পবিত্রতা অর্জনের শিষ্টাচার
বযলুর রহমান
এ. এইচ. এম. রায়হানুল ইসলাম 9422 বার পঠিত
২০. অনাড়ম্বর জীবন-যাপন করা :
একজন প্রকৃত মুমিন কখনো পার্থিব জীবনের ভোগ-বিলাসকে প্রাধান্য দিয়ে স্বেচ্ছাচারী জীবন যাপন করতে পারে না। সে দুনিয়ার যাবতীয় চাকচিক্যকে তুচ্ছ জ্ঞান করে সর্বদা জান্নাতের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কামনা করে । মহান আল্লাহ পার্থিব জীবনের ভোগ-বিলাসকে নিষেধ করেছেন। কেননা দুনিয়ার এ জীবন তো ক্ষণস্থায়ী; কিন্তু পরকালের জীবন চিরস্থায়ী। যার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ فَلَا تَغُرَّنَّكُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَلَا يَغُرَّنَّكُمْ بِاللَّهِ الْغَرُورُ ‘হে মানুষ! নিশ্চয় আল্লাহর ওয়াদা সত্য। সুতরাং পার্থিব জীবন যেন তোমাদেরকে প্রতারিত না করে, আর শয়তান যেন তোমাদেরকে আল্লাহর বিষয়ে ধোঁকায় না ফেলে’ (ফাতির ৩৫/৫০)।
‘হে লোক সকল! ক্বিয়ামত একটি বিভীষিকাময় দিন। এটা অবশ্যই সংঘটিত হবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। সুতরাং সেখানকার (পরকালের) চিরস্থায়ী নে‘মতের পরিবর্তে এখানকার (দুনিয়ার) ক্ষণস্থায়ী ও ধ্বংসশীল আরাম-আয়েশ ও সুখ-সম্ভোগে জড়িয়ে পড়না। দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী সুখ-শান্তি যেন তোমাদেরকে পরকালের চিরস্থায়ী সুখ-শান্তি হ’তে বঞ্চিত না করে। শয়তানের নানামুখী চক্রান্ত হ’তে খুব সর্তক থাকবে। তাঁর প্রতারণার ফাঁদে কখনো পড়োনা। তাঁর মিথ্যা, চটকদার ও চমকপ্রদ কথায় কখনো আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর সত্য কালামকে পরিত্যাগ করোনা’।[1]
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন, وَمَا هَذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا لَهْوٌ وَلَعِبٌ وَإِنَّ الدَّارَ الْآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ ‘এই পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক বৈ কিছুই নয়। আর পরকালীন জীবন হ’ল চিরস্থায়ী জীবন (যেখানে কোন মৃত্যু নেই)। যদি তারা জানত! (অর্থাৎ সেটা বুঝলে মানুষ নশ্বর জীবনকে অবিনশ্বর জীবনের উপর প্রাধান্য দিত না)। (আনকাবূত ২৯/৬৪)। অত্র আয়াতে দুনিয়ার তুচ্ছতা, ঘৃন্যতা, নশ্বরতা এবং ধ্বংসশীলতার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে যে, এর কোন স্থায়ীত্ব নেই। এ দুনিয়া তো খেল-তামাশার জায়গা ছাড়া আর আর কিছুই নয়। পক্ষান্তরে আখেরাতের জীবন হচ্ছে। স্থায়ী ও অবিনশ্বর। এটা নষ্ট, হ্রাস ও তুচ্ছতা হ’তে মুক্ত। যদি তাদের প্রকৃত জ্ঞান থাকতো তবে কখনো এই স্থায়ী জিনিসের উপর অস্থায়ী জিনিসকে প্রাধান্য দিতোনা’।[2]
