করোনাকালে মানবসমাজের জীবনমান উত্তরণে করণীয়
মুহাম্মাদ যয়নুল আবেদীন
তওবা
মু’মিন জীবনের একটি অপরিহার্য বিষয়। তওবা ভুলেন কাফফরা স্বরুপ। ভুল বা পাপ
হয়ে গেলে তওবা করতে হয়। সুন্দর মানুষে পরিণত হওয়ার জন্য তওবার বিকল্প নেই।
আর বনু আদম তো ভুল করবেই এটাই স্বাভাবিক। কেননা, আমাদের আদি পিতা আদম (আঃ)
ভুল করেছিলেন। হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لَمَّا خَلَقَ اللَّهُ آدَمَ مَسَحَ ظَهْرَهُ فَسَقَطَ مِنْ ظَهْرِهِ كُلُّ نَسَمَةٍ هُوَ خَالِقُهَا مِنْ ذُرِّيَّتِهِ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَجَعَلَ بَيْنَ عَيْنَىْ كُلِّ إِنْسَانٍ مِنْهُمْ وَبِيصًا مِنْ نُورٍ ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى آدَمَ فَقَالَ أَىْ رَبِّ مَنْ هَؤُلاَءِ قَالَ هَؤُلاَءِ ذُرِّيَّتُكَ فَرَأَى رَجُلاً مِنْهُمْ فَأَعْجَبَهُ وَبِيصُ مَا بَيْنَ عَيْنَيْهِ فَقَالَ أَىْ رَبِّ مَنْ هَذَا فَقَالَ هَذَا رَجُلٌ مِنْ آخِرِ الأُمَمِ مِنْ ذُرِّيَّتِكَ يُقَالُ لَهُ دَاوُدُ. فَقَالَ رَبِّ كَمْ جَعَلْتَ عُمْرَهُ قَالَ سِتِّينَ سَنَةً قَالَ أَىْ رَبِّ زِدْهُ مِنْ عُمْرِى أَرْبَعِينَ سَنَةً. فَلَمَّا انْقَضَى عُمْرُ آدَمَ جَاءَهُ مَلَكُ الْمَوْتِ فَقَالَ أَوَلَمْ يَبْقَ مِنْ عُمْرِى أَرْبَعُونَ سَنَةً قَالَ أَوَلَمْ تُعْطِهَا ابْنَكَ دَاوُدَ قَالَ فَجَحَدَ آدَمُ فَجَحَدَتْ ذُرِّيَّتُهُ وَنَسِىَ آدَمُ فَنَسِيَتْ ذُرِّيَّتُهُ وَخَطِئَ آدَمُ فَخَطِئَتْ ذُرِّيَّتُهُ.
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যখন আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করলেন তখন তিনি তার পিঠ মাসেহ করলেন। এতে তাঁর পিঠ থেকে তাঁর সমস্ত সন্তান বের হ’ল, যাদের তিনি ক্বিয়ামত পর্যন্ত সৃষ্টি করবেন। তিনি তাদের প্রত্যেকের দুই চোখের মাঝখানে নূরের ঔজ্জল্য সৃষ্টি করলেন, অতঃপর তাদেরকে আদম (আঃ)-এর সামনে পেশ করলেন। আদম (আঃ) বললেন, হে প্রভু! এরা কারা? আল্লাহ বললেন, এরা তোমার সন্তান। আদমের দৃষ্টি তার সন্তানদের একজনের উপর পড়লো যার দুই চোখের মাঝখানে ঔজ্জল্যে তিনি বিস্মিত হ’লেন। তিনি বললেন, হে আমার প্রভু! ইনি কে? আল্লাহ তা‘আলা বললেন, শেষ যামানার উম্মাতের অন্তর্গত তোমার সন্তানদের একজন। তার নাম দাউদ (আঃ)। আদম (আঃ) বললেন, হে আমার রব! আপনি তাঁর বয়স কত নির্ধারণ করেছেন? আল্লাহ বললেন, ষাট বছর। আদম (আঃ) বললেন, পরোয়ারদিগার! আমার বয়স থেকে চল্লিশ বছর কেটে তাকে দাও। আদম (আঃ)-এর বয়স শেষ হয়ে গেলে তাঁর নিকট মালকুল মাউত (আযরাইল) এসে হাযির হন। আদম (আঃ) বললেন, আমার বয়সের কি আরো চল্লিশ বছর অবশিষ্ট নেই? তিনি বললেন, আপনি কি আপনার সন্তান দাউদকে দান করেননি? রাসূল (ছাঃ) বলেন, আদম (আঃ) অস্বীকার করলেন, তাই তার সন্তানরা অস্বীকার করে থাকে। আদম (আঃ) ভুলে গিয়েছিলেন, তাই তাঁর সন্তানদেও ক্রটি-বিচ্যুতি হয়ে থাকে’।[1] প্রত্যেক আদম সন্তান ভুলকারী। আর রাসূল (ছাঃ) অন্যত্র বলেন,كُلُّ ابْنِ آدَمَ خَطَّاءٌ وَخَيْرُ الْخَطَّائِينَ التَّوَّابُونَ. ‘তারাই উত্তম ভুলকারী যারা তওবা করে’।