জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ-এর মুখপত্র মাসিক ‘আত-তাহরীক’-এর ফৎওয়া সমূহ
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 9292 বার পঠিত
(১)
আগস্ট ২০০০ প্রশ্ন (২৪/৩২৪) : বর্তমানে বাংলাদেশে একটি দলের নাম শুনা
যাচ্ছে। যাদের দাবী সশস্ত্র যুদ্ধ ছাড়া ইসলাম কায়েম হবে না এবং এজন্য তারা
গোপনে বিভিন্ন স্থানে ট্রেনিং দিচ্ছে বলে শুনা যাচ্ছে। আমরা আহলেহাদীছ
আন্দোলন করি। আমরা কি ঐ দলে যোগ দিতে পারি?
-ইউনুস আলী, সাং ও পোঃ ফিংড়ী, সাতক্ষীরা।
উত্তর : সশস্ত্র যুদ্ধ ছাড়া ইসলাম কায়েম হবে না কথাটি ঠিক নয়। কারণ ইসলাম কায়েমের মূল মাধ্যম হচ্ছে ‘দাওয়াত’। যার দায়িত্ব সকল নবী পালন করেছেন। আমাদের নবী (ছাঃ) তাঁর জীবনের প্রথম ১৩ বৎসর মক্কায় স্রেফ দাওয়াত দিয়েছেন। অতঃপর মাদানী জীবনে তিনি সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি পান। যা কেবল অমুসলিমদের বিরুদ্ধে ছিল। যা ছিল প্রতিরক্ষামূলক কিংবা শান্তিচুক্তি ভঙ্গ অথবা ইসলামী দাওয়াত প্রত্যাখান করার কারণে। কোন পাপী মুসলমান বা মুনাফিকের বিরুদ্ধে তাঁর কোন যুদ্ধ ছিল না। বরং মৌখিক কালেমার দাবীদারকে তিনি মুসলিম বলেই গণ্য করতেন।... অতএব ‘বাংলাদেশে মৌখিক ও আন্তরিকভাবে কালেমা পাঠকারী জনগণ ও নেতাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করা ইসলামের দৃষ্টিতে জায়েয হবে না। ... কোনরূপ জঙ্গী দলের সাথে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর কোন স্তরের নেতা-কর্মীর যোগদান করা বৈধ হবে না’।
(২) ফেব্রুয়ারী ২০১৩ প্রশ্ন (৪০/২০০) : স¤প্রতি ‘যুগে যুগে শয়তান-এর হামলা’ নামে সশস্ত্র জিহাদে উদ্বুদ্ধ করে বাজারে বই ছাড়া হয়েছে। সেখানে আপনাদের প্রকাশিত কিছু বই যেখানে মুসলিম সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদের বিপক্ষে বক্তব্য রয়েছে, তার তীব্র সমালোচনা করে আপনাদেরকে এ যুগের শয়তান, ইহূদীদের এজেন্ট ইত্যাদি বলা হয়েছে। অমনিভাবে ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে জনৈক তরুণ মুফতীর (জসীমুদ্দীন রহমানী) গরম গরম বক্তৃতায় ও লেখনীতে উৎসাহিত হয়ে অনেক আহলেহাদীছ তরুণ ঐ দলে ভিড়ে যাচ্ছে। তারা বলছে আপনারা ছহীহ হাদীছ মানেন ঠিক আছে, কিন্তু ইসলাম বিরোধী সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদ করেন না। অনেকে বলছে, আপনাদের আক্বীদা ভাল, কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের জন্য আপনাদের কোন পদক্ষেপ নেই। এ বিষয়ে আপনাদের জবাব কি?
