‘ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান’: একজন কম্যুনিস্টের মহৎ নিরীক্ষণ
আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব 10043 বার পঠিত
লেখিকা পরিচিতি : খ্যাতনামা মুসলিম লেখিকা
মরিয়ম জামিলা ২৩ মে ১৯৩৪ সালে নিউইয়র্কে এক জার্মান বংশোদ্ভূত ইহুদি
পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬১ সালে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁকে আমেরিকান
ইহুদী নারীদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী মনে করা হয়। মার্গারেট মার্কাস
নাম্নী এই মহিয়সী নারী শৈশব থেকে মানসিক রোগাক্রান্ত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়
জীবনে অসুস্থতার জন্য তাঁকে কয়েকবার বিরতি দিতে হয়। শেষ পর্যন্ত
সিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তাকে অনার্স শেষ না করেই শিক্ষাজীবন শেষ
করতে হয়।
স্কুল জীবনেই তিনি আরব সংস্কৃতি ও ইতিহাসের প্রতি আকৃষ্ট হন। বিশেষত: আরব ও ফিলিস্তীনীদের দুর্ভোগ তাকে চরমভাবে ব্যথিত করে তুলেছিল। মাত্র বারো বছর বয়সে তিনি ফিলিস্তীনী আশ্রয়শিবিরকে কেন্দ্র করে একটি গল্পগ্রন্থ লেখেন। একজন ভালো চিত্রকরও ছিলেন তিনি। অতঃপর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ইহুদীসহ বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রুপের সংস্পর্শে আসেন, কিন্তু তাদের সকলেই জায়নবাদকে সমর্থন করায় তিনি তাদের প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন না। ১৯৫৩ সালে অসুস্থতায় পড়ার পর তিনি ইসলাম ও কুরআনকে জানার সুযোগ পান এবং এর দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হন। মুহাম্মাদ আসাদের বিখ্যাত The Road to Mecca বইটিও তাকে অনুপ্রাণিত করে যা তাকে ইসলাম গ্রহণের পথ তৈরী করে দেয়। ১৯৫৭-৫৯ সাল পর্যমত্ম দীর্ঘ দু’বছর তাঁকে হাসপাতালে কাটাতে হয়। সুস্থ হওয়ার পর তিনি বাড়িতে ফিরে আসেন এবং বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের সাথে যুক্ত হন। দেশ-বিদেশের ইসলামী ব্যক্তিত্বগণের সাথে যোগাযোগ করতে থাকেন। বিশেষ করে পাকিস্তান জামা‘আতে ইসলামীর আমীর মাওলানা মওদূদীর সাথে তাঁর যোগাযোগ হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৬১ সালের মে মাসে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মরিয়ম জামীলা নাম ধারণ করেন। ১৯৬২ সালে তিনি মাওলানা মওদূদীর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানে গমন করেন এবং সেখানেই ১৯৬৩ সালে মুহাম্মাদ ইউসুফের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পরবর্তী কয়েকবছর গভীরভাবে তিনি ইসলামের উপর পড়াশোনা করেন। অতঃপর লেখালেখির সাথে যুক্ত হন। সূক্ষ্ম ও সাহসী চেতনাশক্তির প্রয়োগ ঘটিয়ে তার ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে মুসলিম সমাজে আমদানীকৃত পশ্চিমা বস্ত্তবাদ, ধনতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও তথাকথিত আধুনিকতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পরিণত হন একজন খ্যাতনামা কলমসৈনিকে। তাঁর সকল লেখনীতে পশ্চিমাদের মত তথাকথিত আধুনিক মুসলিমদেরকেও কোনরূপ ছাড় দেননি। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় তিরিশটি। এছাড়াও বহু প্রবন্ধ তিনি লিখেছেন। উর্দূ, ফারসী, বাংলা, তুর্কী, ইন্দোনেশিয়ান প্রভৃতি ভাষায় তার বেশ কিছু বই অনুবাদ করা হয়েছে। তাঁর যাবতীয় রচনা, বক্তব্য, ভিডিও ক্যাসেট, চিত্রকর্ম বর্তমানে নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত রয়েছে। তার প্রসিদ্ধ কয়েকটি বই হল- ইসলাম ও আধুনিকতা, পশ্চিমাকরণ এবং মানবকল্যাণ, ইসলাম বনাম পাশ্চাত্য, ইসলাম বনাম আহলে কিতাব : অতীত ও বর্তমান, ইসলাম ও পশ্চিমা সমাজ, ইসলাম ও আজকের মুসলিম নারী সমাজ, ইসলামী সংস্কৃতি : তত্ত্ব ও প্রয়োগ, ইসলাম ও আধুনিক মানুষ, পশ্চিমাকরণ বনাম মুসলিম জনগণ ইত্যাদি। যে অসাধারণ প্রজ্ঞা ও বলিষ্ঠ চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তার প্রতিটি বইয়ে তা এককথায় অসাধারণ। গত শতকে তার মত বিদূষী মুসলিম নারী লেখিকার উদাহরণ খুব কম। তাঁর ‘ইসলাম ও প্রাচ্যবাদ’[1] শীর্ষক বইটি ১৯৮০ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। ২০০১ সালে বইটি বাংলায় অনূদিত হয়। তরুণ প্রজন্ম বিশেষত ছাত্রসমাজকে পাশ্চাত্যের বুদ্ধিবৃত্তিক ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা করাই বইটি রচনার মূল লক্ষ্য।
গ্রন্থ পর্যালোচনা :
লেখিকা তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে বইটিতে ইসলাম ধর্ম ও সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসনের বিভিন্নমুখী দিক উন্মোচন করেছেন। দেখিয়েছেন কিভাবে আধুনীকিকরণের অজুহাতে, ছদ্মবেশী হিতৈষী হয়ে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের বিদগ্ধ পন্ডিতগণ ইসলামী মূল্যবোধকে গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্য পন্ডিতি নাশকতায় লিপ্ত হয়েছেন। আর কিভাবে তাদের ধ্যান-ধারণা ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম সমাজে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে।
বইটির শুরুতে সংক্ষিপ্ত ভূমিকায় তিনি প্রাচ্যবিদ নামধারী পশ্চিমা পন্ডিতদের ইসলামের বিরুদ্ধে আঘাত হানার সাধারণ একটি চিত্র উপস্থাপন করেছেন। কিভাবে কথায় কথায় তারা ইসলামকে পশ্চাদ্গামী, নিশ্চল, প্রতিক্রিয়াশীল, প্রগতিবিরোধী বলে শ্লাঘা বোধ করে। কিভাবে তারা ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপের জন্য পন্ডিত উপাধি ও বড় বড় পুরস্কার লাভ করে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ আলোচনার শুরুতে এনে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের সতর্ক করতে চেয়েছেন- যেন তারা এই সব অবিবেকী পন্ডিতকে ইসলামের চূড়ামত্ম বিশেষজ্ঞ বলে ভুল না করে বসে। সাথে সাথে পশ্চিমী দুনিয়া ইসলাম ও মুসলমানদের কি চোখে দেখে তা পাঠককে দেখানোও তাঁর অভিপ্রায়। এর বিরুদ্ধে মুসলমান পন্ডিতদের করণীয় আলোচনা করতে যেয়ে তিনি বলেছেন, ‘মিথ্যা মুকাবিলার একমাত্র পথ হল সত্য উপস্থাপনা এবং যুক্তিগ্রাহ্য, বিশ্বাসযোগ্য কারণ-নির্ভর উন্নততর ধারণা সৃষ্টি করা। তাই আমাদের পন্ডিতমহলের উচিৎ অসম্মতির ছোটখাটো কারণগুলো একপাশে সরিয়ে রেখে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, মনসত্মত্ত্ব প্রাণীবিজ্ঞান সম্পর্কিত একটি সামগ্রিক লাইব্রেরী সৃষ্টিতে নিঃস্বার্থভাবে সহযোগিতা করা। মতলববাজ প্রাচ্যবিদদের নিন্দা করতে যেয়ে তিনি ভুলে যাননি প্রাচ্যবাদের কল্যাণকর দিকসমূহ। নিকলসন ও আরবেরীদের মত প্রাচ্যবিদগণ ইউরোপীয় ভাষায় ইসলামী সাহিত্যের অনুবাদে যে দুঃসাধ্য পরিশ্রম করেছেন তার কৃতিত্ব দিয়েছেন তিনি অকুণ্ঠচিত্তে।
আটটি অধ্যায়ে বিভক্ত বইটিতে লেখিকা আটজন খ্যাতনামা প্রাচ্যবিদের বইকে সামনে রেখে আলোচনার অবতারণা করেছেন।
১ম অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন ‘প্রাচ্যবাদের কাছে ইসলামের ইতিহাস’ সম্পর্কে। এখানে তিনি লেবাননী বংশোদ্ভূত বিখ্যাত আমেরিকান ইতিহাসবিদ ড. ফিলিপ কে. হিট্টির ’Islam and the West' বইটির বিশ্লেষণ করতে যেয়ে দেখিয়েছেন লেখকের নিরংকুশ সংকীর্ণতা ও শঠতা। বইটির একেবারে শুরুতেই ড. হিট্টি যুক্তি প্রদর্শন করেছেন যে, নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) ছিলেন একজন প্রতারক (নাউযুবিল্লাহ)। তারপর পর্যায়ক্রমে বর্ণনা করে গেছেন বিদ্রুপাত্মক ভাষায় নবুয়তের বিভিন্ন পর্যায়গুলো। কুরআনকে তিনি দেখিয়েছেন খৃষ্টান, ইহুদী ও আরব পৌত্তলিকদের প্রভাবজাত জাল রচনা আর ইসলামকে ইহুদী-খৃষ্টান ঐতিহ্যের ‘আরব সংস্করণ’ এবং ‘জাতীয়করণ’ হিসাবে। ইসলামের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উপযুক্ততাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে তিনি লেখেন, ‘ইসলাম যা জয় করে, তা ধর্ম নয়, রাষ্ট্র। ইসলাম ধর্ম নয়, আরবীয় বৈশিষ্ট্য। একটি সংশয়শূন্য পৃথিবীতে আরবরা আকস্মাৎ ফেটে পড়ে এক জাতীয়তাবাদী ইশ্বরতন্ত্রের মত-একটি পূর্ণতর বস্ত্তজীবনের সন্ধানে।’ মানবজাতিসত্তায় ইসলামের অবদান আলোচনা করতে গিয়ে বিভিন্ন সম্রাটের রাজ-প্রাসাদের শান-শওকত, নৃত্য-গীত, সুরা, ছূফীবাদ প্রভৃতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও আইন, জ্ঞান-বিজ্ঞান, বিশেষত মানবতার নৈতিক কল্যাণের ক্ষেত্রে ইসলামের অবদানকে তিনি পুরোপুরি এড়িয়ে গেছেন। পরিশেষে বর্তমান মুসলিম বিশ্বে পশ্চিমাকরণের যে প্রবণতা শুরু হয়েছে তার ভূয়সী প্রশংসা করে আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি আধুনিক পশ্চিমী সমাজ-সভ্যতা, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা ও বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতির গুণগানে মত্ত হয়েছেন।
