মরিশাসে মুসলমানদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
শাহীন রেযা
আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব 10062 বার পঠিত
প্রাথমিক পরিচিতি :
অবস্থান : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ স্থলে ৪,২৪৬ কি. মি. সীমান্ত অঞ্চল জুড়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরাম এবং মায়ানমার দ্বারা পরিবেষ্টিত। দক্ষিণে ৭১৪ কি. মি. দীর্ঘ উপকূল জুড়ে বঙ্গোপসাগর অবস্থিত।
মুসলিম বিশ্বে অবস্থান : ওআইসির ১৪তম এই দেশটি জনসংখ্যার বিচারে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ৩য় বৃহত্তম এবং আয়তনের দিক থেকে ৩৭তম স্থানে অবস্থান করছে।
আয়তন ও ভূ-প্রকৃতি : নদীমাতৃক এ দেশটি ভূখন্ডের আয়তন ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কি.মি. (৫৬,৯৮০ বর্গ মাইল)। নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলে অবস্থিত দেশটির মধ্যাঞ্চল দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা অতিক্রম করেছে। প্রায় সমগ্র দেশটি নদীবিধৌত পলি দ্বারা সৃষ্ট এক বিস্তীর্ণ সমভূমি। জালের মত নদ-নদী, খাল-বিলে ছেয়ে থাকা এরূপ বিশাল ও উর্বর শস্য-শ্যামলা সমতলভূমি পৃথিবীর আর কোন দেশে দেখা যায় না। উত্তর পশ্চিমাংশের এক বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে ধূসর ও লাল বর্ণের মাটি গঠিত উচ্চভূমি বরেন্দ্র ও মধুপুর ভাওয়ালের গড় অঞ্চল। উত্তরপূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব অঞ্চলে রয়েছে তৃণবেষ্টিত নয়নাভিরাম পাহাড়ী অঞ্চল। দক্ষিণাঞ্চলের এক বিরাট এলাকা জুড়ে (৫৫৭৫ বর্গ কি.মি.) অবস্থিত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবন।
জনসংখ্যা ও শিক্ষার হার : প্রায় ১৬ কোটি (১৫ কোটি ৫৯ লাখ ৯১ হাযার) জনসংখ্যার এই দেশটি বিশ্বের ৭ম জনবহুল দেশ। এখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১০৫৫ জন বাস করে। জনসংখ্যার ঘনত্বের বিচারে খুব ছোট কয়েকটি দেশ বাদ দিলে এ দেশটি অর্ধশতাব্দীকাল যাবৎ শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। যার ৬০% হল অনূর্ধ্ব ২৫ বছর বয়সী এবং মাত্র ৩%-এর বয়স ৬৫-এর উর্ধ্বে। শিক্ষার হার ৪৯.০৭%।
ঋাষা : ৯৮% বাংলা ভাষায় কথা বলে। বাকী ২% হল উর্দূভাষী বিহারী এবং নিজস্ব ভাষাভাষী উপজাতি।
স্বাধীনতা: ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট বৃটিশ সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভের পর অখন্ড পাকিস্তানের অংশ হিসাবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ১৮০০ কি. মি. দূরত্বে থেকে দেশটি পাকিস্তানের ৫টি রাজ্যের একটি ছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নয় মাসব্যাপী এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে।
ধর্ম : মুসলিম অধ্যুষিত দেশটিতে জনসংখ্যার শতকরা ৮৯.৭% মুসলিম (বিভাগ অনুযায়ী গড় পরিসংখ্যান- বরিশাল ৮৮%, চট্টগ্রাম ৮৪%, ঢাকা ৯০%, খুলনা ৮২.৮৭%, রাজশাহী ৮৬.৮৪% ও সিলেটে ৮১.১৬%)। এছাড়া হিন্দু ৯.৩%, বৌদ্ধ ০.৭%, খৃষ্টান (অধিকাংশই রোমান ক্যাথলিক) ০.৩%। শহরাঞ্চলে বিহারী গোষ্ঠীভুক্ত শী‘আ এবং কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের কিছুসংখ্যক অনুসারী রয়েছে। পাহাড়ী অঞ্চলে চাকমা, মারমা, ম্রো প্রভৃতি উপজাতিরা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। কুকি, খুমী ইত্যাদি উপজাতি প্রকৃতিপূজারী।
সরকার কাঠামো : সংসদীয় গণতন্ত্র প্রচলিত রয়েছে। পাঁচ বছর পর পর নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী সরকারপ্রধান হলেও সংসদ সদস্যদের ভোটে একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, যিনি রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
প্রশাসনিক কাঠামো : দেশে ৬টি প্রশাসনিক বিভাগ রয়েছে যা ৬৪টি জেলা পরষদে বিভক্ত। প্রশাসনিক উপজেলা রয়েছে ৪৭৬টি। থানা রয়েছে ৫০৩টি।
বিচারবিভাগ : বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রীম কোর্ট যার দুটি শাখা হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ। অধস্তন আদালত রয়েছে আরো ৬টি। ক. ফৌজদারী আদালত, খ. দেওয়ানী আদালত, গ. সালীশী বোর্ড, ঘ. গ্রাম্য আদালত, ঙ. পারিবারিক আদালত, চ. কিশোর আদালত।
অর্থনৈতিক অবস্থা : বাংলাদেশ
নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশ। জিডিপির হার ১২৩০ ডলার যেখানে আন্তর্জাতিক হার
১০,২০০ ডলার। জনগণের মাথাপিছু আয়ের গড় বর্তমানে ৬৯০ ডলার বা ৪৭,৩৭৩ টাকা।
দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে দেশের ৫ কোটি ৬০ লাখ (প্রায় ৪০%) মানুষ।[1]
ঐতিহাসিক ক্রমধারা
প্রাগৈতিহাসিক কাল :
