কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সদস্য সম্মেলনে প্রদত্ত কেন্দ্রীয় সভাপতির উদ্বোধনী ভাষণ
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 9231 বার পঠিত
১৮.০১.১৯৮৬ শুক্রবার রাজশাহী শহরস্থ রাণীবাজার আহলেহাদীছ জামে মসজিদে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর ১ম কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সদস্য সম্মেলন ও প্রশিক্ষণ শিবির অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে উদ্বোধনী ভাষণ পেশ করেন সংগঠনের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি জনাব মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব। ভাষণটির সারাংশ পরে ‘তাওহীদের ডাক’ প্রথম সংখ্যায় (জানু-ফেব্রু’৮৬) প্রকাশিত হয়। গুরুত্ব বিবেচনায় অত্র ভাষণটি পুণঃমুদ্রিত হল
বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘের ১ম কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সদস্য সম্মেলনে আগত দেশের বিভিন্ন এলাকার নিবেদিতপ্রাণ মর্দে মুজাহিদ বন্ধুগণ!
আজ যে যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমি আপনাদের সম্মুখে বক্তব্য রাখতে চাচ্ছি, আসুন প্রথমে আমরা সে বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করি। কেননা সমস্যা চিহ্নিত করতে না পারলে সমাধান বের করা মোটেই সম্ভব নয়।
বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় ধর্ম ও বস্ত্তবাদ বর্তমানে আমাদের দেশে প্রবল স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত। ১৩শ শতাব্দীতে ইউরোপে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মুখোমুখি সংঘর্ষের পর থেকে বস্ত্তবাদ বিভিন্ন বেশে বিভিন্ন মতাদর্শের লোকদের মধ্যে ঢুকে পড়তে শুরু করে। পরে ইংলান্ডের হব্স, লক, ফ্রান্সের ভল্টেয়ার, রুশো, মন্টেস্কু ধর্মের বিরুদ্ধবাদী চেতনায় বারি সিঞ্চন করেন। তার কিছু পরে চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ আল্লাহর অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে বসে। যদিও ডারউইনের আমলেই বিজ্ঞানীগণ এই মতবাদকে পুরোপুরি কেউই গ্রহণ করতে সম্মত হননি। এমনকি হ্যাক্সলের মত গোঁড়া সমর্থক পর্যন্তও এতে বিশ্বাস স্থাপন করেননি। তবুও ‘গোটা বিশ্বপ্রকৃতি কোন অতি প্রাকৃতিক শক্তির সহায়তা ছাড়াই আপনা আপনি চলছে’- বিজ্ঞানীদের আবেগভিত্তিক এই অযৌক্তিক দাবীর সমর্থক হওয়ায় এরা সবাই চোখ বুঁজে ডারউইনবাদকে সর্মথন করলেন। ফলে ইউরোপীয় ধর্মবাদীরা এই বৈজ্ঞানিক নাস্তিকতার স্রোতের সামনে এতখানি নতজানু হয়ে পড়েন যে, ১৮৮২ সালে ডারউইন মৃত্যুবরণ করলে ইংল্যান্ডের চার্চ তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মানে ভূষিত করেন। তাঁকে ওয়েষ্ট মিনিষ্টার এবীতে সমাহিত করার অনুমতি দেন। খৃষ্টান ধর্ম নেতাদের এই পরাজিত মানসিকতা ইউরোপের মাটিতে নাস্তিক্যবাদের শিকড় গাড়তে সাহায্য করে এবং এই আল্লাহ বিরোধী চিন্তাধারাই সেখানে ফ্যাসিবাদ ও বলশেভিকবাদ বিকাশের সুযোগ করে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে ফরাসী বিপ্লব, আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধ, ইংল্যান্ডের Glorious revolution প্রভৃতি ধর্মবিরোধী মনোভাবকে আরও মযবুত করে দেয় এবং বস্ত্তবাদই হয়ে পড়ে যাবতীয় চিন্তা-গবেষণার বিষয়বস্ত্ত।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে এই ধর্মবিরোধী প্রবণতা দু’টি স্বতন্ত্র ধারায় অগ্রসর হ’তে শুরু করে। ১ম- ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের সকল ক্ষেত্র হতে জীবনকে বস্ত্তবাদের সর্বাত্মক ধারণার অধীন করে দেওয়া অর্থাৎ জীবনের সকল ক্ষেত্র হ’তে ধর্মকে নির্বাসন দেওয়া। এই দলের নেতৃত্ব ছিল দ্বিমুখী- (ক) ধর্মতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে এই দলের নেতা ছিলেন গাফলুক, ডঃ ওয়াটসন, গেষ্টাউলফ, ফয়েরবাখ প্রমুখ এবং (খ) রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব ছিল কার্লমার্কস, এঙ্গেলস ও তাদের অনুসারীদের হাতে।
