দক্ষিণ এশিয়ায় আহলেহাদীছ আন্দোলন
প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম 1260 বার পঠিত
আহলেহাদীছ কোন
দল বা মতবাদের নাম নয়, এটি একটি আন্দোলন। এ আন্দোলন ছাহাবায়ে কেরামের যুগ
থেকে চলে আসা এক নির্ভেজাল অবিমিশ্র পবিত্র আন্দোলন। যার একমাত্র উদ্দেশ্য
হচ্ছে পৃথিবীর বুকে ইসলামের দাওয়াতকে ছড়িয়ে দেয়া ঠিক সেভাবে যেভাবে মহান
আল্লাহ কর্তৃক এ দ্বীন নাযিল হয়েছে এবং রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক প্রচারিত হয়েছে।
সালাফে ছালেহীন তথা ছাহাবী, তাবেঈ, তাবে‘ তাবেঈন ও তাঁদের অনুসারীদের সঠিক
বুঝ অনুযায়ী পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনুসরণের প্রতি দাওয়াত দানের উপর
ভিত্তি করেই এ আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত। এ আন্দোলন আক্বীদা-আমল, ইবাদত-বন্দেগী,
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, রাজনীতি, সমাজনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে কথা-কর্ম ও
দিক-নির্দেশনায় সালাফে ছালেহীনের মাসলাক অনুযায়ী পবিত্র কুরআন ও ছহীহ
হাদীছকেই অনুসরণ করে এবং তাকে মানদন্ড হিসাবে উপস্থাপন করে। মূলতঃ ইসলামের
প্রতিটি হুকুম-আহকামকে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করার সাথে সাথে মানবসমাজে
প্রচলিত যাবতীয় শিরক-বিদ‘আত ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধেই তাদের আপোষহীন
সংগ্রাম।
অন্যদিকে বৈশিষ্ট্যগতভাবে আহলেহাদীছ বলতে তাদেরকে বুঝায় যারা কিতাব ও সুন্নাতের যথাযথ অনুসরণ করে এবং দ্বীনের যাবতীয় কর্মকান্ডে কুরআন ও হাদীছের উপর নির্ভর করে। অতএব ইলমুল হাদীছ ও উছূলুল হাদীছে যার অগাধ জ্ঞান নেই অথচ কিতাব ও সুন্নাতের অনুসারী তিনিও আহলেহাদীছ হিসাবে পরিগণিত হবেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি হাদীছ ও ইলমুল হাদীছে পারদর্শী কিন্তু আক্বীদা-বিশ্বাস, জ্ঞান ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে আহলেহাদীছের পরিপন্থী সে আহলেহাদীছ নয়। তবে যদি কেউ আহলেহাদীছদের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলে তাহলে তাদের মত ছওয়াব ও সম্মান-মর্যাদা লাভ করবে। মোদ্দাকথা আহলেহাদীছ হচ্ছে সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গভাবে কিতাব ও সুন্নাতের অনুসারী (মুহাম্মাদ মুহিববুদ্দীন আবূ যুবায়ের, খাছাইছু আহলিল হাদীছ ওয়াস সুন্নাহ, পৃ. ১৮-১৯)।
আহলেহাদীছের পরিচয় :
ফারসী সম্বন্ধ পদে ‘আহলেহাদীছ’ ও আরবী সম্বন্ধ পদে ‘আহলুলহাদীছ’ অর্থ ‘হাদীছের অনুসারী’। প্রচলিত অর্থে কুরআন ও হাদীছের নিরপেক্ষ অনুসারীকে ‘আহলেহাদীছ’ বলা হয়। যিনি জীবনের সর্বক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সিদ্ধান্তকে নিঃশর্তভাবে মেনে নিবেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের তরীক্বা অনুযায়ী নিজের সার্বিক জীবন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবেন, কেবলমাত্র তিনিই এ নামে অভিহিত হবেন।
