আব্দুর রহমান কাশগড়ীর অভিবাসী হওয়ার করুণ কাহিনী
ড. নূরুল ইসলাম
আহমাদুল্লাহ 9493 বার পঠিত
(১১তম সংখ্যা মার্চ-এপ্রিল’১৩-এর পর)
৫. কতিপয় যুবক ধারণা করে, ইসলাম মানুষের স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করে দেয় এবং যাবতীয় শক্তিকে ধ্বংস করে ফেলে। ফলে তারা ইসলাম থেকে দূরে সরে যায় এবং ইসলামকে পশ্চাদমুখী ধর্ম হিসাবে মনে করে। যে ধর্ম তাদের অনুসারীদেরকে পশ্চাতে নিয়ে যায় এবং তাদের ও উন্নতি-অগ্রগতির মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
এই সমস্যার সমাধান : এই যুবকদের জন্য ইসলামের প্রকৃত স্বরূপের পর্দাকে উন্মোচন করা যারা নেতিবাচক ধারণা, জ্ঞানের স্বল্পতা অথবা একই সাথে উভয়টির কারণে ইসলামের প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে জানে না। কবি বলেছেন, ‘আর যে ব্যক্তি অসুস্থার হেতু তিতো মুখের অধিকারী হবে, সে ঐ মুখে সুস্বাদু পানির স্বাদ তিতোই পাবে’।
ইসলাম স্বাধীনতকে সীমাবদ্ধকারী নয়। বরং তা স্বাধীনতাকে সুসমন্বিত করা এবং সঠিক দিক-নির্দেশনা প্রদানকারী। যাতে একজন ব্যক্তিকে মাত্রাতিরিক্ত স্বাধীনতা দেওয়ার ফলে তা অন্যদের স্বাধীনতার সাথে সংঘাতপূর্ণ না হয়। কেননা, যে ব্যক্তিই মাত্রাতিরিক্ত স্বাধীনতা চাইবে। তা অন্যদের স্বাধীনতা অনুযায়ী হ’তে হবে। এতে স্বাধীনতাসমূহের মাঝে সংঘর্ষ বেঁধে যাবে নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়বে ও ধ্বংস নেমে আসবে।
এজন্যই আল্লাহ ধর্মীয় বিধি-বিধানগুলিকে ‘হুদূদ’ (দন্ডবিধি) নামকরণ করেছেন। আর যখন হুকুমটি নিষেধাজ্ঞামূলক হয় তখন আল্লাহ বলেছেন, تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ فَلا تَقْرَبُوها ‘এটাই আল্লাহর সীমা। অতএব তোমরা তার নিকটবর্তী হবে না’ (বাকারাহ ২/১৮৭)। আর যদি হুকুমটি ইতিবাচক হয় তাহ’লে বলেছেন, تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ فَلَا تَعْتَدُوهَا ‘এটাই আল্লাহর সীমা। অতএব তোমরা তা লংঙ্ঘন করবে না’ (বাকারাহ ২/২২৯)।
কতিপয় ব্যক্তির ইসলাম কতৃক স্বাধীনতাকে সীমিত করার ধারণা এবং মহাপ্রজ্ঞাময় সূক্ষ্ণদর্শী আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যে দিকনির্দেশনা ও ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন করেছেন তার মাঝে পার্থক্য রয়েছে।
এর উপর ভিত্তি করে বলা যায়, এই সমস্যার মূলত কোন কারণই নেই। কারণ ব্যবস্থাপনা ও শৃংখলাবিধান এই বিশ্বের প্রতিটি ক্ষেত্রেই একটি বাস্তব বিষয়। মানুষ এই বাস্তবমুখী ব্যবস্থাপনার প্রতি স্বভাবতঃই অনুগত। সে ক্ষুধা ও পিপাসার কতৃত্ব এবং খাদ্য ও পানীয় গ্রহণের শৃঙ্খলার প্রতি অনুগত। আর এজন্যই সে পরিমাণ, ধরণ ও প্রকারগত দিক থেকে তার খাদ্য ও পানীয় গ্রহণে শৃংখলা বিধানে বাধ্য হয়। যাতে সে যেন খাদ্য গ্রহনে তার শরীরের সুস্থতা ও নিরাপত্তা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে।
তদ্রূপ সে বাসস্থান, পোষাক-পরিচ্ছদ এবং যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে তার দেশের রীতি-নীতি আঁকড়ে ধরে সামাজি নিয়ম-কানুনের প্রতি বিনয়ী হয়। যেমন- সে পোষাকের আকার ও ধরন, বাড়ীর আকার-আকৃতি ও তার প্রকার, চলাচল ও ট্রাফিক নিয়মের প্রতি অনুগত হয়। আর যদি সে এগুলোর প্রতি অনুগত না হয়; তবে সে ব্যতিক্রমধর্মী (অসামাজিক) গণ্য হবে। বিচ্ছিন্ন ও প্রচলিত নিয়ম-নীতি থেকে দূরে অবস্থানকারী ব্যক্তির ক্ষেত্রে যা প্রযোজ্য তা তার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।
অতএব পুরো জীবনটাই নির্দিষ্ট সীমারেখার প্রতি অনুগত থাকে। যাতে সকল বিষয় উদ্দিষ্ট লক্ষ্যবস্ত্তর দিকে ধাবমান হয়। উদাহরণস্বরূপ, সমাজ সংস্কার ও বিশৃংখলা রোধের জন্য যদি সামাজিক নিয়ম-নীতির প্রতি আবশ্যিকভাবে অনুগত থাকতে হয় এবং কোন নাগরিক এতে কোন বিরক্ত না হয় তাহলে মুসলিম উম্মাহর সংস্কারের জন্য অবশ্যই শারঈ নিয়ম-নীতির প্রতি অনুগত থাকতে হবে।
তাহ’লে কতিপয় ব্যক্তি কিভাবে এ ব্যাপারে নাখোশ হয় এবং শরী‘আতকে স্বাধীনতা সংকুচিতকারীরূপে দেখে? নিশ্চয়ই এটি স্পষ্ট অপবাদ, বাতিল ও ধ্যাণ-ধারণা।
তেমনিভাবে ইসলাম ক্ষমতা বিনষ্টকারী নয়। বরং তা চিন্তাগত, বুদ্ধিবৃত্তিক ও শারীরিক সকল ক্ষমতা বিকাশের প্রশস্ত ক্ষেত্র।
ইসলাম চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণার দিকে আহবান জানায়। যেন মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে এবং তার বোধশক্তি ও ধ্যান-ধারণাকে উন্নত করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, قُلْ إِنَّمَا أَعِظُكُمْ بِوَاحِدَةٍ أَنْ تَقُومُوا لِلَّهِ مَثْنَى وَفُرَادَى ثُمَّ تَتَفَكَّرُوا ‘বল! আমি তোমাদেরকে একটি বিষয়ে উপদেশ প্রদান করছি যে, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে দুই দুই জন কিংবা এক একজন করে দাঁড়াও। অতঃপর চিন্তা কর’ (সাবা ৩৪/৪৬)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, قُلِ انْظُرُوا مَاذَا فِي السَّماواتِ وَالْأَرْضِ ‘হে নবী বলে দাও! তোমরা অবলোকন কর, কি কি বস্ত্ত রয়েছে আসমানসমূহে ও যমীনে’ (ইউনুস ১০/১০১)।
