আলোকপাত
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
আমি বর্তমানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র । পাঁচ বছর পূর্বে আমি যাবতীয় পাপকাজ থেকে তওবা করে আল্লাহর অশেষ রহমতে দ্বীনের প্রতি পূর্ণভাবে অবিচল থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমি দাড়ি রেখেছি এবং ইসলামী আদব-কায়দাগুলো রপ্ত করেছি। কিন্তু দুঃখজনক হলো আমার পরিবার, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব আমার এই পরিবর্তনকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে এবং আমাকে উপহাস করে। এসব বাধাকে আমি দ্বীনের খাতিরে কিছুই মনে করি না। কিন্তু একদিন এক দুঃসম্পর্কীয় আত্মীয়ের সাথে সাক্ষাৎ হয়। তিনি আমাকে বিদ্রুপের স্বরে মাওলানা সাহেব, হুজুর সাহেব ইত্যাদি বলে সম্বোধন করতে লাগলেন। আমি ক্রমাগতভাবে কয়েকদিন হাসিমুখেই উত্তর দিয়েছি যে, আমি তো আপনার অভিভাবক (মাওলা) নই বা আমি উঁচু দরের সম্মানিত (হুজুরে আ‘লা) কেউ নই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। ক্রোধের স্বরে একদিন আমি তাঁকে এ আচরণ পরিত্যাগ করতে বললাম এবং বললাম আমি যদি একজন ফাসিক, বেদ্বীন হতাম আপনি কি এভাবে আমাকে বিদ্রুপ করতে পারতেন? আমি সেদিন থেকে তার সাথে আর সম্পর্ক না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যদিও আমি সবসময় তাঁর হেদায়াতের জন্যই দো‘আ করি। আমার এ ধরণের আচরণ বা সিদ্ধান্ত কি ঠিক হয়েছে?
- আরীফুল ইসলাম
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
আপনাকে মুবারকবাদ জানাই দ্বীনের পথে ফিরে আসা এবং তার উপর অটলভাবে টিকে থাকার দৃঢ় মানসিকতা অর্জনের জন্য। আল্লাহ আপনাকে দুনিয়া ও আখিরাতে যথাযোগ্য মর্যাদায় ভূষিত করুন। আপনি আপনার নিকটজনদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যে উপহাসের শিকার হয়েছেন তা দ্বীনের পথের পথিকদের জন্য অতি স্বাভাবিক একটি বিষয়, যা থেকে নবী-রাসূলগণ ও তাদের অনুগামীগণ কেউই পরিত্রাণ পাননি। পৃথিবীবাসীর জন্য সর্বোত্তম আদর্শ হওয়া সত্বেও নবী-রাসূলদের এমন একজন ছিলেন না যিনি স্বীয় কওমের দ্বারা লাঞ্ছিত হননি। এমনকি সাধারণভাবে পৃথিবীর অধিকাংশ জ্ঞানী-মনীষীদেরকে এ ধরনের অভিজ্ঞতা বরণ করতে হয়েছে। অতএব কষ্ট অনুভবের প্রয়োজন নেই। আপনি সর্বোচ্চ কল্যাণের পথে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন, ভ্রষ্টতা তথা শয়তানের পথ পরিহার করে ছিরাতে মুস্তাকীম তথা আল্লাহর পথে যাত্রা শুরু করেছেন, এটাই আপনার জন্য মহাসৌভাগ্যের বিষয়। এ পথে আপনার সামনে বহু বাধা-বিপত্তি আসবে। মুমিনদের প্রতি কাফিরদের এরূপ উপহাসের বিবরণ তো পবিত্র কুরআনেই এসেছে, ‘যারা অপরাধী তারা মুমিনদের দেখে উপহাস করত। তারা যখন তাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করতো তখন পরষ্পরে চোখ টিপে ইশারা করত। পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে যাওয়ার সময়ও তারা হাসাহাসি করত। মুমিনদেরকে দেখে তারা বলত, এরা তো নিশ্চিতভাবে পথভ্রষ্ট’ (তাত্বফীফ ২৯-৩১)। আর আল্লাহও বলেছেন যে, তিনি নিজেই তাদের প্রতি পরিহাসকারী এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবকাশদানকারী যাতে তারা সীমালংঘনে মত্ত হয়ে থাকতে পারে (বাক্বারা ১৪-১৫)। অতএব তাদের মূর্খতা, অজ্ঞতাকে গুরুত্ব না দিয়ে কুরআনের ভাষায় তাদেরকে ‘সালাম’ বলে নম্রতার সাথে এড়িয়ে চলুন (হূদ ৬৯, ফুরক্বান ৬৩, ক্বাছাছ ৫২)। কেননা তারা তো শয়তানের ফেরে পড়ে স্বীয় প্রবৃত্তির পূজায় লিপ্ত হয়ে পড়েছে যেখান থেকে আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করেছেন। সুতরাং তাদের সাথে নম্র ও রহমদিল হয়ে কথা বলুন। উদ্ধত আল্লাহদ্রোহী ফেরাউনের সাথে নবী মূসা ও হারুণ (আঃ)-এর বিনম্র আলাপচারিতা থেকে শিক্ষা নিন। তবে এসব পরিস্থিতিতে অবশ্যই নিজেকে দুর্বল ও অপমানিতভাবে উপস্থাপন করবেন না। প্রয়োজনে কঠোর হবেন। যেভাবে রাসূল (সাঃ) কা‘বা ঘরে কাফিরদের ক্রমাগত বিদ্রুপবাণে অতিষ্ঠ হয়ে হঠাৎ একদিন তীব্র ক্রোধ প্রকাশ করেন যা ছিল কাফিরদের কাছে বজ্রপাত সমতুল্য। এতে তারা ভীত ও লজ্জিত হয়ে স্থান ত্যাগ করেছিল। সুতরাং সংশোধনের উদ্দেশ্যে এসব অজ্ঞদের প্রতি সাময়িক কঠোরতা প্রকাশ করতে পারেন। এছাড়া তাদের প্রতি আপনার কিছু কর্তব্য রয়েছে। যেমন- (১) আন্তরিকভাবে সদুপদেশ দেয়া। (২) উপহার সামগ্রী দেওয়া বা বাড়িতে দাওয়াত করা যাতে তাদের অন্তরের পীড়া দূরীভূত হয়। (৩) প্রয়োজনীয় বই পড়তে দেওয়া। (৪) সবসময় তাদের জন্য আল্লাহর নিকট হেদায়াত প্রার্থনা করা। (৫) দ্বীনী বৈঠকসমূহে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
এভাবে আল্লাহ হয়তো আপনার মাধ্যমে তার জন্য হেদায়াতের পথ খুলে দিবেন। যার চেয়ে কল্যাণকর কোন বিষয় আপনার ও তার জন্য কিছুই হতে পারে না। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যদি আল্লাহ তোমার মাধ্যমে কোন ব্যক্তিকে হেদায়াত লাভ করান তবে তা তোমার জন্য লাল উটের (অতি মূল্যবান জিনিস) চেয়েও উত্তম হবে’ (মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/৬০৮০)। আল্লাহ আমাদেরকে তাদের দ্বীনের উপর দৃঢ়চিত্তভাবে কায়েম থাকার তাওফীক দিন এবং পথভ্রষ্টদেরকে পথপ্রদর্শন করুন। আমীন!
দেশ-বিদেশে জঙ্গী কার্যকলাপ শুরু হওয়ার পর বিশেষতঃ ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর আমি দ্বীনের প্রতি মানসিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়েছি এবং আল্লাহর সাহায্য থেকে হতাশ হয়ে গেছি। আমি কিভাবে এ মানসিক ক্রটি কাটিয়ে উঠব? দ্বীনের উপর সার্বক্ষণিক অটল থাকতে আমার করণীয় কি?
-আব্দুর রাকীব
কাকডাঙ্গা,সাতক্ষীরা
এ ধরনের মনোঃপীড়া, উদ্বেগ-পেরেশানীতে আপনার মত অনেক মুসলমানই আক্রান্ত। এটা কেবল আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে স্বল্প ধারণা, চিন্তার অগভীরতা ও অন্তরের সংকীর্ণতারই ফলশ্রুতি। দুর্ভাগ্যজনক যে, বহু মুসলমান ইসলামকে তাদের পূর্বপুরুষদের উত্তরাধিকার মনে করে (যুখরুফ ২৩)। মূলতঃ এ দ্বীন আল্লাহর শক্তি ও ইজ্জতের বদৌলতে চিরঞ্জীব ও চিরবিজয়ী। এতে কোন পরাজয় নেই। কেননা মানবতার চূড়ান্ত বিজয় পরকালীন মুক্তিতেই নিহিত, দুনিয়াবী ক্ষমতা বা সম্পদের মাঝে নয়।
বর্তমান বিশ্বপ্রেক্ষাপটে মুসলিম উম্মাহ যে জাগতিক শক্তিতে পিছিয়ে রয়েছে এটা কেবল তাদের ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণেই। মুসলিম হিসাবে আমরা শর্তগুলো পূরণ করতে পারলেই আল্লাহর প্রতিশ্রুত সাহায্য নেমে আসবে (নূর ৫৫)। বর্তমান অবস্থায় আল্লাহ নির্দেশিত ও রাসূল (ছাঃ) প্রদর্শিত পথ থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করে আমরা কিভাবে আল্লাহর সাহায্য আশা করতে পারি?
