শাস্তিযোগ্য অথবা অন্য কোন সাধারণ অপরাধেও
জড়িত নেই, এমন অনেককে পুলিশ শুধুমাত্র অভিযোগ বা সন্দেহের ভিত্তিতে
গ্রেফতার করে। ফৌজদারী কার্যবিধির ‘৫৪ ধারায়’ পুলিশকেএ অধিকার দেওয়া হ’লেও
মাত্রাতিরিক্ত অপব্যবহারের ফলে ধারাটি অনেকের কাছে ‘কালাকানুন’ হিসাবে
গণ্য। প্রভাবশালী মহল প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে পুলিশকে দিয়ে ৫৪ ধারার
ব্যবহার করায়। অনেক সময় পুলিশের ‘আটক বাণিজ্যের’ নামে এর অপব্যবহার চলে।
একইভাবে ‘১৬৭ ধারায়’ তদন্তের নামেও আসামিকে রিমান্ডে এনে পাশবিক নির্যাতন
চালানো হয়। সকাল, দুপুর অথবা রাতে সাদা পোশাকে কয়েকজন লোক পিতা-মাতার
আদরের টগবগে যুবক সন্তানটিকে উঠিয়ে নিয়ে গেল। এরপরে আর সে ফিরল না। এই
ধরনের ভয়ঙ্কর ও অস্বাভাবিক ঘটনা বন্ধ করার জন্যই ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল
বিচারপতি হামীদুল হক এবং বিচারপতি সালমা মাসুঊদের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্টের
একটি বেঞ্চ এই ধারা দু’টির সংশোধনীমূলক ল্যান্ডমার্ক রায় দেন। সেই রায়ে
অনাচার প্রতিরোধ করার জন্য ‘১৫ দফা গাইডলাইন’ বা দিক নির্দেশনা দেয়া হয়। এই
রায়টির পেছনে একটি দিক নির্দেশনামূলক পটভূমি ছিল। আর তা হ’লো একটি
কাস্টডিয়াল ডেথ বা হাজতে থাকাকালীন একজন নিরাপরাধ ব্যক্তির মৃত্যু।
ভয়ঙ্কর সেই ঘটনাটি :
এই
করুণ ও বীভৎস হত্যাকা-টি ঘটেছিল ১৯৯৮ সালে। যুবকটির নাম ছিল শামীম রেযা
রুবেল। সে ছিল ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তার মৃত্যু সম্পর্কে
ইংরেজী ‘ডেইলি স্টার’ প্রত্রিকা গত ২২ মে’ ১৬ তারিখে একটি করুণ কাহিনী
ছাপিয়েছে । ঐ রিপোর্ট মোতাবেক রুবেল তার পিতা-মাতার সাথে ঢাকার
সিদ্ধেশ্বরীর একটি চিপা গলিতে বসবাস করত। ১৯৯৮ সালের ২৩ শে জুলাই তার পাড়ার
একটি লুঙ্গির দোকানের সেলসম্যানের সাথে গল্প করছিল রুবেল। বেলা ৪-টার দিকে
একটি মাইক্রোবাস বোঝাই ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের কয়েকজন সদস্য রুবেলের বাসায়
আসে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তারা রুবেলকে ধরে ফেলে এবং তাকে নির্বিচারে
প্রহার করতে থাকে। তারা অভিযোগ করে যে, রুবেলের কাছে নাকি অবৈধ অস্ত্র আছে।
ঐ রিপোর্টে বলা হয় যে, তারা সকলেই সাদা পোশাকে এসেছিল। স্থানীয় সকলেই
জানতে পারে যে ওরা কারা। তারা তাকে ডিবি অফিসে নিয়ে যায় এবং প্রহার অব্যাহত
রাখে। প্রহার থেকে বাঁচার জন্য রুবেল মিথ্যার আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় এবং তার
কাছে অবৈধ অস্ত্র আছে বলে সে স্বীকারোক্তি দেয়। তখন ডিবি’র সদস্যরা তাকে
পুনরায় বাসায় আসে। কিন্তু বাসায় কোন অস্ত্র পাওয়া যায়নি। রুবেল স্বীকার
করে যে, অমানুষিক প্রহারের হাত থেকে বাঁচার জন্যই সে মিথ্যা কথা বলেছে। তখন
ডিবি’র সদস্যরা তার উপর আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তার বাসাতেই তারা তাকে
