কাশ্মীর : একটি পর্যালোচনা

মুহাম্মাদ আমীনুল ইসলাম 9525 বার পঠিত

সিকিমকে ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করা আর ভারতশাসিত কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন ও বিশেষ অধিকার বিলুপ্ত করে কেন্দ্রীয় শাসন জারির দৃশ্যপট অনেকটা একই রকম। সিকিমে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করার পর রাজার নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে ভারত সামরিক অভিযান চালিয়েছিল। কাশ্মীরে নতুন করে ৩৫ হাযার সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। জম্মু, কাশ্মীর ও লাদাখে গিজগিজ করছে ভারতীয় সৈন্য। কোনো একটি অঞ্চলে এত অধিক সেনা মোতায়েনের ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। মনে হয়, গোটা কাশ্মীরই বুঝি একটি গ্যারিসন। সিকিম দখল করতে ভারতীয় সেনারা রাজপ্রাসাদের সামনে গুলি চালিয়েছিল এবং অর্ধঘণ্টার অপারেশনে ২৪৩ জন প্রহরী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এরপরই রাজপ্রাসাদের শীর্ষে শোভা পায় ভারতের পতাকা। ভারত বহির্বিশ্বের সঙ্গে সিকিমের সব রকমের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে তৎকালীন দূত বিএস দাসকে সিকিমের প্রধান প্রশাসক নিয়োগ করে।

ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা 'র'-এর প্রাক্তন পরিচালক অশোক রায়না তার ‘ইনসাইড স্টোরি অব ইন্ডিয়াস সিক্রেট সার্ভিস’ শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন, ভারত ১৯৭১ সালেই সিকিম দখল করতে চেয়েছিল। সেই লক্ষ্যে সিকিমে আন্দোলন, হত্যা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়। চীন সীমান্তে নেপাল, সিকিম ও ভুটান- এই তিন রাষ্ট্রের স্বাধীন ভারত কৌশলগত কারণে নিরাপদ মনে করেনি। সাংবাদিক সুধীর শর্মা প্রধানমন্ত্রী লেন্দুপ দর্জির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘সিকিম মিশন’-এর প্রধান চালিকাশক্তি ছিল ‘র’। ব্রিটিশ আমলে সিকিম ছিল একটি আশ্রিত রাজ্য। ইন্দিরা গান্ধী সরকার সিকিমকে ভারতের অঙ্গীভূত করার লক্ষ্যে লোকসভায় একটি বিল উত্থাপন করে ১৯৭৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর। বিলটি ৩১০-৭ ভোটে পাস হয়। এর দেড় মাস পর দৈনিক ইত্তেফাকের পক্ষ থেকে নয়াদিল্লিতে একজন সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। তাকে বলা হয়েছিল, ‘আপনি তো স্বাধীন রাজ্য সিকিম দখল করে নিয়েছেন। একটু ক্ষেপে গিয়ে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, 'কে বলে?' বললাম, 'সারাবিশ্ব।' তিনি বললেন, 'না, শুধু সেই আমেরিকান মহিলা (চোগিয়ালের স্ত্রী) তা বলে বেড়াচ্ছে’। অবশেষে সংবিধান সংশোধন করে ১৯৭৫ সালের মে মাসে সিকিমকে ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যে রূপান্তরিত করা হয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত কাশ্মীর ছিল হিমালয় পর্বত ও পীর পাঞ্জাল পাহাড়ের মধ্যবর্তী একটি উপত্যকা। কাশ্মীরের প্রথম মুসলমান শাসক ছিলেন শাহ মীর (১৩৩৯)। পরবর্তী পাঁচশ বছর মুসলমানরা কাশ্মীর শাসন করে। ১৮২০ সালে শিখ রাজা রঞ্জিৎ সিং কাশ্মীর দখল করে তাকে তার রাজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করেন। তিনি গোলাব সিং দোগরাকে জায়গীর হিসাবে জম্মু প্রদান করেন। গোলাব সিং ছিলেন অত্যন্ত চতুর প্রকৃতির লোক। তিনিই জম্মু ও কাশ্মীরের সর্বশেষ মহারাজা হরি সিংয়ের পূর্বপুরুষ। রঞ্জিৎ সিংয়ের মৃত্যুর পর প্রকাশ্যে শিখদের সঙ্গে থাকলেও গোপনে তার আনুগত্য ছিল ইংরেজদের প্রতি। তার কারসাজি ধরা পড়ে গেলে শিখ দরবার তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করে। যা হোক, প্রথম ইংরেজ-শিখ যুদ্ধে শিখরা পরাজিত হ’লে জম্মুর হিন্দু শাসক গোলাব সিং দোগরা ১৮৪৬ সালে পুরস্কার হিসাবে লাভ করেন জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য। অবশ্য এ জন্য তিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ৭৫ লাখ টাকা পরিশোধ করেন। তার উত্তরসূরীরা ছিলেন রণবীর সিং, প্রতাপ সিং ও হরি সিং।