[2] কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তওবার ফযীলত সম্পর্কে জানেনা। কেউ ফযীলত সম্পর্কে জানলেও এর পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত নয়। আবার কেউ কিভাবে শুরু করবে সেটা বুঝতে পারেনা। নিম্নে তওবার প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব ও পদ্বতি সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল।
প্রিয় পাঠক! আমরা প্রত্যেকেই পাপকারী, কেউই ভুলের উর্ধ্বে নই। আমরা বারবার আল্লাহর ইবাদতে মনোনিবেশ করি, আবার তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেই। এরপর আমরা পুনরায় আল্লাহর মুখাপেক্ষী হই। অতঃপর প্রবৃত্তি আমাদের উপর জয় লাভ করে। আমরা কেউই সর্বদা পাপমুক্ত থাকতে পারিনা। কারণ ভুল করা মানুষের স্বভাব। কিন্তু আল্লাহ বান্দাদের প্রতি ক্ষমাশীল ও করুণাময়। তিনি মানুষের জন্য সর্বদা তওবার দরজা খোলা রেখেছেন। যাতে মানুষ তার ভুল সংশোধন ও নাজাত লাভ করতে পারে।
তওবা : তওবা অর্থ প্রত্যাবর্তন, পরিভাষায় তওবা বলা হয় আল্লাহর অবাধ্যতা ও অপসন্দনীয় কাজ সমূহ ত্যাগ করে, আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর পসন্দনীয় কর্মে মনোনিবেশ করা। অর্থাৎ কুরআন হাদীছে বর্ণিত আদেশ ও নিষেধসমূহের যথাযথ বাস্তবায়ন করা। আল্লাহর ভয়ে পাপ বর্জন করা ও তাকেই একমাত্র ভরসাস্থল মনে করা। তওবাকারী খালেছ নিয়তে ক্ষমা প্রার্থনা করলেই মহান আল্লাহ ক্ষমা করেন। যেমন আল্লাহ বলেন: وَإِنِّي لَغَفَّارٌ لِمَنْ تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا ثُمَّ اهْتَدَى ‘আর আমি অবশ্যই ক্ষমাশীল ঐ ব্যক্তির প্রতি, যে (শিরক হ’তে) তওবা করে এবং (আল্লাহর উপরে) ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে। অতঃপর আমৃত্যু সৎপথে অবিচল থাকে’ (ত্বোয়াহা ২০/৮২)।বরং আল্লাহ সর্বদা তার বান্দাদেরকে তওবা করার প্রতি আহববান করেন। তিনি তওবাকারীর সকল পাপ ক্ষমা করেন। যদিও তা সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ হয়। যেমন আল্লাহ বলেন: قُلْ يَاعِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ ‘বল, হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করে দিবেন। তিনি তো ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (যুমার ৩৯/৫৩)।
তওবা আসলে কি? তওবা হ’ল আল্লাহর অপসন্দনীয় গোপন ও প্রকাশ্য কৃত যাবতীয় কথা ও কর্মকে পরিহার করে প্রকাশ্যে ও নির্জনে আল্লাহর সন্তুষ্টিচিত্ত্বে তার পসন্দনীয় আমল সমূহ করা যা ইসলামী শরী‘আত ও ঈমানের হাক্বীক্বত। তওবা হ’ল হতাশা-নিরাশা মুক্ত হেদায়াত। তওবা সফলতা ও কল্যাণের এমন প্রসবণ বান্দার অগ্রগতি, উন্নতি, জীবনের প্রথম ও শেষ ইহকালীন-পরকালীন যাবতীয় মুক্তির শেষ মনযিল। শুধু তাই নয়, তওবা হ’ল আল্লাহর ভয়ে পাপ অপসন্দ করা ও তা বর্জন করা। মোদ্দা কথা হ’ল পাপে অনুশোচনা ও পাপের মন্দ দিকটি বুঝতে পারা যাতে তার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
