শায়খ শু‘আইব আরনাঊত্ব (রহঃ)

দেলোয়ার হোসাইন 1410 বার পঠিত

[শায়খ শুআইব আরনাঊত (রহঃ) ১৯২৮ সালে সিরিয়ার রাজধানী দামেশকে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২৬ সালে তাঁর পিতা দামেশকে সপরিবারে হিজরত করেন। পিতা-মাতার তত্ত্বাবধানে তিনি খাঁটি ধর্মীয় পরিবেশে বেড়ে উঠেন। ছোটবেলায় তিনি কুরআন মাজীদের বৃহদাংশ মুখস্থ করেন। অতঃপর প্রায় ১০ বছর যাবৎ দামেশকের মসজিদ ও প্রাচীন মাদরাসা সমূহে নাহু, ছরফ, সাহিত্য, বালাগাত (অলংকার শাস্ত্র) প্রভৃতি অধ্যয়ন করেন। আরবী ভাষায় দক্ষতা অর্জনের পর তিনি ৭ বছর যাবৎ ইসলামী ফিক্বহ বা আইনশাস্ত্র অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন। এ সময় তিনি উছূলে ফিক্বহ, তাফসীর, মুছত্বলাহুল হাদীছ (হাদীছের মূলনীতি অভিজ্ঞান) প্রভৃতি শাস্ত্রেও ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। ফিক্বহ শাস্ত্র অধ্যয়নকালে তাঁর শিক্ষকমন্ডলী ও সমকালীন আলেমদের মাঝে ছহীহ ও যঈফ হাদীছ যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দুর্বলতা লক্ষ্য করেন। এর ফলে ইলমে হাদীছে ব্যুৎপত্তি অর্জনের লক্ষ্যে তিনি আরবী ভাষা পাঠদানের পেশা ত্যাগ করে পুরাপুরি তাহকীকী কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৫৮ সাল থেকে তিনি দামেশকের আল-মাকতাবুল ইসলামী প্রকাশনা সংস্থার গবেষণা বিভাগের প্রধান হিসাবে ২০ বছর যাবৎ দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি বিভিন্ন বিষয়ে ৭০ খন্ডের বেশী গ্রন্থ তাহকীক করেন বা তাহকীকী কর্মের তত্ত্বাবধান করেন। এরপর ১৯৮২ সাল থেকে তিনি আম্মানের মুআসসাসাতুর রিসালাহ নামক খ্যাতনামা প্রকাশনীর গবেষণা বিভাগের প্রধান হিসাবে গবেষণা কার্যক্রম অব্যাহত  রাখেন। তাঁর নিজস্ব তাহকীককৃত এবং তাঁর তত্ত্বাবধানে তাহকীককৃত গ্রন্থের সংখ্যা ২৪০ খন্ডের বেশী। এতে তাফসীর, হাদীছ, ফিক্বহ, আক্বীদা, জীবনীগ্রন্থ, মুছত্বলাহুল হাদীছ, সাহিত্য প্রভৃতি শামিল রয়েছে। তাঁর তাহকীককৃত গ্রন্থের মধ্যে মুসনাদে আহমাদ (৫০ খন্ড), যাহাবীর সিয়ারু আলামিন নুবালা (২৫ খন্ড), আল-ইহসান ফী তাকরীবে ছহীহ ইবনু হিববান (১৮ খন্ড), বাগাবীর শারহুস সুন্নাহ (১৬ খন্ড), নববীর রওযাতুত তালেবীন (১১ খন্ড), ইবনুল জাওযীর যাদুল মাসীর ফী ইলমিত তাফসীর (৯ খন্ড), ইবনুল ক্বাইয়িমের যাদুল মাআদ (৫ খন্ড) প্রভৃতি অন্যতম। এগুলির মধ্যে মুসনাদে আহমাদের তাহকীক সবচেয়ে জনপ্রিয়। আধুনিক বিশ্বে হাদীছ তাহকীকে যে তিনজন মুহাদ্দিছ খ্যাতি লাভ করেছেন তারা সবাই আলবেনীয় বংশোদ্ভূত। এরা হলেন শায়খ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (১৯১৪-১৯৯৯ খৃ.), শায়খ শুআইব আরনাঊত ও শায়খ আব্দুল কাদের আরনাঊত (১৯২৮-২০০৪ খৃ.)। তন্মধ্যে শায়খ আলবানীর তাহকীক সবচেয়ে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। এরপরে রয়েছেন শুআইব আরনাঊত। ২৭শে অক্টোবর১৬ তিনি ৯০ বছর বয়সে জর্ডানের রাজধানী আম্মানে মৃত্যুবরণ করেন। ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তাঁর এই সাক্ষাৎকারটি আরবী থেকে অনুবাদ করেছেন দেলোয়ার হোসাইন। - সম্পাদক]