নৃতাত্ত্বিক : বাংলাদেশের আদি ইতিহাস সম্পর্কে ঐতিহাসিক তথ্য তেমন পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয় পাঁচ ছ হাযার বছর পূর্বে এখানে জনবসতি শুরু করে নেগ্রিটো, দ্রাবিড়, তিববতী-মোঙ্গল ও অষ্ট্রো-এশিয়াটিক (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জাভা দ্বীপ ও ইউরোপের আল্পস অঞ্চল থেকে আগত) মানবগোষ্ঠী। তাদের বিচ্ছিন্নভাবে উচ্চারিত আধো আধো ভাষার সম্মিলিত রূপই আদি বাংলা ভাষার অলিখিত রূপ। তখন বঙ্গোপসাগরের তটরেখা ছিল ঢাকা শহরের উত্তর সীমানা স্পর্শ করে পশ্চিমে রাজশাহী বিভাগের দক্ষিণ সীমানা ধরে বায়ে ঘুরে ভাগীরথীর পশ্চিম তীরের অববাহিকা অঞ্চল হয়ে বর্তমানকালের গঙ্গার মোহনা পর্যন্ত প্রলম্বিত। হিমালয়ের পাদদেশস্থ পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের হরিকেল (চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম), উত্তর পশ্চিমে পুন্ড্র-বরেন্দ্র-গৌড়-বঙ্গ (রাজশাহী ও বিহারের কিয়দংশ) এবং দক্ষিণে রাঢ়-কলিঙ্গ (উড়িষ্যার কিয়দংশ) নিয়ে অর্ধচন্দ্রাকৃতির এ ভূভাগ ছিল প্রায় জনশূন্য অরণ্যভূমি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে মানুষ এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করত না। খৃষ্টপূর্ব দেড় হাযার বছর পূর্বে ইউরোপের আলপাইন ও রাশিয়ার ইউরাল পার্বত্য অঞ্চল থেকে বৈদিক আর্যরা (অর্থ-যাযাবর। প্রাচীন ককেশীয় জনশ্রেণীর প্রাচ্য শাখার কোন বিচ্যুত শাখাগোত্রের উত্তর বংশধর, যারা স্মরণাতীতকালে মধ্যএশিয়া থেকে এসে ইরানে যাযাবর জীবন যাপন করত) খাইবার গিরিপথ দিয়ে ভারতবর্ষে আগমন করে। তারও ১৪০০ বছর পর তারা বাংলায় প্রবেশ করে। খৃষ্টীয় ৭ম-৮ম শতাব্দীতে আরবদের আগমনের পর সেমীয় রক্তধারাও বাঙ্গালি জাতির সাথে সংমিশ্রিত হয়। তাই বর্তমান বাঙালি জাতি অষ্ট্রিক দ্রাবিড় আর্য মঙ্গোলীয় সেমীয় নিগ্রো ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর রক্তধারার সংমিশ্রণে এক বিচিত্র জনসমষ্টি হিসাবে বিদ্যমান।
সাংস্কৃতিক : আর্যদের আগমনের পূর্বে বাংলায় বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম সাধারণ্যে স্বীকৃত ছিল। আর্যরা আগমনের মাধ্যমে বৈদিক ধর্ম অত্র অঞ্চলে ভিত্তি লাভ করে। প্রথম অবস্থায় তারা দেবতায় বিশ্বাসী হলেও পৌত্তলিক ছিল না। পরবর্তীতে উপনিষদের ভিত্তিতে ‘ব্রক্ষ্ম উপাসনা’ শুরু হলে মুনী-ঝষিদের দেবধর্মের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মর্মানুসারে প্রতীক পূজার প্রচলন ঘটে। তৎকালীন সমাজে প্রচলিত বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মানুসারীদের মধ্যে ধর্ম হিসাবে নয় বরং তান্ত্রিক আচরণ ও কিংবদন্তিক কাহিনী ভিত্তিতে বৈদিক বা হিন্দু ধর্ম প্রসার লাভ করে এবং পরবর্তীতে ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের ব্যাপক যাজকীয় নীতি পদ্ধতির দ্বারা এই ধর্মকে প্রতিষ্ঠা দান করা হয়। একেশ্বরবাদী জীবনদর্শন এখানে উপস্থিত ছিল কিনা তা নিশ্চিত অবগত হওয়া না গেলেও হিন্দু ধর্মগ্রন্থসমূহের কিছু বর্ণনায় ধারণা পাওয়া যায় যে, তারা কোন এক কালে তাওহীদী দা‘ওয়াতের সংস্পর্শে এসেছিল। নৈতিক ও চারিত্রিক দিক দিয়ে এ সময় অধঃপতনে ডুবে ছিল বাংলার প্রাচীন সমাজ। ধর্ম, দেব-দেবীদের কেন্দ্র করে এক চরম অন্ধকারাচ্ছন্ন কার্যক্রমে লিপ্ত ছিল মানুষ। মদ, নৃত্য-গীত, অশ্লীলতা, যেনা-ব্যভিচার ইত্যাদি ছিল খুবই নৈমিত্তিক। বাংলা ভাষার সর্বপ্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদে এসবের অস্তিত্ব ব্যাপকাকারে বর্ণিত রয়েছে। দেব-দেবীর অশ্লীল মূতি নির্মাণ শিল্প ও পরবর্তীকালে রচিত রুচি বিবর্জিত সাহিত্যে এ অধঃপতনের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে।
রাজনৈতিক : খৃষ্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের ভারতবর্ষ আক্রমণকালে বাংলায় গঙ্গারিডই (বর্তমান ঝিনাইদহের কাযীগঞ্জ উপযেলার বারোবাজার ছিল যার রাজধানী বলে কথিত আছে) নামে একটি শক্তিশালী রাজ্য ছিল বলে গ্রীক লেখকদের বিবরণে পাওয়া যায়। এটিই ইতিহাসে পাওয়া এ অঞ্চলের প্রথম সাম্রাজ্য। পরবর্তীতে এটি বিহারের মগধ, নন্দ, মৌর্য এবং সুঙ্গ সাম্রাজ্যের সাথে একত্রিত হয়ে যায়। ৩০০ থেকে ৬০০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত মৌর্য, সুঙ্গ, গুপ্ত ও হর্ষবর্ধন বংশ বঙ্গদেশ শাসন করে। সপ্তম শতাব্দীর প্রথমভাগে বাংলার সর্বপ্রথম স্বাধীন রাজা হন শশাঙ্ক। বঙ্গদেশ তখন গৌড় হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। এ সময়ই আরবের বুকে ইসলামের বার্তা নিয়ে মুহাম্মাদ (ছাঃ) আগমন করেন। ৬৩৭ খৃষ্টাব্দে শশাঙ্কের মৃত্যুর পরবর্তী ১০০ বছর চরম অরাজকতা ও বিশৃংখলাপূর্ণ। এজন্য এ সময়কালকে ইতিহাসে ‘মাৎসন্যয়’ বলা হয়েছে। অতঃপর ৭৫০ সাল থেকে পরবর্তী ৪০০ বছর বাংলা শাসন করে বৌদ্ধ পাল বংশ। পাহাড়পুরের বিখ্যাত সোমপুর বৌদ্ধবিহার এ সময় প্রতিষ্ঠিত হয়। এ শাসনামলের শেষদিকে হিন্দু সেন বংশ বাংলার রাঢ় অঞ্চলে সেনরাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমান মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুর ছিল তখন বাংলার রাজধানী। সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষণ সেন ১২০৪ সালে বখতিয়ার খিলজী অকস্মাৎ আক্রমণ করলে পূর্ববঙ্গে পলায়ন করেন এবং সেখানে কিছুকাল রাজত্বের পর ১২০৬ সালে প্রাণত্যাগ করেন। এরপর বাংলায় শুরু হয় মুসলিম শাসনামল। সংস্কৃত ‘বঙ্গ’ শব্দটি ‘বঙ্গালহ’ রূপান্তরিত হয়ে ষোড়শ শতাব্দীতে সম্রাট আকবরের সময়ে দেশবাচক পরিচিতি লাভ করে।
বাংলাদেশে ইসলাম :
প্রেক্ষাপট :