ভারত বিভাজনের সময় কাশ্মীর ও সিকিমসহ করদ বা দেশীয় রাজ্য ছিল ৬৮০টি। তাদের ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। অবশ্য চাইলে তারা স্বাধীন হিসাবেও থাকতে পারবে। বেশীরভাগ মুসলমান রাজ্য পাকিস্তানে ও হিন্দু রাজ্যগুলো ভারতে যোগ দেয়। বেলুচিস্তানের কালাত রাজ্য ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কিন্তু ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে তাকে পাকিস্তানে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়। হিন্দুপ্রধান হায়দারাবাদ দেশীয় রাজ্যের মুসলমান নিজামও স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। কিন্তু সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে ভারত তা দখল করে নেয়। গুজরাটের দক্ষিণ-পশ্চিমে ছিল জুনাগড় করদ রাজ্য। রাজ্যের শাসক নওয়াব মহববত খান ১৫ই আগস্ট পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলে ভারত আপত্তি জানায়। কারণ জুনাগড়ের ৮০ শতাংশ লোক হিন্দু এবং এই রাজ্যের সীমানা পাকিস্তানের সঙ্গে লাগোয়া ছিল না। পাকিস্তান একে ভারতে পাকিস্তানের একটি ছিটমহল হিসাবে গণ্য করতে বলল। কিন্তু ভারত তা গ্রাহ্য না করে জুনাগড়ে সৈন্য পাঠায়। ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর নওয়াব পালিয়ে পাকিস্তানে চলে যান এবং ৭ নভেম্বর নওয়াবের দেওয়ান স্যার শাহনওয়াজ ভুট্টো ভারতের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। শাহনওয়াজ ভুট্টোর ছেলে জুলফিকার আলী ভুট্টো ও নাতনী বেনজির ভুট্টো পরবর্তীকালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ভারত শাহনওয়াজ ভুট্টোর আহবানে ৯ই নভেম্বর ১৯৪৭ সনে জুনাগড় দখল করে নেয়।