প্রশ্ন : আপনার জন্ম, বেড়ে উঠা, জ্ঞানার্জন, প্রিয় শিক্ষক ও লেখালেখি সম্পর্কে জানতে চাই।

উত্তর : আমি সাধারণ ছাত্রদের মতই বেড়ে উঠেছি। যখন আমি ব্যবসা করতাম তখন পুরাতন দামেশকের একটি এলাকা সারুজা বাযারে একজন শায়খ আছরের পর আমার দোকানে আসতেন। সেখানকার মানুষেরা সে যুগে আছরের পর আমোদ ফূর্তি করত। এসময় তারা অন্য কোন কাজ করত না। এই শায়খ এসে আমাদেরকে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই আমাদেরকে আরবী ভাষা শিক্ষা দিতেন। এর পাশাপাশি আব্দুল হাকীম আফগানী’র ‘শরহুল কানয’ ও হাশিয়াও তার কাছে পড়েছি।

এমনিভাবে শায়খ ছালেহ ফুরফুরের কাছেও কতিপয় কিতাব পড়েছি। যেমন তাফসীরুন নাছাফী, শারহুল মানার ফিল ঊছূল, ছহীহ মুসলিম, বদরুদ্দীন আইনী (রহঃ) রচিত ছহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘উমদাতুল ক্বারী’ প্রভৃতি আরও অনেক গ্রন্থ আমি তার কাছে পড়েছি। যেমন আল-বালাগাতুল ওয়াযিহা, শরহু ইবনু আক্বীল এবং মানত্বিক। এ যুগে তো মানত্বিকের কোন মূল্য নেই বললেই চলে।

আমার শিক্ষকদের মধ্যে আরও ছিলেন সুলাইমান আল-গাওয়াজী প্রমুখ যাদের কাছে আমি নাহু পড়েছি। তারা উছমানী পদ্ধতিতে আমাদের শিক্ষাদান করতেন। অর্থাৎ তারা প্রথমে পড়াতেন শায়খ আল-বার্জাভীর ‘আল-আওয়ামেল ওয়াল ইযহার’, অতঃপর ইবনু হাজারের আল-কাফিয়া, যেটি এখনও বহুল প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ। এমনিভাবে তাঁর নিকট মারাকীল ফালাহ ও হাশিয়াতুত তাহতাবীও পড়েছি।

শায়েখ নাছীরুদ্দীন আলবানীর পিতার কাছে আবুল হাসান কুদূরী (রহঃ)-এর লিখিত হানাফী ফিকহ গ্রন্থটি পড়েছি, যেটি হানাফী মাযহাবীদের কাছে একটি নির্ভরযোগ্য কিতাব। তাছাড়াও তার কাছে ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে পড়েছি। আমি তাঁর সান্নিধ্যে তিন বছর ছিলাম। এ সময় আমি তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতাম আর তিনি উত্তর দিতেন। আমি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি এজন্য যে তিনি ইলম অর্জনকে আমার জন্য প্রিয়তর করে দিয়েছিলেন।

