ফিৎনা থেকে আত্মরক্ষা

ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 2359 বার পঠিত

বিগত কয়েক বছর ধরে যুবসমাজের মধ্যে দ্বীনের ব্যাপারে সচেতনতা যথেষ্ট বাড়ছে আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাদের মধ্যে অস্থিরতা এবং উদ্বিগ্নতা। তাদের সামনে নানামুখী চ্যালেঞ্জ। ক্যারিয়ার গঠনের চ্যালেঞ্জ, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার চ্যালেঞ্জ, সামাজিক অবস্থান তৈরীর চ্যালেঞ্জ, পরিবারকে সন্তুষ্ট করার চ্যালেঞ্জ, সর্বোপরি নিজেকে দ্বীনের ওপর টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জ। অথচ এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নেই তাদের যথাযথ নৈতিক ও মানসিক প্রস্ত্ততি। নেই তাদেরকে পথপ্রদর্শন করার মত কোন শক্তিশালী সমাজ কাঠামো। ফলে কিভাবে নিজেদের দ্বীনদারী অক্ষুণ্ণ রেখে এসব চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে এবং সফলভাবে তা উৎরানো যাবে-এটাই হ’ল সমকালীন দ্বীনদার যুবকদের প্রধান ভাবনা।

বস্ত্ততঃ একদিকে বস্ত্তবাদী সমাজের চাকচিক্যময় হাতছানি, চারিত্রিক অধঃপতন ঘটানোর জন্য যাবতীয় উপায়-উপকরণের সহজলভ্যতা; অন্যদিকে নানামুখী মতবাদ ও আদর্শের ডামাডালে একজন দৃঢ় আত্মবিশ্বাসী এবং লক্ষ্যে অবিচল ব্যক্তির পক্ষেও যেখানে নিজেকে ধরে রাখা সহজসাধ্য নয়, সেখানে একজন সাধারণ দ্বীনদার যুবকের পক্ষে তা কতটা কঠিন; সেটা বলাই বাহুল্য। এজন্যই বোধহয় রাসূল (ছাঃ) তাঁর ছাহাবীদের লক্ষ্য করে বলেছেন, তোমাদের পরে এমন একটি সময় আসছে, যখন দ্বীনের উপর অটল থাকা ব্যক্তিদের প্রতিদান হবে তোমাদের মধ্যকার পঞ্চাশজন শহীদের সমপরিমাণ (সিলসিলা ছহীহাহ হা/৪৯৪)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তোমাদের পর আসছে এমন একটি সময় যখন দ্বীনের উপর ধৈর্যসহকারে টিকে থাকা হবে হাতের মুঠোয় জ্বলন্ত অঙ্গার ধরে থাকার মত সুকঠিন (ঐ)।

এই সর্বগ্রাসী চ্যালেঞ্জ ও ফিৎনাসমূহকে আমরা দু’টি ভাগে ভাগ করতে পারি। (১) প্রবৃত্তিপরায়ণতা (২) সংশয়াচ্ছন্নতা। প্রবৃত্তিপরায়ণতার মধ্যে পড়ে ঘটে যায় যাবতীয় অন্যায়-অনাচার। আর সংশয়াচ্ছন্নতার মধ্যে পড়ে ঘটে থাকে প্রকৃত সত্যকে খুঁজে না পাওয়া কিংবা মিথ্যাকে সত্য ও অন্যায়কে ন্যায় ভেবে দিশেহারা হওয়া। এর কারণে এমনকি যারা বিশুদ্ধ আক্বীদা ও আমলের অনুসারী, তারাও সঠিক জ্ঞানের অভাবে জঙ্গীবাদ, চরমপন্থা এবং সালাফে ছালেহীনের মানহাজবিরোধী ধ্যান-ধারণার ফাঁদে পড়ে পথভ্রষ্ট হওয়ার আশংকামুক্ত নয়। সুতরাং যদি এই দু’টি ফিৎনাকে আমরা যথাযথভাবে চিহ্নিত করতে পারি এবং তার প্রতিকারে তাক্বওয়াপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করি, তবে এই সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ উন্মুক্ত হবে বলে আশা করা যায়। আর ইসলামের মৌলিক উদ্দেশ্যই হ’ল এই দুটি ফিৎনা থেকে মানবতাকে রক্ষা করা। যেমন ভবিষ্যৎ বংশধরকে সকল ফিৎনা থেকে রক্ষার জন্য পিতা ইবরাহীম ও ইসমাঈল দো‘আ করে বলেছিলেন, হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি তাদের মধ্য থেকেই তাদের মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যিনি তাদের কাছে আপনার আয়াত সমূহ পাঠ করবেন, তাদেরকে কিতাব ও সুন্নাত শিক্ষা দিবেন এবং তাদের (অন্তরসমূহকে) পরিচ্ছন্ন করবেন (বাক্বারাহ ২/১২৯)।