মহান আল্লাহ আরো বলেন,فَخَرَجَ عَلَى قَوْمِهِ فِي زِينَتِهِ قَالَ الَّذِينَ يُرِيدُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا يَا لَيْتَ لَنَا مِثْلَ مَا أُوتِيَ قَارُونُ إِنَّهُ لَذُو حَظٍّ عَظِيمٍ - وَقَالَ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ وَيْلَكُمْ ثَوَابُ اللَّهِ خَيْرٌ لِمَنْ آمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا وَلَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الصَّابِرُونَ ‘অতঃপর ক্বারূণ জাঁকজমক সহকারে তার সম্প্রদায়ের সামনে বের হ’ল। তখন যারা পার্থিব জীবন কামনা করত তারা বলল, হায় ক্বারূণ যা পেয়েছে আমাদেরকে যদি অনুরূপ দেওয়া হ’ত? সত্যিই মহা ভাগ্যবান। পক্ষান্তরে যাদেরকে জ্ঞান দেওয়া হয়েছিল তারা বলল, ধিক তোমাদের! যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তাদের জন্য আল্লাহর দেওয়া পুরস্কারই সর্বোত্তম বস্ত্ত। এটা কেবল তারাই পায়, যারা (আল্লাহর অনুগ্রহের উপর) দৃঢ়চিত্ত’ (ক্বাছাছ ২৮/৭৯-৮০)।
মহান আল্লাহ আরো বলেন, مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْعَاجِلَةَ عَجَّلْنَا لَهُ فِيهَا مَا نَشَاءُ لِمَنْ نُرِيدُ ثُمَّ جَعَلْنَا لَهُ جَهَنَّمَ يَصْلَاهَا مَذْمُومًا مَدْحُورًا ‘যে ব্যক্তি দুনিয়া কামনা করে, আমরা সেখানে যাকে যা ইচ্ছা করি দিয়ে দেই। পরে তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত করি। সেখানে সে প্রবেশ করবে নিন্দিত ও লাঞ্ছিত অবস্থায়’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/১৮)।
এবার আমরা দেখব যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এবং তাঁর ছাহাবীগণের জীবন ধারা কেমন ছিল। হাদীছে এসেছে,عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ مَا شَبِعَ آلُ مُحَمَّدٍ صلى الله عليه وسلم مُنْذُ قَدِمَ الْمَدِينَةَ مِنْ طَعَامِ بُرٍّ ثَلاَثَ لَيَالٍ تِبَاعًا حَتَّى قُبِضَ আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর পরিবার-পরিজন তাঁর ইন্তেকাল পর্যন্ত দু’দিন যবের রুটিও পরিতৃপ্ত হয়ে খেতে পাননি’।[3] হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رضى الله عنه أَنَّهُ مَرَّ بِقَوْمٍ بَيْنَ أَيْدِيهِمْ شَاةٌ مَصْلِيَّةٌ ، فَدَعَوْهُ فَأَبَى أَنْ يَأْكُلَ قَالَ خَرَجَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مِنَ الدُّنْيَا وَلَمْ يَشْبَعْ مِنَ الْخُبْزِ الشَّعِيرِ (আবু সাঈদ মকবুরী বলেন), একদা আবু হুরায়রা (রাঃ) একদল লোকের নিকট যাচ্ছিলেন, যাদের সামনে ভুনা বকরী ছিল। তারা তাকে খেতে ডাকলেন। তিনি খেতে রাযী হ’লেন না এবং বললেন, রাসূল (ছাঃ) পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন অথচ তিনি কোন দিন যবের রুটি পেট পুরে খাননি’।