রামাযান : আত্মশুদ্ধির এলাহী প্রশিক্ষণের মাস

ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 9137 বার পঠিত

দীর্ঘ একটি মাস যাবৎ বিশ্ব চরাচরের মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাববুল আলামীনের অশেষ অনুগ্রহে তাঁরই নির্দেশিত পন্থা মোতাবেক ছিয়ামব্রত পালন করার পর আমরা পুনরায় নিয়মিত জীবনধারায় ফিরে এসেছি। একটি মাসের কঠোর সংযমের প্রশিক্ষণ আমাদের জন্য পরবর্তী এগারো মাস কি ধরনের ভূমিকা রাখবে, তা নির্ভর করছে এ মাসের প্রশিক্ষণকে কতটা গুরুত্বের সাথে এবং কতটা নিবিড়ভাবে গ্রহণ করেছি তার উপর। প্রকৃতপক্ষে মুসলিম সমাজে রামাযান মাসের প্রভাব যেন মু‘জিযার মত। মোস্তফা ছাদেক আর-রাফেঈ তাঁর ‘অহীউল কলাম’ গ্রন্থে সুন্দরভাবে তা উল্লেখ করে বলেন, ‘রামাযানের শুদ্ধিতা ও সংস্কারমূলক প্রভাব আর সব মু‘জিযার মত একটি বিস্ময়কর মু‘জিযা। নবচন্দ্র উদয়ের প্রতি দৃষ্টি রাখা এবং তা দেখার মাধ্যমে ছিয়ামের সূচনা করার পশ্চাতে একটা গভীর অর্থ নিহিত রয়েছে। তা হল চন্দ্রের উদয় সাব্যস্ত হওয়া ও তা ঘোষণা করার মাধ্যমে মানুষ যেন স্বীয় সদিচ্ছা বাস্তবায়নের ঘোষণা উচ্চারণ করে। যেন এক আসমানী আলোকধারা আপন মহিমায় সমগ্র মানবজগতের জন্য দয়া, মানবতা আর পুণ্য সাধনের আভাস নিয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে’। এ যেন দিকে দিকে ইসলামের বিজয়কেতনের অপূর্ব আলোড়ন উচ্ছাস। রামাযান মাসের পবিত্র প্রভাব কিভাবে মানুষকে আত্মিক পরিশুদ্ধি এবং কল্যাণ ও পুণ্যের কাজে অগ্রগামী করে তা সংক্ষিপ্তাকারে নিম্নে উল্লেখিত হল। 

রামাযানের প্রশিক্ষণ :

  1. তাক্বওয়া : ছিয়ামের মৌলিক উদ্দেশ্যই হল তাক্বওয়া তথা আল্লাহভীতি অর্জন। পবিত্র কুরআনে ছিয়াম পালনের নির্দেশে নাযিলকৃত আয়াতে তা স্পষ্টই উল্লেখিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের উপর ছিয়াম ফরয করা হয়েছে তোমাদের পূর্ববর্তীদের মত যাতে তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পার’ (বাক্বারাহ ২/১৮৩)। ইবাদতের মূল রূহ হল আল্লাহকে ভয় করা তথা আল্লাহর নৈকট্য হাছিল করা। আর ছিয়াম হল তার হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ। প্রকাশ্যে-গোপনে, বাহ্যিক-অভ্যন্তরীণ যে কোন কাজে সার্বক্ষণিক আল্লাহকে ভয় করার যে শিক্ষা রামাযানের দীর্ঘ প্রশিক্ষণে অর্জিত হয়, তা সত্যিকারের প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য এক অতুলনীয় পাওয়া। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করার মত ভয় করতে পারল তার পক্ষে সর্বোচ্চ স্তরের মানুষে পরিণত হওয়া অতি সহজ। আর এমন ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট সর্বাধিক সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী। আল্লাহ স্বয়ং পবিত্র কুরআনে বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আলাহর নিকট সর্বাধিক সম্মানিত ব্যক্তি সেই যে আল্লাহকে অধিক ভয় করে’ (হুজুরাত ৪৯/১৩)। তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা (আখিরাতের জন্য) সম্বল অর্জন করে নাও, নিশ্চয়ই সর্বাধিক উত্তম সম্বল হল তাকওয়া’ (বাক্বারাহ ২/১৯৭)। রামাযানের এই তাক্বওয়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর সে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর নৈকট্য অনুভব করতে থাকে বলে যেকোন নিষিদ্ধ, অনৈতিক কাজে বাধাগ্রস্ত হয়।