ইসলামের আবির্ভাবের বহু পূর্ব থেকেই আরব বণিকগণ বাণিজ্যের জন্য ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী বন্দরগুলোতে যাতায়াত করতেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এমনকি এ উপমহাদেশের আদি নাম সিন্দ ও হিন্দ পর্যন্ত আরবদের দেওয়া। আরব বণিকরা মালাবার হয়ে চীনের পথে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করতেন। চট্টগ্রাম ও মেঘনা তীরের চাঁদপুর ছিল নদীবন্দর। এখান থেকে তারা চন্দন কাঠ, মসলা, সূতী কাপড় ইত্যাদি ক্রয় করে নিয়ে যেতেন। ইতিহাসে এসেছে ঈসা (আঃ)-এর জন্মের কয়েক হাযার বছর আগ থেকে দক্ষিণ আরবের সাবা (কুরআনে বর্ণিত) কওমের লোকেরা এই উপমহাদেশে পাল তোলা জাহাজে করে আসত। তার নিদর্শন তাদের প্রতিষ্ঠিত ঢাকা জেলাস্থ সাভার (সাবা-দের উর বা নগর) বন্দর। এছাড়া বাররুল হিন্দ (ইন্ডিয়ার ভূখন্ড) বা বরেন্দ্র ভূমির কথা তো সর্বজনবিদিত। খৃষ্টপূর্ব ষষ্ট শতাব্দীতে ইরানের সম্রাট সাইরাস (যুলকারনাইন) উপমহাদেশে আর্যদের অন্যতম রাজ্য গান্ধারা জয় করেন। এ সময় তার তাওহীদী জীবন দর্শনের ছটা এ অঞ্চলব্যাপী পরিবাহিত হয়েছিল। যার পরোক্ষ প্রভাব পরবর্তীকালে সংঘটিত ব্রাক্ষণ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছিল বলে ধারণা করা হয়।
বাংলায় ইসলামের আগমন :
ঐতিহাসিকদের মতে উপরোক্ত প্রেক্ষিতে হিজরী ১ম শতকেই আরব মুসলিম বণিকদের মাধ্যমেই এদেশে প্রথম ইসলামের আগমন ঘটে। বাণিজ্যের পাশাপাশি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার বিস্তীর্ণ উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোতে তারা ইসলাম প্রচার করেছিলেন। যার মধ্যে বাংলাদেশও ছিল। চীনের ক্যান্টন সমুদ্রতীরে অবস্থিত সাহাবী আবু ওয়াক্কাস মালিক বিন ওহাইবের মসজিদ ও কবর সে সাক্ষ্যই দেয়। অষ্টম-নবম শতাব্দীতে সন্দীপ, রামুসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বণিক ও মুবাল্লিগরা ইসলাম প্রচার করেছিলেন বলে ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়। তৎকালীন আরব লেখকদের বর্ণনায় সামরূপ (কামরূপ-আসাম) ও রাহমি রাজ্যের কথা এসেছে, যা ৮ম-১২শ শতাব্দীর পাল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাজশাহী পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার ও কুমিল্লার ময়নামতিতে প্রাথমিক আববাসীয় যুগের মুদ্রা পাওয়া গেছে। সম্প্রতি লালমণিরহাটে (সদর উপজেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের মজদের আড়া গ্রামে) ৬৯ হিজরীতে নির্মিত একটি প্রাচীন মসজিদের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। উপকূলীয় চট্টগ্রাম (شاطئ الغنغ-গঙ্গা উপকূল) ও নোয়াখালীর বিভিন্ন স্থানের নাম ও ভাষায় আরবী অপভ্রংশের প্রচুর উপস্থিতি এসব নিদর্শনকে আরো সপ্রমাণিত করে। চট্টগ্রামে ঐ সময় একটি মুসলিম রাজ্যও স্থাপিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। সুতরাং ধারণা করা যায় যে, হিজরী প্রথম শতকেই বাংলায় ইসলামের আগমন ঘটেছিল।
তবে ঐ সময় ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এতদঞ্চলে যারা আগমন করেন তাদের পরিচয় সম্পর্কে ইতিহাস নীরব। পরবর্তীকালে আগতদের মাত্র কয়েকজনের নাম জানা যায় যারা মূলতঃ মধ্যএশিয়া ও পারস্য থেকে এ দেশে আগমন করেন। শাহ মুহাম্মাদ সুলতান বলখী (১০৪৭খৃ.-বগুড়ার মহাস্থান), শাহ মুহাম্মাদ সুলতান রূমী (১০৫৩ খৃ-নেত্রকোনা), বাবা আদম শহীদ (১১১৯খৃ-মুন্সীগঞ্জ), শাহ মখদুম রুপোশ (১২৮৯খৃ.-রাজশাহী), শাহ নিয়ামত উল্লাহ বুতশিকন (১১২০ খৃ. ঢাকা), জালালুদ্দীন তাবরীযী (১২০৫খৃঃ), তাকীউদ্দীন আল-আরাবী (১২৫০খৃঃ-ধামুরাইরহাট,নওগাঁ), শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (১৩০০ খৃঃ- সোনারগাঁও, নারায়ণগঞ্জ), শাহজালাল (১৩০৩-সিলেট) প্রমুখ মুবাল্লিগের নাম ইতিহাসে এসেছে যাদের দা‘ওয়াতী তৎপরতায় বর্ণবৈষম্যে অত্যাচারিত ও শাসক নিপীড়নে বিপর্যস্ত হিন্দু ও বৌদ্ধরা ব্যাপকহারে দলে দলে ইসলামের শান্তি ও ন্যাবোর্তা গ্রহণ করেছিল। শুধু তাই নয় এ সময় অনেক শাসক ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ইসলাম প্রচারে ব্যাপক সহযোগিতা করেন। আবার অনেকে ইসলামের বিরুদ্ধাচারণ করে মুবাল্লিগদের বিতাড়িত করার জন্য অস্ত্রধারণ করেন। অনেক মুবাল্লিগ এ সময় তাদের হাতে প্রাণ হারান, যাদের মধ্যে বাবা আদম শহীদের নাম উল্লেখযোগ্য। অনেক সময় মুবাল্লিগ ও নওমুসলিমরাও সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলে এসব রাজাদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন। ১৩০৩ সালে বিখ্যাত শাহজালাল ইয়েমেনী (রহঃ) ৩৬০ জন সঙ্গীসহ রণপ্রস্ত্ততি নিয়েই দিল্লি থেকে সিলেটে আগমন করেছিলেন এবং অত্যাচারী রাজা গৌরগোবিন্দকে পরাজিত করেন। তাঁর উন্নত চরিত্র মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে বাংলার হাজার হাজার হিন্দু-বৌদ্ধ ইসলাম গ্রহণ করেছিল।
বৈশিষ্ট্য :
