দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি : বিপর্যস্ত জনজীবন
আব্দুল্লাহ আল-মুছাদ্দিক
লিলবর আল-বারাদী 1870 বার পঠিত
তিন. লোভ রিপু :
লোভ হ'ল লিপ্সা বা কাম্য বস্ত্ত লাভের প্রবল ইচ্ছা। বিনা লোভে কোন কাজও হয়না আবার লোভ নেই এমন মানুষও নেই। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে যত কাজকর্ম রয়েছে তার প্রতিটির পেছনে নিহীত রয়েছে লোভ। বিনা লোভে পৃথিবীতে কিছুই হয় না। লোভ আছে বলেই মানুষের বেঁচে থাকার স্পৃহা আছে, জাগতিক ও পারলৌকিক আশা-আকাংখা তথা অভিপ্রেত অনুভূতি আছে।
তবে লোভের রকমফের রয়েছে। কথায় বলে, ‘অতি লোভে তাঁতী নষ্ট’। আসলে অতি লোভের পরিণাম হিসাবে আসে পাপ। পৃথিবীতে মানুষ যে লোমহর্ষক কর্মকান্ড করছে তার মূলে রয়েছে অতি লোভ।
লোভকে বাস্তবায়ন বা চরিতার্থ করার জন্য মানুষ যে কোন অসৎ উপায় অবলম্বন করতে পারে। অতি লোভ মানুষকে পাপের সমুদ্রে অবগাহন করিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। বিশেষ করে নারীর লোভ, অর্থ সম্পদের লোভ, সুনাম অর্জনের লোভ ও নেতৃত্বের লোভ ইত্যাদি। লোভই মানুষের জীবনকে চরম ও ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। তখনই লোভ মানব জীবনের বড় রিপু বলে বিবেচিত হয়। আর পাপের পরিণতি মৃত্যু। প্রবাদ রয়েছে, ‘লোভে পাপ পাপে মৃত্যু’।
মানুষ যখন লোভের বশীভূত হয়ে পড়ে তখন তার মানবতা, বিবেক, সুবুদ্ধি লোপ পায়। সে স্বপচারী হয়ে কল্পনার বিশাল রাজ্যের রাজা হয়ে লোভান্ধ হয়। তখনই সে লোভের কলংকিত কালিমায় নিক্ষিপ্ত হয়ে যায় এবং সমূহ বিপদ ও ভয়াল সর্বনাশ তাকে ঘিরে ফেলে। কিন্তু এ লোভকে সংবরণ করে, সংযম করে বা নিয়ন্ত্রণ করে হিতাহিত বোধকে জাগ্রত করে তার জীবন ও জগতের কল্যাণ বিবেচনা করে কাজ চালাতে পারলে সে লোভ তাকে নিতান্ত সুখ স্বর্গে নিক্ষেপ করে। নিয়ন্ত্রিত লোভ পৃথিবীকে সাজিয়ে দিতে পারে অনাবিল আরাম আর কল্যাণময় উন্নতির পুষ্প বাগানে।
লোভ মানুষকে ধ্বংসের দিকে আহবান করে। লোভ-লালসা মানুষের অন্তরের মারাত্মক ব্যাধি। সীমাহীন লোভ-লালসা মানুষকে তার সামর্থ্যের বাইরে ঠেলে দেয়। তার বিবেক-বুদ্ধি লোপ করে তাকে দুর্নীতি ও পাপের পথে পরিচালিত করে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, জবরদখল, ঘুষ-দুর্নীতি, মারামারি, হানাহানি, সন্ত্রাস, বোমাবাজি, অপহরণ, গুম, খুনখারাবিসহ অধিকাংশ সামাজিক অনাচার বা বিপর্যয়ের পেছনে লোভ-লালসার বিরাট প্রভাব রয়েছে। লোভীদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, وَلَتَجِدَنَّهُمْ أَحْرَصَ النَّاسِ عَلَى حَيَاةٍ وَمِنَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا يَوَدُّ أَحَدُهُمْ لَوْ يُعَمَّرُ أَلْفَ سَنَةٍ وَمَا هُوَ بِمُزَحْزِحِهِ مِنَ الْعَذَابِ أَنْ يُعَمَّرَ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِمَا يَعْمَلُونَ ‘তুমি তাদেরকে দীর্ঘ জীবনের ব্যাপারে অন্যদের চাইতে অধিক আকাংখী পাবে এমনকি মুশরিকদের চাইতেও। তাদের প্রত্যেকে কামনা করে যেন সে হাযার বছর আয়ু পায়। অথচ এরূপ আয়ু প্রাপ্তি তাদেরকে শাস্তি থেকে দূরে রাখতে পারবে না। বস্ত্ততঃ তারা যা করে, সবই আল্লাহ দেখেন’ (বাক্বারাহ ২/৯৬)।