ঠিক ওই সময়েই জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। এই রাজ্যের অধিকাংশ লোক ছিল মুসলমান আর রাজা হিন্দু। ভাগাভাগির সময় কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং ভারত বা পাকিস্তানে যোগ না দিয়ে স্বাধীন হিসাবে থাকার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু কোনো কোনো ইতিহাসবিদ বলেছেন, মহারাজা নাকি ভারতে যোগদানের জন্য নয়াদিল্লীর সঙ্গে গোপনে শলাপরামর্শ করছিলেন। তখন পুঞ্চ এলাকায় মুসলমানরা বিদ্রোহের পথ বেছে নিলে রাজা মুসলমানদের ওপর অত্যাচার ও গণহত্যা শুরু করলেন, তাদেরকে তাড়িয়ে দিতে লাগলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল অধিকহারে মুসলমান চলে গেলে অচিরেই কাশ্মীর হিন্দুপ্রধান হয়ে যাবে। ১৯৪৭ সালের আগস্টে ভারত বিভক্তির দুই মাস পর অক্টোবরে পাকিস্তানী মদদে উপজাতীয়রা কাশ্মীর আক্রমণ করে। ২৫শে অক্টোবর তারা বড়মুলা দখল করে। সেখান থেকে গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শ্রীনগরের দূরত্ব মাত্র ৩৫ কিলোমিটার। কিন্তু তারা রাজধানী ও তার অরক্ষিত বিমান ঘাঁটি কব্জায় আনার কোনো চিন্তা না করে সেখানেই দু’দিন কাটিয়ে দেয়। চার্লস শেভনিক্স ট্রেঞ্চের মতে, তারা লুটতরাজ, হত্যা ও নারী ধর্ষণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, লোভ-লালসার জন্য তারা কিছুই করতে পারেনি (দ্য ফ্রন্টিয়ার স্কাউটস)। কাশ্মীরের নিরাপত্তা বাহিনী অত্যন্ত দুর্বল ছিল এবং পাকিস্তানীদের সঙ্গে যুদ্ধ করার মতো তেমন কোনো অস্ত্রশস্ত্রই তাদের ছিল না। মনোবলও দৃঢ় ছিল না। মহারাজা ভাবলেন, পাকিস্তানীরা যদি কাশ্মীর দখল করে নেয়, তাহলে তাকে পাকিস্তানে যোগ দিতে হবে। তখন তিনি ভারতের দিকে তাকালেন। অনুরোধ করলেন কাশ্মীর রক্ষার জন্য সৈন্য পাঠাতে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তাৎক্ষণিক সৈন্য পাঠাতে রাযী ছিলেন; কিন্তু বিচক্ষণ গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটন রাজা হরি সিংকে সৈন্য পাঠানোর আগে ভারতে যোগ দেওয়ার পরামর্শ দিলেন। ২৬ অক্টোবর হরি সিং ভারতে সংযুক্তকরণ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। দু'দিন পর যখন উপজাতীয়রা শ্রীনগরের দিকে যাত্রা শুরু করে, তখন কাশ্মীরে ভারতীয় সৈন্য পৌঁছে গেছে। এখন কাশ্মীরের আর একক মালিক নেই, মালিকানা চলে গেছে তিন দেশের হাতে। ভারতের দখলে আছে ৪৩ শতাংশ, পাকিস্তানের ৩৭ শতাংশ এবং চীনের ২০ শতাংশ। কাশ্মীরে ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধ করেছে তিনবার-১৯৪৭, ১৯৬৫ ও ১৯৯৯ সালে। তিনবারের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে উভয় পক্ষের ৪৭ হাযার লোক মারা গেছে।

ভারত সরকারের নতুন পদক্ষেপের ফলে কাশ্মীরে জনজীবন থমকে গেছে; সর্বত্র বিরাজ করছে চরম আতঙ্ক। কাশ্মীরী নেতা শেখ আবদুল্লাহ ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন ও 'বিশেষ অধিকার' চিরদিন বজায় থাকবে। কাশ্মীর এখন আর কোনো রাজ্য নয়, ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে স্বায়ত্তশাসন এবং বিশেষ অধিকার। নিজস্ব কোনো পতাকা থাকবে না। আজ শেখ আবদুল্লাহর নাতি সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ কারাগারে। বেঁচে থাকলে তিনিও হয়তো গৃহবন্দি হতেন। ভারতের শাসক দল বিজেপি বরাবরই কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন এবং বিশেষ অধিকারের বিরোধিতা করেছে। এখন যে কোনো ভারতীয় কাশ্মীরে জমি কিনতে পারবে। কিন্তু মিজোরামসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে তো পারে না। তাহলে কাশ্মীরীদের শায়েস্তা করার লক্ষ্যেই কি এই ব্যবস্থা? ভারতের বিরোধী দলগুলো এবং বিশ্লেষকরা এর বিরোধিতা করে বলেছেন, পরিণাম শুভ হবে না। কাশ্মীরের ভাগ্যে কী আছে, আল্লাহই ভাল জানেন। এই পদক্ষেপের জের ধরে উপমহাদেশে উত্তেজনা সৃষ্টি হ’লে তার দায় ভারতের।[1]

কাশ্মীরের রাজা হরি সিং ১৯৪৭ সালে প্রথমে স্থির করেছিলেন তিনি স্বাধীন থাকবেন এবং সেই মোতাবেক ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে স্থিতাবস্থার চুক্তি স্বাক্ষর করবেন। পাকিস্তান সে চুক্তিতে স্বাক্ষরও করেছিল। কিন্তু জনজাতি এবং সাদা পোশাকের পাক সেনা যখন কাশ্মীরে অনুপ্রবেশ করে, তখন তিনি ভারতের সাহায্য চান, যা শেষ পর্যন্ত কাশ্মীরের ভারতভুক্তি ঘটায়। ১৯৪৭ সালের ২৬শে অক্টোবর হরি সিং ভারতভুক্তির চুক্তি স্বাক্ষর করেন। পরদিন ২৭শে অক্টোবর ১৯৪৭ গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন সে চুক্তি অনুমোদন করেন। জেনে নেওয়া যাক, ৩৭০ ধারাটি কী ছিল? আর তার তাৎপর্যই বা কী? ৩৭০ ধারা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ১৭ই অক্টোবর৷ এই ধারা বলে ওই রাজ্যে সংসদের ক্ষমতা ১০০ ভাগ কার্যকরী হয় না। ভারতভুক্তি সহ কোনও কেন্দ্রীয় আইন বলবৎ রাখার জন্য রাজ্য সরকারের অবশ্যই একমত হওয়া আবশ্যক। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতকে ভারত ও পাকিস্তানে বিভাজন করে ভারতীয় সাংবিধানিক আইন কার্যকর হওয়ার সময়কাল থেকেই কোনও প্রিন্সলি স্টেটের ভারতভুক্তির বিষয়টি কার্যকরী হয়। ওই আইনে তিনটি সম্ভাবনার কথা রয়েছে প্রথমত, স্বাধীন দেশ হিসাবে থেকে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, ভারতে যোগদান অথবা পাকিস্তানে যোগদান।[2]

দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বরাত দিয়ে জম্মুভিত্তিক পত্রিকা আর্লি টাইমস সম্প্রতি এ খবর জানিয়েছে। এ ব্যাপারে আগামী দু’এক মাসের মধ্যে নিজেই ঘোষণা দিতে পারেন তিনি। রাজ্য হিসাবে কাশ্মীরে মোট ৮৭টি আসন রয়েছে। এর মধ্যে কাশ্মীর উপত্যকার জন্য ৪৬, জম্মুর ৩৭টি এবং লাদাখের জন্য মাত্র ৪টি। এ তিন এলাকায় জনসংখ্যার অনুপাত যথাক্রমে ৫০:৪৫ :৫। লাদাখ ও জম্মুর মোট জনসংখ্যাও কাশ্মীরের সমান হবে না। ভারতীয় সংবিধানের আর্টিকেল ৩৫(এ) ও আর্টিকেল ৩৭০ ধারায় কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। ৩৫(এ) ধারা বলে রাজ্যটিতে একমাত্র কাশ্মীরীরাই ভূ-সম্পত্তির মালিক হওয়ার অধিকারী। কাশ্মীর রাজ্যসভাকে কিছু বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে ৩৭০ ধারায়। বিজেপি সরকার জানে, কাশ্মীরে তারা এককভাবে সরকার গড়তে পারবে না। এক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল কনফারেন্স বা পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) উপর নির্ভর করতে হবে।[3]  

বর্তমানে ধারা ৩৫(এ) এবং ৩৭০ বাতিলের ফলে ভারত এবং কাশ্মীরের মধ্যে চুক্তি যেহেতু লঙ্ঘিত হয়েছে, সেহেতু ল অফ কন্ট্রাক্ট অনুযায়ী পরিস্থিতি ইন্সট্রুমেন্ট অফ অ্যাকসেশনের আগের মুহূর্তে ফিরে যাবে। অর্থাৎ চুক্তি লঙ্ঘনের পরে আইন অনুযায়ী কাশ্মীর স্বাধীন হয়ে যাওয়ার কথা। ধারা ৩৫(এ) এবং ৩৭০ বাতিলের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই ভারতের সুপ্রিমকোর্টে একাধিক মামলা হয়েছে। রায় বের হ’লে বোঝা যাবে সে সব মামলার সারবত্তা।