দীর্ঘ আট বছর লেখাপড়ার পর আমি শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করলাম। অতঃপর আমি ‘আল-ফাতহুল ইসলামী’ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হ’লাম, যে প্রতিষ্ঠানের এক বিরাট সংখ্যক ছাত্র উচ্চমাধ্যমিক, অনার্স এবং মাস্টার্স সহ বিভিন্ন স্তরে পড়াশোনারত রয়েছে। তাদের কেউ ডক্টরেট সম্পন্ন করতে চাইলে মিসরে গিয়ে তাদের আকাংখ্যা পূরণ করত। বলা যায় আমি এবং শায়খ আদীবুল কালাসের জন্যই প্রতিষ্ঠানটি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সেখানে আমরা দুই বছর শিক্ষকতা করেছিলাম এবং এ সময় ছাত্রদেরকে ইসলামী জ্ঞান ও আরবী ভাষা শিক্ষা দিতাম।

তারপর এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হ’ল যে, হাদীছ অধ্যয়নের ব্যাপারে আমার প্রতীতি জন্মালো। এ বিষয়ে আমার আগ্রহ এতটাই গভীর ছিল যে, অচিরেই উছূলে হাদীছের বিভিন্ন গ্রন্থের উপর বুৎপত্তি লাভ করলাম। যেমন মুকাদ্দামাতু ইবনুছ ছালাহ, তাওযীহুল আফকার, শারহুন নুখবাহ প্রভৃতি। আমি সেদিনগুলোতে প্রতি মুহূর্তে প্রার্থনা করতাম যে, আল্লাহ যেন আমাকে মুহাদ্দিছদের দলভূক্ত করেন। আল্লাহ চাইলেন যে আমার দো‘আ কবূল করবেন। সেজন্যই বিগত চল্লিশ বছর থেকে এখনও পর্যন্ত আমি বিভিন্ন গ্রন্থের তাখরীজ এবং ইলমুল হাদীছ গবেষণায় ব্যাপৃত রয়েছি। এর ফসল হিসাবে এ পর্যন্ত আমার রচনা ও সংকলনকর্ম ২০০ খন্ড অতিক্রম করেছে।

প্রশ্ন : মাঝে মাঝে আমরা এ কথা শুনতে পাই যে, হাদীছের সনদ (সূত্র) গবেষণার গুরুত্ব শেষ হয়ে গেছে। এখন আর এ দিকে লক্ষ্য করা উচিত নয়। আবার মাঝে মাঝে এমন কিছু লোক দেখতে পাই যারা সনদের গবেষণাকে খুবই গুরুত্ব দেন। এমনকি ছহীহ বুখারী ও মুসলিমের সনদগুলোতেও তারা নতুন করে গবেষণা করেন এবং হুকুম আরোপের চেষ্টা করেন । এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?

উত্তর : আমার দৃষ্টিকোণ থেকে বলব, হাদীছের সনদ বিচার-বিশ্লেষণের বিষয়টি ইজতিহাদী। কোন বিদ্বানবিশেষের উপর সন্দেহাতীতভাবে এই বিচার-বিশ্লেষণ নির্ভর করে না। কেননা প্রত্যেক বিদ্বান সংশ্লিষ্ট হাদীছের বিষয়ে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। যখন তিনি কোন হাদীছের বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছান, তখন তা অন্য কোন বিদ্বানের দৃষ্টিতে ভুলও হতে পারে কিংবা সঠিকও হতে পারে। এজন্য মুনযিরী (রহঃ) একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন এ বিষয়ে এবং তাতে উল্লেখ করেছেন যে, হাদীছের উপর হুকুম প্রদানের বিষয়টি ইজতিহাদী, যা গবেষকের বোধগম্যতা ও  গবেষণা দক্ষতার উপর নির্ভর করে। দীর্ঘদিনের সাধনা এবং সনদ সম্পর্কে গভীর অনুশীলনের মাধ্যমে এ যোগ্যতা অর্জিত হয়। তবে হাদীছের সনদ বিচার-বিশ্লেষণের এ কাজ বর্তমানে প্রায় সমাপ্ত হয়ে গেছে। আমরা বলতে পারি যে, এই যুগে সনদের উপর পূর্ণভাবে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে এবং আমিও এই ময়দানের একজন কর্মী। আরও অনেক বিদ্বান রয়েছেন যারা সনদ তাহক্বীকের ময়দানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন এবং যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তাদের সকল গবেষণা এবং আমাদের গবেষণা মিলিয়ে এ কথা নিশ্চয় করে বলতে পারি যে, সনদের দিক থেকে হাদীছ শাস্ত্রের প্রায় নববই শতাংশের তাহক্বীক সম্পন্ন হয়েছে এবং তার উপর হুকুম আরোপ করা হয়ে গেছে।

