮/২৯)।
পৃথিবীতে মানুষের চলাফেরা, উঠা-বসা আচার-আচরণ ইত্যাদি বিষয়ে মানুষের মাঝে বিবাদ-বিসংবাদ, দ্বন্দ্ব-কলহ সৃষ্টি হয়। আর এ ক্ষেত্রেও ইসলাম তার অনুসারীদের শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছে। যেমন- কুরআনে আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ অর্থাৎ, ‘মু‘মিনরা তো পরস্পর ভাই ভাই। অতএব, তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করবে এবং আল্লাহকে ভয় করবে যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হও’ (হুজরাত ৪৯/১০)।
মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলো শান্তিময় নিয়ম-কানূন বা আদব মেনে চলা। স্বেচ্ছাচারিতা ও বিচ্ছিন্ন জীবন অবশ্যই যন্ত্রনাদায়ক। অতত্রব আসুন! এক আদমের সন্তান হিসাবে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সুশৃংখল ও শান্তিময় জীবনের জন্য ইসলামী আদব ও শিষ্টাচারের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হই এবং সার্থক জীবন গঠন করি। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন-আমীন।
(ক্রমশঃ)
[লেখক : কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক, আল-‘আওন]
[1]. বুখারী হা/ ৫৫৫৭; আবুদাউদ হা/৪৭৯৭।
[2]. বুখারী হা/৯; আবুদাউদ হা/৪৬৭৬।
[3]. বুখারী হা/৬১১৭; মিশকাত হা/৫০৭১।
[4]. বুখারী হা/৬১১৮; মিশকাত হা/৫০৭০।
[5]. তিরমিযী হা/২৪৫৮।
[6]. আল-মু‘জামুল ওয়াফী (আরবী-বাংলা) অভিধান, ২৩তম সংস্করণ, ৬৯১ পৃ.।
[7]. আওনুল মা‘বূদ, ২৮৭০ নং হাদীছের ব্যাখ্যা।
[8]. বুখারী হা/৬৭৮৭, ৬৭৮৮; মুসলিম হা/৪৩০২, ৪৩০৩; আবুদাউদ হা/৪৩৭৩।
[9]. তিরমিযী হা/১৯২৪; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৯২২।
[10]. বুখারী হা/৪৮১; মিশকাত হা/৪৯৫৫।
[11]. মুসলিম হা/৬৭৫১, ৬৪৮০।