আল্লাহর পথে দাওয়াত : গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 14355 বার পঠিত

ইসলাম মানবসমাজের জন্য এ বিশ্ব চরাচরের মহান সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা আল্লাহ রাববুল আলামীনের মনোনীত ও নাযিলকৃত একমাত্র জীবনবিধান। মূলতঃ আসমান-জমীনের সমসত্মকিছুই আল্লাহর নির্ধারিত সুনির্দিষ্ট ও অবধারিত নিয়ম-বিধান দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে যাকে আমরা প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম বলে সচরাচর প্রকাশ করি। মানবসমাজের জন্যও এই প্রাকৃতিক নীতিবিধান সমভাবে ক্রিয়াশীল যা থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা মানুষের নেই। অনুরূপভাবে দ্বীনে ইসলামও মানবজাতির জন্য সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ নির্ধারিত অবশ্য পালনীয় প্রাকৃতিক নীতিবিধানের অংশ, তবে অন্যান্য বিধান থেকে এর পার্থক্য হল যে, এই নীতিবিধান পালন করা বা না করার ক্ষমতা আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন। অর্থাৎ সে ইচ্ছা করলে যেমন ইসলামকে নিজের চলার পথ হিসাবে বেছে নিতে পারে আবার অস্বীকারও করতে পারে। প্রকৃতির আর কোন বিধানকে লংঘন করার সামান্যতম সামর্থ্য না থাকলেও এই একটি ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধানকে লংঘন করার পূর্ণ সামর্থ্য সে রাখে। এ ক্ষমতা আল্লাহ তাকে দিয়েছেন এজন্য যে, তিনি তাকে এ দুনিয়ার বুকে পাঠিয়েছেন পরীক্ষা নেওয়ার জন্য’ (হূদ ৭, কাহাফ ৭, মূলক ২)। অর্থাৎ এই পরীক্ষা গ্রহণের জন্য যে, মানুষ তার প্রভূর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে কি না বা তাঁর প্রেরিত জীবনবিধানকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করছে কি না অথবা করলে কতটুকু গ্রহণ করছে এবং এর উপর ভিত্তি করে মৃত্যুপরবর্তী জীবনে তার জন্য জান্নাত বা জাহান্নাম নির্ধারণ করে রেখেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আমি মানুষ ও জ্বিন জাতিকে কেবলমাত্র আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি’ (যারিয়াত ৫৬)। ‘তুমি বলে দাও (হে মুহাম্মাদ)! সত্য আসে তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে। অতএব যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করুক আর যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে তা অস্বীকার করুক। নিশ্চয় আমি যালিমদের জন্য জাহান্নামের আগুন প্রস্ত্তত করে রেখেছি’ (কাহাফ ২৯)

যেহেতু আল্লাহ মানুষকে ইচ্ছার স্বাধীনতা দিয়েছেন আবার তাঁর দেয়া জীবনবিধানকে পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের উপর মানুষের দুনিয়াবী কল্যাণ ও পারলৌকিক মুক্তি নির্ভরশীল করে দিয়েছেন, এজন্য তাকে সদাসর্বদা সচেতন ও সতর্ক থাকতে হয়। কেননা নিজের স্বাধীন ইচ্ছার প্রয়োগ করতে যেয়ে আল্লাহর বিধানকে অমান্য করে বসলে সে নিজের জ্ঞান ও বিবেকের অপূর্ণতা এবং অপরিণামদর্শীতার কারণে ন্যায় ও সত্যের পথ থেকে নিশ্চিতভাবে বিচ্যুত হয়ে যায়। ফলে আল্লাহকে ভুলে যেয়ে সে আপন প্রবৃত্তির দাসে পরিণত হয়। বিপরীতমুখী আকর্ষণ তথা শয়তানী প্ররোচনার কালো অাঁধারে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। এভাবে সে নিজের অজান্তেই দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের দলভুক্ত হয়ে পড়ে। বলা বাহুল্য, পৃথিবীতে মানুষের আগমনের পর থেকে আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে এবং ঈমানের উপর টিকে থাকতে পেরেছে এমন মানুষের সংখ্যা অতি অল্প। অধিকাংশই হয়েছে পথভ্রষ্টদের দলভুক্ত।   

এই পথভোলা মানুষদেরকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য আল্লাহ যেমন যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূলকে প্রেরণ করেছেন, তেমনি আবার দায়িত্ব দিয়েছেন তাদেরকে যারা নবী-রাসূলদের অনুসরণ করার মাধ্যমে হেদায়েতপ্রাপ্ত হয়েছেন। আদম (আঃ) থেকে শুরু করে মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যমত্ম সকল নবী-রাসূল এই দায়িত্ব নিয়েই তথা মানবসমাজকে আল্লাহর পথে প্রত্যাবর্তনের দাওয়াত নিয়ে দুনিয়ার বুকে আগমন করেছিলেন। আল্লাহ বলেন, ‘আমি প্রতিটি কওমের মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছি মানুষের জন্য এই দাওয়াত নিয়ে যেন তারা আল্লাহর ইবাদত করে এবং ত্বাগূতকে বর্জন করে’ (নাহাল ৩৬)। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তোমার পূর্বে কোন রাসূল প্রেরণ করি নি এই ওহী ব্যতীত যে, আমি ছাড়া অন্য কোন মা‘বূদ নেই; সুতরাং তোমরা আমারই ইবাদত কর’ (আম্বিয়া ৩৫)। ‘প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য পথপ্রদর্শক ছিল’ (রা‘দ ৭)

