আল্লামা মোহাম্মাদ আব্দুল্লাহেল কাফী আল-কুরায়শীর জীবনের অন্তিম মুহূর্ত
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
আব্দুল্লাহেল কাফী আল-কুরায়শী 9356 বার পঠিত
আহলেহাদীছ পরিচিতি :
আহলেহাদীছ আন্দোলন সম্পর্কে সর্ব প্রথম ইহা অবগত হওয়া আবশ্যক যে, ‘আহলেহাদীছ’ কোন মাযহাব বা ফির্কার নাম নহে। পৃথিবীতে ধর্মীয় বা রাজনৈতিক দলগুলির সংখ্যা যতই অধিক হোক না কেন, সাবধানতার সহিত লক্ষ্য করিলে ইহা প্রতীয়মান হইবে যে, মাযহাব, দল, ফির্কা অথবা পার্টির আদর্শ ও কর্মসূচী ব্যক্তিবিশেষ কর্তৃক উদ্ভাসিত ও রূপায়িত হইয়াছে এবং উদ্ভাবক ও প্রতিষ্ঠাতাকে আশ্রয় করিয়াই উক্ত ফির্কা ও মাযহাবের উত্তরকালে বিস্তৃতি ও বিকাশ ঘটিয়াছে। রাজনৈতিক ও মাযহাবী ফির্কাবন্দীর ইতিহাসে ব্যক্তি বিশেষের কেন্দ্রত্ব ও প্রাধান্য এরূপ অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করিয়া রহিয়াছে যে, ফির্কা বা পার্টির অন্তর্ভুক্ত কোন ব্যক্তি আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা ও কর্মসূচীর অনুসরণের দিক দিয়া যতই অগ্রগণ্য হউক না কেন, ফির্কার ইমাম এবং পার্টির নেতার পুরাপুরি ভক্ত ও অনুগত না হওয়া পর্যন্ত তাহার নিষ্ঠা ও কর্মতৎপরতার কোন মূল্যই স্বীকৃত হয় না। পক্ষান্তরে আদর্শ-নিষ্ঠা ও কর্মতৎপরতা অপেক্ষা ফির্কাবন্দীর ইতিহাসে দলীয় নেতার আনুগত্য এবং অন্ধ অনুসরণ অর্থ্যাৎ তকলীদকেই অধিকতর মূল্যবান স্বীকার করা হইয়াছে। কালক্রমে দলপতির ভ্রম প্রমাদগুলির ফির্কা-পরস্তের দল একান্ত শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠা সহকারে অনুসরণ করিয়া চলিতে থাকে এবং দলীয় আদর্শ ও কর্মসূচীর সহিত দলপতির ব্যক্তিগত উক্তি ও আচরণের সংঘর্ষ ঘটিলে অন্ধ ভক্তের দল নেতার উক্তি ও আচরণকেই ঊর্ধ্বে স্থান দান করে। ইহার শেষ পরিণতি স্বরূপ আদর্শ ও কর্মের সমুদয় নিষ্ঠা ও তৎপরতার পরিবর্তে দলীয় অহমিকতা, গোঁড়ামী ও অনুদারতাই ফির্কার সমুদয় কার্যকলাপকে অধিকার করিয়া বসে।
একথা কাহাকেও বলিয়া দিতে হইবে না যে, উম্মতের অন্তর্ভুক্ত কোন ইমাম, দরবেশ অথবা কূটনীতি বিশারদকে আশ্রয় ও কেন্দ্র করিয়া ‘আহালেহাদীছ আন্দোলনে’র ভিত্তি স্থাপিত হয় নাই। বিভিন্ন ফির্কার অন্তর্ভুক্ত মুসলামানগণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সার্বভৌম নেতৃত্ব স্বীকার করিয়া লইলেও কার্যতঃ উম্মতের অন্তর্ভুক্ত কোন না কোন ব্যক্তির নিজস্ব মতবাদ, দৃষ্টিভঙ্গী, ব্যাখ্যা অথবা আহলেহাদীছগণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর একচ্ছত্র নেতৃত্ব ব্যতীত উম্মতের অন্তর্ভুক্ত কোন মহাপুরুষের উদ্ভাবিত আকীদা ও সিদ্ধান্তকে আহলেহাদীছগণের আকীদা এবং মাযহাবরূপে গ্রহণ করেন নাই। এমনকি সাহাবা ও