-নাজমুল হাসান, লালবাগ, ঢাকা।
উত্তর : ভুয়া নাম-ঠিকানা সম্বলিত সুদৃশ্য মলাটে মোড়ানো ২২৪ পৃষ্ঠার উক্ত বইটি স¤প্রতি আমাদের কাছে এসেছে। পুরো বইটিতে যে প্রচার হিংসা ও বিদ্বেষের বিষ ছড়ানো হয়েছে, তাতে পরিচয়হীন এই লেখকের অসৎ উদ্দেশ্য পরিষ্কার। যদিও তার লেখনীর মধ্যেই তার দাবীর বিরুদ্ধে জওয়াব বিদ্যমান। যেমন তিনি সূরা তওবা ৫ আয়াত দ্বারা প্রমাণ পেশ করেছেন যে, ভূপৃষ্ঠের যেখানে মুশরিকদের পাও, তাদেরকে বধ কর, পাকড়াও কর’ হারাম শরীফ ব্যতীত’ (পৃঃ ৯২)। অতঃপর তিনি হাদীছ পেশ করে বলেছেন, রাসূল (ছাঃ) বলেন, আমি আদিষ্ট হয়েছি গোটা মানব সমাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য, যতক্ষণ না তারা এই সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই...’। তিনি যেহেতু শেষনবী, অতএব এই নির্দেশ কিয়ামত পর্যন্ত চলবে’। এরপর তিনি উপসংহার টেনে বলেছেন, আমরা উপরের কয়েকটি আয়াতের মাধ্যমে প্রমাণ করেছি যে, আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে প্রথমে মক্কায় ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার নির্দেশ দেন। অতঃপর মদীনায় হিজরতের পর জিহাদ ও ক্বিতাল ফরয করে দেন। এই ফরয আদায়ের জন্য তিনি ও সাহাবাগণ আমরণ জিহাদে লিপ্ত ছিলেন। এই জিহাদের মাধ্যমেই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয় (পৃঃ ৯৪)। অর্থাৎ লেখকের দাবী মতে, এখন দেশের যেখানেই মুশরিক পাবে, সেখানেই তাকে হত্যা করবে এবং এখুনি সেটা করতে হবে। আমরা যেহেতু সেটা করছি না, সেহেতু আমরা ‘শয়তান’ এবং ‘ইহূদীদের এজেন্ট’। বস্তুতঃ সংস্কারমুখী আন্দোলনের কারণে ১৯৭৮ সাল থেকেই আমাদের নেতৃবৃন্দ ঘরে-বাইরে এরূপ গালি খেয়ে আসছেন। যেহেতু আমরা এগুলি নই, তাই হাদীছ অনুযায়ী এগুলি অপবাদ দানকারীদের উপরেই বর্তাবে (মুসলিম হা/৬০)। শায়খ আব্দুল কাদের জীলানী (রহঃ)-এর ভাষায় ‘এসবই আহলেহাদীছ-এর বিরুদ্ধে বিদ‘আতীদের ক্রোধাগ্নি ও হঠকারিতার বহিঃপ্রকাশ ব্যতীত কিছুই নয়’ (কিতাবুল গুনিয়াহ ১/৯০)।
উল্লেখ্য যে, উক্ত হাদীছে ‘উক্বাতিলা’ (পরস্পরে যুদ্ধ করা) বলা হয়েছে, ‘আক্বতুলা’ (হত্যা করা) বলা হয়নি। ‘যুদ্ধ’ দু’পক্ষে হয়। কিন্তু ‘হত্যা’ এক পক্ষ থেকে হয়। যেটা বোমাবাজির মাধ্যমে ক্বিতালপন্থীরা করতে চাচ্ছে। অত্র হাদীছে বুঝানো হয়েছে যে, কাফির-মুশরিকরা যুদ্ধ করতে এলে তোমরাও যুদ্ধ করবে। কিংবা তাদের মধ্যকার যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ করবে। কিন্তু নিরস্ত্র, নিরপরাধ বা দুর্বলদের বিরুদ্ধে নয়। কাফির পেলেই তাকে হত্যা করবে সেটাও নয়। তাছাড়া উক্ত হাদীছে ‘যারা কালেমার স্বীকৃতি দেবে, তাদের জান-মাল নিরাপদ থাকবে ইসলামের হক ব্যতীত এবং তাদের বিচারের ভার আল্লাহর উপর রইল’ বলা হয়েছে। এতে স্পষ্ট যে, আমাদের দায়িত্ব মানুষের বাহ্যিক আমল দেখা। কারু অন্তর ফেড়ে দেখার দায়িত্ব আমাদের নয়। অতএব সরকার যদি বাহ্যিকভাবে মুসলিম হয় এবং ইসলামী দাওয়াতের বিরুদ্ধে অবস্থান না নেয়, তাহ’লে তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদের সুযোগ কোথায়?
