সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেটে তিনদিন

মুকাররম বিন মুহসিন 9129 বার পঠিত

প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর সিলেট ভ্রমণের ইচ্ছা ছিল বহুদিন থেকে। কিন্তু সময়-সুযোগের অভাবে তা যেন হয়ে উঠছিল না। হঠাৎ করেই আমাদের প্রিয় মারকায ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী’, নওদাপাড়া থেকে বাৎসরিক শিক্ষা সফরের স্থান নির্ধারণ করা হল সেই কাঙ্খিত স্বপ্নভূমি সিলেট। এ সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া না করে সফরের প্রস্ত্ততি শুরু করলাম।

যাত্রা : ৯ই ফেব্রুয়ারী’১০ মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১০ টায় আমাদের গাড়ি মাদরাসা প্রাঙ্গণ থেকে রওনা দেয়। যাত্রার পূর্ব মুহূর্তে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর মুহতারাম আমীর প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব এক সংক্ষিপ্ত বৈঠকে ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে উপদেশ ও পরামর্শমূলক বক্তব্য রাখেন। সফর পরিচালনায় ছিলেন মারকাযের সম্মানিত স্যার জনাব শামসুল আলম। তার সহযোগিতায় ছিলেন মারকায শিক্ষক শফীকুল ইসলাম এবং ইমামুদ্দীন। খাবার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে  মোযাম্মেল ও শের আলী ভাইসহ সর্বমোট প্রায় ৭০ জন যাত্রী নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হল। মাঘের তীব্র শীত তখন প্রায় যাই যাই করছে। বসমেত্মর আমেজ শুরু হতে যাচ্ছে প্রকৃতিতে। চমৎকার আবহাওয়া, ঘুম, ভ্রমণের আনন্দ সবকিছু মিলিয়ে এক উপভোগ্য রাত্রি কাটিয়ে নরসংদীর কাছাকাছি এক এলাকায় সকালের নাশতা সেরে নিলাম।  মাঝে গাজীপুরে ফজরের ছালাত আদায় করে নিয়েছিলাম। আবার যাত্রা শুরু হল। প্রকৃতির অসাধারণ সৌন্দর্যে গা এলিয়ে সিলেটের পথে দীর্ঘ যাত্রা অব্যাহত থাকল। মাইকে বেজে চলেছে আমীরে জামাআতের বক্তৃতা, কখনো আল-হেরার উজ্জীবনী সুর। উচ্ছ্বসিত হৃদয়ে সিলেটের মাটিতে যখন পা দিলাম তখন দিনমণি মধ্যগগণে প্রায় পৌঁছে গেছে। শিডিউল টাইমের অনেক পরে পৌছানোয় শহরে  অপেক্ষা না করে রওয়ানা হলাম দেশের পূর্বাঞ্চলীয় একমাত্র সীমামত্ম বর্ডার তামাবিলের পার্শ্ববর্তী অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি জাফলং-এর উদ্দেশ্যে। দু’ঘন্টাবাদেই সীমামত্মপারের অধরা কৃষ্ণকায় বিশাল পাহাড়কে ছোঁয়ার প্রতিযোগিতা করতে করতে পৌছে গেলাম গমত্মব্যপানে। মেঘের কোলে পাহাড়ী শয্যাকে পাশে রেখে নিঃশব্দে অপরিমেয় সম্পদ নিয়ে বহমান সুরমা নদীর কাঁচ সদৃশ স্বচ্ছ টলটলে সুনীল জলধারার মনোমুগ্ধকর কলরোল নিমিষেই যেন প্রাণবায়ু স্থির করে দিল। সামনে যেন কল্পনার জগৎ কত সৌন্দর্যপিয়াসীর বিস্ময়-বিমুগ্ধ দৃষ্টি, কত কবির হৃদয়হারী অভিব্যক্তি, যুগ যুগ ধরে বয়ে চলেছ হে স্রোতস্বীনী! কত সুন্দরই না তোমার সেই মহান স্রষ্ঠা যার হাতের ছোয়া কি অপরূপ সাজে সাজিয়েছেন তোমাকে! সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আযীম। নীচে নেমে আসলাম নদীর কূলে। লোভ সামলাতে না পেরে আমাদের অনেকেই গা ভাসিয়ে দিয়েছে শীতল অগভীর নদীর বুকে। নদীর স্থানে স্থানে অবাক করা দৃশ্য। স্বল্প জায়গায় কত লোক, কত ক্রেন, কত ট্রাক, কত নৌকা, কত পানির পাম্প কাজে লাগানো হচ্ছে তার যেন ইয়ত্তা নেই। বড়জোর ১০০ বর্গগজের মধ্যে কাজ করছে প্রায় শতাধিক শ্রমিক। অল্প পানি ও বালির মধ্য থেকে তারা প্রতিনিয়ত পাথর উত্তোলন করছে। কেউ নিচ থেকে উঠাচ্ছে, কেউ বহন করছে, ট্রাক ভর্তি করছে, কেউ পানির পাম্পের কাছে আছে। মাছ শিকারের মত নৌকা থেকে জাল ফেলে পাথরও যেন শিকার করা হচ্ছে। সেখান থেকে নৌকায় চড়ে সীমামেত্মর কাছাকাছি গেলাম। পাথরের স্তূপ পাড়ি দিয়ে বর্ডার ক্যাম্পের নিকটবর্তী হলাম। পরবর্তী ধাপ ফেললেই ভারত। দু’পাশে দুদেশের প্রহরা ক্যাম্প। ভারতেই নদীটির উৎপত্তি স্থল। ভারত অংশের চমৎকার দৃশ্য আমাদেরকে মুগ্ধ করল। দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে নদী বয়ে গেছে। আর একটি ঝুলন্ত ব্রীজ পাহাড়দ্বয়কে সংযুক্ত করেছে। পানি বেশী স্বচ্ছ হওয়ার কারণে পানির ৫/৭ ফুট নিচের সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হাটু পানিতে পাথরের উপরে কিছুক্ষণ হাটাহাটি করতেই পানির শীতলতা আমাদের স্থান ত্যাগে বাধ্য করল। স্থানীয়দের সাথে আলাপচারিতায় জানা গেল যে, বর্ষাকাল ছাড়া সারা বছর এখানে পাথর আহরণ চলে। নদীর তলদেশ খুড়ে পাথর উঠান হয় বলে বড় বড় গর্তে নদী এলাকা সম্পূর্ণ এবড়ো থেবড়ো হয়ে যায়। অতঃপর বর্ষাকালে পাহাড়ী ঢল আসায় বন্যার সৃষ্টি হয় এবং সমস্ত গর্ত পুণরায় পাথরে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। তারপর আল্লাহর অসীম কুদরতে সেগুলোর আকার বৃদ্ধি পেতে থাকে। বর্ষাকাল শেষ হওয়ার পর নদীর পানি যখন শুকিয়ে আসতে শুরু করে তখন বড় বড় পাথর নদীর তলদেশ খুড়ে তোলা হয়। সেখান থেকেই দেখলাম সীমানা ঘেঁষে যাওয়া ইন্ডিয়ার বিশাল পাহাড়গুলো এবং পাহাড়ী গ্রামসমূহ। সেখানে একটি ঝুলমত্ম পাথর রয়েছে। প্রকান্ড এই পাথরটি পাহাড়ের উপর বিপরীত দিকে এমনভাবে হেলে আছে যেন এখনি নিচে পড়ে যাবে। ঝুলমত্ম পাহাড় নামকরণ এজন্যই। অতঃপর পাশ্ববর্তী পাথর ভাঙা কারখানাগুলি পরিদর্শন শেষে বিকাল পাঁচটার দিকে আমরা ফিরে আসলাম আমাদের রান্নার আয়োজনস্থলে। ক্লামত্ম ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় শের আলী ও মোযাম্মেল ভাইয়ের সুস্বাদু রান্না গোগ্রাসে খেয়ে নিলাম। এবার ফিরতি যাত্রা। পার্শ্ববর্তী তামাবিল জিরো পয়েন্টের উদ্দেশ্য রওনা হলাম। এ এলাকায় শুধু কয়লা আর কয়লা যার সবই ভারত থেকে আমদানীকৃত। সেখানে পৌঁছে বিডিআর ক্যাম্পে জওয়ানদের সাথে দেখা হল উভয় সিমামেত্ম বিডিআর-বিএসএফ এর সতর্ক প্রহরা। সেখানে জওয়ানদের সাথে কথা বলে আমাদের বেশ ভাল লাগল। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তাদের দৃঢ় মানসিকতায় খুব উৎসাহবোধ করলাম। আমাদের রাত্রি যাপনের জন্য ব্যবস্থা ছিল জৈন্তাপুর থানার আহলেহাদীছ অধ্যুষিত গ্রাম সেনগ্রামে। মেইন রোড ছেড়ে সাবওয়ে ধরে যেতে যেতে গ্রামে পৌছানোর ২ কি.মি. পূর্বে একটি বরই গাছের ডালে আটকে গেল আমাদের বাসটি। তাই অনেকটা রাস্তা আমাদের হাঁটতে হল। যাইহোক স্থানীয় দাখিল মাদরাসায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল। সেখানে পেঁŠছে মাদরাসা সুপার জনাব ফয়যুল ইসলামসহ অন্যান্য শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারীদের গভীর আন্তরিকতা ও ভালবাসা আমাদেরকে মুগ্ধ করল। অচেনা-অপরিচিত মানুষগুলো আমাদেরকে এভাবে গ্রহণ করবেন তা আমরা ভাবিনি। যাইহোক খাওয়া-দাওয়া, ছালাত আদায়ের পর সারাদিনের ক্লামিত্মতে আমরা গভীর ঘুমে হারিয়ে গেলাম।