  2. ইখলাছ : রামাযান মাস প্রকৃতই ইখলাছ অর্জনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময়। পানাহার বা জৈবিক চাহিদা পূরণের মত হালাল বিষয়কেও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হারাম করে দিয়ে যে কঠোর সংযমের পরীক্ষায় মানুষ অবতীর্ণ হয়, তা তাকে খুলূছিয়াতের উচ্চমার্গে উত্তরণ ঘটায়। কেননা অতি সংগোপনেও যে ব্যক্তি নিজের জন্য হালাল বিষয়কে হারাম করে নিতে পারে কেবলমাত্র আল্লাহরই ভয়ে; সে ব্যক্তি দুনিয়ার সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কেবল তার স্রষ্টার জন্যই নিজেকে নিবেদন করার সামর্থ্য অর্জন করে। আর এ সামর্থ্য যে প্রকৃতার্থে অর্জন করেছে, সে নিশ্চিতভাবেই আল্লাহর মুখলিছ বান্দার কাতারে শামিল হয়ে যায়। হাদীছে কুদসীতে আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন, ‘ছিয়াম আমার জন্যই, আর আমি নিজেই এর প্রতিদান দিব। কেননা বান্দা কেবল আমারই জন্য প্রবৃত্তির চাহিদা ও পানাহার থেকে দূরে থাকে’ (মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/১৯৫৯)
  3. তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা : তওবা কবুলের জন্য রামাযান মাস অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। সেজন্য এই মাসে প্রতি মুহূর্তে তওবা ও ইস্তিগফারের জন্য বার বার তাকীদ করা হয়েছে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘ঐ ব্যক্তির নাক ধুলায় ধূসরিত হোক যে ব্যক্তি রামাযান মাসকে পেল অতঃপর তা অতিক্রান্ত হল অথচ সে নিজের পাপ ক্ষমা করিয়ে নিতে পারল না’ (তিরমিযী, মিশকাত হা/৯২৭)। রাসূল (ছাঃ) রামাযানে বিশেষত শেষ দশকে তওবা ও ইস্তিগফারের জন্য এ দো‘আটি শিক্ষা দিয়েছেন, اَللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّيْ ‘হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমা পছন্দ কর, অতএব তুমি আমাকে ক্ষমা কর’ (আহমাদ, ইবনু মাজাহ, তিরমিযী, মিশকাত হা/২০৯১)। তওবা ও ক্ষমাপ্রার্থনার এই মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ তাকে পাপ কাজে পুনরায় ফিরে যেতে বাধা প্রদান করে। পরবর্তীতে অজ্ঞাতসারে কোন পাপ করে ফেললেও তাৎক্ষণিকভাবে তওবা করে নিজেকে পবিত্র করে ফেলার অভ্যাস তার মধ্যে তৈরী হয়।   
  4. ঈমান ও ইহতিসাব : ইবাদতের প্রধানতম শর্ত হল তাতে ঈমান ও ইহতিসাব থাকা। রামাযান এই দু’টি গুণ অর্জনের বিশেষ প্রশিক্ষণ দান করে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমান এবং ইহতিসাবের সাথে রামাযানের ছিয়াম পালন করল, তার পূর্ববর্তী সকল (ছগীরা) গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে’ (মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/১৯৫৮)। অর্থাৎ আল্লাহ রাববুল আলামীনের প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস সহকারে এবং পরকালীন জীবনে ছওয়াবের আশা রেখে যে ব্যক্তি ছিয়াম আদায় করবে তার জন্য অনুরূপ পুরস্কার নির্ধারিত রয়েছে। ঈমান অর্থ আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখা, যেভাবে রাখার জন্য আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। আর ইহতিসাব শব্দটির ব্যাখ্যায় ইবনুল আছীর বলেন, ‘সৎকর্ম পালন ও অপছন্দনীয় কাজ থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে ইহতিসাবের অর্থ হল যে, প্রতিদান প্রাপ্তির আশায় আত্মনিবেদন ও ধৈর্য অবলম্বন এবং পুণ্যের কাজে নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী আত্মনিয়োগের মাধ্যমে তৎপর হওয়া’ (আন-নিহায়াহ, ১/৯৫৫ পৃঃ)। আল্লামা মুবারকপুরী বলেন, ‘এর অর্থ পরকালীন জীবনে প্রতিদান কামনা করা এবং নিয়তে খুলূছিয়াত রাখা’। অর্থাৎ কেবল ছিয়ামের উদ্দেশ্যেই ছিয়াম রাখা; কারো ভয়ে নয়, লজ্জায় নয় বা মানুষকে দেখানো বা শুনানোর জন্য নয়। আল্লামা খাত্তাবী বলেন, ‘এর অর্থ দৃঢ় সংকল্প রাখা। সেটা হল- সে এমন আগ্রহের সাথে ছিয়াম রাখবে যে তাতে তার কোনরূপ দ্বিধা থাকবে না, ছিয়ামকে কষ্টকর বিষয় মনে হবে না বা দিনকে খুবই দীর্ঘ অনুভূত হবে না। বরং দিনের দীর্ঘতাকে সে ছওয়াব অর্জনের বিরাট মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করবে (মির‘আতুল মাফাতীহ, ৬/৪০৪ পৃঃ)। অর্থাৎ প্রতিটি কাজে ঈমানের পরিচয় রাখা এবং তাতে পরিপূর্ণ আন্তরিকতা বজায় রাখার লাগাতার প্রশিক্ষণই হল ছিয়ামে রামাযান।
  5. রাত্রি জাগরণ : রাত্রি জাগরণ নফল ইবাদতের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদত। পবিত্র কুরআনে মুমিনের পরিচয় দিতে গিয়ে বেশ কয়েক জায়গায় তাদেরকে রাতের ছালাত আদায়কারী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। রাসূল (ছাঃ)ও কিয়ামুল লাইলের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। সাধারণত রাত্রি জাগরণের জন্য দৃঢ় মানসিক ও শারীরিক সামর্থ্যের প্রয়োজন হয়। রামাযানের দীর্ঘ এক মাস যাবৎ তারাবীর ছালাত আদায়ের মাধ্যমে সহজেই এই কঠিন ও মর্যাদাপূর্ণ ইবাদতটি বান্দার আয়ত্ত হয়ে যায়। যার ধারাবাহিকতা পরবর্তী মাসগুলোতে বজায় রাখা তার জন্য আর কষ্টকর হয় না। এজন্য রামাযান মাসের কিয়াম সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বিশেষভাবে উল্লেখ করে বলেন, ‘যে ব্যক্তি রামাযান মাসে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে রাত্রি জাগরণ করে ছালাত আদায় করল, সে ব্যক্তির পূর্ববর্তী গুনাহ সমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে’ (মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/১৯৫৮)