এক্ষণে সকল ফিৎনা ও চ্যালেঞ্জ থেকে আত্মরক্ষার জন্য আমরা পবিত্র কুরআনে বর্ণিত কয়েকটি ব্যবহারিক উপায় আলোচনা করতে পারি।

(১) কুরআন অধ্যয়ন। কুরআন অনুধাবন ও তা বুঝে পাঠ করা এবং কুরআন অনুযায়ী নিজের জীবনকে ঢেলে সাজানোর প্রতিজ্ঞা ফিৎনা থেকে আত্মরক্ষার একটি অন্যতম উপায়। কেননা আল্লাহ এই কুরআন দ্বারাই মানুষের অন্তরকে সুদৃঢ় করেন এবং বাতিল থেকে সুরক্ষা দান করেন (ফুরক্বান ২৫/২২)।

(২) রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনী পাঠ করা। রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনকাহিনী এমন অসংখ্য ঘটনায় পরিপূর্ণ, যা একজন মুমিনকে প্রতি মুহূর্তে ঈমানী চেতনায় উদ্দীপ্ত রাখে। ন্যায় ও কল্যাণের পথে অটল থাকার প্রেরণা যোগায়। অনুরূপভাবে আল্লাহ প্রেরিত অন্যান্য নবীর কাহিনীসমূহ পাঠ করা উচিৎ। কেননা এ সকল ঘটনা মুমিনের জন্য মহা উপদেশ। কুরআনে এ উদ্দেশ্যেই পূর্ববর্তীদের কাহিনীসমূহ উল্লেখ করা হয়েছে (হূদ ১১/১২০)।

(৩) ইলম অনুযায়ী আমল করা। আমরা সাধারণত কোন বিষয়ে হালাল-হারাম জানার পরও তার উপর আমল করি না কিংবা গড়িমসি করি। ফলে সহজেই আমাদের ঈমান দুর্বল ও অরক্ষিত হয়ে পড়ে। সুতরাং ঈমানকে সবল ও প্রাণবন্ত রাখার জন্য ইলম অনুযায়ী আমল করা আবশ্যক (নিসা ৪/৬৬)।

(৪) আল্লাহর রাস্তায় খরচ করা। আত্মত্যাগ ও আত্মোৎসর্গ ব্যতীত জীবনের কোন মহৎ লক্ষ্যই অর্জিত হয় না। এজন্য নিজের ধন-সম্পদ থেকে যখন নিঃস্বার্থভাবে খরচ করা হয়, তখন তা যেমন অন্তরে পরিশুদ্ধি আনে, তেমনি হকের উপরে দৃঢ় থাকার শক্তি যোগায় (বাক্বারাহ ২/২৬৫)।

(৫) সৎব্যক্তিদের সাথে সম্পর্ক গড়া। সমাজে চলার জন্য মানুষের সাথে মিশতেই হয়। আর সেই মানুষ যদি সৎ হন এবং সুপথপ্রদর্শনকারী হন, তবে নিজেকে আল্লাহর আনুগত্যের উপর ধরে রাখা অনেক সহজ হয়ে যায়। এজন্যই ইসলাম সৎসঙ্গী নির্বাচন এবং জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে (তওবা ৯/১১৯, কাহফ ১৮/২৮)। সুতরাং নেককার মানুষদের সান্নিধ্যে থাকা খুবই যরূরী। কোন দ্বীনী সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততার মাধ্যমে এই উদ্দেশ্য হাছিল করা সম্ভব।

(৬) সর্বদা আল্লাহর কাছে দো‘আ করা। একজন মুমিনের নিষ্ঠা এবং আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল প্রকাশ পায় দো‘আর মাধ্যমে। এজন্য দো‘আকেই ইবাদত বলা হয়েছে। অতএব ফিৎনা থেকে বাঁচার জন্য সর্বদা আল্লাহর নিকট সাহায্য চাইতে হবে। তাঁর রহমতই ফিৎনা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় (ইউসুফ ১২/৫৩)।

এজন্য রাসূল (ছাঃ) এই দো‘আটি সর্বদা পাঠ করতেন-‘ইয়া মুক্বাল্লিবাল কুলূব ছাবিবত ক্বালবী আলা দ্বীনিকা’ (হে অন্তর সমূহের পরিবর্তনকারী! তুমি আমার অন্তরকে তোমার দ্বীনের উপর অবিচল রাখ)। আনাস (রাঃ) তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা ঈমান এনেছি আপনার প্রতি এবং আপনি যা কিছু নিয়ে এসেছেন তার প্রতি। তবুও কি আপনি আমাদের ব্যাপারে আশংকা করেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ! কেননা মানুষের অন্তরগুলো আল্লাহর দুই আঙ্গুলের মাঝে রয়েছে। তিনি যেভাবে খুশী অন্তরের পরিবর্তন ঘটান (তিরমিযী হা/২১৪০, সনদ ছহীহ)। সুতরাং নিজেকে দুনিয়াবী যাবতীয় ফিৎনা থেকে বাঁচাতে হ’লে উপরোক্ত পদক্ষেপগুলো নিতে হবে। তবে সবচেয়ে প্রয়োজন হ’ল ফিৎনা থেকে বাঁচার জন্য নিজের অন্তরের তাক্বীদ। যদি কেউ সত্যিকার অর্থে ফিৎনা থেকে বাঁচতে চায় এবং সর্বান্তঃকরণে প্রচেষ্টা চালায়, তবে আল্লাহ তাকে সুপথ প্রদর্শন করবেনই ইনশাআল্লাহ। আর এটা আল্লাহর ওয়াদা (আনকাবূত ২৯/৬৯)।

