মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত একজন কয়েদী ও তাঁর প্রার্থনার শক্তি
আরীফ মাহমুদ, আটলান্টা, জর্জিয়া
সারাদিন
ভীষণ কর্মব্যস্ততায় অতিবাহিত হল ঢাকার উচ্চ আদালত পাড়ায়। অনেকগুলো মামলা
পরিচালনার দায়িত্ব ঘাড়ে। মাথায় চিন্তার জট নিয়ে শত শত মানুষের সাথে বেরিয়ে
যাচ্ছি। ভাবছি হাযারো দুর্নীতি-অনিয়মে ভরা বেহাল হাইকোর্ট নিয়ে। কত মানুষ
প্রতিদিন সকালে ন্যায়বিচারের একবুক আশা নিয়ে এখানে ঢোকে। আবার দিন শেষে
হতাশার মেঘ নিয়ে বের হয়। আবার বুক বাঁধে নতুন আশায়। এভাবেই তো গড়িয়ে গেল
বিগত পাঁচটি বছর। বিকাল প্রায় পাঁচটা বাজে। মনের মেঘের সাথে যোগ হয়েছে
আকাশের কালো মেঘের ঘনঘটা। বিজলীর শব্দে প্রকম্পিত আকাশ। পড়ন্ত বেলায় শীতের
কনকনানি, বাতাসের ঝনঝনানি আর ছিটেফাঁটা বৃষ্টিতে মনটা তেতো হয়ে গেল। প্রধান
ফটকের সামনে এসে কোন দিকে যাব এক দন্ড ভাবি। মনটা ভাল না। মনে হ’ল একটু
বেরিয়ে আসি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এস. এম হলে শ্যালক ঢাবি যুবসংঘ সেক্রেটারী
আব্দুর রাকীবের সাথে দেখা হয় না অনেকদিন। রিক্সায় উঠলাম। জিজ্ঞাসা করি
রিক্সাওয়ালাকে কোন দিক দিয়ে যাবে। রিক্সাওয়ালা সহসা জবাব দেয়, ঢাকা মেডিকেল
কলেজ হাসপাতালের পাশ দিয়ে। রিক্সা বেশ দ্রুতগতিতে চলছে। গুড়িগুড়ি বৃষ্টির
মাঝে পর্দার আড়ালে বসে বেশ ওম ওম লাগছে। ভাবুক দৃষ্টি নিয়ে আনমনে দেখে যাই
ব্যসত্ম রাজপথ। মেডিকেলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎই দৃষ্টি আটকে যায়। কত
মানুষই না কষ্ট পাচ্ছে এই ভবনের মাঝে। জাহান্নামের কিছুটা নমুনা দেখা বা
শাসিত্ম উপলব্ধির জন্য এই এক মেডিকেলই যথেষ্ট। বার্ণ ইউনিট নামটি দেখে
আতংকিত হয়ে ওঠে হৃদয়। মনে পড়ে যায় কয়েকবছর পূর্বে বড় ভাবীর অগ্নি ঝলসানো
দেহের করুণ আর্তনাদ। দু’ফোটা অশ্রুবিন্দুতে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। প্রধান
গেট পার হতেই হঠাৎ দৃষ্টি যায় একটা ডাস্টবিনের দিকে। ভালভাবে তাকিয়ে বুঝতে
পারি একজন মধ্য বয়সী মানুষ ভাঙ্গা ডাস্টবিনের মাঝে ময়লার স্তূপের মাঝে মাথা
ঝুঁকিয়ে বসা। সামান্য নড়াচড়ায় বোঝা যায় প্রাণসম্পন্ন দেহ ওটা। খাবার অথবা
আরো কিছুর খোঁজে হয়তবা এসেছিল। আর নড়তে পারেনি। পক্ষাঘাতগ্রস্থের মত
শক্তিহীন, জীর্ণ শরীরের এই আদম সমত্মানের চোখে বোবা দৃষ্টি। ফ্যালফ্যাল
চোখে কখনওবা মাথা ঠুকরাচ্ছে। আশাহীন জীবন নিয়ে, বীভৎস ঐ দেহ নিয়ে সে যেন
প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হয়ত এ রাতটি তার পার হবে না।
হয়ত কুকুর শিয়ালই তাকে ছিঁড়ে-কুটে খেয়ে ফেলবে। তখন বাধাদানের মত তার হয়ত
সামান্য শক্তিও থাকবে না।
পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছে হাযার হাযার মানুষ। কারও দৃষ্টি নেই। হয়তবা মাদকসেবী মনে করে চরম অবহেলায় এড়িয়ে যাচ্ছে তাকে। আহা তারপরও তো মানব সমত্মান। আর দশটা মানুষের মত ওর জীবনটাও আল্লাহরই সৃষ্টি। এক পলকে এই দৃশ্য দেখে আর যেন থেমে থাকতে পারি না। কিন্তু কি করব ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারি না। রিক্সা থামিয়ে ওর পাশে যাব? ওকে কিছু সাহায্য করব? ভাবতে ভাবতে রিক্সাটি লাগামহীন ঘোড়ার মত ছুটে পালায়। এই বৃষ্টিতে নেমে একাকী কিইবা করতে পারতাম। পার্শ্বেই মেডিকেলে যেখানে হাযারও মানুষের চিকিৎসা হচ্ছে সেখানে কি ভর্তি করাতে পারতাম? নাহ! আর ভাবতে পারি না। অবশেষে আর দশটা মানুষের মত আফসোসের হাতেই আত্মসমর্পণ করলাম। অপরাধবোধে মাথাটা নুয়ে এল। জানি না মানুষ হয়ে মুসলমান হিসাবে মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমার যোগ্য হব কি-না।
তবে একথা সত্য যে, মুসাফির হিসাবে আমি আল্লাহর নিকটে ক্ষমাপ্রার্থী হতে পারি। কিন্তু মানবতার নিরীখে ঐ মানুষটিকে করুণ মৃত্যু দশা থেকে উদ্ধার করা অথবা দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষকে জানানোর কোন সুযোগ কি কারো নেই? কোন আড়ালে অগোচরে নয়, একেবারে জনসম্মুখে অসহায় বনু আদম পড়ে থাকবে আর মানুষ চেয়ে চেয়ে দেখবে এ কি হতে পারে? স্বাধীন দেশ, স্বাধীন সরকার আর সভ্য দেশে মানবাধিকারের জন্য কত দল, কত পন্থী রাজপথ সরগরম করছে প্রতিদিন। অথচ অসহায় ঐসব মানুষের মুক্তি ও কল্যাণের জন্য কারো কি কিছুই করার নেই? কেউ কি নেই এসব চিকিৎসাহীন বনু আদমের সাহায্যের জন্য হাত প্রসারিত করার? মানবাধিকারের শ্লোগান নিয়ে বিভিন্ন সংগঠনকে যখন রাজপথ কাঁপিয়ে তুলতে দেখি, তখন ঐসব বুভুক্ষ অনাহারক্লিষ্ট বনী আদমের মুখ সামনে ভেসে ওঠে। এক অব্যক্ত মন:পীড়ায় মনের রাজ্যে গভীর অন্ধকার নেমে আসে।