আর মতন (হাদীছের মূল অংশ) সমালোচনার বিষয়ে আমার বক্তব্য হ’ল যে, যখনই একজন মানুষ কোন হাদীছের সনদ মূল্যায়ন করবে, তখন অবশ্যই মতনের শুদ্ধতাও মূল্যায়ন করবে। কেননা বিদ্বানগণ ছহীহ হাদীছের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন যে, বর্ণনাকারীকে ন্যায়পরায়ণ ও সৎ হ’তে হয়। তেমনিভাবে হাদীছটি যেন শায ও ইল্লতযুক্ত না হয়। আর শায ও ইল্লত হ’ল সনদ ও মতন উভয়ের সমালোচনা। এক্ষেত্রে আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই যে, কোন ব্যক্তি দীর্ঘ প্রচেষ্টা, সামগ্রিক অনুশীলন, অধিকতর জ্ঞানার্জন এবং এমন তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি, যা তাকে ভুল পথে যেতে দেয় না-ইত্যাদি গুণ ছাড়া এই গবেষণায় সফল হ’তে পারে না। এজন্যই আমি চাই যে, মতন সমালোচনায় কেবল বিজ্ঞজনেরাই যেন আত্মনিয়োগ করেন। সুতরাং এমন একটি প্রতিষ্ঠান থাকা প্রয়োজন, যেখানে মতন মূল্যায়নের জন্য আলাদা গবেষণা পরিচালিত হবে। আমি আশা করি যে আমার এ মতটি সঠিক। কেননা এজাতীয় বিষয়ে একক ব্যক্তির চিন্তাধারার তুলনায় একাধিক ব্যক্তির চিন্তাধারা অধিকতর সঠিক হবে ইনশাআল্লাহ।

প্রশ্ন: ইমাম আল-মিয্যী (রহঃ)-এর তাহযীবুল কামাল এবং ইবনু হাজার আসক্বালানীর (রহঃ)-এর তাহযীবুত তাহযীব গ্রন্থদ্বয় একজন গবেষকের জন্য কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ? এগুলো একটি অপরটির পরিপূরক কি-না?

উত্তর : যিনি হাদীছ তাখরীজের কাজ করেন, তার জন্য আবশ্যক হ’ল ‘তাহযীবুল কামাল’ গ্রন্থটি থাকা। কেননা রাবীদের ব্যাপারে দেখা যায় যে, কখনও এভাবে এসেছে- যেমন ‘মুজাহিদ’। কে এই ‘মুজাহিদ’? একজন গবেষক যখন ‘তাহযীবুল কামাল’ কিতাবটি অধ্যয়ন করবে তখন সেখানে এই রাবীর ছাত্র ও শিক্ষকের আলোচনা পাবে, যেখান থেকে সে সহজেই এই মুজাহিদ নামের রাবীকে চিনতে সক্ষম হবে। রাবীর পরিচয় জানার জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাছাড়া এই কিতাবটিতে কুতুবে সিত্তাহর রাবীদের জীবনী একত্রিত করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিজন রাবীর শিক্ষক এবং ছাত্রমন্ডলী যাদের নাম কুতুব সিত্তাহ-এ উল্লেখিত হয়েছে, তাদের বিস্তারিত পরিচয় এই গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে, যেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একইসাথে ইমাম মিয্যী (রহঃ) জারাহ-তা‘দীলের ইমামদের মন্তব্য এবং মতভেদের স্থানে প্রাধান্যযোগ্য মতটিও উল্লেখ করেছেন। তাই গবেষকের জন্য আবশ্যক হ’ল উক্ত কিতাবে বিভিন্ন ব্যক্তি সম্পর্কে বর্ণিত মন্তব্যগুলিকে একত্রিত করা অতঃপর তার উপর গবেষণা চালিয়ে পরস্পর তুলনার মাধ্যমে কাংখিত সিদ্ধান্তে পৌঁছা।

