বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান
সাইফুর রহমান
এ. এইচ. এম. রায়হানুল ইসলাম 11534 বার পঠিত
ভূমিকা : মহা বিশ্বের সমস্ত সৃষ্টিরাজি পরিচালিত হচ্ছে একক ও অদ্বিতীয় স্রষ্টা মহান আল্লাহ রববুল আলামীনের দেয়া নিয়ামানুসারে। গাছ-পালা, নদী-নালা, রাত-দিনসহ সমস্ত জীবজন্তু গ্রহ-নক্ষত্র এক কথায় সব কিছুই চলছে অদৃশ্য এক নিয়ম মেনে। পৃথিবীতে কোন কিছুই আপনা-আপনি তৈরী হয়নি এবং সেগুলো আপনা থেকে পরিচালিতও হচ্ছে না। বরং সব কিছু একজন পরিচালকের দেওয়া নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনেই পরিচালিত হচ্ছে। সুতরাং স্রষ্টার দেওয়া নিয়মের ব্যতিক্রম যদি কেউবা কোনকিছু সৃষ্টি করে তাহলেই তাতে দেখা দেয় বিশৃংখলা ও অশান্তি।
সমগ্র সৃষ্টি জীবের মধ্যে একমাত্র মানুষকেই আল্লাহ তা‘আলা শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করলেন। কারণ তিনি মানুষকে স্বাধীন চিন্তাশক্তি প্রদান করেছেন। মানুষ নিজের খেয়াল খুশীমত যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। চাইলে সে আল্লাহর আনুগত্যও করতে পারে আবার চাইলে নাফরমানী করতে পারে। আর এজন্য আল্লাহ তা‘আলা মানুষের জন্য চিরশান্তি তথা জান্নাত অথবা শাস্তি তথা জাহান্নামের ব্যবস্থা করেছেন। যে ব্যক্তি জেনে বুঝে আল্লাহর আনুগত্য করবে তার জন্য জান্নাত আর যে ব্যক্তি আল্লাহর নাফরমানী করবে তার জন্য রয়েছে জাহান্নাম। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكُمْ فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ إِنَّا أَعْتَدْنَا لِلظَّالِمِينَ نَارًا أَحَاطَ بِهِمْ سُرَادِقُهَا وَإِنْ يَسْتَغِيثُوا يُغَاثُوا بِمَاءٍ كَالْمُهْلِ يَشْوِي الْوُجُوهَ بِئْسَ الشَّرَابُ وَسَاءَتْ مُرْتَفَقًا ‘আর বলে দাও সত্য এসেছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে, কাজেই যার ইচ্ছা ঈমান আনুক যার ইচ্ছা অস্বীকার করুক। নিশ্চয় আমি যালিমদের জন্য আগুন প্রস্ত্তত করে রেখেছি। যার লেলিহান শিখা তাদেরকে ঘিরে রাখবে। তারা সেখানে পানিও চাইলে তাদেরকে গলিত সীসার ন্যায় পানি দেওয়া হবে যা তাদের মুখমন্ডল ঝলসে দেবে, কত না নিকৃষ্ট পানীয় এটি আর কতই নিকৃষ্ট আবাস্থল (এই জাহান্নাম)’ (কাহাফ-১৮/২৯)।
সুতরাং মানুষ চিন্তাশক্তিতে স্বাধীন হলেও মহান আল্লাহর চিরন্তন কিছু সৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। মানুষ চাইলেও আল্লাহ প্রদত্ত অপার নে‘মতের লাগাম টানতে পারে না। নিম্মে আমরা আল্লাহ প্রদত্ত রাত্রি জাগরণ সম্পর্কিত আলোচনার প্রয়াস পাব।
রাতের পরিচয় : বাংলায় রাত হল দিনের বিপরীত। এর প্রতিশব্দ হলো নিশি, নিশা, রজনী, যামিনী, অন্ধকার, তিমির, আঁধার ইত্যাদি। পরিভাষায় সূর্যাস্ত থেকে পরবর্তী সূর্যোদয় পর্যন্ত সময় কালকে রাত বলা হয়।