যাই হোক, এই নিবন্ধে আলোচনার মূল বিষয় হল- জম্মুতে বীভৎস মুসলিম গণহত্যা এবং জাতিগত নির্মূলকরণ যা খুবই কম চর্চিত হয়েছে বা চর্চিত হয়নি। অথচ এ নিয়ে অনেক তথ্য আছে, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ রয়েছে। রয়েছে ঐতিহাসিক দলীল। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা লাভের পরে 'জম্মু ছিল হিন্দু অধ্যুষিত, কাশ্মীর ছিল মুসলিম অধ্যুষিত'- নিখাদ অসত্য এই প্রোপাগান্ডা বহুলভাবে প্রচারিত হয়ে থাকে। জম্মু এবং কাশ্মীর কোনো প্রদেশই হিন্দু অধ্যুষিত ছিল না, দুটোই ছিল প্রধানত মুসলিম অধ্যুষিত। সুপ্রিমকোর্টের প্রখ্যাত আইনজীবী এ জি নুরানী তাঁর 'The Kashmir Dispute, ১৯৪৭-২০১২' বইতে জহরলাল নেহেরু কর্তৃক লর্ড মাউন্টব্যাটনকে লেখা একটি চিঠির সূত্র উল্লেখ করে বলেন, জম্মুর মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ৬১ শতাংশ। জম্মুর তৎকালীন ৬১ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যা বর্তমানে ৩৩ শতাংশে নেমে এসেছে। এর কারণ আসলগুলি কী কী? ইতিহাসের আলোকে সঠিক পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বিপুল পরিমাণে জনসংখ্যা হ্রাসের পিছনে রয়েছে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সংঘটিত ভয়ানক মুসলিম গণহত্যা ও বিতাড়ন। কাশ্মীর সমস্যা, কাশ্মীরীদের উপর নির্যাতন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়ার সময় আবশ্যিকভাবেই কাশ্মীরী পন্ডিতদের হত্যা ও বিতাড়নের প্রসঙ্গ উঠে আসে। ১৯৯০ সালে কাশ্মীরী পন্ডিতদের উপর চলা নির্যাতন এবং কাশ্মীর থেকে তাদের বিতাড়ন অবশ্যই ঘৃণিত ও চরম নিন্দনীয়। কিন্তু ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে জম্মুতে সংঘটিত লক্ষগুণ ভয়াবহ মুসলিম গণহত্যার নৃশংসতা ইতিহাসের আড়ালেই রয়ে যায় বা রেখে দেওয়া হয়। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস নাগাদ জম্মুতে যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, সে সব নিয়ে জানতে গেলে এবং নিহত মুসলমানদের পরিসংখ্যান জানতে হ’লে তৎকালীন ব্রিটিশ সাংবাদিক ও ব্রিটিশ পত্রিকাগুলির দ্বারস্থ হ’তে হয়।[4]

১৯৪৭ সালের ১৬ই জানুয়ারি হোরাস আলেক্সান্ডার ব্রিটিশ পত্রিকা 'The Spectator'-এ উল্লেখ করেন, ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে জম্মুতে নিহত মুসলিমের সংখ্যা ২ লক্ষেরও বেশী। ১৯৪৮ সালের ১০ই আগস্ট বৃটিশ দৈনিক পত্রিকা 'The London Times'-এ প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়, ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে জম্মুতে কমপক্ষে ২ লক্ষ ৩৭ হাজার মুসলিমকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়।[5]

‘The Statesman’ পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক ইয়ান স্টেফেনস তাঁর 'Horned Moon' বইতেও জম্মুতে ২ লক্ষের বেশী মুসলিম নিধনের পরিসংখ্যান উল্লেখ করেছেন।