শেষনবীর আগমনের মাধ্যমে নবুয়তের সিলসিলা শেষ হওয়ার পর এ দায়িত্ব এখন উম্মতে মুহাম্মাদীর। রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনে এযাম এবং পরবর্তী মুসলমানগণ ইসলামের দাওয়াত পৃথিবীর সর্বত্র পেঁŠছানোর জন্য প্রাণান্ত প্রয়াস নিয়েছিলেন। তারই ফলশ্রুতিতে ইসলামের আলোকোজ্জ্বল  জ্যোতির্মালা আজও পর্যন্ত বিকশিত হচ্ছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর পুণ্যবান বান্দাদের মাধ্যমে তা অব্যাহত থাকবে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরাই সর্বোত্তম জাতি যাদের উত্থান ঘটানো হয়েছে মানবজাতির কল্যাণের জন্য। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে এবং অন্যায় কাজে নিষেধ করবে’..(আলে ঈমরান ১১০)

আল্লাহ রাববুল আলামীন পবিত্র কুরআনের বহু স্থানে দা‘ওয়াত প্রদানের গুরুত্ব ও মর্যাদা এবং নীতিমালা উল্লেখ করেছেন। আধুনিক যুগে দাওয়াতের ক্ষেত্র বিস্তৃতি লাভ করায় ‘দা‘ওয়াহ’ জ্ঞানচর্চার একটি স্বতন্ত্র শাখায় পরিণত হয়েছে। নিম্নে দা‘ওয়াতের পরিচয় এবং এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উল্লেখিত হলঃ

দাওয়াতের পরিচয় :

আরবী الدعوة  শব্দটির আভিধানিক অর্থ হল কোন কিছুর প্রতি আহবান করা। যেমন- আল্লাহর দিকে দাওয়াত প্রদান করা যার অর্থ- মানুষকে আল্লাহ নির্ধারিত পথে চলার জন্য আহবান জানানো। পারিভাষিক অর্থে সাধারণভাবে দাওয়াত এমন আহবানকে বলা হয় যা মানুষকে আল্লাহর পথে আসার জন্য করা হয়। এ আহবানের অর্থ মানুষকে কল্যাণ ও সত্যপথের দিকে উৎসাহিত করা, তাদেরকে সৎকর্মের দিকে আহবান করা ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা, যাতে দুনিয়াবী জীবনে তারা সম্মানের অধিকারী হয় এবং আখিরাতে সৌভাগ্যবানদের দলভুক্ত হয়। আর বিশেষায়িত অর্থে ইসলামী দা‘ওয়াতের অর্থ হল দ্বীনের প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে এবং তা অন্যের নিকট পৌঁছে দেয়ার জন্য নিজের বাকশক্তি এবং কর্মক্ষমতাকে সার্বিকভাবে প্রয়োগ করা। ড. রউফ সা‘লাবী বলেন, দাওয়াহ হচ্ছে সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন, যার দ্বারা মানবসমাজ কুফরী অবস্থা থেকে ঈমানী অবস্থায়, অন্ধকার হতে আলোর দিকে এবং জীবনকে সংকীর্ণতা থেকে প্রশস্ত অবস্থায় রূপান্তরিত করা হয়।

দাওয়াতের হাক্বীকত :

দাওয়াতের হাক্বীকত হল সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে প্রকৃত অর্থে চেনা এবং তার আদেশ ও নিষেধকে জানার মাধ্যমে তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা’ (ইউসুফ ১০৮)। সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ এটাই দাওয়াত প্রদানের সাধারণ মূলনীতি (আলে ইমরান ১০৪) এবং দ্বীন ইসলাম অর্থাৎ আল্লাহ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহের মাধ্যমে যে দ্বীন শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর রিসালত মারফত এ দুনিয়াবাসীর নিকট প্রেরণ করেছেন তা-ই দাওয়াতের বিষয়বস্ত্ত।  

দাওয়াত প্রদানের দিকসমূহ :