জাতীয় নির্বাচন অতীব সন্নিকটে। যুবসমাজের জন্য ফিৎনার একটি বড় উপলক্ষ্য ক্ষমতাকেন্দ্রিক এই রাজনীতি। কত শত মানুষ যে এতে অংশগ্রহণ করে অনৈতিক পথ অবলম্বন করছে এবং বেঘোরে জান-মাল ও ইযযত হারাচ্ছে, তার কোন ইয়ত্তা নেই। একজন দ্বীনদার ও জান্নাতপিয়াসী যুবক কখনও নিজের মূল্যবান জীবন ও সময়কে এমন ধ্বংসাত্মক পথে বিলিয়ে দিতে পারে না। মুমিন অবশ্যই সমাজ ও রাজনীতি সচেতন হবে, কিন্তু মুমিনের প্রকৃত সংগ্রাম হ’ল আক্বীদা ও বিশ্বাসের সংগ্রাম। অতএব যে রাজনীতি তার আক্বীদায় আঘাত হানে, তার বিশ্বাসের ভিত্তিকে চুরমার করে দেয়, যে রাজনীতি আল্লাহর সার্বভৌমত্বের পরিবর্তে মানুষের সার্বভৌমত্বের শ্লোগান দেয়, যে রাজনীতি আল্লাহর বিধান বাদ দিয়ে মানুষের মনগড়া বিধান দিয়ে মানুষের উপর যুলুম করে, যে রাজনীতি সমাজে অশান্তি, ধ্বংস ও বিশৃংখলা ডেকে আনে; তাতে অংশগ্রহণের কোনই সুযোগ নেই। বরং সে রাজনীতি পরিবর্তন করাই হ’ল প্রকৃত রাজনীতি। এই অশুভ রাজনীতিকে পরিবর্তনের জন্য প্রচেষ্টা ও অহীর বিধানের আলোকে সমাজ সংস্কারের সংগ্রামই হ’ল এ যুগে মুমিনের প্রকৃত সংগ্রাম। অতএব যুবসম্প্রদায়কে এই ফিৎনার ব্যাপারে অত্যন্ত সজাগ থাকতে হবে।

নির্বাচনে কে জয়লাভ করবে বা না করবে; কাকে সমর্থন করতে হবে বা না করতে হবে তা আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়; বরং আমাদের বিবেচ্য হবে, কিভাবে সমাজের শাসক ও শাসিত প্রত্যেক মানুষকে আল্লাহর পথে ফিরিয়ে আনা যায়। কিভাবে আল্লাহর বিধানকে সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত করা যায়। একজন নীতিনির্ধারক হিসাবে শাসকও এই দাওয়াতের বাইরে নয়; বরং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সুতরাং জান্নাতপিয়াসী যুবসমাজকে জীবনের মহৎ আদর্শ ও লক্ষ্যকে সর্বাগ্রে রেখে পথ চলতে হবে। কখনও শাসকের সাথে ক্ষমতাকেন্দ্রিক সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া যাবে না; বরং শাসককে নছীহত বা সদুপদেশই হ’ল ইসলামের কর্মনীতি। রাসূল (ছাঃ) বলেন, তিনটি বৈশিষ্ট্য থাকলে একজন মুমিনের অন্তর কখনও প্রতারিত বা পথভ্রষ্ট হয় না- (১) সকল কর্ম কেবল আল্লাহর উদ্দেশ্যে হওয়া (২) শাসকদের সদুপদেশ দেয়া (৩) জামা‘আতকে আঁকড়া থাকা (ইবনু মাজাহ হা/২৩০, ছহীহাহ হা/৪০৩)। ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, ‘এই তিনটি বিষয় দ্বীন পালনের মূলনীতি স্বরূপ। কেননা এতে আল্লাহর হক ও বান্দার হক আদায় এবং একাধারে দুনিয়া ও আখেরাতে সার্বিক কল্যাণ লাভের পথনির্দেশ করা হয়েছে’ (মাজমূ‘ঊল ফাতাওয়া ১/১৮)। আল্লাহ আমাদের সকল ভাই-বোনকে দুনিয়াবী যাবতীয় ফিৎনা থেকে রক্ষা করুন এবং কুফর ও নিফাকমুক্ত ঈমান সহকারে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন!  


আরও