রাত মহান আল্লাহর এক অশেষ নে‘মত : আল্লাহ তা‘আলা এই জগতে কোন কিছুই অনর্থক সৃষ্টি করেননি। বরং সবকিছুই মানুষের কল্যাণের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, وَمَا خَلَقْنَا السَّمَاءَ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا بَاطِلًا ذَلِكَ ظَنُّ الَّذِينَ كَفَرُوا فَوَيْلٌ لِلَّذِينَ كَفَرُوا مِنَ النَّارِ ‘আমি আকাশ, পৃথিবী ও এ দুয়ের মাঝে যা আছে তা অনর্থক সৃষ্টি করিনি। এরকম ধারণা তো কাফিররা করে থাকে সুতরাং কাফিরদের জন্য রয়েছে আগুনের দূর্ভোগ’ ( ছদ-৩৮/২৭)।
মহান আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ ‘তোমরা কি ভেবেছিলে যে আমি তোমাদেরকে অনার্থক সৃষ্টি করেছি তোমাদেরকে আমার নিকট ফিরে আনা হবে না’ (মূ‘মিনুন-২৩/ ১১৫)।
অতএব রাত মহান আল্লাহর এক অশেষ নে‘মত- এ বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই। কেননা রাত আছে বলেই আমরা সারাদিনের কর্মব্যস্ত থেকে ছুটি পেয়ে ক্লান্তি দূর করতে পারছি। রাত আছে বলেই দিনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারছি। রাত আছে বলেই কর্মচঞ্চল পৃথিবীর সুশান্ত রূপ উপভোগ করতে পারছি।
রাত সৃষ্টির উদ্দেশ্য : এই রাত মহান আল্লাহ সৃষ্টি জগতের জন্য করেছেন আচ্ছাদন বা ঢাকনা স্বরূপ। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ لِبَاسًا ‘আর আমি রাতকে করেছি আবরণ’ (নাবা-৭৮/ ১০)। তিনি আরো বলেন, وَهُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ اللَّيْلَ لِبَاسًا وَالنَّوْمَ سُبَاتًا وَجَعَلَ النَّهَارَ نُشُورً ‘আর তিনি তোমাদের জন্য রাতকে করেছেন আবরণ, নিদ্রাকে করেছেন আরামপ্রদ এবং দিনকে করেছেন জীবন্ত হয়ে ওঠার সময়’ (ফুরক্বান-২৫/৪৭)।
আল্লাহ বলেন, هُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ اللَّيْلَ لِتَسْكُنُوا فِيهِ وَالنَّهَارَ مُبْصِرًا إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَسْمَعُونَ তিনি সেই সত্তা যিনি তোমাদের জন্য রাতকে সৃষ্টি করেছেন, যেন তোমরা তাতে বিশ্রাম নাও। আর দিনকে করেছে আলোক ও দিপ্তীময়। নিশ্চয় এতে শ্রবণশীল সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে (ইউনূছ-১০/৬৭) । অন্যত্র আল্লাহ বলেন, أَلَمْ يَرَوْا أَنَّا جَعَلْنَا اللَّيْلَ لِيَسْكُنُوا فِيهِ وَالنَّهَارَ مُبْصِرًا إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ ‘তারা কি লক্ষ্য করেনা যে আমি রাতকে সৃষ্টি করেছি, যেন তারা তাতে বিশ্রাম নিতে পারে আর দিনকে করেছি দীপ্তিময়? নিশ্চয় এতে ঈমান আনয়নকারী সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নির্দেশনাবলী’ (নামল-২৭/৮৬)।
তাই দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে পারি যে রাত আমাদের জন্য এক অফুরন্ত শান্তি ও নে‘মতের উৎস।
আমরা কীভাবে রাত অতিবাহিত করছি?
ইচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃত রাত জাগাটা এখন বর্তমান সমাজে একটা Trend বা প্রথায় পরিণত হয়েছে। যরূরী কাজ থাকলে তো কথাই নেই, কাজ না থাকলেও আমরা অযথাই রাত জাগি। আবার যারা তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যান তাদেরকে উল্টো নানাভাবে তাচ্ছিল্য করে থাকি। আজকে বেশীর ভাগ মানুষ রাতি জাগরণ করে পাপের মধ্যে নিমজ্জিত থেকে। কেউ নেশা করে, কেউ ব্যভিচার করে, কেউ পরকীয়া করে, কেউবা বিনোদনের নামে অশ্লীল নাটক-সিনেমা উপভোগ করে, কেউ আবার পর্নোগ্রাফীর নীল রাজ্যে রাত্রির মূল্যবান সময় কাটাচ্ছে। ছাত্র ছাত্রীরা বইয়ের আড়ালে মুখ লুকিয়ে মোবাইল বা কম্পিউটারে বিপরীত লিঙ্গের সাথে অবাধ সম্পর্ক গড়ে তুলছে অথবা অশালীন ভিডিও দেখে কিংবা গেমস খেলে বিশ্রামের সময়টাকে অপচয় করছে। কেউবা আবার নাইট ক্লাবে রাত কাটাচ্ছে। মোটকথা অধিকাংশ মানুষই পাপ-পঙ্কিলতায় ডুবে থেকে রাতের এই বিশ্রামের মূল্যবান সময়টাকে ধ্বংস করছে।
বর্তমানে সমাজ ব্যবস্থায় রাত্রি জাগরণের এই বদ অভ্যাস কিন্তু আমাদের উপর ঠিকই কুপ্রভাব ফেলছে। যুক্তরাজ্যের স্লিপ রিসার্চ সেন্টারের গবেষকগণ সাম্প্রতিক এক গবেষণায় রাত জাগার ক্ষতির দিকসমূহ প্রকাশিত হয়েছে। এ সম্পর্কিত একটি গবেষণা প্রবন্ধ যেটি প্রকাশিত হয়েছে ‘প্রমিডিংস অবদ্য ন্যাশনাল একাডেমী অব সায়েন্স’ সাময়িকীতে। এতে দেখা যায় যে, গবেষকরা ২২ জন ব্যক্তিকে নিয়ে শারীরিক পরিবর্তনের বিষয় গুলো পর্যবেক্ষণ করেন। গবেষক সিসন আর্চার জানিয়েছেন অনিয়মিতভাবে রাত জাগলে দেহ ঘড়ির ছন্দ রক্ষাকারী জিন ৯৭ শতাংশ ক্ষেত্রেই কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে ।
সুতরাং এভাবে রাত জাগার ফলে মানুষের দু’ধরনের ক্ষতি হচ্ছে এক. ইহকালীন ও পার্থিব ক্ষতি। দুই, পরকালীন ক্ষতি।
ক. ইহকালীন বা পার্থিব ক্ষতি :
রাত জাগার কালে পার্থিব যে সকল ক্ষতি হয় তা নিম্নরূপ :
(১) মানসিক রোগ : যারা রাতে ঘুমায় না বা রাত জেগে থাকে তাদের মধ্যে Depression বা বিষণ্ণতা, অস্থিরতা ও বিরক্তি এবং সেই সাথে নানাবিধ মানসিক রোগ বা উপসর্গের প্রাদুর্ভাব বেশী দেখা যায়। আর যারা ইতোমধ্যে এসব রোগে ভুগছেন তাদের রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। এজন্য মানসিক রোগের চিকিৎসায় ঘুমের ঔষধের প্রয়োগ বেশী দেখা যায়।
(২) স্মৃতিশক্তি কমে যায় : আমরা সারাদিন যা কিছু শিখি বা জানি তা ব্রেনে স্থায়ীভাবে ধরে রাখতে ঘুম অপরিহার্য। ঘুমের মধ্যে স্মৃতির প্রক্রিয়া স্থায়ী রূপ লাভ করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যারা স্বাভাবিক ঘুমায় তাদের তুলনায় রাত জাগা বা অপর্যাপ্ত ঘুমানো ছাত্রদের একাডেমিক পারফরমেন্স কম। এ কারণেই পরীক্ষার আগের রাতে বেশী রাত পর্যন্ত জেগে পড়াশোনা করতে নিষেধ করা হয়।