১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা মুসলিম বিশ্বের জন্য বিপদ ডেকে আনলেও বহু ইতিবাচক এবং ইসলামের জন্য কল্যাণকর বিষয়েরও সূচনা করেছে। গত ৮ বছরে খৃষ্টান ও ইহুদী বিশ্ব মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে যেভাবে নিজেদের পুরানো হিংসাত্মক চেহারা উন্মোচন করেছে তাতে সারাবিশ্বে স্পষ্ট হয়ে গেছে আধুনিক সভ্যতার দাবীদারদের অসার বাগাড়ম্বরতা। ফলে একদিকে যেমন পশ্চিমারা নতুনভাবে ইসলামকে জানার চেষ্টা করছে এবং তাদের মাঝে ইসলাম গ্রহণের প্রবণতা পূর্বের চেয়ে অনেকগুন বেড়ে গেছে। অন্যদিকে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যেও আলহামদুলিল্লাহ দ্বীনের প্রতি সচেতনতা পূর্বের তুলনায় অনেক বেশী জাগ্রত হয়েছে। অতএব আল্লাহর সাহায্য থেকে হতাশ হওয়ার কারণ নেই (হিজর ৫৫-৫৬)। বস্ত্তত প্রকৃত সত্যের পথে ধাবমান একজন মু‘মিন সবসময়ই বিজয়ী (আলে ইমরান ১৩৯)।
আপনি দ্বীনের প্রতি দৃঢ়কদম হওয়ার জন্য করণীয় জানতে চেয়েছেন। এজন্য প্রাথমিক শর্ত হলো ইসলামের দিকে পুরোপুরি ফিরে আসা এবং চলার পথকে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত অনুযায়ী পরিশুদ্ধ করা। আর প্রয়োজন হলো, নিজেকে সার্বক্ষণিক অনুশীলনের মধ্যে রাখা। নিয়মিত অনুশীলন ছাড়া কোন চাওয়াকেই বাস্তবায়ন করা যায় না। নিম্নে কিছু করণীয় উল্লেখ করা হলো-
১- সিজদার সময় একান্তে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চান। রাসূল (ছাঃ) এ ধরনের পেরেশানীর অবস্থায় এ দো‘আ পড়তেন يا مقلب القلوب ثبت قلبي على طاعتك বাيا مصرف القلوب صرف قلوبنا على طاعتك ‘হে অন্তরের পরিবর্তনকর্তা! আমাদের অন্তরকে তুুমি তোমার আনুগত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখ’ (মুসলিম, মিশকাত হা/৮৯)।
২- সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করুন (মু’মিন-৫৫)। সকাল-সন্ধ্যায় পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করুন (রা‘দ-২৮)। রাত-দিনের মাসনূন দোআ‘গুলো মনে করে পড়ুন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, তোমার জিহ্বা যেন সবসময় আল্লাহর যিকিরে সিক্ত থাকে (মিশকাত হা/২২৭৯)।
৩- আল্লাহর মাহাত্ম্য ও বড়ত্বকে স্মরণ করুন। আল্লাহর দৃশ্যমান ও অদৃশ্য নিদর্শনাবলীকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করুন (বাক্বারা-১৬৪)। দিনে দশ সেকেন্ডের জন্য হলেও আল্লাহর স্মরণে চোখ বন্ধ করে উর্ধ্বলোকে বিচরণ করুন।
৪- ছাহাবা ও সালাফে সালেহীনের জীবনেতিহাস পাঠ করুন। তাদের আল্লাহর রাস্তায় অটল থাকার হিম্মত ও মহিমাকে অন্তরে গেঁথে নিন।
৫- ছালাতকে তার পরিপূর্ণ হক্ব সহকারে আদায় করুন, ঠিক যেভাবে রাসূল (ছাঃ) দেখিয়ে দিয়েছেন। ছালাতের মাঝে যে অনন্যসাধারণ পবিত্রতা, ইতিবাচক প্রভাব এবং হৃদয়ের প্রশান্তি রয়েছে তা কেবল যথার্থভাবে আদায়কারীই অনুভব করতে পারেন।
৬- ছাদাকা করুন বিশেষতঃ গোপনে (বাক্বারাহ ২৭১)। মনের উপর এর যে বিরাট প্রভাব রয়েছে তা কেবলমাত্র দাতাই অনুভব করতে পারেন।
৭. সমাজকল্যাণমূলক কাজে মনোনিবেশ করুন। মানুষকে বিপদ-আপদে সহযোগিতা করুন। সৎকাজের জন্য উৎসাহিত করুন। অসৎকাজ দেখলে সাধ্যমত নিষেধ করুন। উত্তম বন্ধুদের সাহচর্যে থাকুন। সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ ফিরে আসলে আপনি নিজেকে অন্যরূপে আবিষ্কার করবেন।
৮. সর্বোপরি পরকালীন চিন্তাকে সবসময় অগ্রাধিকার দিন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার সব চিন্তাকে আখেরাতমুখী করবে, আল্লাহ তার দুনিয়াবী চিন্তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবেন। আর যে ব্যক্তি দুনিয়াবী চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত থাকবে, সে কোথায় ধ্বংস হয়ে গেল সে ব্যাপারে আল্লাহ কোন যিম্মাদারী নিবেন না’ (ইবনে মাজাহ, মিশকাত হা/২৬৩)।
এভাবে নিজেকে জাগ্রত রাখতে পারলে আপনার মানসিক অস্থিরতা দূর হবে এবং সৎ আমলের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে ইনশাআল্লাহ (শূরা ২৩)। আল্লাহর বান্দা হিসাবে নিজেকে মর্যাদা দিন (বনী ইসরাঈল-৭০)। এতে অন্তরে অপার্থিব এক পবিত্রতা, এক সুস্থির প্রশান্তি অনুভব করবেন যা আপনাকে ন্যায় ও কল্যাণের উপর দৃঢ় রাখবে (নূর ৩৫)। সাথে সাথে পাপকাজগুলো একে একে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করুন। সৎ আমল বেশী বেশী করার মাধ্যমে পাপ কাজের মানসিকতা দুরীভূত হয়ে যায় (হূদ ১১৪)। অপ্রয়োজনীয় ও অর্থহীন বিনোদনে সময় নষ্ট করা থেকে সতর্কতার সাথে নিজেকে বিরত রাখুন। নতুবা শয়তানের প্ররোচনায় আপনার আমল ধীরে ধীরে শিথিল হতে থাকবে (নূর ২১)। আল্লাহ আমাদেরকে তার দ্বীনের উপর অটল রাখুন এবং যাবতীয় অকল্যাণ থেকে হেফাজত করুন। আমীন!
সংগঠন কি? একজন সংগঠকের বৈশিষ্ট্য ও কর্তব্য কি?
-আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
নওদাপাড়া মাদরাসা, রাজশাহী
সংগঠন শব্দটির আরবী প্রতিশব্দ হলো الجماعة যা তিনের অধিক একত্রিত বা সমন্বিত কিছুকে বুঝায়। অর্থাৎ সমন্বিতভাবে বা সমষ্টিগতভাবে কোন কার্যক্রম পরিচালনার নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়াই হলো সংগঠন। মানুষ স্বভাবতঃই একাকী জীবনযাপন করতে পারে না। সামাজিক বা সামষ্টিক জীবন যাপনই তার চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ রাববুল আলামীন পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীর মাঝে এই মৌলিক বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করেছেন। সংগঠন হলো এই সমষ্টির একটি আনুষ্ঠানিক কাঠামো। একটি পরিবার যদি হয় ক্ষুদ্র সংগঠন তবে রাষ্ট্র হলো তার সর্ববৃহৎ রূপ। সীমিত অর্থে তাই প্রতিটি মানুষই এক একজন সংগঠক। কোন একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রয়োজনীয় নীতিমালার আলোকে সামষ্টিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করাই একটি সংগঠনের কাজ। সংগঠক হলো এই সংগঠনের মূল প্রাণ যার কর্তব্য হলো সংগঠনকে সুষ্ঠু ও সুশৃংখলভাবে পরিচালনা করা।
সংগঠকের ভূমিকার উপরই নির্ভর করে একটি সংগঠনের গতি-প্রকৃতি। তার পরিচালনা নীতিই নির্ধারণ করে দেয় সংগঠনের গন্তব্যপথ। তাই সংগঠনে সংগঠকের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। একজন সংগঠকের সাধারণ কিছু কর্তব্য হলো-
১. সংগঠনের লক্ষ্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা। লক্ষ্যকে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে অথবা লক্ষ্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকলে সংগঠক সংগঠনের জন্য কাংখিত ফলাফল আনতে নিশ্চিত ব্যর্থ হবে।
২. লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও অটল মানসিকতা পোষণ করা। জ্ঞান, বিদ্যাবত্তা, কর্মদক্ষতা ইত্যাদি বিষয় জরুরী হলেও একটি সুস্থ ইতিবাচক মানসিকতাই একজন সংগঠকের প্রধান সম্পদ যে মানসিকতার বদৌলতে সে সমস্ত বাধা-বিপত্তিকে ধৈর্য ও সাহসের সাথে মোকাবিলা করে জনসমষ্টিকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছাতে অবিচল থাকে। স্বার্থের টান, বিপদের হুমকি, অপ্রাপ্তির হতাশা তাকে কুন্ঠিত করে না। ব্যর্থতার গ্লানিকে অতিক্রম করে সম্ভবনার দুয়ার অনুসন্ধানের দৃঢ়চিত্ততা তাকে একমুহূর্তের জন্যও লক্ষ্য অর্জনে পিছপা করে না।
৩. নিয়ন্ত্রণাধীন বলয়কে একটি পরিবার, একটি টীম বা একটি রাষ্ট্রের মত মনে করা; যার প্রতিটি অঙ্গকে সংগঠক সমানভাবে একই লক্ষ্যে পরিচালিত করে। একজন অনুঘটক, একজন প্রণোদনাদাতা হিসাবে প্রত্যেকের মাঝে সে কর্তব্যের চরম তৃষ্ণাবোধ জাগিয়ে দেয়। কাংখিত লক্ষ্যে উজ্জীবিত করে সে লক্ষ্য অর্জনে প্রত্যেকের মাঝ থেকে সর্বোচ্চটুকু বের করে আনার প্রয়াস চালায়। সংগঠক একদিকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়; অপরদিকে পিছনে থেকে নিয়ন্ত্রণের লাগাম সচেতনতা, দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাসের সাথে ধারণ করে থাকে।
৪. নির্ভরতার প্রতীক হিসাবে মমতাপূর্ণ সহনশীলতা, উদারতা, সহানুভূতি অবলম্বন করা। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে বিশৃংখল জনগোষ্ঠীকে একটি কেন্দ্রীয় শক্তির অধীনে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা তার কর্মনীতির মূল বৈশিষ্ট্য।
৫. নিজের প্রতি, সমাজের প্রতি চেতনাপূর্ণ দায়িত্বশীলতা থাকা। দায়িত্বপরতার কঠিন সংগ্রামে সে আপন বলয়কে এমন এক বন্ধনে আবদ্ধ করে ফেলে যাকে ইচ্ছা করলেই এড়ানো যায় না। সনিষ্ঠ দায়িত্ববোধ, নির্ভুল কর্তব্যপরায়ণতা তাকে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রতি মুহূর্তে তৎপর রাখে।
মোটকথা সার্বক্ষণিক লক্ষ্যে অবিচল থাকা এবং ইতিবাচক মানসিকতা বজায় রেখে অভিষ্ট লক্ষ্যে জনগোষ্ঠীকে সম্মুখপানে অগ্রসর রাখার প্রতিটি সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে আপ্রাণ চেষ্টা করাই একজন প্রকৃত সংগঠকের মূল বৈশিষ্ট্য।
উত্তম চরিত্রগুণ, সার্বজনীন ভালবাসাবোধ, সদাচরণ, অকপট সারল্য, কর্তব্যনিষ্ঠা, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের প্রতি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ, সৎসাহস, নিজ অধিকারের ব্যাপারে ক্ষমা, মার্জনা ও ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা এবং অপরের অধিকার প্রদানে যত্নবান হওয়া ইত্যাদি মহৎগুণগুলো একজন সংগঠককে মানবসমাজে বিশেষভাবে স্থান করে দেয়।