লেখিকা হিট্টির এসব হিংসাত্মক অপপ্রচারণার বিরুদ্ধে জওয়াব দিয়েছেন ঠিকই; তবে স্বল্পভাষায়। কেননা তাঁর উদ্দেশ্য মূলতঃ পাঠককে ইসলামের বিরুদ্ধে এঁদের আক্রোশ ও অপপ্রচারণার ভয়াবহতা অনুধাবন করানো।
২য় অধ্যায়ে তিনি আলোচনা করেছেন ইসলামের প্রতি প্রাচ্যবাদের খৃষ্টান দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। এক্ষেত্রে তিনি নির্বাচন করেছেন 'The call of Minaret', 'Counsels in Contemporary Islam' প্রভৃতি বইয়ের লেখক মিশনারী ও ধর্মযাজক পন্ডিত ড. কেনেথ ক্রাগকে। ড. কেনেথ তার লেখায় খুব নির্লিপ্ত ভাষায় নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নবীত্বকে নিয়ে উপহাস করেছেন আর রাষ্ট্রশক্তি ও সমরশক্তি অবলম্বন করায় ইসলামের আধ্যাত্মিক গুরুত্ব বিপুলভাবে ক্ষয়িত হয়েছে বলে কপট আফসোস প্রকাশ করেন। ইসলামের অপরিবর্তনশীল আইন-কানুনকে নমনীয় করার উপদেশ দিয়ে তিনি লেখেন- সময়ের সাথে অনেক কিছুই বদলে যায়। যেমন প্রাথমিক যুগে আরব সমাজে পৌত্তলিকতার প্রভাব অত্যমত্ম বেশী ছিল বলে ছবি-মূর্তি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে যখন তাওহীদ মুসলামনদের মনে বদ্ধমূল হয়ে গেছে তখন নির্বোধ কঠোরতার সাথে এটা নিষিদ্ধ করাটা বোকামী হয়ে যায়। তার মতে, আধুনিকতা ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অচল করে দিয়েছে।
তিনি ইসলামকে চিনেছেন বহুরূপে। ’পুরনো ইসলাম’, ‘মধ্যযুগীয় ইসলাম’, ‘ঐতিহ্যবাদী ইসলাম’, ‘উদার প্রগতিশীল ইসলাম’, ‘তুর্কী-ভারতীয়-পাকিসত্মানী ইসলাম’ ইত্যাদি তিনি অনর্গল ব্যবহার করেছেন আত্মতৃপ্তির সাথে। তিনি সুপারিশ করেছেন যে মুসলিম সমাজে ধর্মামত্মরকে যে অত্যমত্ম গর্হিত অপরাধ মনে করা হয় তা থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন তাদের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ ও পরমতসহিষ্ণু মনোভাব জাগ্রত করা। আর খৃষ্টান মিশনগুলোর প্রাথমিক কর্তব্য হবে মুসলিম সমাজকে এই উদার ভাবাদর্শে উজ্জীবিত করার জন্য সার্বিক প্রচেষ্টা চালানো।
লেখিকা এখানে প্রতিটি প্রসঙ্গের জবাব দিয়ে গেছেন এবং এ সকল ক্ষেত্রে খৃষ্টসমাজের দ্বিচারিতার নানা রূপগুলোও দেখিয়ে দিয়েছেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে।