দা‘ওয়াত প্রদান দ্বীনের নির্দিষ্ট কোন একটি দিকের সাথে        সম্পৃক্ত নয়, বরং তা দ্বীনের সর্বাংশকে শামিল করে। অর্থাৎ যদি কোন ব্যক্তি মানুষকে বিশুদ্ধ আক্বীদা, দ্বীনের প্রতি নিখাদ আনুগত্য, তাওহীদকে সর্বতোভাবে ধারণ, শিরক ও তার যাবতীয় শাখা-প্রশাখা থেকে মুক্ত থাকার আহবান জানায় সেটাও দাওয়াত। আবার যদি সে তাওহীদ ও আক্বীদা বিষয়ে সৃষ্ট সন্দেহ দূর করার প্রচেষ্টা চালায় সেটাও দাওয়াত।

যদি সে ফরয আমলসমূহ তথা ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ্ব, যাকাত ও পিতামাতার সেবা, সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা, অঙ্গিকারপূরণ ইত্যাদি বিষয়ে আহবান জানায় সেটাও দাওয়াত। আবার যদি আত্মার পরিশুদ্ধি, তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতিা, আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল ইত্যাদি বিষয়ে আহবান জানায় সেটাও দাওয়াত। এমনকি জিহাদও দাওয়াতের অন্তর্ভূক্ত। 

ইবনু তাইমিয়া (রহঃ) বলেন, আল্লাহর পথে দাওয়াত প্রদানের দিকগুলো আপেক্ষিক। প্রয়োজন ও পরিবেশ-পরিস্থিতির চাহিদার সাথে তা পরিবর্তিত হয়। এজন্য পরিবেশ ও প্রয়োজনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কেউ বিশুদ্ধ আক্বীদার দিকে, কেউ বাহ্যিক আমল-আখলাকের দিকে, কেউ বা আত্মার পরিশুদ্ধির দিকে দাওয়াত প্রদান করতে পারে।

দাওয়াত প্রদানের হুকুম :

দাওয়াত ইলাল্ল­াহ তথা আল­াহর পথে আহবান অন্যান্য ফরযের ন্যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরয। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে এ ব্যাপারে তাকীদ এসেছে। আল্লাহ বলেন, ‘আর যেন তোমাদের মধ্য হতে এমন একটি দল থাকে, যারা কল্যাণের প্রতি আহবান করবে, ভাল কাজের আদেশ দিবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই সফলকাম’ (আলে ইমরান ১০৪)। ‘তুমি তোমার রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আহবান কর এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক কর। নিশ্চয় একমাত্র তোমার রবই জানেন কে তাঁর পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে এবং হিদায়াতপ্রাপ্তদের তিনি খুব ভাল করেই জানেন’ (নাহল ১২৫)। ‘তুমি তোমার রবের দিকে আহবান কর এবং কিছুতেই মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’ (সূরা কাসাস  ৮৭)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আমার পক্ষ থেকে যদি একটি আয়াতও জানো, তবে তা অন্যের নিকট পৌছে দাও’ (বুখারী, মিশকাত হা/ ১৯৮)

শায়খ বিন বায বলেন, দায়ীগণ যে অঞ্চলে দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করেন সে অঞ্চল অনুপাতে দাওয়াত প্রদান করা ফরযে কিফায়া। যদি কোন অঞ্চলে প্রয়োজনীয়তা অনুপাতে যথেষ্ট পরিমাণ লোক দাওয়াতী কাজে আত্মনিয়োগ করেন তাহলে সে অঞ্চলে বসবাসকারী অন্যদের উপর থেকে আবশ্যকীয়তা রহিত হয়ে যাবে। তাদের ক্ষেত্রে এটা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা ও একটি অতি উত্তম আমল হিসেবে বিবেচিত হবে। আর যদি সে অঞ্চলে দাওয়াতী কোন তৎপরতাই না থাকে, কেহই এ দায়িত্বের প্রতি গুরুত্ব না দেয় তাহলে সকলেই অপরাধী বলে গণ্য হবে।

অতএব জ্ঞানবান ঈমানদার ব্যক্তিবর্গ ও নায়েবে রাসূলদের উপর  অবশ্য কর্তব্য হচ্ছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এ কাজে আত্মনিয়োগ করা, পরস্পর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আল্ল­াহর বার্তা তাঁর বান্দাদের নিকট পৌঁছে দেয়া। এ দায়িত্ব পালনকালে বড়-ছোট, ধনী-গরীব কোন ভেদাভেদ ও তারতম্য সৃষ্টি না করা। বরং আল্ল­াহর হুকুম যেভাবে আল্ল­াহ অবর্তীণ করেছেন, ঠিক সেভাবে আল­াহর বান্দাদের নিকট পৌঁছে দেয়া।

হ্যাঁ সামগ্রিকতার বিচারে সারা দেশের জন্যে একটি জামাআত থাকতে হবে; থাকা ওয়াজিব, যারা সর্বত্র আল্ল­াহর বাণী পৌঁছে দেবে, সাধ্যমত আল্ল­াহর আদেশ-নিষেধ সম্বন্ধে লোকদের অবহিত করবে। রাসূল (ছাঃ) বিভিন্ন নেতৃবর্গ ও রাষ্ট্র প্রধানের কাছে দায়ী প্রেরণ করেছেন, পত্র দিয়েছেন এবং তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহবান করেছেন।