[4]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, عَنْ سِمَاكِ بْنِ حَرْبٍ قَالَ سَمِعْتُ النُّعْمَانَ يَخْطُبُ قَالَ ذَكَرَ عُمَرُ مَا أَصَابَ النَّاسُ مِنَ الدُّنْيَا فَقَالَ لَقَدْ رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَظَلُّ الْيَوْمَ يَلْتَوِى مَا يَجِدُ دَقَلاً يَمْلأُ بِهِ بَطْنَهُ. নু‘মান ইবনু বাশীর (রাঃ) বলেন, ওমর (রাঃ) ঐ সমস্ত লোকের আলোচনায় বলেন, যারা দুনিয়ার ধন-সম্পদ অধিক জমা করে ফেলেছে, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে দেখেছি, তিনি সারাদিন ক্ষুধায় থাকার ফলে পেটের উপর ঝুঁকে থাকতেন যেন ক্ষুধার জ্বালা কম অনুভব হয়)। তিনি পেট ভরার জন্য নিকৃষ্টমানের খুরমাও পেতেন না’।[5] হাদীছে এসেছে,عَنْ أَبِى بُرْدَةَ قَالَ أَخْرَجَتْ إِلَيْنَا عَائِشَةُ كِسَاءً وَإِزَارًا غَلِيظًا فَقَالَتْ قُبِضَ رُوحُ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فِى هَذَيْنِ আবু বুরদাহ (রাঃ) বলেন, আয়েশা (রাঃ) আমাদের জন্য একখানি চাদর ও মোটা লুঙ্গী বের করে আনলেন এবং বললেন, এ দু’টি (পরে থাকা অবস্থাতেই) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইন্তেকাল করেছেন’।[6]
হাদীছে এসেছে, عَنْ مُحَمَّدٍ قَالَ كُنَّا عِنْدَ أَبِى هُرَيْرَةَ وَعَلَيْهِ ثَوْبَانِ مُمَشَّقَانِ مِنْ كَتَّانٍ فَتَمَخَّطَ فَقَالَ بَخْ بَخْ أَبُو هُرَيْرَةَ يَتَمَخَّطُ فِى الْكَتَّانِ لَقَدْ رَأَيْتُنِى وَإِنِّى لأَخِرُّ فِيمَا بَيْنَ مِنْبَرِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِلَى حُجْرَةِ عَائِشَةَ مَغْشِيًّا عَلَىَّ فَيَجِىءُ الْجَائِى فَيَضَعُ رِجْلَهُ عَلَى عُنُقِى وَيُرَى أَنِّى مَجْنُونٌ وَمَا بِى مِنْ جُنُونٍ مَا بِى إِلاَّ الْجُوعُ মুহাম্মাদ ইবনু সীরিন আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমরা আবু হুরায়রা (রঃ)-এর নিকট ছিলাম। তিনি লাল রঙের দু’টি কাতান পরে ছিলেন। এরপর তিনি নাক পরিষ্কার করলেন এবং বললেন, বাহঃ! বাহঃ! আবু হুরায়রা আজ কাতান দিয়ে নাক পরিষ্কার করছে। আমার এরূপ অবস্থা্ ছিল যে, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মিম্বার এবং আয়েশা (রাঃ)-এর কক্ষের মধ্যস্থলে (ক্ষুধার জ্বালায় বেহুশ হয়ে পড়ে থাকতাম। অতঃপর আগন্তুক আসত এবং আমাকে পাগল মনে করে সে তার পা আমার গর্দানের উপর রাখত, অথচ আমার মধ্যে কোন পাগলামী ছিল না। কেবল মাত্র ক্ষুধার যন্ত্রণা ছিল (যার তীব্রতায় আমি বেহুশ হয়ে পড়তাম)’।[7] হাদীছে এসেছে, عَنْ عَائِشَةَ رضى الله عنها قَالَتْ تُوُفِّىَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم وَدِرْعُهُ مَرْهُونَةٌ عِنْدَ يَهُودِىٍّ بِثَلاَثِينَ {يَعْنِى صَاعًا مِنْ شَعِيرٍ} আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন ইন্তেকাল করেন, তখন তাঁর বর্মটি ত্রিশ ছা‘ যবের বিনিময়ে এক ইয়াহূদীর নিকট বন্ধক রাখা ছিল’।[8]
হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ رَأَيْتُ سَبْعِينَ مِنْ أَصْحَابِ الصُّفَّةِ ، مَا مِنْهُمْ رَجُلٌ عَلَيْهِ رِدَاءٌ ، إِمَّا إِزَارٌ وَإِمَّا كِسَاءٌ ، قَدْ رَبَطُوا فِى أَعْنَاقِهِمْ ، فَمِنْهَا مَا يَبْلُغُ نِصْفَ السَّاقَيْنِ ، وَمِنْهَا مَا يَبْلُغُ الْكَعْبَيْنِ ، فَيَجْمَعُهُ بِيَدِهِ ، كَرَاهِيَةَ أَنْ تُرَى عَوْرَتُهُ আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি সত্তর জন আহলে ছুফ্ফাহকে এই অবস্থায় দেখেছি যে, তাদের কারো কাছে (গা ঢাকার জন্য) চাদর ছিল না। কারো কাছে লু্ঙ্গী ছিল না কারো চাদর ছিল না। (এক সঙ্গে দু’টি বস্ত্তই কারো কাছে ছিল না। তারা তা গর্দানে বেঁধে নিতেন। অতঃপর সেই বস্ত্র কারো পায়ের অর্ধগোছা পর্যন্ত হ’ত এবং কারো টাখনু পর্যন্ত হ’ত। সুতরাং তারা তা হাত দিয়ে জমা করে ধরে রাখত, যেন লজ্জাস্থান দেখা না যায়’।[9] হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَنَسٍ رضى الله عنه قَالَ وَلَقَدْ رَهَنَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم دِرْعَهُ بِشَعِيرٍ وَمَشَيْتُ إِلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم بِخُبْزِ شَعِيرٍ وَإِهَالَةٍ سَنِخَةٍ وَلَقَدْ سَمِعْتُهُ يَقُولُ مَا أَصْبَحَ لآلِ مُحَمَّدٍ صلى الله عليه وسلم إِلاَّ صَاعٌ وَلاَ أَمْسَى وَإِنَّهُمْ لَتِسْعَةُ أَبْيَاتٍ আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘নবী করীম (ছাঃ) যবের বিনিময়ে তাঁর বর্ম বন্ধক রেখে ছিলেন। আর আমি তাঁর নিকট যবের রুটি ও দুর্গন্ধময় (নষ্ট হওয়া) পুরানো চর্বি নিয়ে গিয়েছি। আমি তাঁকে বলতে শুনেছি যে, মুহাম্মাদের পরিবারের কাছে সকাল বা সন্ধ্যায় এক ছা‘ পরিমান খাদ্য দ্রব্য থাকেনা। আনাস (রাঃ) বলেন, তখন তাঁরা মোট নয় ঘর (পরিবার) ছিলেন’।[10] হাদীছে এসেছে,
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَبِيتُ اللَّيَالِىَ الْمُتَتَابِعَةَ طَاوِيًا وَأَهْلُهُ لاَ يَجِدُونَ عَشَاءً وَكَانَ أَكْثَرُ خُبْزِهِمْ خُبْزَ الشَّعِيرِ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একাধারে কয়েক রাত অনাহারে কাটাতেন এবং পরিবার-পরিজনেরা রাতের খাবার পেতেন না। আর তাদের অধিকাংশ রুটি হ’ত যবের’।[11]
হাদীছে এসেছে,عَنْ عُبَيْدِ اللَّهِ بْنِ مِحْصَنٍ الْخَطْمِىِّ عَنْ أَبِيهِ وَكَانَتْ لَهُ صُحْبَةٌ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ أَصْبَحَ مِنْكُمْ آمِنًا فِى سِرْبِهِ مُعَافًى فِى جَسَدِهِ عِنْدَهُ قُوتُ يَوْمِهِ فَكَأَنَّمَا حِيزَتْ لَهُ الدُّنْيَا ওবায়দুল্লাহ ইবনু মিহসান আনছারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি তার ঘরে অথবা গোষ্ঠীর মধ্যে নিরাপদে ও সুস্থ শরীরে সকাল করেছে এবং তার কাছে এক দিনের খাবার আছে, তাকে যেন পার্থিব সমস্ত সম্পদ দান করা হয়েছে’।[12]