১ম ও ২য় শতাব্দীতে আগত আরব বণিক ও মুবাল্লিগরা ছিলেন তাবেঈ, তাবে‘ তাবেঈ। এজন্য সে সময় ইসলামের মৌলিক রূপটাই যে জনগণের মাঝে প্রস্ফূটিত হয়েছিল তা অনুমান করা যায়। ঐতিহাসিক বর্ণনায় জানা যায়, এ সময়ে এতদঞ্চলে হাদীছের চর্চা ছিল। কিন্তু ২য় শতাব্দীর পর উচ্চবর্ণের হিন্দুদের অত্যাচারে নিগৃহীত এবং দরবেশদের কারামত ও উন্নত চরিত্রে আকৃষ্ট বৌদ্ধ ও হিন্দুরা ব্যাপকহারে ইসলাম গ্রহণ করায় মুসলমানদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে ইসলামী আক্বীদা-বিশ্বাসের অবক্ষয় শুরু হয়। প্রয়োজনীয় দাঈ‘র অভাবে ধর্মান্তরিত বিপুল সংখ্যক মুসলমানদেরকে ইসলামের দীক্ষা পুরোপুরি আয়ত্ব করানো সম্ভব না হওয়ায় তারা স্থানীয় সংস্কৃতির মিশ্রযোগে ইসলামের মধ্যে এমন বহু বিষয় সংযুক্ত করে ফেলে যা তার মৌলিক আক্বীদাবিরোধী। অপরদিকে মুসলিম বিশ্বে রাজনৈতিক গোলযোগের সূত্র ধরে ইরাকের কূফা, বসরা এবং পারস্যসহ বিভিন্ন স্থানে নব মুসলিমদের মধ্যে ‘বাতেনী’, ‘ছূফী’ দলের আবির্ভাব ও সেখান থেকে আগত মরমী ছুফী-সাধকগণের ঈমান-আক্বীদাবিরোধী দা‘ওয়াত ইসলামী আক্বীদার প্রভূত ক্ষতি সাধন করে। নবম শতাব্দীতে প্রথমে শী‘আ পরবতীর্তে খৃষ্টীয় মতবাদ, গ্রীক-হেলেনিস্টিক ও নেওপ্লাটোনিক দর্শন, মানিবাদ, পারসিক জরোথুস্ত্রীয় ধর্ম, ইন্ডিয়ার হিন্দু ও বৌদ্ধ চিন্তাধারার সংযোগে সৃষ্ট সর্বেশ্বরবাদী ‘ছূফী’ নামধারী মরমী সন্ন্যাসতন্ত্র [2] দ্বাদশ শতকের পর মুসলিম মননশীলতাকে ব্যাপকভাবে গ্রাস করে নেয়। সাহিত্য, দর্শন, ধর্ম সর্বত্র ছূফীবাদের প্রভাব অপ্রতিহত হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে ইসলামের ব্যাপক বিস্তৃতির সাথে তুর্কী, ইরানী, আফগান, পাঠান, মোঙ্গল এবং স্থানীয় বৌদ্ধ ও হিন্দু দর্শন ও আচারের মিথস্ক্রিয়ায় অজ্ঞতায় নিমজ্জিত বাংলার মুসলিম সমাজ কুরআন ও হাদীছের উপর ভিত্তিশীল মূল ইসলামের পরিবর্তে লৌকিক ইসলাম চর্চায় অভ্যস্ত হয়ে উঠল। তাই এ কথা দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, মধ্যএশিয়া থেকে উত্তর ভারত হয়ে বাংলায় আগত তুর্কী-ইরানী ছূফী-দরবেশ ও মরমী সাধকরা এ দেশে ইসলাম প্রচারে অবদান রাখলেও তাদের প্রচারিত ইসলাম মূল আরবীয় ইসলাম থেকে বহুলাংশে বিচ্ছিন্ন ছিল। ফলে মুসলিম সমাজে ব্যাপকহারে ইসলামী আক্বীদা বিরোধী বিজাতীয় কালচার, দর্শনের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। যদিও পৌত্তলিকতাকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন ও দেবমূর্তি ধ্বংস সাধন এবং বিভিন্ন স্থানে মসজিদ নির্মাণ বাহ্যিকভাবে তাদের মুসলিম পরিচয়কে অন্যদের থেকে স্পষ্টভাবেই পৃথক করে রেখেছিল; তবে তাতে তাদের অন্তরের গহীনে লুকানো মূর্তিটি ধ্বংস হয়নি। অবশ্য এ সময় সোনারগাঁও-এর বিখ্যাত মুহাদ্দিছ শরফুদ্দীন আবু তওয়ামা ও তাঁর ছাত্রদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ইসলামের প্রকৃত বার্তা কিছুটা হলেও প্রচারিত হয়েছিল।
রাজনৈতিক বিজয় পর্ব (১৪০৪-১৭৫৭)
প্রেক্ষাপট :
৭১২ খৃষ্টাব্দে বীরযোদ্ধা মুহাম্মাদ বিন কাসিম কর্তৃক সিন্ধু বিজয় ভারতবর্ষে ইসলামের নবযাত্রা শুরু করে। মুলতানকে কেন্দ্র করে তিনি সিন্ধুতে ইসলামী শাসনব্যবস্থার গোড়াপত্তন করেন। এর সুদীর্ঘ ৩০০ বছর পর মুসলমানরা দ্বিতীয় পর্যায়ে অভিযান শুরু করে। গজনীর সুলতান মাহমূদ ১০০০ খৃ. থেকে শুরু করে ১০২৭ খৃ. পর্যন্ত খাইবার গিরিপথ অতিক্রম করে মোট ১৭ বার ভারত আক্রমণ করেন এবং প্রত্যেকবারই বিজয় লাভ করেন। তন্মধ্যে ১০২৫-২৭ সালের বিখ্যাত সোমনাথ মন্দির বিজয় ছিল এক দুঃসাহসিক ঘটনা, যা ভারতবর্ষে হিন্দুত্ববাদের প্রতিপত্তি হ্রাস করে দেয় এবং উপমহাদেশে ইসলামের দুয়ার অবারিত করে দেয়। তারপর অতিক্রান্ত হয় আরো ১৫০ বছর। গজনীর ঘোরী বংশের অসম সাহসী বীরপুরুষ মুহাম্মাদ ঘোরী ১১৭৫ সালে ভারতবর্ষে আবার ব্যাপক অভিযান শুরু করেন। অসাধারণ রণকৌশল প্রদর্শন করে একে একে পাঞ্জাব, সিন্ধু জয় করে তিনি ১১৯২ সালে এক বিরাট যুদ্ধের পর উত্তর ভারতের দিল্লী পর্যন্ত বিজয় সম্পন্ন করেন। অতঃপর কুতুবুদ্দীন আইবেক দিল্লীতে প্রায় শতবর্ষ ব্যাপী তুর্কী রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। ১২০৪ সালে তারই প্রতিনিধি হিসাবে বখতিয়ার খিলজী বিহার ও বাংলা জয় করেন।
বাংলার স্বাধীন মুসলমান শাসনামল ও পরবর্তীকাল :
প্রথম দেড়’শ বছর বাংলা দিল্লির শাসনাধীনে থাকার পর ১৩৩৬ সালে ফখরুদ্দীন দিল্লী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সোনারগাঁও-এ রাজধানী স্থাপন করেন। অতঃপর ১৩৪২ সালে ইলিয়াস শাহ সমগ্র বাংলা দখল করেন এবং শামসুদ্দীন (দ্বীনের সূর্য) উপাধি নিয়ে স্বাধীন বাংলার প্রথম শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। শতবর্ষব্যাপী শাহ বংশের শাসনের পর ১৪৯৩ সালে হোসেনশাহী বংশ শাসনক্ষমতায় আসে। ১৫৩৮ শূরী বংশের শেরশাহ বাংলা দখল করেন। ১৫৭৬ সালে মোঘল বাদশা আকবর পুনরায় বাংলাকে দিল্লী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। কিন্তু প্রায় ৩০ বছর পর্যন্ত এ শাসন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। এই সুযোগে বাংলার জমিদাররা ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিতে নিজেদের জমিদারীতে স্বাধীনতা অবলম্বন করেন। তাদের আমলে বাংলাদেশ ‘বারো ভুঁইয়া মুলুক’ হিসাবে অভিহিত হত। ঈসা খান ছিলেন সবচেয়ে শক্তিশালী জমিদার (ভৌমিক)। ১৬০৮ সালে সুবাদার ইসলাম খাঁ কার্যভার গ্রহণ করে মোগল শাসনকে সুদৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার আমলেই ১৬১০ সালে ঢাকায় (জাহাঙ্গীর নগর) সুবে বাংলার রাজধানী স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে মীরজুমলা ও শায়েস্তা খানের দক্ষ শাসনামলে বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধ অঞ্চলে পরিণত হয়। অতঃপর অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে মোগল শাসনের দুর্বল সময়ে শী‘আ বংশোদ্ভূত ধর্মপরায়ণ ও সুশাসক মুর্শিদকুলী খাঁ বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। তার মাধ্যমেই শুরু হয় বাংলায় নবাবী আমল। ১৭৪০ সালে আরব ও তুর্কী রক্তবাহী সুশাসক আলীবর্দী খাঁ এক যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলার নবাবী দখল করেন। তার মৃত্যুর পর ১৭৫৬ সালে দৌহিত্র সিরাজুদ্দৌলা মাত্র ২৩ বছর বয়সে বাংলার মসনদে আরোহণ করেন। স্বল্পকালের মধ্যেই বাংলায় বাণিজ্যকুঠি স্থাপনকারী মোগলদের কৃপাভাজন ইংরেজদের সাথে তার মুকাবিলা শুরু হয়। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তারা প্রকাশ্যে জড়িয়ে পড়লে এবং কলকাতায় দূর্গ নির্মাণ শুরু করলে স্বাধীনচেতা সিরাজুদ্দৌলা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ফলে ইংরেজরা সাময়িক আত্মসমর্পণ করে নিজেদের রক্ষা করলেও শুরু করে সিরাজুদ্দৌলার বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্রে¿ লিপ্ত হয়। সিরাজুদ্দৌলার সেনাধ্যক্ষদের কয়েকজন এই জঘন্য ষড়যন্ত্রে যোগ দেয়। অবশেষে ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর আম্রকাননে ৩০০০ ইংরেজ সৈন্যের বিরুদ্ধে ৫০,০০০ সৈন্য নিয়ে উপস্থিত হন সিরাজুদ্দৌলা। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর তিনদিনের মাথায় পরিকল্পনা মাফিকভাবে সেনাপতিদের নির্লিপ্ততায় সিরাজুদ্দৌলা পরাজয় বরণ করলেন এবং পরিবারসহ পলায়ন করলেন। ৩০ জুন তিনি ধরা পড়েন এবং ২ জুলাই শৃংখলিত অবস্থায় নতুন নবাব মীরজাফরের দরবারে আনীত হন। সে রাতেই মীরজাফর পুত্র মিরণের নির্দেশে সিরাজ তার অনুগ্রহভাজন মুহাম্মদী বেগের ছুরিকাঘাতে মর্মান্তিকভাবে নিহত হন। এভাবে মর্মন্তুদ বিশ্বাসঘাতকতা ও নৃশংসতার মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯০ বছরের জন্য ইংরেজদের হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়ল এবং সুদীর্ঘ ৫৫৪ বছরের মুসলিম শাসনের পতন ঘটল।
বৈশিষ্ট্য :
মুসলিম শাসকবৃন্দের হাল-চাল : ১২০৪ থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত প্রায় নিরবচ্ছিন্নভাবে মুসলিম শাসকরা শাসনকার্য পরিচালনা করায় ইসলাম বাংলার অন্যতম প্রধান ধর্মে পরিণত হয়। বখতিয়ার খিলজী থেকে শুরু করে পরবর্তী শাসকদের অধিকাংশই ছিলেন ধর্মানুরাগী। সুলতান গিয়াসুদ্দীন আযম শাহ, ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের মত ধর্মপরায়ণ ও দক্ষ শাসকগণ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে মসজিদ ও মাদরাসা গড়ে তোলেন। ইসলামী শিক্ষার প্রসার ঘটাতে প্রতিটি মসজিদে তারা মক্তবের ব্যবস্থা করেন। ইসলামী বিচারব্যবস্থাও অনেকাংশে তারা অনুসরণ করতেন। তবে খোলাফায়ে রাশেদার অনুশীলিত ইসলামী শাসনতন্ত্র ধারা পূর্ণাঙ্গভাবে অনুসরণের তাকীদ শাসকগণ অনুভব করেননি। ফলে ব্যক্তিগতভাবে ইসলামের অনুসরণ করলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে জনগণের মাঝে ইসলামী আদর্শের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য যে ভূমিকা রাখার প্রয়োজন ছিল তাতে তারা ছিলেন ব্যর্থ। চৌদ্দ ও পনের শতকে ইসলাম প্রচারের জন্য এ দেশে বহু ছূফী-সাধকের আগমন ঘটে। বাংলার আনাচে-কানাচে তারা মসজিদ, খানকাহ ও ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে তোলেন। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, তের ও চৌদ্দ শতকে যেখানে এ দেশে ১৩ টি মসজিদ ছিলো সেখানে পনের ও ষোল শতকে ১৪১টি মসজিদ নির্মিত হয়। সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য উপমহাদেশে বাংলাই ছিল সর্বাধিক ছূফীর আবাসস্থল। কতিপয় ন্যায়নিষ্ঠ ছূফী শাসকদের সহযোগিতায় মুজাহিদ হিসাবে সশস্ত্রভাবে শত্রুদের মোকাবিলা করে বাংলায় মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। বাংলার শাসকরা ছিলেন এই ছূফী ধর্মপ্রচারকদের উদার পৃষ্ঠপোষক। তাদেরকে যে কোন স্থানে বিনা ভাড়ায় পরিভ্রমণের ব্যবস্থা ছিল। রাজদরবারে তাদের যথেষ্ট কদর ও ভক্তি করা হত।
মুসলিম শাসকরা অমুসলিম প্রজাদের ধর্মীয় কর্মকান্ডে বাধা দিতেন না তা যতই রুচিবিগর্হিত হোক না কেন। বরং তাদেরকে উদারভাবে সর্বোচ্চ সহযোগিতাই করে গেছেন। এর পিছনেও সম্ভবতঃ ছূফীবাদী সম্প্রদায়ের প্রভাব কাজ করেছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে আলাউদ্দীন হুসাইন শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় মহাভারত, রামায়ণ, ভগবৎ গীতা ইত্যাদি হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বাংলায় অনূদিত হয়। এজন্য হিন্দু লেখকরা তাকে ‘কৃষ্ণ অবতার’,‘বাংলার আকবর’ ও ‘হিন্দু-মুসলিম মিলনের অগ্রদূত’ বলে প্রশস্তি গেয়েছেন। তার সময়ই ইসলামের প্রসার রোধের জন্য শ্রী চৈতন্যদেব সারা বাংলায় বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। প্রাথমিকভাবে হুসাইন শাহের অতি উদারতার সুযোগে এ কাজটি তিনি নির্বিঘ্নে করতে সক্ষম হন। যদিও শেষ পর্যন্ত হুসাইন শাহ ও আলেমগণ সতর্ক হয়ে গেলে হিন্দুদের এই ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে যায়। কিন্তু এর প্রভাব মুসলিম সমাজে শোচনীয় অধঃপতনের সূচনা করে। আউল, বাউল, সহজিয়া ইত্যাকার উপ-সম্প্রদায়ে বিভক্ত নেড়া মরমীবাদী ভিক্ষুকের প্রভাবে মুসলিম সমাজের অনেক মানুষ প্রভাবিত হয়। কীর্তিকলাপের দিক দিয়ে এসব মুসলমান নামধারী মারেফতি ফকিররা বৈষ্ণব বা চৈতন্য সম্প্রদায়ের মুসলিম সংস্করণ ব্যতীত কিছুই ছিল না।