৩য় অধ্যায়ে তিনি প্রাচ্যবাদের ইহুদী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন ইসরাঈলের ইহুদী প্রাচ্যবিদ সোলোমন ডেভিড গোইনতেইনের 'Jews and Arabs' বই অবলম্বনে। স্বাভাবিকভাবেই তিনি আর সব ইহুদীদের মত রাসূল (ছাঃ)-এর নবুওত ও পবিত্র কুরআনের ঐশ্বরিকতাকে অস্বীকার করেছেন। তবে মুহাম্মাদের হাত দিয়ে ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্মের ধারাবাহিকতায় অনুরূপ একটি ধর্মের জন্ম হল কিভাবে এ বিষয়ে তার মত হল তৎকালীন ইহুদীদের কাছ থেকে ইহুদী ধর্মগ্রন্থ ইঞ্জীল প্রাপ্ত হয়ে তিনি মূসা (আঃ)-এর উপর এতটাই মুগ্ধ হন যে, অনুরূপ নতুন একটি ঐশী গ্রন্থ উৎপন্ন করতে তৎপর হয়ে উঠেন (নাঊযুবিল্লাহ)। ইহুদী আচার-আচরণগুলোর সাথে ইসলামের নিয়ম-কানুনের মিল খোঁজার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে একলাফে এই সিদ্ধামেত্ম পৌছে যান যে, ইসলাম ইহুদী ধর্মের বিকৃত রূপ মাত্র। ইসলামী শাসনব্যবস্থার অধীনে ইহুদীরা কেমন অবস্থায় ছিল তার বর্ণনায় অবশ্য গোইনতেইন স্বীকার করেছেন যে, মধ্যযুগীয় ইউরোপের চেয়ে তখনকার দিনে ইহুদিরা ঢের ভাল ছিল যদিও নীতি অনুযায়ী তারা সেখানে থাকত দ্বিতীয় শ্রেণীর (?) নাগরিক হিসাবে। ইসরাঈলে ইহুদীরা যে জবরদখলপূর্বক রাষ্ট্র গঠন করেছে এবং নির্বিচারে আরব মুসলমানদের নিধন করেছে তার যৌক্তিকতা দেখাতে তার মত হল, যায়নবাদ আগাগোড়া একটি মানবিক ও শামিত্মবাদী আন্দোলন, এখানে সমসত্ম বিপর্যয়ের মূল হল আরবদের দোষ-ত্রুটি, যারা ইহুদী জাতির উপর আক্রমণ শুরু করে; অপরদিকে ইহুদীরা কেবল খুব নিস্পৃহভাবে প্রতিশোধ গ্রহণ করে। তার মতে, যায়নবাদের প্রতি আরব জনগণের বিরোধিতা কিছু স্বার্থপর ও দূর্নীতি পরায়ন নেতার কৃত্রিম সৃষ্টি। যদি সাধারণ আরববাসীকে একা ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে তারা ইহুদী সমাজের সাথে শামিত্মতে বসবাস করতে চাইবে। এই আধুনিক যুগে এসেও আরবদের কুরআনী ধ্রুপদী আরবী ভাষা ব্যবহারে তিনি বিরক্ত। তার মতে কোরআনের ভাষা এখন সমাজের প্রয়োজন মেটাতে যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন আঞ্চলিক কথ্য ভাষাকে উৎসাহিত করা।
৪র্থ অধ্যায়ে তিনি আলোচনা করেছেন মন্টেগোমারী ওয়াটের 'Islam and the intregration of society' বইটি নিয়ে। এই বইয়ে লেখক সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ইসলামকে বিশ্লেষণ করেছেন। চরম বস্ত্তবাদী ভাবকল্পকে সামনে রেখে বরাবরের মত স্থান-কালের ঐতিহাসিক বিবর্তনের ফসল হিসাবে ইসলামকে দেখেছেন। আর ব্যাখ্যায় যেয়ে যে নাতিদীর্ঘ দার্শনিক যুক্তিমালা ও গল্পগাথার বিচিত্র সমাবেশ ঘটিয়েছেন তা তাঁর নিজের কাছেও হয়ত আশ্চর্যরকম ঠেকবে। সমাজের প্রয়োজনে একসময় ইসলামের বিকাশ ঘটলেও এখন তার আবেদন আর অবশিষ্ট নেই। সমাজ সংহতির জন্য কাজ করতে গেলে তাই মুসলমানদেরকে আধুনিক জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। আর এজন্য প্রয়োজন হবে ইসলামকে তার জন্ম-উৎসের সত্যকে তথা এটা যে একটি ‘মানবসৃষ্ট’ ধর্ম তা স্বীকার করে নেয়া। আধুনিক যুগে ইসলামকে টিকিয়ে রাখতে গেলে এটাই সর্বাধিক প্রয়োজনীয়।- মুসলমানদের প্রতি এই প্রাচ্যবিদের পরামর্শ (!)।
