আত্মসমর্পণ
নিশাত তাসনীম
শামসুদ্দীন মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ সেলিম 606 বার পঠিত
যাঁর সঙ্গে আমার সখ্যতা না থাকলেও আন্তরিকতা আছে, যিনি আত্মীয়তার সম্পর্কে সম্পর্কিত না হলেও আঞ্চলিকতার ঐক্যে গ্রথিত, এমনই একজন ব্যক্তি কেরামত নানা। মৌলভীগিরির সুনামের পাশাপাশি চুল ছাঁটায়ও তাঁর বেশ কেরামতি আছে। ধারেপাশেই দোকানের জিনিসের মত তাঁকে সব সময় হাতে পাওয়া যায়। তাছাড়া শৈশবে উনার কাছে ‘কায়দা সিপারা’ পড়েছি ও ধর্মশিক্ষার জন্য গিয়েছি। তাই উনি যে একাধারে হৃদ্যতার যোগানদার ও দাবীদার তা অস্বীকার করলে অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হবে বৈকি।
পীর সাহেবের মুরিদ আমার সেই নানার সঙ্গে রাজশাহীস্থ আলিয়াবাড়ী গ্রামের খাটিয়ামারি দরগাহ থেকে সিন্নি খেয়ে উদরাময় নিয়ে বাড়ী ফিরছি। সান্তাহার স্টেশন। নামার সময় আমার পিছনে নানাজী। প্রচন্ড ভীড়। আমি নেমে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি। ট্রেনের সীটে বা নামার লাইনে থাকার সময় আমার ও উনার মধ্যস্থানের দূরত্ব যত ছিল তার চাইতে ‘আমার নামা’ ও ‘উনার নামা’র মধ্যবর্তী সময়ের দূরত্বটা একটু বেশী হতেই চলল। ভাবলাম বয়সের ভার - দেহ ভারী; তাই বুঝি অলিম্পিকের মত এই শক্ত প্রতিযোগিতায় খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারছেন না।
প্রচন্ড ভীড়। বস্তা বোঝাই বস্ত্তর মত চেপে ধরা মানুষের নিঃশ্বাস নিঃসৃত কার্বনডাই অক্সাইডের চাপে যে দম বন্ধ হয়ে অক্কা পেতে হয়নি সে সৌভাগ্যের কথা স্মরণ করে ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ পাঠ করছি।
ট্রেন থেকে নামার সে অভিযানে নেমে কেরামত নানার হাল হাকীকত যে কেশরঞ্জন বাবুর পরিপাটি কেশের মত সাবলীল নাই এমন ধারণা পোষণ করাই বাঞ্চনীয় হবে। তাই মাটিতে এক পা ফেলে আর এক পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উনিও নেমে আমার গা -এর সঙ্গে গা ঠেকাতে পারলেন না কেন এই চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠিনি।
বয়স বেশী হলেও কেরামত নানার চেহারা মোবারক কিন্তু একেবারে মানচিত্রের মত অসংখ্য দাগ ও ভাঁজে কুঞ্চিত হয়নি। তাই আর যা-ই হোক উনাকে থুত্থুড়ে বলা যায় না কিছুতেই। কারণ ইতিপূর্বে উনাকে বহুবার খাসীর মত ছুটাছুটি করা ভুষন্ডির কাক-এর মত বগলদাবা করে ওরস মোবারকের মহতী ময়দানে হাজির করতে দেখা গেছে।
নানাজী ট্রেন থেকে নামলেন। টুপীটা নেড়ে পাঞ্জাবীটা ঝেড়ে হঠাৎ কি মনে করে এতক্ষণ মধ্যাকর্ষণ শক্তির অনুকূলে ধরে থাকা হাতের ছাতাটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আকাশের দিকে তাক করে বললেন, ‘আমার টাকা’? সওয়াল করে জওয়াব পেলাম উনি নামার চেষ্টা করার সময় বগলে কাতুকুতু ও বিব্রত বোধ করেন। বুঝতে দেরী হল না সুসংঘবদ্ধ পকেটমারদের কেউ তাঁর বগলে মনোহারী কাতুকুতু দিয়ে মনটা ভুলিয়ে রেখেছে। আর অন্যরা পকেটের দফা রফা করে ছেড়েছে। নানাজী থানায় ডায়রী করলেন। কিন্তু তাঁর ওয়ারেন্ট জড়পদার্থ ডায়রীতে নিষ্প্রাণ হয়ে নিঃশব্দে রয়ে গেল। অদ্যাবধি কোন ফল হয় নাই।
স্টেশন ত্যাগ করে রিক্সায় চলতে চলতে আমি বললাম ‘নানাজী! আগে আমাদের বাড়ীতে না হয় চলেন।’ তাই বলে সে আমন্ত্রণ জনৈক বন্ধুর ‘ঈদের দিনে আসলে এসো’ নিমন্ত্রণের মত ছিল না কিন্তু। অন্তর থেকেই উচ্চারণ করেছিলাম। কিন্তু তালগোল পাকিয়ে যাওয়া অবস্থায় পড়ার ফলে বিনয়মিশ্রিত কথাটিও বেকায়দায় বিশ্রী হয়ে বেরিয়ে এলো। ওনার উত্তর অশ্রাব্য গালির মত চপেটাঘাত হেনে আমার কানে ঢুকল। তা হল- ‘বাড়ী বাড়ী গোল্লা দেওয়ার সুখবর আছে নাকি? তাই আগে হাসিমুখে অন্যের বাসায় ঢুকব?’