আহলেহাদীছগণ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ভিত্তিতে জীবন সমস্যার সমাধান তালাশ করেন এবং তাদের নিকটে কোন সমস্যার উদ্ভব হলে তারা সর্বপ্রথমেই পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দিকে প্রত্যাবর্তন করেন। অর্থাৎ তারা সর্বাবস্থায় কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সিদ্ধান্তকে সবার উপরে স্থান দিয়ে থাকেন।
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) আহলেহাদীছের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, ‘আহলেহাদীছ ওয়াস সুন্নাহ হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যতীত যাদের অন্ধভাবে অনুসরণীয় কোন ব্যক্তিত্ব নেই। তাঁরা রাসূলের কথা ও অবস্থা সম্পর্কে অধিক অবগত এবং সেগুলির ছহীহ ও যঈফের পার্থক্য নিরূপণে অত্যধিক গুরুত্ব প্রদানকারী, তাদের নেতৃবৃন্দও এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ পন্ডিত, এসবের (হাদীছের) অর্থ ও তত্ত্ব সম্পর্কে অভিজ্ঞ। আর তারা বিশ্বাসে, কর্মে ও ভালবাসায় হাদীছের অনুসারী। যারা হাদীছকে ভালবাসে তাদের সাথে তারা বন্ধুত্ব স্থাপন করে, আর যারা হাদীছের সাথে বিদ্বেষ পোষণ করে তাদেরকে শত্রু ভাবে’ (মাজমূ‘আহ ফাতাওয়া, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৯৫)। ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন, ‘আমাদের নিকটে আহলেহাদীছ হলেন তারা যারা হাদীছের উপরে আমল করেন’ (ইবনু হাজার আসক্বালানী, আন-নুকাত আলা মুকাদ্দামা ইবনিছ ছালাহ, ১ম খন্ড, পৃঃ ৫১-৫২)।
আহলেহাদীছগণের পরিচয় দিতে গিয়ে Encyclopaedia of Islam-এ বলা হয়েছে, AHL-I-HADITH: The Followers of the prophetic traditions, who profess to hold the same as the early Ashab-al-hadith or Ahl-al-hadith (as opposed to Ahl-al-ray). They do not hold themselves bound by `Taqlid' ... but consider themselves free to seek guidance in mathers of religious faith and practices from the authentic traditions which together with the Quran are in their view the only worthy guide for the true muslims. The Ahle hadith try to go back to first principles and to restore the original simplicity and purity to faith and practices. ‘আহলেহাদীছ বলতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাদীছের অনুসারী দলকে বুঝায়। যারা প্রাথমিক যুগের আহলেহাদীছ বা আছহাবে হাদীছের ন্যায় মত পোষণ করে থাকেন (আহলুর রায়-এর বিপরীত)। যারা তাক্বলীদের বন্ধন স্বীকার করেন না। বরং স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে ছহীহ হাদীছের অনুসরণ করে থাকেন। যারা কুরআন ও ছহীহ হাদীছকেই যথার্থ পথ প্রদর্শক বলে মনে করেন। আহলেহাদীছগণ ইসলামের প্রাথমিক যুগের নীতি সমূহের দিকে ফিরে যেতে চান এবং আক্বীদা ও আমলের মৌলিক সরলতা ও স্বচ্ছতাকে পুনরুদ্ধার করতে প্রচেষ্টা চালান’।
