মৃত্যু পরবর্তী জীবনের প্রতি ঈমান (৩য় কিস্তি)
আসাদুল্লাহ আল-গালিব
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 11527 বার পঠিত
বিশ্বাস
বা দর্শন মানবজীবনের এমন একটি বিষয় যা তার জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়।
এটা এমন এক ভিত্তি যাকে অবলম্বন করেই মানুষ তার সমগ্র জীবনধারা পরিচালনা
করে। এই যে মৌলিক জীবনদর্শনকে কেন্দ্র করে দুনিয়ার বুকে মানুষ আবর্তিত
হচ্ছে, যে আদর্শ ও বিশ্বাসকে লালন করে তার সমগ্র জীবন পরিচালিত হচ্ছে তাকে
ইসলামী পরিভাষায় ‘আক্বীদা’ শব্দ দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়। কোন অবকাঠামো
যেমন ভিত্তি ছাড়া অকল্পনীয়, তেমনভাবে একজন মুসলিমের জীবনে আক্বীদা ও
বিশ্বাসের দর্শন এমনই একটি অপরিহার্য বিষয় যা ব্যতীত সে নিজেকে মুসলিম
হিসাবে সম্বোধিত হওয়ার অধিকার ও দাবী হারিয়ে ফেলে। এটা এমন এক অতুলনীয়
শক্তির অাঁধার যা একজন মুসলমানকে তার আদর্শের প্রতি শতভাগ আস্থাবান করে
তুলে এবং জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সেই বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটাতে
বিরামহীনভাবে সচেষ্ট রাখে। অপরপক্ষে মানবজগতের যাবতীয় পথভ্রষ্টতার মূলে
রয়েছে এই মৌলিক আক্বীদা থেকে বিচ্যুত হওয়া। এজন্য একজন মুসলমানের জন্য
আক্বীদা-বিশ্বাসের ব্যাপারে সুস্পষ্ট জ্ঞান রাখা এবং সে বিশ্বাসের যথার্থতা
নিশ্চিত করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা বিশ্বাসের বিশুদ্ধতা ব্যতীত কোন
ব্যক্তি প্রকৃত অর্থে মুসলিম হতে পারে না। প্রতিটি কথা ও কর্ম যদি বিশুদ্ধ
আক্বীদা ও বিশ্বাস থেকে নির্গত না হয় তবে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি বিশ্বাসের বিষয়ে অবিশ্বাস রাখে তার শ্রম বিফলে
যাবে এবং পরকালে সে ক্ষতিগ্রস্থ হবে’ (মায়েদা ৫)। তিনি আরো বলেন,
‘(হে নবী!) তোমাকে এবং এবং তোমার পূর্বসূরিদের আমি প্রত্যাদেশ করেছি যে,
যদি তুমি আমার শরীক স্থাপন কর তবে তোমার যাবতীয় শ্রম বিফলে যাবে এবং তুমি
ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (যুমার ৬৫)। মানুষ যুগে যুগে
পথভ্রষ্ট হয়েছে মূলতঃ আক্বীদার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি ঘটার কারণে। এজন্য
বিষয়টি সূক্ষ্মতা ও সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে জানা অপরিহার্য। নিম্নে ইসলামী
আক্বীদার পরিচিতি ও মানব জীবনে বিশুদ্ধ আক্বীদা পোষণের গুরুত্ব আলোচনা করা
হল।
আক্বীদার সংজ্ঞা :
শাব্দিক অর্থ : আক্বীদা শব্দটি আরবী العقد শব্দমূল থেকে উদ্গত, যার আভিধানিক অর্থ হল সম্পর্ক স্থাপন করা বা শক্তভাবে অাঁকড়ে ধরা, অথবা কোন কিছুকে সাব্যস্ত করা বা শক্তিশালী হওয়া। অতএব মানুষ যার সাথে নিজের অন্তরের সুদৃঢ় যোগাযোগ স্থাপন করে তাকেই আক্বীদা বলা যায়।