কিম্ভূতকিমাকার পরিস্থিতির প্যাঁচে পড়ে কেরামত নানার দয়ার শরীর যে এখন রাগের শরীরে পরিণত হয়েছে- ভয়ে ভয়ে ভেবে নিয়ে ভদ্র ছেলের মত চুপ হয়ে গেলাম। বন্ধমুখে দু’চোখে দেখলাম, রিক্সার চাকা উনার বাড়ীর দিকেই যাচ্ছে।
বাড়ীর গেটে পৌঁছার পর টাকা চুরি হওয়ার অপমানে শোকে-দুঃখে-ক্ষোভে-লজ্জায় লাল আর বেগুনের মত বাঁকা হওয়া নানাজীর শরীরের দিকে তাকিয়ে খালাম্মা যেন একটু আঁৎকে উঠে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি খবর আববা?’ আঁৎকে উঠায় তার ছোট করতে চাওয়া গলার স্বরটি বড় হয়ে যায়। নানাজীর কৃতিত্বের বিবরণ শুনে অবলা কিন্তু মানসিক দিক দিয়ে সবলা নারী বললেন, ‘বাবা! যা হবার হয়েছে। চোখ মুখ ধুয়ে ভাত খেয়ে নাও। আল্লাহ যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন’।
কেরামত নানার চোরের উপরে থাকা এতক্ষণের রাগ মেয়ের উপরে ঝেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যঁা, দেখতেই তো পাচ্ছি। ঠিকই বলেছ। আল্লাহ আমার মঙ্গল করে দুনিয়া পুলকিত করে ফেললেন। এতগুলো টাকা যে হারিয়ে গেল তা আমার মঙ্গল হওয়ার আলামত তাই না?’
নানার রাগ তো ধরারই কথা। কারণ ইতিপূর্বে উনি এক শীতে আজমীরপথে গিয়ে চাদর, কাঁথা, বালিশ ও শীতের কাপড়-চোপড় হারিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ী ফিরে এসেছেন। হয়তো জীবনে কোনদিন খেলার জগতে নেমে ফুটবলে পা ঠেকাননি কিন্তু হারানো দিনগুলোর তল্পী-তল্পা হারাবার জগতে উনার বার বার বিজয়ই হয়েছে। কেন যে হয়? উনি তো এত বিজয় চাননি। সেদিন পথিমধ্যে ট্রেনের কামরায় দেখেছিলাম এক মহিলা মুড়ি রাখার টিনের মধ্যে তাঁর অসংখ্য বাচ্চা-কাচ্চার বেহিসাবী কাপড়-চোপড় গাদাগাদি করে রেখেছেন। তাঁর সুসন্তানেরা রাস্তার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বৃষ্টির মত মুষলধারে মল-মূত্র নির্গমন করে চলেছে। প্রয়োজনবশতঃ ভদ্র মহিলা টিনের মুখ খুলে কোন নির্দিষ্ট কাপড় খোঁজার চেষ্টা করছেন ও সেগুলো বাইরে নিয়ে খুলছেন। তখন দেখি কাপড়ের দল একটা একটা করে যাদুর ফিতার মত বেরিয়ে আসছে। এতদিন জানতাম মুড়ির টিনের মধ্যে মুড়িই থাকে, কিন্তু এখন দেখছি তাতে কাপড়ও স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করতে পারে।
অতীব সন্তর্পণে অতি বিনয়মিশ্রিত আওয়াজে ভদ্র মহিলাকে ‘ঘটনা কি’? জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম একদিক ধরতে আর একদিক ফসকে যাওয়া ব্যাঙাচির মত বাচ্চা-কাচ্চার উৎপাতে বেসামাল হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে দুনিয়াদারী শেষ হওয়ার ভয়ে উনি এ ব্যবস্থা করেছেন। ভাবছি হারানোর হাত থেকে রেহাই কল্পে নানাজীর জন্য অমন হাস্যকর কোন বুদ্ধি বাতলাতে হবে।