পন্ডিত Titus Murray বলেন, Whatever the prophet Muhammad taught in the Quran and the authoritative Traditions (Ahadith Sahih), that alone is the basiss of the religion known as the Ahl-i-hadith. The tenets of the sect give clear exppression to the zeal which seeks to go back to first principles and to restore the original simplicity and sincerity of faith and practice. ‘কুরআন ও ছহীহ হাদীছ সমূহে যা কিছু শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, একমাত্র তাকেই যারা ধর্মের ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করেন, তারাই হলেন ‘আহলেহাদীছ’। ইসলামের প্রথম যুগের মূলনীতির দিকে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে এবং তার মৌলিক সরলতা, আক্বীদা ও আমলের স্বচ্ছতা পুনরুদ্ধার করার ব্যাপারে তাঁদের যথেষ্ট আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়’।
বস্ত্তত আহলেহাদীছ কোন মাযহাবের নাম নয়; বরং যারা শুধুমাত্র পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছকেই জীবন চলার পথে দিক নির্দেশনা হিসাবে মেনে নেন এবং এতদুভয়ের আদেশ-নিষেধকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দেন ও তদনুযায়ী আমল করেন তারাই আহলেহাদীছ বলে অভিহিত হবেন।
আহলেহাদীছ নামকরণের কারণ :
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-কুরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদের ডীন মুহিববুদ্দীন আবূ যুবায়ের বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাদীছ লাভ, ছহীহ ও যঈফের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ, ছহীহ-যঈফ অনুধাবন, হাদীছ সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা এবং দ্বীনের যাবতীয় বিষয়ের ক্ষেত্রে হাদীছের উপর আমল করতে মনোনিবেশকরণ ও গুরুত্ব প্রদানের কারণে তাদের এ নাম রাখা হয়েছে’ (খাছাইছু আহলিল হাদীছ, পৃ. ১৭)।
আল্লামা শাহরাস্তানী বলেন, ‘তাদের নাম রাখা হয়েছে আহলুলহাদীছ। কেননা হাদীছ সংরক্ষণ ও সংকলনে তারা বিশেষ গুরুত্ব ও মনোযোগ দিয়ে থাকে, আহকাম বা বিধানের দলীলের উপর নির্ভর করে, খবর বা আছার পেলে তারা কিয়াসে জলী বা খফীর দিকে প্রত্যাবর্তন করে না’ (ঐ, পৃ. ২০)।
আল্লামা লালকাঈ বলেন, ‘যারা এই আছারের উপর নির্ভর করে তারা সুন্নাতের অনুসারীদের অন্তর্ভুক্ত, তারা আহলেহাদীছ নাম ধারণের অধিকতর উপযোগী, এ বৈশিষ্ট্যের সর্বাধিক হকদার এবং এ প্রতীকের জন্য বিশিষ্টতর। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মাধ্যমে তাদের বিশিষ্ট হওয়া, তাঁর কথার অনুসরণ, তাঁর সাহচর্যকে দীর্ঘায়িত করা, তাঁর ইলমকে প্রচার করা, তাঁর ব্যক্তিত্ব ও কর্মকে সংরক্ষণ করার কারণে। তাঁর নিকট থেকে তারা ইসলামকে সরাসরি গ্রহণ করেছে, তাঁর শরী‘আতকে প্রত্যক্ষভাবে ধারণ করেছে, তাঁর বিধি-বিধানকে পর্যবেক্ষণ করে কোন মাধ্যম ও মধ্যস্থতাকারী ব্যতিরেকে গ্রহণ করেছে। তারা হাদীছকে পর্যবেক্ষণ করে প্রচার করে, মৌখিকভাবে সংরক্ষণ করে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাসূলের নিকট থেকে দ্বীনকে লুফে নেয়, তাঁর যবানী থেকে লাভ করে এবং এর সবকিছুকে সত্য বলে বিশ্বাস করে। আর ঐসবকে আন্তরিক দৃঢ় বিশ্বাস সহকারে খালেছ অন্তরে গ্রহণ করে’ (ঐ, পৃ. ২০)।
ইমাম ইসফারাইনী বলেন, ‘উম্মতের মধ্যে তাদের চেয়ে রাসূলের হাদীছের অধিক অনুসারী এবং এদের চেয়ে বেশী তাঁর সুন্নাতের পাবন্দও কেউ নেই। একারণে তাদের নামকরণ করা হয়েছে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ (ঐ, পৃ. ২৩)।