হাদীছে এসেছে,عَنْ فَضَالَةَ بْنِ عُبَيْدٍ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ إِذَا صَلَّى بِالنَّاسِ يَخِرُّ رِجَالٌ مِنْ قَامَتِهِمْ فِى الصَّلاَةِ مِنَ الْخَصَاصَةِ وَهُمْ أَصْحَابُ الصُّفَّةِ حَتَّى تَقُولَ الأَعْرَابُ هَؤُلاَءِ مَجَانِينُ أَوْ مَجَانُونَ فَإِذَا صَلَّى رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم انْصَرَفَ إِلَيْهِمْ فَقَالَ لَوْ تَعْلَمُونَ مَا لَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ لأَحْبَبْتُمْ أَنْ تَزْدَادُوا فَاقَةً وَحَاجَةً ফাযালা ইবনু ওবাইদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ‘যখন লোকদের ছালাত পড়াতেন, তখন কিছু লোক ক্ষুধার কারণে পড়ে যেতেন, আর তারা ছিলেন আহলে ছুফফাহ সদস্য। এমন কি মরূবাসী বেদুঈনরা বলত যে, এরা পাগল। একদা যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছালাত সেরে তাদের দিকে মুখ ফিরালেন, তখন বললেন, তোমাদের জন্য আল্লাহর কাছে যা রয়েছে, তা যদি তোমরা জানতে তাহ’লে তোমরা এর চাইতেও বেশী অভাব ও দরিদ্র পসন্দ করতে’।[13]
২১. হারামের ব্যপারে সতর্ক থাকা ও সন্দেহজনক বস্ত্তু পরিহার করা :
ইবাদত কবুলের জন্য অন্যতম শর্ত হ’ল হালাল রূযী। হারাম বা অবৈধ উপার্জন করে যতই ইবাদত করা হোক না কেন তা আল্লাহর নিকট কবুল হবে না। মহান আল্লাহ মানুষ সৃষ্টির পঞ্চাশ হাযার বছর পূর্বে তাদের রূযী নির্ধারণ করে রেখেছেন। অথচ আমরা যেন তা ভুলে গেছি যে, আল্লাহ তা‘আলা রূযীর একমাত্র মালিক। মহান আল্লাহ আমাদের যতটুকু দিয়েছেন তা নিয়েই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে। পানির নীচের মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর খাবার যদি মহান আল্লাহ দিতে পারেন, গর্তের মধ্যের কীট-পতঙ্গকে যদি রূযীর চিন্তা করতে না হয়। সকাল বেলা পাখি তাঁর বাসা থেকে খালি পেটে বেরিয়ে গিয়ে যদি পেট ভর্তি করে বাচ্চাদের জন্য খাবর আনতে পারে, তাহ’লে সৃষ্টির সেরা মানব জাতিকে আল্লাহ দিবেন না এটা কোন কথা হলো? আসলে আমাদের সৃষ্টিকর্তার প্রতি সেই বিশ্বাসটাই নেই! এ জন্যই মহান আল্লাহ বলেছেন, وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ إِنَّ اللَّهَ بَالِغُ أَمْرِهِ قَدْ جَعَلَ اللَّهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْرًا ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য উপায় বের করে দেন। আর তাকে তার ধারণাতীত উৎস থেকে রিযিক দান করবেন। বস্ত্ততঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, তিনিই তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার আদেশ পূর্ণ করবেন। আল্লাহ সবকিছুর জন্য একটা পরিমাণ নির্দিষ্ট করে রেখেছেন’ (তালাক ৬৫/২-৩)।