ব্রিটিশ সাংবাদিকদের লেখালেখিতে উল্লেখিত পরিসংখ্যান থেকে একথা পরিষ্কার যে, জম্মুতে অন্ততপক্ষে ২ লক্ষ থেকে ২ লক্ষ ৫০ হাযারের কাছাকাছি মুসলিমকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ব্রিটিশ সাংবাদিক ছাড়াও প্রত্যক্ষদর্শী জম্মুর সাংবাদিক বেদ ভাসিন এবং অল্প কিছু সাংবাদিক জম্মু গণহত্যা নিয়ে সোচ্চার হন, লেখালেখি করেন। অবশ্য এজন্য বেদ ভাসিনকে গ্রেপ্তারের হুমকিও দেওয়া হয়। এখন প্রশ্ন হল, এই হত্যাকান্ডের পিছনে কারা ছিলেন? স্বাধীনতা অর্জনের পরপরেই অন্যান্য অধিকাংশ প্রিন্সলি স্টেটের মতো কাশ্মীর ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দেয়নি বলে অনেকেই কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং-কে স্বাধীনচেতা মহান হিসাবে আখ্যায়িত করেন। অথচ মহারাজা হরি সিং ছিলেন আদ্যোপান্ত একজন ক্ষমতালোভী স্বৈরাচারী এবং জম্মু গণহত্যার অন্যতম প্রধান নায়ক। ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতেই তিনি ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দেননি। ক্ষমতা সুনিশ্চিত করতে তিনি তার ডোগরা সেনাদের দিয়ে নির্বিচারে মুসলিম গণহত্যা চালিয়েছিলেন। জম্মুতে সংঘটিত মুসলিম গণহত্যার জন্য মহারাজা হরি সিং-কে দায়ী করে ১৯৪৭ সালের ২৫শে ডিসেম্বর মহাত্না গান্ধী বলেন, ‘জম্মু এবং জম্মুর বাইরে থেকে আসা হিন্দু ও শিখরা নির্বিচারে জম্মুর মুসলিমদের হত্যা করেছে। মুসলিম নারীদের অসম্মান করেছে। এজন্য দায়ী মূলত মহারাজা হরি সিং’। মহারাজা হরি সিং আশঙ্কা করেছিলেন, কাশ্মীর মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ায় ভবিষ্যতে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হ’তে পারেন। সেজন্য তিনি যেনতেন প্রকারে অন্ততপক্ষে জম্মুকে কুক্ষিগত রাখতেই এই নির্মম গণহত্যা চালিয়েছিলেন এবং জাতিগত নির্মূলকরণে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। Being the Other: The Muslim in India বইতে লেখক সাইয়েদ নাকভি ১৯৪৯ সালের ১৭ই এপ্রিল বল্লভ ভাই প্যাটেলকে লেখা জহরলাল নেহেরুর চিঠির সূত্র উল্লেখ করে বলেন, হরি সিং সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে জম্মুকে নিজেদের অধীনে রাখতে চেয়েছিলেন, নেহেরু ও বল্লভ ভাই প্যাটেলকে সেকথা তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন।[6]

অন্য প্রদেশের মানুষ কাশ্মীরে জমির দখল নিতে পারবেন না, এই আইন ১৯২৬ সালে মহারাজা হরি সিং নিজেই তৈরি করেছিলেন। কিন্তু কাশ্মীর স্বাধীন হওয়ার পরে তারই উদ্যোগে পরিকল্পিতভাবে পাঞ্জাব এবং সীমান্তবর্তী প্রদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু ও শিখরা জম্মুতে এসে বসবাস শুরু করে। সেই সঙ্গে মহারাজা হরি সিং জম্মুর মুসলমান-প্রজাদের উপর নানাবিধ কর আরোপ করেন। করের এহেন বোঝা চাপানো ও অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে স্থানীয় মুসলমানরা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। অন্যদিকে একই সময়ে ডোগরা সেনা অফিসার পদ থেকে মুসলিমদের অপসারণ করা হয় এবং মুসলিম সেনাদের অস্ত্র সমর্পণ করতে বলা হয়। এরপর হরি সিং-এর ডোগরা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করে। ওই সময় জম্মুর উধমপুর, ছেনানি, রামনগর, রিয়াসি, বাদেরওয়া, ছাম্ব, দেবা বাটালা, আখনুর, কাটুয়াসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় আবালবৃদ্ধবনিতা বহু মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আনুমানিক ২৭০০০ মুসলিম মহিলাকে অপহরণ ও ধর্ষণ করা হয়। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে জম্মুর ১১৩টি গ্রামকে জনমানবহীন করে দেওয়া হয়। যারা বাড়িঘর ছেড়ে পাকিস্তান দখলকৃত সীমান্তের দিকে রওয়া হয়েছিলেন, তাদেরও অনেককেই ধরে ধরে হত্যা করা হয়। গণহত্যা চলাকালীন কার্ফু জারি করা হয়েছিল, তবে সেগুলি ছিল মূলত মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলির জন্য, মুসলিমদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে। অন্যদিকে হত্যাকারীরা বাধাহীনভাবে খোলা অস্ত্র হাতে নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে এবং হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে গেছে।[7]