তাবেয়ীগণের মধ্য হইতেও কোন মাননীয় পুরুষকে আহলেহাদীছগণ অভ্রান্ত ও মাসূম স্বীকার করিয়া লইয়া তাঁহাকে নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করেন নাই। আহলেহাদীছগণ ছাহাবা, তাবেঈন, মহামতি ইমাম চতুষ্ঠয় এবং পরবর্তী যুগের সমুদয় মহামনীষী এবং বিদ্যারথীকে অন্তরের সহিত শ্রদ্ধা করিলেও জ্ঞানের মুক্তি এবং যুক্তির স্বাধীনতাকে প্রলয়কাল পর্যন্ত সমুদয় যোগ্য এবং উপযুক্ত নরনারীর জন্য অবারিত রাখিয়াছেন। তাঁহারা তাঁহাদের জ্ঞান ও বিচার-বুদ্ধিকে একমাত্র আল্লাহ এবং তদীয় রাসূল (ছাঃ) এবং উম্মতের সমুদয় বিদ্বানের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ব্যতীত অন্য কোন নেতা বা মহাপন্ডিতের পদতলে সমর্পণ করিতে মুহূর্তের তরেও প্রস্ত্তত নহেন।
শুধু এইটুকুই নয়, আহলেহাদীছ আন্দোলনের মূলনীতি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ অনুসারে আহলেহাদীছগণ তাঁহাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীক, অর্থনৈতিক, তামাদ্দুনিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের নিয়ন্ত্রণকারী ও ব্যবস্থাপক রূপে আল্লাহর সার্বভৌম প্রভুত্ব এবং মনুষ্যশ্রেণীর মধ্য হইতে শুধু তদীয় রাসূল (ছাঃ)-এর অধিনায়কত্ব স্বীকার করিয়া লইতে বাধ্য। যাঁহারা উল্লিখিত নীতি সমূহ মান্য করিতে প্রস্ত্তত নহেন, তাঁহাদের আহলেহাদীছ হইবার দাবীও তদ্রূপ অর্থহীন। সুতরাং দেখা যাইতেছে যে, যাঁহারা অন্যান্য দল ও ফির্কার সংঙ্গে আহলেহাদীছ আন্দোলনের নামও এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করিয়া থাকেন, তাঁহারা আহলেহাদীছ মতবাদ ও উহার আন্দোলনের পটভূমিকা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ।
আহলেহাদীছ মতবাদের কতিপয় প্রধান বৈশিষ্ট্য :
প্রথম বৈশিষ্ট্য : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সার্বভৌম অধিনায়কত্ব এবং তাঁহার হাদীছের সরাসরি অনুসরণ।
এরূপ প্রশ্ন কাহারো মনে উদিত হওয়া বিচিত্র নয় যে, কুরআন ও সুন্নাহর একচ্ছত্র আধিপত্য ও অধিনায়কত্ব প্রতিপন্ন ও প্রতিষ্ঠা করা কি শুধু আহলেহাদীছ আন্দোলনেরই বৈশিষ্ট্য? এই প্রশ্নের জওয়াবে আমরা সসম্মানে দৃঢ়তার সহিত এই কথাই বলব যে, বাস্তবিকই একমাত্র আহলেহাদীছগণই কুরআন ও সুন্নাহর বিজয় পতাকার ধারক ও বাহক! আহলেসুন্নাত ফির্কাগুলির সকলেই কুরআন ও সুন্নাহর প্রাধান্য নীতিগতভাবে স্বীকার করিয়া লইলেও তাঁহাদের নেতা ইমামগণের সিদ্ধান্তগুলিই কার্যত: তাঁহাদের কাছে প্রকৃত অনুসরণীয় বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকে। যে দলের যিনি মাননীয় ইমাম, তাঁহার কোন উক্তি ও সিদ্ধান্ত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাদীছের পরিপন্থী হইলেও উক্ত ইমাম বা