অর্থাৎ যে ব্যক্তি শরী‘আতের আহকাম পালন করবে আল্লাহ হারামকৃত জিনিস হ’তে দূরে থাকবে, তিনি তাঁর মুক্তির পথ বের করে দিবেন। আর তিনি তাঁকে তাঁর কল্পানাতীত উৎস হ’তে রিযিক্ব প্রদান করবেন। এরপরও আমরা মহান আল্লাহর উপর ভরসা করব না! শুধু কি হারাম হ’তে বেঁচে থাকলেই হবে? যদি এমন কোন জিনিস থাকে যা হালাল নাকি হারাম সন্দেহ রয়েছে তাহ’লে তাও পরিহার করে চলতে হবে। অর্থাৎ কোন বস্ত্ত মনের মধ্যে সন্দেহ বা খটকা সৃষ্টি করলেই তা পরিহার করতে হবে। যতক্ষণ না তাঁর ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে জানা যায়। দেখুন মহান আল্লাহ এ ব্যাপারে কি বলেন তোমরা একে তুচ্ছ গণ্য করেছিলে; অথচ তা আল্লাহর দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। (নূর/১৫) উপরোক্ত আয়াতের মাধ্যমে জানা গেল যে, কোন পাপকে তুচ্ছ করে দেখা যাবেনা। তাই হারামে লিপ্ত হওয়া দূরের কথা, বরং কোন বিষয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হ’লে তা থেকে বিরত থাকতে হবে।
যেমন এ বিষয়ে হাদীছে নববীতে এসেছে, عَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ يَقُولُ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ الْحَلاَلُ بَيِّنٌ وَالْحَرَامُ بَيِّنٌ وَبَيْنَهُمَا مُشَبَّهَاتٌ لاَ يَعْلَمُهَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ فَمَنِ اتَّقَى الْمُشَبَّهَاتِ اسْتَبْرَأَ لِدِيِنِهِ وَعِرْضِهِ وَمَنْ وَقَعَ فِى الشُّبُهَاتِ كَرَاعٍ يَرْعَى حَوْلَ الْحِمَى يُوشِكُ أَنْ يُوَاقِعَهُ أَلاَ وَإِنَّ لِكُلِّ مَلِكٍ حِمًى أَلاَ إِنَّ حِمَى اللَّهِ فِى أَرْضِهِ مَحَارِمُهُ أَلاَ وَإِنَّ فِى الْجَسَدِ مُضْغَةً إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّهُ ، وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهُ أَلاَ وَهِىَ الْقَلْبُ নু‘মান ইবনে বাশীর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি নিশ্চয় হালাল স্পষ্ট এবং হারাম স্পষ্ট। আর উভয়ের মাঝে বহু সন্দেহজনক বিষয় রয়েছে, যা অধিকাংশ লোকই জানেনা। অতএব যে ব্যক্তি এই সন্দেহজনক বস্ত্ত হ’তে দূরে থাকবে, সে তাঁর দ্বীন ও ইয্যতকে বাঁচিয়ে নিবে। আর যে ব্যক্তি সন্দেহে পতিত হবে, সে হারামে পতিত হবে। এর উদাহরণ সেই রাখালের মত, যে নিষিন্ধ চারণ ভূমির আশে পাশে পশু চরায় তাঁর পক্ষে নিষিদ্ধ সীমানায় পড়ে যাওয়ার সম্ভবনা আছে। শোন! প্রত্যক বাদশাহরই সংরক্ষিত চারণ ভূমি থাকে। আর শোন! আল্লাহর সংরক্ষিত চারণ ভূমি হ’ল তাঁর হারামকৃত বস্ত্ত সমূহ। শোন! দেহের মধ্যে একটি মাংস পিন্ড রয়েছে, যখন তা সুস্থ থাকে, তখন গোটা দেহটা সুস্থ থাকে। আর যখন তা খারাপ হয়ে যায়, তখন গোটা দেহটাই খারাপ হয়ে যায়। শোন! তা হ’ল হৃদপিন্ড’।[14]