কেন তওবা করব? এখন প্রশ্ন হ’তে পারে, কেন তওবা করব পাপ কাজেই তো আনন্দ অনুভব করি, কেন আমি সিগারেট ত্যাগ করব তাতে আমি আরাম পাই। কেন দাড়ি কাটব না। এতে আমি স্বস্তি লাভ করি। কেন নারীদের দিকে নযর দেওয়া থেকে বিরত থাকব। এটা তো আমাকে আনন্দ দেয়। আর এটা কি মানানসহ নয় যে, মানুষ যাতে আনন্দ ও স্বস্তি লাভ করে তাই করবে। জান্নাত পিয়াসী মুমিনকে মনে রাখতে হবে, পাপে আনন্দ পাওয়া আর জাহান্নামকে অবধারিত করে নেওয়া কোন মুমিন-মুসলমানের বৈশিষ্ট্য হ’তে পারেনা। কেনন হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم الدُّنْيَا سِجْنُ الْمُؤْمِنِ وَجَنَّةُ الْكَافِرِ. ‘দুনিয়া মুমিনের জেলখানা এবং কাফেদের জন্য বেহেশতখানা’।[3]
তওবা করার কারণগুলো নিম্নরূপ :
(১) আল্লাহ তা‘আলার আদেশ মান্য করাঃ আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা তওবা করার আদেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَصُوحًا عَسَى رَبُّكُمْ أَنْ يُكَفِّرَ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ يَوْمَ لَا يُخْزِي اللَّهُ النَّبِيَّ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ نُورُهُمْ يَسْعَى بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَبِأَيْمَانِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَتْمِمْ لَنَا نُورَنَا وَاغْفِرْ لَنَا إِنَّكَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ-
‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তওবা কর বিশুদ্ধ তওবা। নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের পাপসমূহ মোচন করে দিবেন এবং তোমাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। যার তলদেশ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত হয়। যেদিন আল্লাহ স্বীয় নবী ও তার ঈমানদার সাথীদের লাঞ্ছিত করবেন না। তাদের জ্যোতি তাদের সামনে ও ডাইনে ছুটাছুটি করবে। তারা বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের জ্যোতিকে পূর্ণ করে দিন এবং আমাদের ক্ষমা করুন। নিশ্চয়ই আপনি সবকিছুর উপরে সর্ব শক্তিমান’ (তাহরীম ৬৬/৮)। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তার আদেশ ও নিষেধকে যথাযথভাবে মান্য করা।
(২) দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা লাভ ঃ মহান আল্লাহ বলেন,
وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَى جُيُوبِهِنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوْ آبَائِهِنَّ أَوْ آبَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَائِهِنَّ أَوْ أَبْنَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي أَخَوَاتِهِنَّ أَوْ نِسَائِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ أَوِ التَّابِعِينَ غَيْرِ أُولِي الْإِرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ أَوِ الطِّفْلِ الَّذِينَ لَمْ يَظْهَرُوا عَلَى عَوْرَاتِ النِّسَاءِ وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِنْ زِينَتِهِنَّ وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ-