  6. নিরবচ্ছিন্ন ইবাদত : রামাযানের একটি বিশেষ ইবাদত হল ই‘তিকাফ। রামাযানের শেষ দশদিন পূর্ণাঙ্গভাবে ইবাদতে কাটানোর জন্য দুনিয়াবী সংশ্রব থেকে দূরে থেকে একাকী নিরবচ্ছিন্নভাবে আল্লাহর ইবাদতে সময় কাটানোর এক সুবর্ণ সুযোগ হল ই‘তিকাফ। আত্মিক পরিশুদ্ধির জন্য এর চেয়ে উত্তম প্রশিক্ষণ আর হয় না। দীর্ঘ দশদিনের এই কঠোর সাধনায় লিপ্ত ব্যক্তি অতি সৌভাগ্যবান। কেননা রামাযান যেমন সারা বছরের জন্য প্রশিক্ষণের মাস, তেমনি ই‘তিকাফের দশদিন হল এই প্রশিক্ষণের মাসে একটি বিশেষ প্রশিক্ষণকাল। যা তার জন্য সারা জীবনের সম্বল হতে পারে। এজন্য রামাযানের শেষ দশকে উপনীত হলে রাসূল (ছাঃ) রাত্রি জাগরণের জন্য জোর প্রস্ত্ততি নিতেন। তিনি রাত্রি জাগতেন এবং আপন পরিজনকেও জাগিয়ে দিতেন (মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/২০৮৯-৯০)
  7. কুরআন শিক্ষা করা : পবিত্র কুরআন শিক্ষার অনুপম সুযোগ এ রামাযান মাস। অন্য মাসে কুরআন তেলাওয়াতের যে ছওয়াব রয়েছে এ মাসে সে ছওয়াব আরো বহুগুণ বেশী। এ কারণে কুরআন তেলাওয়াত এ মাসের একটি বিশেষ ইবাদত। কুরআন নাযিলের এ মাসে পুরা কুরআন একবার অর্থসহ তেলাওয়াত করার সুযোগ অনেকেই গ্রহণ করেন। কুরআন সম্পর্কে জানা ও কুরআনের শিক্ষাকে প্রচার করার জন্য রামাযান মাস অতি উত্তম সুযোগ। কুরআন তেলাওয়াত ও কুরআনের শিক্ষাকে উপলব্ধির জন্য রামাযানের এই ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ বাকী মাসগুলোতেও অব্যাহত রাখার অভ্যাস তৈরী করে দেয়। প্রতি রামাযানে জিবরীল (আঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট পবিত্র কুরআন একবার করে উপস্থাপন করতেন। সালাফে ছালেহীন পবিত্র কুরআন পাঠের জন্য এ মাসে কঠোর সাধনা করতেন। কেউ তিন দিনে, কেউ সাত দিনে, কেউ দশ দিনে কুরআন খতম করতেন। ইমাম মালিক বিন আনাস রামাযান মাস আসলে দরস-তাদরীস বন্ধ করে শুধু কুরআন পাঠ করতেন এবং বলতেন, ‘এটা হল কুরআনের মাস’। ইমাম আহমাদও রামাযান মাসে বই-পত্র বন্ধ করে কেবল কুরআনই পাঠ করতেন এবং বলতেন, ‘এটা হল কুরআনের মাস’। ইমাম বুখারী রামাযানে দিনে একবার কুরআন খতম করতেন এবং তারাবীর ছালাতের পর কুরআন তেলাওয়াতে রত হতেন এবং প্রতি তিন রাতে একবার খতম করতেন। এমনকি মুসলিম শাসকরাও কুরআন পাঠের জন্য বিশেষ সময় রাখতেন। কথিত রয়েছে যে, খলীফা ওয়ালীদ বিন আব্দুল মালিক রামাযান মাসে ১৭ বার কুরআন খতম করতেন।
  8. আল্লাহকে স্মরণ : রামাযান মাস প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহকে স্মরণ করার অভ্যাস তৈরী করে দেয়। সাহারীর পর দিনব্যাপী সে আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ বিষয়গুলো থেকে বিরত থাকার যে দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করে, তা তাকে সারাদিন আল্লাহর স্মরণে ব্যাপৃত রাখে। নিজেকে সবসময় সে যিকির-আযকারে নিমগ্ন রাখে। আর মানুষের জন্য সর্বাধিক পবিত্রতাপূর্ণ ও মর্যাদাবৃদ্ধিকারী বিষয় হল ‘আল্লাহর স্মরণ’ (তিরমিযী, মিশকাত হা/২২৬৯, ২২৭০, সনদ ছহীহ)
  9. সৎআমলে অগ্রগামী হওয়া : রামাযানের চাঁদ উঠার পর মৃতপ্রায় আত্মা যেন নতুনভাবে সজীব হয়ে উঠে। অন্যায়, দুরাচার, অলসতার জীর্ণ অপবিত্র পোষাক ঝেড়ে ফেলে সে ন্যায় ও পুণ্যের ঝলমলে পবিত্র পোষাকে সুসজ্জিত হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। অন্ধকারের কৃষ্ণগহবর থেকে প্রত্যাবর্তন করে আলোর বন্যায় মিলিত হওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠে। আল্লাহ রাববুল আলামীন সৎকর্মশীলদের