ক. অর্থ-সম্পদের লোভ : লোভ মানুষের স্বভাব জাত একটি বৈশিষ্ট্য। অধিক পাওয়ার আকাংখাকে এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ উপার্জনের আশা ব্যক্ত করা এই বৈশিষ্ট্যের অন্যতম। প্রত্যেক বান্দার জন্য আল্লাহ রিযিক বণ্টন করে দিয়েছেন। যা থেকে কমবেশী করা হবে না। অতএব পরিমিত ও প্রয়োজন পূর্ণ হওয়ার পর আরও বেশী পাওয়ার আকাংখাকে দমন করতে হবে। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন, أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ-حَتَّى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ ‘অধিক পাওয়ার আকাংখা তোমাদের (পরকাল থেকে) গাফেল রাখে, যতক্ষণ না তোমরা কবরস্থানে উপনীত হও’ (তাকাছুর ১০২/১-২)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দো‘আ করতেন, اللَّهُمَّ ارْزُقْ آلَ مُحَمَّدٍ قُوتًا ‘হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদের পরিবারকে পরিমিত রিযিক দান কর’।[1]
অতএব হে লোভী! যখন তুমি মালের পেছনে জীবন শেষ করলে, তখন আখেরাতের জন্য তুমি কখন সময় দিবে? অথচ আল্লাহ বলেন,يَا ابْنَ آدَمَ تَفَرَّغْ لِعِبَادَتِى أَمْلأْ صَدْرَكَ غِنًى وَأَسُدَّ فَقْرَكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ مَلأْتُ صَدْرَكَ شُغْلاً وَلَمْ أَسُدَّ فَقْرَكَ ‘হে আদম সন্তান! আমার ইবাদতের জন্য অবসর হও। তাহ’লে আমি তোমার অন্তর প্রাচুর্য দিয়ে ভরে দিব এবং তোমার অভাব দূর করে দিব। আর যদি তা না কর তাহ’লে তোমার দু’হাত ব্যস্ততা দিয়ে ভরে দিব এবং তোমার অভাব দূর করব না’।[2]
কবি বলেন, وَلاَ تَحْسَبَنَّ الْفَقْرَ مِنْ فَقْرِ الْغِنَى + وَلَكِنْ فَقْرُ الدِّيْنِ مِنْ أَعْظَمِ الْفَقْرِ‘সচ্ছলতা হারানোকে দরিদ্রতা ভেবো না। বরং দ্বীন হারানোই হ’ল সবচেয়ে বড় দরিদ্রতা’।[3] নিঃসন্দেহে মালের লোভ সকল শত্রুর চেয়ে বড় শত্রু। যা মানুষকে সর্বদা ব্যস্ত রাখে। অথচ তা তার নিজের কোন কাজে লাগে না। যা তাকে আখেরাতের কাজ থেকে বিরত রাখে। অথচ যেটা ছিল তার নিজের জন্য। কেননা অতিরিক্ত যে মাল জমা করার জন্য সে দিন-রাত দৌড়ঝাঁপ করছে, তা সবই সে ফেলে যাবে। কিছুই সাথে নিতে পারবে না, তার নিজস্ব নেক আমলটুকু ব্যতীত। অথচ সে আমল করার মত ফুরছত তার নেই। কবি হুসাইন বিন আব্দুর রহমান বলেন, الْمَالُ عِنْدَكَ مَخْزُونً لِوَارِثِهِ + مَا الْمَالُ مَالُكَ اِلاَّ يَوْمَ تُنْفِقُهُ ‘মাল তোমার কাছে জমা থাকে তার ওয়ারিছদের জন্য। আর ঐ মাল তোমার নয়, যতক্ষণ না তুমি তা (আল্লাহর পথে) ব্যয় করবে’।[4] অতএব লোভ হ’ল দু’প্রকারের। ক্ষতিকর লোভ (فاجع حرص) যা তাকে আখেরাত থেকে ফিরিয়ে দুনিয়ার কাজে লিপ্ত রাখে। আর কল্যাণকর লোভ (نافع حرص), যা তাকে আল্লাহর আনুগত্যের কাজে আকৃষ্ট করে ও সেদিকেই ব্যস্ত রাখে।
মালের লোভ হ’ল, যা অবৈধ ও হারাম পথে উপার্জনে প্ররোচিত করে। এটাকে الشُّحُّ বা কৃপণতা বলে। যা নিন্দিত। আল্লাহ বলেন, وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ ‘যে ব্যক্তি হৃদয়ের কৃপণতা থেকে বাঁচল, সে সফলকাম হ’ল’ (হাশর ৫৯/৯)। হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِيَّاكُمْ وَالشُّحَّ فَإِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ بِالشُّحِّ أَمَرَهُمْ بِالْبُخْلِ فَبَخَلُوا وَأَمَرَهُمْ بِالْقَطِيعَةِ فَقَطَعُوا وَأَمَرَهُمْ بِالْفُجُورِ فَفَجَرُوا ‘তোমরা কৃপণতা হ’তে বেঁচে থাক। কেননা কৃপণতা তোমাদের পূর্বেকার লোকদের ধ্বংস করেছে। এ বস্ত্ত তাদের বলেছে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করতে, তখন সে তা করেছে। তাদের বখীলী করার নির্দেশ দিয়েছে, তখন সে তা করেছে। তাদের পাপ করার নির্দেশ দিয়েছে, তখন সে তা করেছে’।