২য় ধারাটি ছিল- ধর্মের বিরুদ্ধে কোনরূপ Frontal attack বা সম্মুখ হামলা না চালিয়ে কেবল ক্ষমতার আসন থেকে বিতাড়িত করলেই যথেষ্ট হবে। কেননা জীবনের বাস্তব ও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রসমূহ থেকে জনগণ যখন ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত হবে, তখন গৃহের ক্ষুদ্র পরিসর হ’তেও আস্তে আস্তে ধর্ম বিদায় নেবে। কিন্তু যদি উহাকে সম্মুখ হামলা করা হয় তাহলে ধর্মের প্রতি লোকদের স্বাভাবিক প্রবণতা তীব্র হয়ে উঠতে পারে। আর তা হবে এক মারাত্মক ভুল। এই অভিনব হেকমতি সন্দেশের Secularism ১৮৩২ সালে একটি আন্দোলনে রূপ নেয়। জেকব হালেক, চার্লস সাউথওয়েল, থমাস কুপার, থমাস টিয়ারসন, স্যার ব্রেডলে প্রমুখ ছিলেন এই আন্দোলনের নায়ক।
বর্তমান বিশ্বে কম্যুনিষ্ট রাষ্ট্রে প্রথমোক্ত মতবাদ ও অকম্যুনিষ্ট রাষ্ট্র সমূহে দ্বিতীয় মতবাদের অনুশীলন চলছে। আসলে কম্যুনিজম, সেক্যুলারিজম উভয়ে একই ধর্মবিরোধী বস্ত্তবাদী ভাবধারা হ’তে উদ্ভূত। উভয়েরই শেষ লক্ষ্য ধর্মকে মানুষের জীবন হ’তে নির্বাসন দেওয়া। বাংলাদেশে কম্যুনিষ্ট ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী দুই পরাশক্তির যৌথ মহড়া চলছে। কখনো তারা আপোষে লড়ছে বটে, কিন্তু ইসলামকে ঘায়েল করার ব্যাপারে তারা বিশ্বের অন্যান্য স্থানের ন্যায় বাংলাদেশেও একমত হয়ে কাজ করছে।
অনেকেই ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতা নয় বলে বুঝাতে চান। এমনকি এর পক্ষে তারা কুরআনের অতি পরিচিত কয়েকটি আয়াতখন্ডকেও ব্যবহার করেন। আসলে এদেশে যারা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী দলভুক্ত, তাদের সাধারণ সমর্থকরা তো বটেই, নেতাদের মধ্যেও অনেকে হয়তো জানেন না যে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইসলাম সরাসরি সংঘর্ষশীল। বরং আমরা মনে করি কতকগুলো ধূর্ত ব্যক্তি বস্ত্তবাদের আন্তর্জাতিক মোড়লদের ইঙ্গিতে এদেশের সাধারণ ভোটারদেরকে নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে। দেশের ইয্যত, জাতির ঈমান ও নৈতিকতার চাইতে নিজ দলীয় ও ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধার করাই এদের প্রধান লক্ষ্য।
আগেই বলেছি সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ দু’টিই বস্ত্তবাদ নামক বিষবৃক্ষের ফল। এক্ষণে আমরা দেখাতে চাইব-এ দু’টি বহুল প্রচারিত মতবাদের সঙ্গে ইসলামের সংঘর্ষের বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রগুলি কি কি? কম্যুনিজম ও সোশিয়ালিজম নিয়ে আলোচনার কোন প্রয়োজন নেই। কেননা এ দু’টি মতাদর্শ সামাজিক ও ব্যক্তিগত কোন ক্ষেত্রেই ধর্মকে সহ্য করতে প্রস্ত্তত নয়। যদিও কম্যুনিজমের চাইতে সোশিয়ালিজম এক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয়। গোল বেঁধেছে ধর্মনিরপেক্ষতাকে নিয়ে। ধর্মনিরপেক্ষ লোকেরা ধর্মীয় নাম রেখে ও মাঝে মাঝে নামায-রোযা করে দিব্যি ভেবে নেন যে, তিনি ইসলামের আর কি-ইবা বাকী রাখলেন। আমেরিকার লোকেরা ঘটা করে বড়দিন পালন করছে, আমরা ঘটা করে শবেবরাত ও মীলাদুন্নবী করছি, তাহ’লে আমরা কেমন করে ধর্মবিরোধী হলাম?