আহলেহাদীছদের নির্দশন :
আহলেহাদীছদের কিছু মূলনীতি আছে যার উপরে তারা চলে। অনুরূপ তাদের কিছু নির্দশনও আছে যার মাধ্যমে তাদের চেনা যায়। এখানে তাদের গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় নিদর্শন উল্লেখ করা হলো।-
১. আহলেহাদীছগণ হাদীছ মানার স্বার্থে মানুষের কথা পরিহার করে। আর বিদ‘আতীরা মানুষের উক্তির স্বার্থে হাদীছকে পরিত্যাগ করে।
২. আহলেহাদীছগণের নিকটে মানুষের বক্তব্য পেশ করা হ’লে যা হাদীছের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ও সামঞ্জস্যশীল তা গ্রহণ করে। আর যা হাদীছের বিপরীত হয় তা বর্জন করে। পক্ষান্তরে বিদ‘আতীদের নিকট মানুষের বক্তব্য পেশ করা হলে যা তাদের মতের সাথে মিলে যায় তা গ্রহণ করে, আর যা তাদের মতামতের বিপরীত হয় তা পরিহার করে।
৩. আহলেহাদীছদের নিকট রাসূলের ছহীহ হাদীছ উপস্থাপিত হলে তারা সে হাদীছের উপর আমল করা থেকে বিরত হয় না; বরং তার উপর কে আমল করছে বা কে বিরোধিতা করছে সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে তারা ঐ হাদীছের উপর আমলের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়।
৪. আহলেহাদীছগণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যতীত নির্দিষ্ট কোন উক্তি বা ব্যক্তির প্রতি সম্বন্ধিত হন না। সুতরাং তাদের এমন কোন উপাধি নেই, যা দ্বারা তারা পরিচিত হয় এবং কোন নিসবত নেই যার দিকে তারা সম্বন্ধিত হয়, কেবল আহলেহাদীছ ছাড়া। আর বিদ‘আতীরা কখনো নির্দিষ্ট বক্তব্য, কাজ বা লোকের দিকে সম্বন্ধিত হয়। যেমন মুরজিয়া, কাদরিয়া, নাজ্জারিয়া, যাররাবিয়া, খারেজী, রাফেযী ইত্যাদি।
৫. আহলেহাদীছগণ ছহীহ হাদীছ এবং সালাফে ছালেহীনের আছারের প্রতি সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। আর বিদ‘আতীরা তাদের নিজস্ব বক্তব্য ও মাযহাবের সহযোগী-সাহায্যকারী মাত্র।
৬. আহলেহাদীছগণ যখন হাদীছ উল্লেখ করেন এবং কেবল তার দিকেই মানুষকে আহবান করেন, তখন বিদ‘আতীদের অন্তর তাকে ঘৃণা করে এবং তারা তা থেকে দূরে চলে যায়। ফলে তাদের অবস্থা হয় এরূপ যেমন আল্লাহ বলেন, ‘যখন আপনি কুরআনে আপনার পালনকর্তার একত্ব পাঠ করেন, তখন অনীহাবশত ওরা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে চলে যায়’ (বানী ইসরাঈল ৪৬)।
আবার যখন বিদ‘আতীদের নিকট তাদের অনুসরণীয় ব্যক্তিদের কথা ও তাদের বাণী উল্লেখ করা হয়, তখন তারা আনন্দিত হয়। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘যখন খাঁটিভাবে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়, তখন যারা পরকালে বিশ্বাস করে না তাদের অন্তর সংকুচিত হয়ে যায়, আর যখন আল্লাহ ব্যতীত অন্য উপাস্যদের নাম উচ্চারণ করা হয়, তখন তারা আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠে’ (যুমার ৪৫)।
৭. আহলেহাদীছগণ হক্ব চিনে এবং তাঁরা সৃষ্টির প্রতি অনুগ্রহশীল। সুতরাং ইলমের খেদমত ও সৃষ্টির প্রতি অনুগ্রহের ক্ষেত্রে তাদের সীমাহীন আন্তরিকতা রয়েছে। পক্ষান্তরে বিদ‘আত পন্থীরা স্রষ্টাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে ও সৃষ্টিকে অস্বীকার করে। ফলে তাদের জ্ঞান নেই এবং সৃষ্টির প্রতিও অনুগ্রহ নেই। আহলেহাদীছগণ তাদের কাছে দলীল উপস্থাপন করলে বিদ‘আতপন্থীরা তাদের বন্দী ও হত্যা করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে।
