আরব বিশ্বে গণতন্ত্রের কি হ’ল!

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 755 বার পঠিত

আরব দেশের একটা গল্প আছে। একবার এক জেলে সাগরে জাল ফেলেছে। বিরাট এক ডেকচি উঠে এল। জেলে তো মহা খুশী। পেয়ে গেছি সাত রাজার ধন! কিন্তু যে-ই না ডেকচির ঢাকনাটা খুলেছে, অমনি ঘটে গেল তেলেসমাতি। ডেকচি থেকে একগাদা ধোঁয়া বের হয়ে তা আকাশছোঁয়া দৈত্য হয়ে গেল। এখন সেটা জেলেকে খাবে। জেলে তো ভয়ে আধমরা। কি করে, কি করে? চকিতে একটা বুদ্ধি খেলে গেল। দৈত্যকে বলল, আমাকে আপনি খাবেন, এ তো আমার সৌভাগ্য! কিন্তু এত বড় ধড়টা কীভাবে ওই পুঁচকে ডেকচিতে ভরে রেখেছিলেন, তা যদি একটু দেখাতেন, তাহ’লে মরেও শান্তি পেতাম। মাথা মোটা দৈত্য আবার ধোঁয়া হয়ে ডেকচির ভেতর ঢুকল। জেলে অমনি ডেকচির মুখটা ভালো করে আটকে সেটাকে আবার সাগরে ডুবিয়ে দিল ।

আরব বিশ্বে গণতন্ত্রের বর্তমান চেহারার সঙ্গে এই গল্পের বেশ মিল রয়েছে। চলতি দশকের শুরুতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আরব বসন্ত নামের যে বিপুল গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল, তার পরিণতি যেন এমনই। যাদের ওপর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়, প্রত্যাশী মানুষকে তারা দানবের চেহারা দেখিয়েছে। অতিষ্ঠ জনতা পরে তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। পরিণতিতে আরব বিশ্বের একাধিক দেশে ফিরে এসেছে স্বৈরশাসন।

আরব বসন্ত শুরু হয়েছিল তিউনিসিয়ায়। ২০১০ সালের ১৭ই ডিসেম্বর নিজের গায়ে নিজেই আগুন ধরিয়ে দিয়ে বিপ্লবের মশাল জ্বেলে দেন ফেরিওয়ালা বাওয়াজিজি। ঘুষ, দুর্নীতি, বেকারত্ব, রাজনৈতিক নিপীড়ন ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তা ছিল এক জ্বলন্ত বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের আগুন গোটা আরব বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিসিয়ায় অল্প দিনের মধ্যেই স্বৈরশাসনের বিলুপ্তি ঘটে। স্বৈরশাসক জয়নাল আবেদীন বেন আলীর পতনের পর সেখানে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এখন গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত বটে, তবে অভ্যন্তরীণ সমস্যার অন্ত নেই। পশ্চিমারা বলছে, আরব বিশ্বে তিউনিসিয়া গণতন্ত্রের একটি রোল মডেল।

বাস্তবে সেখানে দলাদলি, হানাহানি লেগেই আছে। আছে জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের উৎপাত। সেখানে সরকারবিরোধী তৎপরতা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। সরকারের সমালোচনা তো দূরে থাক, কেউ টুঁ শব্দটি করলে তাকে পাকড়াও করা হয়, চলে নির্যাতন।

আরব বসন্তের গণজাগরণে মিসরের লৌহমানব হুসনী মোবারকের স্বৈরশাসন খড়-কুটোর মতো উড়ে গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একটি আবহ তৈরী হয়। ২০১২ সালের নির্বাচনে ইসলামপন্থী মুসলিম ব্রাদারহুডের হাত ধরে ক্ষমতায় আসেন মুরসী। শুরু থেকেই মুসলিম ব্রাদারহুডের মধ্যে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার একটা প্রবণতা দেখা যায়। মুরসী একাধিক ডিক্রি জারির মাধ্যমে তা নিশ্চিত করার প্রয়াস চালান। এতে দেশের বেশীর ভাগ মানুষই নাখোশ হয়। সেনাবাহিনীর সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দেয় মুরসীর। এ সময় মুরসীর বিরুদ্ধে জনরোষকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় আসেন সেনাপ্রধান জেনারেল আব্দুল ফাত্তাহ সীসী। তিনি মোবারক আমলেরই একজন শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা। এখন প্রেসিডেন্ট সীসীই দেশ চালাচ্ছেন। ঘুরেফিরে মিসরে এসেছে সেই স্বৈরশাসক।