বন্ধুগণ! ইসলামের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সংঘর্ষের প্রধান ক্ষেত্র হ’ল ৩টি। ১-ইসলামের মতে ইহা একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। আধ্যাত্মিক, বৈষয়িক তথা মানুষের জীবনের সকল দিক ও বিভাগের পূর্ণাঙ্গ হেদায়াত এতে রয়েছে। পক্ষান্তরে ধর্মনিরপেক্ষতার মতে ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আধ্যাত্মিক বিষয়ের বাইরে সামাজিক ও বৈষয়িক ব্যাপারে ধর্মের কোন আবশ্যকতা নেই।
২- ইসলামের মতে সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস হলেন আল্লাহ। আইন ও বিধানদাতাও তিনি। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সেই আইনেরই বাস্তবায়ন করবে মাত্র। অন্যকিছুই যোগ-বিয়োগ করার ক্ষমতা তাদের নেই। রাষ্ট্রপ্রধান হ’তে সাধারণ নাগরিক পর্যন্ত সকলেই আল্লাহর গোলাম। সকলেই তাঁর আইনের অনুগত।
পক্ষান্তরে ধর্মনিরপেক্ষতার মতে জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস। পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই সেই সার্বভৌম ক্ষমতা ব্যবহার করার অধিকারী। তারাই খুশী মত আইন ও সংবিধান রচনা করবে। পরিবর্তন, সংযোজন, বিয়োজন কিংবা স্থগিত বা বাতিল করার একমাত্র হক্বদার তারাই। এখানে আল্লাহর আইনের প্রবেশাধিকার নেই। ফলে পার্লামেন্টের রায় আল্লাহর আইনের বিরোধী হ’লেও সেটা তাদের দৃষ্টিতে কোন অন্যায় নয়। কেননা এগুলো বৈষয়িক ব্যাপার।
৩-ইসলামের মতে ন্যায়-অন্যায়ের মানদন্ড হল আল্লাহর অহি। ধর্মনিরপেক্ষতার মতে ঐ মাপকাঠি হল মানুষের জ্ঞান। দল বা দলীয়
নেতার সিদ্ধান্ত, General will –এর নামে Party will বা পার্লামেন্টের রায়ই ন্যায়-অন্যায় নির্ধারক মাপকাঠি।
পরিণতি : এইভাবে সামাজিক ও বৈষয়িক ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রভাব ও পরকালীন জওয়াবদিহির অনুভূতি হ’তে মুক্ত হওয়ার ফলে পরিণতি এই দাঁড়িয়েছে যে, মানুষ হক্ব না-হক্ব, সত্য-মিথ্যার সঠিক মানদন্ড লাভ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। হেদায়েতের আলো প্রজ্জ্বলিত হওয়া সত্ত্বেও এই সকল বস্ত্তবাদী চিন্তাধারার ঘন কুয়াশায় মানুষ তা থেকে আলো নিতে পারছে না। বন্ধুগণ! হেদায়াতের সেই অনির্বাণ দীপশিখা কি? একটু পরেই আমরা সে আলোচনায় আসছি।