...মূলতঃ জিহাদের নামে এই সকল অতি উৎসাহী মুফতীরা যেসব অর্থহীন হম্বি-তম্বি করে থাকেন, তার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। এই শ্রেণীর বায়বীয় আবেগপ্রবণ ব্যক্তিদের কাজে লাগিয়ে মুসলিম দেশগুলিতে জঙ্গীবাদ সৃষ্টি করছে আন্তর্জাতিক ইসলাম বিরোধী চক্র ও তাদের দোসররা। উল্লেখ্য যে, ২০০৫ সালের ফেব্রেুয়ারীতে ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতারের পূর্বে আমাদের প্রকাশিত ‘দাওয়াত ও জিহাদ’ বইয়ের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে ভুয়া নাম-ঠিকানাধারী জনৈক লেখক সশস্ত্র জিহাদ ও ক্বিতালের পক্ষে জোরালো বক্তব্য দিয়ে বই লিখে আমাদের মারকাযে পাঠিয়েছিলেন। বর্তমান তৎপরতা তারই ধারাবাহিকতা হওয়াটা বিচিত্র নয়।
জেনে রাখা উচিৎ যে, মানুষ হত্যা করা ইসলামের মিশন নয়। কোন নবী মানবহত্যার দায়িত্ব নিয়ে পৃথিবীতে আবির্ভূত হননি। আল্লাহ প্রেরিত ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায়ের প্রতিরোধের মাধ্যমে মানবজাতিকে দুনিয়াবী কল্যাণের পথ দেখানো ও পারলৌকিক মুক্তির পথ প্রদর্শনই ছিল তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য। আর সে লক্ষ্য বাস্তবায়নেই তারা অত্যাচারী কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন মূলতঃ আত্মরক্ষার জন্য এবং অন্যায়কে প্রতিরোধের জন্য। মুশরিকদের হত্যা করাই যদি আল্লাহর নির্দেশ হ’ত, তাহ’লে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কেন মদীনায় গিয়ে ইহূদীদের সঙ্গে সন্ধিচুক্তি করলেন? কেন ইহূদী বালককে তাঁর বাড়ীতে গোলাম হিসাবে রাখলেন? এমনকি মৃত্যুকালেও খাদ্যের বিনিময়ে জনৈক ইহূদীর কাছে তাঁর বর্মটি বন্ধক ছিল। বস্তুতঃ ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধকারী ব্যতীত অন্য কারু প্রতি অস্ত্র ধারণ করা ইসলামে নিষিদ্ধ। এ ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের জীবনাদর্শই বাস্বব প্রমাণ হিসাবে যথেষ্ট। অতএব জিহাদের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তাবলী পূরণ না করেই যারা চটকদার কথা বলে জিহাদের নামে জঙ্গীবাদকে উসকে দিচ্ছে, তারা ইসলামের বন্ধু তো নয়ই, বরং ইসলামের শত্রু এবং খারেজী চরমপন্থীদের দলভুক্ত। যাদের ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) বহু পূর্বেই মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক করে গিয়েছেন (বুখারী হা/৩৬১০; মুসলিম হা/১০৬৩; মিশকাত হা/৫৮৯৪; মিশকাত (বঙ্গানুবাদ) হা/৫৬৪২)।
২য় প্রশ্নের জবাব এই যে, রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশ মোতাবেকই আমরা কোন মুসলিম সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ সমর্থন করি না (মুসলিম হা/১৮৫৪; মিশকাত হা/৩৬৭১; মিশকাত (বঙ্গানুবাদ) ৭/২৩৩ পৃঃ, বিস্তারিত দ্রঃ ‘ইক্বামতে দ্বীন : পথ ও পদ্ধতি’ বই)। ৩য় প্রশ্নের জবাব এই যে, নবীদের হেদায়াত অনুযায়ী মানুষের আক্বীদা ও আমল সংশোধনের মাধ্যমে সমাজের সার্বিক সংস্কার সাধনই আহলেহাদীছ আন্দোলনের সামাজিক ও রাজনৈতিক লক্ষ্য। সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বনি¤œ পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সর্বত্র ইসলামী আইন ও বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য এ আন্দোলন সংঘবদ্ধভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আল্লাহর ইচ্ছা হ’লে এর মাধ্যমেই একদিন ‘খেলাফাত আলা মিনহাজিন নবুওয়াত’ প্রতিষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ।
বড় কথা হ’ল অমুসলিম বা কপট মুসলিম সবাইকে যদি হত্যাই করে ফেলা হয়, তাহ’লে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হবে কোথায়? আমাদের রাসূল (ছাঃ) এসেছিলেন জগদ্বাসীর জন্য রহমত হিসাবে (আম্বিয়া ১০৭)। তিনি মানুষ হত্যার মাধ্যমে দ্বীন কায়েম করেননি; বরং কুরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমে মানুষের আক্বীদা ও আমল সংশোধন ও পরিশুদ্ধ করেছেন (জুম‘আ ২)। আর তাদের হাতে গড়া সেই সোনার মানুষগুলোর মাধ্যমেই ইসলামের চূড়ান্ত সামাজিক বিপ্লব সাধিত হয়েছিল। আমরাও সে লক্ষ্যে সাধ্যমত আন্দোলন পরিচালনা করে যাচ্ছি।
জানা আবশ্যক যে, কেবল ‘রাফঊল ইয়াদায়েন’ করলেই তাকে ‘আহলেহাদীছ’ বলা হয় না। বরং ছহীহ আক্বীদা ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক আমলের মাধ্যমেই প্রকৃত ‘আহলেহাদীছ’ হওয়া যায়। অতএব আহলেহাদীছ তরুণরা সাবধান!