(৩) সতর্ক থাকার ক্ষমতা হ্রাস পায় : কেউ যদি দেড় ঘন্টা কম ঘুমায় তাহলে পরের দিন তার শরীরের সক্ষমতা ৩২% কমে যায়। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে সব মেডিকেল রেসিডেন্ট ৪ ঘন্টা কম ঘুমায়, তারা যারা ৭ ঘন্টার বেশী ঘুমায় তাদের চেয়ে দ্বিগুণ বেশী ভুল করে। অথচ তাদের ভুল রোগীদের জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
(৪) সড়ক দুর্ঘটনা : রাতে ঠিক মত ঘুম না হওয়ার পরিণতিতে ড্রাইভিং-এর সময় স্মৃতিবিভ্রাট জনিত সমস্যার তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ায় শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই প্রতি বছর ১ লক্ষের বেশী সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। ১৫৫০ জন নিহত হয় এবং আহত হয় প্রায় ৪০,০০০ মানুষ। আর আমাদের দেশের কথা নাইবা বললাম।
(৫) মেজাজ খিটমিটে হয় : রাত জাগা মানুষদের দিনের বেলায় অস্থিরতা, বিরক্তি, অস্বস্তি বিরাজ করা এবং ক্ষেত্র বিশেষে বিষণ্ণতা কাজ করা কিংবা স্মৃতি বিভ্রাটের কারণে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক ব্যহত হ’তে পারে। সে ক্ষেত্রে মনোমালিন্য বা কথা কাটাকাটির কারণে সহজেই উত্তেজিত হওয়ার ফলে নিকটজনের সাথে সম্পর্কে অবনতি ঘটে।
(৬) ভুল স্মৃতি তৈরী হয় : যারা রাতে পর্যাপ্ত ঘুমান না তাদের ভুল স্মৃতি তৈরী হওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। যেমন এক ব্যক্তি রাতে তার স্ত্রীকে কিছুই বলেনি, অথচ সকালে তিনি এই বলে হৈ চৈ বাধিয়ে দেয় যে ‘তোমাকে রাতে বললাম না খুব সকালেই আমাকে বের হ’তে হবে, তাই নাস্তা প্রস্ত্তত রেখ’। অথচ বাস্তবে সে কিন্তু এ কথা বলেইনি।
(৭) আত্মহত্যার প্রবণতা বেশী হয় : যে সকল মানসিক রোগী আত্মহত্যা করে তাদের বেশির ভাগেরই অন্যতম উপসর্গ থাকে রাতে ঠিকমত ঘুম না হওয়া। গবেষকরা প্রমাণ পেয়েছেন যেসব কিশোর-কিশোরীরা ৫ ঘন্টার কম ঘুমায়, তাদের বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা ৭১% বেশী এবং আত্মহত্যার চিন্তা ৪৮% বেশী। অথচ কিশোর-কিশোরীর জন্য যরূরী হ’ল ৮ ঘন্টা ঘুমানো।
(৮) হার্টের সমস্যা হয় : যারা রাতে ৬ ঘন্টার কম ঘুমায় তাদের উচ্চ রক্তচাপে ভোগার বা নিয়ন্ত্রিত রক্ত চাপ বেড়ে যাওয়ার সম্ভবনা খুব বেশি এবং রাত জাগা রোগীদের হার্ট এ্যাটাক ও স্ট্রোকের প্রাদূর্ভাব বেশী দেখা যায়। সাধারণ মানুষের তুলনায় রাত জাগা মানুষের হার্ট এ্যাটাকের ঝঁুকি ৪০% বেশী। আধুনিক গবেষণামতে ‘আপনি যদি রাতে ৬ ঘন্টার কম ঘুমান এবং ঘুম ঠিক মত না হয় তাহলে আপনার রোগ হওয়া এবং মারা যাওয়ার সম্ভবনা ৪৮% বেশী এবং স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়া বা এতে মারা যাওয়ার সম্ভবনা ১৫% বেশী।