বর্তমান সময়ে দাওয়াত কর্মীর স্বল্পতা, অন্যায়-অশ্ল­ীলতা বৃদ্ধি, অজ্ঞতার প্রাবল্য, ইসলামী আকীদা বিরোধী নানাবিধ ষড়যন্ত্র, নাস্তিকতার দিকে আহবান, রিসালাত ও পরকালকে অস্বীকার এবং বহুদেশে খৃষ্টধর্মের দিকে দাওয়াতের নানা কর্মসূচির বিস্তৃতিসহ বিবিধ চিন্তাধারা ও মতবাদের ব্যাপকতার কারণে দাওয়াত ইলাল্ল­াহ সকল মুসলমানের উপর অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

দাওয়াতী কাজের মাধ্যমসমূহ :

দাওয়াতী কাজের জন্য জুমআ‘র খুৎবা ও সভা-সমাবেশে বক্তৃতা, স্কুল-মাদরাসা-বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদান, বই-পত্র লেখনী ইত্যাদি প্রচলিত নিয়মিত ক্ষেত্র ছাড়াও সম্ভব সকল প্রকার সুযোগকে ব্যবহার করা প্রয়োজন। আজকের যুগে ইসলাম প্রচার, দাওয়াতকর্ম পরিচালনা ও মানুষের কাছে দলীল-প্রমাণাদি উপস্থাপন অনেক দিক দিয়েই সহজ। বিশেষকরে তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে দাওয়াত ও প্রচারকর্ম অনেক সহজ হয়ে গেছে। বর্তমানে রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, ইন্টারনেটসহ নানা মাধ্যমের সাহায্যে অতি সহজে মানুষের কাছে দাওয়াত পৌঁছান সম্ভব। রাসূল (ছাঃ) যেখানে যে অবস্থায় থাকতেন না কেন সে অবস্থাতেই মানুষকে দাওয়াত দিতেন।

দা‘ওয়াত প্রদানের মূলনীতি :

দাওয়াত ইলাল্ল­াহ পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হেদায়েতবাণী তথা আল্লাহর কালাম এবং রাসূল (ছাঃ) প্রদর্শিত পথনির্দেশনা অনুসরণের জন্য একটি এলাহী দাওয়াত। এই মর্যাদাপূর্ণ দাওয়াত প্রদানের মৌলিক কিছু নীতি রয়েছে যা অবশ্য পালনীয়।

প্রথমত : দাওয়াত প্রদানের মানদন্ড হবে কেবলমাত্র পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ। অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে, যে পথে আহবান করা হচ্ছে তা যেন আল্লাহর নির্দেশ বহির্ভুত না হয়ে যায়। তাওহীদ ও সুন্নাতের উপর ভিত্তিশীল এ দাওয়াতে কোন ভাবেই যেন শিরক বা বিদ‘আতের সংস্পর্শ না থাকে। আল্লাহ বলেন, ‘হে রাসূল! আপনি পেঁŠছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তাহলে আপনি তাঁর পয়গাম কিছুই পেঁŠছালেন না’ (মায়েদাহ ৬৭)। রাসূল (ছাঃ)-এর দাওয়াত প্রদানের প্রাথমিক অবস্থায় যখন মক্কার মুশরিকরা কুরআনের প্রতি অভিযোগ করল যে, তা তাদের পুজনীয় মূর্তিসমূহকে পরিত্যাজ্য সাব্যস্ত করেছে এবং দাবী করে বসল, এই কুরআনের পরিবর্তে আরেকটি কুরআন নিয়ে আসতে; তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, এটা আমার জন্য কখনই সম্ভবপর নয়, কেননা এর মালিকানা আমার হাতে নেই, আমি তো আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রচারক মাত্র। পবিত্র কুরআনেও এসেছে- ‘আর যখন তাদের কাছে আমার সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন আমার সাক্ষাতের প্রতি অনাকাঙ্খী লোকগুলো বলে, এই কুরআনের পরিবর্তে অন্য কোন কুরআন নিয়ে এস অথবা একে পরিবর্তন করে দাও। আপনি বলে দিন, একে নিজের পক্ষ থেকে পরিবর্তন করার সাধ্য আমার নেই, আমি তো কেবল তারই অনুসরণ করি যা আমার কাছে অহি করা হয়। আমি ভয় করি কঠিন দিবসে আমার প্রভুর শাসিত্মর, যদি আমি তাঁর অবাধ্যতা করি’ (ইউনুস ১৫)। আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং আপনি এর প্রতিই দাওয়াত দিন এবং সুদৃঢ় থাকুন তার উপর যেভাবে আপনি আদ্দিষ্ট হয়েছেন; আপনি তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করবেন না এবং বলুন আল্লাহ যে কিতাব নাযিল করেছেন, আমি তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি’ (আশ-শূরা ১৫)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল যার উপর আমার কোন নির্দেশনা নেই তা প্রত্যাখ্যাত’ (মুসলিম হা/৪৫৯০)। তিনি আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি দ্বীনের মধ্যে এমন কিছু অনুপ্রবেশ করাল যা এর অন্তর্ভুক্ত ছিল না তা প্রত্যাখ্যাত’ (মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/১৪০)। ‘যে ব্যক্তি পথভ্রষ্টতার দিকে আহবান করে, তার যত অনুসরণকারী হবে, তাদের পাপ সমতুল্য পাপ তার উপর চাপানো হবে’ (মুসলিম, মিশকাত হা/১৫৮)