আর হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ)-এর কিতাবটি (তাহযীবুত তাহযীব) মূলতঃ ‘তাহযীবুল কামাল’-এরই সারসংক্ষেপ।

প্রশ্ন : বর্তমান সময় হাদীছের উপর ছহীহ ও যঈফ হুকুম প্রদান করার ব্যাপারে হাদীছ শাস্ত্রে অভিজ্ঞ ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী? আর হাদীছের উপর হুকুম প্রদানে এমন কোন নীতি রয়েছে যা তালেবে ইলমদের অনুসরণ করা উচিৎ?

উত্তর : তাদের জন্য উচিত প্রথমে গবেষণার সকল উপকরণ পরিপূর্ণভাবে আয়ত্ত করা। তবে গবেষণার যোগ্যতা অর্জন সত্ত্বেও সরাসরি কোন কিতাবে সে হুকুমটি লিপিবদ্ধ করা যাবে না, যতক্ষণ না হুকুমটি প্রদানের যথার্থতা-অযথার্থতা সম্পর্কে তার সুস্পষ্ট ধারণা না থাকে। আর স্বভাবতই মানুষ যখন পূর্বসূরীদের কর্মসমূহ লক্ষ্য না করে কোন কাজ করে তখন সে ভুলের মধ্যে নিপতিত হয়। সুতরাং এ ব্যাপারে পূর্ববতী ইমাম ও মুহাদ্দিছগণ কী বলেছেন, তার প্রতি লক্ষ্য রাখা আবশ্যক। বিশেষ করে যে সকল হাদীছে হুকুম আরোপের ব্যাপারে মতনৈক্য সৃষ্টি হয়েছে সেগুলি ভালভাবে অধ্যয়ন করতে হবে। তারপর যে ফলাফল প্রকাশ পাবে তার ভিত্তিতেই হুকুম আরোপ করবে। পক্ষান্তরে কিছু পরিভাষা শিখে ও সামান্য কিছু বই-পুস্তক পড়ে তার ভিত্তিতে মানুষের সামনে কিছু প্রকাশ করলে তা ভালোর পরিবর্তে মন্দই বয়ে আনবে।

প্রশ্ন : কিছু কিছু নামধারী আলেম ছহীহ বুখারী ও মুসলিমকে নিয়ে সমালোচনা করে। তারা এই দাবী করে যে, এগুলির মধ্যে কিছু মুআল্লাক হাদীছ রয়েছে (এমন হাদীছ যার সনদের শুরু থেকে এক বা একাধিক বর্ণনাকারীর নাম বাদ দেওয়া হয়েছে) এবং কিছু শায হাদীছ রয়েছে (অধিকতর অগ্রাধিকার যোগ্য রাবীর বর্ণনার বিপরীতে কোন ছিকাহ রাবীর হাদীছ)। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?

উত্তর : এটি একটি জ্ঞানহীন কথা। আব্দুল গণী আল-মাকদাসী যেভাবে বলেছেন আমিও সেভাবে বলতে চাই যে, যদি কোন ব্যক্তি এভাবে শপথ করে যে, যদি বুখারী শরীফের সকল হাদীছ (মুসনাদসমূহ) ছহীহ হয়, তাহ’লে তালাক, তবে তালাক পতিত হবে না। কেননা নিঃসন্দেহে ইমাম যা কিছু লিপিবদ্ধ করেছেন সেগুলি ছহীহ হওয়ার ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত হয়েছিলেন। অতএব যে সমস্ত হাদীছকে তিনি এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন সেগুলি তাঁর মতে ছহীহ। কিন্তু পরবর্তী যুগের বিদ্বানরা যখন আসলেন, তখন তারা কয়েকটি হাদীছের ব্যাপারে ইজতিহাদী মতনৈক্য ও সমালোচনা করেছেন।