নির্দয়ভাবে প্রহার করতে থাকে। তার বুক ফাটা চিৎকার প্রতিবেশীরা শুনতে পায়।
তারা তাকে লাথি মারে এবং সে বৈদ্যুতিক খুটিতে গিয়ে ধাক্কা খায়। তারপর তারা
তাকে পুনরায় ডিবি অফিসে নিয়ে যায়। পরদিন ডিবি অফিসে তার লাশ পাওয়া যায়। তার
সারা শরীরে ভয়াবহ নির্যাতনের চিহ্ন ছিল। পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে বলা হয় যে,
ভয়াবহ প্রহারের ফলে যে রক্তক্ষরণ হয় তার ফলেই তার মৃত্যু ঘটেছে। ইংরেজী
ডেইলি স্টারের ঐ রিপোর্টে আরো বলা হয় যে, সেটি ছিল নিরীহ মানুষ হত্যার একটি
সুসস্পষ্ট ঘটনা।
রীট পিটিশন দাখিল :
১৯৯৮ সালে কয়েকটি মানবাধিকার
সংস্থা হাই কোর্টে একটি রীট পিটিশন দাখিল করেন। ঐ রীট পিটিশনে বাংলাদেশ
ফৌজদারী দ-বিধির ‘৫৪ ধারা’ অধীনে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করে সন্দেহজনক
ব্যক্তির সঙ্গে পুলিশের দুর্ব্যবহার এবং একই দ-বিধির ‘১৬৭ ধারা’ অধীনে
আসামীকে রিমান্ডে নিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহারের চ্যালেঞ্জ করা হয়। দরখাস্তে সেই
সময় পুলিশর হেফাযতে মৃত্যু, অমানুষিক নির্যাতন এবং র্দুব্যবহারের কথা
উল্লেখ করা হয়। বিশেষ করে উদাহরণ হিসাবে ৫৪ ধারার অধীনে ইন্ডিপেন্ডেন্ট
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রুবেলকে গ্রেফতার এবং নির্যাতনের পর পুলিশ হেফাযতে
তার মৃত্যুর কথা উল্লেখ করা হয়। দরখাস্তে দাবী করা হয় যে, সংবিধানের ২৭,
৩১, ৩২, ৩৩ এবং ৩৫ ধারা মোতাবেক জনগণের জীবন ও স্বাধীনতার মতো মৌলিক অধিকার
যেন উচ্চ আদালত সুরক্ষা করে।
বিচারপতি হামীদুল হক ও বিচারপতি সালমা
মাসঊদের কোর্টে ২০০৩ সালের ২৪ ও ৩০ মার্চ এবং ২রা এপ্রিল মামলাটির শুনানি
হয়। রুবেলের পক্ষে ছিলেন ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম,
মোহাম্মদ ইদরীসুর রহমান, এম এ মান্নান খান, তানযীবুল আলম এবং আবু ওবায়দুর
রহমান। ৭ই এপ্রিল হাই কোর্ট যে রায় দেয় সেটি বাংলাদেশের বিচার বিভাগে
‘ল্যান্ডমার্ক জাজমেন্ট’ হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। রায়ে বলা হয় যে,
ফৌজদারী দ-বিধির ৫৪ এবং ১৬৭ ধারা সংবিধানে প্রদত্ত নাগরিক অধিকারের সাথে
সম্পূর্ণভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আদালত পুলিশ আইন দ-বিধি এবং সাক্ষ্য আইনের
সংশোধন করে কতিপয় সুপারিশ দেয়। আদালত নির্দেশ দেয় যে, পরবর্তী ৬ মাসের
মধ্যে এসব সুপারিশ কার্যকর করতে হবে। গ্রেফতার এবং রিমান্ড সম্পর্কেও আদালত
১৫টি নির্দেশনামা দেয়।
এই রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে আপিল :
এই
রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপিল বিভাগে আপিল করে। কিন্তু আপিল বিভাগ হাই কোর্টের
রায়ের কার্যকরিতা স্থগিত করেনি। অবশেষে গত ২৪শে এপ্রিল সুপ্রীম কোর্টের
আপিল বিভাগ সরকারের আপিল খারিজ করে দেন এবং হাই কোর্টের ৭ই এপ্রিলের রায়কে
