সমস্ত
প্রশংসা ও স্তুতি সেই আল্লাহর জন্য, যিনি ছালাতকে মুমিনদের জন্য পাথেয়,
ভীত-সন্ত্রস্তদের জন্য শক্তি-সাহস, অন্ধকারে নিমজ্জিতদের জন্য আলোকবর্তিকা
স্বরূপ করেছেন। শান্তি ও করুণা বর্ষিত হোক শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর
প্রতি। ক্বিয়ামুল লাইল হ’ল সৎকর্মশীলগণের জন্য জান্নাতী সোপান, মুমিনগণের
পরকালীন সর্বোত্তম পাথেয়, বিজয়ীদের সফলতার শীর্ষে আরোহণের অনন্য অবলম্বন।
সুতরাং ক্বিয়ামুল লাইলের মাধ্যমে মুমিনগণ তাদের প্রতিপালকের সান্নিধ্য
কামনায় নির্জনে মিলিত হয়। মহান সৃষ্টিকর্তার করুণাকামীরা নিজেদের অবস্থা ও
পরিস্থিতির কথা অকপটে ব্যক্ত করতে কায়মনোবাক্যে তাঁর প্রতি রুজূ হয় এবং
সাহায্য প্রার্থনা করে। আল্লাহর সামনে দ-ায়মান তাদের অন্তরসমূহ দীর্ঘক্ষণ
গোপনালাপে হৃদয়ের যাবতীয় আরজি-আকুতি তাঁরই সামনে পেশ করে প্রশান্তচিত্তে।
ক্বিয়ামুল লাইল-এর পরিচিতি :
ক্বিয়াম
قيام)) অর্থ দাঁড়ানো, লাইল (الليل) অর্থ রাত, অর্থাৎ রাত্রিকালে (ছালাতে)
দাঁড়ানো। পরিভাষায় (এশার ছালাতের পর হতে ফজরের ছালাতের পূর্ব পর্যন্ত)
রাত্রির অর্ধাংশ বা কিয়দাংশ ছালাতের নিমিত্তে দাঁড়ানোকে ক্বিয়ামুল লাইল
বলে। আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الْمُزَّمِّلُ- قُمِ اللَّيْلَ إِلَّا قَلِيلًا- نِصْفَهُ أَوِ انْقُصْ مِنْهُ قَلِيلًا-
‘হে বস্ত্রাবৃত! রাত্রি জাগরণ কর, কিছু অংশ ব্যতীত। রাতের অর্ধেক কিংবা তার চেয়ে কিছুটা কম কর’ (মুযযাম্মিল ৭৩/১-৩)।
এটা রামাযানের তারাবীহ হতে পারে আবার অন্যান্য মাসের তাহাজ্জুদের ছালাতও হতে পারে। তবে উভয় ছালাতই নফল।
عَنِ
الْمُغِيرَةِ بْنِ شُعْبَةَ أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم صَلَّى
حَتَّى انْتَفَخَتْ قَدَمَاهُ فَقِيلَ لَهُ أَتَكَلَّفُ هَذَا وَقَدْ
غَفَرَ اللَّهُ لَكَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ فَقَالَ
أَفَلاَ أَكُونُ عَبْدًا شَكُورًا-
মুগীরা বিন শু‘বা হতে বর্ণিত,‘রাসূল
(ছাঃ) রাতের ছালাত আদায় করা অবস্থায় তার পদদ্বয় ফুলে যেত। তখন তাকে বলা
হ’ল, আপনার আগে পিছের পাপ মোচন হয়ে গিয়েছে, তথাপি আপনি এত কষ্ট করে ছালাত
আদায় করেন কেন? তিনি বলেন, আমি কি কৃতজ্ঞ বান্দা হব না।
ছহীহ বুখারীতে
আছে, হযরত আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত একদা রামাযানের রাতে রাসূল (ছাঃ) মসজিদে
(ক্বিয়ামুল লাইল) রাতের ছালাত পড়েন। আর লোকজন তার সাথে ছালাত আদায় করেন।
অনুরূপ পরের দিনও তিনি ছালাত আদায় করলেন। তাতে বেশী লোকজনের সমাগম হ’ল।
অতঃপর তৃতীয় বা চতুর্থ দিন লোকজন জমা হ’ল, কিন্তু তিনি বের হ’লেন না (তাদের
সাথে ছালাত আদায় করলেন না)। তিনি বললেন, তোমরা যা করছিলে তাতে আমাকে
