শিশু-কিশোরদের উপর নৃশংস নির্যাতন : কারণ ও প্রতিকার (৩য় কিস্তি)
আযীযুর রহমান
আযীযুর রহমান 9224 বার পঠিত
ইসলামী সংস্কৃতির গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য :
সংস্কৃতির অর্থ উৎকর্ষ, অনুশীলন বা সংশোধন। ইংরেজীতে `Culture’’ এবং আরবীতে ‘তাহযীব’ বা ‘ছাকাফাহ’ বলে। বাংলায় সংস্কৃতি শব্দটির পরিবর্তে কৃষ্টি ব্যবহৃত হয়। ‘কর্ষণ’ থেকে কৃষ্টি এবং দঈঁষঃরাধঃরড়হ’ থেকে দঈঁষঃঁৎব’ শব্দ এসেছে। আর কর্ষিত জীবনের স্বরূপকে কৃষ্টি বলা হয়। যমীনকে যেমন কর্ষণ করে আগাছা, পরগাছা, ঝোপ-জঙ্গল থেকে পরিষ্কার করে চাষোপযোগী করা হয়, তেমিন সোনামণি তথা প্রত্যেক মানব জীবনকে ইসলামী ভাবধারায় কর্ষণ করে সত্যিকারে রুচিসম্মত ও আদর্শবান করে গড়ে তোলার সিস্টেমই ইসলামী কৃষ্টি বা সংস্কৃতি। সংস্কৃতি শব্দটি অতি ব্যাপক। সাধারণ মানুষের কাছে কালচার হ’ল শিষ্টাচার বা ভদ্রতা। মি. ফিলিপস বাগবীর মতে, ‘কালচার বলতে যেমন চিন্তা ও অনুভূতির সবগুলো দিক বুঝায়, তেমনি কর্মনীতি, কার্যপদ্ধতি এবং চরিত্রের সবগুলো দিককে পরিব্যাপ্ত করে। মানুষের ভিতরকার অনুশীলিত কৃষ্টির বাহ্যিক পরিশীলিত রূপকে বলা হয় ‘সংস্কৃতি’ (মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, জীবন দর্শন, পৃঃ ৩৮)।
বর্তমান সমাজে সংস্কৃতি বলতে আমরা নাচ, গান, বাজনা, নাটক ও বিচিত্রানুষ্ঠানকে বুঝে থাকি। এ ধারণা সঠিক নয়। মানুষের জীবনের সকল দিক, তৎপরতা, আচার-ব্যবহার, লেনদেন, খাওয়া-দাওয়া, যৌন ক্রিয়াকলাপ, শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদি সবকিছুই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। আর ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ ও সুন্দর ভারসাম্যপূর্ণ জীবন বিধান (ওংষধস রং ঃযব পড়সঢ়ষবঃব ধহফ বিষষ-নধষধহপবফ পড়ফব ড়ভ ষরভব)। ইসলামী জীবনাদর্শের ভিত্তিতে যে সংস্কৃতি গড়ে উঠে তাকে ইসলামী সংস্কৃতি বলা হয়। মানব জীবনের আনুষঙ্গিক উপকরণগুলোর সৌন্দর্যবর্ধন, পরিমার্জন ও পরিশীলন শুধু নয়; বস্তুতঃ সামগ্রিক মানব জীবনকে সুন্দরভাবে, মহত্তর, মহিমাময় করে তোলাই ইসলামী সংস্কৃতির লক্ষ্য।
ইসলামী সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য সমূহ :
(১) ইসলামী সংস্কৃতি শিরক-বিদ‘আত বর্জিত। তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের দর্শনের ভিত্তিতে এর মযবুত প্রাসাদ নির্মিত।
(২) এটি অত্যন্ত কল্যাণকর ও মানবতাবাদী সংস্কৃতি।
(৩) ইসলামী সংস্কৃতি পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র।
(৪) এটি বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত।
(৫) সকল সংকীর্ণতা ও কূপম-ূকতামুক্ত।
(৬) সর্বকালের ও সকল দেশের জন্য প্রযোজ্য।
(৭) দুনিয়া ও আখেরাতের সমন্বিত সংস্কৃতি।
সুধী পাঠক! আসুন, আমরা আমাদের সন্তানদের ইসলামী সংস্কৃতির গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিয়ে প্রকৃত ইসলামী আদর্শে আদর্শবান হিসাবে গড়ে তোলার সার্বিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাই এবং আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রেখে তাঁর সাহায্য কামনা করি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দিন-আমীন!
