শিশু-কিশোরদের উপর নৃশংস নির্যাতন : কারণ ও প্রতিকার (৩য় কিস্তি)
আযীযুর রহমান
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 9058 বার পঠিত
একজন মানুষ তখনই অপরের হৃদয়ে
স্থান করে নেয়, যখন সে নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে দ্বিধাহীনচিত্তে অপরের
জন্য প্রাণ উজাড় করে দিতে পারে। বিখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা মুহাম্মাদ আলী
ক্রীড়াজগতের ক্ষুদ্র আঙিনা থেকে বের হয়ে এসে সমগ্র মানুষের একান্ত আপন হয়ে
উঠেছিলেন জীবনের কঠিনতম মুহূর্তেও মানবতার জন্য আত্মোৎসর্গ করতে পারার এই
মহৎ গুণ থেকেই। কোন ভনিতার আশ্রয় না নিয়ে অকপটে সত্য বলতে পারা, নিজের
বিশ্বাসের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রবল
নৈতিক শক্তি তাঁকে সাধারণের কাতার থেকে নিয়ে গেছে অনেক ঊর্ধ্বে। ১৯৪২ সালে
আমেরিকার লুইসভিল কেন্টাকিতে জন্মগ্রহণকারী ক্যাসিয়াস ক্লে ১৯৬০ সালে
বক্সিং জগতে আবির্ভূত হন। একই সালে রোম অলিম্পিকে সোনা জিতে আলোড়ন তোলেন।
১৯৬৪ সালে তিনি ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। তাঁর নতুন পরিচয় সবাই সহজে মেনে
নিতে পারেনি। বড় বড় স্পন্সর মুখ ফিরিয়ে নিল। ১৯৬৭ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধে
যাওয়ার ডাক এল। কিন্তু তিনি মানবতার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে জড়াতে অস্বীকার
করলেন। তিনি সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করলেন, ‘যুদ্ধ কুরআনের শিক্ষাবিরুদ্ধ। আমরা
(মুসলিমরা) আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের নামে ঘোষিত যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোন
যুদ্ধে অংশ নিতে পারি না। আমি খৃষ্টান বা কোন অমুসলিমদের ঘোষিত যুদ্ধে
অংশগ্রহণ করব না’। তিনি আরও বললেন, ‘ভিয়েতনামীদের সাথে আমার কোন ঝগড়া নেই।
আমাকে তারা সেনাবাহিনীর উর্দি পরে নিজের বাড়ি থেকে দশ হাযার মাইল দূরে গিয়ে
বাদামী ভিয়েতনামীদের উপর বোমা এবং বুলেট নিক্ষেপ করতে কেন বলে, যখন
লুইসভিলে তথাকথিত ‘নিগ্রো’দের সাথে কুকুরের মত আচরণ করা হয় এবং তাদেরকে
ন্যূনতম মৌলিক অধিকার পর্যন্ত দেয়া হয় না’? তিন তিনবার প্রস্তাব
প্রত্যাখ্যান করার পর ৪র্থ দফায় তাঁকে শাস্তিস্বরূপ জেলে পাঠানো হল। তাঁর
খেতাব কেড়ে নেয়া হ’ল। ক্যারিয়ারের স্বর্ণালী মুহূর্তে ৩ বছরের জন্য বক্সিং
লাইসেন্স কেড়ে নেয়া হল। সকল সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাহার করা হল। কিন্তু তিনি
তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় থাকলেন। এতে তাঁর কোন আক্ষেপও ছিল না। তিনি বলেন, ‘আমি
পুরস্কার ছুড়ে ফেলিনি। আমি তা হারাইওনি। যদি আমার স্বাধীনতাই না থাকে,