পরদিন ভোরে সেনগ্রাম মাদরাসা ও স্কুলের সম্মানিত প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি জনাব শফিকুল ইসলাম মাষ্টার আমাদের আগমনের খবর শুনে ছুটে আসেন এবং কুশল বিনিময় করেন। গতরাতে আটকে পড়া গাড়ির খবর শুনে তিনি নিজে উপস্থিত থেকে গাছটি কাটিয়ে গাড়িটি মাদরাসা প্রাঙ্গনে আনার ব্যবস্থা করেন।  

দেশের অন্য প্রামেত্মর শেষ সীমানায় যেখানে তাওহীদ-সুন্নাতের অনুসারীর সংখ্যা অতি বিরল সেখানে একটি আহলেহাদীছ গ্রাম পেয়ে আমরা অভিভূত হয়েছিলাম। যে সিলেটকে শিরক-বিদ‘আতের আড্ডাখানা হিসাবেই জানি তারই এক প্রামেত্ম তাওহীদ ও সুন্নাতের জীবমত্ম স্বাক্ষর হয়ে গ্রামটি আজও তার অসিত্মত্বের জানান দিচ্ছে, এ দৃশ্য আমাদের হৃদয়মনে পরিতৃপ্তির সুবাতাস বইয়ে দিচ্ছিল। সর্বোপরি তাদের আলাপচারিতা, মেহমানদারী ইত্যাদিতে আমরা এত আনন্দ ও স্বস্তি পেয়েছিলাম যে, তার প্রশংসায় কিছু বলতে চেয়েও মুখ ফুটে কিছু বের করতে পারিনি। আজকে এই কলমের অাঁচড়ে তাদেরকে গভীরভাবে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি ও তাদের জন্য আন্তরিক প্রার্থনা করছি- আল্লাহ তাদের উত্তম প্রতিদান দিন এবং কিয়ামত পর্যমত্ম তাদেরকে হেদায়েতের পথে টিকিয়ে রাখুন। আমীন! সেখানে গিয়ে বুঝতে পারলাম, তাওহীদের ডাক তথা কুরআন-সুন্নাহর আহবান কত সুমধুর। হাবলুল্লাহর পতাকাতলে একত্রিত হওয়ার মাহাত্ম্য টের পেলাম আরো একবার।