[5] জাবের (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, وَاتَّقُوا الشُّحَّ فَإِنَّ الشُّحَّ أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ حَمَلَهُمْ عَلَى أَنْ سَفَكُوا دِمَاءَهُمْ وَاسْتَحَلُّوا مَحَارِمَهُمْ...‘এ বস্ত্ত তাদেরকে রক্ত প্রবাহিত করতে প্ররোচিত করে (তখন তারা সেটা করে) এবং তারা হারামকে হালাল করে’।[6] একদল বিদ্বান বলেন, الشُّحُّ বা কৃপণতা হ’ল الشديد الحرص ‘কঠিন লোভ’। যা তাকে বৈধ অধিকার ছাড়াই তা নিতে প্ররোচিত করে। যেমন অন্যের মাল অবৈধ ভাবে নেওয়া, অন্যের অধিকারে অবৈধ হস্তক্ষেপ করা। অন্যের ইযযতের উপর হামলা করা ইত্যাদি।[7]
কৃপন ব্যক্তি সমাজে বেপরওয়া হয়ে চলা ফেরা করে। সর্বদা উত্তমকে অধম ভেবে সন্দিহানের মধ্যে পতিত থাকে এবং পরিশেষে পতন ঘটে মর্মে মহান আল্লাহ বলেন, أَمَّا مَنْ بَخِلَ وَاسْتَغْنَى- وَكَذَّبَ بِالْحُسْنَى - فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْعُسْرَى - وَمَا يُغْنِي عَنْهُ مَالُهُ إِذَا تَرَدَّى- ‘আর যে কৃপণতা করে ও বেপরওয়া হয় এবং উত্তম বিষয়কে মিথ্যা মনে করে, আমি তাকে কষ্টের বিষয়ের জন্যে সহজ পথ দান করব। যখন সে অধঃপতিত হবে, তখন তার সম্পদ তার কোনই কাজে আসবে না’ (লায়ল ৯২/৮-১১) ।
আর এটা আমাদের মনে রাখা দরকার যে, যদি বৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের পরও মানুষের মনে তৃপ্তি না আসে, তাহ’লে বুঝতে হবে তার মনে লোভ বাসা বেঁধেছে। তাই বৈধ ও অবৈধ কোন ভাবেই মালের লোভ করা যাবে না। লোভী ব্যক্তি নিজের অবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চায় না। হাতে যা আছে তাতে সুখী না থেকে অন্যায়ভাবে আরও বেশী কিছু পাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে। অতিরিক্ত কিছু পাওয়ার আকাংখা ও অন্যের ব্যস্ত আত্মসাৎ করার প্রবণতা ইসলাম সম্মত নয়। লোভাতুর দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তির জীবনে কখনো শান্তি আসতে পারে না। লোভের বশবর্তী হয়ে কিছু মানুষ ধর্ম-কর্ম ভুলে নিজের জীবনের সর্বনাশ ডেকে আনে। লোভ-লালসা মানুষকে অন্ধ করে তার বিবেক-বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে তাকে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং ভাল-মন্দ, পাপ-পুণ্য বিচারের ক্ষমতা নির্মূল করে ফেলে। তাই লোভ মানুষের চরম শত্রু জীবনের বিনাশ সাধনই এর কাজ। লোভ-লালসা নিয়ন্ত্রণ ও দমন করতেই হবে, নইলে মানুষের নৈতিকতার বিকাশ, সৎ ও শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপন করা সম্ভব হবে না।
খ. নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব ও মর্যাদার লোভ : প্রত্যেক লোভাতুর ব্যক্তি মাল অর্জনের সাথে সাথে কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব অর্জনে লোভী হয়ে উঠে। যার ফলশ্রুতিতে পরিশেষে মান-মর্যাদা ও সুখ্যাতি প্রতিষ্ঠায় হয়ে উঠে লাগামহীন লোভী। অথচ একজন মুমিন বান্দা কখনো অন্যের সম্পদের দিকে লোভাতুর দৃষ্টি দিতে পারে না। ধন-সম্পদ আহরণ দোষের হয় তখন, যখন অন্যের সম্পদের ওপর লোভাতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করা হয় এবং অবৈধ উপায়ে তা হস্তগত করার প্রচেষ্টা করা হয়। ধন-সম্পদ, মান-মর্যাদা ও খ্যাতি-সম্মান অর্জনের লোভাতুর মানুষ দ্বীনের জন্যে ধ্বংস মর্মে রাসূল (ছাঃ) বলেন, عَنِ ابْنِ كَعْبِ بْنِ مَالِكٍ الأَنْصَارِىِّ عَنْ أَبِيهِ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَا ذِئْبَانِ جَائِعَانِ أُرْسِلاَ فِى غَنَمٍ بِأَفْسَدَ لَهَا مِنْ حِرْصِ الْمَرْءِ عَلَى الْمَالِ وَالشَّرَفِ لِدِينِهِ হযরত কা‘ব বিন মালেক আনছারী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন যে, ‘দু’টি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘকে ছাগপালের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া অত বেশী ধ্বংসকর নয়, যত না বেশী মাল ও মর্যাদার লোভ মানুষের দ্বীনের জন্য ধ্বংসকর।[8] লোভাতুর ব্যক্তি কখনো পরোপকার বা জনকল্যাণকর কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হয় না। লোভ-লালসা বিভিন্ন রকমের হতে পারে। যেমন অর্থ-সম্পদ, মান-সম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তি, ক্ষমতা, পদমর্যাদা, প্রসিদ্ধি ও সুখ্যাতি অর্জনের প্রবল লোভ মানব চরিত্র গঠন ও সংশোধনের পথে বিরাট অন্তরায়। এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা আকাংখা করো না এমন সব বিষয়ে যাতে আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের একে অপরের প্রতি শ্রেষ্ঠ্যত্ব দান করেছেন’ (নিসা ৪/৩২)।
শাদ্দাদ ইবনু আওস (রাঃ) থেকে বর্ণিত একটি মওকূফ হাদীছ। তাঁর থেকে বর্ণিত আছে যে, একদিন বস্ত্রাচ্ছাদিত অবস্থায় তিনি অনবরত কাঁদছিলেন। তখন এক ব্যক্তি তাঁকে বলল, হে আবু ইয়া‘লা, আপনি কাঁদছেন কেন? উত্তরে তিনি বললেন, আমি তোমাদের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর যে জিনিসের ভয় করছি তা হ’ল অবচেতন মনের মাঝে লালিত সুপ্তবাসনা (নেতৃত্বের লোভ) এবং স্পষ্টভাবে লোক দেখানো কাজ। নিশ্চয়ই তোমাদেরকে তোমাদের নেতাদের পক্ষ থেকে ব্যতীত কিছুই দেওয়া হবে না। তারা এমন যে, ভাল কাজের আদেশ দিলেও তা পালিত হয়, আবার মন্দ কাজের আদেশ দিলেও তা পালিত হয়। আর মুনাফিকের অবস্থা কী? মুনাফিক তো আসলে সেই উটের মত, যাকে গলায় রশি পেঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে ফলে রশিতে ফাঁস লেগে সে মারা গেছে। মুনাফিক কখনই মুনাফিকীর ক্ষতি হ’তে নিজকে রক্ষা করতে পারবে না।[9]
মানুষ একটি সংঘবদ্ধ জীব। তাদের নানামুখী প্রয়োজন পূরণে সংঘবদ্ধতার প্রয়োজন রয়েছে। আর সংঘবদ্ধ হ’লেই সেখানে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একজন নেতা থাকা আবশ্যক। সুতরাং এই সংঘবদ্ধ জীবন যাপনে কেউ না কেউ নেতৃত্ব বা কর্তৃত্ব করবে। যা শারঈ বিধান অনুসারে পরিচালিত হতে হবে। এজন্যই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِذَا خَرَجَ ثَلاَثَةٌ فِىْ سَفَرٍ فَلْيُؤَمِّرُوْا أَحَدَهُمْ ‘যখন তিন জন ব্যক্তি সফরে বের হবে, তখন যেন তারা তাদের কোন একজনকে আমীর বা দলনেতা বানিয়ে নেয়’।[10] আবার এই নেতৃত্ব চেয়ে নেওয়া শরীয়ত সম্মত নয় মর্মে হাদীছে এসেছে, عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ سَمُرَةَ قَالَ قَالَ لِىْ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَا عَبْدَ الرَّحْمَنِ لاَ تَسْأَلِ الإِمَارَةَ، فَإِنَّكَ إِنْ أُوْتِيْتَهَا عَنْ مَسْأَلَةٍ وُكِلْتَ إِلَيْهَا، وَإِنْ أُوْتِِيْتَهَا مِنْ غَيْرِ مَسْأَلَةٍ أُعِنْتَ عَلَيْهَا،‘আব্দুর রহমান ইবনু সামুরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বললেন, হে আব্দুর রহমান, তুমি কখনো নেতৃত্ব চেয়ে নিও না। কেননা তুমি যদি চেয়ে নিয়ে তা লাভ কর, তাহ’লে তোমাকে ঐ দায়িত্বের হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে (অর্থাৎ তুমি দায়িত্ব পালনে হিমশিম খাবে, কিন্তু কোন সহযোগিতা পাবে না)। আর না চাইতেই যদি তা পাও তাহ’লে তুমি সেজন্য সাহায্যপ্রাপ্ত হবে’।[11]
আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট আসলাম। আমার সাথে ছিল আশ‘আরী গোত্রের দু’জন লোক। তাদের একজন ছিল আমার ডানে এবং অন্যজন ছিল আমার বামে। তারা দু’জনেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট কার্যভার চেয়ে বসল। নবী করীম (ছাঃ) সে সময় মেসওয়াক করছিলেন। আমি তাঁর ঠোঁটের নিচে মেসওয়াক কীভাবে রয়েছে আর ঠোঁট সঙ্কুচিত হয়ে আসছে সে দৃশ্য এখনো যেন দেখতে পাচ্ছি। তিনি বললেন, হে আবু মূসা বা হে আব্দুল্লাহ বিন কায়েস! ব্যাপার কি? ওদের কথা শুনে আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন তার শপথ, তারা দু’জন যেমন তাদের মনের কথা আমাকে জানায়নি তেমনি এখানে এসে তারা যে কার্যভার চেয়ে বসবে তাও আমি বুঝতে পারিনি। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যেসব পদ আমাদের রয়েছে তা যে চেয়ে নেয় আমরা কখনই তাকে সে পদে নিযুক্ত করব না। তবে হে আবু মূসা, আব্দুল্লাহ ইবনু কায়েস! তুমি (অমুক পদে দায়িত্ব পালনের জন্য) যাও। তারপর তিনি তাঁকে ইয়ামান প্রদেশের শাসক করে পাঠালেন।[12]
মানুষ নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব পেয়ে নানা ধরনের সুবিধা ভোগ করে, যা ক্বিয়ামতের দিন লজ্জাজনক ও গর্হিত কাজে পরিণত হবে মর্মে রাসূল (ছাঃ) বলেন,
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنَّكُمْ سَتَحْرِصُونَ عَلَى الإِمَارَةِ، وَسَتَكُونُ نَدَامَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ، فَنِعْمَتِ الْمُرْضِعَةُ وَبِئْسَتِ الْفَاطِمَةُ. আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই তোমরা শাসন ক্ষমতা লাভের জন্য খুব আগ্রহী হবে। কিন্তু ক্বিয়ামতের দিন তা লজ্জা (ও আফসোসের) কারণ হবে। দুধদানকারী হিসাবে (ক্ষমতার দিনগুলোতে নানান সুযোগ সুবিধা ভোগের দিক দিয়ে) ক্ষমতা কতই না ভাল। কিন্তু ক্ষমতা থেকে অব্যাহতি কতই না নিকৃষ্ট পরিণামবহ’।[13] এই হাদীছের ব্যাখ্যায় ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ক্ষমতা দুধদানকারী পশুতুল্য। কারণ ক্ষমতা থাকলে পদ, পদবী, সম্পদ, হুকুমজারী, নানা রকম ভোগ-বিলাসিতা ও মানসিক তৃপ্তি অর্জিত হয়। কিন্তু মৃত্যু কিংবা অন্য কোন কারণে ক্ষমতা যখন চলে যায়, তখন আর তা মোটেও সুখকর থাকে না। বিশেষত আখেরাতে যখন এজন্য নানা ভীতিকর অবস্থার মুখোমুখি হ’তে হবে তখন ক্ষমতা মহাজ্বালা হয়ে দেখা দিবে’।[14]
বর্তমানে ছাত্রদের মধ্যে এই ক্ষমতা লিপ্সা অর্থাৎ নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব লাভের লোভ পাগল করে দিয়েছে। শিক্ষাগ্রহণের উদ্দেশ্য হয়ে গেছে দুনিয়ার মোহগ্রস্থ ক্ষমতা লোভী। এই ক্ষমতার জন্য তারা নানা রকম চেষ্টা-তদবির করে; তাতেই মানুষ বোঝে যে এরা ক্ষমতাপ্রত্যাশী। তারপর তাদের কারো কপালে ক্ষমতা জোটে, আবার কারো জোটে না। এমর্মে মহান আল্লাহ বলেন, مَّنْ كَانَ يُرِيْدُ الْعَاجِلَةَ عَجَّلْنَا لَهُ فِيْهَا مَا نَشَاءُ لِمَنْ نُّرِيْدُ ثُمَّ جَعَلْنَا لَهُ جَهَنَّمَ يَصْلاَهَا مَذْمُوماً مَّدْحُوراً ‘যারা দুনিয়া পেতে চায় তাদের মধ্যে আমি যাকে ইচ্ছা করি দুনিয়ার সম্পদ থেকে আমার ইচ্ছামাফিক তা