ইসলাম শুধু চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করার প্রতি আহবান জানিয়েই ক্ষ্যান্ত হয় না। বরং যারা উপলব্ধি করে না, গবেষণা ও চিন্তা-ভাবনা করে না। তাদের সমালোচনা করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,أَوَلَمْ يَنْظُرُوا فِي مَلَكُوتِ السَّماواتِ وَالْأَرْضِ وَما خَلَقَ اللَّهُ مِنْ شَيْءٍ ‘তারা কি দেখেনি আকাশসমূহ ও পৃথিবীর রাজত্ব সম্পর্কে এবং আল্লাহ যা কিছু সৃষ্টি করেছেন সে সকল বস্ত্ত হ’তে’? (আ‘রাফ ৭/১৮৫)।
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেছেন, أَوَلَمْ يَتَفَكَّرُوا فِي أَنْفُسِهِمْ مَا خَلَقَ اللَّهُ السَّماواتِ وَالْأَرْضَ وَما بَيْنَهُما إِلاَّ بِالْحَقِّ وَأَجَلٍ مُسَمًّى ‘তারা কি নিজেরা ভেবে দেখেনি যে, আল্লাহ আকাশমন্ডলী, পৃথিবী ও এতদুভয়ের অন্তবর্তী সবকিছু সৃষ্টি করেছেন যথাযথরূপে ও এক নির্দিষ্টকালের জন্য?’ (রূম ৩০/৮)।
তিনি আরো বলেন, وَمَنْ نُعَمِّرْهُ نُنَكِّسْهُ فِي الْخَلْقِ أَفَلَا يَعْقِلُونَ ‘আমি যাকে দীর্ঘ জীবন দান করি। তাকে তার জন্মগত অবস্থায় ফিরিয়ে দেই। তবুও কি তারা অনুধাবন করে না’? (ইয়াসীন ৩৬/৬৮)।
গবেষণা ও চিন্তা করার আদেশ প্রদান বুদ্ধিবৃত্তিক ও চিন্তার দ্বারকে উন্মোচন করে, অন্য কিছুই নয়। এরপরও কিভাবে কতিপয় যুবকরা বলে যে, ইসলাম (শারীরিক এবং মানসিক) শক্তিকে ধ্বংস করে দেয়? আল্লাহ বলেছেন, كَبُرَتْ كَلِمَةً تَخْرُجُ مِنْ أَفْواهِهِمْ إِنْ يَقُولُونَ إِلاَّ كَذِباً ‘কত উদ্ধতপূর্ণ উক্তি তাদের মুখ হ’তে নিঃসৃত হয়! তারা তো শুধু মিথ্যাই বলে’ (কাহাফ ১৮/৫)।
ইসলাম মুসলমানদের জন্য ঐ সকল ভোগের বস্ত্তকে বৈধ ঘোষণা করেছে, যাতে ব্যক্তির শরীরে বা দ্বীনে বা বুদ্ধিমত্তায় ক্ষতিকর কিছু নেই।
ইসলাম সকল প্রকার উৎকৃষ্ট বস্ত্ত হ’তে খাদ্য ও পানীয় হালাল করেছে। আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّباتِ مَا رَزَقْناكُمْ وَاشْكُرُوا لِلَّهِ ‘হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যে জীবিকা দান করেছি সেই পবিত্র বস্ত্ত হ’তে ভক্ষণ কর এবং আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর’ (বাক্বারাহ ২/১৭২)।
আল্লাহ আরো বলেন, وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ ‘আর তোমরা খাও ও পান কর এবং অপচয় কর না। নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীকে ভালবাসেন না’ (আ‘রাফ ৭/৩১)।
আর প্রজ্ঞা ও স্বভাবের দাবী অনুযায়ী ইসলাম সবধরনের পোষাক-পরিচ্ছদকে হালাল করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, يَا بَنِي آدَمَ قَدْ أَنْزَلْنا عَلَيْكُمْ لِباساً يُوارِي سَوْآتِكُمْ وَرِيشاً وَلِباسُ التَّقْوى ذَلِكَ خَيْر-ٌ ‘হে আদম সন্তান! আমি তোমাদের উপর এমন পোষাক নাযিল করেছি, যা তোমার লজ্জাস্থান আবৃত করে ও অবতীর্ণ করেছি সাজ-সজ্জার পরিচ্ছদ। আর অবতীর্ণ করেছি তাক্বওয়াপূর্ণ পোষাক। যা সর্বোত্তম পোষাক’ (আ‘রাফ ৭/২৬)।
আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন, قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ وَالطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ قُلْ هِيَ لِلَّذِينَ آمَنُوا فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا خَالِصَةً يَوْمَ الْقِيَامَة-ِ ‘তুমি জিজ্ঞেস কর যে, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্যে যেসব শোভনীয় বস্ত্ত ও পবিত্র জীবিকা সৃষ্টি করেছেন, তাকে কে নিষিদ্ধ করেছে? তুমি বলে দাও! এসব বস্ত্ত পার্থিব জীবনে মুমিনদের জন্য। ক্বিয়ামতের দিবসে বিশেষ করে তাদের জন্যই’ (আ‘রাফ ৭/৩২)।
আর শারঈ বিবাহের মাধ্যমে মহিলাদের উপভোগকে হালাল করেছে। আল্লাহ বলেছেন, فَانْكِحُوا مَا طابَ لَكُمْ مِنَ النِّساءِ مَثْنى وَثُلاثَ وَرُباعَ فَإِنْ خِفْتُمْ أَلاَّ تَعْدِلُوا فَواحِدَةً ‘নারীদের মধ্য হ’তে তোমাদের মনমত দুই দুই ও তিন তিন এবং চার চারটিকে বিবাহ কর। আর যদি ন্যায় বিচার করতে না পারার আশঙ্কা কর, তাহ’লে একজন (একজনকে বিবাহ কর)’ (নিসা ৪/৩)।
আয়-উপার্জনের ক্ষেত্রে ইসলাম তার অনুসারীদের শক্তি-সামথ্যকে ধ্বংস করেনি। বরং তাদের জন্য সকল প্রকার উপার্জিত ন্যায্য রপ্তানিদ্রব্যকে সন্তুষ্টচিত্তে হালাল বলেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبا ‘আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল এবং সূদকে হারাম করেছেন’ (বাক্বারাহ ২/২৭৫)।
তিনি আরও বলেছেন, هُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ ذَلُولاً فَامْشُوا فِي مَناكِبِها وَكُلُوا مِنْ رِزْقِهِ وَإِلَيْهِ النُّشُورُ ‘তিনিই যিনি তোমাদের জন্য যমীনকে চলাচলের উপযোগী করেছেন। অতএব তোমরা এর দিগন্তে ও রাস্তাসমূহে বিচরণ কর। আর তোমরা তাঁর রিযক্ব হ’তে আহার কর। এবং পুনরুত্থান তো তারই দিকে হবে’ (মুলক ৬৭/১৫)। এছাড়াও তিনি বলেন, فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللهِ ‘যখন ছালাত শেষ হবে তখন তোমরা যমীনে ছড়িয়ে পড়বে। আর আল্লাহর অনুগ্রহ হ’তে অনুসন্ধান করবে’ (জুমু‘আ ৬২/১০)। এরপরও কি কতিপয় ব্যক্তির ধারণা ও উক্তি সঠিক হবে যে, ইসলাম ক্ষমতাকে ধ্বংস করেছে?