এতক্ষণ ধর্ম ও বস্ত্তবাদের সংঘর্ষের যে সংক্ষিপ্ত পরিচয় আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম, ঐতিহাসিকদের নিকট তা মাত্র ছয়শত বৎসরের ইতিহাস হ’লেও কুরআন পাঠকদের নিকট এই ইতিহাসে কোন নুতনত্ব নেই। বরং পৃথিবীতে মানুষের আগমনের প্রথম থেকেই সত্য ও মিথ্যার এই দ্বন্দ্ব চলে আসছে। যুগে যুগে প্রেরিত নবীগণ সত্যের মশাল নিয়ে এগিয়ে গেছেন। আর বাতিলের শিখন্ডীগণ তাদের রাষ্ট্রীয়, সামরিক, অর্থনৈতিক তথা সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাই ধনী ও গরীবের দ্বন্দ্ব নয় বরং হক্ব ও বাতিলের দ্বন্দ্বই মানবজীবনের চিরন্তন দ্বন্দ্ব।
নবীদের আগমনের সিলসিলা সমাপ্ত ও পূর্ণত্ব লাভ করেছে শেষনবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (ছাঃ)-এর আগমনে। কুরআনী অহির বাস্তব রূপকার নবী মুস্তফার শরীয়ত সংক্রান্ত সকল কথা, কাজ ও সম্মতিমূলক আচরণ সবই ছিল অহি নির্দেশিত। যা শরীয়তের পরিভাষায় হাদীছ বা সুন্নাহ নামে অভিহিত।
নবীর মৃত্যু হয়ে গেছে। রেখে গিয়েছেন আমাদের নিকট কিতাব ও সুন্নাতের পবিত্র আমানত। এক্ষণে মুসলিম হিসাবে আমাদের প্রধান কর্তব্য কিতাব ও সুন্নাতের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী মানুষকে অভ্রান্ত হেদায়েতের দিকে দা‘ওয়াত দেওয়া। এবং এভাবে আল্লাহর দ্বীনকে দুনিয়ার অন্যান্য সকল মতাদর্শের উপর বিজয়ী করার প্রচেষ্টায় নিজেদের সর্বশক্তি নিয়োজিত করা।
আহলেহাদীছ আন্দোলন
বন্ধুগণ! রাসূলের রেখে যাওয়া উক্ত আমানতের যথাযথ মূল্যায়ন ও অনুসরণের ফলে খেলাফতে রাশেদার ৩০ বৎসরের শাসনামলে দুনিয়ার মুসলিম এলাকায় এক অতুলনীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু প্রধানতঃ আন্তর্জাতিক ইহুদী চক্রান্ত ও খৃষ্টানী তৎপরতার ফলে মুসলিম জনগণের মধ্যে আক্বীদা ও আমলের ক্ষেত্রে এক বড় রকমের বিপর্যয় দেখা দেয়। রাসূলের জীবদ্দশাতেই মুনাফিকদের আচরণে এটার লক্ষণ দেখা গিয়েছিল এবং খেলাফতে রাশেদার আমলে এদের চক্রান্তের ফলে মর্মান্তিক রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের সূত্রপাত ঘটেছিল। সঙ্গে সঙ্গে গ্রীক বস্ত্তবাদী দর্শনের কুটতর্কে মুসলমানদেরকে জড়িয়ে ফেলা হয়। বলা বাহুল্য এই সব চক্রান্তের মূল উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম জনগণকে কুরআন ও সুন্নাহর মূল উৎস হ’তে অন্য দিকে ফিরিয়ে নেওয়া।