দ্রুত দিয়ে দেই। তারপর তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারণ করে রাখি। যেখানে সে প্রবেশ করবে একান্ত নিন্দিত ও ধিকৃত অবস্থায়’ (ইসরাঈল ১৭/১৮)। বোকাদের সাথে তর্ক, আলেমে দ্বীন ব্যক্তিদের সাথে প্রতিযোগিতা ও জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করতে সর্বদা ব্যস্ত হবে তাকে মহান আল্লাহ জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন মর্মে রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ لِيُجَارِىَ بِهِ الْعُلَمَاءَ أَوْ لِيُمَارِىَ بِهِ السُّفَهَاءَ أَوْ يَصْرِفَ بِهِ وُجُوهَ النَّاسِ إِلَيْهِ أَدْخَلَهُ اللهُ النَّارَ ‘বোকাদের সঙ্গে বিতর্ক করা কিংবা আলেমদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা কিংবা জনগণের দৃষ্টি নিজের দিকে ফেরানোর মানসে যে বিদ্যা অন্বেষণ করবে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে জাহান্নামে দাখিল করবেন’।[15] ক্ষমতার লোভ মানুষকে উদগ্র নেশাগ্রস্থ করে তোলে। এসম্পর্কে ইবনু রজব বলেছেন, ‘জেনে রাখ, মান-মর্যাদার লোভ মহাক্ষতি ডেকে আনে। মর্যাদা লাভের আগে তা অর্জনের পথ-পদ্ধতি বা কলাকৌশল অবলম্বনের চেষ্টা করতে গিয়ে মানুষ অনেক হীন ও অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে। আবার মর্যাদাপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে অন্যের উপর নিপীড়ন, ক্ষমতা প্রদর্শন, দাম্ভিকতা দেখানো ইত্যাদি ক্ষতিকর জিনিসের উদগ্র নেশায় পেয়ে বসে।[16]
দুনিয়া লাভের আকাংখাকে অগ্রাধিকার দিলে আখেরাত লাভের আকাংখা ক্ষীণ হয়। যার ফলে সে আখেরাতকে হারায়। এ সম্পর্কে মহান আলস্নাহ বলেন,مَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الْآخِرَةِ نَزِدْ لَهُ فِي حَرْثِهِ وَمَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الدُّنْيَا نُؤْتِهِ مِنْهَا وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ نَصِيبٍ ‘যে কেউ পরকালের ফসল কামনা করে, আমরা তার ফসল বাড়িয়ে দেই। আর যে ব্যক্তি ইহকালের ফসল কামনা করে, আমরা তাকে সেখান থেকে কিছু দিয়ে থাকি। কিন্তু পরকালে তার কোনই অংশ থাকবে না’ (শূরা ৪২/২০)। আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার মর্যাদা সন্ধান করে, সে কেবল সেটাই পায়। কিন্তু আখেরাত হারায়। কেননা দু’টি বস্ত্ত কখনো এক সাথে অর্জন করা সম্ভব নয়। অতএব সৌভাগ্যবান সেই, যে ব্যক্তি চিরস্থায়ী মর্যাদাকে ক্ষণস্থায়ীর উপর প্রাধান্য দেয়। এমর্মে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَحَبَّ دُنْيَاهُ أَضَرَّ بِآخِرَتِهِ وَمَنْ أَحَبَّ آخِرَتَهُ أَضَرَّ بِدُنْيَاهُ فَآثِرُوا مَا يَبْقَى عَلَى مَا يَفْنَى ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াকে ভালবাসবে, সে তার আখেরাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আর যে ব্যক্তি আখেরাতকে ভালবাসবে, সে তার দুনিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। অতএব তোমরা ধ্বংসশীল বস্ত্তর উপরে চিরস্থায়ী বস্ত্তকে অগ্রাধিকার দাও’।[17]
গ. লোভ দমনে করণীয় :
দুনিয়ার লোভ দমন করার জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলির প্রতি সর্বদা দৃষ্টি রাখতে হবে।
১. ঐসব কর্তৃত্বশীল লোকদের মন্দ পরিণতির দিকে দৃষ্টি দেওয়া, যারা আখেরাতের হক্ব আদায় করেনি। ফলে তারা আল্লাহর রহমত ও মানুষের দো‘আ থেকে চিরবঞ্চিত হয়েছে। বিগত যুগের ও বর্তমান যুগের দুষ্টু নেতারা এর বাস্তব উদাহরণ।