‘আর তুমি মুমিন নারীদের বলে দাও, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থান সমূহের হেফাযত করে। আর তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। তবে যেটুকু স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ পায় সেটুকু ব্যতীত। আর তারা যেন তাদের মাথার কাপড় বক্ষদেশের উপর রাখে (অর্থাৎ দু’টিই ঢেকে রাখে)। আর তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, নিজ পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগিনীপুত্র, নিজেদের বিশ্বস্ত নারী, অধিকারভুক্ত দাসী, কামনামুক্ত পুরুষ এবং শিশু যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অবহিত নয়, তারা ব্যতীত। আর তারা যেন এমন ভাবে চলাফেরা না করে যাতে তাদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়। আর হে মুমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর দিকে ফিরে যাও যাতে তোমরা সফলকাম হ’তে পার’ (নূর ২৪/৩১)। কখনো প্রশান্ত চিত্ত হ’তে পারেন যতক্ষণ না অন্তর আত্মা পাপ বিমুক্ত না হয়।
(৩) আল্লাহর ভালোবাসা লাভঃ মহান আল্লাহ বলেন,
أَمَرَكُمُ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ -
‘তখন আল্লাহর নির্দেশ মতে তোমরা তাদের নিকট গমন কর। নিশ্চয় আল্লাহ তওবাকারীদের ভালবাসেন ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন’ (বাক্বারাহ ২/২২২)। বান্দার উপায় নেই তাঁর প্রতিপালকের শান-মান জেনেও তাঁর নিকট তওবা না করা।
(৪) জান্নাতে প্রবেশ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভঃ
মহান আল্লাহ বলেন,
فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُوا الصَّلَاةَ وَاتَّبَعُوا الشَّهَوَاتِ فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيًّا-إِلَّا مَنْ تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا فَأُولَئِكَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ وَلَا يُظْلَمُونَ شَيْئًا-
‘তাদের পরে এলো তাদের অপদার্থ উত্তরসুরীরা। তারা ছালাত বিনষ্ট করল ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করল। ফলে তারা অচিরেই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে কিন্তু তারা ব্যতীত যারা তওবা করেছে এবং ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি কোনরূপ যুলুম করা হবে না’ (মারিয়াম ১৯/৫৯-৬০)। মানুষের মূল টার্গেট হওয়া উচিৎ জান্নাত লাভ।
(৫) ধন সম্পদ এবং সন্তান-সন্ততিতে বরকত লাভ ঃ মহান আল্লাহ বলেন,
فَقُلْتُ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ إِنَّهُ كَانَ غَفَّارًا- يُرْسِلِ السَّمَاءَ عَلَيْكُمْ مِدْرَارًا-وَيُمْدِدْكُمْ بِأَمْوَالٍ وَبَنِينَ وَيَجْعَلْ لَكُمْ جَنَّاتٍ وَيَجْعَلْ لَكُمْ أَنْهَارًا-