মুসলিম বাতিলপন্থীদের এই আচরণ লক্ষ্য করে ছাহাবায়ে কেরাম ও হক্বপন্থী মুসলিমগণ ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ শুরু করেন এবং মানুষকে কুরআন ও সুন্নাহর মূল উৎসে ফিরে যাওয়ার আহবান জানাতে থাকেন। প্রখ্যাত ছাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) মুসলিম যুবকদের দেখলে খুশীতে উদ্বেলিত হয়ে বলে উঠতেন ‘রাসূলের অছিয়ত অনুযায়ী তোমরা আমার মুবারকবাদ গ্রহণ কর। ...কেননা তোমরাই আমাদের উত্তরসূরী ও আমাদের পরবর্তী আহলুলহাদীছ’ (হাকেম-১৮৮)। বুঝা গেল সমস্ত ছাহাবায়ে কেরাম ‘আহলুলহাদীছ’ ও ‘মুসলিম’ দুই নামেই কথিত হতেন। খেলাফতে রাশেদার আমলে বিজিত দুনিয়ার সকল এলাকার সকল মুসলমান আহলেহাদীছ নামেই অভিহিত ছিলেন। যদিও মুসলিম নামধারী বিদ‘আতী তথা বাতিলপন্থীদের অস্তিত্ব সকল যুগেই ছিল। চতুর্থ শতাব্দী হিজরীতে তাকলীদে শাখ্ছী তথা ইমামদের প্রতি অন্ধ অনুকরণের বিদ‘আত চালু হওয়ার প্রাক্কালেও ভারতে মুসলমানদের অধিকাংশই আহলেহাদীছ ছিলেন (আহসান-৩৮৫)। কিন্তু চতুর্থ হিজরীতে তাকলীদে শাখছী মাথা চাড়া দিয়ে উঠলে তার ঢেউ ভারতেও আসে। ফলে আগে থেকেই মানুষ পূজায় অভ্যস্ত ব্রাক্ষণ্যবাদী ভারতের নওমুসলিমরা অনেকেই তাকলীদের প্রতি ঝুঁকে পড়ে এবং নিজেদের বহুদিনের আচরিত বিভিন্ন রসম-রেওয়াজ ইসলামী রূপ দিয়ে ইসলামী অনুষ্ঠান হিসাবে সমাজে চালু করে দেয়। মানুষের স্বভাবজাত অনুকরণপ্রবণতা ও অনুষ্ঠানপ্রিয়তাই মুসলামানদেরকে তাকলীদের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। মুসলমান ইসলামের নামে বিভিন্ন অনৈসলামী ক্রিয়াকর্মে লিপ্ত হতে থাকে। আনুগত্যের নামে তারা বিভিন্ন পীর-দরবেশের কথা ও কাজের অন্ধ অনুসরণ করতে থাকে। বিভিন্ন নামে বিভিন্ন মাযহাব ও তরীকা গড়ে উঠে। প্রত্যেক মাযহাবের ইমাম ও তরীকার পীরগণ সত্যের মানদন্ড হিসাবে গণ্য হতে থাকেন। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজেদের ইচ্ছামত ফৎওয়া চালু করে বিগত কোন বুযুর্গ ইমামের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। ইহুদী-নাছারা সমাজ যে তাকলীদে শাখছীর কারণে আল্লাহর গযবের শিকার হয়েছে। মুসলমানগণও সেই তাকলীদী জাহেলিয়াতকে বরণ করে নিল। ফলে বস্ত্তবাদীদের ধারণায় মানুষের জ্ঞানই যেমন সত্যের মানদন্ড, তাকলীদপন্থীদের নিকট তেমনি ইমাম বা পীরের ফৎওয়াই হয়ে দাঁড়াল সত্যের মানদন্ড; কুরআন বা সুন্নাহ নয়। শুধু তাই নয় তাকলীদপন্থীগণ নিজেদের রচিত বিদ‘আতগুলিকে সপ্রমাণ করার জন্য জাল বা যঈফ হাদীছের আশ্রয় নিতেও কছুর করেনি। সবচাইতে বড় ক্ষতি এর দ্বারা যেটা হয়েছে, সেটা হল মুসলমানদেরকে কুরআন ও সুন্নাহর মূল উৎস হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ইমাম ও পীর উপাধিধারী কতক মানুষের আনুগত্য শৃংখলে আবদ্ধ করেছে। যদিও কুরআন ও হাদীছের আদেশ-নিষেধের সম্মুখে কারও কথার কোন মূল্য নেই।