পারিভাষিক অর্থ : সাধারণভাবে সেই সুদৃঢ় বিশ্বাস ও অকাট্য কর্মধারাকে আক্বীদা বলা হয় যার প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী ব্যক্তির মনে সামান্যতম সন্দেহের অবকাশ থাকে না।
আর ইসলামী আক্বীদা বলতে বুঝায়- আসমান-যমীন ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছুর যিনি সৃষ্টিকর্তা সেই মহান প্রভুর প্রতি সুনিশ্চিত বিশ্বাস স্থাপন করা, তাঁর উলূহিয়্যাত, রুবূবিয়্যাত ও গুণবাচক নামসমূহকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা। তাঁর ফেরেশতামন্ডলী, নবী-রাসূলগণ, তাঁদের উপর নাযিলকৃত কিতাবসমূহ, তাক্বদীরের ভাল-মন্দ এবং বিশুদ্ধ দলীল দ্বারা প্রমাণিত দ্বীনের মৌলিক বিষয়সমূহ ও অদৃশ্য বিষয়াদি সম্পর্কিত সংবাদসমূহ ইত্যাদি যে সব বিষয়াদির উপর সালাফে ছালেহীন ঐক্যমত পোষণ করেছেন তার প্রতি সুনিশ্চিত বিশ্বাস রাখা।
আল্লাহর নাযিলকৃত যাবতীয় আহকাম-নির্দেশনার প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রদর্শন এবং রাসূল (ছা:)-এর প্রচারিত শরী‘আতের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ও অনুসরণ নিশ্চিত করা ইসলামী আক্বীদার অন্তর্ভুক্ত (ড. নাছের বিন আব্দুল করীম আল-আক্বল, মাবাহিসুন ফি আক্বীদায়ে আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ, পৃঃ ৩)।
আক্বীদা এবং শরী‘আত দু’টি পৃথক বিষয়। কেননা শরী‘আত হল দ্বীনের কর্মগত রূপ এবং আক্বীদা হলো দ্বীনের জ্ঞানগত রূপ যার প্রতি একজন মুসলমানের আন্তরিক বিশ্বাস রাখা অপরিহার্য।
আক্বীদা শব্দটির বিভিন্ন ব্যবহার :
আক্বীদা শব্দটি ইসলামী পরিভাষায় আরো কয়েকটি শব্দ দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়। যেমন- তাওহীদ, সুন্নাত, উছূলুদ্দীন, ফিকহুল আকবার, শরী‘আত, ঈমান ইত্যাদি। যদিও আক্বীদা শব্দটি এগুলোর তুলনায় সামগ্রিক একটি শব্দ। আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ব্যতীত অন্যান্য ফেরকা এক্ষেত্রে আরো কয়েকটি পরিভাষা ব্যবহার করে। যেমন-
যুক্তিবিদ্যা (ইলমুল কালাম) : মু‘তাযিলা, আশ‘আরিয়া এবং তাদের অনুসারীগণ এই পরিভাষাটি ব্যবহার করে। এটা সালাফে ছালেহীনের নীতি বিরোধী অনর্থক কর্ম, যার সাথে শরী‘আতের সম্পর্ক নেই।
দর্শন : দার্শনিকগণ এই পরিভাষা ব্যবহার করে। তবে আক্বীদাকে দর্শন শব্দ দ্বারা ব্যাখ্যা করা চলে না। কেননা দর্শনের ভিত্তি হল অনুমান, বুদ্ধিবৃত্তিক কল্পনা ও অজ্ঞাত বিষয়াদি সম্পর্কে কুসংস্কারাচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সমষ্টি, যার সাথে ইসলামী আক্বীদার সম্পর্ক নেই।
তাসাওউফ : কোন কোন দার্শনিক, প্রাচ্যবিদ ও ছূফীবাদীরা আক্বীদাকে ছুফিতত্ত্ব হিসাবে ব্যাখ্যা দেয়। এটাও অগ্রহণযোগ্য। কেননা সুফিতত্ত্বও নিরর্থক কল্পনা ও কুসংস্কারের উপর নির্ভরশীল। এর অতীন্দ্রিয় ও কাল্পনিক ভাবমালার সাথে শরী‘আতের কোন সম্পর্ক নেই।