ছালাতে আসতে কেউ বাধা প্রদান করেনি, তবে আমি ভয় পাচ্ছিলাম তোমাদের উপর এটা
ফরয হয়ে যায় কি-না। অতএব রাতের ছালাত (قيام الليل) হচ্ছে নফল। তবে নফল
হলেও এর গুরুত্ব অত্যধিক।
রাতের ছালাতের রাক‘আত সংখ্যা :
রাসূল
(ছাঃ)-এর রাতের ছালাত এগারো রাক‘আতের বেশী ছিল না। দুই দুই রাক‘আত করে
সালাম ফিরাতেন। শেষে তিন রাক‘আত বা এক রাক‘আত বিতর ছালাত আদায় করতেন।
عَنْ
أَبِى سَلَمَةَ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ أَنَّهُ أَخْبَرَهُ أَنَّهُ
سَأَلَ عَائِشَةَ رضى الله عنها- كَيْفَ كَانَتْ صَلاَةُ رَسُولِ اللَّهِ
صلى الله عليه وسلم فِى رَمَضَانَ فَقَالَتْ مَا كَانَ رَسُولُ اللَّهِ
صلى الله عليه وسلم يَزِيدُ فِى رَمَضَانَ وَلاَ فِى غَيْرِهِ عَلَى
إِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً-
সালামাহ ইবনু আব্দুর রহমান (রাঃ) আয়েশা
(রাঃ)-কে রাসূল (ছাঃ)-এর রামাযানের রাতের ছালাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন।
তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) রামাযান ও রামাযানের বাইরে এগারো রাক‘আতের বেশী
(রাতের ছালাত) আদায় করতেন না। তিনি প্রথমে দুই দুই রাক‘আত করে চার রাক‘আত
ছালাত আদায় করতেন। তুমি আমাকে তাঁর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে প্রশ্ন করো
না। তারপর চার রাক‘আত (দুই দুই করে) আদায় করতেন। এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা
সম্পর্কে আমাকে প্রশ্ন করোনা। অতঃপর তিনি তিন রাক‘আত বিতর ছালাত আদায়
করতেন’।
ক্বিয়ামুল লাইল-এর গুরুত্ব ও ফযীলত :
রাতের নফল ছালাতের
গুরুত্ব ও ফযীলত অপরিসীম। স্বাভাবিকভাবেই রাতের ছালাত আদায় করা হয় নির্জনে
নিঝুম নিরালায় জনকোলাহল মুক্ত পরিবেশে। পৃথিবীর জীবজগৎ যখন ঘুমন্ত থাকে,
তখন আল্লাহর প্রিয় বান্দা গভীর রাতে স্রষ্টার নিকটে নিজের আবেদন জানায়। তার
প্রার্থনা মহান আল্লাহ গ্রহণ করেন। আল্লাহর মুখলিছ মুছল্লী গোপন ইবাদতের
মাধ্যমে তার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শুকরিয়া আদায় করেন। বিধায় এর
গুরুত্ব ও ফযীলত সীমাহীন। আল্লাহ বলেন,
كَانُوا قَلِيلًا مِنَ اللَّيْلِ مَا يَهْجَعُونَ -وَبِالْأَسْحَارِ هُمْ يَسْتَغْفِرُونَ-
‘রাতের সামান্য অংশই এরা ঘুমিয়ে কাটাত। আর রাতের শেষ প্রহরে এরা ক্ষমা প্রার্থনায় রত থাকত’ (যারিয়াত ৫১/১৭-১৮)। আল্লাহ অন্যত্র বলেন,
أَمَّنْ
هُوَ قَانِتٌ آنَاءَ اللَّيْلِ سَاجِدًا وَقَائِمًا يَحْذَرُ الْآخِرَةَ
وَيَرْجُو رَحْمَةَ رَبِّهِ قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ
وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الْأَلْبَابِ-
‘যে
ব্যক্তি রাতের প্রহরে সিদজাবনত হয়ে দাঁড়িয়ে আনুগত্য প্রকাশ করে, আখেরাতকে