তাকলীদের দ্বিতীয় ফল হল এই যে, প্রত্যেক মাযহাবের লোকেরা নিজেদের মনগড়া মাযহাবকেই অভ্রান্ত সত্য ভাবতে শুরু করল এবং অন্যদের প্রতি বিদ্বেষ ভাব সৃষ্টি হলো। অতিভক্তি ও অতি বিদ্বেষের ফলে শুরু হল পারষ্পরিক হানাহানি। ধ্বংস হল বাগদাদ, মারভ, নিশাপুর। ঐক্য খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়ল চার মুছাল্লাহ নামে ঐক্যের মূর্ত প্রতীক কা‘বাঘরের শান্ত চত্বরে। পাক-ভারত বাংলাদেশের সর্বত্র এমনকি মসজিদেও একত্রে ছালাত আদায় আর সম্ভব থাকল না। পারষ্পরিক বিয়ে-শাদী, সালাম-কালাম পর্যন্ত নিষিদ্ধ হল। কমবেশী যার রেশ এখনও সমাজে চলছে।
বন্ধুগণ! উপরোক্ত তাকলীদী ফের্কাবন্দী ও দলাদলির জোয়ারে যখন সবাই ভেসে চলেছে, তখন পূর্বের ন্যায় একদল মুসলিম বিদ্বান সব সময়ই এর বিরোধিতা করে এসেছেন। তাঁরা সব সময়ই মুসলিম জনসাধারণকে কুরআন ও সুন্নাহর মূলকেন্দ্রে ফিরে যাওয়ার ও সেখান থেকে সরাসরি আলো নেওয়ার আহবান জানিয়েছেন। আহলে বিদ‘আত ও আহলে রায়দের বিরুদ্ধে তারা নিজেদের জন্য পূর্বের ন্যায় আহলুলহাদীছ নাম বজায় রাখেন। হাযারো বাধা বিঘ্নের মধ্যেও তারা দৃঢ় হিমাদ্রির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকেন। শাহ অলিউল্লাহ পরিবার, শাহ ইসমাঈল শহীদ, সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী, এনায়েত আলী, বেলায়েত আলী, মিয়া নাযীর হোসায়েন দেহলভী, নওয়াব ছিদ্দিক হাসান খান ভূপালী, আবুল কাসেম বেনারসী, মুহাম্মাদ হোসায়েন বাটালভী, হাফেয আব্দুল্লাহ গাযীপুরী, ইসমাঈল গুজরানওয়ালা, শামসুল হক আযীমাবাদী, ছানাউল্লাহ অমৃতসরী, মুহাম্মাদ জুনাগড়ী, আববাস আলী, বাবর আলী, আব্দুল্লাহিল কাফী প্রমুখের নাম আমরা এ প্রসঙ্গে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে পারি। বন্ধুগণ! এঁরা সবাই ছিলেন জাতির মুক্তির দিশারী ! এঁরা সবাই চেয়েছিলেন পূর্বের ন্যায় একটি ঐক্যবদ্ধ মুসলিম শক্তি ভারতে আবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠুক। এঁরা কেউই সরাসরি রাজনীতিতে অবতীর্ণ হননি। দূর থেকে রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছেন। কিন্তু কেন এই নিরাপদ অবস্থান?