মুসলিম সুলতানদের কৃপায় বাংলা সাহিত্য চর্চার ব্যাপক অগ্রগতি শুরু হলে মুসলমানদের সাংস্কৃতিক জীবন হিন্দুদের সাংস্কৃতিক জীবনের সাথে একাকার হয়ে যায়। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলো বাংলা ভাষায় অনূদিত হলেও একই সময়ে মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থসমূহ আরবী ও ফারসী থেকে বাংলায় ভাষান্তরিত হয়নি। ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে একচেটিয়া হিন্দুয়ানী আধিপত্য বিস্তার মুসলিম চিত্তমানসকে বিজাতীয় সংস্কৃতির গরলে দ্রবীভূত করে ফেলে। স্বতন্ত্র জাতীয় সংস্কৃতি বিনির্মাণে একেবারেই পিছিয়ে পড়ে বাঙালী মুসলমানরা।
মুসলিম সমাজ : প্রাথমিক পর্বে উপমহাদেশের মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করলেও মধ্যযুগে এ ক্ষেত্রে স্থবিরতা নেমে আসে। মুসলিম সমাজ এ যুগে অবক্ষয়ের শীর্ষস্তরে পৌঁছে যায়। ছূফীবাদী সাধকগণ হিন্দু সমাজকাঠামো ও আচারের সাথে প্রায় একাত্ম হয়ে যাওয়ায় ইসলামের বিশেষত্ব হারিয়ে যেতে থাকে। বিশেষ করে আল্লাহর স্বরূপ, সৃষ্টির সাথে তার সম্পর্ক, আত্মার প্রকৃতি, আল্লাহ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের প্রকৃতি, অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা, ভক্তিবাদ ইত্যাদি বিষয়ে তারা হিন্দু, জৈন যোগী-সাধকদের ধারণার সাথে ঐকান্তিকতায় উপনীত হন। হিন্দুদের নির্বাণ সম্পর্কিত ধারণা, অষ্টমার্গিক পথ, যোগাভ্যাস, অলৌকিক শক্তির সাথে পরিচয়, মানুষের দেহে ঐশী আবির্ভাব, মৃত্যুর পর আত্মার দেহান্তর প্রাপ্তি ইত্যাদি ইসলামে অন্তর্ভুক্ত হয় ফানা, বাকা, তরীকা বা সুলূক, মোরাকাবা, কারামত, হুলূল, তানাসুখ প্রভৃতি নামে। ছূফীদের আচারগুলোও ছিল হিন্দু দর্শনের দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রভাবান্বিত।[3] ইসলামের বিশুদ্ধ একত্ববাদ ছূফীদের কপোলকল্পিত উদ্ভট জটিল ব্যাখ্যায় রহস্যাবৃত্ত হয়ে পড়ে এবং কার্যতঃ তা সর্বেশ্বরবাদী (ওয়াহদাতুল উজূদ) ধারণায় উপনীত হয়।[4] যার মারাত্মক ফল হল- অগণিত মুসলমানদের মধ্যে এ ধারণা সৃষ্টি হওয়া যে, মুসলমানরা অমুসলমানদের কাছ থেকে আধ্যাত্মিক পথনির্দেশ অন্বেষণ করতে পারে। তারা হিন্দুদের বৈদান্তিক অদ্বৈতবাদসহ জন্মান্তরবাদ, অবতারবাদের মত বিকৃত মতবাদের মাঝে অভিন্ন ক্ষেত্র খুঁজে পায়। তাই এ সময় দেখা যেত অনেক মুসলিম সাধকের হিন্দু শিষ্য ছিল আবার হিন্দু সাধকের মুসলিম শিষ্য ছিলো। যার অনিবার্য পরিণতি ছিল ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের মধ্যে পার্থক্য ধীরে ধীরে দূরীভূত হওয়া। সত্যপীর, বড় খান গাজী, কালুশাহ, মানিক পীর (শীব) প্রমুখ পীর একই সাথে হিন্দুদের দেবতা ও মুসলমানদের পীর বলে গণ্য হতো। সব ধর্মে সত্য আছে, বহুভাবে আরাধনা করা যায়, আল্লাহ বলে পৃথক কোন স্বত্তা নেই বরং গোটা পৃথিবীর অস্তিত্ববান সবকিছুর মধ্যেই আল্লাহর প্রকাশ নিহিত, তাই নক্ষত্র, গো বৎস বা যে কোন জিনিসেরই উপাসনা মূলতঃ আল্লাহরই উপাসনা। এজন্য সমুদয় মতের প্রতি সহনশীল থাকা উচিৎ। বহুত্ববাদ সমাজের জন্য সহায়ক। আসল লক্ষ্য হচ্ছে আধ্যাত্মিক উন্নতি; কোন ধর্ম, মতবাদ বা সমাজের আনুগত্য নয়- ইত্যাদি ধারণা জনসমাজে নিত্য হয়ে পড়ে। কর্ম ফলাফল তথা জান্নাত-জাহান্নামের প্রত্যাশা বা ভীতি ব্যতীত কেবলমাত্র প্রতিপালক প্রভুর প্রতি ভালবাসা-অনুরক্তি প্রদর্শনই ছিলো তাদের সাধনার মূল কথা।
এসব ছূফীদের প্রবর্তিত ও প্রচারিত সোহরাওয়ার্দীয়া, চিশতীয়া, কলন্দরীয়া, মাদারীয়া, সাত্তারীয়া, রুহানীয়া, নকশবন্দীয়া, কাদেরিয়া প্রভৃতি জানা-অজানা শতাধিক তরীকায় বাংলার মাটি ছেয়ে যায়। রামাই পন্ডিতের ‘শূন্যপুরাণ’সহ হিন্দুদের রচিত পুঁথি, পদাবলীতে এসবের উল্লেখ রয়েছে। সোহরাওয়ার্দীয়া ও চিশতীয়া তরীকাপন্থীরা অদ্বৈতবাদ [5] তথা সর্বেশ্বরবাদের প্রচারক ছিল। পাক-ভারত-বাংলার হিন্দুয়ানী মানসক্ষেত্রে এ মতবাদ অনুকূল ছিল বলে এই দুই পন্থীদের মতবাদ এ দেশে সহজেই আসন লাভে সমর্থ হয়। ফলে পীরপূজা[6], কবরপূজাসহ নানা শিরকী ও বিদ‘আতী কর্মকান্ডে ডুবে যায় মুসলিম সমাজ। অদৃশ্য অমূর্ত আল্লাহর পরিবর্তে দৃশ্যমান পীর-দরবেশই বাংলার ভক্তিবাদী, গুরুমুখী সাধারণ মানুষের ভক্তি বেশী আকর্ষণ করে। বিপদকালে স্রষ্টার পরিবর্তে পীরের কাছে ধর্ণা দেওয়া, পীরের মাযারে মানত করা, তাবীজ-কবজ নেওয়ার প্রবল ঐতিহ্য এভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গড়ে উঠে।