(৯) ডায়াবেটিকস : ডায়বেটিকসের অন্যতম প্রধান কারণ ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্স অর্থাৎ নিঃসৃত ইনসুলিনের প্রতি কোষের সংবেদনশীলতা কমে যাওয়ায় তা ঠিক মত কাজ করতে পাওে না। পরপর ৪ রাত ঠিক মত না ঘুমালে ইনসুলিনের প্রতি কোষের সংবেদনশীলতা ১৬% কমে যায়। ফলে ওজন বৃদ্ধি, প্রি-ডায়াবেটিক ও ডায়াবেডিক হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। নিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিকস অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। জাপানে এক গবেষণাপত্রে দেখা যায় রাত জেগে কাজ করা শ্রমিকদের তুলনায় দিনে কাজ করা শ্রমিকদের ডায়াবেডিকসের প্রাদুর্ভাব ৫০% কম।
(১০) ওজন বৃদ্ধি : রাত জাগলে শরীরে কর্টিসল হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায় যা রক্তে গ্লুকোজের কাজের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ফলে বেশী পরিমাণ ইনসুলিন নিঃসৃত হয়। কিন্তু রাতের বেলা মাংসপেশীর নড়াচড়া কম থাকায় বা খাদ্যের চাহিদা কম থাকায় ইনসুলিন এই গ্লুকোজকে ফ্যাটসেল চর্বি হিসাবে জমা হ’তে সাহায্য করে। তাছাড়াও রাত জাগলে ক্ষুধা নিবারণকারী লেপটিনের মাত্রা কমে যায় এবং ক্ষুধা উদ্রেককারী গ্রেলিনের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে সামগ্রিক ক্রিয়ায় দীর্ঘ মেয়াদে শরীরে ওজন বেড়ে যায়।
(১১) দেহের বৃদ্ধি কমে যেতে পারে : ঘুমের মাধ্যমে দেহের বৃদ্ধিজনিত নিঃসরণ বেশী হয় ফলে দেহের বৃদ্ধির হারও বেশী থাকে। রাতের বেলায় উচ্চতা বৃদ্ধির কারনেই অনেক সময় শিশুর জয়েন্টে ব্যাথা হয়। জয়েন্টের কাছাকাছি হাড়ের অংশে দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির জন্য দায়ী এপিকাসিয়াল পেট, যা বৃদ্ধির সময় ব্যাথার অনুভূতি সৃষ্টি করে। সুতরাং যারা রাতে ঠিক মত ঘুমায় না, বিশেষত শিশু ও টিনএজারদের দেহের বৃদ্ধি কমে যেতে পারে।
(১২) ব্রেস্ট ও ওভারীর ক্যান্সার : মার্কিন এক গবেষণায় দেখা গেছে যেসব কর্মজীবী নারী রাত জেগে কাজ করে তাদের স্তন ও ডিম্বাশয়ে ক্যান্সারের ঝঁুকি অন্য নারীদের তুলনায় যথাক্রমে ৩০%ও ৪৯% বেশী।
(১৩) পেটের সমস্যা : যারা অতিরিক্ত রাত জাগেন তাদের মধ্যে বুক জ্বালাপোড়া, পেপটিক আলসার, বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, ইরিটেবল বাউয়েল সিনড্রোম, ডায়রিয়া ও কোষ্টকাঠিন্য সহ নানা সমস্যা হতে পারে।
(১৪) ক্ষত না সারা : যে কোন ক্ষত দ্রুত সারাতে গভীর ঘুম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যারা রাতে স্বাভাবিক ভাবে ঘুমায় তাদের শরীরের অবস্থা অন্যদের তুলনায় ভাল।
(১৫) বন্ধ্যাত্ব : যে সকল মহিলা রাত জাগে তাদের অনিয়মিত মাসিক, অকালে সন্তান প্রসব, ব্যাথা যুক্ত মাসিক এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সন্তান না হওয়ার মত সমস্যা হতে পারে। বর্তমানে বিশেষজ্ঞরা অনিয়মিত ও অপর্যাপ্ত ঘুমকে বন্ধ্যাত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসাবে গণ্য করেছেন। এছাড়াও যে সকল নারী-পুরুষ রাতে ঠিকমত ঘুমায় না তাদের যৌনাকাঙ্খা কমে যেতে পারে।