দ্বিতীয়ত : দাওয়াত প্রদান করতে হবে সর্বপ্রথম তাওহীদের দিকে। তাওহীদী আক্বীদাকে সুদৃঢ় করার জন্য অর্থাৎ কেবলমাত্র আল্লাহকেই ইলাহ হিসাবে গ্রহণ করা এবং শিরক ও শিরকী প্রতিভূদের পরিত্যাগ করার এই দাওয়াত প্রাথমিকভাবে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। রাসূল (ছাঃ) যখন অহিপ্রাপ্ত হন তখন আরব সমাজ ছিল ঘোরতর জাহেলিয়াতে নিমজ্জিত। পূর্বপুরুষদের ভ্রষ্ট বিশ্বাস ও আচারকে তারা অন্ধভাবে অনুসরণ করে চলত। রাসূল (ছাঃ) যখন তাদেরকে তাওহীদের দিকে আহবান করলেন তখন তারা বলল, ‘আমরা তো কেবল সে বিষয়েরই অনুসরণ করব, যার উপর আমাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছি। যদিও তাদের বাপ-দাদারা কিছুই জানত না। জানত না সরল পথও’ (বাক্বারা ১৭০)। তাদের বিশ্বাস ও আচরণের শুদ্ধতার জন্য তাদের নিকট কোনরূপ দলীল উপস্থিত ছিল না কেবলমাত্র পূর্বপুরুষদের প্রতি অন্ধ অনুসরণ ব্যতীত। এজন্য আল্লাহ সেই সময় তথা মাক্কী জীবনে তাওহীদের আহবান সূচক আয়াতসমূহ নাযিল করেন। হযরত আয়শা (রাঃ) বলেন, ‘প্রথম পর্যায়ে কুরআনের দীর্ঘ সূরাসমূহ নাযিল হয়েছিল যেখানে ছিল জান্নাত ও জাহান্নামের বর্ণনা। অতঃপর মানুষ যখন ইসলামের দিকে ফিরে এল তখন একে একে হালাল-হারাম সম্বলিত আয়াত নাযিল হওয়া শুরু হয়’ (বুখারী হা/৪৯৯৩)। এভাবে আখেরাতের প্রতি আগ্রহীকরণ ও শাস্তির ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে তাওহীদী আক্বীদাকে পরিশুদ্ধির মাধ্যমেই মক্কায় ইসলামের প্রারম্ভিক দাওয়াত শুরু হয়।

ইসলামী দাওয়াতের বৈশিষ্ট্য :

প্রথমত : ইসলামী দাওয়াতের বৈশিষ্ট্য হল আন্তর্জাতিকতা ও সার্বজনীনতা। যখন আল্লাহ ইসলামের বার্তা নিয়ে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে প্রেরণ করেছেন, অতঃপর এর দাওয়াত দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, তখন থেকে এ দাওয়াত আর কোন নির্দিষ্ট সময় বা স্থান, জাতি বা বর্ণের সাথে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এই দাওয়াত সমগ্র বিশ্বের জন্য। আল্লাহ বলেন, ‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপই প্রেরণ করেছি’ (আম্বিয়া ১০৭)। ‘এটি (আল কুরআন) সারা বিশ্বের জন্য উপদেশস্বরূপ’ (আনআম ৯০)। ‘পরম কল্যাণময় তিনি যিনি তাঁর বান্দার প্রতি ফয়সালার গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন, যাতে সে বিশ্বজগতের জন্য সতর্ককারী হয়’ (ফুরকান ১)। ‘(হে রাসূল) আপনি বলে দিন, হে মানবমন্ডলী! তোমাদের সবার প্রতি আমি আল্লাহ প্রেরিত রাসূল’ (আ‘রাফ ১৫৮)