ধর্মতত্ত্ব (Theology): এটাও দার্শনিক, প্রাচ্যবিদ, যুক্তিবাদীদের আবিস্কৃত শব্দ। এর দ্বারাও ইসলামী আক্বীদার ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। কেননা এর উদ্দেশ্য কেবল স্রষ্টা সম্পর্কে দার্শনিক, যুক্তিবাদী এবং নাস্তিকদের ধারণাসমূহ ব্যাখ্যা করা।
অধিবিদ্যা : দার্শনিক ও পশ্চিমা লেখকরা একে Metaphisycs নামে অভিহিত করে। এটি অনেকটা ধর্মতত্ত্বের কাছাকাছি পরিভাষা।
সাধারণভাবে ধর্ম সম্পর্কিত বা ধর্মহীন বিভিন্ন বাতিল চিন্তাধারাকেও আক্বীদা বলা যায়। যেমন - ইহুদীবাদ, বৌদ্ধবাদ, হিন্দুবাদ, খৃষ্টবাদ, নাস্তিক্যবাদ ইত্যাদি।
বিশুদ্ধ আক্বীদা বনাম ভ্রষ্ট আক্বীদা :
বিশুদ্ধ আক্বীদা বলতে বুঝান হয় ইসলামী আক্বীদা তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদাকে যা আল্লাহ রাববুল আলামীন নির্দেশিত ও রাসূল (ছা:) কর্তৃক প্রচারিত অর্থাৎ যা পূর্ণাঙ্গভাবে কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা সমর্থিত এবং সালাফে ছালেহীনের ঐকমত্যে প্রতিষ্ঠিত।
এতদ্ভিন্ন পৃথিবীর যাবতীয় আক্বীদা ও বিশ্বাস মিশ্রিত, কাল্পনিক, কুসংস্কারযুক্ত এবং মিথ্যার উপর ভিত্তিশীল। যা নিশ্চিতভাবে মানবজাতির গন্তব্যপথকে ভ্রষ্টতার দিকে নিয়ে যায়।
আক্বীদার মৌলিক বিষয়বস্ত্ত :
আক্বীদার মৌলিক বিষয়বস্ত্ত ছয়টি। যথা:-
আলোচিত ছয়টি বিষয়ের প্রতি পূর্ণাঙ্গভাবে বিশ্বাস স্থাপন করা একজন মুসলমানের জন্য অপরিহার্য। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বহু দলীল দ্বারা এগুলো প্রমাণিত (বাকারা ১৭৭, ২৮৫; নিসা ১৩৬; ক্বামার ৪৯; ফুরকান ২; মিশকাত হা/২ ‘ঈমান অধ্যায়’)।
আক্বীদা ও ঈমানের মধ্যে পার্থক্য :
আক্বীদা শব্দটি প্রায়ই ঈমান ও তাওহীদের সাথে গুলিয়ে যায়। অস্বচ্ছ ধারণার ফলশ্রুতিতে অনেকেই বলে ফেলেন, আক্বীদা আবার কি? আক্বীদা বিশুদ্ধ করারই বা প্রয়োজন কেন? ঈমান থাকলেই যথেষ্ট। ফলশ্রুতিতে দ্বীন সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে এক বড় ধরনের অপূর্ণতা সৃষ্টি হয়, যা প্রায়ই মানুষকে পথভ্রষ্টতার দিকে ঠেলে দেয়। এজন্য ঈমান ও আক্বীদার মধ্যকার সম্পর্ক ও পার্থক্য স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। নিম্নে বিষয়টি উপস্থাপন করা হল:-
প্রথমত : ঈমান সমগ্র দ্বীনকেই অন্তর্ভুক্ত করে। আর আক্বীদা দ্বীনের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহকে অন্তর্ভুক্ত করে।
দ্বিতীয়ত : আক্বীদার তুলনায় ঈমান আরো ব্যাপক পরিভাষা। আক্বীদা হল কতিপয় ভিত্তিমূলক বিষয়ের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসের নাম। অন্যদিকে ঈমান শুধু বিশ্বাসের নাম নয়; বরং মৌখিক স্বীকৃতি ও কর্মে বাস্তবায়নের মাধ্যমে তার বাস্তব প্রতিফলনকে অপরিহার্য করে দেয়। সুতরাং ঈমানের দু’টি অংশ। একটি হল অন্তরে স্বচ্ছ আক্বীদা পোষণ। আরেকটি হল বাহ্যিক তৎপরতায় তার প্রকাশ। এ দু’টি পরস্পরের সাথে এমনভাবে সংযুক্ত যে কোন একটির অনুপস্থিতি ঈমানকে বিনষ্ট করে দেয়।