বহাল রাখেন। তবে বলা হয়েছে যে, হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণের কোন কোন অংশে কিছু
কিছু পরিবর্তন করা হবে, যেটা আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে দেখা যাবে।
হাইকোর্টের রায়ের নির্দেশনাসমূহ :
বিনা
পরোয়ানায় গ্রেফতার ও পুলিশি রিমান্ড প্রশ্নে ১৩ বছর আগে দেওয়া হাইকোর্টের
যুগান্তকারী রায় বহাল রেখেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি
এস. কে. সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বিভাগ ২৪শে মে সরকারের আপিল
খারিজ করে এই রায় দেয়। এর ফলে ১৮ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটল। প্রসঙ্গতঃ
হাইকোর্টের রায়ে ‘১৫ দফা নির্দেশনা ও সাতটি সুপারিশ’ করা হয়েছিল।
হাইকোর্টের রায়ে ১৫ দফা নির্দেশনার কয়েকটি :
১. আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে পারবে না।
২. কাউকে গ্রেফতার করার সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে।
৩. গ্রেফতারের কারণ একটি পৃথক নথিতে পুলিশকে লিখতে হবে।
৪. গ্রেফতারকৃতের শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকলে তার কারণ লিখে তাকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে ডাক্তারি সনদ আনবে পুলিশ।
৫. গ্রেফতারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারকৃতকে এর কারণ জানাতে হবে।
৬.
বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেফতারকৃতের
নিকটাত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহক মারফত বিষয়টি
জানাতে হবে।
৭. গ্রেফতারকৃতকে তার পসন্দসই আইনজীবি ও নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে।
৮.
গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) প্রয়োজন হ’লে
ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের অভ্যন্তরে কাঁচ নির্মিত বিশেষ কক্ষে
তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকটাত্মীয় থাকতে
পারবেন।
৯. কারাগারে জিজ্ঞাসাবাদে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া না গেলে
তদন্তকারী কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে সর্বোচ্চ তিন দিন পুলিশ
হেফাযতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে। তবে এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত কারণ থাকতে হবে।
১০. জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ঐ ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে।
১১.
পুলিশ হেফাযতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে
মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করবেন। বোর্ড যদি বলে ঐ ব্যক্তির ওপর নির্যাতন করা
হয়েছে, তা’হলে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা গ্রহণ
করবেন এবং তাকে দ-বিধির ৩৩০ ধারায় অভিযুক্ত করা হবে।
১২. পুলিশ হেফাযতে বা কারাগারে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাতে হবে।
১৩.