‘আমি তাদের বলেছি, তোমরা তোমাদের প্রভুর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর, নিশ্চয়ই তিনি অতীব ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের জন্য আকাশ থেকে প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। তিনি তোমাদের মাল-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দিবেন এবং তোমাদের জন্য বাগিচাসমূহ রচনা করবেন ও নদীসমূহ প্রবাহিত করবেন’ (নূহ ৭১/১০-১২)।
(৬) পাপকাজের কাফফা্রা হওয়া এবং তা সৎ কাজে বদল হওয়া ঃ
মহান আল্লাহ বলেন,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَصُوحًا عَسَى رَبُّكُمْ أَنْ يُكَفِّرَ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ يَوْمَ لَا يُخْزِي اللَّهُ النَّبِيَّ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ نُورُهُمْ يَسْعَى بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَبِأَيْمَانِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَتْمِمْ لَنَا نُورَنَا وَاغْفِرْ لَنَا إِنَّكَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ-
‘হে মু‘মিনগণ তোমরা আল্লাহর কাছে আন্তরিকভাবে তওবা কর। আশা করা যায়, তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মন্দ কর্মসূমহ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার তলদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত’ (তাহরীম ৬৬/ ৮)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
إِلَّا مَنْ تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ عَمَلًا صَالِحًا فَأُولَئِكَ يُبَدِّلُ اللَّهُ سَيِّئَاتِهِمْ حَسَنَاتٍ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا-
‘কিন্তু যারা তওবা করে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎ আমল করে আল্লাহ তাদের পাপসমূহকে পূণ্য দ্বারা পরিবর্তন করে দিবেন। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (ফুরকান ২৫/ ৮০)। উল্লেখ্য যে, এ কয়েকটি ফযীলতই শেষ নয় এ ছাড়া তওবার আরও অনেক গুরুত্ব রয়েছে। সুতরাং কেন আমরা আল্লাহর অবাধ্য হয়ে নিজের উপর যুলুম করব।
কিভাবে তওবা করব?
এখন যদি বলা হয় আমার অন্তর অনুতপ্ত হয়েছে। আমি তওবা করে সৃষ্টিকর্তার দিকে ফিরে যেতে চাই। প্রবৃত্তি অনুসরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মানতে চাই। কিন্তু আমি জানিনা কিভাবে তওবত করব। আর এটা অধিকাংশ মানুষের সমস্যা। তাহ’লে উত্তর হবে এটা খুব সহজ পদ্ধতি। কেননা আল্লাহ যখন কোন বান্দার জন্য কল্যাণ চান তখন তার জন্য তা সহজ করে দেন। তওবা কবুলের দিক-নির্দেশনামূলক কিছু পরামর্শ নিম্নে তুলে ধরা হলো।
(১) খাঁটি নিয়ত ও একনিষ্ঠ তওবা করাঃ