ভয় করে এবং তার রব-এর রহমত প্রত্যাশা করে (সে কি তার সমান যে এরূপ করে না)।
বল, যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান? বিবেকবান লোকেরাই কেবল উপদেশ
গ্রহণ করে’ (যুমার ৩৯/৯)। মুসলিম জাতিকে উৎসাহ প্রদান করে রাসূল (ছাঃ)
ক্বিয়ামুল লাইল তথা রাতের ছালাতের কথা জোরালোভাবে বলেছেন। তিনি বলেন,
عَلَيْكُمْ
بِقِيَامِ اللَّيْلِ فَإِنَّهُ دَأْبُ الصَّالِحِينَ قَبْلَكُمْ وَإِنَّ
قِيَامَ اللَّيْلِ قُرْبَةٌ إِلَى اللَّهِ وَمَنْهَاةٌ عَنِ الإِثْمِ
وَتَكْفِيرٌ لِلسَّيِّئَاتِ وَمَطْرَدَةٌ لِلدَّاءِ عَنِ الْجَسَدِ-
‘তোমাদের
প্রতি ক্বিয়ামুল লাইল অপরিহার্য। নিশ্চয়ই তা তোমাদের পূর্ববর্তী
সৎকর্মশীলদের (নিয়মিত) অভ্যাসগত আমল। আর ক্বিয়ামুল লাইল আল্লাহর
সান্নিধ্যের সোপান, পাপ পংকিলতার পরিসমাপ্তি ও কাফ্ফারা এবং যাবতীয় শারীরিক
অসুখের আরোগ্যদানকারী ঔষধ স্বরূপ’।
রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন,
إِنَّ
فِى الْجَنَّةِ غُرْفَةً يُرَى ظَاهَرُهَا مِنْ بَاطِنِهَا وَبَاطِنُهَا
مِنْ ظَاهِرَهَا فَقَالَ أَبُو مُوسَى الأَشْعَرِىُّ لِمَنْ هِىَ يَا
رَسُولَ اللَّهِ قَالَ لِمَنْ أَلاَنَ الْكَلاَمَ وَأَطْعَمَ الطَّعَامَ
وَبَاتَ لِلَّهِ قَائِماً وَالنَّاسُ نِيَامٌ-
‘জান্নাতের মধ্যে এমন
একটি কক্ষ আছে যার ভেতরটা বাহির থেকে ও বাহিরটা ভেতর থেকে দেখা যায়। আবু
মূসা আল-আশ‘আরী (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কার জন্য? তিনি
বলেন, মিষ্টভাষী, অপরকে খাদ্য দানকারী এবং যখন রাতে মানুষ ঘুমিয়ে থাকে তখন
তাহাজ্জুদগুযারী মুছল্লী-এর জন্য’।
একদা জিবরীল (আঃ) এসে বললেন,
واعْلَمْ أنَّ شَرَفَ المُؤمِنِ قِيامُهُ باللَّيْلِ ‘(হে মুহাম্মাদ) জেনে
রাখ ক্বিয়ামুল লাইল এর মাধ্যমে মুমিন সম্মানিত হয়। রাসূল (ছাঃ) রাতের
ছালাতের গুরুত্ব বুঝাতে আরো বলেছেন,
أَفْضَلُ الصَّلاَةِ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ قِيَامُ اللَّيْلِ-
‘ফরয ছালাতের পর সর্বোত্তম ছালাত হলো রাতের ছালাত’।
রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনে ক্বিয়ামুল লাইল :
পবিত্র
কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহতে বর্ণিত ক্বিয়ামুল লাইল বা রাতের ছালাতের অত্যন্ত
গুরুত্ব ও ফযীলত রয়েছে। এক্ষণে রাসূল (ছাঃ)-এর ক্বিয়ামুল লাইল বা রাতের
ছালাত কেমন ছিল। মহান আল্লাহ রাসূল (ছাঃ)-কে ক্বিয়ামুল লাইল-এর নির্দেশ
দিয়ে বলেন,
يَا أَيُّهَا الْمُزَّمِّلُ - قُمِ اللَّيْلَ إِلَّا
قَلِيلًا - نِصْفَهُ أَوِ انْقُصْ مِنْهُ قَلِيلًا - أَوْ زِدْ عَلَيْهِ
وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلًا-
‘হে বস্ত্রাবৃত! রাত্রি জাগরণ কর, তবে