আমার মতে, ছাত্ররা যখন ছহীহ বুখারীর কোন হাদীছ দেখে তখন তারা যেন হাদীছটির হুকুম ইমাম বুখারীর প্রতিই সমর্পণ করে। কেননা তাঁর প্রতি হাদীছটিতে সম্বন্ধিত করা হাদীছটি ছহীহ হওয়ারই ইঙ্গিতবাহী। আর ছহীহ বুখারীর ব্যাপারে যে সকল সমালোচনা করা হয়েছে, তা কোন জ্ঞানের ভিত্তিতে করা হয়নি। যেমন ফাতহুল বারীর ভূমিকা পড়লে দেখা যায়, যে সকল হাদীছের ব্যাপারে দূর্বলতার অভিযোগ তোলা হয়েছে বা তার রাবীদের ব্যাপারে সমালোচনা করা করেছে, তার বিরুদ্ধে ইবনু হাজার আসক্বালানী কেমন যথার্থভাবে জবাব দিয়েছেন এবং ইমাম বুখারীর অবস্থানের সঠিকতা প্রমাণ করেছেন।

হ্যাঁ! এটা ঠিক যে, ইমাম বুখারী নিজেই কখনো মারফু‘ হাদীছ বর্ণনা করেছেন, অতঃপর মওকূফ হাদীছ বর্ণনা করেছেন। যাতে করে একথা বুঝা যায় যে, মওকূফ হাদীছটিই তাঁর দৃষ্টিতে সঠিক। এই গ্রন্থে তাঁর এমন বহু ইজতিহাদ রয়েছে যা মানুষের জন্য জানা আবশ্যক। যাইহোক আমি বলব যেমনভাবে ওলামায়ে কেরাম বলেন, আল্লাহর কিতাবের পর ছহীহ বুখারীর চেয়ে অধিক বিশুদ্ধ কোন গ্রন্থ নেই।

ছহীহ মুসলিম অবশ্য ছহীহ বুখারীর তুলনায় কিছুটা নিম্ন পর্যায়ের। তবে তিনিও মূলগতভাবে এতে ছহীহ হাদীছ বর্ণনা করেছেন। অবশ্য মুতাবাআ‘তের ক্ষেত্রে শর্ত কিছুটা শিথিল করেছেন। অর্থাৎ কোন হাদীছ ছহীহ সূত্রে বর্ণনা করার পর উক্ত হাদীছটির যদি আরও দুই, তিন, চারটি সনদ নিয়ে আসেন এবং এর মধ্যে যদি কোনটিতে কিছুটা দুর্বলতা থাকে, তবে তিনি হাদীছটি মুতাবাআত বা শাওয়াহেদ (সহযোগী সূত্র) হিসাবে নিয়ে আসেন। বিষয়টি ইমাম মুসলিম নিজেই উল্লেখ করেছেন।

প্রশ্ন : যে সকল রাবীর ব্যাপারে জারাহ ও তাদীল বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দিছগণ কিছু বলেননি, তাদের ব্যাপারে আপনার মত কী?

উত্তর : যাদের ব্যাপারে মুহাদ্দিছগণ কোন মন্তব্য করেননি, তাদের বর্ণিত হাদীছসমূহকে তীক্ষণভাবে যাচাই-বাছাই করতে হবে, বিশেষত যে সকল হাদীছ মুসনাদ আহমাদে এসেছে। যদি কোন রাবী এমন দেখা যায় যে কেউ তার সম্পর্কে মন্তব্য করেননি। কিন্তু ৩/৪ জনের অধিক রাবী তার নিকট থেকে বর্ণনা করেছে এবং কোন আপত্তিকর কিছু বর্ণনা করেনি; তবে সেক্ষেত্রে তার হাদীছকে আমরা দলীলযোগ্য হিসাবে গণ্য করব, যদি না তা কোন ছহীহ হাদীছের বিরোধী হয়।

প্রশ্ন : যে সকল রাবীদের ব্যাপারে জারাহ ও তাদীল বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দিছগণের মতভেদ রয়েছে, তাদের ব্যাপারে আপনার মত কী?