যে সমস্ত জটিলতা যুবকদের অন্তরে উদয় হয় : মৃত অন্তরে ধর্মবিরোধী চিন্তা-ভাবনা, কুমন্ত্রণা আসে না। কেননা তা মৃত অন্তরও ধ্বংসপ্রাপ্ত। মৃত অন্তর যে অবস্থায় রয়েছে তার চাইতে তার কাছ থেকে শয়তান অধিক কোন কিছু করার ইচ্ছা করে না। আর এজন্যই ইবনু মাসঊদ ইবনু আববাস (রাঃ)-কে বলা হয়েছিল, নিশ্চয়ই ইহূদীরা বলে যে, ছালাতের মাঝে তাদেরকে কোন কুমন্ত্রনা দেয়া হয় না। অর্থাৎ ছালাতরত অবস্থায় কুমন্ত্রনা পেয়ে বসে না তাদেরকে তখন তিনি বললেন, তারা সত্য বলেছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত অন্তর নিয়ে শয়তান কি করবে।
আর কোন অন্তর যখন উজ্জীবিত থাকে এবং তাতে কিছুটা ঈমান থাকে; তখন শয়তান তাকে ভীষণভাবে আক্রমণ করে। যাতে না আছে কোন নমনীয়তা। আর না আছে কোন নিশ্চলতা। অতঃপর শয়তান তার অন্তরে ধর্মবিরোধী কুমন্ত্রণাসমূহ ঢেলে দেয়। যদি বান্দা তার অনুগত হয়ে যায় তবে তা বিরাট কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি সে তার রবের, তার দ্বীনের ও আকীবদার ব্যাপারে তাকে সন্দিগ্ধ করে তুলতে চেষ্টা করে। যদি সে (শয়তান) অন্তরে দুর্বলতা ও পরাজয়ভাব লক্ষ্য করে তাহ’লে তার উপর প্রভাব বিস্তার করে ফেলে। এমনকি শেষ পর্যন্ত তাকে দ্বীন থেকে বের করে দেয়। আর যদি সে (শয়তান) হৃদয়ে শক্তি ও প্রতিরোধ লক্ষ্য করে তাহ’লে শয়তান তুচ্ছ হয়ে পশ্চাদপসারী ও লাঞ্ছিত, অপদস্থ অবস্থায় পরাজিত হয়।
এই সমস্ত কুমন্ত্রণাসমূহ যা শয়তান অন্তরে নিক্ষেপ করে; তা অন্তরে কোনরূপ ক্ষতি সাধন করতে পারে না যখন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে বর্ণিত চিকিৎসাকে কাজে লাগায়।
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ: جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، إِنَّ أَحَدَنَا يَجِدُ فِي نَفْسِهِ، يُعَرِّضُ بِالشَّيْءِ، لَأَنْ يَكُونَ حُمَمَةً أَحَبُّ إِلَيْهِ مِنْ أَنْ يَتَكَلَّمَ بِهِ، فَقَالَ: اللَّهُ أَكْبَرُ، اللَّهُ أَكْبَرُ، اللَّهُ أَكْبَرُ، الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي رَدَّ كَيْدَهُ إِلَى الْوَسْوَسَةِ-
‘ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, একজন ব্যক্তি নবী (ছাঃ)-এর নিকটে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের কারো মনের মধ্যে এমন কিছু উদয় হয় যা মুখে প্রকাশ করার চেয়ে সে জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়াকে শ্রেয় মনে করে। তিনি বললেন, আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান আল্লাহর জন্য সমস্ত প্রশংসা যিনি শয়তানের এ ধোঁকাকে কল্পনা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রেখেছেন’।[1]
قَالَ: جَاءَ نَاسٌ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَسَأَلُوهُ: إِنَّا نَجِدُ فِي أَنْفُسِنَا مَا يَتَعَاظَمُ أَحَدُنَا أَنْ يَتَكَلَّمَ بِهِ، قَالَ: وَقَدْ وَجَدْتُمُوهُ؟ قَالُوا: نَعَمْ، قَالَ: ذَاكَ صَرِيحُ الْإِيمَان،
‘রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে তাঁর কিছু সংখ্যক ছাহাবী এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল ! আমরা আমাদের অন্তরে এমন কিছু অনুভব করি যা ব্যক্ত করাকে বা যা মুখে আনাকে আমরা গুরুতর মনে করি। আমরা এ ধরনের কথা মনে আসা অথবা পরস্পর আলোচনা করাকে পসন্দ করি না। তিনি বললেন, তোমরা কি এরূপ অনুভব করো? তারা বললেন হ্যাঁ। তিনি বললেন, এ হ’ল স্পষ্ট ঈমানের লক্ষণ’।[2] আর খাঁটি ঈমানের অর্থ হ’ল, এই আপতিত কুমন্ত্রণাকে তোমাদের অস্বীকার করা ও তোমাদের সেটাকে বড় মনে করা তোমাদের ঈমানের কিছুই ক্ষতি করে না। বরং এটি এর প্রমাণ যে, তোমাদের ঈমান খাঁটি। যাকে ত্রুটি-বিচ্যুতি দূষিত করে না।
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: " يَأْتِي الشَّيْطَانُ أَحَدَكُمْ فَيَقُولُ: مَنْ خَلَقَ كَذَا، مَنْ خَلَقَ كَذَا، حَتَّى يَقُولَ: مَنْ خَلَقَ رَبَّكَ؟ فَإِذَا بَلَغَهُ فَلْيَسْتَعِذْ بِاللَّهِ وَلْيَنْتَهِ "
রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, তোমাদের নিকটে শয়তান আসে এবং বলে, এটা কে সৃষ্টি করেছে? ওটা কে সৃষ্টি করেছে? এমনকি শেষ পর্যন্ত সে বলে, তোমার প্রতিপালককে কে সৃষ্টি করেছে? যখন সে ব্যাপারটি এ স্তরে গিয়ে পোঁছে যাবে তখন সে যেন আল্লাহর নিকট আশ্রয় চায়, এবং বিরত হয়ে যায়।[3] অন্য হাদীছে এসেছে, فَلْيَقُلْ آمَنْتُ بِاللَّه وَرُسُلِهِ ِসে যেন বলে, ‘আমি আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছি’। [4]
আবূ দাউদে বর্ণিত অন্য একটি হাদীছে এসেছে,
قَال فَقُولُوا: اللَّهُ أَحَدٌ اللَّهُ الصَّمَدُ لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ ثُمَّ لِيَتْفُلْ عَنْ يَسَارِهِ ثَلَاثًا وَلْيَسْتَعِذْ مِنَ الشَّيْطَانِ ‘(আমি রাসূল (ছাঃ) কে বলতে শুনেছি) তিনি বলেন, তোমরা বলো আল্লাহ একক, আল্লাহ অভাবমুক্ত, তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তিনিও কারো সন্তান নন। আর কেউই তাঁর সাথে তুলনাযোগ্য নয়। তারপর যেনো বামদিকে তিনবার থুথু ফেলে এবং (আল্লাহর কাছে) শয়তানের (কুমন্ত্রণা) থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে’।[5]
