শিরক ও এর ভয়াবহ পরিণতি
মোসা: মানোয়ারা বিনতে মঈনুল ইসলাম
ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর 10521 বার পঠিত
পৃথিবীতে পাপ নামক যত প্রকারের কার্যক্রম রয়েছে তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর ও বড় পাপ হচ্ছে শিরক। শিরক সবচেয়ে বড় পাপ হওয়ার মূল কারণ হল এটা সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর অস্তিত্ব ও সত্তার প্রতি প্রভাব ফেলে। যা মহান আল্লাহ বরদাশত করতে পারেন না। এই পৃথিবীতে হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত যে এক লক্ষ চবিবশ হাযার নবী ও রাসূল এসেছেন, তাঁদের মৌলিক প্রধান কাজ ছিল শিরক উৎখাত করতঃ তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা। তাঁরা প্রত্যেকেই আজীবন সর্বশক্তি প্রয়োগ করে শিরকের মূল শিকড় উপড়ে ফেলার অবিরাম সংগ্রাম করে গেছেন। সাথে সাথে সমাজের সর্বস্তরে তাওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তাঁদের তিরোধানের পর এ দায়িত্ব হক্বপন্থী আলেমদের উপর অর্পণ করে গেছেন। বড় পরিতাপের বিষয়, আজ সমাজের সর্বস্তরে শিরকের জয়জয়কর চলছে। শিরক যেন একটি মামুলী ব্যাপার। মানুষ একে হালকা জ্ঞান করছে। ফলে অহরহ তারা অগণিত শিরক করলেও তাদের মাঝে অনুশোচনার কোন লক্ষণ নেই।
শিরকের পরিচয় :
আরবী ‘শিরক’ শব্দটি পবিত্র কুরআনে ও ছহীহ হাদীছে ব্যবহৃত বহুল প্রচলিত শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হল- অংশীদার বা শরীক হওয়া। আর কুরআন ও হাদীছে শিরক শব্দটি দ্বারা আল্লাহর রুবূবিয়াত, উলূহিয়াত ও আসাম ওয়াছ ছিফাতের মধ্যে কাউকে অংশীদার বানানোকে বুঝানো হয়েছে।
শিরকের পারিভাষিক সংজ্ঞায় ডঃ ইবরাহীম ইবনু মুহাম্মাদ বলেন, আল্লাহর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য তথা তাঁর জাত, গুণ ও প্রভুত্বে সমকক্ষ স্থাপন করা এবং তিনি ব্যতীত অন্য কাউকে ইবাদত ও আনুগত্যের উপযুক্ত মনে করাই শিরক। ডঃ ছালেহ বিন ফাওযান বলেন, আল্লাহর উলূহিয়াত ও রুবূবিয়াতের ক্ষেত্রে কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করা। আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলে, শিরক হল আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ গ্রহণ করা এবং আল্লাহর মত তাকে ভালবাসা।
‘কিতাবুত তাওহীদ’ প্রণেতার মতে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে আহবান করা, ইবাদতের মাধ্যম সাব্যস্ত করা কিংবা ইবাদতে অংশী স্থাপন করাকে শিরক বলে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) শিরকের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘আল্লাহর জন্য অংশীদার সাব্যস্ত করা, অথচ তিনি (আল্লাহ) তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’ (বুখারী, হা/৪২০৭)। মোট কথা শিরক হল প্রতিপালন, আইন, বিধান ও ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে উলূহিয়্যাহ বা ইবাদতের ব্যাপারে অংশীদার সাব্যস্ত করা এভাবে যে, আল্লাহর সাথে অন্যকে আহবান করা অথবা বিভিন্ন প্রকার ইবাদতে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা। যেমন যবেহ করা, নযর বা মানত করা, ভয় করা, আশা করা এবং ভালবাসা।
শিরকের উৎপত্তি :