৮. আহলেহাদীছগণ তাদের নবীর সুন্নাতের প্রতি নমনীয় এবং সর্বক্ষেত্রে তার দিকেই প্রত্যাবর্তন করে। আর বিদ‘আতীরা তাদের অনুসরণীয় ইমামের বাণীর প্রতি নমনীয় ও তার প্রতি প্রত্যাবর্তিত হয়।
৯. আহলেহাদীছগণ কুরআন, হাদীছ ও ছাহাবায়ে কেরাম যে নীতির উপরে ছিলেন তাকেই তাদের মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করে এবং সকল সমস্যায় সেগুলি অনুযায়ী বিচার-ফয়ছালা করে। আর যারা এসবের বিরোধিতা করে তারা ফাসেকী ও কুফরী করছে বলে মনে করে।
১০. আহলেহাদীছগণের নিকটে যখন বলা হয় যে, আল্লাহ বলেছেন ও আল্লাহর রাসূল বলেছেন তখন তার কাছেই তাদের অন্তর থেমে যায়। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল ব্যতীত অন্যের দিকে ফিরে যায় না, কে কি বলল, তার দিকে দৃষ্টিপাতও করে না। কিন্তু বিদ‘আতীরা তার ব্যতিক্রম।
১১. হাদীছ ছহীহ হোক বা যঈফ হোক যেটা বিদ‘আতীদের মতামতের সাথে মিলে যায় সেটা তারা গ্রহণ করে। আর যেটা তাদের মতামতের সাথে মিলে না ছহীহ হাদীছ হলেও সেটাকে তারা পরিত্যাগ করে। যদি কোনভাবে তা প্রত্যাখ্যান করতে না পারে তাহলে বক্রভাবে অগ্রহণযোগ্য ও ঘৃণিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে তা থেকে দূরে থাকে, যাকে তাহরীফ বলা যায়। আর আহলেহাদীছগণের হাদীছের বিপরীতে নিজস্ব কোন মতামত নেই (খাছাইছু আহলিল হাদীছ, পৃ. ২৭-২৯)।
পরিশেষে আমরা বলব, আহলেহাদীছ একটি গুণবাচক নাম, একটি উপার্জিত বা অর্জিত উপাধি যা উম্মতে মুহাম্মাদীর ভূষণ সদৃশ। কর্মের সাথে, আমলের সাথে, ইচ্ছার সাথে, সাধনার পথে, চিন্তার স্রোতে ও চেতনার ব্রতে এ উপাধি মুমিন জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটা মুসলমানের জন্য, ওয়াহদানিয়াতের জন্য, একতা-সংহতির জন্য উপার্জিত একটি নিখাদ, নির্ভেজাল গুণ। এগুণে গুণান্বিতদের রাসূলের যবানীতে মুক্তিপ্রাপ্ত বলে অভিহিত করা হয়েছে।
ইসলাম যে জীবন ব্রত, কল্যাণ ও নাজাতের স্রোত, তার মূল সত্তা তাওহীদ ও রিসালাত। আর তাওহীদ ও রিসালাতের রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ, স্পর্শ নিহিত আছে কুরআন ও সুন্নাহ্তে। সেই কুরআন ও সুন্নাহর অনুসারীদের গুণবাচক নামই আহলেহাদীছ। মুসলমান, তাওহীদ ও রিসালাতের যে সতত আহবান তাই আহলেহাদীছের মুক্ত কণ্ঠের ডাক। আর কুরআন-সুন্নাহর অনুশাসনে যে জীবন, যে সাধনা, যে সংগ্রাম, যে আন্দোলন, যে আবেদন তাই আহলেহাদীছ। এই সতত প্রবাহমান কুরআন ও সুন্নাহর জীবন প্রতিষ্ঠাকামী আন্দোলন কোন ব্যক্তির আবির্ভাবের সাথে, যুগের সীমায় বা ভৌগলিক রেখায় সীমাবদ্ধ নয়। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের স্বর্ণ সিড়ি বেয়ে এবং নাজাতের সোপান ধরে এ আন্দোলন মহানবী (ছাঃ)-এর নেতৃত্বে তাঁর জীবদ্দশা হতে শুরু করে অদ্যাবধি চলছে সারা দুনিয়ায় তাওহীদ ও সুন্নাহর বিজয়ী পতাকা নিয়ে। মাযহাবী বেড়াজালকে ছিন্ন করে বিভক্ত মুসলিম জাতিকে কুরআন ও হাদীছের কেন্দ্রে ঐক্যবদ্ধরূপে সমবেত করার প্রচেষ্টাই আহলেহাদীছ আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য।