৫ম অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে প্রাচ্যবাদের ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। উইলফ্রেড কান্টওয়ের স্মিথের 'Islam in Modern History' বইটি এখানে আলোচনার কেন্দবিন্দু। ড. স্মিথ প্রাচ্যবাদের গতানুগতিকতা থেকে সামান্য সরে এসে অনেকটা নৈর্ব্যক্তিকভাবে আলোচনা শুরু করলেও বইটির ছত্রে ছত্রে মুসলিম সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োগকে অপরিহার্য দেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। কামালপন্থী তুরস্ককে মডেল ধরে তিনি মুসলমানদের অতীন্দ্রিয় বিশ্বাসের মরীচিকা থেকে বেরিয়ে এসে বাসত্মববাদী হওয়ার পরামর্শ দেন। পশ্চীমী মডেলে খৃষ্টীয় সমাজ অনুকরণে তুরস্কে যে সংস্কার প্রচেষ্টা চালানো হয় তাকে আকণ্ঠ প্রশংসায় ভিজিয়ে তিনি বলছেন, এসব সংস্কারের উদ্দেশ্য খৃষ্টধর্ম গ্রহণের প্রশ্নের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়; বরং মধ্যযুগের পরিবর্তে আধুনিক যুগে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রশ্ন। তিনি বলেন, আধুনিক বিশ্ব গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মাধ্যম দিয়ে সকলকে নিয়ে কিভাবে বাস করা যায় তা দেখিয়ে দিচ্ছে। অতএব মুসলমানদেরকেও ইসলামকে অন্যধর্মের মত সৃষ্টিশীল হিসাবে প্রমাণ দিতে হবে। কেননা একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক যুগ বা ভৌগলিক এলাকার প্রয়োজন পূরণের পর ইসলামের আদি উপযুক্ততা এখন আর অবশিষ্ট নেই।
লেখিকা এককথায় এর জবাব দিয়ে প্রসঙ্গের সমাপ্তি টেনেছেন- ‘যাবতীয় ধর্ম ও দার্শনিক ব্যবস্থা যদি একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর অনুপযোগী হয়ে যায় তাহলে যুক্তির দিক দিয়ে পশ্চিমী সভ্যতার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার সত্য হবে। আজ আমরা যাকে ‘আধুনিকতা’ বলছি তা-ও অবশ্যই কালের স্রোতে বিলীন হয়ে যাবে। তবুও কেন পশ্চিমী ছাঁচ বা আদর্শকে অবিনাশী, অপরাজেয় বলা হয়? আর এর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলারও সাহস কেউ করে না?’
৬ষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম অধ্যায়ে মানবতাবাদী ও আধুনিকতাবাদী দৃষ্টিতে প্রাচ্যবিদরা ইসলামের ব্যাখ্যা কিভাবে করেছেন তা আলোচিত হয়েছে। 