আদম (আঃ) ও নূহ (আঃ)-এর মধ্যকার ব্যবধান প্রায় সহস্রাব্দ ছিল। এ সময় মানুষ তাওহীদের প্রতি বিশ্বাসী ছিল। সে সময় কোন শিরক পৃথিবীতে ছিল না। দুনিয়াতে প্রথম শিরক সংঘটিত হয়েছিল নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের মধ্যে। আর তা হয়েছিল সৎ ও বুযর্গ লোকদের মাধ্যমে। আল্লাহ বলেন, ‘তারা বলল তোমরা তোমাদের উপাস্যদের ত্যাগ কর না, আর তোমরা ওয়াদ, ইয়াগূছ, ইয়াউক এবং নাসরকেও ত্যাগ কর না’ (নূহ ২৩)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মহানবী (ছাঃ) বলেছেন, এ আয়াতে যে ক'টি নাম এসেছে এগুলো নূহ (আঃ) এর কওমের বুযর্গ লোকদের নাম। তাদের মৃত্যুর পর শয়তান ঐ সম্প্রদায়ের লোকদের প্ররোচিত করল, তারা যেন ঐসব বুযর্গগণ যেসব আসরে বসতেন সেখানে তাদের প্রতিমা বানিয়ে রাখে এবং তাদে নামে এগুলোর নামকরণ করে। তারা তাই করল। তবে এগুলোর উপাসনা হত না। এসব লোক মৃত্যুবরণ করার পর ক্রমান্বয়ে তাওহীদের জ্ঞান বিস্মৃত হল, তখন এগুলোর উপাসনা ও পূজা হতে লাগল (বুখারী, হা/৪৯২০)।
শিরকের প্রকারভেদ :
শিরক তিন প্রকার। যথা (১) আশ-শিরক ফির রুবূয়িইয়াহ : আর তা হচ্ছে আল্লাহর কর্তৃত্ব, ক্ষমতা ও সার্বভৌমত্বে কাউকে তাঁর সমকক্ষ মনে করা, অন্য কাউকে অংশীদার বানানো। আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, গায়েব বা অদৃশ্যের খবর একমাত্র তিনিই রাখেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও গায়েবের খবর জানতেন না (আ‘রাফ ১৮৮)।
(২) আশ-শিরক ফিল উলূহিইয়াহ : ইবাদতে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করার নাম আশ-শিরক ফিল উলূহিয়াহ বা ইবাদতে শিরক। ইবাদত হতে হবে সম্পূর্ণ শিরকমুক্ত। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তাঁর সাথে কাউকে শরীক কর না’ (নিসা ৩৬)। ইবদাতে শিরক দু’প্রকার (ক) বড় শিরক : আর তা হল ইবাদতের প্রকারগুলোর কোন একটি প্রকার আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো জন্য করা। যেমন, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো কাছে দো‘আ করা, সিজদা করা, মানত করা, মৃত ব্যক্তি, জিন কিংবা শয়তানের প্ররোচণাকে ভয় করা। আর বড় শিরক কয়েক ভাগে সম্পাদিত হতে পারে। (১) দাওয়াত বা আহবানে শিরক। বিপদ-আপদে আল্লাহকে ব্যতীত অন্য কাউকে ডাকা এ ধরনের শিরক (আনকাবূত ৬৫)। (২) আনুগত্যে শিরক। আল্লাহ ব্যতীত অন্য যে কারো জন্য আনুগত্য প্রকাশ করা (তাওবা ৩১)। (৩) ভালবাসায় শিরক। মুমিনদের ভালবাসা হবে একমাত্র আল্লাহর জন্য। আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে আল্লাহর ন্যায় ভালবাসা শিরক। আর ভালবাসার নিদর্শন হল আদেশ-নিষেধকে বাস্তবায়ন করা (বাক্বারাহ ১৬৫)।
(খ) ছোট শিরক : যেসব কথা ও কাজের মাধ্যমে মানুষ শিরকের দিকে ধাবিত হয় সেসব কথা ও কাজকে ছোট শিরক বলা হয়। যেমন সৃষ্টির ব্যাপারে এমনভাবে সীমালংঘন করা, যা ইবাদতের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ছোট শিরক মানুষকে মুসলিম মিল্লাহ থেকে বের করে না। কিন্তু তাওহীদের ঘাটতি করে। আর উহা বড় শিরকের একটি মাধ্যম। ছোট শিরক আবার দু’প্রকার (১) প্রকাশ্য শিরক : উহা কথা ও কাজের মাধ্যমে সংঘটিত হয়। কথার শিরক হল আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে শপথ করা (তিরমিযী হা/১৫৩৫)। কাজের মাধ্যমে শিরক হল বিপদ দূর করার জন্য সুতা ও কড়া ব্যবহার করা, বদ নযর থেকে বাঁচার জন্য তাবীয-কবজ ঝুলানো। (২) গুপ্ত শিরক : গুপ্ত শিরকের উদাহরণ দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘এ উম্মতের শিরক রাতের আঁধারে কালো পাথরের উপর কালো পিঁপড়া পদাচারণার চেয়েও গুপ্ত বা সূক্ষ্ম’ (ছহীহুল জামে, হা/২৩৩)। আর এ ধরনের শিরক হল ইচ্ছা ও নিয়তের দ্বারা। যেমন লোকদেখানো ও সুখ্যাতি বা সুনামের জন্য কোন কাজ করা।
(৩) আশ-শিরক ফিল আসমা ওয়াছ-ছিফাত :
এই শিরক হল আল্লাহর গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের সাথে সৃষ্টির গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের তুলনা করা। যেমন এ ধরনের কথা বলা যে, আল্লাহর পা আমাদের পায়ের মত, আল্লাহর চেহারা অমুকের চেহারার মত ইত্যাদি। আমরা আল্লাহকে একমাত্র গাওছ বা ত্রাণকর্তা হিসাবে বিশ্বাস করি। তাই আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে গাওছ বলা এ জাতীয় শিরক। এ সকল প্রকার শিরক থেকে আমাদের বেঁচে থাকতে হবে।
শিরক ও বর্তমান সমাজচিত্র :
শিরক ও বর্তমান সমাজচিত্রের কথা বলতে গেলে গা শিউরে উঠে। কেননা এর মত এক অমার্জনীয় অপরাধ মানুষ নির্বিঘ্নে করে চলেছে। এটা যেন তেমন কোন অন্যায় নয়। ছোট-খাট বিষয়। করা না করা সমান। অথচ এর বাস্তবতা সম্পূর্ণ বিপরীত। যা খুবই ভয়াবহ। আমাদের জীবন পরিচালনার জন্য মহান আল্লাহ আমাদের উপর পবিত্র কুরআন নাযিল করেছেন। তা হাতে কলমে বাস্তবতার নিরিখে বাস্তবায়ন করার জন্য তিনি শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে পাঠিয়েছেন। বিধায় সকল সমস্যার সমাধান পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ থেকেই আমাদেরকে নিতে হবে।
হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে যদি আমরা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের মডেল মনে করি কিন্তু রাষ্ট্রীয় জীবনে লক, হিউম, লিংকন, জেফারসন, লেলিন, মাওসেতুং বা কার্লমার্কসের দেয়া বিধান এবং নীতি অধিকতর প্রাসঙ্গিক এবং যুগোপযোগী মনে করি, তবে কুরআন এবং রাসূলের প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা থাকল না। আমাদের জীবন সমস্যা সমাধানের জন্য আল-কুরআন হতে কিছু কিছু বিধান গ্রহণ করা এবং রাষ্ট্র ও অর্থনীতি পরিচালনার জন্যে অন্য ব্যক্তি এবং আর্দশ থেকে কিছু কিছু বিধানকে অধিকতর যুগোপযোগী মনে করা শিরক। কিছুটা আল্লাহর বিধান আর কিছুটা মানুষের দেয়া বিধান এটা যে, শিরক এতে কোন সন্দেহ নেই। অথচ বর্তমান সমাজে ঘটছে তাই। আল্লাহর বিধান ও মানুষের তৈরি করা বিধানের সংমিশ্রণ জগাখিচুড়ী করে চলছে সমাজ ব্যবস্থা। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে আইন ও বিধানদাতা মনে করা শিরক। কারণ সৃষ্টির যাবতীয় আইন ও বিধান প্রদানের ক্ষমতা নিরংকুশভাবে আল্লাহর। আল্লাহ বলেন, ‘সাবধান সৃষ্টি তাঁর এবং হুকুমও তাঁর’ (আ‘রাফ ৫৪)। কাজেই কোন ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে আইন ও বিধানদাতা মনে করা এবং আইনের উৎস বলে বিশ্বাস করা শিরক। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রিযিকদাতা, আইনদাতা, সন্তানদাতা, রোগ ও আরোগ্যদাতা হিসাবে বিশ্বাস করাও শিরক। আমরা জনগণের সর্মথন নিয়ে নির্দিষ্ট এক স্থানে সংখ্যাগরিষ্ঠের দোহাই পেড়ে যে অসংখ্য শরী‘আত বিরোধী আইন তৈরী করে সমাজে প্রয়োগ করছি, এটা কোন পর্যায়ে যাবে তা বুঝতে আশা করি পাঠক সমাজের বাকি নেই। যিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তিনিই ভাল জানেন তাদের জন্য কল্যাণকর বিধানের কথা। মানুষ মানুষের জন্য স্বচ্ছ কল্যাণের আইন রচনা করতে পারে না।
আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে সিজদা করা শিরকের অন্তর্ভুক্ত। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা সূর্যকে সিজদা কর না, চন্দ্রকেও না; আল্লাহকে সিজদা কর, যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন’ (ফুছছিলাত ৩৭)। ঠিক মহানবী (ছাঃ) আল্লাহর কাছে দো‘আ করতেন, ‘হে আল্লাহ! আমার কবরকে মূর্তি বানিও না। যে জাতি তাদের নবী-রাসূলদের কবরকে সিজদার স্থানে পরিণত করেছে, তাদের উপর আল্লাহর গযব তীব্র হয়ে উঠেছে’ (মুওয়াত্তা, মিশকাত হা/৭৫০)। তাই যদি কেউ কোন নবী, ওলী, জিন পরীকে, কবরকে, পশু-প্রাণীকে, নিশানাকে, কোন পবিত্র বস্ত্তকে বা সরদারকে সিজদা করে, রুকু করে, তার জন্য ছওম রাখে, হাত বেধে দাঁড়িয়ে নৈকট্য প্রার্থনা করে, তার নামে ছড়ি দাঁড় করায়, ফেরার সময় উল্টোভাবে ফিরে, কবরকে চুম্বন করে, কবরে বাতি জ্বালায়, কবর যিয়ারতের জন্য দূর-দূরান্ত থেকে আসে, কবরে আলোর ব্যবস্থা করে, কবরে গিলাফ দ্বারা আবৃত করে, কবরের উপর চাদর টাঙ্গিয়ে দেয়, সামিয়ানা টাঙ্গায়, কবরের চৌকাঠে চুম্বন করে, কবরে সমাধিস্থ বুযুর্গ ব্যক্তির নিকটে হাত তুলে কিছু প্রার্থনা করে, কবরের খেদমত করে, কবরের পার্শববর্তী গাছপালাকে সম্মান করে, কবরকে তাওয়াফ করে, কবরে হাত বুলায়, লালশালুতে মাথা ঠেকিয়ে পড়ে থাকে, কবরের মাটি গায়ে মাখে, তার সামনে মিনতি ভরে দাঁড়ায়, নিজের উদ্দেশ্য ও অভাবের কথা তুলে ধরে, সুস্থতা কামনা করে ও সন্তান চায়। মোটকথা এ ধরনের কাজ করলে নিঃসন্দেহে সে শিরক করল। এসব শিরক হওয়া সত্ত্বেও আমাদের সমাজে এর সবগুলোই ব্যাপকভাবে চালু রয়েছে।
খলীফা ওমর (রাঃ)-এর সময় তাকে সংবাদ দেয়া হল যে, কতিপয় মানুষ ঐ বৃক্ষের উদ্দেশ্যে যাতায়াত করে যে বৃক্ষের নীচে ছাহাবীগণ নবী করীম (ছাঃ)-এর হাতে বায়‘আত করেছিলেন। অতঃপর তিনি [ওমর (রাঃ)] ঐ বৃক্ষকে কেটে ফেলার নির্দেশ দিলেন (ফাৎহুল বারী ৭/৪৪৮)। কিন্তু বর্তমানে আমরা সংস্কৃতির নামে, আধুনিকতার নামে অহরহ শিরক করে চলেছি। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও শহীদ দিবস আসলে আমরা শহীদ মিনারে ও স্মৃতিসৌধে গিয়ে ফুলের স্তবক দেই, নীরবে দাঁড়িয়ে থাকি, শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাই। প্রতিটি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ মিনার তৈরী করে দেশে ভবিষ্যৎ কর্ণধার কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদেরকে শিরক শিক্ষা দেয়া হচ্ছে।