(১৬) শরীর ব্যাথা ও ম্যাজম্যাজ করা : যাদের রাতে ঠিকমত ঘুম হয়না তাদের শরীর ব্যাথা ও ম্যাজম্যাজ প্রায় সবসময় লেগেই থাকে। চিকিৎসা শাস্ত্রে শরীর ব্যাথা নামক রোগটি রাত জাগা মানুষদের মধ্যে তুলনামুলকভাবে বেশী দেখা যায়।
(১৭) ক্লান্তি বোধ : ঘুমের মাধ্যমে দেহ বিশ্রাম নেয় পরবর্তী সময়ের জন্য দেহকে পূর্ণ কার্যক্ষম করে তোলার জন্য। কিন্তু যারা রাত জাগে এবং পর্যাপ্ত ঘুমায় না তাদেরকে পরবর্তী দিনে ক্লান্তিতে ভুগতে দেখা যায়।
(১৮) মাইক্রো সিলপ : Microsleep হলো কোন রকম পূর্বাভাস ছাড়াই হঠাৎ করে কয়েক সেকেন্ডের জন্য ঘুমিয়ে পড়া এমনকি কাজ করার অবস্থায়ও। যারা রাত জাগে এবং পর্যাপ্ত ঘুমায় না তাদের মধ্যে Microsleep-এর প্রবণতা বেশী দেখা যায়। যারা ড্রাইভিং করেন বা মেশিন চালায় তাদের জন্য এ অবস্থা মারাত্মক র্দুঘটনা ও প্রাণহানির কারণ হ’তে পারে।
(১৯) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস : দীর্ঘদিন যাবৎ রাত জাগার কারণে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। বিশেষতঃ ভাইরাস জনিত রোগ-বালাইয়ে ভোগার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়।
(২০) প্রদাহ বৃদ্ধি : যারা অনিয়মিত রাত জাগে, তাদের রক্তে প্রদাহ নিদের্শক (Inflammatory Makers) যেমন : Inflammatory (IL-6) Tumor neurosis Factor-Allah) (TNF-A) এবং C-reactive protein (CRP) বেশী থাকে। কোন কোন গবেষক রাত জগাকে Low grade chord chronic inflammation-এর সাথে তুলনা করেছেন। অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, রাত জাগাজনিত যত সমস্যা হয় তার তার বেশীর ভাগ সমস্যার পিছনের রয়েছে এই মৃদু মাত্রার দীর্ঘ মেয়াদী প্রদাহ। আর এ কারণেই রাত জাগা ব্যক্তিদের শরীরে জ্বর জ্বর ভাব, শরীর ব্যাথা বা সমস্যা করা এবং মাথা ব্যাথা করার মত উপসর্গ প্রায়ই দেখা যায়।
(২১) মাথা ব্যাথা (Migraine) : যারা রাতে ঠিকমতো ঘুমায় না তাদের মাথা ব্যাথা বা Migraine-এর ব্যাথা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
(২২) মৃগীরোগ ও খিঁচুনীর উপদ্রব : গবেষণায় দেখা গেছে, রাত জাগা মৃগী রোগীদের খিঁচুনীতে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা রাতে স্বাভাবিক ঘুমানো রোগীদের তুলনায় বেশী।
(২৩) ডার্ক সার্কল ও বগি আই : যারা ক্রমাগত রাত জাগে, তাদের চোখের চারপাশে কালো দাগ বা Dark circle তৈরী হয়। কারো কারো Boggy eye বা চোখের নিচে ফুলে উঠে।
(২৪) অঞ্জনী (STYE) : যারা অতিরিক্ত রাত জাগে তাদের অঞ্জনীরা Stye হওয়ার সম্ভবনাও বেশী হয়।
(২৫) জিন : মানব দেহে এমন কতগুলো জিন আছে যাদের কার্যকারিতা ‘দিবা-রাত্রিতে বা circlias rhythm মেনে চলে। রাত জাগার ফলে এসব জিন চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হ’তে পারে। এগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হ’লে দেহে নানা রকম জটিলতা স্থায়ী রূপ নিতে পারে।