(৩) মার্চ ২০১৪ প্রশ্ন (৩৯/১৯৯) : জিহাদ কি এবং কেন? কোন কোন অবস্থার প্রেক্ষিতে জিহাদ ‘ফরযে আইন’ এবং ‘ফরযে কিফায়া’ সাব্যস্ত হয়? বিস্তারিত জানিয়ে বাধিত করবেন।
-আবুবকর ছিদ্দীক, ধানম-ি, ঢাকা।
উত্তর : ‘জিহাদ’ অর্থ, সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো’। পারিভাষিক অর্থে, আল্লাহর দ্বীনকে সমুন্নত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। এর দ্বারা নিজেকে এবং অপরকে প্রবৃত্তির চাহিদা থেকে দূরে রাখা এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর দ্বীনকে সমুন্নত রাখার সর্বাত্মক প্রচেষ্টাকে বুঝানো হয়। ইবনু হাজার বলেন, নফস, শয়তান ও ফাসিকদের বিরুদ্ধে জিহাদও এর অন্তর্ভুক্ত’ (ইবনু হাজার, ফাৎহুল বারী ‘জিহাদ’ অধ্যায়-এর ভূমিকা ৬/৫ পৃঃ)। কাফিরের বিরুদ্ধে জিহাদ প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয। চাই সেটা হাত দিয়ে হৌক বা যবান দিয়ে হৌক বা মাল দিয়ে হৌক কিংবা অন্তর দিয়ে হৌক’ (ফাৎহুল বারী হা/ ২৮২৫-এর ব্যাখ্যা, ৬/৪৫ পৃঃ)। তবে ঈমান, ছালাত ও ছিয়ামের ন্যায় সশস্ত্র ‘জিহাদ’ প্রত্যেক মুমিনের উপরে সর্বাবস্থায় ‘ফরয আয়েন’ নয়। বরং আযান, জামা‘আত, জানাযা ইত্যাদির ন্যায় ‘ফরযে কিফায়াহ’। যা উম্মতের কেউ আদায় করলে অন্যদের জন্য যথেষ্ট হয়ে যায়। না করলে সবাই গোনাহগার হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে জিহাদ ফরযে আয়েন হয়ে যায়। যেমন, (১) মুসলমানদের বাড়ীতে বা শহরে শত্রুবাহিনী উপস্থিত হ’লে (তওবাহ ৯/১২৩)। (২) শাসক যখন কাউকে যুদ্ধে বের হবার নির্দেশ দেন (মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৭১৫, ৩৮১৮)। (৩) যুদ্ধের সারিতে উপস্থিত হ’লে (আনফাল ৮/১৫, ৪৫)। (৪) যখন কেউ বাধ্য হয় (তিরমিযী হা/১৪২১, মিশকাত হা/৩৫২৯)। বর্তমান যুগে মুসলিম দেশের সেনাবাহিনী সশস্ত্র যুদ্ধের দায়িত্ব পালন করবে।
স্মর্তব্য যে, শত্রুশক্তির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণার অধিকার হ’ল মুসলমানদের সর্বসম্মত আমীরের (নিসা ৪/৫৯)। রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ ব্যতীত কোন দল বা ব্যক্তি এককভাবে কারু বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদ ঘোঘণা করতে পারে না (বিস্তারিত দ্রষ্টব্য : ‘জিহাদ ও ক্বিতাল’ বই)।
(৪) নভেম্বর ২০১৪ প্রশ্ন (৫/৪৫) : জনৈক ব্যক্তি বলেন, শাহাদাতের আকাক্সক্ষা না থাকলে ইবাদত কবুল হবে না। এটা কি ঠিক?