এই হাদীছগুলিতে ছাহাবীগণ নবী (ছাঃ)-কে তাদের (কুমন্ত্রণা) ব্যাধির বিবরণ দিয়েছেন। আর তিনি তাদেরকে চারটি বিষয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন-
প্রথমতঃ এই সকল কুমন্ত্রণাগুলি হ’তে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকা এবং এগুলিকে এমনভাবে ভুলে হওয়া যে সেগুলি আদৌ ছিল না। এগুলি থেকে মুখ ফিরিয়ে সঠিক চিন্তায় বিভোর থাকা।
দ্বিতীয়তঃ (الاستعاذة بلله منها, و من الشيطان الرجيم ) বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা।
তৃতীয়তঃ ْ (آمَنْتُ بِاللَّه وَرُسُلِه) ِ আল্লাহ ও তার রাসূলগণের প্রতি ঈমান এনেছি’ বলা।
চতুর্থতঃ(اللَّهُ أَحَدٌ اللَّهُ الصَّمَدُ لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ ثُمَّ يَتْفُلْ عَنْ يَسَارِهِ ثَلَاثًا وََيَقُولْ : اعوذ بلله مِنَ الشَّيْطَان) : এই কথা বলা যে, ‘আল্লাহ এক। আল্লাহ মুখাপেক্ষীহীন। তিনি (কাউকে) জন্ম দেননি এবং তিনি (কারও) জন্মিত নন। আর তার সমতুল্য কেউ নেই’। সে যেন তার বামপার্শ্বে তিনবার থু থু ফেলে এবং বলে, ‘আমি বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাচ্ছি’।
তাক্বদীরের ব্যাপারে কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা : সার্বিকভাবে যেসব বিষয় যুবকদের মনে উদিত হয় এবং তারা হতভম্ব হয়ে থমকে যায়, তন্মধ্যে অন্যতম তাক্বদীরের বিষটি। কেননা তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনয়ন ইসলামের অন্যতম একটি স্তম্ভ। যা ব্যতীত ঈমান পূর্ণ হয় না। আর তা হ’ল, এই মর্মে ঈমান আনা যে, আকাশ ও যমীনে যা কিছু ঘটবে আল্লাহ তা‘আলা তা অবগত আছেন এবং তিনি তার ভাগ্য নির্ধারণকারী। যেমনটি আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা বলেছেন, أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا فِي السَّماءِ وَالْأَرْضِ إِنَّ ذلِكَ فِي كِتابٍ إِنَّ ذلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ ‘তুমি কি জানো না যে, আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু রয়েছে আল্লাহ তা অবগত আছেন? অবশ্যই এসবই লিপিদ্ধ আছে এক কিতাবে। অবশ্যই এটা আল্লাহর উপরে সহজ’ (হজ্জ ২২/৭০)।
নবী (ছাঃ) তাক্বদীর সম্পর্কে তর্ক-বিতর্ক ও ঝগড়া করতে নিষেধ করেছেন।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَنَحْنُ نَتَنَازَعُ فِي القَدَرِ فَغَضِبَ حَتَّى احْمَرَّ وَجْهُهُ، حَتَّى كَأَنَّمَا فُقِئَ فِي وَجْنَتَيْهِ الرُّمَّانُ، فَقَالَ : أَبِهَذَا أُمِرْتُمْ أَمْ بِهَذَا أُرْسِلْتُ إِلَيْكُمْ؟ إِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ حِينَ تَنَازَعُوا فِي هَذَا الأَمْرِ، عَزَمْتُ عَلَيْكُمْ أَلَّا تَتَنَازَعُوا فِيه-ِ
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের কাছে বের হয়ে আসলেন। এমতাবস্থায় আমরা তাক্বদীর নিয়ে তর্ক করছিলাম। তারপর তিনি রেগে গেলেন। এমনকি তাঁর মুখমন্ডল রক্তিম হয়ে গেল যেন তার দুই গালে ডালিম ছড়ানো হয়েছে। এরপর বললেন, তোমরা কি এ ব্যাপারে আদিষ্ট হয়েছ? নাকি আমি এই বিষয়ে তোমাদের নিকট প্রেরিত হয়েছি? তোমাদের পূর্ববর্তীগণ ধ্বংস হয়েছে যখন তারা এই বিষয়ে তর্ক করেছে। আমি তোমাদেরকে এ বিষয়ে ঝগড়া না করতে কঠোরভাবে বলছি’।[6]
তাক্বদীর নিয়ে আলোচনা এবং তর্ক-বিতর্ক করা একজন ব্যক্তিকে এমন গোলকধাঁধাঁয় পতিত করে, যা থেকে সে বের হ’তে সক্ষম হয় না। এ থেকে বেঁচে থাকার পথ হ’ল তুমি কল্যাণকর কাজে আগ্রহী হবে এবং সে ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালাবে। যেভাবে তুমি আদিষ্ট হয়েছ। কেননা আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে বুদ্ধি ও উপলদ্ধি দান করেছেন এবং তোমার নিকট রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন। আর তাদের সাথে আসমানী গ্রন্থসমূহ নাযিল করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
رُسُلًا مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى اللَّهِ حُجَّةٌ بَعْدَ الرُّسُلِ وَكَانَ اللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمًا-
‘আমরা রাসূলগণকে জান্নাতের সুসংবাদ দানকারী ও জাহান্নামের ভয় প্রদর্শনকারী রূপে প্রেরণ করেছি। যাতে রাসূলগণের পরে লোকদের জন্য আল্লাহর বিরুদ্ধে কোনরূপ অজুহাত দাঁড় করানোর সুযোগ না থাকে। আর আল্লাহ অতীব পরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী’ (নিসা ৪/১৬৫)।
যখন মহানবী (ছাঃ) তাঁর ছাহাবীদেরকে বললেন, তোমাদের মধ্যে এমন কোন ব্যক্তি নেই, যার স্থান হয় জান্নাতে বা জাহান্নামে নিদিষ্ট করে রাখা হয়নি। এ কথা শুনে সবাই বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! তাহলে আমরা আমল বাদ দিয়ে আমাদের লিখিত ভাগ্যের উপর কি ভরসা করব? উত্তরে রাসূল (ছাঃ) বললেন, তোমরা আমল করতে থাক,কেননা যাকে যে আমালের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, তার জন্য সে আমলকে সহজ করে দেয়া হবে। যে ব্যক্তি সৌভাগ্যের অধিকারী হবে। তার জন্য সৌভাগ্যের অধিকারী লোকদের আমলকে সহজ করে দেয়া হবে। যে ব্যক্তি দুর্ভাগ্যের অধিকারী হবে। তার জন্য দুর্ভাগ্যের অধিকারী লোকদের আমলকে সহজ করে দেয়া হবে। অতঃপর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নিম্নোক্ত আয়াতগুলি তেলাওয়াত করলেন।