অপরদিকে নিজেদের অসচেতনতায় ও আন্তকলহে শাস্ত্রীয় আলেমগণ ইসলামী শিক্ষার সার্বজনীন অভিভাবকত্ব ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন। কুরআন-হাদীছের চর্চা বাদ দিয়ে তারা ফিকহী খুঁটিনাটি বিষয়ে তুমুল বাক-বিতন্ডায় লিপ্ত থাকতেন। সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের বিশেষ কোন অবস্থান ছিল না। এমনকি ইসলামবিরোধী শক্তিসমূহ সম্বন্ধেও তারা তেমন একটা সচেতন ছিলেন না। অপরদিকে ছূফী পীর-ফকিররা সাধারণ জনগণের অনেক নিকটতর হওয়ায় অনেক বেশী প্রভাব রাখতে পারতেন। তাদের অনাড়ম্বরতা, সরলতা সাধারণ মানুষকে সহজেই আকৃষ্ট করত। ফলে তাদের ইসলামী আক্বীদা পরিপন্থী কার্যকলাপের প্রতিরোধ করা ছিল অত্যন্ত দুঃসাধ্য ব্যাপার। পরিস্থিতি এতটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় যে এমনকি শাসকরা পর্যন্ত বিষয়টির ভয়াবহতা উপলব্ধি করলেও প্রতিরোধ করতে অক্ষম হয়ে পড়েন। এরই মাঝে এই সর্বগ্রাসী পথভ্রষ্টতায় উদ্বিগ্ন কতিপয় বিশুদ্ধতাবাদী আলেমগণ এবং স্বয়ং ছূফীদের কেউ কেউ মুসলমানদেরকে রক্ষার কঠিনতম কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তাদের প্রচেষ্টায় ও বিশেষতঃ মুসলিম শাসনের উপস্থিতির কারণে সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও এই দুরবস্থার মাঝে মুসলমানরা কমপক্ষে আত্মপরিচয় ও স্বাতন্ত্র্যবোধ টিকিয়ে রেখে নিজেদের অস্তিত্ব হেফাযত করতে সক্ষম হয়েছিল। যদিও হিন্দুদের ব্যাপক শত্রুতা যে মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষার এ সংগ্রামে একটা বড় ভূমিকা রেখেছিল তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
বাদশাহ আকবরের সময় উপমহাদেশে ইসলামের উপর বয়ে যায় চূড়ান্ত বিপর্যয়ের ঝড়। সভাসদ ও অন্দরমহলের প্ররোচনায় অশিক্ষিত আকবর এমনসব উদ্ভট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যা ছিল একেবারেই স্থুল ও অতি নীচ চেতনার পরিচায়ক। তার চেয়েও ন্যক্কারজনক ছিল আকবরের সমর্থনে দরবারের সাথে সংশ্লিষ্ট মুসলিম নামধারী ওলী-আওলিয়া, ফকীহ ও আলেমগণের হীন ও ঘৃণ্য আচরণ। এমনকি আকবরের প্রবর্তিত হাস্যকর ‘দ্বীনে ইলাহী’ নামক ধর্মের বায়‘আতনামার খসড়ায় স্বাক্ষরদানকারী ১৮ জনের ১৭ জনই ছিল মুসলমান! এ ছিল মুসলমানদের উপর সুদীর্ঘকাল যাবৎ চেপে বসা অশিক্ষা, কুসংস্কারের অবশ্যম্ভবী পরিণতি। মাওলানা আকরম খাঁ বলেন, ‘তাতারীদিগের উত্থান ও তাহার ভয়াবহ পরিণতির কথা অনেকেই অবগত আছেন। কিন্তু জাতির সহস্ত-সঞ্চিত যে মহাপাতকের প্রতিক্রিয়া চঙ্গেজ ও হালাকু খাঁ রূপে প্রকট হইয়া উঠিয়াছিল, তাহার প্রতি লক্ষ্য করার মত চিন্তাশীল মানুষ মুছলমান সমাজে আজও খুব কমই দেখা যায়’। জনৈক ঐতিহাসিক বলেন, যথাসময়ে মুজাদ্দিদ আলফে ছানীর দুঃসাহসিক আবির্ভাব না ঘটলে হিন্দুস্থানের বুক থেকে তিনশত বছর পূর্বেই ইসলামের নাম-গন্ধ পর্যন্ত উঠে যেত। বাদশাহ আকবারের অনাচারের বিরুদ্ধে শায়খ আহমাদ সারহিন্দীর পরিচালিত (১৫৬৩-১৬৩৪ খৃঃ) এই সংস্কারবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে উপমহাদেশের মুসলিম সমাজে এই প্রথম জাগ্রত হয় এক নতুন চেতনা। মধ্যযুগের নির্জীবতায় সৃষ্টি হয় নবচাঞ্চল্য। পরে মোগল বাদশাহ আওরঙ্গজেবের সংস্কারধর্মী পদক্ষেপে ইসলামী শাসনধারার সাথে কিছুটা হলেও পরিচিত হতে সক্ষম হয় মুসলিম সমাজ।
উপমহাদেশে শী‘আদের প্রভাব শুরু হয় সম্রাট বাবরের মাধ্যমে। রাজ্যশাসনে একজন যোগ্য মিত্র শী‘আ মতাবলম্বী শাহ ইসমাইল সাফাভীর সান্নিধ্যে এসে শী‘আ মতবাদ সম্পর্কে তার বিরোধী মানসিকতা লোপ পায়। পরবর্তীতে বাবরের পুত্র হুমায়ুন ইরানে নির্বাসিত জীবন-যাপনকালে ইরানী অভিজাতদের সংস্পর্শে এসে প্রভাবান্বিত হন। রাজ্য ফিরে পাওয়ার পর তিনি তুর্কী কর্মচারীদের দৌরাত্ম্য প্রতিরোধে তার শী‘আ বন্ধুদের মুঘল দরবারে হিজরতের আমন্ত্রণ জানান। তখন থেকেই প্রতিভাবান ইরানীরা সাম্রাজ্যে সর্বেসর্বা হয়ে পড়ে। শী‘আ সম্প্রদায়ভুক্ত বিখ্যাত বৈরাম খাঁ হুমায়ুনের ডানহাতে পরিণত হন যিনি পরে সম্রাট আকবরের অভিভাবকত্বের দায়িত্বেও নিয়োজিত হন। এভাবে শী‘আ মতবাদ উপমহাদেশে শক্তভাবে স্থান করে নেয় যার প্রভাব বাংলাতে পড়ে। শী‘আ সাহিত্যিকদের মাধ্যমে কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা, মুহাররম পর্ব ও অন্যান্য শী‘আ আচার-অনুষ্ঠান এ অঞ্চলের মানুষের চেতনারাজ্যে গভীরভাবে স্থান করে নেয়।
এছাড়া ভিন্নধারার একটি অবক্ষয় বিশুদ্ধতাবাদী আলেমদের মাঝেও মধ্যযুগে সবসময়ই বিরাজ করেছিল। আববাসীয় খিলাফতের কিছুকাল পূর্বে মাযহাব বা ধর্মীয় ব্যাখ্যা নিয়ে আলেমদের মধ্যে দলগত যে বিভক্তি বিরাট আকারে মাথাচাড়া দেয় খিলাফতের পতন পরবর্তী চিন্তার অস্বাভাবিক স্থবিরতার সময় তা মুসলিম বিশ্বে স্থায়ী ভিত্তি লাভ করে। এদেশে আগত ছূফী-সাধকগণ এবং তুর্কী ও আফগান শাসকগোষ্ঠী হানাফী মাযহাবের অনুসারী হওয়ায় এ অঞ্চলের অধিবাসীরাও এই মতবাদের অনুসারীতে পরিণত হয়। আলেমদের এক বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল এই মাযহাবগত বিরোধ। এ বিরোধ এড়ানো তাদের পক্ষে এক প্রকার অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যায়ে একমাত্র শাহ ওয়ালীউল্লাহই ছিলেন এ ক্ষেত্রে প্রায় সফল এক ব্যক্তিত্ব, যিনি স্বয়ং এ বিরোধ দূরীকরণে অসাধারণ ভূমিকা রাখেন। ইসলামের বিশুদ্ধ, অবিমিশ্র ধারার যে স্বর্ণোজ্জ্বল দ্বীপশিখা তিনি উপমহাদেশের বুকে প্রজ্জ্বলন করেছিলেন তা আজও পর্যন্ত মুসলমানদের জন্য প্রকৃত ইসলামী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় প্রেরণার উৎস হয়ে রয়েছে।