২. মিথ্যাবাদী, অহংকারী ও যালেমদের উপর আল্লাহ প্রতিশোধ থেকে শিক্ষা নেওয়া।
৩. বিনয়ী ব্যক্তিদের প্রতি দুনিয়াতে আল্লাহ পুরস্কার এবং আখেরাতে তাদের উচ্চ মর্যাদার প্রতি দৃষ্টিপাত করা।
৪. আল্লাহ ওয়ালা ব্যক্তিদের পবিত্র জীবন ও দুনিয়াবী মর্যাদা থেকে উদ্বুদ্ধ হওয়া। যেমন আল্লাহ বলেন, مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ ‘পুরুষ হৌক নারী হৌক মুমিন অবস্থায় যে সৎকর্ম সম্পাদন করে, আমরা তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং অবশ্যই তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম অপেক্ষা উত্তম পুরস্কারে ভূষিত করব’ (নাহল ১৬/৯৭)। বস্ত্ততঃ পবিত্র জীবন লাভ করাই হ’ল দুনিয়াতে আল্লাহর দেওয়া সবচেয়ে বড় পুরস্কার। এছাড়া আখেরাতের অতুলনীয় পুরস্কার তো আছেই। যা চোখ কখনো দেখেনি, কান কখনো শোনেনি এবং হৃদয় কখনো কল্পনা করেনি।[18] নিঃসন্দেহে আলেম যখন তার ইলমের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করবে তখন সবাই তাকে ভয় করবে। আর যখন তার দ্বারা সে মাল বৃদ্ধি কামনা করবে, তখন সে অন্যকে ভয় করবে। অতএব সকল কল্যাণ নিহিত রয়েছে আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যে। আর আল্লাহর অনুগত বান্দা দুনিয়া ও আখেরাতের মালিক। আল্লাহ বলেন, وَلِلَّهِ الْعِزَّةُ وَلِرَسُولِهِ وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَلَكِنَّ الْمُنَافِقِينَ لاَ يَعْلَمُونَ ‘সকল সম্মান আল্লাহর জন্য, তার রাসূলের জন্য এবং মুমিনদের জন্য। কিন্তু কপট বিশ্বাসীরা তা জানে না’ (মুনাফিকূন ৬৩/৮)। লোভাতুর ব্যক্তির ক্ষতিকর দিক থেকে সতর্ক থাকতে হবে। প্রত্যেক মানুষের প্রবৃত্তি পরায়ণতাকে উসকে দেয়। বিলাসিতার প্রতি তার অন্তর ধাবিত হয়। কখনো কখনো হালাল আয়ের সীমা অতিক্রম করে সে সন্দেহযুক্ত আয়ের মধ্যে প্রবেশ করে। এমনকি যুক্তি দিয়ে হারামকে হালাল করে। যার ফলে সে আল্লাহ থেকে উদাসীন হয়ে পড়ে।
ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, মাল ও সম্পদ কামনার বিষয়ে চার ধরনের মানুষ রয়েছে। (১) যারা আল্লাহর অবাধ্যতার মাধ্যমে মানুষের উপর কর্তৃত্ব চায় ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করে। যেমন দুষ্টমতি রাজা-বাদশা ও সমাজনেতারা। (২) যারা কর্তৃত্ব কামনা ছাড়াই সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। যেমন চোর-বাটপার প্রভৃতি নিম্নশ্রেণীর লোকেরা (৩) যারা বিশৃংখলা ছাড়াই কেবল কর্তৃত্ব চায়। যেমন ঐসব দ্বীনদার লোক যারা দ্বীনের মাধ্যমে সমাজের উপর তাদের শ্রেষ্ঠত্ব কামনা করে। (৪) জান্নাতীগণ। যারা সমাজে শ্রেষ্ঠত্ব চায় না ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করে না।[19]
এক্ষণে সম্পদ ও কর্তৃত্ব যদি আল্লাহর নৈকট্য হাছিলে ব্যয়িত হয়, তবে সেটাতে দ্বীন ও দুনিয়ার কল্যাণ রয়েছে। আর যদি তা না থাকে, তাহ’লে তা হয় সমাজের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর। যেটাকে হাদীছে ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللهَ لاَ يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের চেহারা ও মাল দেখেন না। তিনি দেখেন তোমাদের হৃদয় ও কর্ম’।[20]
এক্ষণে যে ব্যক্তি জিহাদ ও ক্ষমতার মাধ্যমে দ্বীন কায়েমে ব্যর্থ হবে, সে ব্যক্তি উপদেশের মাধ্যমে ও আল্লাহর নিকট দো‘আর মাধ্যমে সেটা করবে। সর্বোপরি সে তার সর্বোচ্চ সাধ্য মতে আল্লাহর আনুগত্য করে যাবে।