কিছু অংশ ব্যতীত। রাতের অর্ধেক কিংবা তারচেয়ে কিছুটা কম কর। অথবা তার চেয়ে
একটু বাড়াও। আর স্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে কুরআন আবৃত্তি কর’ (মুযযাম্মিল
৭৩/১-৪)।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
وَمِنَ اللَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَكَ عَسَى أَنْ يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَحْمُودًا-
‘আর
রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ আদায় কর তোমার অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে। আশা
করা যায় তোমার রব তোমাকে প্রশংসিত অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করবেন’(ইসরা
১৭/৭৯)।
রাসূল (ছাঃ)-এর ক্বিয়ামুল লাইলের বাস্তব প্রশিক্ষণ ও উদাহরণ
সম্বলিত দিক নির্দেশনা কি প্রমাণ করে? আল্লাহ তা‘আলার কৃতজ্ঞ বান্দা হতে
গেলে কি শুধুমাত্র মৌখিক স্বীকৃতি, অন্তরে বিশ^াস, তাসবীহ-তাহলীলই, আল্লাহর
কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য যথেষ্ট হবে? নাকি তিনি যেভাবে ইবাদতে নিমগ্ন
থাকতেন সেভাবে আমাদেরকে ইবাদতের সাগরে অবগাহন করতে হবে? রাসূল (ছাঃ) বলেন,
عَنْ
حُذَيْفَةَ قَالَ صَلَّيْتُ مَعَ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم ذَاتَ
لَيْلَةٍ فَاسْتَفْتَحَ بِسُورَةِ الْبَقَرَةِ فَقَرَأَ بِمِائَةِ آيَةٍ
لَمْ يَرْكَعْ فَمَضَى قُلْتُ يَخْتِمُهَا فِى الرَّكْعَتَيْنِ فَمَضَى
قُلْتُ يَخْتِمُهَا ثُمَّ يَرْكَعُ فَمَضَى حَتَّى قَرَأَ سُورَةَ
النِّسَاءِ ثُمَّ قَرَأَ سُورَةَ آلِ عِمْرَانَ ثُمَّ رَكَعَ نَحْوًا مِنْ
قِيَامِهِ.
‘হুযায়ফা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি এক রাতে রাসূল
(ছাঃ)-এর সাথে ছালাত আদায় করলাম। তিনি ছালাত শুরু করলেন সূরা বাক্বারাহ
দিয়ে অতপর একশ আয়াত পড়লেন কিন্তু রুকূ না করে সামনে চললেন। আমি বললাম, তিনি
দুই রাক‘আতে তা শেষ করবেন। কিন্তু তিনি সামনে চললেন। আমি বললাম, তিনি শেষ
করে রুকূতে যাবেন। কিন্তু তিনি সামনে চললেন। এমনকি তিনি সূরা নিসা অত:পর
সূরা আলে ইমরান পড়লেন। অত:পর তার দাড়ানোর সমপরিমাণ সময় তিনি রুকূ করলেন।
তিনি
ধীর-স্থিরভাবে তেলাওয়াত করছিলেন। যখন তিনি তাসবীহর আয়াত পড়ছিলেন তখন
তাসবীহ পাঠ করছিলেন (যেমন সাব্বিহিসমা রব্বিকাল আ‘লা)। কুরআনের আয়াত পাঠ
করে তিনি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করেন।
অন্যত্র বর্ণিত আছে, ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন,
صَلَّيْتُ
ذَاتَ لَيْلَةٍ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَلَمْ يَزَلْ
قَائِمًا حَتَّى هَمَمْتُ بِأَمْرِ سَوْءٍ. قُلْتُ وَمَا ذَاكَ الأَمْرُ
قَالَ هَمَمْتُ أَنْ أَجْلِسَ وَأَتْرُكَهُ.