আনাস (রাঃ) বর্ণিত একদা নবী কারীম (ছাঃ) একটি খেজুর কুড়িয়ে পেলেন। অতঃপর তিনি বললেন, যদি আমার একটি ছাদাক্বা হওয়ার আশংকা না হ’ত, তাহ’লে আমি এটি খেয়ে ফেলতাম’।[15] عَنِ النَّوَّاسِ بْنِ سَمْعَانَ الأَنْصَارِىِّ قَالَ سَأَلْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَنِ الْبِرِّ وَالإِثْمِ فَقَالَ الْبِرُّ حُسْنُ الْخُلُقِ وَالإِثْمُ مَا حَاكَ فِى صَدْرِكَ وَكَرِهْتَ أَنْ يَطَّلِعَ عَلَيْهِ النَّاسُ নাওয়াস ইবনু সাম‘আন (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে একজন লোক গুনাহের কাজ ও ছাওয়াবের কাজ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে উত্তরে রাসূল (ছাঃ) বললেন, সৎকাজ
কাজ হ’ল সদাচার এবং গুনাহের কাজ হ’ল যা তোমার অন্তরে সংশয় সৃষ্টি করে, আর সেটা মানুষ জানতে পারুক তা তুমি অপসন্দ কর’।[16]
হাদীছে এসেছে, عَنْ وَابِصَةَ بْنِ مَعْبَدٍ الأَسَدِىِّ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ لِوَابِصَةَ جِئْتَ تَسْأَلُ عَنِ الْبِرِّ وَالإِثْمِ؟ قَالَ قُلْتُ نَعَمْ قَالَ فَجَمَعَ أَصَابِعَهُ فَضَرَبَ بِهَا صَدْرَهُ وَقَالَ اسْتَفْتِ نَفْسَكَ اسْتَفْتِ قَلْبَكَ يَا وَابِصَةُ ثَلاَثاً الْبِرُّ مَا اطْمَأَنَّتْ إِلَيْهِ النَّفْسُ وَاطْمَأَنَّ إِلَيْهِ الْقَلْبُ وَالإِثْمُ مَا حَاكَ فِى النَّفْسِ وَتَرَدَّدَ فِى الصَّدْرِ وَإِنْ أَفْتَاكَ النَّاسُ وَأَفْتَوْكَ ওবেছা ইবনু মা‘বাদ আসাদী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট আসলাম। অতঃপর তিনি বললেন, তুমি পুণ্যের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে এসেছে? আমি বললাম জী, হ্যাঁ। তিনি বলেলন, তুমি তোমার অন্তরকে জিজ্ঞেস কর। পুণ্যে হ’ল তা, যার প্রতি তোমার মন প্রশান্ত হয় এবং অন্তর পরিতৃপ্ত হয়। আর পাপ হ’ল তা, যা মনে খটকা সৃষ্টি করে এবং অন্তর সন্দিহান হয়। যদিও লোকেরা তোমাকে তা বৈধ হওয়ার ব্যাপারে ফতোয়া দিয়ে থাকে’।[17]
(ক্রমশ)
[লেখক : সভাপতি, দিনাজপুর (পূর্ব) সাংগঠনিক যেলা]
[1]. ইবনু কাছীর ১৬/৭২ পৃ.।
[2]. ইবনু কাছীর ১৫/৬০৭ পৃ.।
[3]. বুখারী হা/৫৪১৬; মুসলিম হা/২৯৭০; তিরমিযী হা/২৩৫৭; নাসাঈ হা/৪৪৩।
[4]. বুখারী হা/৫৪১৪।
[5]. আহমাদ হা/৩৫৩; মুসলিম/২৯৭৮।
[6]. আহমাদ/২৩৫১৭; বুখারী হা/৫৮১৮; মুসলিম হা/২০৮০; তিরমিযী হা/১৭৩৩।
[7]. বুখারী হা/৭৩২৪; তিরমিযী হা/২৩৬৭।
[8]. বুখারী হা/৪৪৬৭; মুসলিম হা/১৬০৩; নাসাঈ হা/৪৬০৯।
[9]. বুখারী হা/৪৪২।
[10]. আহমাদ হা/১১৫৮২; বুখারী হা/২০৬৯; তিরমিযী হা/১২১৫; নাসাঈ হা/৪৫১০।
[11]. আহমাদ হা/২৩০৩; তিরমিযী হা/২৩৬০।
[12]. তিরমিযী হা/২৩৪৬।
[13]. আহমাদ হা/২৩৪২০; তিরমিযী হা/২৩৬৮।
[14]. আহমাদ হা/১৭৮৮৩; বুখারী হা/৫২; মুসলিম হা/১৫৯৯; তিরমিযী হা/১২০৫; নাসাঈ হা/৪৪৫৩; আবুদাঊদ হা/৩৩২৯; দারেমী হা/২৫৩৩।
[15]. আহমাদ হা/২৭৪৫১; বুখারী হা/২০৫৫; মুসলিম হা/১০৭১।
[16]. আহমাদ হা/১৭১৭৯; মুসলিম হা/২৫৫৩; তিরমিযী হা/২৩৮৯।
[17]. আহমাদ হা/১৭৫৩৮।