শিশু-কিশোরদের মনোজগৎ ও তার চাহিদা :
চাহিদা-১ : সুধী পাঠক! আমাদের মাথার উপর যে আকাশ রয়েছে তার চেয়ে বিস্তৃত ও বিশাল আকাশ আছে প্রতিটি সোনামণির মনের মাঝে। মনের আকাশ দেখার জন্য বাহ্যিক চোখের প্রয়োজন হয় না, থাকতে হয় অন্তর্দৃষ্টি। আর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন চোখ সৃষ্টিতে থাকা চাই একাগ্রতা ও অধ্যবসায়। অধ্যবসায় সৃষ্টি হয় স্বপ্ন থেকে। স্বপ্ন মানুষকে মোহিত করে অনেক উপরে নিয়ে যায়। স্বপ্ন দু’প্রকার। যথা : (১) ঘুমের মধ্যে দেখা স্বপ্ন। (২) জেগে থেকে দেখা স্বপ্ন। ঘুমিয়ে থেকে দেখা স্বপ্ন নিজস্ব নয়। জেগে থেকে দেখা স্বপ্ন সম্পূর্ণ নিজের। জেগে থেকে দেখা স্বপ্নই প্রকৃত স্বপ্ন। এই প্রকৃত স্বপ্ন মানুষকে ভিন্ন জগতে নিয়ে যায়, তাকে আনন্দিত করে। শিহরিত করে হৃদয়াভ্যন্তরে। উচ্চ শিখরে পৌঁছতে সহযোগিতা করে। অনেক উপরে যেতে সহযোগিতা করে। এই স্বপ্নই নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য এবং দেশের জন্য এমনকি বিশ্বের জন্যও হ’তে পারে। শিশু-কিশোররা তাদের মধ্যে অসংখ্য কল্পনা থেকে নতুন নতুন স্বপ্ন দেখে। কল্পনা ও স্বপ্নগুলো মেধা ও মননের দ্বার উন্মুক্ত করে। সুপ্ত মেধাকে করে বিকশিত। শিশুদের মনের আকাশ যতটা সংবেদনশীল তার চেয়ে অধিক কোমল ও স্বচ্ছ। স্বচ্ছ আকাশে স্বপ্নের উজ্জ্বল তাঁরার সম্মেলন ঘটানো অত্যাবশ্যক।
শিশু-কিশোরদের মনটাকে কাজ দিতে হবে। তাহ’লে সে ভাল থাকবে। সুস্থ ও সুন্দর থাকবে। শিশু-কিশোররা ভবিষতে কি হবে জিজ্ঞেস করলে তারা বলে, কেউ প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, কেউ আবার ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কেউ হাফেয, ক্বারী, মাওলানা, ইমাম ইত্যাদি হওয়ার স্বপ্নের আশা ব্যক্ত করে থাকে। মানুষকে মানুষ হওয়ার জন্য দো‘আ ও সহযোগিতা করতে হয়। গরু-ছাগল পশু-পাখি এমনিতে পশু-পাখি, তাদের এজন্য কোন প্রকার দো‘আ ও সহযোগিতার প্রয়োজন হয় না। শিক্ষকেরা শিশু-কিশোরদের প্রকৃত মানুষ হিসাবে গড়ার অন্যতম ভূমিকা রেখে থাকে। আমরা বর্তমান সমাজে দেখতে পাচ্ছি শিশুরা একটা অস্থির সময় পার করছে। কেউবা হচ্ছে মাদকাসক্ত আবার কেউবা পিতা-মাতা ও অভিভাবকদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করছে। কতিপয় অসচেতন বিপদগামী শিক্ষকের কারণে অনেক বেশী মার্কস পাওয়ার লোভে কোমলমতি মেয়ে শিশু ও ছাত্রীরা কুরুচিপূর্ণ শিক্ষকদের লালসার শিকার হচ্ছে। আবার কোন কোন অভিভাবক সন্তানদের সামনে নেশাদার দ্রব্য সেবন করছে। এসব পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সকলকে সচেতন হ’তে হবে। শিশু-কিশোরদের মনের হাযারো স্বপ্নকে সুন্দরভাবে পালনের পরিবেশ সৃষ্টি করে দেওয়া আমাদের সকলের দায়িত্ব। শিশুদের মনোজগত হৌক আরও সুন্দর, স্বপ্নময়। তাদের চরিত্র হোক আদর্শময়, সুশৃঙ্খল ও স্বার্থক। এটাই আমাদের কামনা হওয়া উচিত।
চাহিদা-২ : আমরা সবাই জানি শিশুরা হাসতে শেখার আগে কান্না শেখে। কান্না দ্বারা তার প্রয়োজন প্রকাশ বা চাহিদা জানায় এবং হাসি দ্বারা সন্তুষ্টি প্রকাশ করে। জন্মের পরই শিশুরা কতকগুলো সমস্যার সম্মুখীন হয়। যেমন- (১) সুরক্ষিত কোলাহলহীন ছন্দময় সুন্দর বাসস্থান থেকে সমস্যাবহুল কোলাহলপূর্ণ পৃথিবীতে আগমন ঘটে। (২) তার খাদ্যের পথ ও পদ্ধতি বদলে যায়। (৩) নিজেকেই শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণের দায়িত্ব পালন করতে হয়। (৪) শারীরিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। (৫) সবকাজে অন্যের বিশেষ সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। শিশু তার মায়ের গর্ভে সবসময় হৃদপি-ের ছন্দময় পানির ভিতর ডুবে থাকে। ফলে মায়ের চলাফেরা ও ঝাঁকুনি থেকে রক্ষা পায়। মহান আল্লাহর সৃষ্টিকৌশল কতই না সুন্দর!