فَأَمَّا مَنْ أَعْطى وَاتَّقى- وَصَدَّقَ بِالْحُسْنى- فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْيُسْرى- وَأَمَّا مَنْ بَخِلَ وَاسْتَغْنى- وَكَذَّبَ بِالْحُسْنى فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْعُسْرى-
(৫) আর যে দান করেছে এবং মুত্তাক্বী হয়েছে। (৬) উত্তমকে সত্যায়ন করেছেন। (৭) অচিরেই তাকে আমি সহজ পথকে সুগম করে দিব (৮) পক্ষান্তরে যে কার্পণ্য করল ও বেপরোয়া হয়েছে (৯) আর উত্তমকে মিথ্যা মনে করল। (১০) অতি শীঘ্রই তার জন্য আমি সুগম করে দিব কঠোরতার পথ। (লাইল ৯২/৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০)।৬
মহানবী (ছাঃ) তাদেরকে আমল করার আদেশ করলেন। এবং তাদের জন্য লিপিবদ্ধ বস্ত্তর (তাক্বদীর) উপর নির্ভরকে জায়েয করলেন না। কেননা জান্নাতীদের মধ্যে যার নাম লেখা হয়েছে সে জান্নাতবাসীর মতো আমল না করলে তাদের অর্ন্তভুক্ত হবেন না। আর জাহান্নামীদের মধ্যে যার নাম লেখা হয়েছে সে তাদের মতো আমল না করলে তাদের অর্ন্তভুক্ত হবে না। আর আমল হয় ব্যক্তির সাধ্যানুসারে। কেননা সে নিজেই জানে যে, আল্লাহ তাকে কাজের ইচ্ছা ও তা সম্পাদন করার ক্ষমতা দান করেছেন। সে চাইলে তা করবে বা বর্জন করবে।
যেমন, একজন মানুষ সফরের পরকিল্পনা করে। অতঃপর সে ভ্রমণ করে সে অবস্থান করার সংকল্প করে। অতঃপর সে অবস্থান করে। সে আগুন দেখে ও সেখান থেকে পালিয়ে যায়। সে তার নিকট কোন পসন্দনীয় জিনিস দেখে এবং তার দিকে অগ্রসর হয়। সুতরাং আনুগত্য ও নাফরমানির বিষয়টিও অনুরূপ। ব্যক্তি তা স্বেচ্ছায় সম্পাদন করে এবং স্বেচ্ছায় বর্জন করে।
কিছু মানুষের কাছে তাক্বদীরের বিষয়ে আরো দু’টি প্রশ্ন দেখা দেয়।
প্রথম প্রশ্ন : একজন ব্যক্তি মনে করে যে সে একটি কাজ স্বেচ্ছায় করছে এবং স্বেচ্ছায় তা বর্জন করছে। অথচ সেটি সম্পাদন করা বা ত্যাগ করার ব্যাপারে বাধ্যতাকে করার বিষয়টি সে অনুভব করছে না। তাহ’লে এটি কিভাবে ঈমানের সাথে একত্রিত হবে যে, প্রত্যকটি বস্ত্ত আল্লাহর ফায়ছালা ও তার নির্ধারিত ভাগ্য অনুযায়ী হয়?
এর জবাব হ’ল, যখন আমরা বান্দার কর্ম ও তার নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করি তখন তাকে দু’টি বিষয় থেকে উদ্ভূত পাই।
(১) اراده অর্থাৎ কোন কাজের ইচ্ছা। (২) قدرة (ক্ষমতা)। যদি এ দু’টি না থাকে তাহ’লে কোন ‘কর্ম’ পাওয়া যায় না। আর ইচ্ছা ও ক্ষমতা দু’টিই আল্লাহর সৃষ্টি। কারণ ইচ্ছা হ’ল মেধাগত শক্তির অন্তর্ভুক্ত। আর ক্ষমতা শারীরিক শক্তির অন্তর্ভুক্ত। যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তবে মানুষের মেধাকে ছিনিয়ে নিতেন। ফলে সে ইচ্ছাহীন হয়ে যেত। অথবা তার ক্ষমতাকে কেড়ে নিতেন। ফলে কাজ করা তার কাছে করার অসম্ভব হয়ে যেত।
যখন কোন মানুষ কোন কাজ করে এবং তা বাস্তবায়ন করে। তখন আমরা নিশ্চিতভাবে জানতে পারি যে, আল্লাহ তা চেয়েছেন ও তা করার শক্তি দিয়েছেন। নতুবা সেই কাজ থেকে তার ইচ্ছাকে পরিবর্তন করে দিতেন। অথবা কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতেন। যা উক্ত কাজের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তার ও তার ক্ষমতার মধ্যে প্রতিবন্ধক হ’ত। এক বেদুঈনকে জিজ্ঞেস করা হ’ল, কিভাবে আল্লাহকে চিনলেন? তিনি বললেন, দৃঢ় ইচ্ছাকে ভেঙ্গে দেওয়া ও ঝোঁককে ফিরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন : মানুষকে তার পাপকর্মের জন্য শাস্তি দেয়া হবে। তাকে কিভাবে শাস্তি দেয়া হবে অথচ সেটা তার ভাগ্যে লিপিবদ্ধ আছে এবং তার পক্ষে তো তার ভাগ্যে লিপিবদ্ধ বিষয় হ’তে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব নয়?
এর জবাবে আমরা বলব : যখন তুমি এটি বলবে তখন এটাও বল যে, মানুষকে আনুগত্যপূর্ণ কর্মের উপর পরস্কার দেওয়া হবে। তাহ’লে কিভাবে তাকে ছওয়াব দেয়া হবে, অথচ তার তা ভাগ্য লিপিবদ্ধ আছে? আর তার পক্ষে তো তার ভাগ্যে লিখিত বিষয় থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব? এটা ন্যায়-সঙ্গত নয় যে, তুমি পাপকাজের স্বপক্ষে ভাগ্যকে দলীল হিসাবে গ্রহন করবে। কিন্তু আনুগত্যের পক্ষে তাকে দলীল হিসাবে গ্রহন করবে না।
দ্বিতীয় জবাব : আল্লাহ তা‘আলা আল-কুরআনে এই দলীলকে বাতিল করেছেন। আর একে জ্ঞানবিহীন উক্তির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
سَيَقُولُ الَّذِينَ أَشْرَكُوا لَوْ شاءَ اللَّهُ مَا أَشْرَكْنا وَلا آباؤُنا وَلا حَرَّمْنا مِنْ شَيْءٍ كَذلِكَ كَذَّبَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ حَتَّى ذاقُوا بَأْسَنا قُلْ هَلْ عِنْدَكُمْ مِنْ عِلْمٍ فَتُخْرِجُوهُ لَنا إِنْ تَتَّبِعُونَ إِلاَّ الظَّنَّ وَإِنْ أَنْتُمْ إِلاَّ تَخْرُصُونَ