নেতার নামে যে দলটি গড়িয়া উঠিয়াছে, তাঁহারা কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশের সরাসরি অনুসরণের পরিবর্তে তাঁহাদের নেতার উক্তিরই অনুসরণ করিয়া থাকেন এবং নেতার সিদ্ধান্তের প্রতিকূল হাদীছের পরোক্ষ ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত হন এবং যেভাবেই হউক রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ)-এর হাদীছকে টানিয়া হেঁচড়াইয়া স্বীয় নেতার সিদ্ধান্তের সহিত সুসামঞ্জস্য করিতে সচেষ্ট হইয়া থাকেন। অথচ একটি স্থানেও তাঁহারা তাঁহাদের নেতার সিদ্ধান্ত বর্জন করিয়া রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাদীছের অনুসরণ করিতে প্রবৃত্ত হন না। পক্ষান্তরে নেতার পরিগৃহীত কোন হাদীছ তাহক্বীক্ব ক্ষেত্রে দুর্বল বা অপ্রমাণিত সাব্যস্ত হইলেও তাঁহারা উহা পরিত্যাগ করিয়া অধিকতর বলিষ্ঠ ও প্রামাণ্য হাদীছ গ্রহণ করিতে চান না। অধিকন্তু অনেক ক্ষেত্রে নেতার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তকেই ভিত্তি করিয়া তাঁহারা ‘কিয়াস’ বা উপমান পদ্ধতির সাহায্যে বিভিন্ন মাস’আলা আবিষ্কার করিয়া থাকেন।
কিন্তু আহলেহাদীছ মতবাদের বৈশিষ্ট্য এই যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সার্বভৌম অধিনায়কত্ব এবং তাঁহার হাদীছের আনুগত্য চুল পরিমাণও অতিক্রম করিয়া যাওয়া আহলেহাদীছগণের নীতি বিরুদ্ধ। কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মুকাবিলায় কোন মহাবিদ্বান, আইন শাস্ত্রবিদ ও শক্তিমান শাসনকর্তার উক্তি ও নির্দেশ মান্য করা আহলেহাদীছ আক্বীদা অনুসারে অবৈধ ও মহাপাপ। বলিষ্ঠতর হাদীছের সমকক্ষতায় দুর্বল হাদীছের অনুসরণ করা আহলেহাদীছগণের রীতি বিরুদ্ধ। আমাদের এই দাবীর অকাট্য প্রমাণ এই যে, পৃথিবীর সমুদয় মাযহাবী ফির্কা তাঁহাদের মাযহাবের মাসআলাগুলি বিশেষভাবে সঙ্কলিত করিয়া পৃথক পৃথক ফিকহ গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন এবং প্রত্যেকটি দল তাঁহাদের নিজেদের দলীয় মাসআলার গ্রন্থগুলিকে নিজেদের গ্রন্থরূপে এবং অপরাপর দলের মাসআলার পুস্তকগুলিকে ভিন্ন মাযহাবের কিতাবরূপে অভিহিত করিয়াছেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যতীত আহলেহাদীছগণের যেরূপ কোন স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সর্বাধিনায়ক বা ইমাম নাই, সেইরূপ আহলেহাদীছ বিদ্বানগণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাদীছ গ্রন্থ ব্যতীত কোন বিদ্বান ও মহাপন্ডিতের লিখিত পুস্তককে নিজেদের গ্রন্থরূপে স্বীকার করেন নাই। তাঁহারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাদীছের চয়ন, সঙ্কলন, সম্পাদন, ব্যাখ্যা ও আলোচনা ব্যতীত কোন ইমাম বা নেতার সিদ্ধান্তগুলিকে ভিত্তি করিয়া নতুন নতুন মাসআলা রচনা করার কার্যে কদাচ প্রবৃত্ত হন নাই।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য : কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক সর্ব সমস্যার যুগোপযোগী সমাধান।