জন্য এ মাসে প্রতিটি সৎকর্মের জন্য সীমাহীন পুরস্কারের ডালি সাজিয়ে রেখেছেন। এ মাসে প্রতিটি সৎ আমলের জন্য ৭০ থেকে ৭০০ গুণ বেশী ছওয়াব প্রদান করা হয় (মুসলিম)। হাদীছে কুদসীতে আল্লাহ বলেন, ‘বনী আদমের প্রতিটি সৎআমলের প্রতিদান দেয়া হয় দশ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত; তবে ছিয়াম ব্যতীত। কেননা তা কেবল আমার জন্যই রাখা হয়। তাই এর প্রতিদান আমি নিজেই দান করব’ (মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/১৯৫৯)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যখন রামাযান মাস উপস্থিত হয় তখন আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। অন্য বর্ণনায় জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয় আর শয়তানকে শৃংখলিত করা হয়। অপর বর্ণনায় এসেছে, ‘রহমতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়’ (মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/১৯৫৬)। এজন্য এ মাসে সৎআমলের দিকে বেআমল মানুষ দুর্নিবার আগ্রহ নিয়ে অগ্রসর হয়। যা তাকে পরবর্তী মাসগুলোতে আবার নতুনভাবে সৎ ও ন্যায়ের কাজে আগ্রহী করে তোলে। 
  10. ছাদাকা ও দানের হাত সম্প্রসারণ : রামাযান মাস উপস্থিত হলে রাসূল (ছাঃ) এত বেশী দান করতেন যে হাদীছের ভাষায় তা ছিল প্রবাহিত বায়ুর চেয়ে অধিক (মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/২০৯৮)। নফল ছাদাকাসহ বেশী ছওয়াব হাছিলের জন্য এ মাসেই যাকাত প্রদানের প্রবণতা মুসলিম সমাজে দেখা যায়। এছাড়া ঈদের ছালাতের পূর্বে যাকাতুল ফিৎর আদায় করাকে রাসূল (ছাঃ) প্রত্যেক মুসলমানের উপর বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন (মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/ ১৮১৫)। এভাবে মানুষের দুঃখে এগিয়ে আসা এবং আর্থিক সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শনেরও অসাধারণ প্রশিক্ষণ রামাযান মাস প্রদান করে।
  11. সামাজিক সাম্য ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি : রামাযানের সামাজিক গুরুত্ব অতীব লক্ষ্যণীয়। ছিয়াম পালনকারীকে ইফতার করানো অতি ছওয়াবের কাজ (বায়হাক্বী, সনদ ছহীহ, মিশকাত হা/১৯৯২)। তাই রামাযান মাসে ছায়েমদের ইফতার করানো মুসলিম সমাজের একটি অপরিহার্য অঙ্গ, যা সামাজিক অঙ্গনকে প্রীতিমুখর করে তোলে। সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের সুবাতাস পরিলক্ষিত হয় সারা দুনিয়া জুড়ে। মাসব্যাপী ফজরের পূর্বে ও সন্ধ্যার সময় মানুষের মাঝে একতার বিনিময়, ফিৎরা আদায়, জামা‘আতের সাথে তারাবীর ছালাত আদায় সবকিছুই সারা বছরের জন্য ব্যক্তি ও সমাজজীবনের গতিপথ নির্ধারণ করার মহান শিক্ষা দান করে। এছাড়া বিত্তশালী ও বিত্তহীন নির্বিশেষে সকলেই উপবাসব্রত পালনের ভিতর দিয়ে ক্ষুধার্তের যে যন্ত্রণা অনুভব করতে বাধ্য হয় তা দারিদ্রের যন্ত্রণা সম্পর্কে বিত্তবানদের সচেতন করে তোলে। আরাম-আয়েশ ও ভোগবিলাসে আকণ্ঠ নিমজ্জিত আত্মহারার মানবিক অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। এভাবে একই অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যে এক সমন্বিত অনুভূতির উজ্জীবন ঘটে সমাজের প্রতিটি স্তরে, তা পরস্পরের সমস্যা ও সম্ভবনাগুলোকে গুরুত্বের সাথে দেখার মানসিকতা প্রস্ত্তত করে দেয়। রামাযানের এই একটি প্রশিক্ষণই একজন মানুষকে পূর্ণতা দানের জন্য যথেষ্ট।         