'ধর্ম মানুষের সৃষ্টি’- এই প্রতিপাদ্য দিয়েই শুরু হয় বিবর্তনমূলক মানবতাবাদী দর্শন। আর আধুনিকতাবাদী দর্শন তার শেষ টানে ‘ধর্ম অবশ্যই সময়ের সঙ্গে পা ফেলে চলবে’- এই প্রতিপাদ্য নিয়ে। অর্থাৎ অভিজ্ঞতার দিগমত্ম প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে পুরনো ধ্যান-ধারণা ছুড়ে ফেলে নতুনকে গ্রহণ করতে হবে- এটাই আধুনিকতাবাদের মূল কথা। এই আধুনিকতা যেহেতু পারলৌকিক যাবতীয় প্রসঙ্গকে অপ্রাসঙ্গিক ও অর্থহীন বিধায় বাতিল করে দেয়; তাই ইসলাম যদি নিজেকে পরিবর্তন করতে না পারে তবে তাকে একই ভাগ্য বরণ করতে হবে। এই ঘরানার একজন সৎ ও অমত্মর্দৃষ্টিসম্পন্ন লেখক প্রফেসর এইচ. এ. আর. গীব পর্যমত্ম তার ’Modern Trends in Islam' বইতে আধুনিকতার সাথে ইসলামের সংঘাতের বিষয়টি যথার্থতার সাথে তুলে ধরতে সমর্থ হলেও অন্য প্রাচ্যবিদদের মতই মুসলিম সমাজকে পুনর্গঠনের প্রয়োজনে বার বার খোদ ইসলামের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার রব তোলা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি।
পরিশেষে সংক্ষিপ্ত উপসংহারে লেখিকা প্রাচ্যবাদের মৌলিক চারটি বক্তব্য উল্লেখ করেছেন- ১. মানুষ জৈবিক বিবর্তনের মাধ্যমে খুব নিম্ন অবস্থা থেকে বর্তমান উন্নত শারিরীক ও মানসিক কাঠামোয় উন্নীত হয়েছে। ২. মানবসমাজও একইভাবে খুবই আদিম সত্মর থেকে উঠে এসে ধীরে ধীরে সুউচ্চ সংস্কৃতির শিখরে পৌঁছেছে বিকাশপ্রাপ্ত হয়ে- যার উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে আধুনিক পশ্চিমী সভ্যতা। ৩. ‘পরিবর্তন’ একটি চিরমত্মন প্রাকৃতিক আইন। সুতরাং পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিরোধিতা করার অর্থ হল খোদ প্রাকৃতিক আইনকেই লঙ্ঘন করা। নতুনই সর্বোত্তম, পুরাতন সদা পরিত্যাজ্য। তাই পূর্বে প্রতিষ্ঠিত কোন আদর্শ বা নীতিবিধানকে সমর্থন করার অর্থ আদিম ও সীমাবদ্ধ অসিত্মত্বের দিকে পশ্চাদগমন করা। সুতরাং ধর্মের যে ধারণা ‘সর্বপ্রাণবাদ’ দিয়ে শুরু হয়েছিল যা সফল হয়েছিল ’নীতিতাত্ত্বিক একত্ববাদ’-এ, তার কবর রচিত হয়েছে দীর্ঘ মানবীয় অভিজ্ঞতার ফল-ফসল আধুনিক 'বৈজ্ঞানিক বস্ত্তবাদ’-এর আবির্ভাবে। ৪. বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক সভ্যতা ঐশী প্রত্যাদেশ ও অতীন্দ্রিয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ধর্মের ধারণাকে নাকচ করে দেয়। কেননা ঐশ্বরিকতা মেনে নেয়ার অর্থ হল ’পরিবর্তন’কে স্বীকৃতি না দেয়া। কেননা চূড়ামত্ম সত্য যখন জানা গিয়েছে, তখন তাকে পরিবর্তন করার উপায় নেই। অথচ ‘পরিবর্তন’ ছাড়া ‘প্রগতি’ কোনভাবেই সম্ভব নয়।
এ মাপকাঠিগুলোর উপর প্রাচ্যবিদরা ইসলামকে বিবেচনা করে বলেই ইসলামকে ‘সংস্কার’ করার জন্য, ‘আধুনিকীকরণ’ করার জন্য তারা এত মরিয়া। তবে বিশেষকরে আজকের অবক্ষয়ের যুগেও অসংগঠিত, পশ্চাদপদ, হীনবল মুসলমানদের ব্যাপারে তারা এত উদ্বিগ্ন কেন? লেখিকা তার উত্তর দিয়েছেন- এর কারণ দু’টি- ১. ঐতিহাসিক : ইসলামের শক্তিতে বলীয়ান মুসলমানদের স্বর্ণজ্বল অতীতের সেই দিনগুলোতে পাশ্চাত্য যে তীক্ত অভিজ্ঞতার স্বাদ গ্রহণ করেছে তা তাদের মাঝে আজও অনঢ়ভাবে ক্রিয়াশীল। এজন্য তারা মুসলমানদের অব্যক্ত সম্ভাবনাময় শক্তিকে সবসময় ভয় পায়, ভয় পায় একটি শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্র বা ঐক্যবদ্ধ মুসলিম এলাকাকে। ২. দার্শনিক : পাশ্চাত্য আজ যে দর্শনের উপর দাড়িয়ে (প্রাচীন গ্রীস থেকে আমদানীকৃত নাসিত্মক্যবাদ, অজ্ঞেয়বাদ, বস্ত্তবাদ এবং নৈতিক আপেক্ষিকতাবাদ) রয়েছে, তার বিরুদ্ধে আল্লাহর অহিপ্রাপ্ত বিশুদ্ধ ভাবাদর্শ হিসাবে ইসলামকে তারা একমাত্র চ্যালেঞ্জ মনে করে। ফলে ইসলামকে প্রতিরোধে মনসত্মাত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের অংশ হিসাবে হিসাবে প্রাচ্যবিদরা এই প্রচারে মুসলিম দেশগুলোকে প্লাবিত করা তাদের অবশ্য কর্তব্য মনে করেন যে, ইসলাম ও ইসলামী জীবন-প্রক্রিয়া হতাশাজনকভাবে ‘মধ্যযুগীয়’ এবং ‘সেকেলে’।
লেখিকা প্রাচ্যবিদদের ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রচারের বিভিন্নধাপের সাথে পাঠককে পরিচিত করিয়ে দিতে তাদের বক্তব্যসমূহ বিসত্মারিত আকারে উদ্ধৃত করেছেন এবং প্রয়োজনীয় সকল স্থানেই উপযুক্ত যুক্তি ও ইতিহাস তুলে ধরে তাদের অভিযোগগুলো খন্ডন করেছেন। দেখিয়ে দিয়েছেন তাদের পরম আরাধ্য ও ঢাক-ঢোল পিটানো ’ধর্মনিরপেক্ষতা’র ব্যর্থতার করুণ চিত্র, যা কেবল দিয়েছে বিনোদন, শিল্পকলা, কামুকতা, অর্থহীন আমোদ-প্রমোদ, জাতিগত ভেদবুদ্ধি, সর্বব্যাপী অপরাধপ্রবণতা, আইন-শৃংখলাহীনতা, অরাজকতা-অত্যাচার, আধুনিক যুদ্ধের অভূতপূর্ব বর্বরতা আর অনর্থক বিলাসিতায় প্রাকৃতিক ও মানবিক সম্পদের বিপুল অপচয়। বিত্ত-বৈভব, বস্ত্তগত আরাম-উপভোগ ও আত্মচরিতার্থতার সুযোগ সেখানে অবারিত কিন্তু আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উপবাস সেখানে অতি তীব্র। আর এটাই সেই তথাকথিত ‘অগ্রগতি’ আর ’শিক্ষা-সংস্কৃতি’র বাসত্মব ফলাফল!!
বইটি সাধারণ সচেতন পাঠক ছাড়াও বিশেষতঃ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য খুব প্রয়োজনীয়। কেননা পাঠ্যসূচীর পরিপূরক হিসাবে তাদেরকে প্রায়ই প্রাচ্যবিদ পন্ডিতদের লেখনী পড়তে হয়। আর অসচেতনতার কারণে তারা সহজেই তাদের অপপ্রচারণার ফাঁদে পড়ে বিভ্রামত্ম হয়। অনুবাদক আব্দুর রাকিব যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন বইটি সুখপাঠ্য করার। তবে কিছু স্থানে জটিলতা রয়ে গেছে যা পাঠকের জন্য ক্লামিত্মর কারণ হতে পারে।
[1]. প্রাচ্যবাদ মূলতঃ একটি পরিভাষা যা ব্যবহৃত হয় পাশ্চাত্য দার্শনিক, লেখক ও চিত্রকরদের প্রাচ্য সম্পর্কিত ধারণাকে বুঝানোর জন্য। অর্থাৎ তারা তাদের লেখা ও চিত্রের মাধ্যমে প্রাচ্যের ধর্মসমূহ, চিমত্মা-চেতনা, আচার-ব্যবহারকে যেভাবে চিত্রিত করেছেন তাকে প্রাচ্যবাদ হিসাবে অভিহিত করা হয়। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ’ নামে আলাদা বিভাগ রয়েছে। পরিভাষাটি ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ব্যবহৃত হওয়া শুরু হয় এবং শেষভাগে এসে এটি পূর্ণাঙ্গ একটি বিষয়ে রূপ নেয়।