এই মতবাদের আর একটি বৈশিষ্ট্য হইতেছে ইহার স্থিতি স্থাপকতা গুণ। বিভিন্ন ফির্কা ও দলের ন্যায় আহলেহাদীছ আন্দোলন মানব সমাজের নিত্য নতুন প্রয়োজন ও যুগধর্মের দাবীকে অস্বীকার করে না। যুগ বিশেষের কোন মানবীয় নেতৃত্ব, প্রজ্ঞা ও সিদ্ধান্তকে চরম ও অকাট্য বলিয়া স্বীকার না করায় এবং উহাকে আশ্রয় করিয়া ইহার পরিপুষ্টি সাধিত না হওয়ায় আহলেহাদীছ আন্দোলনে কুরআন ও সুন্নাহ্কে ভিত্তি করিয়া সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক সমস্যাসমূহের যুগোপযোগী সমাধানের সকল সময়েই অবকাশ রহিয়াছে। প্রচলিত মাযহাব সমূহের কোন একটিতেও সকল যুগের সকল প্রকার বৈজ্ঞানিক প্রশ্নের জওয়াব খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। অতএব দেখা যাইতেছে যে, গতানুগতিকতা ও ফির্কাবন্দীর প্রভাব অস্বীকার না করা পর্যন্ত ইসলামকে সর্বযুগোপযোগী শক্তিশালী জীবন ব্যবস্থারূপে প্রমাণিত করার কোন উপায় নাই। একমাত্র আহলেহাদীছ আন্দোলনই এই রোগের প্রতিষেধক।
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য : আল্লাহর একত্ব ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নবুওতের চরমত্বের ভিত্তিতে মুসলিম জাতির সংহতি।
‘আল্লাহর একত্ব এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কর্তৃক নবুওতের চরমত্ব’ এই মহা মতবাদকে ভিত্তি করিয়া মুসলিম সমাজের জাতীয় সংহতির গুরুত্ব প্রতিপন্ন করা হইয়াছে। অতীতে ও বর্তমানে দল, মত ও ফির্কার উগ্র প্রভাবেই মুসলিম সংহতির এই অত্যাবশ্যক মতবাদ ক্ষুণ্ণ হইয়াছে। একমাত্র আহলেহাদীছ আন্দোলনই বিশ্বের বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন মুসলিমকে নবুয়তে আলিংগনাবদ্ধ হইবার আহবান জানাইয়াছে।
আরো একটি বৈশিষ্ট্য :
আহলেহাদীছ আন্দোলনের আর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, রাজনীতি ক্ষেত্রেও ইহা দলীয় স্বাতন্ত্র্য ও পার্থক্যের আহবায়ক নয়, ইহা কখনো পৃথক কোন রাজনৈতিক গোঠ গঠন করিতে চায় না। দেশের এবং জাতির বৃহত্তর ও মহত্তর কল্যাণের জন্য সকল প্রকার ন্যায়ানুমোদিত আন্দোলনে মুসলিম জনগণের সহিত মিলিত হইয়া সমাজের অন্য দশ জনের ন্যায় কাজ করিয়া যাওয়াই ইহার পরিগৃহীত কর্মপন্থা। এই আন্দোলনের অনুসারীরা আইন সভায় রক্ষাকবচ বা স্বতন্ত্র আসনের দাবীদার হইতে পারে না, এমনকি দলগতভাবে তাহারা নিজেদের স্বতন্ত্র নির্বাচন দাবীও উপস্থিত করে না। এই আন্দোলনের অনুসরণকারীগণের জন্য স্বতন্ত্র কোন কলোনী বা