শুরুতে বলেছিলাম বোধ হয় ওরস শরীফের খানা খেয়ে পেটে ঈসা খাঁ ও মানসিংহের মল্লযুদ্ধ অনুভবের কথা। পেট খারাপ হ’ল কেন? তবে কি হাভাতের মত খুব বেশী খেয়েছি? না। ‘তবারক’ বা ‘সিন্নী’ মুরগীর খাবারের মতই ঠুকরে খাওয়ার মত অল্প খাবার। তবে পেটে মেঘের মত ডাকাডাকি হচ্ছে কার অঙ্গুলি হেলনে? আমরা সাধারণতঃ মনে করি পবিত্র মাযার শরীফের পবিত্র খাবার তবারক খেলে পুষ্টিহীন বাঙ্গালীর রোগ,গুনাহ মাফ হয়ে দেহ পরিপুষ্ট হবে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা পরিদৃষ্টে আমার মনে হল এটা মুখে দিলে বাংলার মানুষ অনাহার জনিত কারণে অপুষ্টিতে ভুগবে না; উদরাময় জাতীয় কারণে অপুষ্টিতে মরবে। এই খাবারগুলো একবার রান্না করে ওরস শরীফ যতদিন পর্যন্ত চলে ততদিন পর্যন্ত সদ্ব্যবহার করা হয়। খাবারের মধ্যে সুগন্ধি উৎক্ষেপণকারী আগরবাতি ও নূরবিকীর্ণকারী মোমবাতি প্রবিষ্ট করানো হয়েছে হয়তো পবিত্র পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য। সেগুলো পুড়ে ছাই ও গলিত মোম ক্ষির ও পোলাও -এর সঙ্গে মসলার মত মিশে যাচেছ। ঐ রুচিভর্তি খাবারগুলো তুলে এনে আবার সমবেত মুরীদানদের ফূর্তি সহকারে উদরপূর্তি করানো হচ্ছে। পায়েশ, ফিরনী, ফলমিশ্রিত খিচুরীর পাত্রগুলো যেন খাবারের পাত্র নয়-মাছি বন্দর। সত্যিই সেগুলো আর এক পার্ল হারবারে পরিণত হয়েছে। বিমানবন্দরে বিমান যেমন উঠানামা করে, খাদ্যপাত্রে মাছিও তেমন উঠানামা করছে। বিমান যেমন সোঁ সোঁ শব্দে সমগ্র বন্দর মুখরিত করে, মাছিও তেমন ভোঁ ভোঁ শব্দে সমুদয় খাবার বাজীমাত করে ছেড়েছে। সে খাবার খেলে যে কেউ কুস্তিগীর ‘গামা’ ফিগার লাভ করবে না; বরং তার পেটের মধ্যে কুস্তি শুরু হবে তেমন আশা করাই বিজ্ঞজনোচিত হবে।
মরহূম পীর ছাহেব যেখানে শায়িত সেখানে আর এক অদ্ভূত দৃশ্য দেখলাম। দেখতে পেলাম লোকজন দক্ষিণ দিকে মুখ করে ঢপাঢপ টিপ দিচ্ছেন। উল্টা দিকে সিজদা। আমি তো জানি বাংলাদেশে সিজদার দিক পশ্চিম। ভাবলাম সূর্য কি আজ দক্ষিণ দিকে উঠল না-কি? ধাঁধা ধরা মনে তানতারা চোখে আকাশের দিকে চেয়ে দেখি প্রকৃতির নীতি ঠিকই আছে। দুরু দুরু বক্ষে আজব দিকে সিজদা করার কারণ জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম, ‘ওটা হ’ল পীর সাহেব কেবলা।’ আরও পরে জানতে পারলাম ‘ঐ দিকে মুখ করে মরহুম পীর সাহেব শুয়ে আছেন।’ হ্যাঁ, সত্য বলছি। ঐ রকম স্থানে সূর্য্যের মতিগতি ঠিক থাকলেও সিজদার গতি অন্যরকম। যদি আমার এ কথা গ্যালিভার্স ট্রাভেল্স-এর মত কাল্পনিক মনে হয় তবে কিন্তু আপনার কাছে আমি শুধু ‘কল্পনাকারী’ নই ‘মিথ্যুক’ বিশেষণেও বিশেষিত হব। আর যদি তা-ই হয় আপনি একটু চেষ্টা করলেই ঘটনাটি নিজে চাক্ষুস দেখে চক্ষু শীতল ও বক্ষ উতলা করতে পারেন। কিন্তু যদি দেখেও দর্শিত ব্যাপারটি এড়িয়ে যান বা তেমন কিছু মনে না করেন তবে কিন্তু আপনার কাছে আমার বিশেষণটি পাল্টাবে না। আমাকে যখন lawyer এর মত lier মনে হচ্ছে ও আমার কথা অবিশ্বাস হচ্ছে তখন এ কথাটি স্মরণ করুন ‘আপনার সমর্থিত জিনিস ভুল হলেও তাকে ঠিকই মনে হয়।’ গ্রামে বাচ্চারা মারামারি করতে লাগলে মায়েরা এসে যদি জানতে পারেন যে নিজের ছেলে অপরাধ করেছে তবে কিন্তু তারা নিজের ছেলেকে মারেন না, বরং ছেলেকে সমর্থনের পাশাপাশি তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেন; শুধু ছেলেকে নিয়ে গযল বানাতে বাকী রাখেন মাত্র।
বান্দার মত ভক্ত মুরীদবৃন্দের ভাষ্য অনুসারে মৃত পীর সাহেবের কাছে তাঁদের এই ধর্ণা অসীলা হিসাবে তাঁকে পাবার আশায়। দীর্ঘদিন দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছেন- স্বাস্থ্য হচ্ছে না। তাই কেউ পীরের দরগায় গিয়েছেন রোগমুক্তির আশায়। বিয়ে হয়েছে দশ বছর হল তবু বাচ্চা হচ্ছে না, তাই কেউ সেখানে গিয়েছে সন্তান লাভের আশায়। কেউ গিয়েছে পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস পাবার আশায়, কেউ গিয়েছে প্রীতি বৃদ্ধির আশায়, কেউ গিয়েছে বেহেশতী সুখের আশায়, কেউ গিয়েছে স্ত্রীর হাতে ঝাঁটাপিটা খেয়ে স্ত্রীকে বশীভূতকরণের আশায়, কেউ গিয়েছে মন্ত্রীত্ব ঠিক রাখার আশায়, কেউ গিয়েছে পরকালীন মুক্তির আশায়। এমনকি হরতাল, ধর্মঘট ও বিক্ষোভের চোট সইতে না পেরে কোন কোন সময় দেশের প্রেসিডেন্টকে বিদেশ থেকে প্লেনে করে উট এনে মৃত পীরের পদপ্রান্তে দিতে দেখা যায় তাঁর শাসনদন্ড সোজা রাখার আশায়।
কিন্তু একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায়- এই ভুরি ভুরি আশার জগৎ অমাবশ্যার অমানিশার মতই অন্ধকার। তাঁদের অনেকের ধারণা- মরহূম পীর ছাহেব তাঁদের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবেন। আমরা জানি হাশরের ময়দানে হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ) ছাড়া অপরাপর সকল নবী, খলীফা, ছাহাবা, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন, বুযর্গ, বাদশাহ ও মানুষ ‘ইয়া নাফসী ইয়া নাফসী’ করবেন। আখেরী নবী ‘ইয়া উম্মাতী’ উচ্চারণ করবেন। কাজেই আশা করি আমাদের পীর সাহেবও ইয়া নাফসী ওয়ালাদের মধ্যেই পড়বেন। পরকালে যাঁর মুখের মন্ত্র ‘আমার কি হবে?’ তিনি কি করে ‘অন্যের ভাল করা যাবে’ এই চিন্তা করবেন তা ভাবা খুব শক্ত।