অথচ সবচেয়ে বড় গুনাহ ও শিরক থেকে বেঁচে থাকার যথার্থ শিক্ষা দেয়াই উচিৎ ছিল এ দেশের তরুণ প্রজন্মকে। আমাদের হিন্দু ভাইয়েরা মন্দিরে মূর্তিকে সামনে রেখে পূজা-অর্চনা করে, সিজদা করে। আর অন্যদিকে মুসলিমরা পীর-বুযুর্গদের মাটির নীচে দাফন করে কবর সামনে রেখে একই কায়দায় পূজা করে। তথা সিজদা করে, মানত করে, দো‘আ করে, সম্মান প্রদর্শন করে, নীরবতা পালনসহ কত কিছু যার শেষ নেই বললেই চলে। আবার অতি আধুনিকতার দোহাই পেড়ে খোদ ইসলাম প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামকারী ব্যক্তিবর্গও ইট-পাথর-বালু-সিমেন্টের তৈরী খাম্বা বা পিলারকে সামনে রেখে মাথা নত করে সম্মান প্রদর্শন করে, এক মিনিট নীরবতা পালন করে, পুষ্পস্তবক অর্পণ করে, নানা কায়দায় প্রার্থনা করে। এসব কিছুর মধ্যে মূলতঃ মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। বরং পর্যায়ক্রমে শেষেরটা বেশী হাস্যকর। শীতকালে প্রচন্ড শৈত্যপ্রবাহ কুয়াশাচ্ছন্ন দিনে সকাল, দুপুর, বিকাল তথা সারাদিনই একই রকম থাকে। সারাদিনই সূর্যের আলোর মুখ দেখা যায় না। ঠিক মূর্তিপূজা, কবর বা মাজার পূজা ও শহীদ মিনার পূজা একই সূত্রে গাঁথা। স্রেফ কিছু নিয়ম-নীতির পার্থক্য মাত্র। এছাড়াও ভক্তিভাজন পীর বা নেতা-নেত্রীর ছবিতে ফুলের মালা দেয়া, চিত্রের পাদদেশে শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদন করা, নীরবে শ্রদ্ধা নিবেদন করা, ভাস্কর্যের নামে শিক্ষাঙ্গন ও রাস্তার মোড়ে মোড়ে মূর্তি স্থাপন করা ও তাকে সম্মান দেখানো, শিখা অনির্বাণ ও শিখা চিরন্তন বানিয়ে নীরবে সম্মান প্রদর্শন করা মূর্তিপূজার শামিল। যা শিরক।
আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ গায়েব বা অদৃশ্যের খবর জানে না। তাই কেউ যদি মনে করে পীর সাহেব, হুযুরে কেবলা গায়েব জানে তাহলে তা শিরক হবে। সাথে সাথে জ্যোতিষী বা গণকের নিকটে যাওয়া ও তার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করা, তাকে হাত দেখানোও শিরক। আবার অনেকে রোগমুক্তি, সন্তানলাভ, মুশকিলে আসান, মামলা মোকদ্দমায় জয়লাভ, পরীক্ষায় ভাল ফলাফলের প্রত্যাশা কিংবা নানাবিধ উদ্দেশ্য পূরণের জন্য দরগা-মাযারে দান-খয়রাত, গরু-ছাগল, টাকা-পয়সা, চাল, মিষ্টি, হাঁস-মুরগী, শিরনিসহ বিভিন্ন প্রকার জিনিস দিয়ে থাকেন। এসবগুলোও শিরকের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে কোন পশু-পাখি যবেহ করা শিরক। আবার আমরা আল্লাহ ব্যতীত অনেক কিছুর নামে শপথ বা কসম করি সেগুলোও শিরক। যেমন আমরা মাটি, দানা, চোখ, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, সন্তানের মাথায় হাত রেখে, পেটের সন্তানের সহ আরো অনেক কিছুর শপথ করি, যা শিরকের পর্যায়ভুক্ত। যদি শপথ করতে হয় তাহলে সরাসরি আল্লাহর নামে শপথ করতে হবে। সৃষ্টি স্রষ্টার নামে শপথ করবে, সৃষ্টির নামে নয়। আমরা অনেক সময় বালা-মুছীবত দূর করার জন্য রিং, তাগা, কালো সুতা ও তাবীয ব্যবহার করি যা শিরক (তিরমীযী, মিশকাত হা/৪৫৫৬)। স্বামী-স্ত্রীর, দুই বন্ধু বা বান্ধবী তথা দু’জন ব্যক্তির মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ার জন্য তাবীয বা ঝাড়ফুঁক জাতীয় যেসব কৌশল অবলম্বন করা হয় তার সবগুলোই শিরক। আমরা অনেকে প্রভাতে দোকান খুলে প্রথম খরীদদারকে বাকী দিতে চাই না অমঙ্গলের আশংকায়। এরূপ ধারণা করাও শিরক। অমুক দিন অমুক গাছ বা বাঁশ কাটা যাবে না, ভাঙ্গা আয়নায় মুখ দেখলে এই ক্ষতি হয়, এ জাতীয় বিশ্বাস শিরকের শামিল। আবার অনেক সময় সন্তানের নাম না বুঝে আব্দুন নবী তথা নবীর বান্দা, নূরুন্নবী তথা নবীর নূর, গোলাম রাসূল তথা রাসূলের গোলাম বা এরূপ নাম রেখে থাকি। এসবও শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