প্রখ্যাত সাংবাদিক বেদ ভাসিন-এর মতে, জম্মুর মুসলিম নিধনে ডোগরা সেনাদের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আর এস এস) কর্মীরা প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। এমনকি এই হত্যাকান্ড চালানোর জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সঙ্গেও আর এস এস, হিন্দু মহাসভার মতো হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি যুক্ত ছিল। এছাড়া তৎকালীন বহু কংগ্রেস নেতাও এই হত্যাকান্ডে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন, পরবর্তীকালে যাঁদের কেউ কেউ মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিলেন। জম্মুর বৃহৎ বীভৎস হত্যাকান্ডটি সংঘটিত হয়েছিল পাকিস্তানী পাঠানদের জম্মু কাশ্মীর আক্রমণের পাঁচদিন এবং ইন্সট্রুমেন্ট অফ অ্যাকসেশন সাক্ষরের ন'দিন আগে।[8]

সাংবাদিক বেদ ভাসিন-এর মতে, হরি সিং-এর ডোগরা সেনা, আর এস এস কর্মী, হিন্দু মহাসভার কর্মী, কংগ্রেস নেতা, পাঞ্জাব ও অন্যান্য প্রদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী হিন্দু এবং শিখদের যোগসাজশে জম্মুতে ব্যাপক মুসলিম নিধনযজ্ঞ চালানো হলেও প্রতিক্রিয়া হিসাবে কাশ্মীর প্রদেশের মুসলিমরা একজন কাশ্মীরী পন্ডিতকেও হেনস্থা করেনি, হত্যা দূরে থাক। সেই সময়ে কাশ্মীরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিল সম্পূর্ণ অটুট। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ক্ষমতালোভী মহারাজা হরি সিং-কে সঙ্গে নিয়ে হিন্দুত্ববাদী সঙ্ঘ পরিবার এবং হিন্দু মহাসভা ব্যাপক নিধনযজ্ঞ চালিয়ে, বিতাড়ন করে জম্মুর সংখ্যাগুরু মুসলিমদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করে জম্মুতে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। বর্তমানে সঙ্ঘ পরিবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে কাশ্মীর থেকে ৩৫(এ) এবং ৩৭০ তুলে দিয়ে তাদের পূর্বপরিকল্পিত, পূর্বরচিত বৃত্তই সম্পন্ন করলো কিনা সেকথা সময়ই বলবে।[9]

সর্বোপরি পূর্ব পরিকল্পিতভাবে অবরোধ জারি করে কাশ্মীরকে নিজেদের দখলে নিতে চায় ভারত। আর সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছে ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার। স্বাধীনচেতা কাশ্মীরীদের দমিয়ে যে কোনভাবে কাশ্মীরকে দখল করাই তাদের মূল লক্ষ্য। হে আল্লাহ! তুমি কাশ্মীরকে যালেমদের হাত থেকে রক্ষা কর- আমীন!

[লেখক : সম্পাদক. মাসিক হারাবতী ও প্রাক্তন সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, জয়পুরহাট যেলা]


[1]. সিকিম, কাশ্মীর এবং ইন্দিরা ও আব্দুল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের স্মৃতি -হাসান শাহরিয়ার প্রবীণ সাংবাদিক, কলাম লেখক ও বিশ্নেষক; সিজেএ ইন্টারন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট ইমেরিটাস ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের প্রাক্তন সভাপতি প্রতিবেশী প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০১৯

[2]. Article 370, কাশ্মীর আবার খবরে, কারণ অর্থনীতি আজ কবরে বিশিষ্ট কৃষি পরিকল্পনাবিদ কল্যাণ গোস্বামীর।

[3]. টিবিটি, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৮

[4]. The forgotten massacre that ignited the Kashmir dispute by Rifat Fareed, ALJAZEERA.

[5]. Being the Other: The Muslim in India, by Saeed Naqvi.

[6]. The forgotten Poonch uprising of 1947 by Christopher Snedden.

[7]. The killing field of Jammu- How muslims become a minority in the region, by Saeed Naqvi, Scroll.In.

[8]. The Kashmir Dispute, 1947-2012 by A.G Noorani.

[9]. Why Jammu Erupts by A.G Noorani, Frontline.



আরও