  12. অন্যায়, অকল্যাণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ : ছিয়ামের মধ্যে রয়েছে ব্যক্তিজীবনকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পাপ থেকে থেকে মুক্ত করে আত্মশুদ্ধির মহাইঙ্গিত। ঘুষ, জুয়া, চোরাকারবারী, মুনাফাখোরী, প্রতারণা, জালিয়াতিতে সমাজ আজ সয়লাব। সামান্য স্বার্থে মানুষ একে অপরের জানি দুশমন হয়ে পড়ছে। তুচ্ছ কারণে খুন-খারাবী, মিথ্যাচার, অপপ্রচার ইত্যাদি সমাজ জীবনের একটি অপরিহার্য অঙ্গে যেন পরিণত হয়েছে। মানবাধিকার, আধুনিকতার চূড়ান্ত সীমানায় উত্তরণের দাবীদার হয়েও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত রাষ্ট্রগুলো গরীব রাষ্ট্রগুলোর উপর লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে বিধ্বংসী খেলায় মেতে উঠছে। এই সর্বগ্রাসী লোভ আর সমাজবিরোধী চিন্তা-চেতনার বিরুদ্ধে সামগ্রিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রশিক্ষণ দেয় রামাযান মাস। এমনকি হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, কেউ যদি ছিয়াম পালনকারীর উপর অন্যায়ভাবে মৌখিক বা শারীরিক আক্রমণ করে বসে তখনও পাল্টা আক্রমণের নির্দেশ না দিয়ে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তুমি বরং বল, আমি ছায়েম’ (মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/১৯৫৯)। অর্থাৎ আমি ছিয়াম রেখেছি। অতএব আমার উপর তোমার আক্রমণ করা যেমন শোভা পায় না, তেমনি আমারও শোভা পায় না তোমার উপর আক্রমণ করা। এভাবে শক্র-মিত্র উভয়পক্ষের দিক থেকেই সম্ভাব্য অন্যায়, অবিচারের সমস্ত পথরোধের বাস্তবসম্মত অনন্য সাধারণ প্রশিক্ষণ প্রদান- এ কেবল রামাযান মাসের পক্ষেই সম্ভব। রাসূল (ছাঃ) যথার্থই বলেছেন, الصيام جنة ‘ছিয়াম হল (কুস্বভাব, অনাচারের বিরুদ্ধে) ঢালস্বরূপ’ (মুত্তাফাক আলাইহ, ঐ)।        
  13. অসৎকাজ থেকে দূরে থাকা : কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য ইত্যাদি সকল প্রকার তাড়না থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করাই ছিয়ামের শিক্ষা। ভিতর-বাহির সমভাবে পাপমুক্ত করার মধ্য দিয়েই ছিয়ামের পূর্ণ বিকাশ লাভ করে। পাপপ্রবণতার বিরুদ্ধে মানুষের ইচ্ছাশক্তির দৃঢ়তা সৃষ্টির জন্য রামাযান যে বিজ্ঞানসম্মত প্রশিক্ষণ দান করে তা ছায়েম ব্যক্তিকে পশুপ্রবৃত্তির দিকে অগ্রসর হওয়া থেকে সুদৃঢ় ঢালের মত রক্ষা করে। একজন ছবরকারী, প্রতিরোধকারী হিসাবে স্বীয় আত্মাকে তখন সে এমন স্তরে উন্নীত করতে সক্ষম হয় যার মাধ্যমে সে স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয় এক অবস্থানে পৌঁছে যায়। তার বিবেকশক্তি হয়ে উঠে শাণিত ও প্রবল। ফলে পার্থিব জীবনের ক্ষণস্থায়ী স্থূল সুখচিন্তার কবর রচনা করে চিরস্থায়ী পারলৌকিক জীবনের প্রস্ত্ততি গ্রহণে