পুলিশ বা কারা হেফাযতে কেউ মারা গেলে ম্যাজিষ্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে তা
তদন্তের ব্যবস্থা করবেন। মৃত ব্যক্তির ময়না তদন্ত করা হবে। ময়না তদন্তে বা
তদন্তে যদি মনে হয় ঐ ব্যক্তি কারা বা পুলিশ হেফাযতে মারা গেছে, তা’হলে
ম্যাজিস্ট্রেট মৃত ব্যক্তির আত্মীয়ের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তা তদন্তের
নির্দেশ দিবেন।
পুলিশ-এর ‘৫৪ ধারায়’ আইনসিদ্ধ গ্রেফতার :
১. যদি পুলিশ মনে করে ব্যক্তিটি আমলযোগ্য অপরাধের সাথে জড়িত।
২. ঘর ভাঙা যায় এ ধরনরে কোন যন্ত্রপাতি থাকলে, যদি আইনসংগতভাবে থাকে তা প্রমাণ করার দায়িত্ব ঐ ব্যক্তির।
৩. সরকারি আদেশে যাকে অপরাধী ঘোষণা করা হয়েছে।
৪. চোরাই মাল আছে এরূপ সন্দেহজনক কোন ব্যক্তি ।
৫. পুলিশের কাজে বাঁধা দানকারী ব্যক্তি বা পুলিশ হেফাযত হ’তে পালানোর চেষ্টা করলে বা পালালে।
৬. প্রতিরক্ষা বাহিনী হ’তে পলায়নকারী ব্যক্তি, যদি যুক্তিসংগতভাবে তাকে সন্দেহ করা যায়।
৭. বাংলাদশেরে বাইরে যারা অপরাধ করে ।
৮. ৫৬৫ (৩) ধারা অনুযায়ী কোন মুক্তিপ্রাপ্ত আসামীকে।
৯. যাকে গ্রেফতার করার জন্য অন্য কোন অফিসারের নিকট অনুরোধ পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি (১৭-২৩শে মে’১৬) ‘৫৪ ধারায়’ গ্রেফতারের হালচিত্র :
দেশব্যাপী
গেল (১৭ -২৩শে মে) ফৌজদারি কার্যবিধির ‘৫৪ ধারায়’ তিন শতাধিক ব্যক্তিকে
গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেয়া হয়েছে
৮১ জনকে। এর মধ্যে শুধুমাত্র রাজধানীতেই ৫৪ ধারায় ১৪২ জনকে গ্রেফতার করেছে
পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা (ডিবি)। রিমান্ডে নেয়া হয়েছে ৩৮ জনকে। ডিএমপির ৪৯
থানার মধ্যে ১৯টি থানায় এ গ্রেফতারের ঘটনা ঘটে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন
এলাকার বিভিন্ন থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহে কার্যবিধির ৫৪
ধারায় রাজধানীর মতিঝিল জোনের পল্টন থানায় ১৮, শাহজাহানপুর ৫, গুলশান জোনের
বাড্ডা ২, কোতোয়ালি ৪, লালবাগে ২, বংশালে ৪, কামরাঙ্গীরচরে ৮, দারুসসালামে
২, মিরপুরে ৯, ভাষানটেকে ৩, পল্লবীতে ১১, ধানম-িতে ৮, হাজারীবাগে ১, রমনায়
৩, শাহবাগে ২, কলাবাগানে ১, তেজগাঁও জোনের শেরেবাংলা নগরে ৩, আদাবরে ২,
তেজগাঁওয়ে ১৪, শিল্পাঞ্চলে ৩, উত্তরা জোনের উত্তরখান থানায় ৩, উত্তরা পূর্ব
থানায় ২, পশ্চিম থানায় ২, তুরাগ থানায় ৮, দক্ষিণখান থানায় ৬, ওয়ারী জোনের
ডেমরা থানায় ২, যাত্রাবাড়ী থানায় ৬, কদমতলীতে ৪, শ্যামপুরে ৭, সূত্রাপুরে
১২, ওয়ারীতে ৫ ও গে-ারিয়া থানায় ২ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
তবে ডিএমপি
সদর দফতর দাবী করেছে, ২৪ ঘণ্টায় পুলিশ রাজধানী থেকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪
ধারায় মাত্র একজনকে গ্রেফতার করেছে। আর এক সপ্তাহে (১৭ মে-২৩ মে) ঐ ধারায়
মাত্র ১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
২০০৩ সালে হাই কোর্টের ঐ রায়কে
সমাজের সর্বস্তরের মানুষ বিপুলভাবে অভিনন্দন জানিয়েছিল। কিন্তু হাই কোর্টের
রায় বা জনগণের অভিনন্দন সরকার তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর কোন প্রভাবই
ফেলতে পারেনি। ২০০৩-২০১৬ এই ১৩ বছরে শত শত ব্যক্তিকে বিনা পরোয়ানায় সাদা
পোশাকের পুলিশ গ্রেফতার করেছে। অসংখ্য ব্যক্তিকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে এবং
অসংখ্য ব্যক্তিকে রিমান্ডে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে।
হাইকোর্টের এই ১৫ দফার প্রতি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তথা সরকার তথা প্রশাসনের
উপেক্ষার কয়েকটি নজির তুলে ধরছি।
(১) ২০০৭ সালের ১৩ই এপ্রিল ইংরেজী
দৈনিক ‘নিউ এজে’ যে, ২০০৪ সালের জুন মাস থেকে ২০০৭ সালের এপ্রিল মাস
পর্যন্ত এই ২ বছর ১০ মাসে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো ৮০০ ব্যক্তিকে জেল হেফাযতে
নির্যাতন করে হত্যা করেছে।
(২) ২০০৯ সালের ১৪ই অক্টোবর সাবেক
উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুকে রিমান্ডে নেয়ার পর এটর্নি জেনারেল মাহবুবে
আলম ও অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল একেএম যহীরুল হককে তীব্র ভাষায় তিরস্কার
করেছে হাইকোর্ট। হাইকোর্ট এটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে বলেছে, ‘আপনারা
শুনানিতে সময় নেবেন আবার রিমান্ডে নিয়ে টর্চার করবেন- এটা কোন ধরনের আচরণ?