সেটার কারণ ছিল বৃটিশের ভেদ-বুদ্ধির রাজনীতি। Divide and rule-এর ভেদনীতির ফলে মুসলমান গণতন্ত্রের ধোঁকায় পড়ে রাজনীতির নামে দলীয় কোন্দলে লিপ্ত হয়। বৃটিশ চলে গেছে। কিন্তু তাদের সেই নীতি আমাদের উপরে পুরো মাত্রায় সওয়ার হয়ে আছে। রাজনীতির নামে আজ এক মুসলমান অন্য মুসলমানের বুকে ছুরি মারছে।
বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা
বন্ধুগণ! ইতিপূর্বে যে অবস্থার কথা আমরা আলোচনা করে এসেছি, বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা তার চাইতে আরও নাযুক বলা যেতে পারে। মুসলিম ঐক্য বিনষ্ট করার আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র এখানে দুই ভাবে কাজ করছে। এক-পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের মুরববীরা এদেশের তরুণদের একটি দলকে বস্ত্তবাদের দীক্ষা দিচ্ছে। একাজে মুসলমানদের মধ্য হতেই কিছু রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীকে তারা বাছাই করে নিয়েছে। অথবা এরাই নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য তাদের গোলামী বরণ করে নিয়েছে। দুই-ইসলামের নামে যারা রাজনীতি করছেন তারাও নিজ নিজ দলীয় অহমিকা বজায় রাখতে গিয়ে সাড়ে পাঁচ ডজন দলে বিভক্ত হয়েছেন। এবং ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আন্তর্জাতিক রাজনীতির দাবার ঘুটি হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছেন। ইসলামের স্বার্থ নয়, বরং দলীয় স্বার্থই এদের নিকট বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। শুধু এতেই শেষ নয় বরং মধ্য যুগে গ্রীক দর্শন সঞ্জাত কুটতর্কের ন্যায় ‘রাজনীতি হ’তে ধর্ম পৃথক’ এমন একটা অনৈসলামী থিওরীর প্রচারে আমাদেরই একদল ভাইকে মাঠে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য, তাঁরাই সমাজে প্রকৃত দ্বীনদার নামে খ্যাত হচ্ছেন।
এদেশে যাঁরা ইসলামী রাজনীতি করছেন, তাঁরা তাঁদের ভূমিকাতে স্পষ্ট নন। তার কারণ তাঁরা মঞ্চে-মিছিলে কুরআন ও সুন্নাহর বৈজয়ন্তী ঘোষণা করলেও ব্যক্তি জীবনে তাঁদের অধিকাংশই বিভিন্ন মাযহাব ও তরীকার অনুসারী। যে অনৈসলামী গণতন্ত্রের বরকতে (?) তাঁরা রাজনৈতিক ক্ষমতা হাছিলের স্বপ্ন দেখেছেন, সে গণতন্ত্রে জনগণই খোদা। সংখ্যাগুরুর অত্যাচার সেখানে থাকবেই। তাই কুরআন ও সুন্নাহর নিরপেক্ষ অনুসারী হিসাবে যারা দাবী করেন, তাদের পক্ষে এই দাপট নীরবে হযম করা কোনকালেই সম্ভব হবে না। কুরআন ও হাদীছ দুনিয়ায় বহাল তবিয়তে বর্তমান থাকতে ইসলামের নামে কোন নির্দিষ্ট একটি তাকলীদী মতবাদ জাতির স্কন্ধে চেপে বসুক এটা কখনোই তারা বরদাশ্ত করবে না।