‘আমি কোন এক রাত্রিতে রাসূল
(ছাঃ)-এর সাথে ছালাত আদায় করছিলাম। তিনি ছালাতে দাঁড়িয়েই ছিলেন অনড়ভাবে।
আর আমি খারাপ কোন কিছুর জন্য দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলাম। বলা হ’ল, কি
সে তোমার দুশ্চিন্তা? তিনি বললাম, আমার দুশ্চিন্তা ছিল যে, আমি বসে পড়ব আর
তাঁকে ত্যাগ করব’।
অথচ ইবনু মাসউদ (রাঃ) নবী (ছাঃ)-এর শক্তিশালী ও
ইকতেদাকারী ছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে নবী (ছাঃ)-এর ক্বিয়ামুল লাইল
অর্থাৎ রাতের ছালাত কেমন ছিল। আর আজকের উম্মতের অবস্থা কি? আল্লাহ্ তা‘আলা
আমাদের হেফাযত করুন এবং তাঁর নবী (ছাঃ)-এর যথাযথ অনুসরণ করার তাওফীক দান
করুন।
পূর্বসূরীদের জীবনে ক্বিয়ামুল লাইল :
হাসান বাছরী বলেন, রাতের মধ্যভাগের ছালাতের চাইতে কোন ইবাদতই দৃঢ়তর রূপে আমি পাইনি।
শাদ্দাদ
বিন আওস যখন বিছানায় যেতেন তখন তিনি নিজেকে কড়াইয়ের উপরে উত্তপ্ত কোন
দানার মত মনে করতেন। রাতে আমি ঘুমিয়ে থাকব কিন্তু জাহান্নাম তো আমাকে ছাড়বে
না। অতঃপর তিনি বিছানা ছেড়ে ছালাতে দ-ায়মান হতেন।
তাউস (রহঃ) রাতে তার বিছানায় শক্ত হয়ে বসতেন। অতঃপর পবিত্র হতেন এবং সকাল পর্যন্ত ছালাত আদায় করতেন।
পূর্বসুরীদের ক্বিয়ামুল লাইল এর স্তর :
সালাফে
ছালেহীন ক্বিয়ামুল লাইল তথা রাতে ছালাত আদায় করতেন। তাদের ক্বিয়ামুল লাইল
এর পদ্ধতি কেমন ছিল? ইবনুল জাওযী বলেন, পূর্বসুরীদের ক্বিয়ামুল লাইল ছিল
সাত স্তরে বিন্যস্ত। ১. তারা সারা রাত জেগে এশার ছালাতের ওযূ দ্বারা ফজরের
ছালাত আদায় করতেন। ২. তারা রাতের অর্ধাংশ জেগে থাকতেন । ৩. তারা রাতের এর
তৃতীয়াংশ জেগে ছালাত আদায় করতেন। ৪. তারা রাতের এক পঞ্চাংশ বা এর ষষ্ঠাংশ
ক্বিয়ামুল লাইল করতেন।
৫. তাদের কেউ রাতে ঘুম না আসা পর্যন্ত ক্বিয়াম
করতেন। আর যখন ঘুম আসত তখন ঘুমিয়ে যেতেন। অতঃপর যখন তখন আবার ক্বিয়াম
করতেন। ৬. তাদের কেউ কেউ রাতে চার রাক‘আত বা দুই রাকা‘আত ছালাত আদায় করতেন।
৭. তাদের মধ্যে কেউ কেউ দুই এশার মধ্যবর্তী সময়টুকু জেগে থাকতেন এবং
সাহারীর সময় জাগ্রত হতেন এবং ক্বিয়াম করতেন।
ক্বিয়ামুল লাইল এর সহজ উপায় বা পদ্ধতি :
রাতের
গভীরে জন-মানব যখন ঘুমে বিভোর। তখন রাত জেগে ইবাদত করা অবশ্যই কঠিন ও
কষ্টসাধ্য। যার কারণেই সকলেই রাত জেগে ইবাদত করতে সক্ষম নয়। সেক্ষেত্রে
বিজ্ঞপ-িতগণ কতিপয় উপায় বা পদ্ধতি পেশ করেছেন যা অবলম্বন করলে রাতে জেগে
ইবাদত করা সম্ভব।
আবু হামেদ গাযযালী রাতে জাগ্রত থাকার দুটি উপায় বের করেছেন। প্রথমতঃ প্রকাশ্য। দ্বিতীয়তঃ অপ্রকাশ্য।
প্রথমতঃ বাহ্যিক চারটি অনুসরণীয় বিষয় হ’ল :
(১) খাদ্য বেশী গ্রহণ না করে বেশী পানি পান করা।
(২) দিনের বেলায় অপ্রয়োজনীয় ক্লান্তিকর কাজ এড়িয়ে চলা।
(৩) দিনের বেলায় দুপুরের খাবার গ্রহনের পর কিছুক্ষণ ঘুমানো (قيلولة) করা।
(৪) দিনের বেলায় বোঝা বহন না করা, যা রাতের কিয়ামকে বাধাগ্রস্থ করে।
দ্বিতীয়তঃ আভ্যন্তরীণ চারটি অনুসরণীয় বিষয় হ’ল :
(১)