একটি পারসিক গল্প আছে। মধ্যপ্রাচ্যে একজন অত্যন্ত পরাক্রমশালী যালিম শাসক ছিলেন। বল প্রয়োগ করে সম্পদ সঞ্চয়ই ছিল তাঁর নেশা। তাঁর অত্যাচারে অতীষ্ঠ হয়ে বুদ্ধি করে এক দরবেশ একদিন তাঁকে বললেন, মৃত্যুর পর তাঁর আরাম-আয়েশের উপকরণের কোন অভাব থাকবে না, শুধু একটি ত্রুটি ছাড়া। তা হল তাঁর স্বর্গের সোনার মশারীতে থাকবে শুধু একটি ছিদ্র। কিন্তু সেখানকার মশারা এত বিষাক্ত যদি একটি মশা কোনক্রমে তাঁর শরীরে একটি বার চুম্বন করতে পারে তবে তা তাঁর সমস্ত সুখ বিনাশ করে ছাড়বে। রাজা মুক্তির উপায় জিজ্ঞাসা করলে তাঁকে বলা হল, ‘রাজামশাই! আপনার তো এত প্রতাপ, প্রভাব ও ধন-দৌলত, তার মধ্য থেকে আপনি শুধু একটি সূঁচ সঙ্গে নিয়ে মারা যাবেন। আর কিছু দরকার নেই’। রাজা মশাই বললেন, ‘আমি কখন মরব তা কি আমি জানি’? দরবেশ বললেন, ঠিক আছে আপনি মারা গেলে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় আপনার কফিনের সঙ্গে একটি সূঁচ দিয়ে দেব। রাজা সহেব বললেন, ‘মৃত্যুর পর আমি তো ওটা কাজে লাগাতে পারব না। যিনি এই পৃথিবীতে অগাধ ঐশ্বর্য, সম্মান ও প্রতিপত্তির মালিক ছিলেন মৃত্যুর পর তিনিও নিষ্ক্রিয় প্রমাণিত হলেন। পাঠক একবার ভেবে দেখুন! কীভাবে আমরা আশা করতে পারি কোন মৃত ব্যক্তি আমাদের কোন উপকার করতে পারে? এর পরেও কি আমরা আবার পোঁটলা বেঁধে মৃত পীরের আস্তানায় যাব?
লেখার কলেবর প্রকান্ড করতে হচ্ছে আরও একটি কথা বলে যা না বললে কিছু সত্য অপ্রকাশিত থেকে যায়। যারা সেখানে যান তাদের অধিকাংশই অত্যন্ত ভাল মনে এমনকি এমনও অনেকে আছেন যাঁরা সত্যিকারের হজ্জগামীর মত পবিত্র মন নিয়ে যান। সত্যিকারের হাজী বলার কারণ এই যে, হাজীদের মাঝে এমনও আছেন যাঁরা কিন্তু আল্লাহতে মনোযোগী কপালকে পুণ্যভূমিতে ঠেকানোর জন্য যান না; যান নিজের গরম টাকাওয়ালা হাত বিক্রেতার ভাগ্য লালকারী বিদেশী লাল হাতে ঠেকানো জন্য। হজ্জের কার্যকলাপ বাদ রেখে হাজীরা টাকা ঢালছেন আর সেখানকার জিনিসপত্র বাচ্চা কোলে নেওয়ার মত দু’হাতে জড়িয়ে ধরছেন ও ঝুড়ি ভরছেন- এই হ’ল হজ্জের আধুনিক দৃশ্য। তবে আর যা-ই হোক হাজীদের বাড়ী থেকে মক্কা রওয়ানা কিন্তু একত্ববাদের চর্চার জন্যই; কিন্তু আজমীর-মহাস্থান, বায়েজীদ বোস্তামী, সিলেট-বাগদাদ গামীদের অধিকাংশই যান কাঁধের উপর বসে থাকা কিরামান কাতেবীন-এর খাতায় ‘মুশরিক’ এর তালিকায় নিজের অজ্ঞাতসারে বা উদাসীনতাভরে নাম লেখানোর জন্য।