‘অচিরেই মুশরিকরা বলবে, আল্লাহ যদি চাইতেন আমরা শিরক করতাম না এবং আমাদের বাপ-দাদারাও করত না। আর হারাম কিছুই করতাম না। এভাবেই তাদের পূর্বে যুগের কাফিররা (রাসূলদেরকে) মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল আমার শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করা পর্যন্ত। তুমি জিজ্ঞেস কর। তোমাদের কাছে কি কোন ইলম আছে? যদি থাকে তবে তা আমাদেরকে পেশ কর। তোমরা ধারণা ও অনুমানই অনুসরণ করো। আর তোমরা আনুমানিক কথা বল’ (আন‘আম ৬/১৪৮)।
আল্লাহ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করলেন যে, তাক্বদীর দ্বারা শিরকের উপর দলীল পেশকারী এই সকল লোকের পূর্ব পুরুষগণও তাদের মত মিথ্যাচার করত। এবং এর উপর বিদ্যমান ছিল আল্লাহর শাস্তি আস্বাদন পর্যন্ত। যদি তাদের দলীল সঠিক হ’ত, তবে আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি আস্বাদন করাতেন না। অতঃপর আল্লাহ তাঁর নবী (ছাঃ)-কে চ্যালেঞ্জ করতে আদেশ করেছেন। তাদের দলীলেন বিশুদ্ধার বিষয়ে প্রমাণ পেশ করার মাধ্যমে আর বর্ণনা করেছেন যে, এ বিষয়ে তাদের কোন প্রমাণ নেই।
তৃতীয় জবাবে আমরা বলব : নিশ্চয়ই তাক্বদীর (ভাগ্য) গোপন ও লুক্কায়িত বিষয়। সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ ব্যতীত কেউ তা জানে না। তাহ’লে পাপী বান্দা কোথা থেকে জানল যে, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য পাপকে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন যে সে তার দিকে অগ্রসর হয়? এটা কি সম্ভব নয় যে, তার জন্য আনুগত্যকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে? তাহলে কেন পাপের প্রতি অগ্রসর হওয়ার বদলে আনুগত্যের প্রতি অগ্রসর হয় না এবং বলে না, ‘আল্লাহ আমার জন্য আনুগত্যকে লিপিবদ্ধ করেছেন’।
চতুর্থ জবাব : আমরা বলব, আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান ও উপলদ্ধি করার ক্ষমতা দান করার মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন, তার উপর গ্রন্থসমূহ নাযিল করেছেন এবং তার প্রতি রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছেন। তার কাছে ক্ষতিকর বস্ত্ত থেকে উপকারী বিষয়গুলি বর্ণনা করেছেন এবং তাকে ‘ইচ্ছা’ ও ‘শক্তি’ দান করেছেন । যে দু’টির মাধ্যমে সে দু’টো পথের যে কোন একটির উপর চলতে পারে। তাহ’লে এই পাপ কেন ক্ষতিকর পথকে কল্যাণময় পথের উপর অগ্রাধিকার দেয়?
এই পাপী ব্যক্তিটি যদি কোন দেশে ভ্রমণ করার মনস্থ করে এবং তার জন্য দু’টি পথ থাকে। তন্মধ্যে একটি সহজ ও নিরাপদ। আর অন্যটি কষ্টকর ও শঙ্কাপূর্ণ। তাহলে অবশ্যই সে সহজ ও নিরাপদ পথে চলবে। সে কখনো কঠিন ও শঙ্কাপূর্ণ পথে চলবে না এই যুক্তি দিয়ে যে, আল্লাহ তার উপর এটি লিপিবদ্ধ করেছেন। বরং সে যদি (এই কঠিন পথে) চলত ও দলীল দিত যে আল্লাহ তা‘আলা এটি তার ভাগ্য লিপিবদ্ধ করেছেন। তবে অবশ্যই মানুষ সেটাকে বোকামী ও পাগলামী গণ্য করত। অনুরূপভাবে কল্যাণ ও অনিষ্টের পথের বিষয়টিও বরাবর। তাই মানুষ যেন কল্যাণের পথে চলে এবং অমঙ্গলের পথে চলার মাধ্যমে যেন নিজেকে ধোঁকা না দেয় এই যে, যুক্তি দিয়ে আল্লাহ তার উপর এটি লিপিবদ্ধ করেছেন।
আমরা প্রত্যেক মানুষকে দেখি যে, সে উপার্জনে সক্ষম। আমরা জীবিকা অর্জনের তাকে জন্য প্রতিটি পথে চলতে দেখি। তাক্বদীরকে দলীলস্বরূপ পেশ করে আয়-উপার্জন পরিত্যাগ করে সে ঘরে বসে থাকে না।
তাহ’লে দুনিয়ার জন্য প্রচেষ্টা এবং আল্লাহর আনুগত্যের প্রচেষ্টার মাঝে তফাৎ কি? কেন তুমি আনুগত্য বর্জন করার ব্যাপারে তাক্বদীরকে তোমার পক্ষে দলীলরূপে পেশ করছ এবং দুনিয়ার কর্মকান্ডকে ত্যাগ করার ক্ষেত্রে তাক্বদীরকে প্রমাণ স্বরূপ উপস্থাপন করছ না? নিশ্চয়ই বিষয়টি কোন স্থানে স্পষ্ট হয় (অর্থাৎ কখনো কখনো বিষয়টি অনুধাবনে আসে)। কিন্তু প্রবৃত্তি অন্ধ ও বধির করে দেয়।
যুবকদের বর্ণনা সম্বলিত কতিপয় হাদীছ : যখন এই কথাগুলি যুবকদের সমস্যাবলীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে... তখন আমি কতিপয় হাদীছ উল্লেখ করতে চাচ্ছি। যেখানে যুবকদের উল্লেখ রয়েছে। তন্মধ্যে কতিপয় হ’ল-
(১) يَعْجَبُ رَبُّكَ مِنَ الشَّابِّ لَيْسَتْ لَهُ صَبْوَةٌ ‘তোমার প্রতিপালক এমন যুবককে ভালবাসেন যার ‘ছবওয়া’ নেই।[7]
‘ছবওয়া’ হ’ল, প্রবৃত্তি পূজা এবং হক পথ থেকে বিরত হওয়া।
سَبْعَة يظلهم الله تَعَالَى فِي ظِلِّهِ يَوْمَ لَا ظِلَّ إِلَّا ظِلُّهُ إِمَامٌ عَادِلٌ وَشَابٌّ نَشَأَ فِي عِبَادَةِ اللَّهِ وَرجل قلبه مُعَلّق بِالْمَسْجِدِ وَرَجُلَانِ تَحَابَّا فِي اللَّهِ اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللَّهَ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ وَرجل دَعَتْهُ امْرَأَة ذَات منصب وَجَمَالٍ فَقَالَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا حَتَّى لَا تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ-
(২) ‘ যে দিন আল্লাহর (আরশের) ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না সে দিন আল্লাহ তা‘আলা সাত প্রকার মানুষকে সে ছায়ায় আশ্রয় দিবেন। (ক) ন্যায়-পরায়ণ শাসক। (খ) যে যুবক আল্লাহর ইবাদতের ভিতর গড়ে উঠেছে। (গ) যার অন্তর সর্বদা মসজিদের সাথে থাকে (ঘ) আল্লাহর সন্তুুষ্টির উদ্দ্যেশে যে দু’ব্যক্তি পরস্পর মহববত রাখে, উভয়ে একত্রিত হয় সেই মহববতের উপর আর পৃথক হয় সেই মহববতের উপর। (ঙ) এমন ব্যক্তি যাকে সম্ভ্রান্ত সুন্দরী নারী (অবৈধ মিলনের জন্য) আহবান জানিয়েছে। তখন সে বলেছে, আমি আল্লাহকে ভয় করি। (চ) যে ব্যক্তি গোপনে এমনভাবে দান করে যে, তার ডানহাত যা দান করে, তার বামহাত জানতে পারে না। (ছ) যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তাতে আল্লাহর ভয়ে তার চোখ হতে অশ্রু বের হয়ে পড়ে’।[8]