মুসলমানের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ, বিদ‘আত কর্মসমূহ ও দুনিয়ার প্রতি আসক্তিকর
লোভ-লালসা থেকে অন্তরকে নিরাপদে রাখা। (২) অতিরিক্ত ভয়-ভীতি সঞ্চারক
কর্মকা- থেকে বিরত থাকা। (৩) ক্বিয়ামুল লাইল তথা রাত জোগে ছালাত আদায় ও
অন্যান্য ইবাদত করার ফযীলত সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করা।
(৪)
ক্বিয়ামুল লাইলের সর্বোৎকৃষ্ট ফলাফল হ’ল- এতে ঈমানী দৃঢ়তা এবং আল্লাহর
প্রতি বান্দার অগাধ ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। কেননা ক্বিয়ামুল লাইলে বান্দা তাঁর
মহান প্রভুর সাথে চুপিচুপি কথা বলে।
ক্বিয়ামে রামাযান :
ক্বিয়ামে
রামাযান তারাবীহ বা তাহাজ্জুদ ছালাত। তারাবীহ মুসলমানেরা রামাযানের মাসে
আদায় করে থাকে। আর এটা এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত বান্দা যার মাধ্যমে
তার প্রতিপালকের অধিকতর নিকটবর্তী হয়।
হাফেয ইবনু রজব বলেন, ‘মুমিন
ব্যক্তি এই মাসে নিজের জন্য দুটি জিহাদকে একত্রিত করে (ক) দ্বীনের জিহাদ যা
ছিয়াম পালনের মাধ্যমে হয়। (খ) রাতের জিহাদ যা ক্বিয়ামের মাধ্যমে হয়। আর
আল্লাহ তা‘আলা এই দুটি জিহাদের অগণিত প্রতিফল প্রদান করবেন’।
শায়খ উছায়মীন (রহ:) বলেন, ‘অন্যান্য ইবাদতের তুলনায় রামাযানের রাতের ছালাত সর্বাধিক ফযীলত রয়েছে।
عَنْ
أَبِى هُرَيْرَةَ رضى الله عنه عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم
قَالَ َمَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا
تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ- مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا
غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ- مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ
إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
‘আবূ
হুরায়রা (রাঃ) বলেন, নবী (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছওয়াবের
আশায় রামাযানে ছিয়াম পালন করবে, তার অতীতের সমস্ত গোনাহ মাফ করা হবে। যে
ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছওয়াবের আশায় রামাযানে ক্বিয়ামুল লাইল (তারাবীহর)
ছালাত আদায় করবে, তারও অতীতের সমস্ত গোনাহ মাফ করা হবে। যে ব্যক্তি
লাইলাতুল ক্বদরে ঈমানের সাথে ছওয়াবের আশায় রাত জেগে ইবাদত করে, তার পিছনের
সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করা হবে’।
রাসূল (ছাঃ) তারাবীহর ছালাত সর্বপ্রথম
মসজিদে জামা‘আতের সাথে তিন দিন আদায় করেছিলেন। তাঁর উম্মতের উপর ফরয হওয়ার
ভয়ে পরে তিনি তা ত্যাগ করেন। যখন তিনি মৃত্যু বরণ করেন তখন শরী‘আতের বিধান
স্থায়িত্ব লাভ করল এবং এটা ফরয হওয়ার ভয়ও দূরীভূত হ’ল। সুতরাং তা পুনরায়
জামা‘আতের সাথে আদায় করা শুরু হয়ে গেল যা অদ্যাবধি আমরা আদায় করছি, কিয়ামত
পর্যন্ত চলবে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর দ্বীনের বিধানের উপর অটল রেখে
অধিক নেকী অর্জনের সুযোগ ও তাওফীক দান করুন- আমীন!