দ্বিতীয়ত: এই দাওয়াত অতি স্বচ্ছ, সরল ও সুস্পষ্ট, যা কোন জোর জবরদস্তির অপেক্ষা রাখে না। কেননা এ দ্বীন হল মানবজাতির স্বভাবধর্ম যার উপর আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘প্রতিটি নবজাতক ইসলামের উপরই জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তার পিতামাতা তাকে ইহুদী, নাছারা বা অগ্নিপূজক বানিয়ে দেয়’ (মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/৯০)। এজন্য এই দাওয়াত উপস্থাপনে কোন জবরদস্তি বা বাধ্যতামূলক নীতি অবলম্বনের প্রয়োজন নেই। আল্লাহ বলেন ‘বলুন, আমি তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাই না আর আমি লৌকিকতাকারীও নই’ (ছোয়াদ ৮৬)। ‘আপনি আপনার পালনকর্তার পথের দিকে আহবান করুন জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও উত্তম উপদেশ শুনিয়ে এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন পছন্দনীয় পন্থায়’ (নাহ্ল ১২৫)। ‘যখন আমার বান্দারা আপনাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে; (বলে দিন) আমি রয়েছি অতি সন্নিকটে। আমি প্রার্থনাকারীর প্রার্থনাকে কবুল করি যখন সে প্রার্থনা করে। সুতরাং আমার হুকুম পালন করা এবং আমার প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস স্থাপন করা তাদের জন্য একান্ত কর্তব্য, যাতে তারা সঠিক পথ পেতে পারে’ (বাক্বারা ১৮৬)। ‘আল্লাহ কাউকে সাধ্যাতীত কোন কাজের ভার দেন না, সে তাই পায় যা উপার্জন করে এবং তাই তার উপর বর্তায় যা সে করে’ (বাক্বারা ১৮৬)। ‘তোমরা আল্লাহর জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাও যেভাবে প্রচেষ্টা চালানো প্রয়োজন, তিনি তোমাদেরকে নির্বাচন করেছেন এবং দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন সংকীর্ণতা রাখেননি’ (হজ্জ্ব ৭৮)

দাওয়াতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা :

  1. ইসলাম মানবতার স্বভাবধর্ম। ফলে সৃষ্টিগতভাবেই মানুষের মাঝে সত্য গ্রহণের যোগ্যতা বিদ্যমান। কিন্তু অসুস্থ ও প্রতিকূল পরিবেশ তাকে সত্য গ্রহণে বাধাগ্রস্থ করে। মানব সত্ত্বার সুস্থ এবং সুন্দরের পূজারী। এ সুপ্ত শক্তিকে জাগ্রত করার জন্যই সত্য ও কল্যাণের পথে দাওয়াত দেয়া প্রয়োজন। আল্লাহ বলেন, ‘এটা আল্লাহর দেয়া ফিৎরাত (স্বভাব) যার উপর তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টিতে কোন পরিবর্তন নেই’ (রূম ৩০)
  2. আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন কেবল তাঁর ইবাদতের জন্যই। কিন্তু মানুষ তাঁকে না দেখেই তাঁর ইবাদত করে কি না তার পরীক্ষা তিনি নিতে চান। এ পরীক্ষা দিতে যেয়ে মানুষ যেন বিভ্রান্ত হয়ে না পড়ে এজন্য তাদের সতর্ক করার জন্য ও তাঁর বাণী প্রচারের জন্য যুগে যুগে লক্ষাধিক নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। আর এর মাধ্যমে শেষ দিবসে তিনি মানুষের এই ওযর পেশ করার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছেন যে, তারা সত্যপথের দাওয়াত পায়নি বলে গোমরাহ হয়েছিল। আল্লাহ বলেন, ‘আমি রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে, যাতে রাসূলগণকে প্রেরণের পর আল্লাহর কাছে মানুষের আপত্তি করার আর কোন অবকাশ না থাকে’ (নিসা ১৬৫)
  3. মানুষকে আল্লাহ সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। সমাজ পরিচালনার জন্য নানা বিধি-বিধান প্রণয়ন অপরিহার্য। কিন্তু সে তার সীমাবদ্ধ জ্ঞানের কারণে একটি নির্ভুল জীবনবিধান প্রণয়ন করতে সক্ষম নয়। কেননা ভূত-ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যে সীমাহীন প্রজ্ঞা প্রয়োজন তা মানুষের নেই। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদেরকে অতি অল্পই জ্ঞান দেয়া হয়েছে’ (বনী ইসরাঈল ৮৫)। পক্ষান্তরে আল্লাহর জ্ঞান অসীম অনন্ত। তিনি সৃষ্টিকর্তা আবার তিনিই পালনকর্তা। সৃষ্ট জগতের সকল সমস্যা ও সমাধান তার পরিজ্ঞাত। ভূত-ভবিষ্যৎ তাঁরই আয়ত্বে। ফলে তাঁর প্রদত্ত জীবনব্যবস্থাই হবে মানুষের জন্য চিরস্থায়ী ও কল্যাণকর দিকনির্দেশনা। আল্লাহ বলেন, ‘হুকুমদানে (বিধান রচনায়) আল্লাহর চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কে হতে পারে বিশবাসী সম্প্রদায়ের জন্য’ (মায়েদা ৫০)? এ জীবনব্যবস্থার সাথে সকল মানুষকে পরিচয় করানো এবং তা অনুসরণের মাধ্যমে সমাজের বুকে কল্যাণ ও প্রশান্তির সুবাতাস ছড়িয়ে দেয়ার জন্য দাওয়াত প্রদান অবশ্য কর্তব্য।
  4. মানুষ সৃষ্টিগতভাবে ভুলপ্রবণ ও ষড়রিপুর তাড়নাযুক্ত। ফলে স্রষ্টাকে চিনলেও প্রায়ই সে স্রষ্টার নির্দেশের কথা ভুলে যায়। প্রবৃত্তির অনুসরণ করে নিজের ধ্বংস ডেকে আনে। এজন্য মানুষকে সরলপথের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে ও অন্যায় পথ থেকে বিরত রাখতে সবসময় নছীহত-উপদেশ অব্যাহত রাখতে হয়। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল সর্বদাই থাকা প্রয়োজন যারা কল্যাণের দিকে আহবান করবে, ন্যায়ের আদেশ দিবে এবং অন্যায় থেকে নিষেধ করবে’ (আলে ঈমরান ১০৪)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যখন কোন অন্যায় কাজ হতে দেখে, সে যেন তা স্বহস্তে পরিবর্তন করে দেয়। যদি সে ক্ষমতা না থাকে তবে মুখ দ্বারা তার প্রতিবাদ করবে, আর যদি সে ক্ষমতাও না থাকে তবে নিজের অন্তরে তাকে ঘৃণা করবে। আর এটাই হল ঈমানের দুর্বলতম স্তর’ (মুসলিম, মিশকাত হা/৫১৩৭)। তিনি আরও বলেন, ‘সেই সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ! তোমরা অবশ্যই ভাল কাজের আদেশ দিবে এবং খারাপ কাজ থেকে নিষেধ করবে। নতুবা অনতিবিলম্বেই আল্লাহ তা‘আলা নিজের পক্ষ থেকে তোমাদের উপর আযাব প্রেরণ করবেন। অতঃপর তোমরা তার নিকট দো‘আ করবে কিন্তু তোমাদের দো‘আ কবুল করা হবে না’ (তিরমিযী, মিশকাত হা/৫১৪০, সনদ হাসান)