তাহলে শ্রেষ্ঠতম পুরস্কার দিয়ে আমি কি করব?’। একজন কালো তরুণ এভাবে স্রেফ
নিজের নৈতিক অবস্থানের উপর অবিচল থাকতে অর্থ-সম্পদের হাতছানি, খ্যাতি,
প্রিয় খেলা অবলীলায় পদদলিত করলেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর এই আপোষহীন
অবস্থান সারা আমেরিকায় সাড়া ফেলে দেয়। কারামুক্তির পর বিভিন্ন
বিশ্ববিদ্যালয় এবং সভা-সমিতিতে তাঁর ডাক আসতে থাকে। শীঘ্রই তিনি আমেরিকায়
মানবাধিকারের পক্ষে একজন শক্তিমান বক্তায় রূপান্তরিত হন। পরিণত হন
বক্সিং-এর চ্যাম্পিয়ন থেকে ‘জনগণের চ্যাম্পিয়নে’। বিবিসির চোখে স্বীকৃতি
পান শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ক্রীড়া ব্যক্তিত্বে। নিজেকে ‘দ্যা গ্রেটেস্ট’ বলার
হিম্মতটা তাই কখনও তাঁর জন্য বাগাড়ম্বর মনে হয়নি। গিনেস বুক অব রেকর্ডস
জানাচ্ছে, সা¤প্রতিক পৃথিবীতে আর কোন মানুষকে নিয়ে এত ভাষায় এত কথা বলা
হয়নি, যতটা হয়েছে আলীকে নিয়ে। ১৯৭৭ সালে তিনি ঘোষণা করেন, বক্সিং ক্যারিয়ার
শেষে তিনি বাকি জীবন ‘আল্লাহর সাথে সাক্ষাতে’র প্রস্তুতির জন্যই ব্যয়
করবেন। মানুষের মাঝে শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেয়ার মনস্থ করেন। তিনি বলেন,
‘মানবসেবার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর এই পৃথিবীতে অবস্থানের ভাড়া মেটাই’।
নিজ ধর্ম এবং আত্মপরিচয় ছিল তাঁর কাছে সবার ঊর্ধ্বে। মুসলমান হওয়ার পর তাঁর ইসলাম পূর্ব নামে কোথাও ডাকা হলে ভীষণ ক্ষুব্ধ হতেন। মুহাম্মাদ আলী না বলে পুরানো নাম ক্যাসিয়াস ক্লে বলায় প্রতিপক্ষ নর্টনকে নক আউট করতে গিয়ে তাঁকে একেকটা ঘুষি মারছিলেন আর বলছিলেন, ‘হোয়াট ইজ মাই নেম’। নিজের মুসলিম পরিচয়কে সর্বত্র তুলে ধরতে পসন্দ করতেন। বহু মানুষ তাঁর মাধ্যমে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় এসেছেন। ইসলাম এবং মুসলমানদের স্বার্থের প্রশ্নে সবসময় তিনি অগ্রগামী ছিলেন। ফিলিস্তীনের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে তিনি ছিলেন একজন সোচ্চার কণ্ঠ। শান্তির বার্তা নিয়ে ছুটে গেছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। তাঁর বাগবৈদগ্ধ এবং কাব্যপ্রতিভাও ছিল অসামান্য। তাঁর বহু উক্তি স্বরণীয় উক্তি হিসাবে উদ্ধৃত হয়েছে। মুহাম্মাদ আলী আজীবন বেঁচে ছিলেন অকপট সাহস, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দ্রোহ, মানবতার মুক্তির বার্তা বহনকারী হিসাবে। ইসলামের পরশ তাঁর মনন ও চেতনায় দান করেছিল অনন্য সৌন্দর্য। তিনি চলে গেছেন বটে, কিন্তু বিশ্বের তাবৎ কালো, নিপীড়িত এবং মুক্তিকামী মানুষের কাছে তিনি বহুদিন বেঁচে থাকবেন সাহস ও অনুপ্রেরণার উজ্জ্বল প্রতীক হিসাবে। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতে উচ্চ স্থান দান করুন। আমীন!