তৃতীয়ত : আক্বীদা হল বিশ্বাসের মাথা এবং ঈমান হল শরীর। অর্থাৎ আক্বীদা হল ঈমানের মূলভিত্তি। আক্বীদা ব্যতীত ঈমানের উপস্থিতি তেমনি অসম্ভব, যেমনভাবে ভিত্তি ব্যতীত কাঠামো কল্পনা করা অসম্ভব। সুতরাং ঈমান হল বাহ্যিক কাঠামো আর আক্বীদা হল ঈমানের আভ্যন্তরীণ ভিত্তি।
চতুর্থত : আক্বীদার দৃঢ়তা যত বৃদ্ধি পায় ঈমানও তত বৃদ্ধি পায় ও মজবুত হয়। আক্বীদায় দুর্বলতা সৃষ্টি হলে ঈমানেরও দুর্বলতা সৃষ্টি হয়, আমলের ক্ষেত্রেও সে দুর্বলতার প্রকাশ পায়। যেমনভাবে রাসূল (ছা:) বলেন, মানুষের হৃদয়ের মধ্যে একটি গোশতপিন্ড রয়েছে, যদি তা পরিশুদ্ধ হয় তবে সমস্ত শরীর পরিশুদ্ধ থাকে, যদি তা কদর্যপূর্ণ হয় তবে সমস্ত শরীরই কদর্যপূর্ণ হয়ে যায়। (মুত্তাফাক আলাইহে, মিশকাত ‘ক্রয়-বিক্রয় অধ্যায়’ হা/২৭৬০)
পঞ্চমত : বিশুদ্ধ আক্বীদা বিশুদ্ধ ঈমানের মাপকাঠি, যা বাহ্যিক আমলকেও বিশুদ্ধ করে দেয়। যখন আক্বীদায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয় তখন ঈমানও বিভ্রান্তিপূর্ণ হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের অনুসরণ করা হয় এজন্য যে, তারা যে আক্বীদার অনুসারী ছিলেন তা ছিল বিশুদ্ধ এবং কুরআন ও সুন্নাহের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আর এজন্যই তারা ছিলেন খালিছ ঈমানের অধিকারী এবং পৃথিবীর বুকে উত্থিত সর্বোত্তম জাতি। অন্যদিকে মুরজিয়া, খারেজী, কাদরিয়াসহ বিভিন্ন উপদলসমূহ আক্বীদার বিভ্রান্তির কারণে তাদের ঈমান যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, তেমনি তাদের কর্মকান্ড নীতিবিচ্যুত হয়ে পড়েছে। এভাবেই আক্বীদার অবস্থান পরিবর্তনের কারণে ঈমানের অবস্থানও পরিবর্তন হয়ে যায়।
ষষ্ঠত : সকল রাসূলের মূল দা‘ওয়াত ছিল বিশুদ্ধ আক্বীদা তথা তাওহীদের প্রতি আহবান জানানো। এক্ষেত্রে কারো অবস্থান ভিন্ন ছিল না। কিন্তু আমল-আহকাম সমূহ যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন ছালাত, ছিয়াম, যাকাত, হজ্জ ইত্যাদি আমলসমূহ পূর্ববর্তী নবীদের যুগে ছিল না অথবা থাকলেও তার বৈশিষ্ট্য ছিল ভিন্নরূপ। সুতরাং ঈমানের দাবীসূচক আমলসমূহ কালের বিবর্তনে পরিবর্তিত হলেও আক্বীদার বিষয়টি সৃষ্টির অনাদিকাল থেকে অভিন্ন ও অপরিবর্তনীয়।
সঠিক আক্বীদা পোষণের অপরিহার্যতা :
আক্বীদার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির ভয়াবহ ফলাফল :
আলেম-ওলামাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হল মৌলিক আক্বীদাসমূহের বিষয়ে সাধারণ মুসলমানদের সঠিক জ্ঞান দান করা এবং সাধ্যমত সর্বত্র তার প্রসার ঘটান। কেননা যে ব্যক্তি তার জীবনের ব্যষ্টিক, সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক সর্বক্ষেত্রে বিশুদ্ধ আক্বীদার প্রতিফলন ঘটাতে পারে, সে দুনিয়া ও আখিরাত সর্বক্ষেত্রে সফল। অথচ দুঃখজনক