সে উন্মুখ হয়ে ওঠে। জাহান্নামের আগুন থেকে আত্মরক্ষা করে জান্নাতের চিরন্তন প্রশান্তিময় আবাসস্থলে স্থান করে নেওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। জান্নাতের দরজায় দাড়িয়ে সেই আহবানকারীর হৃদয়স্পর্শী আহবান তার প্রাণে জাগায় ব্যাগ্র অনুভূতি - يا باغي الخير أقبل ويا باغي الشر أقصر ‘হে কল্যাণের অভিযাত্রী! অগ্রসর হও!! হে অকল্যাণের অভিসারী! ক্ষান্ত হও’। মানবের অন্তরের কৃষ্ণ কুৎসিত সবকিছুকে আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে তাতে হেদায়াতের নূর প্রজ্জ্বলন করানোর জন্যই রামাযানের আগমন। তাই রামাযান মাস পাওয়া সত্ত্বেও যারা এ মাসের এই অসাধারণ প্রভাব থেকে বঞ্চিত হল তাদের উদ্দেশ্যে কঠোর ভৎর্সনাবাণী  উচ্চারণ করে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি বাজে কথা বা বাজে আমল ছাড়তে পারল না, তার জন্য আল্লাহর প্রয়োজন নেই যে সে পানাহার থেকে বিরত থাকুক’ (বুখারী, মিশকাত হা/১৯৯৯)। রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন, ‘কত ছিয়াম পালনকারী এরূপ রয়েছে  যার ছিয়াম দ্বারা ক্ষুধা ব্যতীত আর কিছুই লাভ হয় না এবং কত রাত্রি জাগরণকারী রয়েছে যার কিয়াম কেবল রাত্রি জাগরণ ছাড়া কিছু্ই হয় না’ (আহমাদ, হাকেম, দারেমী, মিশকাত হা/২০১৪)

পরিশেষে বলব বছরের শ্রেষ্ঠ দিন যেমন আরাফার দিন, সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন যেমন জুম‘আর দিন, বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ রাত্রি যেমন লাইলাতুল ক্বদর, তেমনই বছরের সর্বোত্তম মাস হল রামাযান মাস। তাক্বওয়া, তওবা ও তিলাওয়াতের এই মাস আমাদের জন্য মেহমান স্বরূপ। যদি আমরা সঠিকভাবে এ মাসের মেহমানদারী করে থাকি, তবে সত্যি সত্যিই তা প্রশিক্ষণের মাস হিসাবে স্বার্থক হয়ে উঠবে। এ মাস আমাদের জন্য ত্রিশদিনের একটি এলাহী শিক্ষাকেন্দ্র। একটি আধ্যাত্মিক মহাবিদ্যালয়। এ মাস অপ্রকাশ্য শত্রুদের বিরুদ্ধে এক প্রবল জিহাদের ময়দান। এ মাস কল্যাণ ও পুণ্যের এক দিগন্তহীন বিশাল সমুদ্র। যার যত খুশি মণি-মুক্তা কুড়ানোর অফুরন্ত সুযোগ। ঈদুল ফিতর সেই সমুদ্রের বেলাভূমি। শাওয়ালের চাঁদ উঠার মাধ্যমে বার্ষিক প্রশিক্ষণপর্ব শেষে জান্নাতী সওগাত নিয়ে আবার যেন আমরা স্থলের জীবনে ফিরে আসি। প্রশিক্ষণার্থীদের যারা যত উত্তম সম্বল অর্জনে সক্ষম হয়েছে এ মাসে, তারা পরবর্তী এগারো মাস তার যথার্থ বাস্তবায়নে অগ্রগামীদের কাতারভুক্ত হবে। আর যারা বঞ্চিত হয়েছে তারা এই মহাসুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ব্যর্থ হবে। মূলত ইসলাম মানুষের কাছ থেকে যা কিছু কামনা করে তা বাস্তবায়নের পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা অর্জন করানোর জন্যই রামাযানের এই দীর্ঘ প্রশিক্ষণ। আর এই প্রশিক্ষণকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কার্যকর রাখার মাঝেই মানুষের সফলতা-ব্যর্থতা নিহিত। আল্লাহ রাববুল আলামীন আমাদের সকলকে এই মাসের দীর্ঘ প্রশিক্ষণে অর্জিত শিক্ষাকে পরবর্তী ১১টি মাসে বাস্তবায়ন করার তাওফীক দান করুন- আমীন!!



আরও