হরিপুর গ্যাসফিল্ড : সকাল ৮ টা নাগাদ আমরা হরিপুর গ্যাসফিল্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে পথিমধ্যে জৈন্তাপুরের হীরা বিবির রাজবাড়ীতে যাত্রাবিরতি করলাম। সেখান থেকে আরো ১৫/২০ মিনিটের পথ অতিক্রম করে পৌঁছলাম হরিপুর গ্যাসফিল্ড এলাকায়। বিশাল এলাকা, চারিদিকে পাহাড়-টিলা, গাছ-পালা, সবুজে ঘেরা বৈচিত্র্যময় এলাকা হরিপুর। মাটির নিচ গ্যাসে পরিপূর্ণ হওয়ায় চারিদিকে গ্যাসের আলামত। একটি পাহাড় দেখলাম যার স্থানে স্থানে গ্যাসীয় আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছে। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই প্রায় ১ বিঘা আয়তনের একটি ছোট পুকুর দেখলাম, যার মধ্য থেকে অবিরাম ধারায় বুদ বুদ করে গ্যাস উত্থিত হচ্ছে। পানির উপর গ্যাস ফেনার মত হয়ে আছে। যার উপর জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি নিক্ষেপ করলে আগুন জ্বলে উঠছে। লোকমুখে জানলাম, এই পুকুরটার কোন তলা খুঁজে পাওয়া যায় না যদিও অস্বাভাবিক কিছু নজরে পড়ল না। তবে পুকুরে কোন জীবনের অস্তিত্ব নেই। ইতিপূর্বে গ্যাস উঠানো হত এমন একটি জায়গায় দেখলাম অল্প অল্প আগুন বের হচ্ছে। যা প্রায় ৭ বছর থেকে জ্বলছে। আমাদের মধ্যে যারা ইতিপূর্বে সিলেট এসেছে কিন্তু হরিপুর দেখেনি, তাদের কাছে এটাই ছিল সিলেট সফরের স্বার্থকতা। জৈমত্মাপুর মাদরাসার সুপার জনাব ফয়যুল ইসলাম এ সময় আমাদের সাথে উপস্থিত থেকে পুরো এলাকা ঘুরিয়ে দেখান।

সিলেট শহর : গ্যাসক্ষেত্র দেখে আমরা রওনা দিলাম সিলেট শহরের দিকে। প্রথমেই গেলাম শাহজালাল (রহ.)-এর ভাগ্নে শাহপরাণ (রহ.)-এর মাযার দর্শনে। সেখানে পূর্ব থেকেই আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন সিলেটের তাসলীম ভাই ও সজীব ভাই। যেলা ‘আন্দোলনে’র সাবেক সভাপতি জনাব আব্দুস সবুর ভাই কোন কাজে ঢাকা অবস্থান করায় এই দু’ভাইকে আমাদেরকে ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য সাথী করে দেন। মাযারে গিয়ে দেখলাম আজব দৃশ্য। প্রায় ৩৫ ফুট মত উঁচু জায়গায় তাঁর কবর। সেখানে মানুষ সিজদা করছে, ছালাত আদায় করছে, দোয়ার মাধ্যমে তাদের কামনা-বাসনা প্রকাশ করছে, সন্তান চাচ্ছে ইত্যাদি আরো কত কি! একদল মানুষ দান করার জন্য সবাইকে অবিরাম আহবান করে চলেছে। কবরের ঘেরার মধ্যে লাখ লাখ টাকার ছড়াছড়ি, মোমবাতি, আগর বাতির স্তূপ দেখে বিস্মিত হলাম। সাথে সাথে খাদেমদের আয়ের কথা চিন্তা করে হতবাক হলাম। অসীলা পূজার মাধ্যমে সৌভাগ্য কামনায় মানুষের গভীর আন্তরিকতা দেখে জাহেলী যুগের মুশরিকদের অবস্থার কথা স্মরণ হল। ফিরে আসার সময় দেখলাম মানুষ কবরের সম্মানার্থে নামার সময় উল্টো হয়ে নামছে। কুসংস্কারচ্ছন্ন মানুষগুলির প্রতি বড়ই আফসোস হল আর নিজেকেও বড় ব্যর্থ মনে হ’ল এই ভেবে যে, আমরা হয়তো আমাদের দাওয়াতী দাায়িত্ব কিছুই পালন করছি না। 