মুসলিম জাতি আজ শতধা বিভক্ত। অথচ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্যই আল-কুরআনের শাশ্বত আহবান। মুসলিম জনগণ আজ জ্ঞাত-অজ্ঞাতসারে শিরক-বিদ‘আতে লিপ্ত। অথচ এই জাহেলী কর্মের বিরুদ্ধেই সমস্ত নবী-রাসূল ও তাদের অনুসারী মনীষীবৃন্দের আপোষহীন সংগ্রাম। তাওহীদী শক্তির সেই চূড়ান্ত আদর্শ পরিত্যাগ ও রাসূল (ছাঃ)-এর প্রদর্শিত চিরন্তন হেদায়েতকে অগ্রাহ্য করার কারণেই মুসলিম জাতি আজ অপমানিত, ভাগ্যবিড়ম্বিত, দুর্দশাগ্রস্ত ও কুফরী শক্তির মুখাপেক্ষী। রাসূল বলেন, لَئِنْ أَنْتُمْ اتَّبَعْتُمْ أَذْنَابَ الْبَقَرِ وَتَبَايَعْتُمْ بِالْعِينَةِ وَتَرَكْتُمْ الْجِهَادَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ لَيُلْزِمَنَّكُمْ اللَّهُ مَذَلَّةً فِي أَعْنَاقِكُمْ ثُمَّ لَا تُنْزَعُ مِنْكُمْ حَتَّى تَرْجِعُونَ إِلَى مَا كُنْتُمْ عَلَيْهِ وَتَتُوبُونَ إِلَى اللَّهِ – অর্থাৎ যদি তোমরা ঈনা বিক্রয় কর, ষাড়ের লেজ ধরে থাক এবং কৃষিকাজে লিপ্ত থাকার কারণে জিহাদ পরিত্যাগ কর, তবে আল্লাহ তোমাদের উপর এমন অপমান প্রবল করে দেবেন যে, যতক্ষণ না তোমরা দ্বীনের উপর পূর্ণরূপে প্রত্যাবর্তন করবে এবং তওবা করবে, ততক্ষণ আল্লাহ তোমাদের থেকে ঐ অপমান দূর করবেন না (আবু দাউদ, হা/৩০০৩; আহমাদ, হা/৫৩০৪)।
দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণে সমস্ত মানব মন্ডলীর নিকট পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছকে নির্ভেজাল রূপে উপস্থিত করতে প্রতিটি মুসলিম দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আর এজন্য সবাইকে কুরআন ও সুন্নাহর নিঃশর্ত অনুসারী হ’তে হয়। আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রায়োগিক ও ব্যবহারিক অর্থও তাই। ছহীহ হাদীছের উপর আমলের মাধ্যমেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে মুহাববাত করার মোক্ষম উপায়। আর ছহীহ হাদীছের উপর আমল করার মধ্যেই কল্যাণ, মাগফিরাত ও নাজাত নিহিত। আহলেহাদীছগণ সেই মহাগ্রন্থ আল-কুরআন ও মহানবী (ছাঃ)-এর অমীয় বাণী ছহীহ হাদীছের উপর আমল করার উদাত্ত আহবান জানায় দুনিয়ার মানুষকে।
ঈমান ও আক্বীদায়, ইবাদত-বন্দেগীতে এবং ইনসাফ ও ইহসানে উম্মতে মুহাম্মাদীকে পুরাপুরিভাবে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অনুসরণ ও অনুকরণ ব্যতীত দুনিয়া ও আখিরাতের কোন কল্যাণ, নাজাত আর মাগফিরাত কামনা নিষ্ফল। তাই আসুন, সবাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের রেযামন্দী হাছিলের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে তাক্বলীদে শাখছী পরিহার করে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের স্বচ্ছ স্রোতধারায় একতাবদ্ধ হয়ে তাওহীদী কালিমার নাজাতী কাফেলা ‘আহলেহাদীছে’র পতাকাতলে সমবেত হই। নিজেদের তৈরী দ্বন্দ্বমুখর তথাকথিত আদর্শিক সংকট পরিহার করে ও সর্বোতভাবে বর্জন করে ‘উসওয়াতুন হাসানাহ’ মহামানব ও বিশ্বনবী (ছাঃ)-এর আদর্শকে অনুকরণ, অনুসরণ ও মনে প্রাণে লুফে নেই। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!!