সর্বোপরি একজন দাঈ আল্লাহর পথে আহবানের প্রয়োজনীয়তা তখন সর্বাধিক অনুভব করেন যখন তিনি উপলব্ধি করতে সক্ষম হন স্বীয় অপরিমেয় সৌভাগ্যকে। ইসলাম নামক মহা অনুগ্রহ লাভে যে ব্যক্তি ধন্য হয়েছেন, যার বদৌলতে তিনি আগামী দিনের চিরস্থায়ী জীবনে মুক্তির দিশা খুঁজে পেয়েছেন, সে ব্যক্তি তার এই মহাঅর্জনকে যারা এ সম্পর্কে বেখবর তাদের মাঝে পেঁŠছে দিতে উদগ্রীব হবেন এটা অতি স্বাভাবিক। যে ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ লাভে যত বেশী সক্ষম হয়েছেন, যে ব্যক্তি জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে, চক্ষুযুগলের প্রতিটি পলকে, আত্মার প্রতিটি নিঃশ্বাসে মহান স্রষ্টার অনুগ্রহ যত বেশী অনুভব করেন সে ব্যক্তি তার এই মহাপ্রাপ্তিকে তত বেশী মানবসমাজে ছড়িয়ে দিতে  তৎপর হন। যখন এই পৃথিবীর সামান্য কোন অর্জনকেও আমরা প্রচারের উপলক্ষ্য মনে করি তখন এই সর্বোচ্চ অর্জন যে কোন ব্যক্তির জন্য সর্বাধিক বড় প্রচার উপলক্ষ্য তা বলাই বাহুল্য। দাওয়াতের এই আকুতি লক্ষ্য করা যায় সূরা ইয়াসীনে বর্ণিত ইন্তাকিয়া নগরীর হাবীব নাজ্জারের মর্মস্পর্শী ঘটনায়। যখন সে দরদভরা কন্ঠে তার কওমকে আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁর প্রতি ঈমান আনার আহবান জানাচ্ছিল তখন তার কওম তাকেসহ তার তিনজন সাথীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে ফেলল। অতঃপর আল্লাহ যখন তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাচ্ছিলেন তখন সে তার কওমের প্রতি লা‘নত না করে গভীর আক্ষেপে বলছিল, ‘হায় আমার কওম যদি জানত! যদি জানত আমার প্রভু আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং আমাকে সম্মানিতদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন!’ (ইয়াসীন ২০-২৭)