এরপর আমাদের পরবর্তী গন্তব্য শাহজালাল (রহ.)-এর মাযারের দিকে অগ্রসর হলাম। দুই মাযারের মাঝে দূরত্ব ৩/৪ কি.মি.। সেখানে আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘের সাবেক কেন্দ্রীয় তাবলীগ সম্পাদক আবু তাহের ভাই ও হাম্মাদ ভাই। মাযারের বিশাল প্রাঙ্গনে প্রবেশ করে একটু ভিমরী খেলাম। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, ধনী-গরীব নির্বিশেষে কত কিসিমের মানুষের ভীড়। একপাশে উঁচু মিনার বিশিষ্ট মসজিদ। প্রাঙ্গনের প্রান্তে রয়েছে জালালী কবুতরদের বাসা, আরেকপাশে গজার মাছের পুকুর, টাকা-পয়সা, নযর-মানত প্রদানের স্থান। আরো রয়েছে জমজম কূপে সাথে সংযুক্ত বলে কথিত একটি পুকুর (নাউযুবিল্লাহ)। মূল মাযারে ঢুকে দেখলাম এলাহী কারবার। বিশাল এলাকা জুড়ে মূল কবরটি, একপাশে পীর সাহেবের উদ্দেশ্যে ছালাত আদায়ের স্থান, আরেকপাশে কুরআন পড়ার স্থান। একদল মানুষ কুরআন তেলাওয়াত করছে। কবরের প্রাচীরের পাশেই কয়েকজন অর্থ-কড়ি, নযর-নেওয়াজ প্রদানের জন্য সকলকে নির্দেশনা দিচ্ছে। আর কবরের চারপাশ ঘিরে বড় একদল মানুষ চরম আন্তরিকতা ও আধ্যাত্মিকতার সাথে পীর সাহেবের উদ্দেশ্যে নীচু স্বরে ক্রন্দনের সাথে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে নিজের চাওয়া-পাওয়ার কথা জানাচ্ছে। মাযারের পাশেই বিশাল কবরস্থান। বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ কিছু ব্যক্তির কবর এখানে রয়েছে। বর্তমানে যে কোন ব্যক্তিই ৫ লক্ষ টাকা দিয়ে নিজের কবরের স্থানটি এখানে ক্রয় করতে পারে। আফসোস! এই সম্মানিত ব্যক্তিরা হয়ত কোনদিনই তাঁদের অনুসারীদের এসব করতে বলে যাননি। কিন্তু তাঁদের মৃত্যুর পর মুরীদদের বাড়াবাড়ি রকম ভক্তি তাঁদেরকে যেমন আক্ষরিক অর্থেই পূজনীয় আসনে বসিয়েছে, তেমনি সিলেটের মাটিকে পুণ্যভূমির নামে অপুণ্যভূমি আর শিরকী আড্ডাখানা বানিয়ে ছেড়েছে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাযারো মানুষ এখানে আসছে প্রতিনিয়ত এবং ফিরে যাচ্ছে মুশরিকের খাতায় নিজের নাম লিখিয়ে। যে মানুষটি এসেছিলেন এ অঞ্চলের মানুষকে খাঁটি তাওহীদপন্থী বানাতে, আজ তাঁর মাযারে এসে মানুষ ফিরে যাচ্ছে তাওহীদবিরোধী জাহেল মুশরিক গোমরাহ হয়ে (হাদানাল্লাহ ইয়্যানা ওয়া ইয়্যাহুম.. আমীন!)।   

দুঃখ ভারাক্রামত্ম হৃদয়ে মাযার থেকে বের হয়ে একটি রেস্তোঁরায় দুপুরের খাবার খেয়ে শহরের ড্রীমল্যান্ড পার্ক পরিদর্শনে গেলাম। তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সিলেটে সম্পূর্ণ কৃত্রিম এই পার্কটি আমাদের ভ্রমণ অনুভূতির সাথে ছিল বেমানান। যাইহোক সেখানে কিছু সময় কাটিয়ে আমাদের সঙ্গী সিলেটি ভাইদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার ফিরে এলাম একদিনেই মমতা লেগে যাওয়া সেই সেনগ্রামে। খাওয়া-দাওয়া, ছালাত শেষে গভীর নিদ্রায় রাত্রি অতিক্রামত্ম হল। উল্লেখ্য, সিলেট শহরে তাবলীগী ইজতেমা ২০১০ এর পোষ্টার বিভিন্ন জায়গায় লাগিয়ে দিয়েছিলাম।