পরিশেষে বলতে হয়, মহান আল্লাহর বিরুদ্ধে কোন প্রকার চ্যালেঞ্জ চলেনা। আমরা যতই কুট কৌশল করে হারামকে হালাল বানানোর পথকে সুগম করি না কেন, আল্লাহ হ’লেন সর্বত্তোম সুকৌশলী। লোভ রিপুকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতা জাগিয়ে অবাধ বিশৃংখলা থেকে বিরত রাখার মধ্যেই রয়েছে প্রতিবিধান। চরিত্রের উত্তম গুণাবলী দিয়ে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে লোভ রিপুর প্রতিরোধ গড়ে তোলতে হবে। রিপুর তাবেদারী মানুষকে ইহকালিন শান্তি ও পরোকালিন মুক্তি দিতে পারে না। প্রত্যেক মানুষকে সোচ্চার হ’তে হবে লোভ রিপুর বিপরীতে। সকলের মাঝে আল্লাহভীতি ও স্ব স্ব মূল্যবোধের ধারনা দিয়ে তাদেরকে ফিরিয়ে আনতে হবে। নচেৎ আমাদের ধ্বংস অনিবার্য।
সুতরাং লোভ রিপু মানুষের জন্যে এক চরম শক্র। পারিপার্শ্বিক ও বহিঃজগতের যেকোন শক্র এর কাছে হার মানতে বাধ্য। জাগতিক জীবনে যারা এ লোভ রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তারাই প্রকৃত প্রস্তাবে ইহলৌকিক জীবনে লাভ করেছে সুখ, সমৃদ্ধি ও আদর্শ সংসার জীবন। লোভ রিপু প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে থাকতে হবে কিন্তু তা হবে নিয়ন্ত্রিত। নিয়ন্ত্রিত রিপু ঔষুধের মত কাজ করে এবং তা যথাস্থানে প্রয়োগ করে থাকে। আর অনিয়ন্ত্রিত রিপু নিশা জাতীয় দ্রব্যের মত মাতাল করে এবং তা অপচয় করে ও অপাত্রে প্রয়োগের ফলে ক্রিয়া না করে প্রতিক্রিয়াতে পরিণত হয়। সুতরাং হে মানব সমাজ! রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করো, সুখী-সমৃদ্ধি জীবন গড়ো।
(ক্রমশ)
[লেখক : যশপুর, তানোর, রাজশাহী]
[1]. বুখারী হা/৬৪৬০; মুসলিম হা/১০৫৫; মিশকাত হা/৫১৬৪।
[2]. ইবনু মাজাহ হা/৪১০৭; আহমাদ হা/৮৬৮১; ছহীহ আত-তারগীব হা/৩১৬৬; মিশকাত হা/৫১৭২।
[3]. ইবনু রজব হাম্বলী (৭৩৬-৭৯৫ হিঃ), মাজমূ ‘রাসায়েল ৬৫ পৃ.।
[4]. খতীব বাগদাদী, কিতাবুল বুখালা ২২২ পৃ.।
[5]. আবুদাঊদ হা/১৬৯৮।
[6]. মুসলিম হা/২৫৭৮; মিশকাত হা/১৮৬৫।
[7]. দরসে হাদীছ : মাল ও মর্যাদার লোভ দ্বীনের জন্য নেকড়ে স্বরূপ, মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, আত-তাহরীক, ১৯তম বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যা মার্চ ২০১৬।
[8]. তিরমিযী হা/২৩৭৬; মিশকাত হা/৫১৮১।
[9]. ইবনুল মুবারক, আয-যুহুদ, পৃ. ১৬।
[10]. আবুদাঊদ হা/২৬০৮, আলবানী এটিকে হাসান বলেছেন।
[11]. বুখারী হা/৭১৪৭; মুসলিম হা/১৬৫২।
[12]. মুসলিম হা/১৮২৪।
[13]. বুখারী হা/৭১৪৮।
[14]. ফাতহুল বারী ১৩/১২৬।
[15]. তিরমিযী হা/২৬৫৪; আলবানী হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন। দ্রঃ ছহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব ১/২৫ পৃ.; ঈষৎ পরিবর্তনসহ দু’টি ক্ষুধার্ত নেকড়ের হাদীছের ব্যাখ্যা ৪৭-৫৩ পৃ.।
[16]. তিরমিযী হা/২৬৫৪; আলবানী হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন। দ্রঃ ছহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব ১/২৫ পৃ.; ঈষৎ পরিবর্তনসহ দু’টি ক্ষুধার্ত নেকড়ের হাদীছের ব্যাখ্যা ৩২ পৃ.।
[17]. আহমাদ হা/১৯৭১২; ছহীহ আত-তারগীব হা/৩২৪৭; মিশকাত হা/৫১৭৯।
[18]. বুখারী হা/৩২৪৪; মুসলিম হা/২৮২৪; মিশকাত হা/৫৬১২।
[19]. ইবনু তায়মিয়াহ, আস-সিয়াসাতুশ শারঈয়াহ ২১৭-১৯ পৃ.।
[20]. মুসলিম হা/২৫৬৪; মিশকাত হা/৫৩১৪।