সকল নবী-রাসূল (আঃ) এবং শেষনবী (ছাঃ) জাতি-ধর্ম, ধনী-গরীব, স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেঁŠছে দিয়েছেন। কে দাওয়াত গ্রহণ করবে না করবে, কে ক্ষতি সাধন করবে না করবে এ জাতীয় চিন্তা থেকে তারা ছিলেন মুক্ত। দ্বীনের প্রচারে কোন যুলুমকারীর যুলুম, নিন্দুকের নিন্দাকে তাঁরা ভয় করতেন না। কেননা এ দাওয়াত প্রদান তো আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া অন্যান্য দায়িত্বের মত একটি বড় দায়িত্ব।

দাওয়াত প্রদানের ফযীলত :

ইসলামী দাওয়াতের মূল দাওয়াতদাতা আল্লাহ রাববুল আলামীন স্বয়ং নিজে। কুরআনে এসেছে ‘তারা আহবান জানায় জাহান্নামের দিকে। আর আল্লাহ আহবান করেন স্বীয় নির্দেশে জান্নাতের দিকে এবং ক্ষমার দিকে’ (বাক্বারাহ ২২১)

পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হলেন নবী-রাসূলগণ। আল্লাহ তাঁর দাওয়াত এই শ্রেষ্ঠ মানুষ নবী-রাসূলগণকে মানব জাতির নিকট প্রচার করার দায়িত্ব দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তো প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রাসূল পাঠিয়ে এ নির্দেশ দিয়েছি যে, আল্লাহর ‘ইবাদত কর’ তাগুত (আল্লাহদ্রোহী)-কে বর্জন কর’ (নাহ্ল ১২৫)। ‘নিশ্চয়ই আপনাকে সত্য (দাওয়াত) সহকারে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে প্রেরণ করেছি এবং এমন কোন জাতি নেই যার নিকট সতর্ককারী গমন করেনি’ (নাহ্ল ৩৬)

সুতরাং এটা সুস্পষ্ট যে, এই মর্যাদাপূর্ণ দাওয়াত প্রচারের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ পৃথিবীর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময় দায়িত্ব পালনে লিপ্ত রয়েছেন। এজন্য আল্লাহর পথে আহবানকারীকে পবিত্র কুরআনে সর্বোত্তম বার্তাবাহক বলে অভিহিত করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর দিকে আহবান করে, সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং বলে আমি একজন মুসলিম; তার কথা অপেক্ষা উত্তম কথা আর কার?’ (হা-মীম সাজদাহ ৩৩)

অন্যদিকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দানের অর্থ দুনিয়া ও আখিরাতের চিরন্তন কল্যাণ লাভের পথে আহবান। এ দাওয়াত যে ব্যক্তি কবুল করে নিল  সে চির কল্যাণের পথে অভিযাত্রী হল। এ দাওয়াতই তার জন্য জীবনের নতুন দিশা এবং চিরন্তন মুক্তির দুয়ার উন্মুক্ত করে দিল। এ থেকেই দাওয়াতের গুরুত্ব ও মর্যাদা সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যায়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর কসম! তোমার মাধ্যমে আল্লাহ যদি একজন ব্যক্তিকেও হেদায়েত করেন তবে সেটা হবে তোমার জন্য লাল উটের চেয়েও উত্তম’ (মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/৬০৮০)। তিনি আরও বলেন, ‘কেউ যদি কোন নেক কাজের পথ নির্দেশ দেয়, সে ঐ নেক কাজ সম্পাদনকারীর সমতুল্য ছওয়াব পায়’ (মুসলিম, মিশকাত হা/২০৯)। ‘যে হেদায়েতের দিকে আহবান করে, এ হেদায়েতের যত অনুসরণকারী হবে, তাদের প্রতিদানের সমতুল্য প্রতিদান সে পাবে’ (মুসলিম, মিশকাত হা/১৫৮)। তিনি আরও বলেন, ‘আল্লাহ সে ব্যক্তির মুখ উজ্জ্বল করুন যে আমার কথা শুনেছে অতঃপর তা যথাযথভাবে স্মরণ রেখেছে ও রক্ষা করেছে অতঃপর তা যথাযথভাবে অন্যের কাছে পৌছিয়ে দিয়েছে’ (ইবনে মাজাহ, মিশকাত হা/২২৮, সনদ ছহীহ)। তিনি আরও বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ফিরিশতাগণ এবং আসমান ও জমীনের অধিবাসীরা এমনকি পিপীলিকা তার গর্তে আর মাছ- যে ব্যক্তি মানুষকে উত্তম কথা শিক্ষা দেয় তার জন্য দো‘আ করে’ (তিরমিযী, মিশকাত হা/২১৩, সনদ হাসান)

আল্লাহ রাববুল আলামীন আমাদের প্রত্যেককে ইসলামের শাশ্বত বিধানের প্রতি পরিপূর্ণ আত্মসমার্পণ করার তাওফীক দান করুন এবং এই দ্বীনের সর্বব্যাপী আলোকচ্ছটা থেকে যারা অন্ধকারে রয়েছে তাদের কাছে আলোর বার্তা পৌঁছে দেয়ার যোগ্যতা ও সামর্থ্য দান করুন। আমীন!!



আরও