(২৬) নৈতিকতার অধঃপতন : যারা অতিরিক্ত রাত জাগে ও পর্যাপ্ত ঘুমায় না তাদেও নৈতিক বিচারবোধ অনেকাংশে হ্রাস পায়। ফলে তার দ্বারা অহেতুক ও অনৈতিক কাজ অনেক বেড়ে যায়।
(২৭) হাই তোলা : রাত জাগা মানুষগুলোর মধ্যে দিনের বেলায় অতিরিক্ত হাই তোলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
(২৮) অলসতা : রাতে পর্যাপ্ত ঘুমানোর ফলে দিনে অতিরিক্ত হাই উঠে এবং শরীরে সর্বদা অলসতা বিরাজ করে। ফলে শরীর কর্মচঞ্চল হ’তে পারে না। এছাড়াও রাত জাগার আরো অনেক পার্থিব ক্ষতি রয়েছে।
খ. পারলৌকিক ক্ষতি :
(১) আল্লাহর বিরোধিতা : মহান আল্লাহ মানুষের কল্যাণের জন্য ঘুমকে এক মহা নে‘মত হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। আর এই ঘুমকে পুরোপুরি উপভোগ করার জন্য তিনি রাতের নিস্তব্ধতাকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে মানুষ দিনের কর্মক্লান্তি রাতে ঘুমানোর মাধ্যমে দূর করে পরের দিন আবার পূর্ব কর্মদ্যোম নিয়ে তার ইবাদত ও পার্থিব কাজ করতে পারে। কিন্তু আমরা তার এই নে‘মতের শুকরিয়া আদায় না করে, নিজের ইচ্ছে মতো রাতের বিশ্রামকে নষ্ট করছি। এটা তার নিয়মের বিরোধিতা নয় কি?
(২) সুন্নাতের বিরোধিতা : রাসূল (ছাঃ) এশার ছালাতের পূর্বে ঘুমানো এবং এশার পর কথোপকথনকে অপসন্দ করতেন (বুখারী হা/৫৬৮; মুসলিম হা/৬৪৭)।
(৩) ফজরের ছালাত কাযা : অতিরিক্ত
রাত জাগার ফলে অধিকাংশ সময় ফযরের ছালাত জামা‘আতে আদায় করা সম্ভব হয় না।
অথচ এর ফযীলত অনেক বেশী। উছমান ইবনু আফফান (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এশার ছালাত জামা‘আতে আদায় করে তার জন্য অর্ধরাত
ছালাত আদায়ের ছওয়াব রয়েছে। আর যে ব্যক্তি এশা ও ফযরের ছালাত জামা‘আতে আদায়
কওে, তার জন্য সারা রাত ছালাত আদায়ের ছওয়াব আছে’।[1]
(৪) দায়িত্বহীনতার পাপ : রাত জাগার ফলে দিনে ঘুমের চাপ সৃষ্টি হয়। যে কারণে ব্যক্তির ব্যবসা, চাকুরী, কৃষি কাজ, শিক্ষাদান, প্রভৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা মানুষের প্রকৃতি পরিপন্থী, যে প্রকৃতির উপর আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছেন। আর এ বিষয়ে অবশ্যই তাকে ক্বিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসা করা হবে। মানুষের দুনিয়াবী জীবন হচ্ছে মহান আল্লাহর নির্দেশিত ইবাদতের জন্য। সুতরাং বিচারের মাঠে তাকে অবশ্যই এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে। অতঃপর সে তার ভালো-মন্দ কৃতফল ভোগ করবে।
এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا ‘যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই তার পিছে পড়ো না। নিশ্চয়ই কান, চোখ ও হৃদয় প্রত্যেকটির বিষয়ে তোমরা (ক্বিয়ামতের দিন) জিজ্ঞাসিত হবে’ (ইসরা ১৭/৩৬)।