-আমীনুল ইসলাম, সিরাজগঞ্জ।
উত্তর : উক্ত বক্তব্য ভিত্তিহীন। তবে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মারা গেল, অথচ জিহাদ করল না। এমনকি জিহাদের কথা মনেও আনলো না, সে ব্যক্তি মুনাফেকীর একটি শাখার উপর মৃত্যুবরণ করল’ (মুসলিম হা/১৯১০, মিশকাত হা/৩৮১৩)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘মক্কা বিজয়ের পরে আর কোন হিজরত নেই। তবে জিহাদ ও তার নিয়ত বাকী রইল। অতএব যখন তোমাদেরকে জিহাদের জন্য আহ্বান করা হবে, তখন তোমরা বের হবে’ (মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৭১৫, ৩৮১৮)। সুতরাং প্রত্যেক মুমিনের অন্তরে জিহাদের বাসনা ও শহীদী মৃত্যুর কামনা থাকা যরূরী। অবশ্যই সে জিহাদ হ’তে হবে আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত করার উদ্দেশ্যে প্রকৃত জিহাদ।
বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জিহাদের নামে মুসলমানদের মধ্যে পরস্পরে যে সশস্ত্র সংঘাত চলছে, তা কখনোই জিহাদ নয় (বিস্তারিত দ্রষ্টব্য : ‘জিহাদ ও ক্বিতাল’ বই)।
(৫) মার্চ ২০১৫ প্রশ্ন (৩৪/২৩৪) : অমুসলিম দেশে অবস্থান কালে সেদেশের আইন মেনে চলা কি যরূরী?
-সুমন, পীরগঞ্জ. ঠাকুরগাঁও।
উত্তর : মুসলিম হৌক অমুসলিম হৌক প্রতিষ্ঠিত কোন সরকারের বিধি-বিধান শরী‘আত বিরোধী না হলে তা মেনে চলা সেদেশের নাগরিকদের জন্য আবশ্যক। রাসূল (ছাঃ) বলেন, তোমরা তাদের (শাসকদের) হক আদায় কর এবং তোমাদের হক আল্লাহর কাছে চাও (বুখারী হা/৭০৫২; মিশকাত হা/৩৬৭২)। তবে ইসলাম বিরোধী হুকুম মানতে কোন মুসলিম নাগরিক বাধ্য নয় (বুখারী হা/৭২৫৭; মিশকাত হা/৩৬৯৬, ৩৬৬৪)। বরং তা থেকে বিরত থাকতে হবে, তার প্রতিবাদ করতে হবে অথবা তাকে ঘৃণা করতে হবে (মুসলিম, মিশকাত হা/৫১৩৭)। সেক্ষেত্রে বাধ্য করা হলে সেদেশ থেকে হিজরত করতে হবে। বাধ্যগত অবস্থায় সেখানে অবস্থান করতে হলে এবং তাকে শরী‘আতবিরোধী কাজ করতে বাধ্য করা হ’লে সেক্ষেত্রে সে গুনাহগার হবে না (বাক্বারাহ ২/১৭৩)।
(৭) আগস্ট ২০১৬ প্রশ্ন (২৭/৪২৭) : আল্লাহ বলেন, ...‘তোমরা মুশরিকদের যেখানে পাও হত্যা কর, পাকড়াও কর, অবরোধ কর এবং ওদের সন্ধানে প্রত্যেক ঘাঁটিতে ওঁৎ পেতে থাক। কিন্তু যদি তারা তওবা করে, ছালাত আদায় করে ও যাকাত দেয়, তাহ’লে ওদের রাস্তা ছেড়ে দাও...’ (তওবা ৯/৫)। উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ভূপৃষ্ঠের যেখানেই কাফির-মুশরিকদের পাওয়া যাবে সেখানেই পাকড়াও করে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া; অতঃপর গ্রহণ না করলে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছেন। উক্ত ব্যাখ্যা সঠিক কি?