উত্তর : যেমনটা আমরা জারাহ ও তা‘দীলের গ্রন্থসমূহে পেয়েছি যে, সংশ্লিষ্ট মুহাদ্দিছগণের কেউ হ’লেন কঠোর, আবার কেউ হ’লেন শিথিলতা অবলম্বনকারী। অপরপক্ষে একজন রাবী যতই শক্তিশালী হননা কেন, এমনকি তার সূত্রে ইমাম বুখারী ও মুসলিম হাদীছ গ্রহণ করলেও দেখা যায় যে, কোন কোন হাদীছ বর্ণনায় উক্ত রাবীর ব্যাপারে আপত্তি থাকে। অর্থাৎ কোন ব্যক্তির পক্ষেই নিরেটভাবে সমালোচনামুক্ত থাকা সম্ভব নয়। এজন্য ইমাম শাফেঈ বলতেন যে, আমাদের কাছে একজন ছিকাহ রাবী হ’লেন তিনি, যার বর্ণনায় ভুল কম হয় এবং সঠিকটা বেশী হয়; আর যঈফ রাবী হ’লেন তিনি, যার বর্ণনায় ভুল বেশী হয়, সঠিক কম হয়। এই মূলনীতির ভিত্তিতেই আমি চলি। এর বিস্তারিত পাবেন ‘তাহরীরুত তাক্বরীব’ গ্রন্থে। যার কারণে আমি যখন দেখি যে কোন রাবীর ব্যাপারে অধিকাংশ জারাহ-তা‘দীল বিশেষজ্ঞগণ যখন ‘ছিকাহ’ মন্তব্য করছেন, তখন যদি ইবনু হাজার আসক্বালানী ‘ছাদূক’ মন্তব্য করেন; আমি ইবনু হাজারের বক্তব্য পরিত্যাগ করেছি এবং ধরে নিয়েছি যে এ ক্ষেত্রে ইবনু হাজারের সিদ্ধান্ত ভুল হয়েছে।      

প্রশ্ন : ছাত্রদের উদ্দেশ্যে আপনার কিছু পরামর্শ কামনা করছি।

উত্তর : প্রত্যেক ছাত্রের জন্য এটা জানা আবশ্যক যে, হাদীছ হ’ল ইসলামী শরী‘আতের মূল সূত্রগুলোর একটি, যার উপর মুজতাহিদগণ নির্ভর করেন। তাদের শারঈ জ্ঞানের প্রথম উৎস হ’ল কুরআন,  এরপর  সুন্নাত,  তথা হাদীছ;  এরপর

ইজমা ও কিয়াস। সকল ইমাম নির্বিশেষে এই ক্রমধারা বর্ণনা করেছেন। অতএব একজন ফক্বীহকে একাধারে একজন দ্বারা তিনি শরী‘আতের মৌলিক চারটি উছূলসহ অন্যান্য উছূলসমূহ থেকে উপকৃত হ’তে পারেন। সুতরাং শরী‘আতের কোন বিষয়ে কুরআনের বর্ণনা এবং ছাহাবীদের ব্যাখ্যা ও আমল না জেনে শুধু এককভাবে হাদীছের ইবারতের উপর নির্ভরশীল হওয়া সঠিক নয়। আর এ বিষয়ে মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা, মুছান্নাফ আব্দুর রায্যাক এবং সুনান সাঈদ ইবনু মানছূর বিশেষভাবে দেখা যেতে পারে। কেননা এ তিনটি গ্রন্থে হাদীছ উল্লেখ করার সাথে সাথে ছাহাবী এবং তাবেঈদের মন্তব্যও যুক্ত করা হয়েছে।

সবশেষে আমি দো‘আ করি আল্ল­াহ আপনাদের প্রচেষ্টায় বরকত দান করুন ও দীর্ঘ হায়াত দান করুন। আপনাদের সাথে এই সাক্ষাতে আমি খুশী হয়েছি। আপনাদের সার্বিক সাফল্য ও  অগ্রগতি কামনা করছি...।



বিষয়সমূহ: মনীষীদের জীবনী
আরও