উপনিবেশের দাবীদার হইবার উপায় নাই। মুসলিম জনগণের সাধারণ স্বার্থই হইতেছে এই আন্দোলনের অনুসারীগণের স্বার্থ এবং জাতির পতাকাই হইতেছে ইহাদের একমাত্র পতাকা। দেশের সকল প্রকার রাজনীতিকে ইসলামী রূপ প্রদান করা এবং কুরআন ও সুন্নাহকে ভিত্তি করিয়া সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ গড়িয়া তোলাই এই আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। খিলাফতে রাশিদার আদর্শে ইসলামী রাষ্ট্রের পুনরুজ্জীবন সাধন আহলেহাদীছ আন্দোলনের রাজনৈতিক লক্ষ্য।
আহলেহাদীছ আন্দোলনের পটভূমি ও কর্মক্ষেত্র :
ফলকথা, আহলেহাদীছ নির্দিষ্ট কোন দল বা ফির্কার নাম নয়, প্রত্যুতঃ ফির্কাবন্দীর নিরসনকল্পে এবং বিচ্ছিন্ন মুসলিম সমাজকে এক ও অভিন্ন মহাজাতিতে পরিণত করার উদ্দেশ্যে সংগ্রাম পরিচালনা করার জন্যই ইহার উত্থান হইয়াছে। কিন্তু কুরআন ও হাদীছের সার্বভৌম প্রতিষ্ঠা এবং জাতির পুনর্গঠন ও সংস্কারের কার্য এরূপ সুদূর প্রসারী ও শাখা-প্রশাখা বহুল যে, আহলেহাদীছ আন্দোলনের কর্মীগণ সকল সময় সমবেতভাবে একই নির্দিষ্ট কর্মক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকিতে পারেন নাই।
গ্রন্থ রচনা :
বিগত উনবিংশ শতকে তাঁহাদের একদল ভারত উপমহাদেশে লেখনীর সাহায্যে কুরআন ও সুন্নাহর অনুবাদ ও ব্যাখ্যা এবং ইসলামের দার্শনিক তত্ব সম্বলিত সহস্র সহস্র গ্রন্থ ও সাহিত্য রচনা করিয়া গিয়াছেন। প্রথিতযশা সাহিত্যিক ও মুহাদ্দিছ নওয়াব সাইয়েদ সিদ্দীক হাসান খান, আল্লামা শামসুল হক আযিমাবাদী, মাওলানা সানাউল্লাহ অমৃতসরী, মাওলানা মোহাম্মাদ হুসাইন বাটালভী, মাওলানা মুহীউদ্দীন লাহোরী, মওলানা বদীউয্যমান, মাওলানা ওয়াহীদুয্যামান প্রভৃতি বিদ্বানের নাম এই দলের পুরোভাগে অবস্থিত। নওয়াব সাইয়েদ সিদ্দীক হাসান এককভাবেই ক্ষুদ্র বৃহৎ পাঁচ শতাধিক গ্রন্থ রচনা করিয়া গিয়াছেন। এই দলের তত্ত্বাবধানে ‘শুহনায়ে হিন্দ’ ‘ইশাআস্সুন্নাহ,’ যিয়াউস্ সুন্নাহ,’ দিলগুদায পয়সা আখ্বার ও কর্জন গেজেট প্রভৃতি সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকাগুলি প্রকাশিত হইয়া ভারত উপমহাদেশে সাংবাদিকতার বীজ উপ্ত করে। উর্দূ সাহিত্যকেও আহলেহাদীছগণই ভারত উপমহাদেশে সমৃদ্ধ করিয়া তুলিয়াছিলেন। স্যার সৈয়দ আহমদ খান, নওয়াব মুহসিনুল মুলক, মাওলানা হালী, ডেপুটি নযীর আহমদ, মুমিন খান শহীদ দেহলভী ও আব্দুল হালীম শরর প্রভৃতির নাম উর্দূ গদ্য ও কাব্য সাহিত্যে প্রলয়কাল পর্যন্ত অমর হইয়া রহিবে।
কুরআন ও হাদীছের অধ্যাপনা :