মোটকথা, মাযারকেন্দ্রিক পীর-ফকীর-গণক, তাবীয-কবয ইত্যাদি যে সকল কার্যক্রম রয়েছে তার সবই শিরক। আবার শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, মূর্তিসম্বলিত ভাস্কর্য, বিভিন্ন দিবস পালন কেন্দ্রিক যেসব কার্য সম্পাদিত হয় এর অধিকাংশের সাথেই শিরক জড়িত। আজকে সারা বিশ্বে দিবস পালনের যে প্রতিযোগিতা চলছে তার সাথে ইসলামী জীবনব্যবস্থার কোন সম্পর্ক নেই। এভাবে শিরক ও শিরক সম্পর্কিত কার্যাবলী আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে তা ভয়াবহ। এভাবে আমরা জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে প্রতিনিয়ত নির্দ্বিধায় শিরক করে নিজেদেরকে জাহান্নামের খোরাক বানাচ্ছি। তাই আমাদের সকলকে শিরক সম্পর্কে সর্বাধিক সচেতন হতে হবে।
শিরকের ফলাফল ও পরিণতি :
আমাদের জ্ঞাত-অজ্ঞাতসারে অগণিত শিরক করা হয়ে যাচ্ছে। অথচ একবার ভেবেও দেখিনি যে, শিরককারীর শেষ পরিণতি বা ফলাফল কী। পাপ সমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় পাপ হচ্ছে শিরক। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শিরক করল সে গুরুতর পাপে পাপী হল’ (নিসা ৪৮)। লোকমান হাকীম তার সন্তানকে বলেছিলেন, ‘হে বৎস! আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবে না, নিশ্চয়ই শিরক বড় ধরনের যুলুম’ (লোকমান ১৩)।
শিরক ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। মহান আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল ও দয়ালু। বান্দার যত গুনাহ রয়েছে তিনি চাইলে ক্ষমা করে দিবেন। কিন্তু শিরকের গুনাহ তিনি ক্ষমা করবেন না (নিসা ৪৮, ১১৬)। শিরক এমনই এক অপরাধ যে, শিরক করলে পূর্বের সকল আমল নষ্ট হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন, ‘আপনার প্রতি এবং আপনার পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছে যে, যদি আপনি আল্লাহর শরীক স্থাপন করেন, তাহলে আপনার কর্ম নিষ্ফল হয়ে যাবে। আর আপনি ক্ষতিগ্রস্তদের একজন হবেন’ (যুমার ৬৫)। আরো বলেন, ‘যদি তারা শিরক করত তবে তাদের আমলসমূহ নষ্ট হয়ে যেত’ (আন‘আম ৮৮)। শিরক এমন এক গুরুতর অপরাধ যে, তা শিরককারীর জন্য জান্নাতকে হারাম করে দেয় এবং জাহান্নাম অপরিহার্য করে দেয়। এ মর্মে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপন করে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার বাসস্থান হবে জাহান্নাম। আর অত্যাচারীদের কোন সাহায্যকারী নেই’ (মায়েদাহ ৭২)। একই মর্মে হাদীছে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক না করে মৃত্যুবরণ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি তাঁর সাথে কাউকে শরীক করে মৃত্যুবরণ করবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে (মুসলিম হা/২৬৬৩)।