এ সময় বাংলায় হাদীছের চর্চা তেমন উল্লেখযোগ্য আকারে ছিল বলে ইতিহাসে পাওয়া যায় না। তবে চতুর্দশ শতকে দিল্লির খ্যাতনামা মুহাদ্দিছ নিযামুদ্দীন আওলিয়ার ছাত্র শায়খ সিরাজুদ্দীন গৌড়ে ইসলাম প্রচার করেন। পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে আলাউদ্দীন আলাউল হক, নুর কৎবে আলম, জৌনপুরের ইবরাহীম শারকী, রাজশাহীর শাহ মু‘আয্যম দানিশমন্দ, ঢাকার মুহাম্মাদ দায়েম প্রমুখের নাম জানা যায় যারা ইলমে হাদীছের চর্চা এ অঞ্চলে জারী রেখেছিলেন। বাংলার সুলতানদের মধ্যে আলাউদ্দীন হুসাইন শাহ (১৪৯৪-১৫১৯ খৃঃ) ছিলেন ইলমে হাদীছের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক। সুতরাং অবক্ষয় যুগে অল্পবিস্তর হলেও বাংলায় রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত অনুযায়ী বিশুদ্ধ ইসলামী জীবনধারা পরিচালনার ধারা যে অব্যাহত ছিল এটা নিশ্চিত। প্রাচীন পুঁথি সাহিত্যেও মাঝে মাঝে এর নিদর্শন পাওয়া যায়।[7]
আলোচনার প্রান্তে এসে বলা যায় যে, বাংলার মুসলিম সমাজে প্রাচীন ও মধ্যযুগে বিভিন্নরূপে জাহেলিয়াতের আক্রমণ ঘটেছিল মূলতঃ ৩টি কারণে- (১) মুসলমানদের প্রতিবেশী হিন্দু সমাজ, (২) ছূফীবাদের গঠন-প্রকৃতি ও তাদের মাধ্যমে আগত ইসলাম; যা ছিল মূলতঃ ইসলামের ইরানী সংস্করণ ও (৩) তুর্কী ও মোগল শাসকদের কার্যকলাপ। ফলশ্রুতিতে আল্লাহ প্রেরিত এবং রাসূল (ছাঃ) প্রচারিত বিশুদ্ধ ইসলামী আক্বীদা ও সামাজিক নীতিমালা এ অঞ্চলে পরিদৃষ্ট হয়নি। শাসকদের মাঝেও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ইসলামী আদলে গড়ে তোলার ছিল না কোন হৃদ্যিক তাকীদ। ফলে নামে-বেনামে বহু বিজাতীয় কুসংস্কার, বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান মুসলিম সমাজের মন-মস্তিষ্কের উপর প্রবল প্রভাব বিস্তার করে। তাওহীদ ও রিসালতের স্বচ্ছ সলিলে জমে যায় শিরক ও বিদ‘আতের বিষাক্ত কালো আবর্জনার স্তূপ। ইসলাম বাংলার মানুষের মাঝে প্রচলিত অর্থের একটি আধ্যাত্মবাদী ধর্ম হিসাবেই চর্চিত হতে থাকে। মূর্তিপূজা হারাম হওয়ার ব্যাপারে কোন সংশয় না থাকলেও অন্যান্য শিরকী ও বিদ‘আতী কর্মকান্ডের সাথে আপস করার মনোবৃত্তি মুসলিম সমাজে যুগ যুগ ধরে পরিপুষ্ট হয়। এ সমস্ত কারণে মূল্যবোধের নিরিখে চারিত্রিকভাবে কিছুটা সুদৃঢ় থাকলেও আক্বীদা-বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে অধঃপতনের অতল তলে ডুবে ছিল বাংলার মুসলিম সমাজ।
তথ্যসূত্র :
মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস- মাওলানা আকরম খাঁ।
বাংলাদেশে ইসলাম- আব্দুল মান্নান তালিব।
বাংলাদেশ ইতিহাস পরিক্রমা- কে.এম. রইসউদ্দীন খান।
ফিনিসিয়া থেকে ফিলিপাইন- মোহাম্মাদ কাসেম।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা (মুসলিম বিশ্ব সংখ্যা, এপ্রিল-জুন ১৯৮৪)।
আহলেহাদীছ আন্দোলন- ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব।
ভারতবর্ষের ইতিহাস- ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান।
ইতিহাসের ইতিহাস- গোলাম আহমদ মর্তুজা।
উপমহাদেশের রাজনীতিতে আলেম সমাজ- আই. এইচ. কোরেশী।
ভারতীয় সংস্কৃতিতে ইসলামের প্রভাব- ড. তারা চাঁদ।
বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস- ড. আব্দুল করীম।
বরেন্দ্র অঞ্চলে মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্য- ড. এ কে এম ইয়াকুব আলী।
[1]. জাতিসংঘের মতে, দারিদ্রসীমা হল প্রাপ্তবয়স্ক লোকের দৈনিক উপার্জনের গড় ১ ডলারের নিচে হওয়া। আর আয়ের গড় ২ ডলারের নীচে এমন লোকের সংখ্যা দেশে বর্তমানে ৭৮%-এরও বেশী।
[2]. মরমীবাদ হল একটি অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য মানসিক ক্রিয়া যা প্রত্যেক ধর্মের অন্তর্নিহিত ব্যাপার। সকল সংস্কৃতিতে ও মানুষের সকল যুগের ইতিহাসে এর উদ্ভব হতে দেখা যায়।
[3]. যেমন- ছূফী রীতির লতীফা ও রাবিতা (মধ্যস্থ বা গুরুর মাধ্যমে পরমাত্মার সাথে মিলিত হওয়ার পদ্ধতি) ভারতীয় কুন্ডলীনী ও গুরুবাদেরই প্রতিচিত্র। হিন্দুদের গুরু/ সাধক/ ঋষী-শিষ্য-আশ্রম ও মুসলমানদের সংস্কৃতিতে পীর/ দরবেশ/ ওলী- মুরীদ- খানকাহ/ দরগাহ; হিন্দু রীতির প্রেম, যোগসাধন, দশা ও প্রানায়ামের জপ, কীর্তন ছূফী নীতিতে ইশক, হাল, মাকাম ও যিকর; উপাসনায় বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্য-গীতের ব্যবস্থা ইত্যাদি।
[4]. সর্বেশ্বরবাদ অর্থ সর্বভূতে আল্লাহর অধিষ্ঠান বা ‘অহং বক্ষ্মাস্মি’বাদ তথা ‘স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই; বরং সৃষ্টির মধ্যেই স্রষ্টার প্রকাশ’ মতবাদ। আল্লাহকে ফার্সীতে ‘খোদা’- খোদ (স্বয়ং) + আঃ (আসিয়াছেন) - মানে সংস্কৃত ভাষায় যাকে স্বয়ম্ভু বলা হয় তা এই শিরকী আক্বীদা থেকেই উৎসারিত।
[5].‘স্রষ্টা ও সৃষ্টি অভিন্ন; সৃষ্টি স্রষ্টার সাথে ফানা বা মিশে যেতে পারে’ মতবাদ।
[6]. ফার্সী শব্দ ‘পীর’ বলা হতো ইরানের অগ্নি উপাসকদের গুরুকে।
[7]. যেমন- মধ্যযুগে নাগরীলিপিতে লিখিত মুন্সী সাদেক আলী রচিত পুথিসাহিত্য ‘কেতাব হালতুন্নবী’ (শামায়েলে মুহাম্মাদী অথবা নবীজীবনী) যা একসময় সিলেটের ঘরে ঘরে পাঠ করা হতো তার শেষের দিকে লেখক বলছেন, ‘আখেরী যামানায় এই বাংলায় নবীর সুন্নাত যারা মানবে তারা একেকজন শহীদের ছওয়াব পাবে’। শেষ অধ্যয়টির নাম ‘বেদাতীর বয়ান’ (ঢাকা: উৎস প্রকাশন, ২০০৯) পৃষ্ঠা ২৫৮।