আহলেহাদীছগণের আর একটি দল তাঁহাদের সমস্ত জীবন শুধু কুরআন ও হাদীছের অধ্যাপনা কার্যেই উৎসর্গ করিয়া গিয়াছেন। ইহাদের অক্লান্ত সাধনার ফলেই পাক-ভারত ও বঙ্গ-আসামের ঘরে ঘরে রাসূলূল্লাহ (ছাঃ) হাদীছের পবিত্র প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত হইয়াছিল, আল্লামা শায়খ হুসাইন বিন মুহসিন আল-আনসারী, আল্লামা বশীর সহ্সওয়ানী, আল্লামা হাফিয আব্দুল্লাহ গাযীপুরী প্রভৃতি এই দলের শীর্ষস্থানীয়।
তাবলীগে-দ্বীন :
আহলেহাদীছগণের আর একটি দল শির্ক ও বিদ‘আতের প্রতিরোধকল্পে এবং তাওহীদ ও সুন্নাতের প্রতিষ্ঠার উদগ্র বাসনায় আকুল হইয়া কান্দাহার হইতে সিংহল পর্যন্ত এবং পোলের তরাই হইতে আরম্ভ করিয়া সুন্দরবন পর্যন্ত পথে পথে ঘুরিয়া কে কোন স্থানে যে মৃত্যুবরণ করিয়াছেন তাহার বিস্তৃত বিবরণ প্রদান করার উপায় নাই। সৈয়দ হাবীবুল্লাহ, সৈয়দ আব্দুল্লাহ গজনভী, সৈয়দ আব্দুল্লাহ ঝাউ, মওলানা ইবরাহীম নসীরাবাদী মুহাজিরে মক্কী, মাওলানা খাওয়াজা আহমদ নদীয়াভী, মাওলানা যিল্লুর রহীম মংগলকোটি, মাওলানা মনসুরুর রহমান ঢাকাভী, মাওলানা মীযানুর রহমান শ্রীহট্টী ও মাওলানা আব্দুল হাদী ইসলামাবাদী প্রভৃতির নাম এই দলের অগ্রভাগে উল্লেখ করা যাইতে পারে।
জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ :
আহলেহাদীছগণেরই আর একটি দল সংসারের মায়া এবং সুখ-শান্তির বুকে পদাঘাত করিয়া ভারত উপমহাদেশকে যুগপৎ ভাবে হিন্দু ও ইংরেজদের কবল ইহতে উদ্ধার করিয়া এই দেশে খেলাফতে রাশিদার শাসন ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন কল্পে নিষ্কাশিত তলওয়ার হস্তে সক্রিয়া সংগ্রাম চালাইয়া গিয়াছেন। আল্লামা ইসমাইল শহীদ দেহলভী, সাদিকপুরের মাওলানা বেলায়াত আলী ও মাওলানা এনায়েত আলী ভ্রাতৃযুগল, আল্লামা শাহ ইসহাক দেহলভীর জামাতা মাওলানা নসীরুদ্দীন শহীদ, ২৪ পরগনার মাওলানা ইবরাহীম আফতাব খান শহীদ প্রভৃতি বীর সেনানীর নাম এই দলেরঅধ্যক্ষরূপে চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় লিখিত রহিবে। ভারত উপমহাদেশকে বিজাতি, বিধর্মী ও বৈদেশিকদের কবল হইতে মুক্ত করার জন্য আহলেহাদীছগণ যে সক্রিয় সংগ্রাম অর্ধ শতাব্দীরও অধিককাল পরিচালিত করিয়াছিলেন, ভারতের সিপাহীযুদ্ধ ও ‘ওয়াহাবী বিদ্রোহের’ কাহিনীর প্রত্যেকটি পৃষ্ঠাকে তাহা রক্ত রঞ্জিত করিয়া রাখিয়াছেন।
মোটের উপর শতাব্দীর ঊর্ধ্বকাল ধরিয়া পাক ভারতের যে কোন স্থানে যে কোন ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সাহিত্যিক, তামাদ্দুনিক ও সংস্কারমূলক আন্দোলন জন্মগ্রহণ করিয়াছে, তাহার প্রত্যেকটিতে আহলেহাদীছগণ হয় কর্ণধার ও পথ-প্রদর্শক রূপে নেতৃত্ব করিয়াছেন, আর না হয় কুরআনের বিশ্ববিশ্রুত নীতি ‘ন্যায়ের সাহচর্য ও অন্যায়ের প্রতিরোধ’- অনুসারে আহলেহাদীছগণ সেগুলির সহিত সহযোগের হস্ত মিলাইয়া আসিয়াছেন।
[লেখকের ‘আহলে-হাদীস আন্দোলন ও উহার বৈশিষ্ট্য’ শীর্ষক পুস্তিকা থেকে সংকলিত ও আধুনিক বানানরীতির সাথে সমন্বয়কৃত]