হল, আধুনিক যুগে বহু আলেমই আক্বীদাকে খুব সংকীর্ণ অর্থে ধরে নিয়েছেন, যার প্রভাব অবধারিতভাবে সাধারণ মানুষের মাঝে পড়ছে। ফলে আমলগত ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ আক্বীদার উপস্থিতিকে নিশ্চিত না করে অনেকে কেবল আক্বীদা সম্পর্কে সাধারণ ধারণা রাখাই যথেষ্ট মনে করেছে যেমনটি করেছিল মু‘তাযিলাসহ আরো কিছু উপদল। অনেকে আবার কেবল অন্যদের সাথে নিজেদের পার্থক্য নিরূপণের ক্ষেত্রে, কিংবা রাষ্ট্রক্ষমতা লাভের মত উপলক্ষের সাথে আক্বীদাকে সীমাবদ্ধ রেখেছে যেমন-খারেজীরা। ফলশ্রুতিতে বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রে বিধর্মীগোষ্ঠীর বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসনের পথ ধরে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ইত্যাদি নিত্য-নতুন শিরকী মতবাদ সহজেই মুসলমানদের মাঝে গেড়ে বসতে সক্ষম হয়েছে। সচেতনতার দাবীদার বহু মুসলমান এ ধারণা রাখে যে, ইসলাম ভিন্ন অন্য ধর্মের লোকেরাও জান্নাতে যাবে যদি তারা সৎ হয়। ‘আক্বীদা ও শরী‘আত ভিন্ন জিনিস, আক্বীদা কেবলমাত্র একটি সাংস্কৃতিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাধারা; ব্যবহারিক জীবনে যার বিশেষ কোন গুরুত্ব নেই, ধর্ম ব্যক্তিগত বিষয়; রাষ্ট্র, সমাজ, শিক্ষা ইত্যাদি সার্বজনীন ক্ষেত্রে তার কোন ভূমিকা থাকা উচিৎ নয়’ ইত্যাদি কুফরী চিন্তাধারা লক্ষ্যে-অলক্ষ্যে অধিকাংশ মুসলমানের মানসজগতকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। বলা বাহুল্য, এ সমস্ত ধোঁয়াশার প্রভাব এতই ক্ষতিকারক যে মানুষের সত্যানুসন্ধিৎসু মনকে একেবারেই পঙ্গু করে রাখে এবং মিথ্যার আধিপত্যকে মেনে নেওয়ার শৈথিল্যবাদী মানসিকতা প্রস্ত্তত করে দেয়। আর এসবই সঠিক আক্বীদা থেকে বিচ্যুতির অবধারিত ফলশ্রুতি।
সংক্ষিপ্ত আলোচনার শেষ প্রান্তে বলা যায় যে, আক্বীদা দ্বীনের প্রাথমিক ও মৌলিক বিষয়। আক্বীদা সঠিক হওয়ার উপরই ঈমান ও আমলের যথার্থতা নির্ভরশীল। তাই সবকিছুর পূর্বে আক্বীদার বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করাই একজন মুসলিমের প্রথম ও অপরিহার্য দায়িত্ব। আজকের পৃথিবীতে যখন সংঘাত হয়ে উঠেছে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক তখন একজন মুসলমানের জন্য স্বীয় আক্বীদা সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সর্বাধিক বেড়েছে। কেননা হাযারো মাযহাব-মতাদর্শের দ্বিধা-সংকটের ধ্বংসাত্মক, দুর্বিষহ জঞ্জালকে সযত্নে পাশ কাটিয়ে সত্যের দিশা পাওয়া এবং সত্য ও স্বচ্ছ দ্বীনের দিকে ফিরে আসা বিশুদ্ধ আক্বীদা অবলম্বন ব্যতীত অসম্ভব। আল্লাহ রাববুল আলামীন সকল মুসলিম ভাই-বোনকে সঠিক আক্বীদার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত স্বচ্ছ ঈমানের উপর অটল থাকার তাওফীক দান করুন ও যাবতীয় শিরকী ও জাহেলী চিন্তাধারা থেকে আমাদেরকে হেফাযত করুন। আমীন!!