বান্দা যখন একনিষ্ঠ হয়ে প্রভুর দিকে প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা করে। আল্লাহ তাকে শক্তি দিয়ে সাহায্য করেন এবং তার পথে আসন্ন বিপদসমূহ সরিয়ে দিয়ে তার তওবার পথকে সুপ্রসন্ন করেন। আর যে আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ হয় না। সে শয়তানের কুমন্ত্রণায় প্রভাবিত হয়। আর তার অন্তরে অন্যায়- অশ্লীলতার কামনা-বাসনা উঁকি দিতে থাকে। যা আল্লাহ ব্যতিত কেউ জানেনা। যেমন আল্লাহ ইউসুফ (আঃ)-এর ব্যাপারে বলেন, وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِ وَهَمَّ بِهَا لَوْلَا أَنْ رَأَى بُرْهَانَ رَبِّهِ كَذَلِكَ لِنَصْرِفَ عَنْهُ السُّوءَ وَالْفَحْشَاءَ إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُخْلَصِينَ ‘উক্ত মহিলা তার বিষয়ে কুচিন্তা করেছিল এবং সেও তার প্রতি কল্পনা করত যদি না সে স্বীয় পালনকর্তার প্রমাণ অবলোকন করত। এভাবেই এটা একারণে যাতে আমরা তার থেকে যাবতীয় মন্দ ও অশ্লীল বিষয় সমূহ সরিয়ে দেই। নিশ্চয়ই সে ছিল আমাদের মনোনীত বান্দাগণের অন্তর্ভুক্ত’ (ইউসুফ ১২/২৪)।
(২) আত্মসমালোচনা করা ঃ
নিশ্চয় অন্তরের হিসাব রক্ষণা-বেক্ষণা কল্যাণের নাগাল পেতে সাহায্য করে এবং অকল্যাণ থেকে দূরে রাখে। আর চলে যাওয়া সময়ের অনুভূতি জাগায় যা মানুষকে তাওবা করতে সহযোগিতা করে ও তওবার পরবর্তী জীবন সুন্দর ও সাফল্যমন্ডিত করে। মহান আল্লহ বলেন,
اقْرَأْ كِتَابَكَ كَفَى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيبًا-
‘(সেদিন আমরা বলব,) তুমি তোমার আমলনামা পাঠ কর। আজ তুমি নিজেই নিজের হিসাবের জন্য যথেষ্ট’(বনু ইস্রাইল ১৭/১৪)।
(৩) অন্তরকে উপদেশ দেওয়া, ভয় ও ভৎর্সনা করা :
তাকে বলা হে অন্তর! মৃত্যুর পূবে তওবা কর। আর মৃত্যুর অকস্মাৎ ঘটে। তাকে অন্যদের মৃত্যুর কথা স্বরণ করিয়ে দেওয়া ও সাথে সাথে মৃত্যু নির্ধারিত ও চিরন্তন সত্য এ কথার প্রতি দৃষ্টিপাত করানো। কবরই তোমার বাড়ী। মাটি তোমার বিছানা, পোকা-মাকড় তোমার সাথী, তুমি ভয় কর যে মালাকুল মাউত তোমার নিকট আসবেই, আর তুমি পাপাচারকে লিপ্ত থাকবে? তোমার সে সময়ের লজ্জানুভূতি কোন কাজে আসবে না। সে তোমার কান্না ও চিন্তা গ্রহণ করবেনা। অতঃএব তুমি আখেরাতকে ভয় কর। এভাবে তাকে উপদেশ প্রদান ও ভীতি প্রদর্শন করা যতক্ষণ না অন্তর তওবা না করে। ওছমান (রাঃ) কবর দেখলেই কেঁদে অস্থির হয়ে যেতেন। কেননা রাসূর (ছাঃ) বলেন,مَا رَأَيْتُ مَنْظَرًا قَطُّ إِلاَّ وَالْقَبْرُ أَفْظَعُ مِنْهُ. ‘আমি কখনও এমন কোন দৃশ্য অবলোকন করিনি যার তুলনায় কবর অধিক ভয়ংকর নয়’।[4]
(৪) পাপাচারের স্থান থেকে দূরে অবস্থান করা :
আর তা হচ্ছে ঐ স্থান পরিত্যাগ করা যেখানে তুমি আল্লাহর অবাধ্য হয়েছিলে এটা তোমাকে তাওবা করতে সাহায্য করবে। যেমন একজন ব্যক্তি নিরানববই জন মানুষকে হত্যা করেছিলেন, অতঃপর জনৈক আলেম তাকে বলেছিলেন, নিশ্চয় তোমার গোত্র একটি মন্দ গোত্র। আর আল্লাহর যমীনে অমুক অমুক গোত্র ভালো রয়েছে। তুমি সেখানে যাও এবং তাদের সাথে ইবাদত কর। মহান আল্লাহ বলেন, فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ- وَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ-‘অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা সে দেখতে পাবে। আর কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও সে দেখতে পাবে’ (যিলযাল ৯৯/৭-৮)।
(৫) মন্দ বন্ধু গ্রহণ হ’তে বিরত থাকা :