মানুষকে লিবার্টি দেওয়ার জন্য আমরা এখানে বসেছি। আপনি আজ রাষ্ট্রপক্ষে
আছেন, কাল অন্য পক্ষেও থাকতে পারেন। আপনাকেও টর্চার করা হ’তে পারে। এটা
ভালো নয়। আপনাদের ক্ষমতা আছে। আমাদেরকেও পেটান। এভাবে চালাতে চাইলে হাই
কোর্ট উঠিয়ে দিন’।
(৩) ২০১৫ সালের ২১শে আগস্ট ‘ডেইলি স্টারে’ প্রথম
পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটি খবর থেকে জানা যায় যে, অভিজিৎ হত্যার দায়ে তাওহীদুর
রহমানকে ২০১৫ সালের ২১শে আগস্ট গ্রেফতার করা হয়েছে বলে র্যাব দাবী করেছে।
কিন্তু তাওহীদুর রহমানের বোন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত বৃটিশ নাগরিক নাসেরা বেগম
বলেছেন যে, সাদা পোশাক পরা ৪ ব্যক্তি তার ধানমন্ডি ৯/এ, ফ্ল্যাট থেকে ২৮শে
মে দুপুর ১.৪৫ মিনিটে তাওহীদুর রহমানকে উঠিয়ে নেয়। ঐ ৪ ব্যক্তি নিজেদেরকে
ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের সদস্য বলে পরিচয় দেয়। সেই দিনই অর্থাৎ ২৮শে মে নাছেরা
বেগম ঐ ৪ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ধানমন্ডি থানায় অপহরণের দায়ে জিডি করেন।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মীযানুর রহমান নাছেরা বেগমের বক্তব্য
সমর্থন করে বলেন যে, এক মাস আগে এ সম্পর্কে তিনি ঐ মহিলার ফোন পেয়েছেন। অথচ
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বলে যে, তারা তাওহীদুর রহমানকে ধানমন্ডির স্টার
কাবাবের একটি গলি থেকে রাত সাড়ে ১২ টার সময় গ্রেফতার করেছে।
(৪)
প্রধান বিচারপতি বলেন, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান আমাকে বলেছেন,
বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ডের দায়িত্ব পালনকারী এক মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরিবারের সদস্যরা
বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেছেন। কিন্তু আজো তার খোঁজ পাওয়া যায়নি।
পরিশেষে,
সরকার তথা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ভাইদেরকে বলব, আইনের ‘ভক্ষক না হয়ে
রক্ষক হউন’ সুখী, সমৃদ্ধি, শান্তিময় দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করুন। আল্লাহ
বলেছেন, ‘পৃথিবীতে তোমরা অশান্তি সৃষ্টি করো না’ (বাক্বারাহ ২/১১)। আপনারাও
অশান্তি সৃষ্টিকারী হবেন না। আল্লাহকে ভয় করুন। অন্যথায় আল্লাহ্র শাস্তি
থেকে আপনারা কেউই রেহাই পাবেন না। আল্লাহ আমাদের সহায় হউন-আমীন!
[লেখক : ২য় বর্ষ, দা‘ওয়াহ এ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া]