লিবিয়া এখন জীবন্ত রণক্ষেত্র। ২০১১ সালের অক্টোবরে মু‘আম্মার গাদ্দাফীর ৪২ বছরের শাসনামলের পতন ঘটার পর থেকে সেখানে মারামারি-কাটাকাটি লেগেই আছে। বার্তা সংস্থা এএফপির তথ্যমতে, সেখানে প্রায় ১ হাজার ৭০০টি সশস্ত্র গোষ্ঠী ও দল ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত। মাঝখান থেকে ফায়দা লুটতে সেখানে শিকড় গেড়েছে আইএস ও আল-কায়েদার মতো জঙ্গী সংগঠনগুলো। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো লিবিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যের সরকার গঠনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ ডামাডোল থামার লক্ষণ নেই।

ইয়েমেনেও সেই একই অবস্থা। গণজোয়ারের প্রবল তোড় উপেক্ষা করে খুঁটি গেড়ে বসেই ছিলেন প্রেসিডেন্ট আলী আব্দুল্লাহ ছালেহ। একপর্যায়ে তাঁর বাড়িতে বোমা ফেলা হ’ল। কোনোমতে বেঁচে সঊদী আরবে ভাগলেন তিনি। পোড়া চেহারা নিয়ে ফিরে এসে ক্ষমতা ছেড়েও দিলেন। কিন্তু শান্তি তো নেই। ২০১৪ সালে বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদু-রাববু মানসুর হাদির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হলে আবার সেই ডামাডোল ফিরে আসে। এই বিদ্রোহের মূলে রয়েছে ছালেহর অনুগত হুথী গোষ্ঠীর মানুষ। হাদির পক্ষে আবার লড়ছে সঊদী নেতৃত্বাধীন জোট। ২০১৫ সালের মার্চ থেকে এই জোটের বিমান হামলায় এ পর্যন্ত প্রায় ১০ হাযার লোক নিহত হয়েছে। বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে প্রায় ২ কোটি ৮০ লাখ মানুষ। এরপরও হুথী বিদ্রোহীরা কিন্তু বহাল তবিয়তেই আছে। সেখানে খাদ্যসংকট চরমে উঠেছে, যার ভুক্তভোগী হচ্ছে শিশুরা।

আর সিরিয়ার যুদ্ধ যেন শেষ হওয়ার নয়। পুরো দেশটাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। শুরুতে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-ুআসাদকে উৎখাতে বিদ্রোহীদের সশস্ত্র আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির পশ্চিমা কিছু মিত্রও মদদ দিয়েছে। এতে বাশারের সেনারা অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। পরে বাশারের পক্ষে রাশিয়া কঠোর অবস্থান নিলে পরিস্থিতি দাঁড়ায় সেয়ানে সেয়ানে টক্করের মতো। মাঝখানে ফায়দা লুটতে হাযির হয় আইএস ও সহযোগী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর জঙ্গী ও জিহাদীরা। এখন দেশটিতে কয়েকটি পক্ষের মধ্যে চলছে বহুমুখী লড়াই। এর মধ্যে বিভিন্ন দেশের মধ্যস্থতায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ও রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ একাধিকবার যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনায় বসেছেন। কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

বিশ্বব্যাংক বলছে, আরব বসন্তের ঝড়ঝাপটায় যেসব দেশে সরকার বা শাসন বদল হয়েছে, সেসব দেশ আগেই বরং ভালো ছিল। আরব বিশ্বের অন্য যেসব দেশে আরব বসন্ত আসেনি, সেসব দেশের শাসকেরা এর মধ্যে শিক্ষা যা নেওয়ার নিয়েছেন। যেমন সঊদী সরকার ভিন্নমতাবলম্বীদের সঙ্গে বিরোধে না গিয়ে তাদের সাথে সমাঝোতার চেষ্টায় সফল হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, গণপরিসেবা ইত্যাদি খাতে জনসেবার হার বাড়িয়ে জনতার মন জয় করেছে। সঊদী নাগরিকদের বেশী করে দেওয়া হচ্ছে বিনিয়োগ ও আয়ের সুযোগ। কাতার, জর্ডান, মরক্কো ও ওমানের মতো দেশগুলোতেও শাসকের ক্ষমতা নিরঙ্কুশভাবে কুক্ষিগত না করে কিছু ক্ষেত্রে জনতার হাতে দেওয়া হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা। অন্যদিকে মিসর, লিবিয়া ও ইরাকে স্বৈরশাসকের পতনের পরিস্থিতি কি দাঁড়িয়েছে, সেটাও এখন ভালোভাবেই টের পাচ্ছে আরব বিশ্বের মানুষ। একনায়ক উৎখাতের আন্দোলনে নেমে সিরিয়ার মতো দুর্ভাগ্য ডেকে আনতে কেউ আর ইচ্ছুক নয়।



আরও