(৩) الحَسَنُ وَالحُسَيْنُ سَيِّدَا شَبَابِ أَهْلِ الجَنَّةِ ‘হাসান ও হুসায়েন জান্নাতবাসী যুবকদের সর্দার’।[9]
(৪) জান্নাতীদেরকে বলা হবে- إِنَّ لَكُمْ أَنْ تَشِبُّوا فَلَا تَهْرَمُوا أَبَدًا ‘তোমরা যুবক থাকবে, কখনো বৃদ্ধ হবে না ।[10]
(৫) مَا أَكْرَمَ شَابٌّ شَيْخًا لِسِنِّهِ إِلَّا قَيَّضَ اللَّهُ لَهُ مَنْ يُكْرِمُهُ عِنْدَ سِنِّهِ ‘যে যুবক কোন বৃদ্ধকে সম্মান করবে তার বয়সের কারণে, আল্লাহ তাকে নির্ধারণ করবেন যে সেই যুবককে তার বয়সের কারণে তাকে সম্মান করবে’।[11] (তিরমিযী, দূর্বল সনদে)।
(৬) আবূবকর (রাঃ) তার কাছে উমর ইবনুল খাত্ত্বাবের থাকার সময় যায়েদ বিন ছাবিতকে বললেন, إِنَّكَ رَجُلٌ شَابٌّ عَاقِلٌ وَ َلاَ نَتَّهِمُكَ، كُنْتَ تَكْتُبُ الوَحْيَ لِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَتَتَبَّعِ القُرْآنَ فَاجْمَعْهُ ‘তুমি একজন বুদ্ধিমান যুবক। আমরা তোমাকে কোনরূপ দোষারোপ করি না। আর তুমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অহী লেখতে। কুরআনের সংকলন করে তা একত্রিত কর’।[12]
دَخَلَ عَلَى شَابٍّ وَهُوَ فِي الْمَوْتِ، فَقَالَ: كَيْفَ تَجِدُكَ؟ قَالَ: أَرْجُو اللَّهَ يَا رَسُولَ اللَّهِ وَأَخَافُ ذُنُوبِي، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا يَجْتَمِعَانِ فِي قَلْبِ عَبْدٍ فِي مِثْلِ هَذَا الْمَوْطِنِ، إِلَّا أَعْطَاهُ اللَّهُ مَا يَرْجُو، وَآمَنَهُ مِمَّا يَخَافُ-
(৭) ‘মহানবী (ছাঃ) একজন যুবকের কাছে এলেন। সে তখন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিল। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন অনুভব করছ? যুবকটি বলল, আমি আল্লাহর কাছে (রহমত) প্রত্যাশা করছি হে আল্লাহর রাসূল ! আর আমি আমার পাপের জন্য আশঙ্কা করছি। নবী (ছাঃ) বললেন, এই যুবকটির মত কোন বান্দার হৃদয়ে দু’টি বিপরীত বস্ত্ত এক হয় তাহ’লে আল্লাহ তাকে তার চাওয়া পূর্ণ করে দিবেন। আর সে যা হ’তে ভয় পায় তা থেকে নিরাপত্তা দান করবেন’।[13]
قَالَ: لاَ وَاللَّهِ، مَا وَلَّى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَلَكِنَّهُ خَرَجَ شُبَّانُ أَصْحَابِهِ، وَأَخِفَّاؤُهُمْ حُسَّرًا لَيْسَ بِسِلاَحٍ (৮) ‘হুনায়নের যুদ্ধের সময় বারা ইবনু আযেব (রাঃ) বলেছেন, আল্লাহর কসম, না। রাসূল (ছাঃ) পালিয়ে যান নি। কিন্তু তার কিছু সংখ্যাক যুবক ছাহাবী (যুদ্ধের ময়দানে) বেরিয়ে গিয়েছিল কোন অস্ত্র-শস্ত্র ব্যতীতই’।[14]
(৯) আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেছেন, كُنَّا نَغْزُو مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَنَحْنُ شَبَابٌ ‘আমরা যুবক বয়সে নবী (ছাঃ) এর সাথে যু্দ্ধ করতাম’।[15]
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ: كَانَ شَبَابٌ مِنَ الْأَنْصَارِ سَبْعِينَ رَجُلًا يُسَمَّوْنَ الْقُرَّاءَ قَالَ: كَانُوا يَكُونُونَ فِي الْمَسْجِدِ فَإِذَا أَمْسَوْا انْتَحَوْا نَاحِيَةً مِنَ الْمَدِينَةِ، فَيَتَدَارَسُونَ وَيُصَلُّونَ يَحْسِبُ أَهْلُوهُمْ أَنَّهُمْ فِي الْمَسْجِدِ، وَيَحْسِبُ أَهْلُ الْمَسْجِدِ أَنَّهُمْ عِنْدَ أَهْلِيهِمْ، حَتَّى إِذَا كَانُوا فِي وَجْهِ الصُّبْحِ اسْتَعْذَبُوا مِنَ الْمَاءِ، وَاحْتَطَبُوا مِنَ الْحَطَبِ، فَجَاءُوا بِهِ فَأَسْنَدُوهُ إِلَى حُجْرَةِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ،
(১০) ‘আনাস বিন মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, আনছার গোত্রে সত্তরজন যুবক ছিল। তাদেরকে ‘ক্বারী’ বলা হ’ত। তারা মসজিদে থাকত। যখন সন্ধ্যা হ’ত তখন তারা মদীনার একপ্রান্তে গমন করত। তারা আলোচনা-পর্যালোচনা করত ও ছালাত আদায় করত। তাদের পরিবারবর্গ ভাবত তারা মসজিদে আছে। আর মসজিদে অবস্থানকারীগণ মনে করত তারা তাদের পরিবারের সাথে আছে। যখন ফজরের সময় হ’ত, তখন তারা সুস্বাদু পানি পান করত। তাঁরা কাঠ সংগ্রহ করত এবং তারা সেগুলি নিয়ে এসে নবী (ছাঃ) -এর ঘরে হেলান দিয়ে রেখে দিত’।[16] আর তারা এগুলি বিক্রয় করে আহলে ছুফ্ফার জন্য খাদ্য ক্রয় করত। আহলে ছুফ্ফা হ’ল মদীনায় হিজরতকারী নিঃস্ব-ফকীরগণ। যেখানে তাদের কোন পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন ছিল না। ফলে তারা মসজিদে একটি চালের নিচে কিংবা তার মসজিদের নিকটে থাকত।
عَنْ عَلْقَمَةَ، قَالَ: كُنْتُ أَمْشِي مَعَ عَبْدِ اللهِ بِمِنًى، فَلَقِيَهُ عُثْمَانُ، فَقَامَ مَعَهُ يُحَدِّثُهُ، فَقَالَ لَهُ عُثْمَانُ: يَا أَبَا عَبْدِ الرَّحْمَنِ، أَلَا نُزَوِّجُكَ جَارِيَةً شَابَّةً، لَعَلَّهَا تُذَكِّرُكَ بَعْضَ مَا مَضَى مِنْ زَمَانِكَ، قَالَ: فَقَالَ عَبْدُ اللهِ: لَئِنْ قُلْتَ ذَاكَ، لَقَدْ قَالَ لَنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ، مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ، فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ، وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ، وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ، فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ
(১১) ‘ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর শিষ্য আলক্বামা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, আমি আব্দুল্লাহর সাথে মিনাতে হাঁটছিলাম। অতঃপর ওছমান (রাঃ) এর তার সাক্ষ্যাৎ হ’ল। তিরি তার সাথে দাঁড়ালেন। তাকে ওছমান বললেন, হে আবূ আব্দুর রহমান! আমরা তোমার সাথে একটি যুবতীকে কি বিবাহ দিব না? যাতে করে সে তোমার অতীতে ঘটে যাওয়া কিছু বিষয় স্বরণ করিয়ে দেয়। তখন আব্দুল্লাহ বললেন, আপনি আমাকে এ কথা বলছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে বলেছেন, হে যুবক সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্য হ’তে যে সামর্থ রাখে, সে যেন বিবাহ করে। কেননা তা দৃষ্টিকে অবনত রাখে। লজ্জাস্থানের সর্বাধিক হেফাযতকারী। আর যে সক্ষম নয় সে যেন ছওম (নফল) পালন করে। কেননা তা তার জন্য (চরিত্র হেফাযতকারী) ঢালস্বরূপ’।[17]
(১২) দাজ্জালে সর্ম্পকে একটি হাদীছে নবী (ছাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন,
يَدْعُو رَجُلًا مُمْتَلِئًا شَبَابًا، فَيَضْرِبُهُ بِالسَّيْفِ فَيَقْطَعُهُ جَزْلَتَيْنِ رَمْيَةَ الْغَرَضِ، ثُمَّ يَدْعُوهُ فَيُقْبِلُ وَيَتَهَلَّلُ وَجْهُهُ، يَضْحَكُ، ‘দাজ্জাল একজন সুঠামদেহী যুবককে ডাকবে। তারপর তাকে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করবে। আর তাকে ভীষণভাবে আঘাত করে দু’টুকরা করে ফেলবে। অতঃপর দাজ্জাল তাকে আহবান করবে এবং যুবকটি (জীবিত হয়ে) তার ডাকে সাড়া দিবে এবং প্রফুল্ল চিত্তে হাসতে থাকবে’।[18]
أَتَيْنَا إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَنَحْنُ شَبَبَةٌ مُتَقَارِبُونَ، فَأَقَمْنَا عِنْدَهُ عِشْرِينَ يَوْمًا وَلَيْلَةً، وَكَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَحِيمًا رَفِيقًا، فَلَمَّا ظَنَّ أَنَّا قَدِ اشْتَهَيْنَا أَهْلَنَا - أَوْ قَدِ اشْتَقْنَا - سَأَلَنَا عَمَّنْ تَرَكْنَا بَعْدَنَا، فَأَخْبَرْنَاهُ، قَالَ: ارْجِعُوا إِلَى أَهْلِيكُمْ، فَأَقِيمُوا فِيهِمْ وَعَلِّمُوهُمْ وَمُرُوهُمْ - وَذَكَرَ أَشْيَاءَ أَحْفَظُهَا أَوْ لاَ أَحْفَظُهَا - وَصَلُّوا كَمَا رَأَيْتُمُونِي أُصَلِّي، فَإِذَا حَضَرَتِ الصَّلاَةُ فَلْيُؤَذِّنْ لَكُمْ أَحَدُكُمْ، وَلْيَؤُمَّكُمْ أَكْبَرُكُمْ-
(১৩) ‘মালিক বিন হুয়ায়রিছ (রাঃ) বলেছেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে আসলাম। তখন আমরা সমবয়সী যুবক ছিলাম। আমরা তার কাছে বিশদিন এবং বিশ রাত অবস্থান করলাম। আর মহানবী (ছাঃ) অত্যন্ত সদয় এবং নম্র ছিলেন। যখন তিনি ধারণা করলেন যে, আমরা আমাদের পরিবারের প্রতি যেতে আকাংখা করছি কিংবা ব্যথা অনুভব করছি; তখন তিনি আমাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন যে, আমরা আমাদের পিছে কাদেরকে ফেলে এসেছি। আমরা তা তাকে জানালাম। তিনি বললেন, তোমরা ফিরে যাও তোমাদের পরিবারের প্রতি। আর তাদের মাঝে অবস্থান কর। এবং তাদের শিক্ষা দাও ও তাদের আদেশ দাও। (বর্ণনাকারী বলেন) তিনি আরো কিছু উল্লেখ করেছিলেন যা আমার হিফয করেছি বা করিনি। আর (নবী (ছাঃ) তাদেরকে বলেছেন) তোমরা (সেই ভাবে) ছালাত পড়, যেভাবে আমাকে ছালাত পড়তে দেখছ। যখন ছালাত (ছালাতের সময়) উপস্থিত হবে, তখন তোমাদের মধ্যে হ’তে একজন আযান দিবে এবং তোমাদের মধ্য থেকে যে বয়সে বড় সে ইমামতি করবে’।[19]
আমরা যা আলোচনা করতে মনস্থ করেছিলাম তা এ পর্যন্তই। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন এর দ্বারা মঙ্গল করেন। আর সমস্ত প্রশংসা বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহর জন্য। দরূদ ও সালাম আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাঁর পরিবারবর্গ এবং তার সকল ছাহাবীর উপর বর্ষিত হৌক- আমীন!
[1]. আবুদাঊদ হা/৫১১২।
[2]. মুসলিম হা/২০৯।
[3]. বুখারী হা/৩২৭৬; মুসলিম, হা/২১৩।
[4]. মুসলিম, মিশকাত হা/৬৬।
[5]. আবু দাঊদ হা/৪৭২২।
[6]. তিরমিযী হা/২১৩৩, তিনি হাদীছটিকে গরীব বলেছেন; আলবানী ‘হাসান’ বলেছেন।
[7]. আহমাদ হা/১৭৩৭১; মু‘জাম ইবনুল আরাবী হা/৮৬৬; আলবানী এর সনদকে ‘জাইয়েদ’ বলেছেন।দ্র. হা/ সিলসিলাহ ছহীহা হা/২৮৪৩।
[8]. বুখারী হা/১৪২৩; মুসলিম হা/১০৩১; মিশকাত হা/৭০১।
[9]. তিরমিযী হ/৩৭৬৮; তিনি হাদীছটিকে হাসান ছহীহ বলেছেন।
[10]. মুসলিম হা/২৮৩৭।
[11]. তিরমিযী হা/২০২২; আলবানী ‘মুনকার’ বলেছেন, যঈফা হা/৩০৪।
[12]. বুখারী হা/৪৬৭৯।
[13]. ইবনে মাজাহ হা/৪২৬১; আলবানী ও যুবায়ের আলী যাঈ (রহঃ) একে হাসান বলেছেন, তাহক্বীক্ব ইবনে মাজাহ হা/৪২৬১।
[14]. বুখারী হা/২৯৩০; মুসলিম হা/১৭৭৬।
[15]. আহমাদ হা/৩৭০৬।
[16]. আহমাদ হা/১৩৪৬২।
[17]. বুখারী হা/৫০৬৫; মুসলিম হা/১৪০০।
[18]. মুসলিম হা/২৯৩৭।
[19]. বুখারী হা/৬৩১।