সৎকর্মশীল বান্দাগণ বা সালাফে ছালেহীনরা জান্নাত লাভের উপায় হিসাবে রাতের সময়কে ইবাদতে কাজে লাগাতেন। তারা রাতের যতটুকু অংশ জেগে থাকতেন ততটুটুকে ছালাত, যিকির, ইস্তিগফার ও কুরআন তিলাওয়াতের সময় হিসাবে ব্যয় করতেন। তারা নিয়মিত তাহাজ্জুদ ছালাত আদায়ের অভ্যস্ত ছিলেন। সুতরাং আমাদেরও উচিৎ রাতের পিনপতন নীরবতায় বিশ্রাম গ্রহণের পাশপাশি মহান আল্লাহর ইবাদতে আত্মনিয়োগ করা। দিনে কর্মব্যস্ততার দরুণ আমরা যথাযথভাবে আল্লাহর ইবাদত করতে সক্ষম হই না। তাই রাতের নিস্তব্ধতার অবসওে আমাদের প্রতিপালক সমীপে মনের সমস্ত আবেগ ঢেলে দিয়ে প্রার্থনা নিবেদন করা কর্তব্য। তাহলেই আশা করা যায় আমরা সৎকর্মশীল বান্দাদের অর্ন্তভুক্ত হতে পারব ইনশাআল্লাহ।
গ. রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাওয়ার উপকারিতা :
আমরা যদি রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাই তাহলে শেষ রাতে তাহাজ্জুদ ও জামা‘আতে ফযরের ছালাতের জন্য উঠা সহজ হবে। শেষ রাতের এই সময়টা ইবাদতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও উপযুক্ত। মহান আল্লাহ বলেন,
إِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي جَنَّاتٍ وَعُيُونٍ-آخِذِينَ مَا آتَاهُمْ رَبُّهُمْ إِنَّهُمْ كَانُوا قَبْلَ ذَلِكَ مُحْسِنِينَ- كَانُوا قَلِيلًا مِنَ اللَّيْلِ مَا يَهْجَعُونَ- وَبِالْأَسْحَارِ هُمْ يَسْتَغْفِرُونَ-
‘সেদিন মুত্তাক্বীগণ জান্নাতে ও ঝর্ণাসমূহের মাঝে থাকবে। এমতাবস্থায় যে, তারা গ্রহণ করবে যা তাদের পালনকর্তা তাদেরকে দান করবেন। নিশ্চয়ই তারা ইতিপূর্বে ছিল সৎকর্মশীল। তারা রাত্রির সামান্য অংশেই নিদ্রা যেত এবং রাত্রির শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করত’ (যারিয়াত ৫১/১৫-১৮)।
ঘ. কীভাবে রাত জাগার অভ্যাস ত্যাগ করবেন :
এখন হয়তো বলবেন যে, আমার তো তাড়াতাড়ি ঘুম আসে না। কাজ না থাকলেও তাড়াতাড়ি ঘুমাতে পারি না। তাহলে কীভাবে রাত জাগার অভ্যাস পরিত্যাগ করব? নিম্নে কিছু পরামর্শ পেশ করা হলো-
সমাপনী :
আলোচনার দ্বারপ্রান্তে এসে আমরা একথা বলতে পারি যে, আমাদেরকেই বেছে নিতে হবে যে, আমরা আমাদের রাত জাগাকে অভিশপ্ত করবো নাকি মহান আল্লাহর রহমতপ্রাপ্ত করবো। যদি আমরা নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণে রাত্রিযাপন পরিত্যাগ করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এর দেখানো পথ ও পদ্ধতি অনুযায়ী রাত্রি অতিবাহিত করতে পারি, তবে তা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য কল্যাণকর ও বরকতময় হবে। তাই আসুন! আমরা আমাদের রাত্রি জাগরণকে কল্যাণকর করার চেষ্টা করি। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তার দ্বীনের পথে কবুল করুন- আমীন।
[লেখক : সভাপতি, দিনাজপুর (পূর্ব) সাংগঠনিক যেলা]
[1]. বুখারী হা/১৩৭৭; তিরমিযী হা/২২১; আবুদাউদ হা/৫৫৫, আহমাদ হা/ ৪০৯।