পরদিন সকালে বিদায়ের পালা। বিদায়ের আগে এখানে একটি সাংগঠনিক প্রোগ্রাম করার কথা ছিল। কিমত্ম আমাদের ক্লামিত্ম ও সময়ের স্বল্পতায় তা আর হয়ে উঠল না। মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক সহ গ্রামবাসীকে তাবলীগী ইজতেমা-২০১০ এর দাওয়াত দিয়ে সকলের কাছে বিদায় নিয়ে বিশেষত: জনাব শফিকুল ইসলাম মাষ্টারের সাথে তাঁর বাড়িতে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে আমরা পরবর্তী গন্তব্য শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত দেশের একমাত্র জলপ্রপাতের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।

মাধবকুন্ড জলপ্রপাত : মাধবকুন্ডের মূল আকর্ষণ জলপ্রপাত। সেখানে যাওয়ার পথটির সৌন্দর্যও ভোলার নয়। পথিমধ্যে আমাদের একজন গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমরা শঙ্কিত হলেও আল্লাহর ইচ্ছায় সে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠল। মূল ঝর্ণা থেকে ৫০০ মিটার দূরে মূল ফটক। অনেক মানুষের আনাগোনা। সকলের হৃদয়ে জলপ্রপাত দেখার আকাংখা। যাইহোক সকলের সাথে আমরাও বিপুল কৌতূহলে পদব্রজে সারি সারি পাহাড়ের মাঝ দিয়ে অগ্রগামী হতে থাকলাম। অবশেষে তার দেখা মিলল। ইন্ডিয়ার পাথারিয়া পাহাড়ে উৎপন্ন জলপ্রপাতটি প্রায় ২০০ ফুট উচ্চতা থেকে অবিরল ধারায় পতিত হচ্ছে। যতদূর সম্ভব নিকটবর্তী হয়ে তার সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। এবার উঁচু পাহাড়ের যে স্থান থেকে অবিরাম জলধারা পতিত হচ্ছে তার উৎস দর্শনের পালা। অনেক পরিশ্রমসাধ্য রোমাঞ্চকর পথ পাড়ি দিয়ে প্রায় খাড়া পাহাড়টির উপর আরোহণ করার সময় নিজেদের পর্বত অভিযাত্রী মনে হচ্ছিল। উপরে উঠে একেবারে ঝর্ণাধারা নেমে যাওয়ার স্থানে উপস্থিত হলাম। অজানা স্থান থেকে পাথুরের অাঁকাবাঁকা নালা বেয়ে পানির ধারা বয়ে এসে আছড়ে নেমে পড়ছে ২০০ ফুট নীচে । নিচের দর্শনার্থীদের দেখা যাচ্ছে পিপীলিকার মত। এত উপর থেকে নীচের অসাধারণ ল্যান্ডমার্কের দৃশ্য আমাদেরকে যেন মেঘের জগতে নিয়ে গেল। ভাষায় বোঝানো কঠিন কি অপরূপ সে সৌন্দর্য। আল্লাহু আকবর! বার বার মনে পড়ছিল আল্লাহর বাণী ‘তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ কিভাবে আল্লাহ সৃষ্টিকর্ম আরম্ভ করেছেন’। সেখানে হাযারো মানুষের ভীড়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছে আল্লাহর সৃষ্টিকর্ম উপভোগ করার জন্য। আমাদের ৬৫ জন ছাত্রের সবচেয়ে কম বয়সী ছেলেটিকেও বাঁধা দেওয়া যায়নি এত উপরে উঠতে, এমনকি সেই অসুস্থ ছেলেটাকেও। সন্দিহান ছিলাম শামসুল স্যারকে নিয়ে। কিছুক্ষণ বাদে উনাকেও উপরে দেখে সবাই হৈ চৈ করে উঠল। আল্লাহর অপরূপ সৃষ্টিকে দেখার জন্য কোন বাধাই যেন কেউ মানতে চাচ্ছে না, কেউই এ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখতে চাচ্ছে না। ঘণ্টা দুই সেখানে অবস্থানের পর আমরা আবার বাসে ফিরে এলাম।