-আব্দুল করীম, জকিগঞ্জ, সিলেট।
উত্তর : এটি হ’ল খারেজী চরমপন্থীদের ব্যাখ্যা। তাদের মতে ‘যেখানেই পাও’ এটি সাধারণ নির্দেশ। অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের যেখানেই পাও না কেন তাদেরকে বধ কর, পাকড়াও কর হারাম শরীফ ব্যতীত’ (যুগে যুগে শয়তান-এর হামলা ৯২ পৃ.)।
আয়াতটি বিদায় হজ্জের আগের বছর নাযিল হয় এবং মুশরিকদের সাথে পূর্বেকার সকল চুক্তি বাতিল করা হয়। এর ফলে মুশরিকদের জন্য বায়তুল্লাহর হজ্জ চিরতরে নিষিদ্ধ করা হয় এবং পরের বছর যাতে মুশরিকমুক্ত পরিবেশে রাসূল (ছাঃ) হজ্জ করতে পারেন তার ব্যবস্থা করা হয়। এটি বিশেষ অবস্থায় একটি বিশেষ নির্দেশ মাত্র।
খারেজীপন্থীরা কুরআনের আরও দু’টি আয়াতের অপব্যাখ্যা করে থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘সাবধান! সৃষ্টি ও আদেশের মালিক কেবল তিনিই’ (আ‘রাফ ৭/৫৪)। ‘আল্লাহ ব্যতীত কারু শাসন নেই’ (ইউসুফ ১২/৪০) এইসব আয়াতের অপব্যাখ্যা করে তারা হযরত আলী (রাঃ) ও মু‘আবিয়া (রাঃ) উভয়কে ‘কাফির’ এবং তাঁদের রক্ত হালাল গণ্য করেছিল ও হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ফলে তাদের ধারণায় কোন মুসলিম সরকার ‘মুরতাদ’ হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে তার রাষ্ট্রে কিছু কুফরী কাজের প্রকাশ ঘটালো’ (যুগে যুগে শয়তান-এর হামলা ১৪৫ পৃ.)। তাহ’লে তো এই আক্বীদার লোকেরা ক্ষমতায় গেলে কোন অমুসলিম বা কবীরা গোনাহগার মুসলিম এদেশে বসবাস করতে পারবে না। বরং এদের দৃষ্টিতে তারা প্রত্যেকে হত্যাযোগ্য আসামী হবে। অথচ রাসূল (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সময় মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রে মুনাফিক, ইহূদী, নাছারা, কাফের সবধরনের নাগরিক স্বাধীনভাবে বসবাস করতো।
বস্তুতঃ ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধকারী ব্যতীত অন্য কারু প্রতি অস্ত্র ধারণ করা ইসলামে নিষিদ্ধ। এ ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের জীবনাদর্শই বাস্তব প্রমাণ হিসাবে যথেষ্ট। অতএব জিহাদের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তাবলী পূরণ না করেই যারা চটকদার কথা বলে জিহাদের নামে জঙ্গীবাদকে উসকে দিচ্ছে, তারা ইসলামের বন্ধু তো নয়ই, বরং ইসলামের শত্রু এবং খারেজী চরমপন্থীদের দলভুক্ত। যাদের ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) বহুপূর্বেই মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক করে গিয়েছেন (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৮৯৪; মিশকাত (বঙ্গানুবাদ) হা/৫৬৪২; বিস্তারিত দেখুন : জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আহলেহাদীছ আন্দোলন-এর ভূমিকা ৩৭-৫৭ পৃ.)।
(৮) আগস্ট ২০১৬ প্রশ্ন (৩৯/৪৩৯) : মুসলিম দেশে বসবাসকারী কোন অমুসলিমকে কোন মুসলিম শরী‘আতসম্মত কারণে হত্যা করতে পারবে কি?
-আব্দুল্লাহ আল-মামূন, রাজশাহী।
উত্তর : অমুসলিম বা মুসলিম ব্যক্তির কোন অপরাধ রাষ্ট্রীয় আদালত কর্তৃক প্রমাণিত হওয়ার পূর্বে কারো জন্য আইন হাতে তুলে নেওয়া জায়েয নয়। এরূপ করলে উক্ত ব্যক্তি কবীরা গুনাহগার হিসাবে গণ্য হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমকে হত্যাকারী ব্যক্তি জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না (বুখারী হা/৩১৬৬, মিশকাত হা/৩৪৫২)। আর চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম হ’ল, যাদের সাথে মুসলমানদের জিযিয়া চুক্তি বা রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে সন্ধি অথবা কোন মুসলিমের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা প্রদান করা হয়েছে (ফাৎহুলবারী ১২/২৫৯)। আল্লাহ বলেন, ‘যে কেউ জীবনের বদলে জীবন অথবা জনপদে অনর্থ সৃষ্টি করা ব্যতীত কাউকে হত্যা করে, সে যেন সকল মানুষকে হত্যা করে। আর যে ব্যক্তি কারু জীবন রক্ষা করে, সে যেন সকল মানুষের জীবন রক্ষা করে’ (মায়েদাহ ৫/৩২)।