নিশ্চয় মানুষ তার বন্ধুর স্বভাবে প্রভাবিত হয়। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন,
الرَّجُلُ عَلَى دِينِ خَلِيلِهِ فَلْيَنْظُرْ أَحَدُكُمْ مَنْ يُخَالِلُ
‘মানুষ তার বন্ধুর ধ্যান-ধারণার অনুসারী হয়ে থাকে। সুতরাং তোমাদের সকলেরই খেয়াল রাখা উচিত সে কার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করছে’।[5]
(৬) পাপের শাস্তি সর্ম্পকে চিন্তা করা :
যখন কোন বান্দা জানে যে নিকৃষ্ট পাপ সমূহ কঠিন শাস্তিযোগ্য; এবং এর থেকে প্রত্যাবর্তন জান্নাত পাওয়ার জন্য যরূরী। তখন অন্তর সহজে পরির্বতন হবে। অবশেষে আল্লাহর দিকে ফিরে যাবে।
(৭) অন্তরকে জান্নাতের আশা ও জাহান্নামের ভয় দেখানো :
জান্নাতের মহান মান-মর্যাদা শান-শওকাত সর্ম্পকে অন্তকে বুঝানো যা আল্লাহর আনুগত্যের মধেই নিহিত রয়েছে। আর জাহান্নাম এক ভয়াবহ ব্যাপার যা অবাধ্য ও যালেমদের জন্য প্রস্ত্তত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
تَتَجَافَى جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَطَمَعًا وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ-
‘যারা (রাত্রির বেলায় শয্যাত্যাগ করে (তাহাজ্জুদের ছালাতে) তাদের প্রভুকে ডাকে ভয় ও আকাংখার সাথে এবং আমরা তাদের যে রিযিক দিয়েছি, তা থেকে (আল্লাহর পথে) ব্যয় করে’(সাজদাহ ৩২/১৬)।
(৮) সর্বদা সৎ কাজে ব্যস্ত থাকা :
নিশ্চয় অন্তর এমন একটি জিনিস যা সৎ কাজে ব্যস্ত না রাখলে অসৎ কাজে জড়িয়ে পড়বে। আর অবসর মানুষকে শয়তানের ধোঁকায় পতিত করে। ফলে সে খারাপ কাজে লিপ্ত হয়। এজন্য কথায় বলে, ‘অলস মস্তিষ্কে শয়তানের বাস’। মহান আল্লাহ বলেন, فَإِذَا فَرَغْتَ فَانْصَبْ- وَإِلَى رَبِّكَ فَارْغَبْ- ‘অতএব যখন অবসর পাও, ইবাদতের কষ্টে রত হও। এবং তোমার প্রভুর দিকে রুজূ হও’ (শরহ ৯৪/৭-৮)।
(৯) প্রবৃত্তি দমন করা :
বান্দার জন্য প্রবৃত্তির অনুসরণ করা উচিত নয়। এজন্য আল্লাহ বলেন,أَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ أَفَأَنْتَ تَكُونُ عَلَيْهِ وَكِيلًا ‘আপনি কি তাকে দেখননি? যে তার প্রবৃত্তিকে উপাস্য রূপে গ্রহণ করেছে। তবু কি আপনি তার যিম্মাদার হবেন? (ফুরকান ২৫/৪৩)। অর্থাৎ আল্লাহ প্রবৃত্তির অনুসরণকারীর দায়িত্ব নিবেন না।
(১০) তওবা করে পাপের পুনরাবৃত্তি না করা :
ততক্ষণ পর্যন্ত তওবা কবুল হবে না যতক্ষণ তার নিয়তে উক্ত কর্মের পুনরাবৃত্তি করার আকাঙ্খা অবশিষ্ট থাকবে, তওবা করতে হবে যেন পুনরায় উক্ত কাজে লিপ্ত হওয়ার আকাঙ্খা না থাকে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَ يُلْدَغُ الْمُؤْمِنُ مِنْ جُحْرٍ وَاحِدٍ مَرَّتَيْنِ . ‘মুমিন ব্যক্তি একই গর্তে দু’বার দংশিত হয় না’।[6]
(ক্রমশ)
[লেখক : কাদাকাটি, আশাশুনি, সাতক্ষীরা]
[1]. তিরমিযী হা/৩০৭৬; মিশকাত হা/১১৮।
[2]. ইবনু মাজাহ হা/৪২৫১; মিশকাত হা/২৩৪১।
[3]. ইবনু মাজাহ হা/৪১১৩; মিশকাত হা/৫১৫৮।
[4]. তিরমিযী হা/২৪৭৮; মিশকাত হা/১৩২।
[5]. তিরমিযী হা/২৩৭৮; মিশকাত হা/৫০১৯।
[6]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫০৫৩।