সুধী পাঠক! আমরা জানি, মায়েরা তার শিশুকে নিজের অজান্তে বাম বুকে রাখেন। আর হৃদপি-ের অবস্থান তো বুকের বাম পাশেই। মায়ের কোলে গেলেই শিশু শান্ত হয়, তার কারণ মাতৃগর্ভে যে স্পন্দনে শিশু আবিষ্ট ছিল সে স্পন্দন কানে লাগতেই সে শান্ত হয়ে যায়। বাম স্তনের অবস্থাও হৃদপি-ের উপরে। তাই শিশুকে মায়ের কাছে রাখলেই তার মন ভাল থাকে ও চাহিদা পূরণ হয় এবং বিনো সূতী মালার সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়। শিশুরা একটু বড় হ’লেই তার মনটাকে ভাল কাজের দিকে একটু একটু করে পরিচিত করে দিতে হবে। মনটাকে শূন্য রাখা যাবে না। ইংরেজীতে বিখ্যাত একটি প্রবাদ রয়েছে ‘ঊসঢ়ঃু সরহফ রং ফরারষং ড়িৎশংযড়ঢ়’ অর্থাৎ ‘শূন্য মন শয়তানের কারখানা’। কথাটি বড়ই তিক্ত, কিন্তু বাস্তব সত্য। আমরা আমাদের শিশুদেরকে ছোট বলে কর্মহীন অবস্থায় ছেড়ে দিয়ে থাকি। ফলে ধীরে ধীরে তারা খারাপের দিকে ধাবিত হয়। তাই তাদের মনটাকে সর্বদা কাজ দিতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ النَّفْسَ لَأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ ‘নিশ্চয় মানুষের মন মন্দপ্রবণ’ (ইউসুফ ১২/৫৩)। তাই ধরে নেওয়া যায় মানুষের মন বেশীর ভাগ সময় খারাপ কাজের দিকে ধাবিত হয়। আর তার নৈতিক সত্তা বা বিবেক তাকে বাধা দেয়। আর শিশুদের সুপ্ত বিবেককে জাগ্রত করে দেওয়াই আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
শিশুর মনটাকে কাজ দেওয়া এবং বশে আনার উপায় :
(১) শিশুদেরকে রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ অনুযায়ী সাত বছর বয়স থেকে ছালাতের প্রশিক্ষণ দেওয়া। সূর্য উঠার পূর্বে ফজর থেকেই একজন সোনামণির প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ছালাত আদায় করতে হ’লে ভোরে উঠতে হবে, দাঁত মাজতে হবে, টয়লেটে যেতে হবে, ওযূ করে ছালাতের প্রস্তুতি নিতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, وَأَقِمِ الصَّلَاةَ لِذِكْرِي ‘আমাকে স্মরণ রাখার জন্য ছালাত কায়েম কর’ (ত্বহা ২০/১৪)।
(২) প্রতিটি কাজের পূর্বে দো‘আ ও তাসবীহের মাধ্যমে আল্লাহকে স্মরণ করা এবং রামাযানে একটু একটু করে ছিয়াম পালনের অভ্যাস করানো।
(৩) মুখ ও মনকে একসাথে কাজে লাগানো। চুপি চুপি মন ছালাতে বেশী ঘুরপাক খায়। একটু শব্দ করে কুরআন পাঠ, বই পড়া, বক্তৃতা ও তাসবীহ পাঠ করলে মুখ ও মন একসাথে কাজ করে।
(৪) সব সময় সকল প্রকার কুচিন্তা ছেড়ে সুচিন্তায় মগ্ন থাকার প্রশিক্ষণ দিতে হবে পরিবার থেকে। শয়তান মানুষের দুর্বল ও অসহায়ত্বের মধ্যে কুচিন্তা ঢুকিয়ে দেয়। আল্লাহর স্মরণে কুচিন্তা দূর হয়ে যায়।
(৫) সমস্ত প্রকার বিপদ, সমস্যা ও ঝামেলা এবং আনন্দঘন খুশীর মুহূর্তে আল্লাহর উপর দৃঢ় ভরসা করা কর্তব্য। মহান আল্লাহ বলেন, وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ ‘আল্লাহর উপর ভরসা করা মুমিনের কর্তব্য’ (আলে ইমরান ৩/১২২)। অতএব সন্তানকে উত্তম চরিত্রবান করে গড়ে তোলার জন্য উল্লেখিত ৫টি নীতির যথাযথ অনুসরণ এবং বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
[লেখক : প্রথম কেন্দ্রীয় পরিচালক, সোনামণি ও সিনিয়র অফিসার, মানব শক্তি বিভাগ, খুলনা বিমানবন্দর, খুলনা]