শিরক ধ্বংস ও বিপর্যয়ের কারণ। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তার রাসূল মুশরিকদের থেকে দায়মুক্ত’ (তওবা ৩)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়ে আর পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে যায় অথবা বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করে’ (হজ্জ ৩১)। শিরক এমন এক জঘন্য অপরাধ যে অপরাধের কারণে উক্ত অপরাধীর জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা যাবে না। আল্লাহ বলেন, ‘নবী ও মুমিনদের জন্য উচিৎ নয় যে, তারা মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে, তারা আত্মীয়ই হোক না কেন। বিষয়টি সুস্পষ্ট হওয়ার পর যে তারা জাহান্নামী’ (তওবা ১১৩)।
শিরকের ভয়াবহতা তার শেষ পরিণতির চিত্র দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যায়। যা কল্পনা করাও কঠিন। তাই শিরক সম্পর্কে আমাদেরকে কতটুকু সচেতন হওয়া প্রয়োজন সে কথা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
সমাপনী :
পরিশেষে বলা যায়, শিরক মানব জাতির ক্ষতি সমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্ষতির কারণ। অন্যান্য অপরাধ মানুষকে যতটা অপরাধে নিক্ষেপ করবে শিরকের অপরাধ তার যেয়ে অনেক অনেকগুণ বেশী ভয়ংকর। অথচ এই শিরক বর্তমান সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। মানুষের বাস্তব জীবনের সাথে মিশে গেছে গভীরভাবে। বর্তমান সমাজের সভ্যতা-সংস্কৃতি, অনুষ্ঠানাদি, কৃষ্টি-কালচারের সাথে মিশে একাকার- বিলীন হয়ে গেছে। যা থেকে শিরককে পৃথক করা বড় দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। এরই প্রেক্ষিতে মানুষ হরহামেশা অজস্র শিরকী কর্মকান্ড করেও নিজেকে সভ্যতার চরম শিখরে উন্নীত বলে প্রমাণ করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। অগণিত শিরক কেবল সভ্যতার দোহাই দিয়ে বর্তমান সমাজে সগৌরবে চালু আছে। এমনকি এই শিরক যে মহা অপরাধের কাজ তা তারা স্বীকারও করে না। যারা এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী অবস্থান নিতে চায় তাদেরকে সম্মুখীন হতে হয় বাধা-বিপত্তির।
হে বর্তমান সময়ের শিক্ষিত সমাজ! আর কতদিন গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে মেকি সুখের নেশায় বিভোর থাকবে! এখন সময়ের দাবী গা ঝাড়া দিয়ে ওঠো। জেগে জেগে ঘুমের সময় আর নেই। ঐ শোন চারিদিকে সত্যের জয়গান প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। হাতছানি দিয়ে ডাকছে তোমায়। সারা পৃথিবীতে এখন ভিত্তিহীন, ভূয়া, দুর্নীতি, ভেজালবিরোধী শ্লোগান উঠেছে। তাই আমাদের সকলকে ফিরে যেতে হবে সূক্ষ্মভাবে সত্যানুসন্ধানে। আমাদের প্রতিটি আমলই হবে রাসূল (ছাঃ) থেকে বর্ণিত বিশুদ্ধ প্রমাণের ভিত্তিতে। নতুবা সে আমল যে অসার হয়ে পড়বে তা নতুন করে বলা নিষ্প্রয়োজন। তাই আসুন! আমার সবাই হিংসা-দ্বন্দ্ব, ভুল বুঝাবুঝি, সর্বপ্রকার গোঁড়ামী পরিহার করে শিরকমুক্ত জীবন গড়ার শপথ গ্রহণ করি। আসমান ও যমীনের মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাববুল আলামীনের সার্বভৌমত্বের জয়গান জীবনের সর্বক্ষেত্রে, পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে দেই। আল্লাহ আমাদের সে তাওফীক দান করুন। আমীন!!