শ্রীমঙ্গল : মাধবকুন্ড থেকে রওনা দিলাম শ্রীমঙ্গলের দিকে। কুলাউড়া হয়ে আমরা শ্রীমঙ্গলে পৌঁছলাম বিকাল ৪ টার সময়। দুপুরের খাবার বাকি। তারপরেও যেন কারো ক্ষুধা নেই। চারদিকে অনিন্দ্য সুন্দর নয়নজুড়ানো থরে থরে সুসজ্জিত চা বাগানে মোড়া বিসত্মীর্ণ টিলাভূমি সকলকে উদ্বেলিত করে তুলেছে। যতদূর চোখ যায় শুধুই চায়ের বাগান। বিভিন্ন কোম্পানী হাযার হাযার হেক্টর এলাকা জুড়ে চা বাগান করেছে। দেশের রপ্তানী আয়ের বড় অংশ আসে এই চা থেকে। এছাড়া ছোট ছোট পাহাড় ও সংলগ্ন প্রান্তরে অবস্থিত সারি সারি রাবার বাগান, আনারস বাগান, লেবু বাগান হৃদয়ের গভীরে যে ভালোলাগার অনুভূতি এনে দিল তা যেন ভুলবার নয়। মাইলের পর মাইল জনমানবশুন্য বিস্তৃত বাগান। দেখলাম রাবার গাছ থেকে কিভাবে আঠা সংগ্রহ করা হচ্ছে। অনেক বড় বাগান অথচ রাবার গাছগুলোতে একটি পাতাও নেই। সেসব বাগানে শেষ বিকেলের রক্তিম আলোর মিষ্টি ছটায় আমেরিকার আরিজোনার ল্যান্ডস্কেপগুলোর ছবি যেন মূর্ত হয়ে উঠল। বেশ কয়েকটি চা বাগানে ঢুকে আমরা প্রদক্ষিণ করলাম। শ্রীমঙ্গলের আরেকটি অভিজ্ঞতা হল- সাত রঙের চা পান। এককাপ চা-এ ৭ টি ভিন্ন ভিন্ন রঙের স্তর। আরো মজার ব্যাপার হল প্রতিটি রং এর স্বাদ ভিন্ন ভিন্ন। খুব সুস্বাদু না হলেও চিত্তাকর্ষক। মূল্য ৭০ টাকা। সেখানকার মাত্র একজন ব্যক্তিই এ চায়ের আবিষ্কারক ও কারিগর। পর্যটক মহলে এ চায়ের বেশ সমাদর রয়েছে।

মাগরিব ছালাত আদায়ের পর আমাদের রান্নাস্থলে ফিরে এসে দেখি রান্না শেষ। ক্ষুধার্ত অবস্থায় প্রবল আগ্রহের সাথে দুপুর ও রাতের খাবার গ্রহণ করলাম। রাত ৮ টায় রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সফরে অংশগ্রহণকারী সকলের মাঝে বিতরণ করা হল মারকাযের নামাঙ্কিত বাৎসরিক ক্যালেন্ডার এবং কলম। আয়োজন করা হয়েছিল সাধারণ জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা। ছিল আকর্ষণীয় সব পুরস্কারের ব্যবস্থা। সবশেষে ৩ দিনের সুখস্মৃতি চারণ করতে করতে ১৩ ফেব্রুয়ারী ফজরের আযানের ঠিক ১০ মিনিট পূর্বে মারকায প্রাঙ্গনে ফিরে আসলাম। ফালিল্লাহিল হামদ। যেন ক্লান্ত ভ্রমণ শেষে পাখির নীড়ে ফেরা। বাংলার রূপকে আরো একবার নিবিঢ়ভাবে দেখার সুযোগ ঘটল আমাদের ৩ দিনের স্মরণীয় এ সফরের মাধ্যমে। এজন্য আল্লাহর দরবারে জানাই শুকরিয়া। সাথে সাথে এ শিক্ষা সফর বাসত্মবায়নে যারা শ্রম দিয়েছেন এবং বিশেষত সিলেটি ভাইরা যারা আমাদের সার্বিক সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি আমত্মরিক মোবারকবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।    



আরও