বন্ধুগণ! ৬৬টি ইসলামিক পার্টির মধ্যে আমরাও একটি ভোটপ্রার্থী পার্টি হয়ে বিভক্তির কাতার আর বাড়াতে চাইনা। আমরা নিজেরা প্রার্থী না হয়ে মুসলিম ঐক্যের পক্ষে বলতে পারেন একটি Pressure group হিসাবে কাজ করতে চাই। আমরা উদারভাবে সকল মুসলমানকে কুরআন ও সুন্নাহর সার্বভৌম অধিকার নিঃর্শতভাবে মেনে নেওয়ার ভিত্তিতে এক ও ঐক্যবদ্ধ প্লাটফরমে জমায়েত হওয়ার আহবান জানাই। আমরা রাজনীতির নামে, ধর্মের নামে, তরীকার নামে, মাযহাবের নামে, পীর-মুরীদির ভাগাভাগির নামে আপোষে ভেদাভেদের বিরোধী। আমরা চাই মসজিদ হ’তে বঙ্গভবন পর্যন্ত সর্বত্র আল্লাহর প্রভুত্ব ও রাসূলের নিরংকুশ নেতৃত্ব কায়েম হৌক। মানুষের বানানো কিয়াসী মাযহাব বা কোন ইজম নয়, বরং কুরআন ও সুন্নাহ হৌক সকল সমস্যার একমাত্র সমাধান ও ন্যায়-অন্যায়ের একমাত্র মাপকাঠি।
যুবসমাজ
এদেশের যুবসমাজ রাজনৈতিক নেতাদের লোভনীয় শিকার। যৌবনের উদ্দীপনাকে বিভিন্ন রাজনীতির বলি হিসাবে এদেশে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রত্যেক পার্টি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী এদেরকে শহীদ ও গাযী হিসাবে আখ্যায়িত করছে। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন থিওরীর চাকচিক্যে এদের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরা বিভ্রান্ত হচ্ছে।
যুবসমাজকে ঐ সকল থিওরীর বেড়াজাল হ’তে মুক্ত করে কুরআন ও হাদীছের অভ্রান্ত সত্যের দিকে দা‘ওয়াত দেওয়ার উদ্দেশ্যেই জন্ম নিয়েছে নির্ভেজাল তাওহীদের ঝান্ডাবাহী এদেশের একক যুবসংগঠন ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ ১৯৭৮ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী ঢাকাতে। আহলেহাদীছ নাম শুনেই আঁৎকে উঠবার কোন কারণ নেই। এটা কোন সাম্প্রদায়িক আন্দোলন নয়। বরং রায় ও বিদ‘আতপন্থীদের থেকে নিজেদের বৈশিষ্ট্যের স্বাতন্ত্র্য বুঝানোর জন্যেই ছাহাবায়ে কেরামের ন্যায় আমরা এ নামে নিজেদেরকে পরিচিত করতে গর্ববোধ করি। ইসলামের নামে বিভিন্ন রাজনৈতিক গোঠ রচনা করে ও তাদের যুবসংগঠন রচনা করেও যদি সবাই অসাম্প্রদায়িক থাকতে পারেন, তাহলে আমাদেরকে সাম্প্রদায়িক বলার পিছনে যুক্তি কোথায়? আমরা সকল মুসলমানকে মুসলমান হিসাবে বিশ্বাস করি। সকল মুসলমানের পিছনে ছালাত আদায় ও বিয়ে-শাদী সবকিছু জায়েয মনে করি। তবে একটি ক্ষেত্রে আমরা আপোষ করি না। সেটি হল শিরক ও বিদ‘আতের সঙ্গে আমাদের কোন অবস্থাতেই কোন সম্পর্ক নেই। আর সেকারণেই বিদ‘আতীদেরকে মুসলমান হিসাবে স্বীকার করলেও তাদেরকে আমরা আহলেহাদীছ হিসাবে গ্রহণ করি না। আর তারাও এই নামটি সঙ্গত কারণেই ব্যবহার করতে ভয় পান।
বন্ধুগণ! আহলেহাদীছ আন্দোলন কখনোই ভোট চাওয়ার আন্দোলন ছিল না। আজও নয়। আমরা চাই মানুষ মানুষের অন্ধ অনুসরণ ছেড়ে দিয়ে নিরংকুশভাবে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য বরণ করে নিক। আর এ পথেই দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা কামনা করি, অন্য কোন পথে নয়।
অতএব আহলেহাদীছ আন্দোলনের সূর্য সারথী আমার তরুণ বন্ধুগণ! আপনারাই আগামী দিনের ভবিষ্যত। এদেশে আল্লাহর প্রভুত্ব ও রাসূলের নিরংকুশ নেতৃত্ব কায়েম করার দায়িত্ব আপনাদের। আপনাদের প্রতি ফোঁটা রক্ত আল্লাহর অমূল্য আমানত। আসুন! তা ব্যয় করি আল্লাহর পথে, রাসূলের পথে, কুরআন ও সুন্নাহর নির্ভেজাল সত্য কায়েমের পথে। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন! আমীন !!